অমৃত চিছাম
বাংলাদেশে প্রায় ৪০-৪৫% জনসংখ্যা কৃষির
ওপর নির্ভরশীল। এ দেশে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ বিভিন্ন ধরনের খাদ্যশস্য উৎপাদন হয়ে থাকে। বাংলাদেশের কৃষি খাত একটি বিশাল অংশ হিসেবে আমাদের অর্থনীতি ও খাদ্য নিরাপত্তার ভিত্তি হিসেবে কাজ করছে। বাংলাদেশের মোট জাতীয় উৎপাদনে কৃষির অবদান প্রায় ১৪%-১৫% (২০২৩ সালের তথ্য অনুযায়ী)। এর মধ্যে অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ ফসল হলো ধান, যা দেশের খাদ্য নিরাপত্তার প্রধান উৎস। দেশের মোট কৃষি জমির প্রায় ৭০-৭৫% ধান চাষের জন্য ব্যবহৃত হয়। দেশের মোট ধান উৎপাদন প্রায় ৩৫-৩৮ মিলিয়ন মেট্রিক টন হয়ে থাকে। সারাবিশ্বে ধান উৎপানে বাংলাদেশের অবস্থান ৩য়। বোরো ধান, যা মূলত আমন ধান নামে পরিচিত, বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান ফসল। এটি সাধারণত বৃষ্টিনির্ভর, তবে উন্নত সেচ ব্যবস্থা ব্যতীত ভালো ফলন পাওয়া খুব কঠিন। দেশে প্রতি বছর আমন
ধান (বোরো ধান) উৎপাদন হয়ে থাকে ১৩-১৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন। বাংলাদেশে প্রায় ১৮ মিলিয়ন কৃষক ধান চাষে নিয়োজিত। এর মধ্যে প্রায় ৪০%-৪৫% কৃষক সেচ ব্যবস্থার জন্য বিদ্যুৎচালিত পাম্প ব্যবহার করে থাকে। কিন্তু বর্তমানে বিদ্যুৎ-বিভ্রাট এই খাতের জন্য গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষত, পল্লীবিদ্যুৎ সংযোগের মধ্য দিয়ে যারা বোরো ধান উৎপাদন করে থাকে, সেই সব সাধারণ কৃষকদের রাতের ঘুম হারাম করার মতো একটি বিষয় হলো বিদ্যুৎ-বিভ্রাট। এই বিদ্যুৎ-বিভ্রাটের কারণে কৃষকরা কৃষি কাজে প্রয়োজনীয় সেচ সময়মতো দিতে পারেন না, ফলে ফসলের উৎপাদন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রথমেই ছোট করে জেনে নেয়ার চেষ্টা করি বিদ্যুৎ-বিভ্রাট কাকে বলে? বিদ্যুৎ-বিভ্রাট (বিদ্যুৎ বিপর্যয়) হলো এমন একটি পরিস্থিতি, যখন কোনো নির্দিষ্ট এলাকা বা অঞ্চলে সাময়িকভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। বিদ্যুৎ-বিভ্রাট বিভিন্ন ধরন হতে পারে, যেমন: বিদ্যুৎ সরবরাহের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত চাহিদা বা উৎপাদন ক্ষমতার অভাবে লোডশেডিং হয়ে থাকে, যার ফলে কৃষকদের সেচের সময় খুবই সীমিত হয়।
বোরো মৌসুমে বিদ্যুৎ সরবরাহের ঘাটতি ৫,০০০-৭,০০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত পৌঁছে, যার ফলে প্রায় ১-৩ ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিং হয়ে থাকে বিশেষ করে পল্লীবিদ্যুতের অন্তর্ভুক্ত অঞ্চলসমূহে এ হার অনেকাংশেই বেশি। এসব লোডশেডিং কৃষকদের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর, কারণ এটি সেচ পাম্পের কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা অল্প থাকায় বিদ্যুৎ-বিভ্রাট ঘটতে পারে, বিশেষত বোরো মৌসুম বা চাহিদা বেশি থাকলে। বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থার অসুবিধার কারণে বিদ্যুৎ সরবরাহে বিঘœ ঘটে। বিভিন্ন অঞ্চলে লাইনের ত্রুটি বা ভারী বৃষ্টি-বন্যার কারণে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হতে পারে। বৈরী আবহাওয়া, ঘূর্ণিঝড়, বৃষ্টিপাত, কিংবা শক্তিশালী বাতাস বিদ্যুৎ সরবরাহের বিপর্যয় ঘটাতে পারে, যা দীর্ঘ সময় ধরে বিদ্যুৎ-বিভ্রাট সৃষ্টি করে।
প্রতিদিনের সেচ কাজে বিদ্যুৎ ব্যবহৃত হয়, এবং এটি একটি নির্ভরযোগ্য সেচ ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করে। বিশেষত, বোরো ধান উৎপাদনে সেচের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।
বোরো ধান চাষের জন্য নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জমি সেচ দেয়া না হলে ফসল নষ্ট হয়ে যেতে পারে। যদি পাম্পের মাধ্যমে জল সরবরাহ না হয়, তবে ধান খেত শুকিয়ে যাবে, ফলন কমে যাবে এবং কৃষকরা ন্যায্য মুনাফা অর্জন করতে পারবেন না। বিদ্যুৎ-
বিভ্রাটের কারণে কৃষকরা অতিরিক্ত সময় ধরে বিদ্যুৎ পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন, যার ফলে সেচ কাজে বিলম্ব হয়। এতে তাদের ফসল উৎপাদন খরচও অনেকাংশে বৃদ্ধি পায়।
সেচের জন্য বিদ্যুৎ-বিভ্রাটের কারণে ডিজেলচালিত পাম্পের ব্যবহার বৃদ্ধি পায়, যা কৃষকদের জন্য অতিরিক্ত খরচ এর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ডিজেল পাম্পের জন্য কৃষকদের অতিরিক্ত খরচ প্রায় ১৫%-২০% পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। ২০২০ সালের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রায় ৪০%-৪৫% কৃষক সেচের জন্য বিদ্যুৎনির্ভর পাম্প ব্যবহার করেন। বিশেষত, আমন বা বোরো ধান চাষে পানির সরবরাহের জন্য বিদ্যুৎ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিদ্যুৎ-বিভ্রাটের কারণে সেচ কাজ ব্যাহত হলে ধান উৎপাদন ২০%-২৫% পর্যন্ত হ্রাস পায়। বিদ্যুৎ-বিভ্রাটের ফলে শুধু কৃষকরা ফসলের ক্ষতির সম্মুখীন হন না, বরং এটি দেশের জাতীয় অর্থনীতির ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এর ফলে কৃষকদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ও অর্থনৈতিক অবস্থা বিপর্যস্ত হতে পারে। ফলস্বরূপ তারা ঋণের বোঝা বা বাজারে কম দামে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হয়, যা তাদের জীবনযাত্রাকে আরও কঠিন করে তোলে। ধান উৎপাদনে ক্ষতি হলে খাদ্য উৎপাদনও বহুগুণ কমে যায়। বাংলাদেশে ধান হচ্ছে প্রধান খাদ্য এবং উৎপাদন কমলে খাদ্য নিরাপত্তার সংকট তৈরি হতে পারে, যার ফলশ্রুতিতে দারিদ্র্যতা বহুগুণ বৃদ্ধি পেতে পারে। বাংলাদেশ সরকার বিদ্যুৎ খাতের উন্নতি এবং কৃষকদের সমস্যা সমাধানে ২০২৫ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ৩৫,০০০ মেগাওয়াটে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। বিদ্যুৎ-বিভ্রাটের কারণে কৃষি খাতের ক্ষতি কমানোর জন্য আরও বেশ কিছু কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে সরকার। এর মধ্যে ২০২৫ সালের মধ্যে ৫,০০০ মেগাওয়াট সৌরশক্তি উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ। এরই মধ্যে কৃষকদের জন্য সৌর পাম্পব্যবস্থা প্রদান করা হচ্ছে। সৌর সেচ পাম্পের মাধ্যমে কৃষকদের সেচের জন্য বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী সমাধান প্রদান করা হচ্ছে। এক পরিসংখ্যান হতে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রায় ৪০,০০০ কৃষক সৌর সেচ পাম্প ব্যবহার করছেন। ২০২৩ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সৌর পাম্পের ব্যবহার প্রায় ৫%-৬% বৃদ্ধি পেয়েছে। তাছাড়া সরকার সৌরশক্তির ব্যবহার বৃদ্ধির লক্ষ্যে ২০ লাখ সৌর পাম্প বিতরণ করার লক্ষ্যমাত্রা গ্রহণ করেছে, যাতে কৃষকদের বিদ্যুৎ-বিভ্রাটের সমস্যা অনেকাংশে হ্রাস করা যায়। বিদ্যুৎ-বিভ্রাটের কারণে সেচ ব্যবস্থার সমস্যা আরও প্রকট হয়। এর সমাধানে কিছু বিকল্প সেচব্যবস্থা চিন্তা করা যেতে পারে। যেমন-
ড্রিপ সেচ ব্যবস্থা : এটি একটি পানি সাশ্রয়ী সেচপদ্ধতি যা বিদ্যুৎ-বিভ্রাটের সময়ে কার্যকর হতে পারে। ড্রিপ সেচব্যবস্থায় পানির সরবরাহ খুবই সুনির্দিষ্ট এবং কার্যকরী, যা বিদ্যুৎ-বিভ্রাটের প্রভাবকে কমিয়ে আনে।
স্প্রিঙ্কলার সেচ ব্যবস্থা : এই পদ্ধতিতে পানি সমানভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারে, যা বড় আকারে জমির সেচে ব্যবহৃত হয়। এই পদ্ধতির মাধ্যমে বিদ্যুৎ ব্যবহারের প্রয়োজন
কম হয়।
বৃষ্টির পানি সংগ্রহ : বর্ষাকালে বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করে সেটি সেচের কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে। এটি বিদ্যুৎ-বিভ্রাটের ক্ষেত্রে একটি টেকসই এবং সাশ্রয়ী সমাধান হতে পারে।
এনার্জি-এফিসিয়েন্ট সেচ পাম্প : বিদ্যুৎ খরচ কমানোর জন্য এনার্জি-এফিসিয়েন্ট সেচ পাম্প ব্যবহারের প্রচলন করা যেতে পারে। এই পাম্পগুলো কম বিদ্যুৎ ব্যবহার করে বেশি কার্যক্ষমতা প্রদান করে।
স্মার্ট গ্রিড প্রযুক্তি : স্মার্ট গ্রিড প্রযুক্তি বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনাকে আরও কার্যকরী করতে সাহায্য করতে পারে। এটি বিদ্যুৎ বিতরণে স্বচ্ছতা এবং দক্ষতা বাড়ায়, এবং বিদ্যুৎ-বিভ্রাটের ঝুঁকি কমায়।
স্থায়ী কৃষিব্যবস্থা : সেচব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে কৃষকরা স্থায়ী কৃষি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন, যেমন অনাবাদি ভূমিতে চাষ করার জন্য নির্ভরযোগ্য পানির উৎস ব্যবহার করা।
সেচ পাম্পের জন্য ঋণ সুবিধা : কৃষকদের সহজ শর্তে সেচ পাম্প কেনার জন্য ঋণ প্রদান করা যেতে পারে, যাতে তারা প্রযুক্তি ব্যবহার করে উৎপাদন বৃদ্ধি করতে পারেন।
বিদ্যুৎ ভর্তুকি : সেচব্যবস্থার জন্য বিদ্যুৎ খরচের উপর ভর্তুকি প্রদান করা যেতে
পারে, যাতে বিদ্যুৎ-বিভ্রাটের সময়ে কৃষকরা সহজে সেচ চালিয়ে যেতে পারেন।
বিদ্যুৎ-বিভ্রাট সমস্যা সমাধানে সরকারকে আরও কার্যকর নীতিমালা প্রণয়ন করতে
হবে। যেমন-
কৃষি খাতে বিদ্যুৎ সংযোগ ও নেটওয়ার্ক উন্নয়ন : বিদ্যুৎ সংযোগের উন্নতি এবং সেচ ব্যবস্থার জন্য নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। সরকারের মাধ্যমে দক্ষ বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
কৃষি প্রযুক্তির উন্নয়ন : বিদ্যুৎ ব্যবহার কমিয়ে কৃষি উৎপাদন বাড়াতে কৃষি
প্রযুক্তির উন্নয়ন ও উদ্ভাবন করতে হবে। এগ্রো-ইনফরমেটিক্স : কৃষকদের মধ্যে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ও অ্যাপ ব্যবহারের মাধ্যমে সেচের সময় এবং অন্যান্য কৃষি কাজের জন্য পরামর্শ প্রদান করা যেতে পারে।
শক্তির দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য অডিট : বিদ্যুৎ ব্যবহারের জন্য কৃষকদের শক্তি দক্ষতার প্রশিক্ষণ
ও অডিটের ব্যবস্থা করা যেতে পারে, যাতে তারা বিদ্যুৎ ব্যবহার আরও দক্ষভাবে করতে
পারেন।
নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার : সৌরশক্তি বা বায়ুশক্তির মতো নবায়নযোগ্য শক্তির মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যেতে পারে। সৌর প্যানেল ব্যবহার করে সেচ পাম্প চালানোর মাধ্যমে কৃষকরা বিদ্যুৎ-বিভ্রাটের প্রভাব থেকে বাঁচতে পারেন। বিদ্যুৎ-বিভ্রাট বাংলাদেশের কৃষি খাত, বিশেষত বোরো ধান উৎপাদনে একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেচের জন্য বিদ্যুৎনির্ভর পাম্প ব্যবহারের কারণে যখন বিদ্যুৎ-বিভ্রাট ঘটে, তখন কৃষকরা সময়মতো সেচ দিতে পারছেন না, যার ফলস্বরূপ ফসলের উৎপাদন বহুলাংশে কমে যায় এবং একইসঙ্গে অর্থনৈতিক অনেক ক্ষতি হয়।
এই সমস্যার সমাধানের জন্য সেচ ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ, নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার, এবং বিদ্যুৎ খাতে সংস্কার প্রয়োজন। শুধু সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও কার্যকর পদক্ষেপের মাধ্যমে কৃষি খাতে বিদ্যুৎ-বিভ্রাটের প্রভাব কমানো সম্ভব, যা দেশের খাদ্য নিরাপত্তা এবং কৃষকদের আর্থিক উন্নতির জন্য অপরিহার্য। সরকার এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো যদি দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করে, তবেই দেশের কৃষি খাতকে এই সমস্যা থেকে মুক্ত করা সম্ভব। সর্বোপরি বিদ্যুৎ-বিভ্রাট হ্রাস করা সম্ভব হলে একটি সুখী, সমৃদ্ধ, সোনার বাংলাদেশ বিনির্মাণে কার্যকর ভূমিকা পালন করবে এটাই সবার প্রত্যাশা।
[লেখক : শিক্ষার্থী, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ^বিদ্যালয়]
অমৃত চিছাম
বৃহস্পতিবার, ১০ এপ্রিল ২০২৫
বাংলাদেশে প্রায় ৪০-৪৫% জনসংখ্যা কৃষির
ওপর নির্ভরশীল। এ দেশে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ বিভিন্ন ধরনের খাদ্যশস্য উৎপাদন হয়ে থাকে। বাংলাদেশের কৃষি খাত একটি বিশাল অংশ হিসেবে আমাদের অর্থনীতি ও খাদ্য নিরাপত্তার ভিত্তি হিসেবে কাজ করছে। বাংলাদেশের মোট জাতীয় উৎপাদনে কৃষির অবদান প্রায় ১৪%-১৫% (২০২৩ সালের তথ্য অনুযায়ী)। এর মধ্যে অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ ফসল হলো ধান, যা দেশের খাদ্য নিরাপত্তার প্রধান উৎস। দেশের মোট কৃষি জমির প্রায় ৭০-৭৫% ধান চাষের জন্য ব্যবহৃত হয়। দেশের মোট ধান উৎপাদন প্রায় ৩৫-৩৮ মিলিয়ন মেট্রিক টন হয়ে থাকে। সারাবিশ্বে ধান উৎপানে বাংলাদেশের অবস্থান ৩য়। বোরো ধান, যা মূলত আমন ধান নামে পরিচিত, বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান ফসল। এটি সাধারণত বৃষ্টিনির্ভর, তবে উন্নত সেচ ব্যবস্থা ব্যতীত ভালো ফলন পাওয়া খুব কঠিন। দেশে প্রতি বছর আমন
ধান (বোরো ধান) উৎপাদন হয়ে থাকে ১৩-১৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন। বাংলাদেশে প্রায় ১৮ মিলিয়ন কৃষক ধান চাষে নিয়োজিত। এর মধ্যে প্রায় ৪০%-৪৫% কৃষক সেচ ব্যবস্থার জন্য বিদ্যুৎচালিত পাম্প ব্যবহার করে থাকে। কিন্তু বর্তমানে বিদ্যুৎ-বিভ্রাট এই খাতের জন্য গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষত, পল্লীবিদ্যুৎ সংযোগের মধ্য দিয়ে যারা বোরো ধান উৎপাদন করে থাকে, সেই সব সাধারণ কৃষকদের রাতের ঘুম হারাম করার মতো একটি বিষয় হলো বিদ্যুৎ-বিভ্রাট। এই বিদ্যুৎ-বিভ্রাটের কারণে কৃষকরা কৃষি কাজে প্রয়োজনীয় সেচ সময়মতো দিতে পারেন না, ফলে ফসলের উৎপাদন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রথমেই ছোট করে জেনে নেয়ার চেষ্টা করি বিদ্যুৎ-বিভ্রাট কাকে বলে? বিদ্যুৎ-বিভ্রাট (বিদ্যুৎ বিপর্যয়) হলো এমন একটি পরিস্থিতি, যখন কোনো নির্দিষ্ট এলাকা বা অঞ্চলে সাময়িকভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। বিদ্যুৎ-বিভ্রাট বিভিন্ন ধরন হতে পারে, যেমন: বিদ্যুৎ সরবরাহের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত চাহিদা বা উৎপাদন ক্ষমতার অভাবে লোডশেডিং হয়ে থাকে, যার ফলে কৃষকদের সেচের সময় খুবই সীমিত হয়।
বোরো মৌসুমে বিদ্যুৎ সরবরাহের ঘাটতি ৫,০০০-৭,০০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত পৌঁছে, যার ফলে প্রায় ১-৩ ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিং হয়ে থাকে বিশেষ করে পল্লীবিদ্যুতের অন্তর্ভুক্ত অঞ্চলসমূহে এ হার অনেকাংশেই বেশি। এসব লোডশেডিং কৃষকদের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর, কারণ এটি সেচ পাম্পের কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা অল্প থাকায় বিদ্যুৎ-বিভ্রাট ঘটতে পারে, বিশেষত বোরো মৌসুম বা চাহিদা বেশি থাকলে। বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থার অসুবিধার কারণে বিদ্যুৎ সরবরাহে বিঘœ ঘটে। বিভিন্ন অঞ্চলে লাইনের ত্রুটি বা ভারী বৃষ্টি-বন্যার কারণে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হতে পারে। বৈরী আবহাওয়া, ঘূর্ণিঝড়, বৃষ্টিপাত, কিংবা শক্তিশালী বাতাস বিদ্যুৎ সরবরাহের বিপর্যয় ঘটাতে পারে, যা দীর্ঘ সময় ধরে বিদ্যুৎ-বিভ্রাট সৃষ্টি করে।
প্রতিদিনের সেচ কাজে বিদ্যুৎ ব্যবহৃত হয়, এবং এটি একটি নির্ভরযোগ্য সেচ ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করে। বিশেষত, বোরো ধান উৎপাদনে সেচের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।
বোরো ধান চাষের জন্য নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জমি সেচ দেয়া না হলে ফসল নষ্ট হয়ে যেতে পারে। যদি পাম্পের মাধ্যমে জল সরবরাহ না হয়, তবে ধান খেত শুকিয়ে যাবে, ফলন কমে যাবে এবং কৃষকরা ন্যায্য মুনাফা অর্জন করতে পারবেন না। বিদ্যুৎ-
বিভ্রাটের কারণে কৃষকরা অতিরিক্ত সময় ধরে বিদ্যুৎ পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন, যার ফলে সেচ কাজে বিলম্ব হয়। এতে তাদের ফসল উৎপাদন খরচও অনেকাংশে বৃদ্ধি পায়।
সেচের জন্য বিদ্যুৎ-বিভ্রাটের কারণে ডিজেলচালিত পাম্পের ব্যবহার বৃদ্ধি পায়, যা কৃষকদের জন্য অতিরিক্ত খরচ এর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ডিজেল পাম্পের জন্য কৃষকদের অতিরিক্ত খরচ প্রায় ১৫%-২০% পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। ২০২০ সালের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রায় ৪০%-৪৫% কৃষক সেচের জন্য বিদ্যুৎনির্ভর পাম্প ব্যবহার করেন। বিশেষত, আমন বা বোরো ধান চাষে পানির সরবরাহের জন্য বিদ্যুৎ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিদ্যুৎ-বিভ্রাটের কারণে সেচ কাজ ব্যাহত হলে ধান উৎপাদন ২০%-২৫% পর্যন্ত হ্রাস পায়। বিদ্যুৎ-বিভ্রাটের ফলে শুধু কৃষকরা ফসলের ক্ষতির সম্মুখীন হন না, বরং এটি দেশের জাতীয় অর্থনীতির ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এর ফলে কৃষকদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ও অর্থনৈতিক অবস্থা বিপর্যস্ত হতে পারে। ফলস্বরূপ তারা ঋণের বোঝা বা বাজারে কম দামে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হয়, যা তাদের জীবনযাত্রাকে আরও কঠিন করে তোলে। ধান উৎপাদনে ক্ষতি হলে খাদ্য উৎপাদনও বহুগুণ কমে যায়। বাংলাদেশে ধান হচ্ছে প্রধান খাদ্য এবং উৎপাদন কমলে খাদ্য নিরাপত্তার সংকট তৈরি হতে পারে, যার ফলশ্রুতিতে দারিদ্র্যতা বহুগুণ বৃদ্ধি পেতে পারে। বাংলাদেশ সরকার বিদ্যুৎ খাতের উন্নতি এবং কৃষকদের সমস্যা সমাধানে ২০২৫ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ৩৫,০০০ মেগাওয়াটে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। বিদ্যুৎ-বিভ্রাটের কারণে কৃষি খাতের ক্ষতি কমানোর জন্য আরও বেশ কিছু কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে সরকার। এর মধ্যে ২০২৫ সালের মধ্যে ৫,০০০ মেগাওয়াট সৌরশক্তি উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ। এরই মধ্যে কৃষকদের জন্য সৌর পাম্পব্যবস্থা প্রদান করা হচ্ছে। সৌর সেচ পাম্পের মাধ্যমে কৃষকদের সেচের জন্য বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী সমাধান প্রদান করা হচ্ছে। এক পরিসংখ্যান হতে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রায় ৪০,০০০ কৃষক সৌর সেচ পাম্প ব্যবহার করছেন। ২০২৩ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সৌর পাম্পের ব্যবহার প্রায় ৫%-৬% বৃদ্ধি পেয়েছে। তাছাড়া সরকার সৌরশক্তির ব্যবহার বৃদ্ধির লক্ষ্যে ২০ লাখ সৌর পাম্প বিতরণ করার লক্ষ্যমাত্রা গ্রহণ করেছে, যাতে কৃষকদের বিদ্যুৎ-বিভ্রাটের সমস্যা অনেকাংশে হ্রাস করা যায়। বিদ্যুৎ-বিভ্রাটের কারণে সেচ ব্যবস্থার সমস্যা আরও প্রকট হয়। এর সমাধানে কিছু বিকল্প সেচব্যবস্থা চিন্তা করা যেতে পারে। যেমন-
ড্রিপ সেচ ব্যবস্থা : এটি একটি পানি সাশ্রয়ী সেচপদ্ধতি যা বিদ্যুৎ-বিভ্রাটের সময়ে কার্যকর হতে পারে। ড্রিপ সেচব্যবস্থায় পানির সরবরাহ খুবই সুনির্দিষ্ট এবং কার্যকরী, যা বিদ্যুৎ-বিভ্রাটের প্রভাবকে কমিয়ে আনে।
স্প্রিঙ্কলার সেচ ব্যবস্থা : এই পদ্ধতিতে পানি সমানভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারে, যা বড় আকারে জমির সেচে ব্যবহৃত হয়। এই পদ্ধতির মাধ্যমে বিদ্যুৎ ব্যবহারের প্রয়োজন
কম হয়।
বৃষ্টির পানি সংগ্রহ : বর্ষাকালে বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করে সেটি সেচের কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে। এটি বিদ্যুৎ-বিভ্রাটের ক্ষেত্রে একটি টেকসই এবং সাশ্রয়ী সমাধান হতে পারে।
এনার্জি-এফিসিয়েন্ট সেচ পাম্প : বিদ্যুৎ খরচ কমানোর জন্য এনার্জি-এফিসিয়েন্ট সেচ পাম্প ব্যবহারের প্রচলন করা যেতে পারে। এই পাম্পগুলো কম বিদ্যুৎ ব্যবহার করে বেশি কার্যক্ষমতা প্রদান করে।
স্মার্ট গ্রিড প্রযুক্তি : স্মার্ট গ্রিড প্রযুক্তি বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনাকে আরও কার্যকরী করতে সাহায্য করতে পারে। এটি বিদ্যুৎ বিতরণে স্বচ্ছতা এবং দক্ষতা বাড়ায়, এবং বিদ্যুৎ-বিভ্রাটের ঝুঁকি কমায়।
স্থায়ী কৃষিব্যবস্থা : সেচব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে কৃষকরা স্থায়ী কৃষি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন, যেমন অনাবাদি ভূমিতে চাষ করার জন্য নির্ভরযোগ্য পানির উৎস ব্যবহার করা।
সেচ পাম্পের জন্য ঋণ সুবিধা : কৃষকদের সহজ শর্তে সেচ পাম্প কেনার জন্য ঋণ প্রদান করা যেতে পারে, যাতে তারা প্রযুক্তি ব্যবহার করে উৎপাদন বৃদ্ধি করতে পারেন।
বিদ্যুৎ ভর্তুকি : সেচব্যবস্থার জন্য বিদ্যুৎ খরচের উপর ভর্তুকি প্রদান করা যেতে
পারে, যাতে বিদ্যুৎ-বিভ্রাটের সময়ে কৃষকরা সহজে সেচ চালিয়ে যেতে পারেন।
বিদ্যুৎ-বিভ্রাট সমস্যা সমাধানে সরকারকে আরও কার্যকর নীতিমালা প্রণয়ন করতে
হবে। যেমন-
কৃষি খাতে বিদ্যুৎ সংযোগ ও নেটওয়ার্ক উন্নয়ন : বিদ্যুৎ সংযোগের উন্নতি এবং সেচ ব্যবস্থার জন্য নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। সরকারের মাধ্যমে দক্ষ বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
কৃষি প্রযুক্তির উন্নয়ন : বিদ্যুৎ ব্যবহার কমিয়ে কৃষি উৎপাদন বাড়াতে কৃষি
প্রযুক্তির উন্নয়ন ও উদ্ভাবন করতে হবে। এগ্রো-ইনফরমেটিক্স : কৃষকদের মধ্যে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ও অ্যাপ ব্যবহারের মাধ্যমে সেচের সময় এবং অন্যান্য কৃষি কাজের জন্য পরামর্শ প্রদান করা যেতে পারে।
শক্তির দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য অডিট : বিদ্যুৎ ব্যবহারের জন্য কৃষকদের শক্তি দক্ষতার প্রশিক্ষণ
ও অডিটের ব্যবস্থা করা যেতে পারে, যাতে তারা বিদ্যুৎ ব্যবহার আরও দক্ষভাবে করতে
পারেন।
নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার : সৌরশক্তি বা বায়ুশক্তির মতো নবায়নযোগ্য শক্তির মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যেতে পারে। সৌর প্যানেল ব্যবহার করে সেচ পাম্প চালানোর মাধ্যমে কৃষকরা বিদ্যুৎ-বিভ্রাটের প্রভাব থেকে বাঁচতে পারেন। বিদ্যুৎ-বিভ্রাট বাংলাদেশের কৃষি খাত, বিশেষত বোরো ধান উৎপাদনে একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেচের জন্য বিদ্যুৎনির্ভর পাম্প ব্যবহারের কারণে যখন বিদ্যুৎ-বিভ্রাট ঘটে, তখন কৃষকরা সময়মতো সেচ দিতে পারছেন না, যার ফলস্বরূপ ফসলের উৎপাদন বহুলাংশে কমে যায় এবং একইসঙ্গে অর্থনৈতিক অনেক ক্ষতি হয়।
এই সমস্যার সমাধানের জন্য সেচ ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ, নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার, এবং বিদ্যুৎ খাতে সংস্কার প্রয়োজন। শুধু সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও কার্যকর পদক্ষেপের মাধ্যমে কৃষি খাতে বিদ্যুৎ-বিভ্রাটের প্রভাব কমানো সম্ভব, যা দেশের খাদ্য নিরাপত্তা এবং কৃষকদের আর্থিক উন্নতির জন্য অপরিহার্য। সরকার এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো যদি দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করে, তবেই দেশের কৃষি খাতকে এই সমস্যা থেকে মুক্ত করা সম্ভব। সর্বোপরি বিদ্যুৎ-বিভ্রাট হ্রাস করা সম্ভব হলে একটি সুখী, সমৃদ্ধ, সোনার বাংলাদেশ বিনির্মাণে কার্যকর ভূমিকা পালন করবে এটাই সবার প্রত্যাশা।
[লেখক : শিক্ষার্থী, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ^বিদ্যালয়]