গৌতম রায়
ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়ে কোনো অনুরাগী-অনুগামী মোহাম্মদ সেলিমের ছবি সংযুক্ত একটি ব্যানার বা ফ্লেক্স কোথাও টাঙিয়েছেন। আর সেটা নিয়েই সমাজমাধ্যমে এখন কেউ কেউ বিপ্লব করতে চাইছেন! তারা দেখাতে চাইছেন, রাজনৈতিকভাবে নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ তরিকার সঙ্গে সংযুক্ত রাখা সেলিম আসলে ধর্মনিরপেক্ষ নন। তিনি যেহেতু ইসলাম ধর্মাবলম্বী জন্মসূত্রে, তাই তার ব্যক্তিজীবনে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম ঘিরে কোনোরকম আকর্ষণ থাকুক বা নাই থাকুক, সেসব বিচার বিশ্লেষণে কিছু লোক যেতে রাজি নয়। ঘটনাচক্রে তারা জন্মসূত্রে হিন্দু।
সেলিমের জীবন সংগ্রামকে রাজনৈতিক চোখে দেখতে এরা রাজি নয়। দেখতে চায় যেহেতু তিনি জন্মসূত্রে মুসলমান, তাই তিনি ঈদ ঘিরে মুসলমানদের শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন। আসলে তিনি ধর্মনিরপেক্ষতার মুখোশ পরে থাকা একজন মুসলমান। এটা প্রমাণ করতেই এখন ভারতের ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক শক্তি আর প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িক শক্তি এবং প্রগতিশীল বলে নিজেদের জাহির করা এক ধরনের দেখনদার, স্বঘোষিত প্রগতিশীল, বামপন্থী বলে নিজেদর দাবি করা লোক তাদের মধ্যেÑ ‘আগে কে বা প্রাণ করিবেক দান, তারি লাগি কাড়াকাড়ি’ পড়ে গেছে।
সমাজ মাধ্যমে শারদ উৎসব ঘিরে সেলিমের হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বাঙালিকে শুভেচ্ছা জানানো, দীপাবলির আলোর উৎসবে মানুষকে শুভেচ্ছা জানানো, গুরুনানক জয়ন্তীতে গুরু নানকের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন, রঙের উৎসব, বসন্ত উৎসব ঘিরে আপামর বাঙালিকে তার শুভেচ্ছা জানানোÑ এ সমস্ত কিছুই এইসব অতি প্রগতিশীল, সমালোচকদের চোখে পড়ে না। তারা একবারের জন্য এটা উল্লেখ করেন না যে, অন্নদাশঙ্কর রায়ের মতো মানুষের জন্মদিন ঘিরে সেলিমের শ্রদ্ধা জ্ঞাপন। সমরেশ বসুর জন্মশতবর্ষের শুরুর দিন, সমরেশের হাত বদল হয়ে যাওয়া নৈহাটির বাড়িতে গিয়ে সেলিমের শ্রদ্ধা জ্ঞাপন। তারা দেখেন না রামকৃষ্ণ মিশনের পঞ্চদশ অধ্যক্ষ, যাকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, গায়ের জোরে ‘গুরুজী’ সম্বোধন করতেন, সেই স্বামী আত্মানন্দের প্রয়াণের পর, বেলুড় মঠে গিয়ে তার শ্রদ্ধা জ্ঞাপন। আত্মস্থানন্দের উত্তরসূরি স্বামী স্মরণানন্দ অসুস্থ হলে, রামকৃষ্ণ মিশন সেবা প্রতিষ্ঠানকে গিয়ে তাকে দেখে আসাÑ এসব কোনো কিছুই এই লোকেদের নজরে পড়ে না। নজরে পড়ে কেবলমাত্র কোথায় কোন অনুরাগী ঈদ উপলক্ষে সেলিমের ছবি সম্বলিত ফ্লেক্স দিয়েছে। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখা হয়Ñ সেলিম নাকি জুমার নামাজের দিন কোনো সভা সমিতিতে যান না। এমনকি কোনো নির্বাচনী জনসভায় তার পৌঁছতে দেরি হলে, সমাজ মাধ্যমে একাংশের লোক লিখতে শুরু করে; মাগরিব বা এশার নামাজ আদায়ের কারণে, এই দেরি হয়েছে!
আসলে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে বিজেপি যাতে রাজনৈতিক ইস্যুর বাইরে নিয়ে গিয়ে, হিন্দু-মুসলমানে পর্যবসিত করতে পারে- তার জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চেষ্টার ত্রুটি নেই। গোটা পশ্চিমবঙ্গজুড়ে এখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার এবং দলের সীমাহীন দুর্নীতির জেরে চাকরিহারা মানুষদের হাহাকার। তার বাইরে চরম বেকারত্ব তো আছেই। বিগত ১৪ বছর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শাসনকালে পশ্চিমবঙ্গে নতুন কোনো শিল্প হওয়া তো দূরের কথা, মাঝারি এবং ছোট যে সমস্ত শিল্প গুলি ছিল, যার জেরে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে কিছু মানুষ, কায়িক শ্রমের বিনিময়ে পেটের ভাত জোগাড় করতে পারতেন, সেই সব শিল্পগুলো আজ ইতিহাস। মাঝারি এবং ছোট শিল্পগুলোর ওপর তৃণমূল দলের সব স্তরের নেতাদের যে ধরনের তোলাবাজি তাতে এই ধরনের অল্প পুঁজির শিল্প আর পশ্চিমবঙ্গের টিকে থাকতে পারছে না।
অপরপক্ষে কার্যত গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন নরেন্দ্র মোদির সুবিধে করে দেওয়ার জন্য সিঙ্গুরে আন্দোলনের নামে অরাজকতার মধ্যে দিয়ে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেভাবে টাটা গোষ্ঠীকে পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া করে গুজরাটে সানন্দে স্থিত করেন, তার জেরে নতুন কোনো বড় শিল্প পশ্চিমবঙ্গে আসছে না। এমনকি মোদির ছত্রছায়ায় থাকা আদানি- আম্বানিরা পশ্চিমবঙ্গে এসে মমতার নানা ধরনের বাণিজ্য সম্মেলনে অংশ নিচ্ছেন। মমতার সঙ্গে রাজ্য প্রশাসনের সদর দপ্তর নবান্নে দেখা করছেন; কিন্তু এই রাজ্যের বুকে বড় কোনো শিল্প স্থাপনের ব্যাপারে আজ পর্যন্ত তাদের মধ্যে থেকে কোনো ধরনের ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায়নি।
ওয়াকফ আইন সংশোধন ঘিরে সংসদের উভয়কক্ষে আলোচনার সময় তৃণমূল কংগ্রেসের একাধিক সংসদ সদস্য উপস্থিত থাকেননি। আইনটির বিপক্ষে ভোট দেননি। ভারতীয় সংসদের প্রচলিত আইন অনুযায়ী তাহলে প্রশ্ন ওঠে, তৃণমূল কংগ্রেস, তার দলের সমস্ত সাংসদদের মোশানটির বিপক্ষে ভোট দেওয়ার জন্য নির্দেশ জারি কি করেনি? যদি নির্দেশ জারি না করে থাকে, তাহলে বুঝতে হবে, এই আইনটিকে ঘিরে তৃণমূল কংগ্রেসের মধ্যে, বিজেপির সঙ্গে একটা লুকোচুরির খেলা আছে।
আর যদি নির্দেশ, যাকে সংসদীয় ভাষায় হুইপ বলা হয়, তা জারি করা হয়ে থাকে, আর তার দলের কয়েকজন সাংসদ সেটিকে অমান্য করে ভোটদানে বিরত থাকে, অনুপস্থিত থাকেÑ তাহলে সেই সব সাংসদদের বিরুদ্ধে কি আইন অনুযায়ী তৃণমূল কংগ্রেস কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে?
এ থেকে কিন্তু খুব পরিষ্কার ভাবে বুঝতে পারা যায়, ওয়াকফ সংশোধনী আইনের মধ্যে দিয়ে ভারতবর্ষের সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত যে মত প্রকাশের স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা, তাকে অমান্য করে, আরএসএসের উদ্দেশ্য যে রাজনৈতিক হিন্দু রাষ্ট্র স্থাপন, সেই উদ্দেশ্যকে ফলপ্রসূ করবার লক্ষ্যে, কেন্দ্রীয় সরকারের পরিচালক বিজেপির যে অভিসন্ধি, সেই অভিসন্ধির প্রতি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তার দল তৃণমূল কংগ্রেসের প্রচ্ছন্ন সমর্থন আছে।
মমতা কিন্তু একটি বারের জন্যেও সংসদে এই ওয়াকফ সংশোধনী আইন ঘিরে ভোট দান পর্বে লোকসভা বা রাজ্যসভা উভয় জায়গাতেই কেন তার দলের কয়েকজন সংসদ অনুপস্থিত থাকলেন- এ সম্পর্কে একটি শব্দ খরচ করেননি।
কিভাবে পশ্চিমবঙ্গে আরএসএসের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপিকে জায়গা করে দেওয়ার জন্য মমতা একেবারে আত্মনিবেদিত, তা বুঝতে পারা যায় ওয়াকফ আইন ঘিরে নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে তার ডাকা সভার অব্যবহিত পরে পৃথক একটি সভা মমতার করবার ভিতর দিয়ে।
এই সভা তিনি করলেন দীঘার কাছে জগন্নাথ মন্দিরের উদ্বোধন ঘিরে। এ কার্যক্রমের মধ্যে দিয়েই বুঝতে পারা যায়, রাজ্যের চরম বেকারত্ব, শিল্প সংকট, তার দলের সর্বস্তরের সীমাহীন দুর্নীতি, ভেঙে পড়া স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। ভেঙে পড়া শিক্ষা ব্যবস্থাÑ এই সমস্ত কিছু থেকে মানুষের দৃষ্টিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য, ঠিক কেন্দ্রীয় সরকার-নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহের আদলে মমতার কাছে একমাত্র সমাধান হয়ে দাঁড়িয়েছে হিন্দু-মুসলমান। ওয়াকাফ নিয়ে মিটিং করতে গিয়ে তিনি এমন ব্যক্তিত্বদের সেখানে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন যাদের সঙ্গে ওয়াকফ ঘিরে কোনো সম্পর্ক থাকার কথা নয়। ছবিতে দেখতে পাওয়া গেছে, বৈষ্ণবদের যে গলায় তুলসীর মালা পড়বার রেওয়াজ রয়েছে, সেই রকম তুলসীর মালা পরা মানুষজন ইমাম-মুয়াজ্জিনদের জন্য ডাকা সভায় উপস্থিত। ইমাম-মুয়াজ্জিনদের ভেতরে কখনো কোনো মহিলা থাকে না। অথচ মমতার ডাকা মিটিংয়ে দর্শক আসনে একাধিক মহিলাকে দেখতে পাওয়া গেছে। বহু অল্প বয়স্ক ছেলেদের দেখা গেছে যারা সাধারণ শার্ট প্যান্ট পড়ে এই সভায় গেছে।
নতুন ওয়াকফ আইন ঘিরে গোটা ভারত যখন উত্তাল, পশ্চিমবঙ্গে একদিকে আন্দোলন। একদিকে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা। তিনজন মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। পুলিশের অপদার্থতা বলে শেষ করতে পারা যায় না। এইরকম একটি পরিস্থিতিতে কেন দীঘার জগন্নাথ মন্দির ঘিরে এত অতি তৎপরতা দেখাচ্ছেন মমতা? জগন্নাথ মন্দির তো দীঘার কোনো প্রাচীন বৈশিষ্ট্য নয়। মমতা পাশের রাজ্য উড়িষ্যার সঙ্গে ধর্ম ঘিরে টক্কর দিয়ে নিজেকে ‘অতি হিন্দু’ প্রমাণ করবার উদগ্র বাসনায় দীঘায় এই জগন্নাথ মন্দির করছেন। মন্দির মসজিদের রাজনীতি ব্যতীত মমতার যে কোনো রকম রাজনৈতিক সম্বল নেই, এই জগন্নাথ মন্দির দীঘাতে করার মধ্যে দিয়ে সেটা আবারও মমতা প্রমাণ করলেন।
কোটি কোটি টাকা রাজকোষ থেকে খরচ করে কেন একটি বিশেষ ধর্মের মন্দির মসজিদ তৈরি করা? রাজকোষ থেকে এভাবে কোনো রকমের টাকা খরচের সংস্থান ভারতের সংবিধানে নেই। অথচ মমতা একের পর এক কেবল সংবিধান বিরোধীই নয়, মানবতাবিরোধী এই ধরনের কাজ করে যাচ্ছেন। যে রাজ্যে কোনো নতুন শিল্প সংস্থা নেই। যে রাজ্যের মানুষ পেটের তাগিদে ভিন রাজ্যে পাড়ি দিতে বাধ্য হচ্ছে। বহু ক্ষেত্রে কেবলমাত্র লাশ হয়ে ফিরে আসছে সেই সব মানুষেরা। সেই রাজ্যের দরকার আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা এবং তার সুষ্ঠু পরিচালনা। ছোট-বড় মাঝারি সমস্ত ধরনের শিল্পের সুষ্ঠু বিকাশ। যার মধ্যে দিয়ে নতুন প্রজন্মের মানুষ বেকারত্বের জ্বালা থেকে মুক্ত হতে পারে। এই রাজ্যে দরকার সুষ্ঠু স্বাস্থ্যব্যবস্থা। সাধারণ মানুষ, গরিব মানুষ যাতে সঠিকভাবে চিকিৎসা পায়। চিকিৎসা ব্যবস্থাটাকে যেভাবে মমতার সৌজন্যে একেবারে বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে, সেই জায়গা থেকে বের হয়ে আসার জন্য দরকার সুস্থ স্বাভাবিক একটা সরকারি পরিকল্পনা।
এ সমস্ত কিছু না করে রাজকোষের টাকা দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে দীঘায় জগন্নাথ মন্দির। পশ্চিমবঙ্গে কি জগন্নাথ মন্দিরের অভাব আছে? তাহলে কেন এভাবে রাজ্যের প্রধান প্রশাসক তিনি একটি বিশেষ ধর্মের মন্দির স্থাপনাকে কেন্দ্র করে নিজেকে এবং গোটা প্রশাসনকে যুক্ত করবেন? ভারতের স্বাধীনতার পর সোমনাথ মন্দিরের পুনঃনির্মাণ ঘিরে বল্লভভাই প্যাটেল যে ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতির আশ্রয় নিয়েছিলেন, পন্ডিত জওহরলাল নেহরু ছিলেন তার কঠিন-কঠোর সমালোচক। দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্রপ্রসাদ, সেই পুনঃনির্মিত সোমনাথ মন্দিরের উদ্বোধন করা মনস্থ করলে, পন্ডিত নেহরু, তীব্র ভাষায় লিখিতভাবে রাষ্ট্রপতিকে সমালোচনা করেছিলেন।
কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে গোটা ভারত চলছে। সেই সঙ্গে মমতার নেতৃত্বে পশ্চিমবঙ্গেও একাংশের লোক মোদির সেই চটিতে পা গলিয়েছে। নিজের মতো করে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে গোটা পশ্চিমবঙ্গকে সাম্প্রদায়িকতার হিন্দুত্বের নতুন গবেষণাগারে রূপান্তরিত করবার জন্য নিজেকে নিয়োজিত করেছে। পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘু মুসলমানদের যে বেঁচে থাকার জায়গাটাই আজ একটা বড় রকমের সংকটের মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছে, সেই বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থিরা এবং কিছু অংশে কংগ্রেস ছাড়া আর কারো কোনো ভাবনাচিন্তা নেই।
[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]
গৌতম রায়
শনিবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৫
ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়ে কোনো অনুরাগী-অনুগামী মোহাম্মদ সেলিমের ছবি সংযুক্ত একটি ব্যানার বা ফ্লেক্স কোথাও টাঙিয়েছেন। আর সেটা নিয়েই সমাজমাধ্যমে এখন কেউ কেউ বিপ্লব করতে চাইছেন! তারা দেখাতে চাইছেন, রাজনৈতিকভাবে নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ তরিকার সঙ্গে সংযুক্ত রাখা সেলিম আসলে ধর্মনিরপেক্ষ নন। তিনি যেহেতু ইসলাম ধর্মাবলম্বী জন্মসূত্রে, তাই তার ব্যক্তিজীবনে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম ঘিরে কোনোরকম আকর্ষণ থাকুক বা নাই থাকুক, সেসব বিচার বিশ্লেষণে কিছু লোক যেতে রাজি নয়। ঘটনাচক্রে তারা জন্মসূত্রে হিন্দু।
সেলিমের জীবন সংগ্রামকে রাজনৈতিক চোখে দেখতে এরা রাজি নয়। দেখতে চায় যেহেতু তিনি জন্মসূত্রে মুসলমান, তাই তিনি ঈদ ঘিরে মুসলমানদের শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন। আসলে তিনি ধর্মনিরপেক্ষতার মুখোশ পরে থাকা একজন মুসলমান। এটা প্রমাণ করতেই এখন ভারতের ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক শক্তি আর প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িক শক্তি এবং প্রগতিশীল বলে নিজেদের জাহির করা এক ধরনের দেখনদার, স্বঘোষিত প্রগতিশীল, বামপন্থী বলে নিজেদর দাবি করা লোক তাদের মধ্যেÑ ‘আগে কে বা প্রাণ করিবেক দান, তারি লাগি কাড়াকাড়ি’ পড়ে গেছে।
সমাজ মাধ্যমে শারদ উৎসব ঘিরে সেলিমের হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বাঙালিকে শুভেচ্ছা জানানো, দীপাবলির আলোর উৎসবে মানুষকে শুভেচ্ছা জানানো, গুরুনানক জয়ন্তীতে গুরু নানকের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন, রঙের উৎসব, বসন্ত উৎসব ঘিরে আপামর বাঙালিকে তার শুভেচ্ছা জানানোÑ এ সমস্ত কিছুই এইসব অতি প্রগতিশীল, সমালোচকদের চোখে পড়ে না। তারা একবারের জন্য এটা উল্লেখ করেন না যে, অন্নদাশঙ্কর রায়ের মতো মানুষের জন্মদিন ঘিরে সেলিমের শ্রদ্ধা জ্ঞাপন। সমরেশ বসুর জন্মশতবর্ষের শুরুর দিন, সমরেশের হাত বদল হয়ে যাওয়া নৈহাটির বাড়িতে গিয়ে সেলিমের শ্রদ্ধা জ্ঞাপন। তারা দেখেন না রামকৃষ্ণ মিশনের পঞ্চদশ অধ্যক্ষ, যাকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, গায়ের জোরে ‘গুরুজী’ সম্বোধন করতেন, সেই স্বামী আত্মানন্দের প্রয়াণের পর, বেলুড় মঠে গিয়ে তার শ্রদ্ধা জ্ঞাপন। আত্মস্থানন্দের উত্তরসূরি স্বামী স্মরণানন্দ অসুস্থ হলে, রামকৃষ্ণ মিশন সেবা প্রতিষ্ঠানকে গিয়ে তাকে দেখে আসাÑ এসব কোনো কিছুই এই লোকেদের নজরে পড়ে না। নজরে পড়ে কেবলমাত্র কোথায় কোন অনুরাগী ঈদ উপলক্ষে সেলিমের ছবি সম্বলিত ফ্লেক্স দিয়েছে। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখা হয়Ñ সেলিম নাকি জুমার নামাজের দিন কোনো সভা সমিতিতে যান না। এমনকি কোনো নির্বাচনী জনসভায় তার পৌঁছতে দেরি হলে, সমাজ মাধ্যমে একাংশের লোক লিখতে শুরু করে; মাগরিব বা এশার নামাজ আদায়ের কারণে, এই দেরি হয়েছে!
আসলে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে বিজেপি যাতে রাজনৈতিক ইস্যুর বাইরে নিয়ে গিয়ে, হিন্দু-মুসলমানে পর্যবসিত করতে পারে- তার জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চেষ্টার ত্রুটি নেই। গোটা পশ্চিমবঙ্গজুড়ে এখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার এবং দলের সীমাহীন দুর্নীতির জেরে চাকরিহারা মানুষদের হাহাকার। তার বাইরে চরম বেকারত্ব তো আছেই। বিগত ১৪ বছর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শাসনকালে পশ্চিমবঙ্গে নতুন কোনো শিল্প হওয়া তো দূরের কথা, মাঝারি এবং ছোট যে সমস্ত শিল্প গুলি ছিল, যার জেরে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে কিছু মানুষ, কায়িক শ্রমের বিনিময়ে পেটের ভাত জোগাড় করতে পারতেন, সেই সব শিল্পগুলো আজ ইতিহাস। মাঝারি এবং ছোট শিল্পগুলোর ওপর তৃণমূল দলের সব স্তরের নেতাদের যে ধরনের তোলাবাজি তাতে এই ধরনের অল্প পুঁজির শিল্প আর পশ্চিমবঙ্গের টিকে থাকতে পারছে না।
অপরপক্ষে কার্যত গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন নরেন্দ্র মোদির সুবিধে করে দেওয়ার জন্য সিঙ্গুরে আন্দোলনের নামে অরাজকতার মধ্যে দিয়ে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেভাবে টাটা গোষ্ঠীকে পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া করে গুজরাটে সানন্দে স্থিত করেন, তার জেরে নতুন কোনো বড় শিল্প পশ্চিমবঙ্গে আসছে না। এমনকি মোদির ছত্রছায়ায় থাকা আদানি- আম্বানিরা পশ্চিমবঙ্গে এসে মমতার নানা ধরনের বাণিজ্য সম্মেলনে অংশ নিচ্ছেন। মমতার সঙ্গে রাজ্য প্রশাসনের সদর দপ্তর নবান্নে দেখা করছেন; কিন্তু এই রাজ্যের বুকে বড় কোনো শিল্প স্থাপনের ব্যাপারে আজ পর্যন্ত তাদের মধ্যে থেকে কোনো ধরনের ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায়নি।
ওয়াকফ আইন সংশোধন ঘিরে সংসদের উভয়কক্ষে আলোচনার সময় তৃণমূল কংগ্রেসের একাধিক সংসদ সদস্য উপস্থিত থাকেননি। আইনটির বিপক্ষে ভোট দেননি। ভারতীয় সংসদের প্রচলিত আইন অনুযায়ী তাহলে প্রশ্ন ওঠে, তৃণমূল কংগ্রেস, তার দলের সমস্ত সাংসদদের মোশানটির বিপক্ষে ভোট দেওয়ার জন্য নির্দেশ জারি কি করেনি? যদি নির্দেশ জারি না করে থাকে, তাহলে বুঝতে হবে, এই আইনটিকে ঘিরে তৃণমূল কংগ্রেসের মধ্যে, বিজেপির সঙ্গে একটা লুকোচুরির খেলা আছে।
আর যদি নির্দেশ, যাকে সংসদীয় ভাষায় হুইপ বলা হয়, তা জারি করা হয়ে থাকে, আর তার দলের কয়েকজন সাংসদ সেটিকে অমান্য করে ভোটদানে বিরত থাকে, অনুপস্থিত থাকেÑ তাহলে সেই সব সাংসদদের বিরুদ্ধে কি আইন অনুযায়ী তৃণমূল কংগ্রেস কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে?
এ থেকে কিন্তু খুব পরিষ্কার ভাবে বুঝতে পারা যায়, ওয়াকফ সংশোধনী আইনের মধ্যে দিয়ে ভারতবর্ষের সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত যে মত প্রকাশের স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা, তাকে অমান্য করে, আরএসএসের উদ্দেশ্য যে রাজনৈতিক হিন্দু রাষ্ট্র স্থাপন, সেই উদ্দেশ্যকে ফলপ্রসূ করবার লক্ষ্যে, কেন্দ্রীয় সরকারের পরিচালক বিজেপির যে অভিসন্ধি, সেই অভিসন্ধির প্রতি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তার দল তৃণমূল কংগ্রেসের প্রচ্ছন্ন সমর্থন আছে।
মমতা কিন্তু একটি বারের জন্যেও সংসদে এই ওয়াকফ সংশোধনী আইন ঘিরে ভোট দান পর্বে লোকসভা বা রাজ্যসভা উভয় জায়গাতেই কেন তার দলের কয়েকজন সংসদ অনুপস্থিত থাকলেন- এ সম্পর্কে একটি শব্দ খরচ করেননি।
কিভাবে পশ্চিমবঙ্গে আরএসএসের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপিকে জায়গা করে দেওয়ার জন্য মমতা একেবারে আত্মনিবেদিত, তা বুঝতে পারা যায় ওয়াকফ আইন ঘিরে নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে তার ডাকা সভার অব্যবহিত পরে পৃথক একটি সভা মমতার করবার ভিতর দিয়ে।
এই সভা তিনি করলেন দীঘার কাছে জগন্নাথ মন্দিরের উদ্বোধন ঘিরে। এ কার্যক্রমের মধ্যে দিয়েই বুঝতে পারা যায়, রাজ্যের চরম বেকারত্ব, শিল্প সংকট, তার দলের সর্বস্তরের সীমাহীন দুর্নীতি, ভেঙে পড়া স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। ভেঙে পড়া শিক্ষা ব্যবস্থাÑ এই সমস্ত কিছু থেকে মানুষের দৃষ্টিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য, ঠিক কেন্দ্রীয় সরকার-নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহের আদলে মমতার কাছে একমাত্র সমাধান হয়ে দাঁড়িয়েছে হিন্দু-মুসলমান। ওয়াকাফ নিয়ে মিটিং করতে গিয়ে তিনি এমন ব্যক্তিত্বদের সেখানে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন যাদের সঙ্গে ওয়াকফ ঘিরে কোনো সম্পর্ক থাকার কথা নয়। ছবিতে দেখতে পাওয়া গেছে, বৈষ্ণবদের যে গলায় তুলসীর মালা পড়বার রেওয়াজ রয়েছে, সেই রকম তুলসীর মালা পরা মানুষজন ইমাম-মুয়াজ্জিনদের জন্য ডাকা সভায় উপস্থিত। ইমাম-মুয়াজ্জিনদের ভেতরে কখনো কোনো মহিলা থাকে না। অথচ মমতার ডাকা মিটিংয়ে দর্শক আসনে একাধিক মহিলাকে দেখতে পাওয়া গেছে। বহু অল্প বয়স্ক ছেলেদের দেখা গেছে যারা সাধারণ শার্ট প্যান্ট পড়ে এই সভায় গেছে।
নতুন ওয়াকফ আইন ঘিরে গোটা ভারত যখন উত্তাল, পশ্চিমবঙ্গে একদিকে আন্দোলন। একদিকে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা। তিনজন মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। পুলিশের অপদার্থতা বলে শেষ করতে পারা যায় না। এইরকম একটি পরিস্থিতিতে কেন দীঘার জগন্নাথ মন্দির ঘিরে এত অতি তৎপরতা দেখাচ্ছেন মমতা? জগন্নাথ মন্দির তো দীঘার কোনো প্রাচীন বৈশিষ্ট্য নয়। মমতা পাশের রাজ্য উড়িষ্যার সঙ্গে ধর্ম ঘিরে টক্কর দিয়ে নিজেকে ‘অতি হিন্দু’ প্রমাণ করবার উদগ্র বাসনায় দীঘায় এই জগন্নাথ মন্দির করছেন। মন্দির মসজিদের রাজনীতি ব্যতীত মমতার যে কোনো রকম রাজনৈতিক সম্বল নেই, এই জগন্নাথ মন্দির দীঘাতে করার মধ্যে দিয়ে সেটা আবারও মমতা প্রমাণ করলেন।
কোটি কোটি টাকা রাজকোষ থেকে খরচ করে কেন একটি বিশেষ ধর্মের মন্দির মসজিদ তৈরি করা? রাজকোষ থেকে এভাবে কোনো রকমের টাকা খরচের সংস্থান ভারতের সংবিধানে নেই। অথচ মমতা একের পর এক কেবল সংবিধান বিরোধীই নয়, মানবতাবিরোধী এই ধরনের কাজ করে যাচ্ছেন। যে রাজ্যে কোনো নতুন শিল্প সংস্থা নেই। যে রাজ্যের মানুষ পেটের তাগিদে ভিন রাজ্যে পাড়ি দিতে বাধ্য হচ্ছে। বহু ক্ষেত্রে কেবলমাত্র লাশ হয়ে ফিরে আসছে সেই সব মানুষেরা। সেই রাজ্যের দরকার আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা এবং তার সুষ্ঠু পরিচালনা। ছোট-বড় মাঝারি সমস্ত ধরনের শিল্পের সুষ্ঠু বিকাশ। যার মধ্যে দিয়ে নতুন প্রজন্মের মানুষ বেকারত্বের জ্বালা থেকে মুক্ত হতে পারে। এই রাজ্যে দরকার সুষ্ঠু স্বাস্থ্যব্যবস্থা। সাধারণ মানুষ, গরিব মানুষ যাতে সঠিকভাবে চিকিৎসা পায়। চিকিৎসা ব্যবস্থাটাকে যেভাবে মমতার সৌজন্যে একেবারে বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে, সেই জায়গা থেকে বের হয়ে আসার জন্য দরকার সুস্থ স্বাভাবিক একটা সরকারি পরিকল্পনা।
এ সমস্ত কিছু না করে রাজকোষের টাকা দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে দীঘায় জগন্নাথ মন্দির। পশ্চিমবঙ্গে কি জগন্নাথ মন্দিরের অভাব আছে? তাহলে কেন এভাবে রাজ্যের প্রধান প্রশাসক তিনি একটি বিশেষ ধর্মের মন্দির স্থাপনাকে কেন্দ্র করে নিজেকে এবং গোটা প্রশাসনকে যুক্ত করবেন? ভারতের স্বাধীনতার পর সোমনাথ মন্দিরের পুনঃনির্মাণ ঘিরে বল্লভভাই প্যাটেল যে ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতির আশ্রয় নিয়েছিলেন, পন্ডিত জওহরলাল নেহরু ছিলেন তার কঠিন-কঠোর সমালোচক। দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্রপ্রসাদ, সেই পুনঃনির্মিত সোমনাথ মন্দিরের উদ্বোধন করা মনস্থ করলে, পন্ডিত নেহরু, তীব্র ভাষায় লিখিতভাবে রাষ্ট্রপতিকে সমালোচনা করেছিলেন।
কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে গোটা ভারত চলছে। সেই সঙ্গে মমতার নেতৃত্বে পশ্চিমবঙ্গেও একাংশের লোক মোদির সেই চটিতে পা গলিয়েছে। নিজের মতো করে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে গোটা পশ্চিমবঙ্গকে সাম্প্রদায়িকতার হিন্দুত্বের নতুন গবেষণাগারে রূপান্তরিত করবার জন্য নিজেকে নিয়োজিত করেছে। পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘু মুসলমানদের যে বেঁচে থাকার জায়গাটাই আজ একটা বড় রকমের সংকটের মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছে, সেই বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থিরা এবং কিছু অংশে কংগ্রেস ছাড়া আর কারো কোনো ভাবনাচিন্তা নেই।
[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]