alt

opinion » post-editorial

‘বৈষম্যহীন বাংলায়’ দলিতদের প্রতি সীমাহীন বৈষম্য

শিপন কুমার রবিদাস

: বৃহস্পতিবার, ২৭ মার্চ ২০২৫

বর্ণবাদ হলো সেই দৃষ্টিভঙ্গি, চর্চা এবং ক্রিয়াকলাপ যেখানে বিশ্বাস করা হয় যে: মানুষ বৈজ্ঞানিকভাবেই অনেকগুলো গোষ্ঠীতে বিভক্ত এবং একই সঙ্গে বিশ্বাস করা হয় কোন কোন গোষ্ঠী অন্য গোষ্ঠীর চেয়ে নির্দিষ্ট কিছু বৈশিষ্ট্যের জন্য উঁচু অথবা নিচু; কিংবা তার ওপর কর্তৃত্ব করার অধিকারী; অথবা বেশি যোগ্য কিংবা অযোগ্য। বর্ণবাদের সঠিক সংজ্ঞা নির্ধারণ করাটা কঠিন। গবেষকদের মতে, বর্ণবাদ কখনো গায়ের চামড়ার রং দিয়ে হতে পারে, কখনো আঞ্চলিকতা দিয়ে হতে পারে, কখনো গোত্র দিয়ে হতে পারে, কখনো বর্ণ দিয়ে হতে পারে। কিছু কিছু সংজ্ঞা অনুসারে, কোনো মানুষের আচরণ যদি কখনো তার জাতি বা বর্ণ দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয়, সেটি অন্য কারো জন্য ক্ষতিকর না হলেও তাকে বর্ণবাদ বলা হবে। অন্যান্য সংজ্ঞায় শুধু বর্ণবাদ দিয়ে প্রভাবিত হয়ে শোষণ এবং অত্যাচার করাই বর্ণবাদ।

যদিও কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর ‘মানুষ জাতি’ কবিতায় বলে গেছেনÑ “কালো আর ধলো বাহিরে কেবল ভিতরে সবারই সমান রাঙা”। তবুও সাদা আর কালোতে, জাতি আর ধর্মের নানা বর্ণবাদী বৈষম্যে নিপীড়িত হয়েছেন, সহিংসতায় প্রাণ দিয়েছেন অগণিত মানুষ। আবার এই বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রামেও প্রাণ দিতে হয়েছে অগণিত মানুষকে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশেই জন্ম ও পেশাগত কারণে অস্পৃশ্যতার চর্চা ও অমানবিক আচরণের দৃষ্টান্ত অহরহ। বাংলাদেশে এই একবিংশ শতাব্দীতেও দলিত ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীরা প্রতিনিয়ত অস্পৃশ্যতার শিকার হন বৃহত্তর সমাজের কাছ থেকে। খাবারের হোটেল থেকে শুরু করে উপাসনালয়, সেলুনসহ অনেক ক্ষেত্রেই বৈষম্যের শিকার হন তারা। সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েই তাদের জীবনযাপন করতে হয়, ‘পাবলিক স্পেস’ ব্যবহারের সুযোগ তারা পাননা। এই বিচ্ছিন্নতা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং মানসিক। এই মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

জন্ম ও পেশাগত পরিচয়ের কারণে বাংলাদেশে দলিত জনগোষ্ঠীর প্রায় ৭৫ লাখ মানুষ সমাজে অস্পৃশ্যতার শিকার। দলিতরা প্রতিনিয়ত শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি, সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালন, কর্মক্ষেত্র, ব্যবসা বাণিজ্য, আবাসনÑ এমনকি মৃতদেহ সৎকারের ক্ষেত্রেও বিভিন্নভাবে বৈষম্যের শিকার হয়। যুগ যুগ ধরে দলিত জনগোষ্ঠীর ওপর চলমান যে বৈষম্য বিদ্যমান রয়েছে তা তাদের আর্থসামাজিক অবস্থা উন্নয়নের অন্যতম প্রধান অন্তরায়।

বাংলাদেশের অনেকেই জাত-পাত বৈষম্যের অস্তিত্ব অস্বীকার করেন, মানতে নারাজ। তাদের মতে, সভ্যতার এ যুগে এসে অস্পৃশ্যতা চর্চার সময় নেই। হ্যাঁ, বিষয়টি এমনটি হলে ভালোই হতো। কিন্তু বাস্তবতা পুরো উল্টো। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এখনও কিছু মানুষের রেস্টুরেন্ট, সেলুন, উপাসনালয়ে প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত। লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, রংপুরসহ অধিকাংশ জেলাতেই হরিজন গোত্রের পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের হোটেলের বাইরে থেকে খাবার নিতে দেখা যায়। থাকে তাদের জন্য আলাদা প্লেট-গ্লাস। এর চেয়ে অমানবিক আর কী হতে পারে। এ লজ্জা কার?

বর্ণবৈষম্যমূলক আচরণের সূত্র ধরে বগুড়ার সান্তাহারে মিঠুন বাঁশফোরের হাত গরম তেলে ঝলসে দেয়া, মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় হরিজন শিশুকে স্কুল থেকে বের করে দেয়া, রংপুরের গঙ্গাচড়ায় হরিজন শিশুকে খাবার হোটেল থেকে বিতাড়িত করা, দিনাজপুরের পার্বতীপুরে হরিজন শিশু শিক্ষার্থীদের ভর্তি না নেয়ার মতো ঘটনাগুলো একই সূত্রে গাথা। এরকম চলমান উদাহরণ দিয়ে শেষ করা যাবে না। বিশ্বাস না হলে যখন-তখন প্রমাণ মিলবে সরেজমিন পরিদর্শনে গেলে। বিষয়গুলো হরহামেশাই ঘটছে সারাদেশে। দেখার কেউ নেই। কোনও প্রতিকারও নেই। অঞ্চলভেদে এই বৈষম্যের তারতম্য থাকলেও কঠিন এবং কঠোর প্রতিবন্ধকতার মধ্যে দলিতদের জীবনযাপন করতে হয়। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ নির্বিশেষে সব নাগরিকের সমান অধিকারের কথা উল্লেখ করা হলেও স্বাধীনতার এত বছর পরও বৈষম্য বিরাজমান।

দেশের অনগ্রসর দলিত, হরিজন, তৃতীয় লিঙ্গসহ পিছিয়ে পড়া তথাকথিত অস্পৃশ্য নাগরিকদের প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপে আইন প্রণয়নের দাবি দীর্ঘদিনের। ‘অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর প্রতি বৈষম্য বিলোপ আইন প্রণয়নের জন্য ২০১৪ সালে বাংলাদেশ সরকারের আইন মন্ত্রণালয় “বৈষম্য বিলোপ আইন ২০১৪” খসড়া তৈরি করেছে যা এখনও চূড়ান্তভাবে আইন আকারে অনুমোদিত হয়নি। এটি কার্যকর হলে বৈষম্যের শিকার ব্যক্তি মামলা করতে পারবেন এবং সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে অবহেলিত মানুষগুলো উপকৃত হবেন। অবহেলিত জনগোষ্ঠীর প্রায় এক কোটি মানুষের অধিকার নিশ্চিত হবে। এতে বৈষম্য বিলোপ বিশেষ আদালত প্রতিষ্ঠা এবং বৈষম্য করার অপরাধে নানা দ-ের সুপারিশ রয়েছে। সুপারিশে বলা হয়, সরকার প্রতিটি জেলায় এক বা একাধিক ‘বৈষম্য বিলোপ বিশেষ আদালত’ প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শক্রমে জেলা জজ বা দায়রা জজকে এ আদালতের বিচারক নিযুক্ত করবে। অভিযোগ গঠনের তারিখ থেকে ৬০ কার্যদিবসের মধ্যে বিচারকাজ শেষ করতে হবে। এটি কার্যকর হলে বৈষম্যের শিকার ব্যক্তি ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা করার অধিকারী হবেন। খসড়া আইনে বলা আছে; ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, শারীরিক, মানুষিক ও লৈঙ্গিক প্রতিবন্ধীত্ব এবং কথিত অস্পৃশ্যতার অজুহাতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বৈষম্যমূলক কাজ শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। প্রস্তাবিত খসড়ায় অবহেলিত জনগোষ্ঠীর লোকদের সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সেবা লাভে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হলে প্রথমবার ২ বছরের কারাদ- বা ৫০ হাজার টাকা অর্থদ- বা উভয় দ- দিতে পারবেন আদালত। পরে প্রতিবারের জন্য ৫ বছরের কারাদ- বা সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকা অর্থদ- বা উভয় দ- দেয়া যাবে। শিক্ষা ও চিকিৎসা গ্রহণে বাধা; কর্মলাভে বাধা, জনস্থল, সার্বজনীন উৎসব, নিজ উপাসনালয়ে প্রবেশ ও অংশগ্রহণে বাধা প্রভৃতি শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য হবে। কিন্তু খসড়াটি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হলেও কোনো অগ্রগতি নেই। সরকারের বিভিন্ন দায়িত্বশীল ব্যক্তি আইনটি প্রণয়নে নানা সময়ে নানা কথা বললেও বাস্তবে তার কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন আইন ও সনদ বাস্তবায়নেও বৈষম্য বিলোপে আইন করাটা জরুরি। এ বিষয়ে সরকারের যথাযথ কর্তৃপক্ষকে আরও আন্তরিক হতে হবে।

বাংলাদেশের সংবিধানের ১৪, ২৭ ও ২৮ নম্বর অনুচ্ছেদে সুস্পষ্টভাবে ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো ব্যক্তির প্রতি কোনো প্রকার বৈষম্য করা যাবে না বলে উল্লেখ করা হলেও সুনির্দিষ্ট কোনো বিধি-বিধান না থাকায় ভুক্তভোগী ব্যক্তির পক্ষে আদালতের আশ্রয় গ্রহণ করা কঠিন। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ দলিত ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠী অধিকার আন্দোলন (বিডিইআরএম) ও নাগরিক উদ্যোগ এবং আরো অন্যান্য নাগরিক সংগঠন দীর্ঘদিন ধরে বৈষম্য বিলোপ আইন প্রনয়ন ও বাস্তবায়নের দাবি জানিয়ে আসছে। পরবর্তিতে এই দাবির প্রেক্ষিতে আইন কমিশন, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ও অন্যান্য নাগরিক সংগঠনের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে ‘বৈষম্য বিলোপ আইন-২০১৪’ শিরোনামে একটি খসড়া আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে দাখিল করে। আইনটির খসড়া প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় বিডিইআরএম ও নাগরিক উদ্যোগ শুরু থেকেই আইন কমিশনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করেছে।

দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে আমরা স্বপ্ন দেখেছিলাম, ওই অধিবেশনেই প্রস্তাবিত ‘বৈষম্যবিরোধী বিল’টি পাস করে বাংলাদেশের দলিত ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় সরকারের প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন হবে। কিন্তু আশার গুড়ে বালি। সংসদে কত কত বিল পাস হয়েছে, কিন্তু অধিকতর জনগুরুত্বপূর্ণ এ বিলটি আশার মুখ না দেখায় আমরা সত্যিই ব্যথিত। রাষ্ট্রের কাছে প্রশ্ন, আদৌ কি ‘বৈষম্যবিরোধী বিল’টি পাস করা হবে। অথবা সে আন্তরিকতা সংশ্লিষ্টজনদের আছে?

বাংলাদেশ ঐতিহাসিকভাবে ভাষা-সংস্কৃৃতি-পেশার বৈচিত্র্যকে ধারণ করে এবং তা স্বীকৃতি দেয়ার নজির বাহবা পাবার যোগ্যও বটে। বৈচিত্র্যের বৈভব ও বহুত্ববাদের এই দেশে সবকিছুরই ভিন্নতা পাবে এক অনন্য মর্যাদা, এমনটাই প্রত্যাশিত। আন্তর্জাতিক বর্ণবৈষম্য দিবসে আজ আমাদের সকলের অঙ্গীকার হোক দেশের সকল জাতি ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, পেশা, লিঙ্গভিত্তিক বিদ্যমান বৈষম্য বিলোপের মাধ্যমে একটি বহুত্ববাদী সমাজ গঠনে অবদান রাখার। যেখানে দেশের সকল মানুষ সমঅধিকারের ভিত্তিতে মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকবে। কণ্ঠে কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হোক: “জাতপাত নিপাত যাক, মানবতা মুক্তি পাক”।

[লেখক : সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ দলিত ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠী অধিকার আন্দোলন (বিডিইআরএম), কেন্দ্রীয় কমিটি]

নরসুন্দর পেশার গুরুত্ব ও সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন

বিভাগভিত্তিক এমপিআর নির্বাচন পদ্ধতি

প্ল্যাটফর্ম সমাজে বাংলাদেশ: জ্ঞানের ভবিষ্যৎ কার হাতে?

আনন্দবেদনার হাসপাতাল: সরকারি ও বেসরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থার বাস্তবতা

ছবি

ভিন্ন ধরনের নির্বাচন, ভিন্ন ধরনের ফল

বেসরকারি খাতে সিআইবি’র যাত্রা: ঋণ ব্যবস্থার নতুন দিগন্ত

স্বাস্থ্যসেবায় মানবিকতা প্রতিষ্ঠা হোক

ছবি

নেপালে সরকার পতন ও বামপন্থীদের ভবিষ্যৎ

ডাকসু নির্বাচন ও সংস্কারপ্রয়াস: রাজনৈতিক চিন্তার নতুন দিগন্ত

নির্বাচন কি সব সমস্যার সমাধান

জিতিয়া উৎসব

ছবি

অলির পর নেপাল কোন পথে?

রম্যগদ্য: “মরেও বাঁচবি নারে পাগলা...”

অপরিকল্পিত নগরায়ন ও শ্রীপুর পৌরসভা

ভূরিভোজ, উচ্ছেদ এবং আদিবাসী পাহাড়িয়া

অনলাইন সংস্কৃতিতে হাস্যরসের সমাজবিজ্ঞান

মামলাজট নিরসনে দেওয়ানি কার্যবিধির সংস্কার

বাস্তব মস্কো বনাম বিভ্রান্ত ইউরোপ

ছাত্রসংসদ নির্বাচন ও ভবিষ্যৎ ছাত্ররাজনীতির গতিপ্রকৃতি

সড়ক দুর্ঘটনা: কারও মৃত্যু সাধারণ, কারও মৃত্যু বিশেষ

ঐকমত্য ছাড়াও কিছু সংস্কার সম্ভব

আবার বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম : সংকটে সাধারণ মানুষ

ডায়াবেটিস রোগীর সেবা ও জনসচেতনতা

ভিন্ন ধরনের ডাকসু নির্বাচন

ডাকসু নির্বাচন : পেছনে ফেলে আসি

প্রসঙ্গ : এলডিসি তালিকা থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ

“কোপা চাটিগাঁ...”

ই-কমার্স হতে পারে প্রবৃদ্ধির ইঞ্জিন

ভারত-চীনের নতুন সমীকরণ

সাইবার যুগে মানুষের মর্যাদা ও নিরাপত্তা

ছবি

ভারত-চীন সম্পর্কে কৌশলগত উষ্ণতার সূচনা

ভারত-চীন সম্পর্কে কৌশলগত উষ্ণতার সূচনা

একজন নাগরিকের অভিমানী বিদায় ও রাষ্ট্রের নৈতিক সংকট

নিষিদ্ধ জালের অভিশাপে হুমকির মুখে সমুদ্রের জীববৈচিত্র্য

আধিপত্যবাদের শৃঙ্খল এবং পুঁজির লুন্ঠন যাদের রক্তাক্ত করে, তাদের চাই একজোটে

জার্মানি : কৃচ্ছসাধনের বোঝা জনগণের কাঁধে

tab

opinion » post-editorial

‘বৈষম্যহীন বাংলায়’ দলিতদের প্রতি সীমাহীন বৈষম্য

শিপন কুমার রবিদাস

বৃহস্পতিবার, ২৭ মার্চ ২০২৫

বর্ণবাদ হলো সেই দৃষ্টিভঙ্গি, চর্চা এবং ক্রিয়াকলাপ যেখানে বিশ্বাস করা হয় যে: মানুষ বৈজ্ঞানিকভাবেই অনেকগুলো গোষ্ঠীতে বিভক্ত এবং একই সঙ্গে বিশ্বাস করা হয় কোন কোন গোষ্ঠী অন্য গোষ্ঠীর চেয়ে নির্দিষ্ট কিছু বৈশিষ্ট্যের জন্য উঁচু অথবা নিচু; কিংবা তার ওপর কর্তৃত্ব করার অধিকারী; অথবা বেশি যোগ্য কিংবা অযোগ্য। বর্ণবাদের সঠিক সংজ্ঞা নির্ধারণ করাটা কঠিন। গবেষকদের মতে, বর্ণবাদ কখনো গায়ের চামড়ার রং দিয়ে হতে পারে, কখনো আঞ্চলিকতা দিয়ে হতে পারে, কখনো গোত্র দিয়ে হতে পারে, কখনো বর্ণ দিয়ে হতে পারে। কিছু কিছু সংজ্ঞা অনুসারে, কোনো মানুষের আচরণ যদি কখনো তার জাতি বা বর্ণ দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয়, সেটি অন্য কারো জন্য ক্ষতিকর না হলেও তাকে বর্ণবাদ বলা হবে। অন্যান্য সংজ্ঞায় শুধু বর্ণবাদ দিয়ে প্রভাবিত হয়ে শোষণ এবং অত্যাচার করাই বর্ণবাদ।

যদিও কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর ‘মানুষ জাতি’ কবিতায় বলে গেছেনÑ “কালো আর ধলো বাহিরে কেবল ভিতরে সবারই সমান রাঙা”। তবুও সাদা আর কালোতে, জাতি আর ধর্মের নানা বর্ণবাদী বৈষম্যে নিপীড়িত হয়েছেন, সহিংসতায় প্রাণ দিয়েছেন অগণিত মানুষ। আবার এই বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রামেও প্রাণ দিতে হয়েছে অগণিত মানুষকে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশেই জন্ম ও পেশাগত কারণে অস্পৃশ্যতার চর্চা ও অমানবিক আচরণের দৃষ্টান্ত অহরহ। বাংলাদেশে এই একবিংশ শতাব্দীতেও দলিত ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীরা প্রতিনিয়ত অস্পৃশ্যতার শিকার হন বৃহত্তর সমাজের কাছ থেকে। খাবারের হোটেল থেকে শুরু করে উপাসনালয়, সেলুনসহ অনেক ক্ষেত্রেই বৈষম্যের শিকার হন তারা। সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েই তাদের জীবনযাপন করতে হয়, ‘পাবলিক স্পেস’ ব্যবহারের সুযোগ তারা পাননা। এই বিচ্ছিন্নতা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং মানসিক। এই মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

জন্ম ও পেশাগত পরিচয়ের কারণে বাংলাদেশে দলিত জনগোষ্ঠীর প্রায় ৭৫ লাখ মানুষ সমাজে অস্পৃশ্যতার শিকার। দলিতরা প্রতিনিয়ত শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি, সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালন, কর্মক্ষেত্র, ব্যবসা বাণিজ্য, আবাসনÑ এমনকি মৃতদেহ সৎকারের ক্ষেত্রেও বিভিন্নভাবে বৈষম্যের শিকার হয়। যুগ যুগ ধরে দলিত জনগোষ্ঠীর ওপর চলমান যে বৈষম্য বিদ্যমান রয়েছে তা তাদের আর্থসামাজিক অবস্থা উন্নয়নের অন্যতম প্রধান অন্তরায়।

বাংলাদেশের অনেকেই জাত-পাত বৈষম্যের অস্তিত্ব অস্বীকার করেন, মানতে নারাজ। তাদের মতে, সভ্যতার এ যুগে এসে অস্পৃশ্যতা চর্চার সময় নেই। হ্যাঁ, বিষয়টি এমনটি হলে ভালোই হতো। কিন্তু বাস্তবতা পুরো উল্টো। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এখনও কিছু মানুষের রেস্টুরেন্ট, সেলুন, উপাসনালয়ে প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত। লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, রংপুরসহ অধিকাংশ জেলাতেই হরিজন গোত্রের পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের হোটেলের বাইরে থেকে খাবার নিতে দেখা যায়। থাকে তাদের জন্য আলাদা প্লেট-গ্লাস। এর চেয়ে অমানবিক আর কী হতে পারে। এ লজ্জা কার?

বর্ণবৈষম্যমূলক আচরণের সূত্র ধরে বগুড়ার সান্তাহারে মিঠুন বাঁশফোরের হাত গরম তেলে ঝলসে দেয়া, মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় হরিজন শিশুকে স্কুল থেকে বের করে দেয়া, রংপুরের গঙ্গাচড়ায় হরিজন শিশুকে খাবার হোটেল থেকে বিতাড়িত করা, দিনাজপুরের পার্বতীপুরে হরিজন শিশু শিক্ষার্থীদের ভর্তি না নেয়ার মতো ঘটনাগুলো একই সূত্রে গাথা। এরকম চলমান উদাহরণ দিয়ে শেষ করা যাবে না। বিশ্বাস না হলে যখন-তখন প্রমাণ মিলবে সরেজমিন পরিদর্শনে গেলে। বিষয়গুলো হরহামেশাই ঘটছে সারাদেশে। দেখার কেউ নেই। কোনও প্রতিকারও নেই। অঞ্চলভেদে এই বৈষম্যের তারতম্য থাকলেও কঠিন এবং কঠোর প্রতিবন্ধকতার মধ্যে দলিতদের জীবনযাপন করতে হয়। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ নির্বিশেষে সব নাগরিকের সমান অধিকারের কথা উল্লেখ করা হলেও স্বাধীনতার এত বছর পরও বৈষম্য বিরাজমান।

দেশের অনগ্রসর দলিত, হরিজন, তৃতীয় লিঙ্গসহ পিছিয়ে পড়া তথাকথিত অস্পৃশ্য নাগরিকদের প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপে আইন প্রণয়নের দাবি দীর্ঘদিনের। ‘অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর প্রতি বৈষম্য বিলোপ আইন প্রণয়নের জন্য ২০১৪ সালে বাংলাদেশ সরকারের আইন মন্ত্রণালয় “বৈষম্য বিলোপ আইন ২০১৪” খসড়া তৈরি করেছে যা এখনও চূড়ান্তভাবে আইন আকারে অনুমোদিত হয়নি। এটি কার্যকর হলে বৈষম্যের শিকার ব্যক্তি মামলা করতে পারবেন এবং সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে অবহেলিত মানুষগুলো উপকৃত হবেন। অবহেলিত জনগোষ্ঠীর প্রায় এক কোটি মানুষের অধিকার নিশ্চিত হবে। এতে বৈষম্য বিলোপ বিশেষ আদালত প্রতিষ্ঠা এবং বৈষম্য করার অপরাধে নানা দ-ের সুপারিশ রয়েছে। সুপারিশে বলা হয়, সরকার প্রতিটি জেলায় এক বা একাধিক ‘বৈষম্য বিলোপ বিশেষ আদালত’ প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শক্রমে জেলা জজ বা দায়রা জজকে এ আদালতের বিচারক নিযুক্ত করবে। অভিযোগ গঠনের তারিখ থেকে ৬০ কার্যদিবসের মধ্যে বিচারকাজ শেষ করতে হবে। এটি কার্যকর হলে বৈষম্যের শিকার ব্যক্তি ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা করার অধিকারী হবেন। খসড়া আইনে বলা আছে; ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, শারীরিক, মানুষিক ও লৈঙ্গিক প্রতিবন্ধীত্ব এবং কথিত অস্পৃশ্যতার অজুহাতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বৈষম্যমূলক কাজ শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। প্রস্তাবিত খসড়ায় অবহেলিত জনগোষ্ঠীর লোকদের সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সেবা লাভে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হলে প্রথমবার ২ বছরের কারাদ- বা ৫০ হাজার টাকা অর্থদ- বা উভয় দ- দিতে পারবেন আদালত। পরে প্রতিবারের জন্য ৫ বছরের কারাদ- বা সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকা অর্থদ- বা উভয় দ- দেয়া যাবে। শিক্ষা ও চিকিৎসা গ্রহণে বাধা; কর্মলাভে বাধা, জনস্থল, সার্বজনীন উৎসব, নিজ উপাসনালয়ে প্রবেশ ও অংশগ্রহণে বাধা প্রভৃতি শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য হবে। কিন্তু খসড়াটি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হলেও কোনো অগ্রগতি নেই। সরকারের বিভিন্ন দায়িত্বশীল ব্যক্তি আইনটি প্রণয়নে নানা সময়ে নানা কথা বললেও বাস্তবে তার কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন আইন ও সনদ বাস্তবায়নেও বৈষম্য বিলোপে আইন করাটা জরুরি। এ বিষয়ে সরকারের যথাযথ কর্তৃপক্ষকে আরও আন্তরিক হতে হবে।

বাংলাদেশের সংবিধানের ১৪, ২৭ ও ২৮ নম্বর অনুচ্ছেদে সুস্পষ্টভাবে ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো ব্যক্তির প্রতি কোনো প্রকার বৈষম্য করা যাবে না বলে উল্লেখ করা হলেও সুনির্দিষ্ট কোনো বিধি-বিধান না থাকায় ভুক্তভোগী ব্যক্তির পক্ষে আদালতের আশ্রয় গ্রহণ করা কঠিন। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ দলিত ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠী অধিকার আন্দোলন (বিডিইআরএম) ও নাগরিক উদ্যোগ এবং আরো অন্যান্য নাগরিক সংগঠন দীর্ঘদিন ধরে বৈষম্য বিলোপ আইন প্রনয়ন ও বাস্তবায়নের দাবি জানিয়ে আসছে। পরবর্তিতে এই দাবির প্রেক্ষিতে আইন কমিশন, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ও অন্যান্য নাগরিক সংগঠনের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে ‘বৈষম্য বিলোপ আইন-২০১৪’ শিরোনামে একটি খসড়া আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে দাখিল করে। আইনটির খসড়া প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় বিডিইআরএম ও নাগরিক উদ্যোগ শুরু থেকেই আইন কমিশনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করেছে।

দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে আমরা স্বপ্ন দেখেছিলাম, ওই অধিবেশনেই প্রস্তাবিত ‘বৈষম্যবিরোধী বিল’টি পাস করে বাংলাদেশের দলিত ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় সরকারের প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন হবে। কিন্তু আশার গুড়ে বালি। সংসদে কত কত বিল পাস হয়েছে, কিন্তু অধিকতর জনগুরুত্বপূর্ণ এ বিলটি আশার মুখ না দেখায় আমরা সত্যিই ব্যথিত। রাষ্ট্রের কাছে প্রশ্ন, আদৌ কি ‘বৈষম্যবিরোধী বিল’টি পাস করা হবে। অথবা সে আন্তরিকতা সংশ্লিষ্টজনদের আছে?

বাংলাদেশ ঐতিহাসিকভাবে ভাষা-সংস্কৃৃতি-পেশার বৈচিত্র্যকে ধারণ করে এবং তা স্বীকৃতি দেয়ার নজির বাহবা পাবার যোগ্যও বটে। বৈচিত্র্যের বৈভব ও বহুত্ববাদের এই দেশে সবকিছুরই ভিন্নতা পাবে এক অনন্য মর্যাদা, এমনটাই প্রত্যাশিত। আন্তর্জাতিক বর্ণবৈষম্য দিবসে আজ আমাদের সকলের অঙ্গীকার হোক দেশের সকল জাতি ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, পেশা, লিঙ্গভিত্তিক বিদ্যমান বৈষম্য বিলোপের মাধ্যমে একটি বহুত্ববাদী সমাজ গঠনে অবদান রাখার। যেখানে দেশের সকল মানুষ সমঅধিকারের ভিত্তিতে মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকবে। কণ্ঠে কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হোক: “জাতপাত নিপাত যাক, মানবতা মুক্তি পাক”।

[লেখক : সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ দলিত ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠী অধিকার আন্দোলন (বিডিইআরএম), কেন্দ্রীয় কমিটি]

back to top