আনোয়ারুল হক
জুলাই অভ্যুত্থানের পরে বাংলাদেশে তরুণ নেতৃত্বে একটি নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টি নামে আত্মপ্রকাশ করেছে। নতুন দল গঠনের প্রক্রিয়ার সময়েই বলা হয়েছিল দলটি মধ্যপন্থি রাজনীতি করবে এবং সাম্য, ন্যায়বিচার, সুশাসন এই দলের অঙ্গীকার। তবে নতুন দলের নেতৃত্বে নানা মত-পথের এমনকি সম্পূর্ণ বিপরীত মতাদর্শের তরুণরাও রয়েছেন।
দলটির সংগঠকদের গত বছর জুলাই-অগাস্ট থেকেই মানুষ দেখছে। ইতোমধ্যে তাদের অনেকে এমন অনেক ঘটনায় সম্পৃক্ত হয়েছেন যেগুলো মধ্যপন্থার চেতনার সাথে যায় না। আবার এই দলের সামনের সারিতে আমরা যাদের দেখছি তার বাইরেও অনেক আধুনিক মনষ্ক, রাজনৈতিক জ্ঞানের গভীরতা সম্পন্ন চৌকস তরুণ-তরুণীরা আছেন যাদের বুদ্ধিদীপ্তভাবে বর্তমানের অস্থির সময়ের প্রতিকূলতাকে মোকাবেলা করার যোগ্যতা রয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত তাদের ঘোষিত কোন কর্মসূচি নেই। একেক নেতা একেক সুরে তাদের নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের ব্যাখ্যা দিচ্ছেন।
একটি বিষয়ে তাদের সবার সুর মোটামুটি একই। সেটি হচ্ছে বাংলাদেশের সংবিধান বাতিল করতে হবে। সংবিধানের প্রতি বাংলাদেশের সব শাসকদেরই ‘ভক্তি’ আমরা দেখেছি। শাসকদের নিজ পছন্দ মত চলতে সংবিধান বাধা হয়ে দাঁড়ালেই তারা সংবিধান সংশোধনের জন্য তৎপর হয়ে ওঠেন। তাইতো মুজিব আমলে প্রনীত সংবিধানে মাত্র ২ বছরের মাথায় মুজিবই সংশোধনী আনেন। এবং পরবর্তীতেও সকল শাসকেরা যার যার সুবিধামতো সংবিধান সংশোধন করেছেন। এবার আর সংশোধনী নয়। তারা চান বাতিল। কেন? সংবিধানের মূল নীতি সমূহ তাদের পছন্দ নয়।
প্রধান আপত্তি ধর্ম নিরপেক্ষতা নিয়ে। নতুন দলের এবং সংবিধান সংস্কার কমিটির যুক্তিতে মিল রয়েছে। সংস্কার কমিটির প্রধান আলী রিয়াজ পশ্চিমা দুনিয়ার নাগরিক। তিনি মনে করেন, গণতন্ত্র ও বহুত্ববাদের মধ্যেই ধর্ম নিরপেক্ষতা বিদ্যমান। তাত্ত্বিক অর্থে হয়তোবা কথা ঠিক; কিন্তু আমাদের উপমহাদেশের বাস্তবতায় সেই কলকাতার দাংগা বা নোয়াখালীর দাঙ্গা থেকে শুরু করে দেশ বিভাগের আগে পরে ভারত পাকিস্তান উভয় অংশে দাঙ্গার যে বীভৎসতা হয়েছে এবং তৎপরবর্তীতে আজ অবধি এই যে ৫ আগস্টের পরিবর্তনের সাথে সাথে মন্দির মাজার হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান আক্রান্ত হলো, বিশেষ করে হঠাৎ করে উগ্র মৌলবাদী উত্থানের চেহারা দেখে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মনস্তত্ত্বাতিক জগতে যে অসহায়ত্ব জন্ম নিলো সে সব বিবেচনায় নিলে রাষ্ট্রের ধর্ম নিরপেক্ষ চরিত্র দালিলিকভাবে লিপিবদ্ধ থাকা জরুরী। তা না হলে ধর্মীয় সংখ্যালঘু এমনকি উদারমনা মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের নিরাপত্তা এ দেশে বারবার বিঘিœত হবে। তাতে তার কি যায় আসে। তিনি তো আর এ দেশে থাকবেন না!
ধর্মীয় গোত্রীয় বিভাজন ও বিরোধের অভিশাপ থেকে সমাজ ও রাষ্ট্রকে স্থিতিশীল ও নিরাপদ রাখার জন্য কোরআনের নির্দেশনা হলো- ‘তোমাদের বিশ্বাস তোমাদের, আমাদের ধর্ম আমাদের’। (সুরা : আল কাফিরুন, আয়াত : ৭)। কোরআনের এই নির্দেশনা তো রাষ্ট্রের ধর্ম নিরপেক্ষ থাকার পক্ষে। ধর্মের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি একটি মারাত্মক ব্যাধি। পবিত্র কোরআনের নির্দেশনা হল, ‘... তোমরা তোমাদের দ্বীনের মধ্যে বাড়াবাড়ি করো না। ’ (সুরা নিসা, আয়াত : ১৭১)। ধর্মীয় বাড়াবাড়ির এই ব্যাধি থেকে মুসলমান, হিন্দু বা অন্যান্য ধর্মাবলম্বী, বিশ্বাসী, অবিশ্বাসী, সংস্কারবাদী, সংশয়বাদী, রক্ষণশীল সবাইকে মুক্ত রাখতেই ধর্মনিরপেক্ষতা সংবিধানে দালিলিকভাবে উল্লেখ থাকা প্রয়োজন। বহুত্ববাদকে নিশ্চিত করার জন্যই ধর্ম নিরপেক্ষতা প্রয়োজন।
ভূ-রাজনৈতিক কারণেও প্রয়োজন। হিন্দুত্ববাদী মোদি সরকার ভারতবর্ষের সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বাতিল করতে চায়। তার জন্য আঁটসাঁটবেধে সবকিছু গুছিয়ে ফেলেছিলেন মোদি; কিন্তু ভারতবর্ষের অসাম্প্রদায়িক, গনতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল ও শক্তিসমূহ জোট বেঁধে গত লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি ও তার মিত্রদের পার্লামেন্টে দুই-তৃতীয়াংশ আসন পাওয়া থেকে অনেকটাই দূরে রাখতে পেরেছে। বাংলাদেশে এ অঘটন ঘটালে ভারতবর্ষের হিন্দুত্ববাদীদের উষ্কে দেয়া হবে; এবং সেখান থেকেও ধর্মনিরপেক্ষতাকে যদি মুছে ফেলে দেওয়া হয় এবং ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ তিন দেশই যদি ধর্মীয় উগ্রবাদের নিশান তুলে দাঁড়ায় কি চেহারাটা হবে এই উপমহাদেশের?
আমরা তো সেই শৈশব থেকে পড়ে এসেছি হজরত মোহাম্মদ (সা.) বিদায় হজের ঐতিহাসিক তাৎপর্যময় ভাষণে, সবাইকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন- ‘সাবধান! ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি কোরো না। এ বাড়াবাড়ির ফলে তোমাদের আগে অনেক জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে। ’ আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে, এ উপমহাদেশকে ধর্মীয় উগ্রবাদের বিপদ থেকে রক্ষা করতে, এ অঞ্চলের ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের মানুষকে সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ রাখতে, ভিন্ন ভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীর স্বকীয়তা, বৈচিত্র্য অক্ষুণ্ব রাখতে সকল রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ, আলেম সমাজ, ভিন্ন ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ধর্মগুরু সবাইকেই ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ির বিপরীতে ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে অবস্থান নিতে হবে। আর এ প্রশ্নে সবাইকে এক রাখার জাতীয় দায়িত্ব পালনে তো সবার আগে এগিয়ে আসা উচিত এবারের গনঅভ্যুত্থানে বিজয়ী তরুণদের। তাহলেই না মানুষ ভরসা করতে পারবে যে পথ হারাবে না বাংলাদেশ। অর্ধ শতাব্দীরও অধিককাল যাবত যা সংবিধানে মূল নীতি হিসাবে আছে তা বাতিল করতে চাইলে সমাজে অহেতুক অস্থিরতা ও অশান্তি সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে, যা সামাল দেয়া কঠিন হবে।
প্রাসঙ্গিক মনে হওয়ায় আমাদের প্রতিবেশী দেশের কিছু ঘটনার উল্লেখ করতে চাই। ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি পরপর তিনবার গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। ২০০২ সালে গোধরা স্টেশনে ট্রেনে আগুন লাগানোর ঘটনাকে কেন্দ্র করে গুজরাটে ব্যাপক সাম্প্রদায়িক সহিংসতার সৃষ্টি হয়। তার রাজ্য সরকারের নির্লিপ্ততার ফলে ১,০০০ জনেরও অধিক সংখ্যালঘু মুসলিম নিহত হন। মোদি ‘গুজরাটের কসাই’ হিসাবে ‘খ্যাতি’ অর্জন করেন। সে কারণে বহু ধর্ম, বহু জাতির, বহু সংস্কৃতির বৈচিত্র্যময় ভারতবর্ষে প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী হিসাবে মোদির গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ ছিলো। তারপরেও বিজেপি নেতৃত্ব মোদির ক্যারিশমাটিক নেতৃত্বের উপর ভরসা রেখে ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে তার নেতৃত্বে লড়াই করে ১৯৮৪ সালের পর প্রথমবারের মতো একক দল হিসাবে লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে।
নির্বাচনী প্রচার অভিযান থেকেই মোদি আওয়াজ তুললেন ‘সবকা সাথ্ সবকা বিকাশ’। অর্থাৎ বিজয়ী হলে ধর্ম বর্ণ জাত পাত নির্বিশেষে সকলের অগ্রগতির জন্য তার সরকার কাজ করবে। তার আওয়াজ জনমনে ছাপ ফেলে; কিন্তু মোদি খুবই চাতুরতার সাথে অতি ধীরে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ তথা আরএসএসের হিন্দুত্ববাদী নীতিকে অগ্রাধিকার দিয়ে তার পরিকল্পনা সাজাতে শুরু করেন। বাবরি মসজিদের স্থানে মন্দির নির্মাণ ও ঘটা করে সরকারিভাবে তার উদ্বোধন, ধর্মের ভিত্তিতে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন তথা সিএএ, ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদের অধীনে জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যকে প্রদত্ত বিশেষ মর্যাদা বাতিল, অতি সম্প্রতি মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মীয় সম্পত্তি নিয়ন্ত্রণের মত স্পর্শকাতর বিষয় ওয়াকফ আইনে পরিবর্তন আনা এবং এ ধরনের অসংখ্য ছোট বড় ঘটনার মাধ্যমে আমাদের চেনা জানা ভারতবর্ষ অনেকটাই পাল্টে গেছে।
লোকসভা নির্বাচনে মোদি নিজ দলকে মধ্যপন্থী দল হিসেবে আখ্যায়িত করে মুসলিম নেতৃবৃন্দকে পাশে রেখে বলতেন ‘সবহি ধরাম সমান হ্যায়, সবহি লোগ মেরে হ্যায়।’ আজ কোথায় সেই মধ্যপন্থা, কোথায় সব ধর্ম সমান-এর গল্প? সাম্প্রদায়িক মেরুকরণকে মোদি এবং তার দল সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। ‘সব কা সাথ সবকা বিকাশের’ আড়ালে স্বাধীন ভারতের যা যা অর্জন বিশেষত ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রই আজ আরএসএস-বিজেপির শাসনে বিপন্ন।
মোদি এবং ভারতীয় জনতা পার্টির উদাহরণ নিশ্চয়ই আমাদের নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টির ক্ষেত্রে প্রয়োজ্য নয়। তারপরেও উদাহরণটি বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন এ কারণে যে, তরুণ নেতৃত্বের একটা উল্লেখযোগ্য অংশের ছাত্র রাজনীতিতে হাতেখড়ি অনেকটা আরএসএস মার্কা ইসলামী মৌলবাদী ছাত্র সংগঠনের হাত ধরে। পরবর্তীতে তারা ঐ সংগঠন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ‘ছাত্র শক্তি’ নামক সংগঠন গড়ে তোলেন। প্রাথমিক সংগঠনের মৌলবাদী রাজনীতির প্রভাব তাদের মনোজগতে আছে বা ‘যার ছায়া পড়েছে তাদের মনেরও আয়নাতে’। তাই তো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, লাখো লাখো শহীদের আত্মদান, ধর্ষিতা নারীদের আর্তনাদ, মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম...’, ‘যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে...’ ‘I, Major Ziaur Rahman, on behalf of our great leader Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman, hereby declare that the independent People’s Republic of Bangladesh has been established... ’। বিপ্লবী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীনের প্রথম ঘোষণা- ‘যুদ্ধক্ষেত্রাস্তীর্ণ ধ্বংসাবশেষের মধ্য দিয়ে, ধূলি-কাদা আর রক্তের ছাপ মুছে এক নতুন দেশ জন্ম নিলো,’ স্বাধীন বাংলা বেতারের ‘জয় বাংলা বাংলার জয়/ হবে হবে হবে, হবে নিশ্চয়’, শোন একটি মজিবরের কন্ঠ স্বরের ধ্বনি প্রতিধ্বনি’- এসব কিছু কোটি কোটি বাঙালির মনে যে আবেগ অনুভূতির সঞ্চার করে তা তাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে না।
তাই তো ’২৪-এর এক মাসের ছাত্র-গণআন্দোলনকে তারা মুক্তিযুদ্ধ বা স্বাধীনতা যুদ্ধের সাথে গুলিয়ে ফেলে মুক্তিযুদ্ধের বিশাল ক্যানভাসটাকে খাটো করতে চায়। আশঙ্কা জাগে ধর্ম নিরপেক্ষতাকে উঠিয়ে দিয়ে পাশের দেশের হিন্দুত্ববাদের অনুকরণে ধীরে ধীরে বাংলাদেশটাকে আবার পাকিস্তানি ধারায় তথাকথিত ইসলামীকরণের দিকে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা কাজ করছে কিনা। তাই যদি না হবে তবে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নামকরণ কি এমন অপরাধ করলো! স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের এক পটভূমিতেই তো অমঙ্গলকে দূর করে মঙ্গলের আহ্বান জানিয়ে শোভাযাত্রার নামকরণ হয় ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’; যা ইউনেস্কো বিশ্বের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত করে। এ বিষয়ে কোনো সদুত্তর কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে আছে? আসলে নাই। ওনারা বলছেন ‘ফ্যাসিস্ট আমলে’ এ নামকরণের অপব্যবহার করা হয়েছে। তো এখন ‘গণতন্ত্র আর দ্বিতীয় স্বাধীনতার’ আমলে অপব্যবহার না করলেই হয়। নাম পাল্টাতে হবে কেন? প্রকৃত ঘটনা হলো বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং একই সাথে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের ‘স্বৈরাচার বিরোধী’ উপদেষ্টা উগ্র ইসলামী মৌলবাদীদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন। তবে এ কথা মনে রাখা প্রয়োজন মুক্তিযুদ্ধ শুধু ক্ষুদ্র এক ইতিহাস নয়। মুক্তিযুদ্ধ মানেই বাংলাদেশ।
সংবিধানের মূলনীতি থেকে তারা সমাজতন্ত্র বাতিল করতে চান। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নায়করা যদি এ কথা বলেন তাহলে তো বলতেই হবে বৈষম্য বিরোধিতার স্লোগান কি শুধু জনতুষ্টির জন্য তারা তুলেছিলেন? সমাজতন্ত্র ছাড়া দুনিয়ায় আর কোনো ব্যবস্থা কী আছে যা সমাজ থেকে বৈষম্য বিলীন করতে পারে? তাহলে কি বৈষম্য বিরোধিতা মানে আওয়ামী আমলে লুটপাট চলেছে, এখন আমাদেরও লুটপাটের সুযোগ দিয়ে সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। যদিও শেখ হাসিনার পতনের পর পরই সমন্বয়কদের একাংশের বিরুদ্ধে দ্রুত অতিদ্রুত ‘মানি মেকিং’ -এর অভিযোগ শোনা যায় এবং এখনও তা চলছে- তারপরেও এটা বিশ্বাস করতে চাই দল হিসেবে তারা এটা করছেন না।
সংস্কার কমিটির প্রধান এককালের সমাজতন্ত্রী আলী রিয়াজ বলেছেন, রাশিয়ায় সমাজতন্ত্রের পতনের পরে সংবিধানের মূলনীতিতে সমাজতন্ত্র রাখার বিষয়টি প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে। এ কেমন কথা! সমাজতন্ত্র তো চীন রাশিয়ার বিষয় নয়। বাংলাদেশ বৈষম্যহীন সমাজ তথা সমাজতন্ত্রের পথে এগোবে বাংলাদেশি পন্থায়, বাংলাদেশের বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে। নাগরিক পার্টি তাদের ঘোষনায় সাম্যের সমাজ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে। সাম্য প্রতিষ্ঠা তো কোনো বায়বীয় বিষয় নয়। একটা ব্যবস্থা এবং সেটাই সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা। নিশ্চয়ই সে ব্যবস্থা মূলনীতিতে লিপিবদ্ধ করলেই কায়েম হয়ে যাবে না। এটা দীর্ঘ লড়াই ও সমাজের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের বিষয়। সংবিধানে সে লক্ষ্য লিখিত থাকলে অসাম্যের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত মেহনতি মানুষের সাম্যের অধিকার প্রতিষ্ঠা রাষ্ট্রের ওপর বর্তায়। সেটা কোন্ পন্থায় হবে তা নিয়ে নানা দলের নানা মত থাকতে পারে; কিন্তু লুটেরা ধনবাদী ও ভোগবাদী ব্যবস্থার বিপরীতে সাম্যের আর্থিক ব্যবস্থা তথা সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য সংবিধানে লিপিবদ্ধ থাকলে লুটেরাদের দৌরাত্ম্য নিয়ন্ত্রনে রেখে রাষ্ট্র বৈষম্য কমিয়ে আনতে সাংবিধানিক পদক্ষেপ নিতে পারে। বৈষম্যের শিকার আমজনতাও মনে করবে দেশটি একান্তই তার। দেশের অগ্রগতি নিশ্চিত করতে সে তার ঘাম শ্রম সবটাই বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত থাকবে। এসব বিষয় কি নাগরিক পার্টির নেতৃত্ব বিবেচনায় নিয়েছেন?
তৃতীয় শক্তির জন্য একটা জায়গা কিন্তু এখনও শূন্য আছে। অপ্রস্তুত অবস্থায় রাজনীতির মাঠে নামা তরুণেরা নতুন বন্দোবস্তের কথা বললেও তাদের কৌশল ও আচরণে পুরোনো রাজনীতির ধারাই বহমান থাকায় এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ধারা থেকে বিচ্যুত হওয়ায় ওই শূন্যতা তারা পূরণ করতে পারছেন না। আর সে কারণেই তাদের মাঝে পরিশীলিত রাজনৈতিক বোধ অপেক্ষা বিজয়ী ঔদ্ধত্য বাড়ছে। তাই তো অভ্যুত্থানের আট মাস পরেও কিন্তু জনজীবনে স্বস্তির ভাব আসে নাই। মানুষের মনে প্রশ্ন, এবারের ব্যতিক্রমী এ গণঅভ্যুত্থান থেকে রাজনৈতিক দলগুলো কী শিক্ষা নিলো? তার কোন সদুত্তর নাই। অভ্যুত্থান পরবর্তী পরিস্থিতিতে যে নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ হলো সেখানেও নতুনত্ব দৃশ্যমান হচ্ছে না। বরং একটা ভীতি সৃষ্টি হচ্ছেÑ সাম্য, ন্যায়বিচার, সুশাসন ও বহুত্ববাদের মিষ্টি কথার আড়ালে ধর্মীয় মৌলবাদী কোনো কোনো গোষ্ঠীর সঙ্গে মিলিত হয়ে সংস্কার কমিটির মাধ্যমে ‘সবকা সাথ্ সবকা বিকাশ’ মার্কা কিছু একটা ঘটানোর চেষ্টা হচ্ছে না তো!
[লেখক : সাবেক ছাত্র নেতা]
আনোয়ারুল হক
শনিবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৫
জুলাই অভ্যুত্থানের পরে বাংলাদেশে তরুণ নেতৃত্বে একটি নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টি নামে আত্মপ্রকাশ করেছে। নতুন দল গঠনের প্রক্রিয়ার সময়েই বলা হয়েছিল দলটি মধ্যপন্থি রাজনীতি করবে এবং সাম্য, ন্যায়বিচার, সুশাসন এই দলের অঙ্গীকার। তবে নতুন দলের নেতৃত্বে নানা মত-পথের এমনকি সম্পূর্ণ বিপরীত মতাদর্শের তরুণরাও রয়েছেন।
দলটির সংগঠকদের গত বছর জুলাই-অগাস্ট থেকেই মানুষ দেখছে। ইতোমধ্যে তাদের অনেকে এমন অনেক ঘটনায় সম্পৃক্ত হয়েছেন যেগুলো মধ্যপন্থার চেতনার সাথে যায় না। আবার এই দলের সামনের সারিতে আমরা যাদের দেখছি তার বাইরেও অনেক আধুনিক মনষ্ক, রাজনৈতিক জ্ঞানের গভীরতা সম্পন্ন চৌকস তরুণ-তরুণীরা আছেন যাদের বুদ্ধিদীপ্তভাবে বর্তমানের অস্থির সময়ের প্রতিকূলতাকে মোকাবেলা করার যোগ্যতা রয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত তাদের ঘোষিত কোন কর্মসূচি নেই। একেক নেতা একেক সুরে তাদের নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের ব্যাখ্যা দিচ্ছেন।
একটি বিষয়ে তাদের সবার সুর মোটামুটি একই। সেটি হচ্ছে বাংলাদেশের সংবিধান বাতিল করতে হবে। সংবিধানের প্রতি বাংলাদেশের সব শাসকদেরই ‘ভক্তি’ আমরা দেখেছি। শাসকদের নিজ পছন্দ মত চলতে সংবিধান বাধা হয়ে দাঁড়ালেই তারা সংবিধান সংশোধনের জন্য তৎপর হয়ে ওঠেন। তাইতো মুজিব আমলে প্রনীত সংবিধানে মাত্র ২ বছরের মাথায় মুজিবই সংশোধনী আনেন। এবং পরবর্তীতেও সকল শাসকেরা যার যার সুবিধামতো সংবিধান সংশোধন করেছেন। এবার আর সংশোধনী নয়। তারা চান বাতিল। কেন? সংবিধানের মূল নীতি সমূহ তাদের পছন্দ নয়।
প্রধান আপত্তি ধর্ম নিরপেক্ষতা নিয়ে। নতুন দলের এবং সংবিধান সংস্কার কমিটির যুক্তিতে মিল রয়েছে। সংস্কার কমিটির প্রধান আলী রিয়াজ পশ্চিমা দুনিয়ার নাগরিক। তিনি মনে করেন, গণতন্ত্র ও বহুত্ববাদের মধ্যেই ধর্ম নিরপেক্ষতা বিদ্যমান। তাত্ত্বিক অর্থে হয়তোবা কথা ঠিক; কিন্তু আমাদের উপমহাদেশের বাস্তবতায় সেই কলকাতার দাংগা বা নোয়াখালীর দাঙ্গা থেকে শুরু করে দেশ বিভাগের আগে পরে ভারত পাকিস্তান উভয় অংশে দাঙ্গার যে বীভৎসতা হয়েছে এবং তৎপরবর্তীতে আজ অবধি এই যে ৫ আগস্টের পরিবর্তনের সাথে সাথে মন্দির মাজার হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান আক্রান্ত হলো, বিশেষ করে হঠাৎ করে উগ্র মৌলবাদী উত্থানের চেহারা দেখে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মনস্তত্ত্বাতিক জগতে যে অসহায়ত্ব জন্ম নিলো সে সব বিবেচনায় নিলে রাষ্ট্রের ধর্ম নিরপেক্ষ চরিত্র দালিলিকভাবে লিপিবদ্ধ থাকা জরুরী। তা না হলে ধর্মীয় সংখ্যালঘু এমনকি উদারমনা মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের নিরাপত্তা এ দেশে বারবার বিঘিœত হবে। তাতে তার কি যায় আসে। তিনি তো আর এ দেশে থাকবেন না!
ধর্মীয় গোত্রীয় বিভাজন ও বিরোধের অভিশাপ থেকে সমাজ ও রাষ্ট্রকে স্থিতিশীল ও নিরাপদ রাখার জন্য কোরআনের নির্দেশনা হলো- ‘তোমাদের বিশ্বাস তোমাদের, আমাদের ধর্ম আমাদের’। (সুরা : আল কাফিরুন, আয়াত : ৭)। কোরআনের এই নির্দেশনা তো রাষ্ট্রের ধর্ম নিরপেক্ষ থাকার পক্ষে। ধর্মের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি একটি মারাত্মক ব্যাধি। পবিত্র কোরআনের নির্দেশনা হল, ‘... তোমরা তোমাদের দ্বীনের মধ্যে বাড়াবাড়ি করো না। ’ (সুরা নিসা, আয়াত : ১৭১)। ধর্মীয় বাড়াবাড়ির এই ব্যাধি থেকে মুসলমান, হিন্দু বা অন্যান্য ধর্মাবলম্বী, বিশ্বাসী, অবিশ্বাসী, সংস্কারবাদী, সংশয়বাদী, রক্ষণশীল সবাইকে মুক্ত রাখতেই ধর্মনিরপেক্ষতা সংবিধানে দালিলিকভাবে উল্লেখ থাকা প্রয়োজন। বহুত্ববাদকে নিশ্চিত করার জন্যই ধর্ম নিরপেক্ষতা প্রয়োজন।
ভূ-রাজনৈতিক কারণেও প্রয়োজন। হিন্দুত্ববাদী মোদি সরকার ভারতবর্ষের সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বাতিল করতে চায়। তার জন্য আঁটসাঁটবেধে সবকিছু গুছিয়ে ফেলেছিলেন মোদি; কিন্তু ভারতবর্ষের অসাম্প্রদায়িক, গনতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল ও শক্তিসমূহ জোট বেঁধে গত লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি ও তার মিত্রদের পার্লামেন্টে দুই-তৃতীয়াংশ আসন পাওয়া থেকে অনেকটাই দূরে রাখতে পেরেছে। বাংলাদেশে এ অঘটন ঘটালে ভারতবর্ষের হিন্দুত্ববাদীদের উষ্কে দেয়া হবে; এবং সেখান থেকেও ধর্মনিরপেক্ষতাকে যদি মুছে ফেলে দেওয়া হয় এবং ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ তিন দেশই যদি ধর্মীয় উগ্রবাদের নিশান তুলে দাঁড়ায় কি চেহারাটা হবে এই উপমহাদেশের?
আমরা তো সেই শৈশব থেকে পড়ে এসেছি হজরত মোহাম্মদ (সা.) বিদায় হজের ঐতিহাসিক তাৎপর্যময় ভাষণে, সবাইকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন- ‘সাবধান! ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি কোরো না। এ বাড়াবাড়ির ফলে তোমাদের আগে অনেক জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে। ’ আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে, এ উপমহাদেশকে ধর্মীয় উগ্রবাদের বিপদ থেকে রক্ষা করতে, এ অঞ্চলের ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের মানুষকে সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ রাখতে, ভিন্ন ভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীর স্বকীয়তা, বৈচিত্র্য অক্ষুণ্ব রাখতে সকল রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ, আলেম সমাজ, ভিন্ন ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ধর্মগুরু সবাইকেই ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ির বিপরীতে ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে অবস্থান নিতে হবে। আর এ প্রশ্নে সবাইকে এক রাখার জাতীয় দায়িত্ব পালনে তো সবার আগে এগিয়ে আসা উচিত এবারের গনঅভ্যুত্থানে বিজয়ী তরুণদের। তাহলেই না মানুষ ভরসা করতে পারবে যে পথ হারাবে না বাংলাদেশ। অর্ধ শতাব্দীরও অধিককাল যাবত যা সংবিধানে মূল নীতি হিসাবে আছে তা বাতিল করতে চাইলে সমাজে অহেতুক অস্থিরতা ও অশান্তি সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে, যা সামাল দেয়া কঠিন হবে।
প্রাসঙ্গিক মনে হওয়ায় আমাদের প্রতিবেশী দেশের কিছু ঘটনার উল্লেখ করতে চাই। ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি পরপর তিনবার গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। ২০০২ সালে গোধরা স্টেশনে ট্রেনে আগুন লাগানোর ঘটনাকে কেন্দ্র করে গুজরাটে ব্যাপক সাম্প্রদায়িক সহিংসতার সৃষ্টি হয়। তার রাজ্য সরকারের নির্লিপ্ততার ফলে ১,০০০ জনেরও অধিক সংখ্যালঘু মুসলিম নিহত হন। মোদি ‘গুজরাটের কসাই’ হিসাবে ‘খ্যাতি’ অর্জন করেন। সে কারণে বহু ধর্ম, বহু জাতির, বহু সংস্কৃতির বৈচিত্র্যময় ভারতবর্ষে প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী হিসাবে মোদির গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ ছিলো। তারপরেও বিজেপি নেতৃত্ব মোদির ক্যারিশমাটিক নেতৃত্বের উপর ভরসা রেখে ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে তার নেতৃত্বে লড়াই করে ১৯৮৪ সালের পর প্রথমবারের মতো একক দল হিসাবে লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে।
নির্বাচনী প্রচার অভিযান থেকেই মোদি আওয়াজ তুললেন ‘সবকা সাথ্ সবকা বিকাশ’। অর্থাৎ বিজয়ী হলে ধর্ম বর্ণ জাত পাত নির্বিশেষে সকলের অগ্রগতির জন্য তার সরকার কাজ করবে। তার আওয়াজ জনমনে ছাপ ফেলে; কিন্তু মোদি খুবই চাতুরতার সাথে অতি ধীরে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ তথা আরএসএসের হিন্দুত্ববাদী নীতিকে অগ্রাধিকার দিয়ে তার পরিকল্পনা সাজাতে শুরু করেন। বাবরি মসজিদের স্থানে মন্দির নির্মাণ ও ঘটা করে সরকারিভাবে তার উদ্বোধন, ধর্মের ভিত্তিতে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন তথা সিএএ, ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদের অধীনে জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যকে প্রদত্ত বিশেষ মর্যাদা বাতিল, অতি সম্প্রতি মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মীয় সম্পত্তি নিয়ন্ত্রণের মত স্পর্শকাতর বিষয় ওয়াকফ আইনে পরিবর্তন আনা এবং এ ধরনের অসংখ্য ছোট বড় ঘটনার মাধ্যমে আমাদের চেনা জানা ভারতবর্ষ অনেকটাই পাল্টে গেছে।
লোকসভা নির্বাচনে মোদি নিজ দলকে মধ্যপন্থী দল হিসেবে আখ্যায়িত করে মুসলিম নেতৃবৃন্দকে পাশে রেখে বলতেন ‘সবহি ধরাম সমান হ্যায়, সবহি লোগ মেরে হ্যায়।’ আজ কোথায় সেই মধ্যপন্থা, কোথায় সব ধর্ম সমান-এর গল্প? সাম্প্রদায়িক মেরুকরণকে মোদি এবং তার দল সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। ‘সব কা সাথ সবকা বিকাশের’ আড়ালে স্বাধীন ভারতের যা যা অর্জন বিশেষত ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রই আজ আরএসএস-বিজেপির শাসনে বিপন্ন।
মোদি এবং ভারতীয় জনতা পার্টির উদাহরণ নিশ্চয়ই আমাদের নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টির ক্ষেত্রে প্রয়োজ্য নয়। তারপরেও উদাহরণটি বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন এ কারণে যে, তরুণ নেতৃত্বের একটা উল্লেখযোগ্য অংশের ছাত্র রাজনীতিতে হাতেখড়ি অনেকটা আরএসএস মার্কা ইসলামী মৌলবাদী ছাত্র সংগঠনের হাত ধরে। পরবর্তীতে তারা ঐ সংগঠন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ‘ছাত্র শক্তি’ নামক সংগঠন গড়ে তোলেন। প্রাথমিক সংগঠনের মৌলবাদী রাজনীতির প্রভাব তাদের মনোজগতে আছে বা ‘যার ছায়া পড়েছে তাদের মনেরও আয়নাতে’। তাই তো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, লাখো লাখো শহীদের আত্মদান, ধর্ষিতা নারীদের আর্তনাদ, মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম...’, ‘যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে...’ ‘I, Major Ziaur Rahman, on behalf of our great leader Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman, hereby declare that the independent People’s Republic of Bangladesh has been established... ’। বিপ্লবী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীনের প্রথম ঘোষণা- ‘যুদ্ধক্ষেত্রাস্তীর্ণ ধ্বংসাবশেষের মধ্য দিয়ে, ধূলি-কাদা আর রক্তের ছাপ মুছে এক নতুন দেশ জন্ম নিলো,’ স্বাধীন বাংলা বেতারের ‘জয় বাংলা বাংলার জয়/ হবে হবে হবে, হবে নিশ্চয়’, শোন একটি মজিবরের কন্ঠ স্বরের ধ্বনি প্রতিধ্বনি’- এসব কিছু কোটি কোটি বাঙালির মনে যে আবেগ অনুভূতির সঞ্চার করে তা তাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে না।
তাই তো ’২৪-এর এক মাসের ছাত্র-গণআন্দোলনকে তারা মুক্তিযুদ্ধ বা স্বাধীনতা যুদ্ধের সাথে গুলিয়ে ফেলে মুক্তিযুদ্ধের বিশাল ক্যানভাসটাকে খাটো করতে চায়। আশঙ্কা জাগে ধর্ম নিরপেক্ষতাকে উঠিয়ে দিয়ে পাশের দেশের হিন্দুত্ববাদের অনুকরণে ধীরে ধীরে বাংলাদেশটাকে আবার পাকিস্তানি ধারায় তথাকথিত ইসলামীকরণের দিকে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা কাজ করছে কিনা। তাই যদি না হবে তবে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নামকরণ কি এমন অপরাধ করলো! স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের এক পটভূমিতেই তো অমঙ্গলকে দূর করে মঙ্গলের আহ্বান জানিয়ে শোভাযাত্রার নামকরণ হয় ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’; যা ইউনেস্কো বিশ্বের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত করে। এ বিষয়ে কোনো সদুত্তর কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে আছে? আসলে নাই। ওনারা বলছেন ‘ফ্যাসিস্ট আমলে’ এ নামকরণের অপব্যবহার করা হয়েছে। তো এখন ‘গণতন্ত্র আর দ্বিতীয় স্বাধীনতার’ আমলে অপব্যবহার না করলেই হয়। নাম পাল্টাতে হবে কেন? প্রকৃত ঘটনা হলো বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং একই সাথে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের ‘স্বৈরাচার বিরোধী’ উপদেষ্টা উগ্র ইসলামী মৌলবাদীদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন। তবে এ কথা মনে রাখা প্রয়োজন মুক্তিযুদ্ধ শুধু ক্ষুদ্র এক ইতিহাস নয়। মুক্তিযুদ্ধ মানেই বাংলাদেশ।
সংবিধানের মূলনীতি থেকে তারা সমাজতন্ত্র বাতিল করতে চান। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নায়করা যদি এ কথা বলেন তাহলে তো বলতেই হবে বৈষম্য বিরোধিতার স্লোগান কি শুধু জনতুষ্টির জন্য তারা তুলেছিলেন? সমাজতন্ত্র ছাড়া দুনিয়ায় আর কোনো ব্যবস্থা কী আছে যা সমাজ থেকে বৈষম্য বিলীন করতে পারে? তাহলে কি বৈষম্য বিরোধিতা মানে আওয়ামী আমলে লুটপাট চলেছে, এখন আমাদেরও লুটপাটের সুযোগ দিয়ে সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। যদিও শেখ হাসিনার পতনের পর পরই সমন্বয়কদের একাংশের বিরুদ্ধে দ্রুত অতিদ্রুত ‘মানি মেকিং’ -এর অভিযোগ শোনা যায় এবং এখনও তা চলছে- তারপরেও এটা বিশ্বাস করতে চাই দল হিসেবে তারা এটা করছেন না।
সংস্কার কমিটির প্রধান এককালের সমাজতন্ত্রী আলী রিয়াজ বলেছেন, রাশিয়ায় সমাজতন্ত্রের পতনের পরে সংবিধানের মূলনীতিতে সমাজতন্ত্র রাখার বিষয়টি প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে। এ কেমন কথা! সমাজতন্ত্র তো চীন রাশিয়ার বিষয় নয়। বাংলাদেশ বৈষম্যহীন সমাজ তথা সমাজতন্ত্রের পথে এগোবে বাংলাদেশি পন্থায়, বাংলাদেশের বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে। নাগরিক পার্টি তাদের ঘোষনায় সাম্যের সমাজ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে। সাম্য প্রতিষ্ঠা তো কোনো বায়বীয় বিষয় নয়। একটা ব্যবস্থা এবং সেটাই সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা। নিশ্চয়ই সে ব্যবস্থা মূলনীতিতে লিপিবদ্ধ করলেই কায়েম হয়ে যাবে না। এটা দীর্ঘ লড়াই ও সমাজের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের বিষয়। সংবিধানে সে লক্ষ্য লিখিত থাকলে অসাম্যের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত মেহনতি মানুষের সাম্যের অধিকার প্রতিষ্ঠা রাষ্ট্রের ওপর বর্তায়। সেটা কোন্ পন্থায় হবে তা নিয়ে নানা দলের নানা মত থাকতে পারে; কিন্তু লুটেরা ধনবাদী ও ভোগবাদী ব্যবস্থার বিপরীতে সাম্যের আর্থিক ব্যবস্থা তথা সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য সংবিধানে লিপিবদ্ধ থাকলে লুটেরাদের দৌরাত্ম্য নিয়ন্ত্রনে রেখে রাষ্ট্র বৈষম্য কমিয়ে আনতে সাংবিধানিক পদক্ষেপ নিতে পারে। বৈষম্যের শিকার আমজনতাও মনে করবে দেশটি একান্তই তার। দেশের অগ্রগতি নিশ্চিত করতে সে তার ঘাম শ্রম সবটাই বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত থাকবে। এসব বিষয় কি নাগরিক পার্টির নেতৃত্ব বিবেচনায় নিয়েছেন?
তৃতীয় শক্তির জন্য একটা জায়গা কিন্তু এখনও শূন্য আছে। অপ্রস্তুত অবস্থায় রাজনীতির মাঠে নামা তরুণেরা নতুন বন্দোবস্তের কথা বললেও তাদের কৌশল ও আচরণে পুরোনো রাজনীতির ধারাই বহমান থাকায় এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ধারা থেকে বিচ্যুত হওয়ায় ওই শূন্যতা তারা পূরণ করতে পারছেন না। আর সে কারণেই তাদের মাঝে পরিশীলিত রাজনৈতিক বোধ অপেক্ষা বিজয়ী ঔদ্ধত্য বাড়ছে। তাই তো অভ্যুত্থানের আট মাস পরেও কিন্তু জনজীবনে স্বস্তির ভাব আসে নাই। মানুষের মনে প্রশ্ন, এবারের ব্যতিক্রমী এ গণঅভ্যুত্থান থেকে রাজনৈতিক দলগুলো কী শিক্ষা নিলো? তার কোন সদুত্তর নাই। অভ্যুত্থান পরবর্তী পরিস্থিতিতে যে নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ হলো সেখানেও নতুনত্ব দৃশ্যমান হচ্ছে না। বরং একটা ভীতি সৃষ্টি হচ্ছেÑ সাম্য, ন্যায়বিচার, সুশাসন ও বহুত্ববাদের মিষ্টি কথার আড়ালে ধর্মীয় মৌলবাদী কোনো কোনো গোষ্ঠীর সঙ্গে মিলিত হয়ে সংস্কার কমিটির মাধ্যমে ‘সবকা সাথ্ সবকা বিকাশ’ মার্কা কিছু একটা ঘটানোর চেষ্টা হচ্ছে না তো!
[লেখক : সাবেক ছাত্র নেতা]