কানন পুরকায়স্থ
অক্সফোর্ড ইংরেজি অভিধান অনুসারে ‘রিসেটের’ অর্থ আবার নতুন করে সেট করা, কোন কিছুর গঠন পরিবর্তন করা এবং প্রায়শই শূন্যে স্থাপন করা, অথবা কোনকিছুকে আবার ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত করা, সাধারণত এটিকে তার আসল সেটিংসে ফিরিয়ে আনা।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, এই শব্দটির ব্যবহার প্রযুক্তি এবং রাজনীতি, উভয় ক্ষেত্রেই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। প্রযুক্তিতে আমরা আমাদের কম্পিউটার, মোবাইল ফোন বা অন্যান্য বিভিন্ন যন্ত্র রিসেট করার জন্য ‘রিসেট’ বাটন ব্যবহার করি, যাতে এটি সঠিকভাবে কাজ করতে পারে। রাজনীতিতে আমরা শুনি যে কোন উপদেষ্টা বা রাজনীতিবিদ বলেন যে দেশের তরুণ প্রজন্ম রিসেট বাটন টিপে দেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপট বদলে দিয়েছে; কিন্তু আমরা কিভাবে রিসেট করব? এর পদ্ধতিগুলি কী? রিসেট বলতে কী বোঝায়- তা নির্ভর করবে এটিকে বাস্তবায়ন করার পরাকৌশলের ওপর।
মাঝে মাঝে সমস্যার তীব্রতার কারণে জড়তা আমাদের গ্রাস করে। পরিবর্তনের এত সম্ভাবনা আমাদের স্থবির করে দেয়, তখন আমরা সিদ্ধান্তের পক্ষাঘাতেও ভুগি, যাকে ইংরেজি ভাষায় বলা হয় decision paralysis। আমরা কী করা উচিত বা উচিত নয়, তা নিয়ে একে অপরের সাথে লড়াই করি কিন্তু বাস্তবে কিছুই অর্জন করি না। আমরা সমস্যার পিছনে ছুটতে ছুটতেও ক্লান্ত হয়ে পড়ি। আমরা মাঝে মাঝে আটকে থাকি এবং কী করব বা কী করব না তা বুঝতে পারি না। উপমা হিসেবে, কোথাও ‘আটকে পড়ার’ অর্থ হতে পারে আমাদের পথ একটি পাথর দ্বারা অবরুদ্ধ করা হয়েছে, যা অপসারণ করা প্রয়োজন। কিন্তু একটি বড় পাথর সরানোর জন্য, একজনকে কৌশলগত ভাবে দক্ষ হতে হবে; কিন্তু কিভাবে কৌশলগতভাবে দক্ষ হতে হবে? এখন যা প্রয়োজন তার সবকিছুর একসাথে পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশে প্রয়োজনীয় সমস্ত পরিবর্তন একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করা যাবে না। তবে কেউ এমন কিছু পরিবর্তন করতে পারে যা আমরা ‘লিভারেজ পয়েন্ট’ বলি, এটি আমেরিকান সিস্টেম তাত্ত্বিক ডোনেলা মিডোসের ব্যবহার করা জনপ্রিয় একটি শব্দ। লিভারেজ পয়েন্ট হচ্ছে সেই স্থান বা ক্ষেত্র যেখানে সামান্য প্রচেষ্টায় অনেক বেশি সুবিধা পাওয়া যায়। পূর্বে উল্লিখিত একটি পাথর অপসারণের প্রেক্ষাপটে, লিভারকে সমর্থন করে এমন একটি অবলম্বন বিন্দু (fulcrum) হলো একটি লিভারেজ পয়েন্ট; কিন্তু এটাই যথেষ্ট নয়। এটিকে সরানোর জন্য আমাদের কিছু সম্পদের প্রয়োজন। সম্পদ বিভিন্নভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। কৌশলটি হলো সমস্ত সম্পদকে এমনভাবে সারিবদ্ধ করা যাতে তারা একই দিকে এগিয়ে যায়। বাস্তবে লিভারেজ পয়েন্টে সম্পদকে জড় বা বিন্যস্থ করতে হবে। আমরা কি বাংলাদেশে লিভারেজ পয়েন্ট খুঁজে পেয়েছি, যাতে আমরা সেই পয়েন্টে এগিয়ে যাওয়ার জন্য আমাদের সম্পদকে ব্যবহার করতে পারি?
আমাদের কিছু গোয়েন্দা কাজের প্রয়োজন এই লিভারেজ পয়েন্ট কে খুঁজে বের করার জন্য। এটি করার জন্য, কাজের বাস্তবতা পরীক্ষা করা প্রয়োজন, এর অর্থ হলো কাজটি দেখা এবং শুরুতে কিছু ফলাফল যাচাই করা। চূড়ান্ত গন্তব্যের বিকল্প পথ চিহ্নিত করা, এর অর্থ লক্ষ্যের লক্ষ্য (goal of the goal) বিবেচনা করা। সেরা কাজটি বিশ্লেষণ এবং প্রতিলিপি করা। এই ভাবে একটি দেশ আলোকিত পথের সন্ধান পাবে। যদি কেউ এই আলোকিত পথের সন্ধান পায় তাহলে তার পরবর্তী প্রয়োজন হচ্ছে এই পথকে লক্ষ্য অর্জনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য বিশ্লেষণ করা। আলোকিত পথকে সর্বস্তরে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। কারণ এই পথ একটি দেশের নানাবিধ সমস্যার মধ্যে চাপা পড়ে থাকে তাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে দৃশ্যমান নয়। একজনকে সেগুলো খনন করতে হবে। একটি প্রতিষ্ঠানে আলোকিত স্থানের একটি উদাহরণ ধারণ (retention) হতে পারে। যদি ধরে রাখার হার কমে যায়, তবে এটি ভাল নয়। এই ধারণাটি একটি রাজনৈতিক পরিস্থিতিতেও ভাবা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, একটি রাজনৈতিক দলের সদস্যপদ ধরে রাখা সেই দলের দর্শন এবং তাদের গ্রহণযোগ্যতার সূচক হতে পারে। তবে একটি আলোকিত স্থান শনাক্তকরণের সাথে আরেকটি বিষয় যুক্ত তা হল সমস্ত বিভ্রান্তি দূর করা। এর অর্থ হলো- সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি বা সাংস্কৃতিক আদর্শের ওপর মনোযোগ দিতে হবে এবং আক্ষরিক অর্থেই অন্য সবকিছু বাদ দিতে হবে। আলোকিত দিকগুলি পরীক্ষা করে, আমরা সেই পরিস্থিতিগুলো শনাক্ত করতে পারি যা আমাদের সাফল্যের সুযোগ করে দেয় এবং যদি আমরা সেই পরিস্থিতিগুলো বুঝতে পারি, তাহলে আমরা সেগুলো প্রতিলিপি করতে পারি, যা আমাদের সাফল্য ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ করে দিতে পারি।
একটি কাক্সিক্ষত অগ্রগতি শক্তির দ্বারা আটকে যেতে পারে, এর অর্থ হলো সীমাবদ্ধতাকে লক্ষ্য করা প্রয়োজন। এটি লক্ষণীয় যে সীমাবদ্ধতাগুলো একটি লক্ষ্যের ওপর নির্ভরশীল। কারণ সীমাবদ্ধতাগুলো কেবল লক্ষ্যের প্রেক্ষাপটে অর্থবহ। এর যৌক্তিক ফলাফল হলো এই যে, যখন কেউ তাদের লক্ষ্য পরিবর্তন করে, তখন সীমাবদ্ধতাও পরিবর্তিত হয়। সুতরাং সীমাবদ্ধতা কী তা খুব বস্তুনিষ্ঠভাবে অন্বেষণ এবং পরীক্ষা করা গুরুত্বপূর্ণ, রাজনৈতিকভাবে নয়। আমাদের পুরো সিস্টেমের একটি মানচিত্র করতে হবে। রাজনৈতিক বা সামাজিক অস্থিরতার মতো কোন পাথর সরাতে সক্ষম হওয়ার জন্য পরিবেশের আলোকিত স্থান (bright spot) তন্ন তন্ন করে দেখা প্রয়োজন। এটি একজনকে একটি লিভারেজ পয়েন্ট শনাক্ত করতে সহায়তা করবে।
যাই হোক, যদি আমরা বলি যে, আমরা লিভারেজ পয়েন্ট খুঁজে পেয়েছি, তাহলে এর অর্থ হলো আমরা এমন কিছুতে মনোনিবেশ করেছি যা করা সম্ভব এবং করার যোগ্য। যখন আমরা লিভারেজ পয়েন্ট খুঁজে পাই তখন আমাদের লিভারেজ পয়েন্টে জমা করার জন্য সম্পদ খুঁজে বের করতে হবে। রিসেট করার অনুশীলন থেকে অভিজ্ঞতা এবং শেখার মাধ্যমে কাজকে ত্বরান্বিত করতে হবে। সাধারণভাবে একজন নেতা কোন সমস্যার সমাধান করতে হবে তা জানেন ভালো, কিন্তু তারা মানুষকে কীভাবে সমাধান করতে হবে তাও বলে দেন। এর অর্থ হলো কিছু নেতা বলবেনÑ ‘এটা করো, ওটা করো।’ কার্যকর ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে এটি একটি ‘নিম্ন স্বায়ত্তশাসন উচ্চ সারিবদ্ধকরণ’ (low autonomy but high alignment) পরিস্থিতি।
অন্যদিকে যখন আমরা ‘উচ্চ স্বায়ত্তশাসন কিন্তু নিম্ন সারিবদ্ধকরণ’ পরিস্থিতির কথা ভাবি, তখন দল যা ইচ্ছা তাই করতে পারে এবং মূলত বিভিন্ন দিকে দৌড়াতে পারে। শেষপর্যন্ত আমরা এমন একটি দেশ পাই যা ফ্রাঙ্কেনস্টাইনে পরিণত হয়। দক্ষিণ এশিয়ার কিছু দেশে যেমন বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কি এমনটা ঘটছে না? আমাদের আসলে ‘সারিবদ্ধ স্বায়ত্তশাসন’ প্রয়োজন। এর অর্থ হলো নেতারা কোন সমস্যাগুলো সমাধান করতে হবে তার ওপর মনোনিবেশ করবেন, কিন্তু দলগুলোকে কিভাবে এটি সমাধান করতে হবে তা খুঁজে বের করতে দিতে হবে। ‘সারিবদ্ধকরণ’ যত শক্তিশালী হবে, তত বেশি স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা সম্ভব হবে। এই মুহূর্তে উদাহরণস্বরূপ বাংলাদেশে আমরা যা দেখছি, এ ধরনের স্বায়ত্তশাসন সাশ্রয়ী নয়।
সুতরাং, ‘রিসেট’ শুধুমাত্র একটি শব্দ নয়। কেবল রিসেট করার জন্য একটি বোতাম টিপলে কাজ হবে না। একটি উন্নত বিশ্ব, একটি উন্নত দেশ এবং জনগণের উন্নত জীবনমান অর্জনের জন্য অণুপ্রেরণা গুরুত্বপূর্ণ। এ অণুপ্রেরণাকে কাজে লাগানোর জন্য জনগণের ‘প্রয়োজনীয়তা’ এবং ‘কাক্সিক্ষত’ বিষয়ের মধ্যে মিল খুঁজে বের করতে হবে। প্রেরণা অন্বেষণের পর ‘সারিবদ্ধ স্বায়ত্তশাসন’ একটি দেশকে রিসেট বা পুনর্গঠন করায় সহায়ক হতে পারে। মূলত আমার দৃষ্টিতে রিসেট বা পুনর্গঠনের অর্থ হলোÑ ‘সামঞ্জস্যপূর্ণ সারিবদ্ধ স্বায়ত্তশাসন।’ এই সারিবদ্ধতা (alignment) অবশ্যই ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং একটি ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সমাজের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে।
[লেখক : যুক্তরাজ্যে কর্মরত শিক্ষাবিদ]
কানন পুরকায়স্থ
সোমবার, ২১ এপ্রিল ২০২৫
অক্সফোর্ড ইংরেজি অভিধান অনুসারে ‘রিসেটের’ অর্থ আবার নতুন করে সেট করা, কোন কিছুর গঠন পরিবর্তন করা এবং প্রায়শই শূন্যে স্থাপন করা, অথবা কোনকিছুকে আবার ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত করা, সাধারণত এটিকে তার আসল সেটিংসে ফিরিয়ে আনা।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, এই শব্দটির ব্যবহার প্রযুক্তি এবং রাজনীতি, উভয় ক্ষেত্রেই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। প্রযুক্তিতে আমরা আমাদের কম্পিউটার, মোবাইল ফোন বা অন্যান্য বিভিন্ন যন্ত্র রিসেট করার জন্য ‘রিসেট’ বাটন ব্যবহার করি, যাতে এটি সঠিকভাবে কাজ করতে পারে। রাজনীতিতে আমরা শুনি যে কোন উপদেষ্টা বা রাজনীতিবিদ বলেন যে দেশের তরুণ প্রজন্ম রিসেট বাটন টিপে দেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপট বদলে দিয়েছে; কিন্তু আমরা কিভাবে রিসেট করব? এর পদ্ধতিগুলি কী? রিসেট বলতে কী বোঝায়- তা নির্ভর করবে এটিকে বাস্তবায়ন করার পরাকৌশলের ওপর।
মাঝে মাঝে সমস্যার তীব্রতার কারণে জড়তা আমাদের গ্রাস করে। পরিবর্তনের এত সম্ভাবনা আমাদের স্থবির করে দেয়, তখন আমরা সিদ্ধান্তের পক্ষাঘাতেও ভুগি, যাকে ইংরেজি ভাষায় বলা হয় decision paralysis। আমরা কী করা উচিত বা উচিত নয়, তা নিয়ে একে অপরের সাথে লড়াই করি কিন্তু বাস্তবে কিছুই অর্জন করি না। আমরা সমস্যার পিছনে ছুটতে ছুটতেও ক্লান্ত হয়ে পড়ি। আমরা মাঝে মাঝে আটকে থাকি এবং কী করব বা কী করব না তা বুঝতে পারি না। উপমা হিসেবে, কোথাও ‘আটকে পড়ার’ অর্থ হতে পারে আমাদের পথ একটি পাথর দ্বারা অবরুদ্ধ করা হয়েছে, যা অপসারণ করা প্রয়োজন। কিন্তু একটি বড় পাথর সরানোর জন্য, একজনকে কৌশলগত ভাবে দক্ষ হতে হবে; কিন্তু কিভাবে কৌশলগতভাবে দক্ষ হতে হবে? এখন যা প্রয়োজন তার সবকিছুর একসাথে পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশে প্রয়োজনীয় সমস্ত পরিবর্তন একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করা যাবে না। তবে কেউ এমন কিছু পরিবর্তন করতে পারে যা আমরা ‘লিভারেজ পয়েন্ট’ বলি, এটি আমেরিকান সিস্টেম তাত্ত্বিক ডোনেলা মিডোসের ব্যবহার করা জনপ্রিয় একটি শব্দ। লিভারেজ পয়েন্ট হচ্ছে সেই স্থান বা ক্ষেত্র যেখানে সামান্য প্রচেষ্টায় অনেক বেশি সুবিধা পাওয়া যায়। পূর্বে উল্লিখিত একটি পাথর অপসারণের প্রেক্ষাপটে, লিভারকে সমর্থন করে এমন একটি অবলম্বন বিন্দু (fulcrum) হলো একটি লিভারেজ পয়েন্ট; কিন্তু এটাই যথেষ্ট নয়। এটিকে সরানোর জন্য আমাদের কিছু সম্পদের প্রয়োজন। সম্পদ বিভিন্নভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। কৌশলটি হলো সমস্ত সম্পদকে এমনভাবে সারিবদ্ধ করা যাতে তারা একই দিকে এগিয়ে যায়। বাস্তবে লিভারেজ পয়েন্টে সম্পদকে জড় বা বিন্যস্থ করতে হবে। আমরা কি বাংলাদেশে লিভারেজ পয়েন্ট খুঁজে পেয়েছি, যাতে আমরা সেই পয়েন্টে এগিয়ে যাওয়ার জন্য আমাদের সম্পদকে ব্যবহার করতে পারি?
আমাদের কিছু গোয়েন্দা কাজের প্রয়োজন এই লিভারেজ পয়েন্ট কে খুঁজে বের করার জন্য। এটি করার জন্য, কাজের বাস্তবতা পরীক্ষা করা প্রয়োজন, এর অর্থ হলো কাজটি দেখা এবং শুরুতে কিছু ফলাফল যাচাই করা। চূড়ান্ত গন্তব্যের বিকল্প পথ চিহ্নিত করা, এর অর্থ লক্ষ্যের লক্ষ্য (goal of the goal) বিবেচনা করা। সেরা কাজটি বিশ্লেষণ এবং প্রতিলিপি করা। এই ভাবে একটি দেশ আলোকিত পথের সন্ধান পাবে। যদি কেউ এই আলোকিত পথের সন্ধান পায় তাহলে তার পরবর্তী প্রয়োজন হচ্ছে এই পথকে লক্ষ্য অর্জনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য বিশ্লেষণ করা। আলোকিত পথকে সর্বস্তরে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। কারণ এই পথ একটি দেশের নানাবিধ সমস্যার মধ্যে চাপা পড়ে থাকে তাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে দৃশ্যমান নয়। একজনকে সেগুলো খনন করতে হবে। একটি প্রতিষ্ঠানে আলোকিত স্থানের একটি উদাহরণ ধারণ (retention) হতে পারে। যদি ধরে রাখার হার কমে যায়, তবে এটি ভাল নয়। এই ধারণাটি একটি রাজনৈতিক পরিস্থিতিতেও ভাবা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, একটি রাজনৈতিক দলের সদস্যপদ ধরে রাখা সেই দলের দর্শন এবং তাদের গ্রহণযোগ্যতার সূচক হতে পারে। তবে একটি আলোকিত স্থান শনাক্তকরণের সাথে আরেকটি বিষয় যুক্ত তা হল সমস্ত বিভ্রান্তি দূর করা। এর অর্থ হলো- সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি বা সাংস্কৃতিক আদর্শের ওপর মনোযোগ দিতে হবে এবং আক্ষরিক অর্থেই অন্য সবকিছু বাদ দিতে হবে। আলোকিত দিকগুলি পরীক্ষা করে, আমরা সেই পরিস্থিতিগুলো শনাক্ত করতে পারি যা আমাদের সাফল্যের সুযোগ করে দেয় এবং যদি আমরা সেই পরিস্থিতিগুলো বুঝতে পারি, তাহলে আমরা সেগুলো প্রতিলিপি করতে পারি, যা আমাদের সাফল্য ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ করে দিতে পারি।
একটি কাক্সিক্ষত অগ্রগতি শক্তির দ্বারা আটকে যেতে পারে, এর অর্থ হলো সীমাবদ্ধতাকে লক্ষ্য করা প্রয়োজন। এটি লক্ষণীয় যে সীমাবদ্ধতাগুলো একটি লক্ষ্যের ওপর নির্ভরশীল। কারণ সীমাবদ্ধতাগুলো কেবল লক্ষ্যের প্রেক্ষাপটে অর্থবহ। এর যৌক্তিক ফলাফল হলো এই যে, যখন কেউ তাদের লক্ষ্য পরিবর্তন করে, তখন সীমাবদ্ধতাও পরিবর্তিত হয়। সুতরাং সীমাবদ্ধতা কী তা খুব বস্তুনিষ্ঠভাবে অন্বেষণ এবং পরীক্ষা করা গুরুত্বপূর্ণ, রাজনৈতিকভাবে নয়। আমাদের পুরো সিস্টেমের একটি মানচিত্র করতে হবে। রাজনৈতিক বা সামাজিক অস্থিরতার মতো কোন পাথর সরাতে সক্ষম হওয়ার জন্য পরিবেশের আলোকিত স্থান (bright spot) তন্ন তন্ন করে দেখা প্রয়োজন। এটি একজনকে একটি লিভারেজ পয়েন্ট শনাক্ত করতে সহায়তা করবে।
যাই হোক, যদি আমরা বলি যে, আমরা লিভারেজ পয়েন্ট খুঁজে পেয়েছি, তাহলে এর অর্থ হলো আমরা এমন কিছুতে মনোনিবেশ করেছি যা করা সম্ভব এবং করার যোগ্য। যখন আমরা লিভারেজ পয়েন্ট খুঁজে পাই তখন আমাদের লিভারেজ পয়েন্টে জমা করার জন্য সম্পদ খুঁজে বের করতে হবে। রিসেট করার অনুশীলন থেকে অভিজ্ঞতা এবং শেখার মাধ্যমে কাজকে ত্বরান্বিত করতে হবে। সাধারণভাবে একজন নেতা কোন সমস্যার সমাধান করতে হবে তা জানেন ভালো, কিন্তু তারা মানুষকে কীভাবে সমাধান করতে হবে তাও বলে দেন। এর অর্থ হলো কিছু নেতা বলবেনÑ ‘এটা করো, ওটা করো।’ কার্যকর ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে এটি একটি ‘নিম্ন স্বায়ত্তশাসন উচ্চ সারিবদ্ধকরণ’ (low autonomy but high alignment) পরিস্থিতি।
অন্যদিকে যখন আমরা ‘উচ্চ স্বায়ত্তশাসন কিন্তু নিম্ন সারিবদ্ধকরণ’ পরিস্থিতির কথা ভাবি, তখন দল যা ইচ্ছা তাই করতে পারে এবং মূলত বিভিন্ন দিকে দৌড়াতে পারে। শেষপর্যন্ত আমরা এমন একটি দেশ পাই যা ফ্রাঙ্কেনস্টাইনে পরিণত হয়। দক্ষিণ এশিয়ার কিছু দেশে যেমন বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কি এমনটা ঘটছে না? আমাদের আসলে ‘সারিবদ্ধ স্বায়ত্তশাসন’ প্রয়োজন। এর অর্থ হলো নেতারা কোন সমস্যাগুলো সমাধান করতে হবে তার ওপর মনোনিবেশ করবেন, কিন্তু দলগুলোকে কিভাবে এটি সমাধান করতে হবে তা খুঁজে বের করতে দিতে হবে। ‘সারিবদ্ধকরণ’ যত শক্তিশালী হবে, তত বেশি স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা সম্ভব হবে। এই মুহূর্তে উদাহরণস্বরূপ বাংলাদেশে আমরা যা দেখছি, এ ধরনের স্বায়ত্তশাসন সাশ্রয়ী নয়।
সুতরাং, ‘রিসেট’ শুধুমাত্র একটি শব্দ নয়। কেবল রিসেট করার জন্য একটি বোতাম টিপলে কাজ হবে না। একটি উন্নত বিশ্ব, একটি উন্নত দেশ এবং জনগণের উন্নত জীবনমান অর্জনের জন্য অণুপ্রেরণা গুরুত্বপূর্ণ। এ অণুপ্রেরণাকে কাজে লাগানোর জন্য জনগণের ‘প্রয়োজনীয়তা’ এবং ‘কাক্সিক্ষত’ বিষয়ের মধ্যে মিল খুঁজে বের করতে হবে। প্রেরণা অন্বেষণের পর ‘সারিবদ্ধ স্বায়ত্তশাসন’ একটি দেশকে রিসেট বা পুনর্গঠন করায় সহায়ক হতে পারে। মূলত আমার দৃষ্টিতে রিসেট বা পুনর্গঠনের অর্থ হলোÑ ‘সামঞ্জস্যপূর্ণ সারিবদ্ধ স্বায়ত্তশাসন।’ এই সারিবদ্ধতা (alignment) অবশ্যই ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং একটি ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সমাজের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে।
[লেখক : যুক্তরাজ্যে কর্মরত শিক্ষাবিদ]