alt

উপ-সম্পাদকীয়

শিশুদের আর্থিক অন্তর্ভুক্তি : স্কুল ব্যাংকিংয়ের সম্ভাবনা ও সংকট

মিহির কুমার রায়

: মঙ্গলবার, ১৭ জুন ২০২৫

২০১০ সালে দেশের স্কুলশিক্ষার্থীদের আর্থিক অন্তর্ভুক্তি ও আর্থিক সচেতনতা বাড়াতে বাংলাদেশ ব্যাংক স্কুল ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরু করে। ২০১১ সালে এ কার্যক্রমে টাকা জমার সুযোগ চালু হলে এটি আরও কার্যকর রূপ পায়। বর্তমানে দেশের ৬১টি তফসিলি ব্যাংকের মধ্যে ৫৯টি ব্যাংক স্কুল ব্যাংকিং চালু রেখেছে। ১১ থেকে ১৭ বছর বয়সি শিক্ষার্থীরা মাত্র ১০০ টাকা জমা রেখে অ্যাকাউন্ট খুলতে পারে। এতে ফি, চার্জ, ডেবিট কার্ড, ইন্টারনেট ব্যাংকিংসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ছাড় ও সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। স্কুল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে শিশুরা আর্থিক ব্যবস্থাপনায় অভ্যস্ত ও পারদর্শী হয়ে উঠছে, যা ভবিষ্যতে তাদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে।

তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে আমানতের পরিমাণ কমে যাওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ সতর্কবার্তা, যা সংশ্লিষ্ট মহলকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে উদ্বুদ্ধ করবেÑ এমনটাই প্রত্যাশা। দেশের মোট জনসংখ্যার একটি বড় অংশ শিক্ষার্থী। শুধু প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীই ৪ কোটির বেশি। এই বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীকে ব্যাংকিং কার্যক্রমের বাইরে রাখা অযৌক্তিক। বরং ছোটবেলা থেকেই সঞ্চয়ের মানসিকতা গড়ে তুললে ব্যক্তি, পরিবার ও রাষ্ট্রÑ সব পর্যায়ে অর্থনৈতিক ইতিবাচকতা সৃষ্টি হয়। এই ভাবনা থেকেই সরকার তথা বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকগুলোকে স্কুল ব্যাংকিং চালুর অনুমোদন দেয়।

স্কুল ব্যাংকিংয়ের লক্ষ্যÑ ১১ থেকে ১৭ বছর বয়সি শিক্ষার্থীরা, যাদের নিজস্ব কোনো আয় নেই। তারা সাধারণত মা-বাবা, ভাইবোন, আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেকে উৎসব বা বিশেষ উপলক্ষে উপহার হিসেবে কিছু অর্থ পায় কিংবা টিফিন বাবদ যে অর্থ পায়, তার কিছু অংশ বাঁচিয়ে সঞ্চয় হিসেবে জমা রাখার অভ্যাস গড়তে পারে। এ উদ্দেশ্যে স্কুলের নিকটস্থ ব্যাংক শাখায় একটি সেভিংস হিসাব খোলার সুযোগই স্কুল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে তৈরি করা হয়েছে। অনেক ব্যাংক শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করতে ‘ইয়ং স্টার’, ‘ফিউচার স্টার’, ‘প্রজন্ম স্টার’ ইত্যাদি আকর্ষণীয় নামে সঞ্চয় স্কিম চালু করেছে। স্বভাবতই এসব ছোট ছেলেমেয়ের মাঝে আগ্রহ তৈরি করছে।

তবে এখানেই থেমে থাকলে চলবে না। ব্যাংকগুলোকে ভাবতে হবেÑ আরও কী কী উদ্যোগ নেওয়া যায় শিক্ষার্থীদের জন্য। বাস্তবতা হলো, দেশে সঞ্চয়ের বিপরীতে সুদের হার খুবই কম। অথচ আমানত বাড়াতে হলে সুদের হার বাড়ানোর বিকল্প নেই বললেই চলে। এই আর্থিক নীতি সরকারেরÑবিশেষত অর্থ মন্ত্রণালয়েরÑ বিভিন্ন মহলে সমালোচিতও হচ্ছে। সেক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো চাইলে ক্ষুদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য সুদের বিকল্প কিছু প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে পারে। যেমন- বিশেষ ছাড়, পুরস্কার, বার্ষিক সঞ্চয় পুরস্কার বা শিক্ষাবিষয়ক ভর্তুকিমূলক সহায়তা।

অবশ্য কিছু ব্যাংক প্রতিবছর দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের আর্থিক সহায়তা ও বৃত্তি দিয়ে থাকে। এ সহায়তার পরিসর আরও বাড়ানো যেতে পারে। সংক্ষেপে বললে, শিশু-কিশোরদের সঞ্চয়ে আগ্রহী করতে এবং স্কুল ব্যাংকিংকে টেকসই করতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো আরও উদ্ভাবনী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে। এর মাধ্যমেই স্কুল ব্যাংকিং কার্যক্রম সফল ও অর্থবহ হয়ে উঠবে। একই সঙ্গে শিক্ষার্থীরা হাতে-কলমে ব্যাংকিং সম্পর্কে জানতে পারবে। আর সেই অভিজ্ঞতা ভবিষ্যতে তাদের উচ্চশিক্ষা ও পেশাজীবনে কাজে লাগবে।

তবে আশঙ্কার বিষয় হলোÑ চলতি বছরের প্রথম তিন মাসেই স্কুল ব্যাংকিংয়ের আওতায় আমানত কমেছে প্রায় ৬৩ কোটি টাকা। আর গত ৯ মাসে জমাকৃত অর্থ কমেছে ৩৩২ কোটি টাকারও বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এই উদ্বেগজনক তথ্য। অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের ব্যাংকিং চর্চা যত বাড়ছে, তাদের জমা রাখা অর্থ ততই কমছে, যা দেশের আর্থিক শিক্ষার অগ্রগতির ক্ষেত্রে এক বিপজ্জনক সংকেত।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুসারে, ২০২৪ সালের মার্চ শেষে দেশের স্কুল শিক্ষার্থীদের নামে ৪৪ লাখ ৭৯ হাজার ৭৮২টি অ্যাকাউন্ট খোলা রয়েছে। ডিসেম্বরের তুলনায় অ্যাকাউন্ট বেড়েছে ৫১ হাজারের বেশি, অথচ আমানত কমেছে ৬৩ কোটি ৩১ লাখ টাকা। গত ৯ মাসে অ্যাকাউন্ট বেড়েছে ৬৭ হাজার ৮৬৬টি, কিন্তু জমা কমেছে ৩৩১ কোটি ৩১ লাখ টাকা।

তথ্য বলছে, স্কুল ব্যাংকিংয়ে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় বেসরকারি ব্যাংকগুলো। তারা মার্চ পর্যন্ত খুলেছে ৩১ লাখ ৩৬ হাজার ১১৪টি হিসাব, যেখানে জমা রয়েছে ১ হাজার ৫৯০ কোটি ৭০ লাখ টাকা। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর হিসাব সংখ্যা ১১ লাখ ৪৮ হাজার ৫৪৭টি, জমার পরিমাণ ৪২২ কোটি ৩১ লাখ টাকা। বিশেষায়িত ব্যাংকগুলো খুলেছে ১ লাখ ৯২ হাজার ৪০৬টি হিসাব, যেখানে জমা রয়েছে ৫২ কোটি ২৮ লাখ টাকা। বিদেশি ব্যাংকগুলোর হিসাব মাত্র ২ হাজার ৭১৫টি, জমা ৯ কোটি ৩৯ লাখ টাকা।

লিঙ্গভিত্তিক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এই অন্তর্ভুক্তিমূলক কার্যক্রমে ছেলেরা এগিয়ে। মোট হিসাবের ৫১ শতাংশ ছেলেদের নামে, যা ২২ লাখ ৮৫ হাজার ৮১টি; আর আমানতের প্রায় ৪৯ শতাংশ তাদের নামে। সবচেয়ে এগিয়ে থাকা পাঁচটি ব্যাংকের মধ্যে রয়েছে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক (৫.৫ লাখ অ্যাকাউন্ট), ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ (৩.৭ লাখ), অগ্রণী ব্যাংক (২.৬ লাখ), এশিয়া ব্যাংক (১.৯ লাখ) এবং রূপালী ব্যাংক (১.৬ লাখ)।

এই পতনশীল আমানতের পেছনে যে কারণগুলো চিহ্নিত করা হচ্ছে, তার মধ্যে রয়েছেÑ দেশের দীর্ঘমেয়াদি উচ্চ মূল্যস্ফীতি, জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি এবং ব্যাংকিং খাতের প্রতি আস্থাহানি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বেতন, বই, ইউনিফর্ম ইত্যাদি খরচ বেড়ে যাওয়ায় অভিভাবকেরা বাধ্য হয়ে শিক্ষার্থীর অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তুলে নিচ্ছেন। একই সঙ্গে, বিগত সময়ে প্রকাশ পাওয়া ব্যাংক খাতের অনিয়ম মানুষের বিশ্বাসে ধস নামিয়েছে। এছাড়া বছরের শুরু ও শেষে ছুটি বাড়ায় অনেক শিক্ষার্থী ভ্রমণে যায়, সেখানেও খরচ বেড়ে যাচ্ছে।

তবে এই ব্যাখ্যাগুলো যতই যৌক্তিক হোক না কেন, স্কুল ব্যাংকিংয়ের মূল লক্ষ্য যেন হারিয়ে না যায়Ñ তা নিশ্চিত করতে হবে। এই কার্যক্রমের প্রবৃদ্ধি ও গ্রহণযোগ্যতা দিনদিন বাড়ছেÑ তবে তা দীর্ঘমেয়াদে টেকসই রাখতে হলে প্রয়োজন বাংলাদেশ ব্যাংকের আরও সক্রিয় ও দূরদর্শী ভূমিকা। একই সঙ্গে, অংশগ্রহণকারী ব্যাংকগুলোকেও শিশু-কিশোরদের অর্থনীতির অংশীদার হিসেবে বিবেচনা করতে হবে, নিছক ‘সামাজিক দায়বদ্ধতা’ কার্যক্রম হিসেবে নয়।

শিশু-কিশোরদের সঞ্চয়ের অভ্যাস, ব্যাংকিং শিক্ষায় আগ্রহ ও ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করার এ উদ্যোগকে আরও সুসংহত, আকর্ষণীয় ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করে গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি।

[লেখক : সাবেক ডিন (ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ) ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা]

ব্যাকবেঞ্চারদের পৃথিবী : ব্যর্থতার গায়ে সাফল্যের ছাপ

আমের অ্যানথ্রাকনোজ ও বোঁটা পঁচা রোগ

প্রশিক্ষণ থেকে কেন বাদ নারী কৃষকরা?

ইরান-ইসরায়েল সংঘাত ও বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া

লই গো বুক পেতে অনল-বাণ!

সরকারি হাসপাতালের পরিবেশ

আমেরিকার অলিগার্কি পতনের আখ্যান

রম্যগদ্য : ‘উহু উহু, তোরে মাফ করা যায় না...’

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম বাজেট : সংকোচন, সংকট ও সম্ভাবনার প্রতিফলন

আম রপ্তানি : বাস্তবতা ও চ্যালেঞ্জ

ছবি

সামাজিকমাধ্যম গুরুত্বহীন নয়

জমির শ্রেণী চেনার উপায় ও পরিবর্তনের নিয়ম-কানুন

বাংলাদেশ : “রক্তে জন্ম আর পানিতে মরণ”

নতুন নোট, নতুন বিতর্ক

রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের হতাশা ও উপজেলা পর্যায়ের অদক্ষতা : কে নেবে দায়িত্ব?

তরল সম্পর্কের গোলকধাঁধা

পরিবার থেকে রাষ্ট্র : ন্যায়ভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের উপায়

বাজেটে বৈষম্য কমানোর কোনো স্পষ্ট প্রতিফলন আছে কি

চোখের নজর কম হলে আর কাজল দিয়ে কী হবে

রম্যগদ্য : ‘নির্বাচন, না নীর-বচন...’

প্লাস্টিক দূষণ নয়, প্রকৃতির পাশে দাঁড়ান

কোরবানির পর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা

ত্যাগের মহিমায় ঈদুল আজহা

নাম ও মর্যাদা : অর্থবহ নামকরণে বৈষম্য রোধের আহ্বান

ডিজিটাল পুঁজিবাদের যুগে নগর বাংলাদেশের শ্রেণী কাঠামো

পারিবারিক শিক্ষা ও রাষ্ট্রসংস্কার : ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনের পথরেখা

প্রসঙ্গ : রাজধানীর যানজট

নবায়নযোগ্য জ্বালানি : চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

ছবি

তাহলে একাত্তরে হয়নিকো কোনো অপরাধ!

ঈদযাত্রা হোক নিরাপদ

আমেরিকার মধ্যপ্রাচ্য কৌশলে বাস্তববাদী বাঁক

রম্যগদ্য : ‘জনগণের ভালোবাসা কি আমার ব্যাংক-ব্যালেন্স বাড়াইবো?’

ভালো থাকার কঠিন কলা : কিছু সরল সত্য

নীরব ঘাতক তামাক

পরিবেশবান্ধব নগর গঠনে রাজনীতিবিদদের ভূমিকা

নিয়ন্ত্রণহীন নেটজগৎ ও ফেইসবুক : সমাজে বিভ্রান্তির ডিজিটাল উৎপত্তি

tab

উপ-সম্পাদকীয়

শিশুদের আর্থিক অন্তর্ভুক্তি : স্কুল ব্যাংকিংয়ের সম্ভাবনা ও সংকট

মিহির কুমার রায়

মঙ্গলবার, ১৭ জুন ২০২৫

২০১০ সালে দেশের স্কুলশিক্ষার্থীদের আর্থিক অন্তর্ভুক্তি ও আর্থিক সচেতনতা বাড়াতে বাংলাদেশ ব্যাংক স্কুল ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরু করে। ২০১১ সালে এ কার্যক্রমে টাকা জমার সুযোগ চালু হলে এটি আরও কার্যকর রূপ পায়। বর্তমানে দেশের ৬১টি তফসিলি ব্যাংকের মধ্যে ৫৯টি ব্যাংক স্কুল ব্যাংকিং চালু রেখেছে। ১১ থেকে ১৭ বছর বয়সি শিক্ষার্থীরা মাত্র ১০০ টাকা জমা রেখে অ্যাকাউন্ট খুলতে পারে। এতে ফি, চার্জ, ডেবিট কার্ড, ইন্টারনেট ব্যাংকিংসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ছাড় ও সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। স্কুল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে শিশুরা আর্থিক ব্যবস্থাপনায় অভ্যস্ত ও পারদর্শী হয়ে উঠছে, যা ভবিষ্যতে তাদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে।

তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে আমানতের পরিমাণ কমে যাওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ সতর্কবার্তা, যা সংশ্লিষ্ট মহলকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে উদ্বুদ্ধ করবেÑ এমনটাই প্রত্যাশা। দেশের মোট জনসংখ্যার একটি বড় অংশ শিক্ষার্থী। শুধু প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীই ৪ কোটির বেশি। এই বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীকে ব্যাংকিং কার্যক্রমের বাইরে রাখা অযৌক্তিক। বরং ছোটবেলা থেকেই সঞ্চয়ের মানসিকতা গড়ে তুললে ব্যক্তি, পরিবার ও রাষ্ট্রÑ সব পর্যায়ে অর্থনৈতিক ইতিবাচকতা সৃষ্টি হয়। এই ভাবনা থেকেই সরকার তথা বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকগুলোকে স্কুল ব্যাংকিং চালুর অনুমোদন দেয়।

স্কুল ব্যাংকিংয়ের লক্ষ্যÑ ১১ থেকে ১৭ বছর বয়সি শিক্ষার্থীরা, যাদের নিজস্ব কোনো আয় নেই। তারা সাধারণত মা-বাবা, ভাইবোন, আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেকে উৎসব বা বিশেষ উপলক্ষে উপহার হিসেবে কিছু অর্থ পায় কিংবা টিফিন বাবদ যে অর্থ পায়, তার কিছু অংশ বাঁচিয়ে সঞ্চয় হিসেবে জমা রাখার অভ্যাস গড়তে পারে। এ উদ্দেশ্যে স্কুলের নিকটস্থ ব্যাংক শাখায় একটি সেভিংস হিসাব খোলার সুযোগই স্কুল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে তৈরি করা হয়েছে। অনেক ব্যাংক শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করতে ‘ইয়ং স্টার’, ‘ফিউচার স্টার’, ‘প্রজন্ম স্টার’ ইত্যাদি আকর্ষণীয় নামে সঞ্চয় স্কিম চালু করেছে। স্বভাবতই এসব ছোট ছেলেমেয়ের মাঝে আগ্রহ তৈরি করছে।

তবে এখানেই থেমে থাকলে চলবে না। ব্যাংকগুলোকে ভাবতে হবেÑ আরও কী কী উদ্যোগ নেওয়া যায় শিক্ষার্থীদের জন্য। বাস্তবতা হলো, দেশে সঞ্চয়ের বিপরীতে সুদের হার খুবই কম। অথচ আমানত বাড়াতে হলে সুদের হার বাড়ানোর বিকল্প নেই বললেই চলে। এই আর্থিক নীতি সরকারেরÑবিশেষত অর্থ মন্ত্রণালয়েরÑ বিভিন্ন মহলে সমালোচিতও হচ্ছে। সেক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো চাইলে ক্ষুদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য সুদের বিকল্প কিছু প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে পারে। যেমন- বিশেষ ছাড়, পুরস্কার, বার্ষিক সঞ্চয় পুরস্কার বা শিক্ষাবিষয়ক ভর্তুকিমূলক সহায়তা।

অবশ্য কিছু ব্যাংক প্রতিবছর দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের আর্থিক সহায়তা ও বৃত্তি দিয়ে থাকে। এ সহায়তার পরিসর আরও বাড়ানো যেতে পারে। সংক্ষেপে বললে, শিশু-কিশোরদের সঞ্চয়ে আগ্রহী করতে এবং স্কুল ব্যাংকিংকে টেকসই করতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো আরও উদ্ভাবনী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে। এর মাধ্যমেই স্কুল ব্যাংকিং কার্যক্রম সফল ও অর্থবহ হয়ে উঠবে। একই সঙ্গে শিক্ষার্থীরা হাতে-কলমে ব্যাংকিং সম্পর্কে জানতে পারবে। আর সেই অভিজ্ঞতা ভবিষ্যতে তাদের উচ্চশিক্ষা ও পেশাজীবনে কাজে লাগবে।

তবে আশঙ্কার বিষয় হলোÑ চলতি বছরের প্রথম তিন মাসেই স্কুল ব্যাংকিংয়ের আওতায় আমানত কমেছে প্রায় ৬৩ কোটি টাকা। আর গত ৯ মাসে জমাকৃত অর্থ কমেছে ৩৩২ কোটি টাকারও বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এই উদ্বেগজনক তথ্য। অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের ব্যাংকিং চর্চা যত বাড়ছে, তাদের জমা রাখা অর্থ ততই কমছে, যা দেশের আর্থিক শিক্ষার অগ্রগতির ক্ষেত্রে এক বিপজ্জনক সংকেত।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুসারে, ২০২৪ সালের মার্চ শেষে দেশের স্কুল শিক্ষার্থীদের নামে ৪৪ লাখ ৭৯ হাজার ৭৮২টি অ্যাকাউন্ট খোলা রয়েছে। ডিসেম্বরের তুলনায় অ্যাকাউন্ট বেড়েছে ৫১ হাজারের বেশি, অথচ আমানত কমেছে ৬৩ কোটি ৩১ লাখ টাকা। গত ৯ মাসে অ্যাকাউন্ট বেড়েছে ৬৭ হাজার ৮৬৬টি, কিন্তু জমা কমেছে ৩৩১ কোটি ৩১ লাখ টাকা।

তথ্য বলছে, স্কুল ব্যাংকিংয়ে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় বেসরকারি ব্যাংকগুলো। তারা মার্চ পর্যন্ত খুলেছে ৩১ লাখ ৩৬ হাজার ১১৪টি হিসাব, যেখানে জমা রয়েছে ১ হাজার ৫৯০ কোটি ৭০ লাখ টাকা। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর হিসাব সংখ্যা ১১ লাখ ৪৮ হাজার ৫৪৭টি, জমার পরিমাণ ৪২২ কোটি ৩১ লাখ টাকা। বিশেষায়িত ব্যাংকগুলো খুলেছে ১ লাখ ৯২ হাজার ৪০৬টি হিসাব, যেখানে জমা রয়েছে ৫২ কোটি ২৮ লাখ টাকা। বিদেশি ব্যাংকগুলোর হিসাব মাত্র ২ হাজার ৭১৫টি, জমা ৯ কোটি ৩৯ লাখ টাকা।

লিঙ্গভিত্তিক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এই অন্তর্ভুক্তিমূলক কার্যক্রমে ছেলেরা এগিয়ে। মোট হিসাবের ৫১ শতাংশ ছেলেদের নামে, যা ২২ লাখ ৮৫ হাজার ৮১টি; আর আমানতের প্রায় ৪৯ শতাংশ তাদের নামে। সবচেয়ে এগিয়ে থাকা পাঁচটি ব্যাংকের মধ্যে রয়েছে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক (৫.৫ লাখ অ্যাকাউন্ট), ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ (৩.৭ লাখ), অগ্রণী ব্যাংক (২.৬ লাখ), এশিয়া ব্যাংক (১.৯ লাখ) এবং রূপালী ব্যাংক (১.৬ লাখ)।

এই পতনশীল আমানতের পেছনে যে কারণগুলো চিহ্নিত করা হচ্ছে, তার মধ্যে রয়েছেÑ দেশের দীর্ঘমেয়াদি উচ্চ মূল্যস্ফীতি, জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি এবং ব্যাংকিং খাতের প্রতি আস্থাহানি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বেতন, বই, ইউনিফর্ম ইত্যাদি খরচ বেড়ে যাওয়ায় অভিভাবকেরা বাধ্য হয়ে শিক্ষার্থীর অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তুলে নিচ্ছেন। একই সঙ্গে, বিগত সময়ে প্রকাশ পাওয়া ব্যাংক খাতের অনিয়ম মানুষের বিশ্বাসে ধস নামিয়েছে। এছাড়া বছরের শুরু ও শেষে ছুটি বাড়ায় অনেক শিক্ষার্থী ভ্রমণে যায়, সেখানেও খরচ বেড়ে যাচ্ছে।

তবে এই ব্যাখ্যাগুলো যতই যৌক্তিক হোক না কেন, স্কুল ব্যাংকিংয়ের মূল লক্ষ্য যেন হারিয়ে না যায়Ñ তা নিশ্চিত করতে হবে। এই কার্যক্রমের প্রবৃদ্ধি ও গ্রহণযোগ্যতা দিনদিন বাড়ছেÑ তবে তা দীর্ঘমেয়াদে টেকসই রাখতে হলে প্রয়োজন বাংলাদেশ ব্যাংকের আরও সক্রিয় ও দূরদর্শী ভূমিকা। একই সঙ্গে, অংশগ্রহণকারী ব্যাংকগুলোকেও শিশু-কিশোরদের অর্থনীতির অংশীদার হিসেবে বিবেচনা করতে হবে, নিছক ‘সামাজিক দায়বদ্ধতা’ কার্যক্রম হিসেবে নয়।

শিশু-কিশোরদের সঞ্চয়ের অভ্যাস, ব্যাংকিং শিক্ষায় আগ্রহ ও ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করার এ উদ্যোগকে আরও সুসংহত, আকর্ষণীয় ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করে গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি।

[লেখক : সাবেক ডিন (ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ) ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা]

back to top