বাবুল রবিদাস
শিশুরা যখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাতায়াত শুরু করে, তখন প্রথম শ্রেণির পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হতে হয়। পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর শিক্ষার্থীরা রোল নম্বর অনুযায়ী প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয় হয়ে ওঠে। এরপর শুরু হয় দ্বিতীয় শ্রেণির ক্লাস। এ সময়ই একটি শিক্ষামূলক গান আমাদের মনে পড়েÑ ‘হারজিত চিরদিন থাকবে, তবুও এগিয়ে যেতেই হবে। কে প্রথম আর কে দ্বিতীয় ভাবছো কেন বসে?’
আমাদের স্কুলপদ্ধতি এমনই, যেখানে ধনী-গরিব, দলিত-বঞ্চিত, শ্রমিক-মজদুরÑ সব পরিবারের সন্তানেরাই সমানভাবে অংশ নেয়। ধনী ঘরের পিতা-মাতারা সচেতনভাবে সন্তানকে শৈশব থেকেই নৈতিকতা, উপদেশমূলক গল্প ও জ্ঞানভিত্তিক উপন্যাসের সঙ্গে পরিচিত করান। তারা সন্তানের সঙ্গে পড়ালেখা মিলিয়ে গল্প বলেন, উৎসাহ দেন। এতে সন্তানরা শৈশবেই একটি সহায়ক পরিবেশে বেড়ে ওঠে এবং শিক্ষকের পাঠদানের সঙ্গে অভিভাবকীয় সহায়তা যুক্ত হয়ে যায়।
অন্যদিকে দলিত-বঞ্চিত বা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অভিভাবকেরা হয়তো নিজেই শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। ফলে তারা সন্তানকে পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি গল্প বা জীবনঘনিষ্ঠ চিন্তার খোরাক দিতে পারেন না। এ কারণে এসব শিশু স্কুলে গিয়ে নতুন ও প্রতিকূল এক বাস্তবতার মুখোমুখি হয়। সেখানে অন্যদের হাসাহাসি, বিদ্রƒপ ও অবজ্ঞার মুখে তাদের আত্মবিশ্বাস ভেঙে পড়ে। তারা মনে করে, এই পরিবেশ তাদের জন্য নয়। ফলে ধীরে ধীরে তারা শ্রেণিকক্ষে পেছনের বেঞ্চে চলে যায়।
তবে এখানেই থেমে যায় না গল্প। আত্মবিশ্বাস না থাকলেও এই শিশুদের মধ্যে অনেকেই ধৈর্য ধরে এগিয়ে যেতে থাকে। তারা জানে পরিশ্রমের কোনো বিকল্প নেই। সময়ের ব্যবধানে দেখা যায়, পেছনের বেঞ্চে বসা এসব শিক্ষার্থীই একদিন সফল ও বিখ্যাত হয়ে ওঠে। যেমনটি বলা হয়Ñ ‘ধীর স্থির লোক দৌড়ে জিতে।’
বিশ্বজুড়ে গবেষণা, জরিপ ও পরিসংখ্যানে দেখা যায়, অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী স্কুলে অঙ্ক, বিজ্ঞান বা অর্থনীতির জটিল সমস্যায় হোঁচট খেয়ে ফেল করেছে। কিন্তু পরবর্তীতে তারাই অধ্যবসায়, ধৈর্য ও সময়ের সঠিক ব্যবহারে কর্মক্ষেত্রে অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছে। তাদের জন্য তখন আর পরীক্ষার নম্বর, ফলাফল বা সার্টিফিকেটের প্রয়োজন হয়নি।
এ প্রসঙ্গে উঠে আসে ভারতের খ্যাতনামা হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ দেবী শেঠির নাম। ক্লাস টু-তে ফেল করা এই শিক্ষার্থীকে তাঁর শিক্ষকরা একসময় বলেছিলেন, ‘তুমি তো ব্যর্থ।’ তিনি ছিলেন পুরো ক্লাসে একমাত্র ফেল করা ছাত্র। কিন্তু তিনি হাল ছাড়েননি। মেডিকেল কলেজে প্রথম দফায় সুযোগ না পেলেও দ্বিতীয় দফায় ভর্তি হন। শুরুটা কঠিন ছিল, বহুবার হোঁচট খেয়েছেন, কিন্তু থেমে থাকেননি। বরং তিনি সংকল্প করেছিলেন, হার্ট সার্জন হবেন। পরীক্ষার ভয়, খারাপ ফল, এসব কিছুই তাকে দমাতে পারেনি। তার কথায়, পরিশ্রম, অধ্যবসায় ও ধৈর্য থাকলে সাফল্য আসবেই। তিনি আজ শুধু একজন চিকিৎসক নন, একজন অনুপ্রেরণার মানুষ।
এমন উদাহরণ আরেকটি হলো জ্যাক মা। চীনের এই উদ্যোক্তা আজ বিশ্বের ৩৩তম ধনী ব্যক্তি। অথচ তিনিও ব্যাকবেঞ্চার ছিলেন। প্রাথমিক পরীক্ষায় দুইবার, মাধ্যমিকে তিনবার, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় তিনবার ফেল করেছিলেন। চাকরির পরীক্ষায় ৩০ বার ব্যর্থ হন। এমনকি কেএফসিতে যখন ২৪ জন আবেদন করেছিলেন, তখন ২৩ জনের চাকরি হয়, শুধু তিনিই বাদ পড়েন। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০ বার আবেদন করে প্রত্যাখ্যাত হন। তবুও জ্যাক মা হাল ছাড়েননি।
এমন কাহিনী আমাদের শেখায়Ñ ‘পারিবো না কথাটি বলিও না আর। একবার না পারিলে দেখো শতবার।’ আমাদের সমাজে শিক্ষার্থীরা দুই-একবার ফেল করলেই হাল ছেড়ে দেয়। অথচ জ্যাক মা দশবার ব্যর্থ হয়েও এগিয়ে গেছেন। তিনি ভাগ্যের মুখাপেক্ষী ছিলেন না, বরং চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে লড়াই চালিয়ে গেছেন।
এই ব্যাকবেঞ্চারদের তালিকায় আরও রয়েছেনÑ রিচার্ড ব্র্যানসন, সায়মন কোয়েল, বেনেডিক্ট কাম্বারব্যাচ, জে কে রাউলিং, জ্যাক মা প্রমুখ। তারা সবাই পরীক্ষায় ফেল করেছেন, কিন্তু জীবন-পরীক্ষায় পাশ করে দেখিয়েছেন, সাফল্য নম্বরের নয়, মানসিক দৃঢ়তার।
শিক্ষার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত কেবল ভালো নম্বর নয়, বরং ব্যক্তিত্ব গঠন, আত্মবিশ্বাস অর্জন এবং বাস্তব জীবনে সফল হওয়া। তাই অভিভাবক, শিক্ষক ও সমাজÑ সবাইকে মনে রাখতে হবে, যে শিশুটি হয়তো এখন পিছিয়ে আছে, সে-ই একদিন পৃথিবী জয় করতে পারে।
সুতরাং ফেল করলেই জীবন শেষ নয়। ব্যর্থতা মানেই পরাজয় নয়। জীবন একটি যুদ্ধ এবং যুদ্ধ মানেই সামনে এগিয়ে যাওয়া। পেছনের বেঞ্চের শিক্ষার্থীরাও একদিন হয়ে উঠতে পারে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষ। আমাদের দায়িত্ব, তাদের সেই পথে এগিয়ে নিতে সহায়তা করা।
[লেখক : আইনজীবী, জজ কোর্ট, জয়পুরহাট]
বাবুল রবিদাস
মঙ্গলবার, ১৭ জুন ২০২৫
শিশুরা যখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাতায়াত শুরু করে, তখন প্রথম শ্রেণির পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হতে হয়। পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর শিক্ষার্থীরা রোল নম্বর অনুযায়ী প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয় হয়ে ওঠে। এরপর শুরু হয় দ্বিতীয় শ্রেণির ক্লাস। এ সময়ই একটি শিক্ষামূলক গান আমাদের মনে পড়েÑ ‘হারজিত চিরদিন থাকবে, তবুও এগিয়ে যেতেই হবে। কে প্রথম আর কে দ্বিতীয় ভাবছো কেন বসে?’
আমাদের স্কুলপদ্ধতি এমনই, যেখানে ধনী-গরিব, দলিত-বঞ্চিত, শ্রমিক-মজদুরÑ সব পরিবারের সন্তানেরাই সমানভাবে অংশ নেয়। ধনী ঘরের পিতা-মাতারা সচেতনভাবে সন্তানকে শৈশব থেকেই নৈতিকতা, উপদেশমূলক গল্প ও জ্ঞানভিত্তিক উপন্যাসের সঙ্গে পরিচিত করান। তারা সন্তানের সঙ্গে পড়ালেখা মিলিয়ে গল্প বলেন, উৎসাহ দেন। এতে সন্তানরা শৈশবেই একটি সহায়ক পরিবেশে বেড়ে ওঠে এবং শিক্ষকের পাঠদানের সঙ্গে অভিভাবকীয় সহায়তা যুক্ত হয়ে যায়।
অন্যদিকে দলিত-বঞ্চিত বা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অভিভাবকেরা হয়তো নিজেই শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। ফলে তারা সন্তানকে পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি গল্প বা জীবনঘনিষ্ঠ চিন্তার খোরাক দিতে পারেন না। এ কারণে এসব শিশু স্কুলে গিয়ে নতুন ও প্রতিকূল এক বাস্তবতার মুখোমুখি হয়। সেখানে অন্যদের হাসাহাসি, বিদ্রƒপ ও অবজ্ঞার মুখে তাদের আত্মবিশ্বাস ভেঙে পড়ে। তারা মনে করে, এই পরিবেশ তাদের জন্য নয়। ফলে ধীরে ধীরে তারা শ্রেণিকক্ষে পেছনের বেঞ্চে চলে যায়।
তবে এখানেই থেমে যায় না গল্প। আত্মবিশ্বাস না থাকলেও এই শিশুদের মধ্যে অনেকেই ধৈর্য ধরে এগিয়ে যেতে থাকে। তারা জানে পরিশ্রমের কোনো বিকল্প নেই। সময়ের ব্যবধানে দেখা যায়, পেছনের বেঞ্চে বসা এসব শিক্ষার্থীই একদিন সফল ও বিখ্যাত হয়ে ওঠে। যেমনটি বলা হয়Ñ ‘ধীর স্থির লোক দৌড়ে জিতে।’
বিশ্বজুড়ে গবেষণা, জরিপ ও পরিসংখ্যানে দেখা যায়, অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী স্কুলে অঙ্ক, বিজ্ঞান বা অর্থনীতির জটিল সমস্যায় হোঁচট খেয়ে ফেল করেছে। কিন্তু পরবর্তীতে তারাই অধ্যবসায়, ধৈর্য ও সময়ের সঠিক ব্যবহারে কর্মক্ষেত্রে অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছে। তাদের জন্য তখন আর পরীক্ষার নম্বর, ফলাফল বা সার্টিফিকেটের প্রয়োজন হয়নি।
এ প্রসঙ্গে উঠে আসে ভারতের খ্যাতনামা হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ দেবী শেঠির নাম। ক্লাস টু-তে ফেল করা এই শিক্ষার্থীকে তাঁর শিক্ষকরা একসময় বলেছিলেন, ‘তুমি তো ব্যর্থ।’ তিনি ছিলেন পুরো ক্লাসে একমাত্র ফেল করা ছাত্র। কিন্তু তিনি হাল ছাড়েননি। মেডিকেল কলেজে প্রথম দফায় সুযোগ না পেলেও দ্বিতীয় দফায় ভর্তি হন। শুরুটা কঠিন ছিল, বহুবার হোঁচট খেয়েছেন, কিন্তু থেমে থাকেননি। বরং তিনি সংকল্প করেছিলেন, হার্ট সার্জন হবেন। পরীক্ষার ভয়, খারাপ ফল, এসব কিছুই তাকে দমাতে পারেনি। তার কথায়, পরিশ্রম, অধ্যবসায় ও ধৈর্য থাকলে সাফল্য আসবেই। তিনি আজ শুধু একজন চিকিৎসক নন, একজন অনুপ্রেরণার মানুষ।
এমন উদাহরণ আরেকটি হলো জ্যাক মা। চীনের এই উদ্যোক্তা আজ বিশ্বের ৩৩তম ধনী ব্যক্তি। অথচ তিনিও ব্যাকবেঞ্চার ছিলেন। প্রাথমিক পরীক্ষায় দুইবার, মাধ্যমিকে তিনবার, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় তিনবার ফেল করেছিলেন। চাকরির পরীক্ষায় ৩০ বার ব্যর্থ হন। এমনকি কেএফসিতে যখন ২৪ জন আবেদন করেছিলেন, তখন ২৩ জনের চাকরি হয়, শুধু তিনিই বাদ পড়েন। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০ বার আবেদন করে প্রত্যাখ্যাত হন। তবুও জ্যাক মা হাল ছাড়েননি।
এমন কাহিনী আমাদের শেখায়Ñ ‘পারিবো না কথাটি বলিও না আর। একবার না পারিলে দেখো শতবার।’ আমাদের সমাজে শিক্ষার্থীরা দুই-একবার ফেল করলেই হাল ছেড়ে দেয়। অথচ জ্যাক মা দশবার ব্যর্থ হয়েও এগিয়ে গেছেন। তিনি ভাগ্যের মুখাপেক্ষী ছিলেন না, বরং চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে লড়াই চালিয়ে গেছেন।
এই ব্যাকবেঞ্চারদের তালিকায় আরও রয়েছেনÑ রিচার্ড ব্র্যানসন, সায়মন কোয়েল, বেনেডিক্ট কাম্বারব্যাচ, জে কে রাউলিং, জ্যাক মা প্রমুখ। তারা সবাই পরীক্ষায় ফেল করেছেন, কিন্তু জীবন-পরীক্ষায় পাশ করে দেখিয়েছেন, সাফল্য নম্বরের নয়, মানসিক দৃঢ়তার।
শিক্ষার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত কেবল ভালো নম্বর নয়, বরং ব্যক্তিত্ব গঠন, আত্মবিশ্বাস অর্জন এবং বাস্তব জীবনে সফল হওয়া। তাই অভিভাবক, শিক্ষক ও সমাজÑ সবাইকে মনে রাখতে হবে, যে শিশুটি হয়তো এখন পিছিয়ে আছে, সে-ই একদিন পৃথিবী জয় করতে পারে।
সুতরাং ফেল করলেই জীবন শেষ নয়। ব্যর্থতা মানেই পরাজয় নয়। জীবন একটি যুদ্ধ এবং যুদ্ধ মানেই সামনে এগিয়ে যাওয়া। পেছনের বেঞ্চের শিক্ষার্থীরাও একদিন হয়ে উঠতে পারে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষ। আমাদের দায়িত্ব, তাদের সেই পথে এগিয়ে নিতে সহায়তা করা।
[লেখক : আইনজীবী, জজ কোর্ট, জয়পুরহাট]