আনোয়ারুল হক
তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মো. মাহফুজ আলমের দু’দিন আগের এক বক্তব্য শুনে কিছু লিখতে ভয় লাগে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিবকে পাশে নিয়ে তিনি বললেন, ‘সাংবাদিক পরিচয়ে বা বিভিন্ন পরিচয়ে,... ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে বড় বড় কথা বলতেছে। ওই সাহস কোথায় ছিল গত ১৫ বছরে?’ এই প্রশ্ন শুনে আমার মনে হলো আসলেই তো গত ১৫ বছরে কখনো কিছু লিখি নাই। গোটা জীবনেই লেখালেখি আর পড়াশোনা করার অভ্যাস ছিলো না। শেষ জীবনে এসে কেনো যে ভিমরতী হলো! এর প্রধান দায়ও কিন্তু মাহফুজ আলমের।
অনেকেই মনে করেন, দেশে সনদ, সংবিধান, আইনি সুরক্ষা ইত্যাদি অনেক সময় কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ থাকে; বাস্তব রাজনীতির মাঠে এর প্রভাব তেমন থাকে না। রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকলে আইনি কাঠামোর মাধ্যমে সবকিছু করিয়ে ফেলা যায় না। অতীতেও এভাবে সফল হওয়া যায়নি। যে সনদ নিয়ে এতো বিতর্ক এবং সংস্কার সংস্কার করে যারা জানপ্রাণ কোরবান করছেন তারাও এটা খুব ভালো করে জানেন।
৫ আগস্টের পরে ‘জুলাই গণপরিসর’ শীর্ষক এক আলোচনায় তার ‘দায় ও দরদের’ সমাজ গড়ে তোলার আলোচনা শুনে বিমোহিত হয়েছিলাম। তার এবং জুলাই আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় আরো ক’জনার বক্তব্য শুনে নিজের চিন্তাভাবনাকেও নবায়ন করার চেষ্টা থেকে লেখালেখির একটা প্রচেষ্টা শুরু করি। যদিও মাহফুজ আলম ও তার সঙ্গীসাথীরা দ্রুতই তাদের বক্তব্য থেকে ইউটার্নে চলে যান। তবে আমার লেখার প্রচেষ্টা আরো গতি পেলো ড. ইউনূসের এক বক্তৃতা শুনে। ইউনূস সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘মন খুলে আমাদের সমালোচনা করবেন। সমালোচনা না করলে বুঝবো কীভাবে কোথায় ভুল হচ্ছে’। এখন ইউনূসের বা তার সরকারের সমালোচনাকে তথ্য উপদেষ্টা বলছেন ‘বড়ো বড়ো কথা বলা হচ্ছে‘। অথচ নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে সরকারের বিরুদ্ধে বড়ো বড়ো কথা সাংবাদিক বা টকশোতে অংশগ্রহণকারীদের অপেক্ষা সরকার ঘনিষ্ঠ এনসিপি এবং জামাতই বেশি বলছে। লন্ডন বৈঠকের পর থেকে বরং বিএনপি একটু সফট এবং প্রধান উপদেষ্টা ও এনসিপির সাথে একত্রে বিশ্ব সভায় অংশ নিয়ে আসার পর থেকে আরো সফট প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করছে। কোনো রকমে পরিস্থিতিটা নির্বাচনের দিকে নেওয়াই সম্ভবত বিএনপির কৌশল। তাই অপছন্দের অনেক কিছু থাকলেও সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টার পাশে মির্জা ফখরুল হাস্যোজ্জ্বল থাকার চেষ্টা করেছেন।
অনেকেই মনে করেন, দেশে সনদ, সংবিধান, আইনি সুরক্ষা ইত্যাদি অনেক সময় কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ থাকে; বাস্তব রাজনীতির মাঠে এর প্রভাব তেমন থাকে না। রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকলে আইনি কাঠামোর মাধ্যমে সবকিছু করিয়ে ফেলা যায় না। অতীতেও এভাবে সফল হওয়া যায়নি। যে সনদ নিয়ে এতো বিতর্ক এবং সংস্কার সংস্কার করে যারা জানপ্রাণ কোরবান করছেন তারাও এটা খুব ভালো করে জানেন। তাদের রাজনৈতিক বক্তৃতা-বিবৃতি, রাজনৈতিক আচরণ-অভ্যাস পর্যবেক্ষণ করলেই বুঝা যায় সনদ- সংস্কার ‘বাত কি বাত’। তাদের প্রধান উদ্দেশ্য সংস্কার নয়, উদ্দেশ্য ক্ষমতার অংশীদারিত্ব এবং সে লক্ষ্যে সংসদে আসন লাভের নিশ্চয়তা। যে তরুণদের নেতৃত্বে এতো বড় গণসংগ্রাম হয়ে গেলো সেই তরুণদের দল ছাত্র তরুণদের থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্র সংসদ নির্বাচনে সেটাতো ভালো ভাবেই দেখা গেল। ১৫ মাসেই ছাত্র লীগের ১৫ বছরকে অতিক্রম করার প্রচেষ্টা তাদেরকে এই জায়গায় নিয়ে এসেছে। আর ‘মধ্যপন্থার’ নামে তারা যে প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতি করেছে তা ধর্মীয় মৌলবাদীদেরই অক্সিজেন যুগিয়েছে। ছাত্র-তরুণরাই যখন এনসিপির সাথে নেই সাধারণ মানুষ তো অনেক দূরের ব্যাপার।
বরং ছাত্র তরুণদের মধ্যে জায়গা করে নেওয়ার পরেও জাতীয় রাজনীতিতে বিশেষ সুবিধা করতে পারেনি- এমন উদাহরণই তো সামনে রয়েছে। যেমন স্বাধীনতার পর সারা দেশে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ছাত্র সংসদে বামধারার ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়ন একচেটিয়া বিজয় লাভ করার পরেও বামপন্থী ন্যাপ- সিপিবি জাতীয় নির্বাচনে সুবিধা করতে পারেনি। পরবর্তীতে জাসদ ছাত্র লীগ এবং বাসদ ছাত্র লীগ-ছাত্র ফ্রন্ট বিজয় লাভ করলেও জাসদ বা বাসদ জাতীয় নির্বাচনে বিশেষ সুবিধা করতে পারেনি।এ সব ইতিহাস পর্যালোচনা করে তরুণদের দলের ভবিষ্যত না বুঝার কারণ নেই। অন্তর্বর্তী সরকারে মন্ত্রীত্বগিরী করে ও ক্ষমতার ছড়ি ঘুরিয়ে তারা ক্ষমতার অংশীদারিত্ব থেকে নাই হয়ে যাবেন এটা তাদের জন্য মেনে নেওয়া কঠিন। তাই তারা সনদ ও সংষ্কারের নামে দরকষাকষি করছেন অন্তর্বর্তী সরকার, বিএনপি, জামায়াত এবং এস্টাবলিশমেন্টের সাথে। মোদ্দা কথা দল হিসেবে তাদের জনসমর্থন থাকুক বা না থাকুক সংসদে এবং ক্ষমতার অংশীদারিত্বে তাদের কোটা চাই।
যতই জামায়াতের সাথে বাহাস করুক না কেনো কোটা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তারা জামায়াতকে কৌশলী মিত্র হিসেবে পাশে রেখে জাতীয় নির্বাচনের জন্য স্থিতিশীল পরিবেশ পরিস্থিতি হতে দেবে না। অন?্যদিকে এনসিপি ও জামায়াতের পক্ষে অবস্থান নিয়ে আছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন যার সভাপতি হচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা নিজেই এবং দ্বিতীয় ব্যাক্তিও পশ্চিমা বিশ্বের পছন্দের মার্কিন প্রবাসী অধ্যাপক। প্রধান উপদেষ্টার সাথে বিএনপি নেতৃত্বের লন্ডন ও নিউইয়র্ক সফর এবং মধ্যপন্থায় ছাড় দিয়ে উগ্র দক্ষিণ পন্থার সাথে আপোসের পরিনতি হচ্ছে যে ঐকমত্য কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশের পর বিএনপিকে বলতে হচ্ছে, ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার বদলে জাতীয় অনৈক্য সৃষ্টি করছে। জাতীয় ঐক্যমত কমিশন জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে প্রতারণা করেছে’। এটা তো কমিশনের মতিগতি দেখে অনেক আগে থেকেই বোঝা যাচ্ছিলো। বিএনপি কেনো বুঝতে পারলো না? দেশে সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক ধারার রাজনীতির অনুপস্থিতি এবং বিএনপি তার নিজস্ব রাজনৈতিক অবস্থানে দৃঢ় না থাকায় রাজনীতিতে মধ্যমপন্থা কিছুটা ব্যাকফুটে চলে গেছে। রাজনীতির গতিপথকে প্রভাবিত করার মতো শক্তি-সামর্থ্য বর্তমান পরিস্থিতিতে বামপন্থীদেরও নেই। এ শুন্যতার সুযোগে উগ্র দক্ষিণপন্থা ক্ষমতার স্বাদ পেতে মরিয়া।
উগ্র দক্ষিণপন্থা এবং ধর্মীয় উগ্রবাদীদের প্রধান দল জামায়াত ইসলাম গত বছর জুলাই আন্দোলন সমাপ্তির সাথে সাথে রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয় সমূহে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় উঠেপড়ে লাগে। আর বিএনপি আওয়ামী লীগের ফেলে যাওয়া আইনি বেআইনি আর্থিক কর্মকা- দখলে ব্যস্ত থাকায় জামায়াত তাদের পরিকল্পনায় অভাবনীয় সাফল্যও পায়। জামায়াত ছয় মাসেরও বেশী সময় যাবত প্রার্থী ঘোষণা করে জোরেশোরে নির্বাচনী প্রচার প্রচারণাও চালিয়ে যাচ্ছে। অপরদিকে এনসিপি ও অন্যান্য ধর্মভিত্তিক দলগুলোর সাথে সমান্তরালভাবে দক্ষিণপন্থী দাবী দাওয়া নিয়ে আন্দোলনের মহড়াও দিচ্ছে। নানা রাজনৈতিক সমীকরণে দেশে জামায়াতের ভোট বেড়েছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা।এর কিছুটা সত্যতাও আছে। তবে এই বৃদ্ধি নির্বাচনে বিএনপিকে ছাড়িয়ে যাওয়ার বা প্রধান বিরোধী দলের আসনে বসার নিশ্চয়তা দেয় না। ভূ- রাজনীতির নানা খেলায় বিশ্বমোড়ল ও পশ্চিমা দুনিয়ার মদদ পাওয়ার পরেও জামায়াতের এখন পর্যন্ত প্রধান বিরোধী দল হওয়ার নিশ্চয়তা নাই। তাই আওয়ামী লীগের কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা অব্যাহত রাখা ও জাতীয় পার্টির কার্যক্রমকেও নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনতে তারা এনসিপির সাথে মিলিতভাবে নানামুখী প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
জাতীয় ঐক্যমত কমিশন রাজনৈতিক দল সমূহের মতামত, ভিন্নমত উপেক্ষা করে শুধু মাত্র জামাত এনসিপির মতামতকে ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাব হিসাবে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে পেশ করে পরিস্থিতিকে গুরুতর জটিলতার দিকে নিয়ে গেলেন। জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশনকি একটি নির্বাচিত পার্লামেন্টের চেয়েও অধিকতর ক্ষমতাশালী ঐক্যমত কমিশন বলছে তাদের প্রস্তাব ২৭০ দিনের মধ্যে পার্লামেন্ট পাশ না করলে অটোপাস হিসাবে গণ্য হবে। তাহলে আর পার্লামেন্টের দরকার কি? অটোপাশই যেহেতু হবে পার্লামেন্টে না তুলে অবিলম্বে কার্যকর হিসাবে গণ্য হবে - এভাবে ঘোষণা করে দিলেই হয়। যে দেশে ৫% মানুষ গণভোটে অংশ না নিলেও দুই দুইবার সামরিক সরকার ভোটার উপস্থিতি ৭২% থেকে ৮৮% এবং না ভোট ১% থেকে ৫% দেখায় সেখানে গণভোট মানুষকে আকৃষ্ট করে না। এমনকি বিচারপতি শাহাবুদ্দিনের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতিত্বের সময়কালের পরে যে সাংবিধানিক গণভোট সংঘটিত হয়েছিল, তখন বিএনপি এবং আওয়ামীলীগ গনভোটে অংশ নিতে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করলেও ৩৫% মানুষ ভোট দেয়।
৬৫% মানুষ মতামত দেয়নি। এ ধরনের ভোট অনেকটাই মূল্যহীন। শাসক যা চায় তার প্রতিফলন ঘটানো হয়। তবে জাতীয় নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হলে মানুষ ব্যাপকভাবে অংশ নেয়। সেদিক থেকে জাতীয় নির্বাচনের দিন একই সাথে গণভোট হলে মানুষের অংশগ্রহণ হয়তোবা নিশ্চিত হবে। কিন্তু তারপরও প্রশ্ন থেকে যাবে।
কারণ অংশগ্রহণ করে মানুষ কিসের উপর ভোট দেবে? দেশে সক্রিয় রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে সবচেয়ে বড় দল বিএনপির প্রস্তাবগুলো বাদ দিয়ে জামাত-এনসিপির প্রস্তাবকেই জাতীয় ঐকমত্য বলা হচ্ছে। যে বিষয়ে সবাই একমত সেটাইতো ঐকমত্য। দেশের অন্যতম প্রধান দল বিএনপির দ্বিমত থাকলে সেটাকে জাতীয় ঐকমত্য না বলে কতৃত্ববাদী কায়দায় ‘জবরদস্তিমূলকভাবে চাপিয়ে দেয়া ঐকমত্য’ বলা যেতে পারে। আর শুধু বিএনপি কেনো, অনেক দলেরই অনেক বিষয়ে দ্বিমত ভিন্নমত আছে। প্রধান উপদেষ্টা তো বলেছিলেন সবাই যেটুকুতে একমত হবে সেটুকু দিয়েই সংস্কারের কাজ শুরু হবে। এখন ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশমতো বিএনপির হাত-পা বেঁধে অর্থাৎ বিএনপির রাজনীতিকে কৌশলে ঐকমত্য প্রস্তাব থেকে বাদ রেখে সরকার গণভোটের আয়োজন করতে গেলে অনিবার্যভাবেই দেশে রাজনৈতিক অনৈক্য, এমনকি সংঘাত তৈরির পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে যা জাতীয় নির্বাচনকেই অনিশ্চিত করে তুলবে। কারো কারো সেটাই আকাক্সক্ষা। রাজনীতিতে ‘বাপ-বেটা’ দুই দল তো ইতিমধ্যেই বলে ফেলেছে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হচ্ছে না। সনদ- সংস্কার নিয়ে গণভোট করতে হলে বিষয়সমূহ আগে নির্বাচিত পার্লামেন্টে আলোচিত হতে হবে এবং সেখানে যতটুকু ঐকমত্য হবে এবং পার্লামেন্টে পাস হবে সেটা নিয়ে গণভোটে যেতে হবে। এটাই স্বাভাবিক ও নিয়মতান্ত্রিক পন্থা। এর বাইরে অসংখ্য দ্বিমত- ভিন্ন মত ও পূর্ব থেকে রাজনৈতিক দলের অজানা প্রস্তাব সহ যে সনদ ও তা কার্যকর করার প্রস্তাব রচিত হয়েছে তা নিয়ে গনভোটে গেলে তা হবে জগাখিচুডি মার্কা গনভোট এবং তা সংবিধান সম্মতও হবে না। মনে রাখা প্রয়োজন সব রাজনৈতিক দল একমত হলেও তাকে আইনসম্মতভাবে জাতীয় ঐকমত্য বলা যায় না।
রাজনীতির এই ঘূর্ণাবর্তে সংঘাতমুক্ত, ‘দোসরমুক্ত’, নীরব-শান্তিপূর্ণ একটি ‘চমৎকার নির্বাচন,’ যা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতিশ্রুতি - তা সহজেই সম্ভব যদি ক্ষমতার অংশীদারিত্বে কোটা নির্ধারণ করে দেয়া যায়! ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে যে সব বিষয় নিয়ে আলোচনাই করেন নাই সেসব বিষয়েও তো সরকারের কাছে প্রস্তাবনা দিয়েছেন। তাই তাদের অসুবিধা কি ছিলো তাদের মতো করে তাদের মিত্রদের জন?্য অন্তত ‘জুলাই যোদ্ধা’ হিসেবে এনসিপির জন্য সংসদে কোটা নির্ধারণ করে দিতে। সে আসনগুলোতে অন?্য কেউ প্রার্থী হতে না পারলেও নির্বাচন কমিশন ঘোষিত নিয়মানুযায়ী ভোট তো হতো। তাদের শুধু লড়তে হতো ‘না’ প্রতীকের সাথে। তাদেরকে সংসদ সদস্য হওয়ার জন্য অন্যদের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হতো না, কাউকে এতো হুমকি ধামকি দেওয়ার প্রয়োজনই থাকতো না। নির্বাচনের দোরগোড়ায় এসে পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হওয়ার সম্ভাবনাও থাকতো না।‘চমৎকার’ নির্বাচনের প্রতিশ্রুতিও পূরণ হ’তো! এবং গুনে মানে শেখ হাসিনার বিনা ভোট, নিশি ভোট ও ড্যামি ভোটের নির্বাচনও এই ‘চমৎকার নির্বাচনের কাছে পরাজিত হতো।
শুধু একটি নৈতিক পরাজয় হতো। কোটা বিরোধী আন্দোলন করে এসে কোটায় সংসদ সদস্য হতে হচ্ছে বা কোটায় মন্ত্রী হতে হচ্ছে! তাতে কি? ধরে নেই কোটাবিরোধী কথাগুলো ঐ সময়ের জন?্য জনতুষ্টিমুলক কিছু কথা ছিলো। রাজনীতিবিদরা হরহামেশা এরকম বলে থাকেন আবার পরিস্থিতি অনুযায়ী পল্টি খান। পার্লামেন্টের স্পীকারেরও খুব সুবিধা হতো। পার্লামেন্টে বিভিন্ন বিষয়ে ভোটাভুটিতে বেশি কথা না বলে, স্পিকারকে শুধু বলতে হতো ‘কোটা জয়যুক্ত হয়েছে, কোটা জয়যুক্ত হয়েছে, কোটা জয়যুক্ত হয়েছে’!
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
[লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা]
 
                                         
                                         ইপেপার
                        
                                                	                            	জাতীয়
                           	                            	সারাদেশ
                           	                            	আন্তর্জাতিক
                           	                            	নগর-মহানগর
                           	                            	খেলা
                           	                            	বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
                           	                            	শিক্ষা
                           	                            	অর্থ-বাণিজ্য
                           	                            	সংস্কৃতি
                           	                            	ক্যাম্পাস
                           	                            	মিডিয়া
                           	                            	অপরাধ ও দুর্নীতি
                           	                            	রাজনীতি
                           	                            	শোক ও স্মরন
                           	                            	প্রবাস
                           	                            নারীর প্রতি সহিংসতা
                            বিনোদন
                                                                        	                            	সম্পাদকীয়
                           	                            	উপ-সম্পাদকীয়
                           	                            	মুক্ত আলোচনা
                           	                            	চিঠিপত্র
                           	                            	পাঠকের চিঠি
                        ইপেপার
                        
                                                	                            	জাতীয়
                           	                            	সারাদেশ
                           	                            	আন্তর্জাতিক
                           	                            	নগর-মহানগর
                           	                            	খেলা
                           	                            	বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
                           	                            	শিক্ষা
                           	                            	অর্থ-বাণিজ্য
                           	                            	সংস্কৃতি
                           	                            	ক্যাম্পাস
                           	                            	মিডিয়া
                           	                            	অপরাধ ও দুর্নীতি
                           	                            	রাজনীতি
                           	                            	শোক ও স্মরন
                           	                            	প্রবাস
                           	                            নারীর প্রতি সহিংসতা
                            বিনোদন
                                                                        	                            	সম্পাদকীয়
                           	                            	উপ-সম্পাদকীয়
                           	                            	মুক্ত আলোচনা
                           	                            	চিঠিপত্র
                           	                            	পাঠকের চিঠি
                           	                                            আনোয়ারুল হক
শুক্রবার, ৩১ অক্টোবর ২০২৫
তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মো. মাহফুজ আলমের দু’দিন আগের এক বক্তব্য শুনে কিছু লিখতে ভয় লাগে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিবকে পাশে নিয়ে তিনি বললেন, ‘সাংবাদিক পরিচয়ে বা বিভিন্ন পরিচয়ে,... ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে বড় বড় কথা বলতেছে। ওই সাহস কোথায় ছিল গত ১৫ বছরে?’ এই প্রশ্ন শুনে আমার মনে হলো আসলেই তো গত ১৫ বছরে কখনো কিছু লিখি নাই। গোটা জীবনেই লেখালেখি আর পড়াশোনা করার অভ্যাস ছিলো না। শেষ জীবনে এসে কেনো যে ভিমরতী হলো! এর প্রধান দায়ও কিন্তু মাহফুজ আলমের।
অনেকেই মনে করেন, দেশে সনদ, সংবিধান, আইনি সুরক্ষা ইত্যাদি অনেক সময় কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ থাকে; বাস্তব রাজনীতির মাঠে এর প্রভাব তেমন থাকে না। রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকলে আইনি কাঠামোর মাধ্যমে সবকিছু করিয়ে ফেলা যায় না। অতীতেও এভাবে সফল হওয়া যায়নি। যে সনদ নিয়ে এতো বিতর্ক এবং সংস্কার সংস্কার করে যারা জানপ্রাণ কোরবান করছেন তারাও এটা খুব ভালো করে জানেন।
৫ আগস্টের পরে ‘জুলাই গণপরিসর’ শীর্ষক এক আলোচনায় তার ‘দায় ও দরদের’ সমাজ গড়ে তোলার আলোচনা শুনে বিমোহিত হয়েছিলাম। তার এবং জুলাই আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় আরো ক’জনার বক্তব্য শুনে নিজের চিন্তাভাবনাকেও নবায়ন করার চেষ্টা থেকে লেখালেখির একটা প্রচেষ্টা শুরু করি। যদিও মাহফুজ আলম ও তার সঙ্গীসাথীরা দ্রুতই তাদের বক্তব্য থেকে ইউটার্নে চলে যান। তবে আমার লেখার প্রচেষ্টা আরো গতি পেলো ড. ইউনূসের এক বক্তৃতা শুনে। ইউনূস সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘মন খুলে আমাদের সমালোচনা করবেন। সমালোচনা না করলে বুঝবো কীভাবে কোথায় ভুল হচ্ছে’। এখন ইউনূসের বা তার সরকারের সমালোচনাকে তথ্য উপদেষ্টা বলছেন ‘বড়ো বড়ো কথা বলা হচ্ছে‘। অথচ নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে সরকারের বিরুদ্ধে বড়ো বড়ো কথা সাংবাদিক বা টকশোতে অংশগ্রহণকারীদের অপেক্ষা সরকার ঘনিষ্ঠ এনসিপি এবং জামাতই বেশি বলছে। লন্ডন বৈঠকের পর থেকে বরং বিএনপি একটু সফট এবং প্রধান উপদেষ্টা ও এনসিপির সাথে একত্রে বিশ্ব সভায় অংশ নিয়ে আসার পর থেকে আরো সফট প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করছে। কোনো রকমে পরিস্থিতিটা নির্বাচনের দিকে নেওয়াই সম্ভবত বিএনপির কৌশল। তাই অপছন্দের অনেক কিছু থাকলেও সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টার পাশে মির্জা ফখরুল হাস্যোজ্জ্বল থাকার চেষ্টা করেছেন।
অনেকেই মনে করেন, দেশে সনদ, সংবিধান, আইনি সুরক্ষা ইত্যাদি অনেক সময় কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ থাকে; বাস্তব রাজনীতির মাঠে এর প্রভাব তেমন থাকে না। রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকলে আইনি কাঠামোর মাধ্যমে সবকিছু করিয়ে ফেলা যায় না। অতীতেও এভাবে সফল হওয়া যায়নি। যে সনদ নিয়ে এতো বিতর্ক এবং সংস্কার সংস্কার করে যারা জানপ্রাণ কোরবান করছেন তারাও এটা খুব ভালো করে জানেন। তাদের রাজনৈতিক বক্তৃতা-বিবৃতি, রাজনৈতিক আচরণ-অভ্যাস পর্যবেক্ষণ করলেই বুঝা যায় সনদ- সংস্কার ‘বাত কি বাত’। তাদের প্রধান উদ্দেশ্য সংস্কার নয়, উদ্দেশ্য ক্ষমতার অংশীদারিত্ব এবং সে লক্ষ্যে সংসদে আসন লাভের নিশ্চয়তা। যে তরুণদের নেতৃত্বে এতো বড় গণসংগ্রাম হয়ে গেলো সেই তরুণদের দল ছাত্র তরুণদের থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্র সংসদ নির্বাচনে সেটাতো ভালো ভাবেই দেখা গেল। ১৫ মাসেই ছাত্র লীগের ১৫ বছরকে অতিক্রম করার প্রচেষ্টা তাদেরকে এই জায়গায় নিয়ে এসেছে। আর ‘মধ্যপন্থার’ নামে তারা যে প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতি করেছে তা ধর্মীয় মৌলবাদীদেরই অক্সিজেন যুগিয়েছে। ছাত্র-তরুণরাই যখন এনসিপির সাথে নেই সাধারণ মানুষ তো অনেক দূরের ব্যাপার।
বরং ছাত্র তরুণদের মধ্যে জায়গা করে নেওয়ার পরেও জাতীয় রাজনীতিতে বিশেষ সুবিধা করতে পারেনি- এমন উদাহরণই তো সামনে রয়েছে। যেমন স্বাধীনতার পর সারা দেশে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ছাত্র সংসদে বামধারার ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়ন একচেটিয়া বিজয় লাভ করার পরেও বামপন্থী ন্যাপ- সিপিবি জাতীয় নির্বাচনে সুবিধা করতে পারেনি। পরবর্তীতে জাসদ ছাত্র লীগ এবং বাসদ ছাত্র লীগ-ছাত্র ফ্রন্ট বিজয় লাভ করলেও জাসদ বা বাসদ জাতীয় নির্বাচনে বিশেষ সুবিধা করতে পারেনি।এ সব ইতিহাস পর্যালোচনা করে তরুণদের দলের ভবিষ্যত না বুঝার কারণ নেই। অন্তর্বর্তী সরকারে মন্ত্রীত্বগিরী করে ও ক্ষমতার ছড়ি ঘুরিয়ে তারা ক্ষমতার অংশীদারিত্ব থেকে নাই হয়ে যাবেন এটা তাদের জন্য মেনে নেওয়া কঠিন। তাই তারা সনদ ও সংষ্কারের নামে দরকষাকষি করছেন অন্তর্বর্তী সরকার, বিএনপি, জামায়াত এবং এস্টাবলিশমেন্টের সাথে। মোদ্দা কথা দল হিসেবে তাদের জনসমর্থন থাকুক বা না থাকুক সংসদে এবং ক্ষমতার অংশীদারিত্বে তাদের কোটা চাই।
যতই জামায়াতের সাথে বাহাস করুক না কেনো কোটা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তারা জামায়াতকে কৌশলী মিত্র হিসেবে পাশে রেখে জাতীয় নির্বাচনের জন্য স্থিতিশীল পরিবেশ পরিস্থিতি হতে দেবে না। অন?্যদিকে এনসিপি ও জামায়াতের পক্ষে অবস্থান নিয়ে আছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন যার সভাপতি হচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা নিজেই এবং দ্বিতীয় ব্যাক্তিও পশ্চিমা বিশ্বের পছন্দের মার্কিন প্রবাসী অধ্যাপক। প্রধান উপদেষ্টার সাথে বিএনপি নেতৃত্বের লন্ডন ও নিউইয়র্ক সফর এবং মধ্যপন্থায় ছাড় দিয়ে উগ্র দক্ষিণ পন্থার সাথে আপোসের পরিনতি হচ্ছে যে ঐকমত্য কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশের পর বিএনপিকে বলতে হচ্ছে, ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার বদলে জাতীয় অনৈক্য সৃষ্টি করছে। জাতীয় ঐক্যমত কমিশন জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে প্রতারণা করেছে’। এটা তো কমিশনের মতিগতি দেখে অনেক আগে থেকেই বোঝা যাচ্ছিলো। বিএনপি কেনো বুঝতে পারলো না? দেশে সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক ধারার রাজনীতির অনুপস্থিতি এবং বিএনপি তার নিজস্ব রাজনৈতিক অবস্থানে দৃঢ় না থাকায় রাজনীতিতে মধ্যমপন্থা কিছুটা ব্যাকফুটে চলে গেছে। রাজনীতির গতিপথকে প্রভাবিত করার মতো শক্তি-সামর্থ্য বর্তমান পরিস্থিতিতে বামপন্থীদেরও নেই। এ শুন্যতার সুযোগে উগ্র দক্ষিণপন্থা ক্ষমতার স্বাদ পেতে মরিয়া।
উগ্র দক্ষিণপন্থা এবং ধর্মীয় উগ্রবাদীদের প্রধান দল জামায়াত ইসলাম গত বছর জুলাই আন্দোলন সমাপ্তির সাথে সাথে রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয় সমূহে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় উঠেপড়ে লাগে। আর বিএনপি আওয়ামী লীগের ফেলে যাওয়া আইনি বেআইনি আর্থিক কর্মকা- দখলে ব্যস্ত থাকায় জামায়াত তাদের পরিকল্পনায় অভাবনীয় সাফল্যও পায়। জামায়াত ছয় মাসেরও বেশী সময় যাবত প্রার্থী ঘোষণা করে জোরেশোরে নির্বাচনী প্রচার প্রচারণাও চালিয়ে যাচ্ছে। অপরদিকে এনসিপি ও অন্যান্য ধর্মভিত্তিক দলগুলোর সাথে সমান্তরালভাবে দক্ষিণপন্থী দাবী দাওয়া নিয়ে আন্দোলনের মহড়াও দিচ্ছে। নানা রাজনৈতিক সমীকরণে দেশে জামায়াতের ভোট বেড়েছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা।এর কিছুটা সত্যতাও আছে। তবে এই বৃদ্ধি নির্বাচনে বিএনপিকে ছাড়িয়ে যাওয়ার বা প্রধান বিরোধী দলের আসনে বসার নিশ্চয়তা দেয় না। ভূ- রাজনীতির নানা খেলায় বিশ্বমোড়ল ও পশ্চিমা দুনিয়ার মদদ পাওয়ার পরেও জামায়াতের এখন পর্যন্ত প্রধান বিরোধী দল হওয়ার নিশ্চয়তা নাই। তাই আওয়ামী লীগের কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা অব্যাহত রাখা ও জাতীয় পার্টির কার্যক্রমকেও নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনতে তারা এনসিপির সাথে মিলিতভাবে নানামুখী প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
জাতীয় ঐক্যমত কমিশন রাজনৈতিক দল সমূহের মতামত, ভিন্নমত উপেক্ষা করে শুধু মাত্র জামাত এনসিপির মতামতকে ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাব হিসাবে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে পেশ করে পরিস্থিতিকে গুরুতর জটিলতার দিকে নিয়ে গেলেন। জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশনকি একটি নির্বাচিত পার্লামেন্টের চেয়েও অধিকতর ক্ষমতাশালী ঐক্যমত কমিশন বলছে তাদের প্রস্তাব ২৭০ দিনের মধ্যে পার্লামেন্ট পাশ না করলে অটোপাস হিসাবে গণ্য হবে। তাহলে আর পার্লামেন্টের দরকার কি? অটোপাশই যেহেতু হবে পার্লামেন্টে না তুলে অবিলম্বে কার্যকর হিসাবে গণ্য হবে - এভাবে ঘোষণা করে দিলেই হয়। যে দেশে ৫% মানুষ গণভোটে অংশ না নিলেও দুই দুইবার সামরিক সরকার ভোটার উপস্থিতি ৭২% থেকে ৮৮% এবং না ভোট ১% থেকে ৫% দেখায় সেখানে গণভোট মানুষকে আকৃষ্ট করে না। এমনকি বিচারপতি শাহাবুদ্দিনের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতিত্বের সময়কালের পরে যে সাংবিধানিক গণভোট সংঘটিত হয়েছিল, তখন বিএনপি এবং আওয়ামীলীগ গনভোটে অংশ নিতে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করলেও ৩৫% মানুষ ভোট দেয়।
৬৫% মানুষ মতামত দেয়নি। এ ধরনের ভোট অনেকটাই মূল্যহীন। শাসক যা চায় তার প্রতিফলন ঘটানো হয়। তবে জাতীয় নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হলে মানুষ ব্যাপকভাবে অংশ নেয়। সেদিক থেকে জাতীয় নির্বাচনের দিন একই সাথে গণভোট হলে মানুষের অংশগ্রহণ হয়তোবা নিশ্চিত হবে। কিন্তু তারপরও প্রশ্ন থেকে যাবে।
কারণ অংশগ্রহণ করে মানুষ কিসের উপর ভোট দেবে? দেশে সক্রিয় রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে সবচেয়ে বড় দল বিএনপির প্রস্তাবগুলো বাদ দিয়ে জামাত-এনসিপির প্রস্তাবকেই জাতীয় ঐকমত্য বলা হচ্ছে। যে বিষয়ে সবাই একমত সেটাইতো ঐকমত্য। দেশের অন্যতম প্রধান দল বিএনপির দ্বিমত থাকলে সেটাকে জাতীয় ঐকমত্য না বলে কতৃত্ববাদী কায়দায় ‘জবরদস্তিমূলকভাবে চাপিয়ে দেয়া ঐকমত্য’ বলা যেতে পারে। আর শুধু বিএনপি কেনো, অনেক দলেরই অনেক বিষয়ে দ্বিমত ভিন্নমত আছে। প্রধান উপদেষ্টা তো বলেছিলেন সবাই যেটুকুতে একমত হবে সেটুকু দিয়েই সংস্কারের কাজ শুরু হবে। এখন ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশমতো বিএনপির হাত-পা বেঁধে অর্থাৎ বিএনপির রাজনীতিকে কৌশলে ঐকমত্য প্রস্তাব থেকে বাদ রেখে সরকার গণভোটের আয়োজন করতে গেলে অনিবার্যভাবেই দেশে রাজনৈতিক অনৈক্য, এমনকি সংঘাত তৈরির পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে যা জাতীয় নির্বাচনকেই অনিশ্চিত করে তুলবে। কারো কারো সেটাই আকাক্সক্ষা। রাজনীতিতে ‘বাপ-বেটা’ দুই দল তো ইতিমধ্যেই বলে ফেলেছে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হচ্ছে না। সনদ- সংস্কার নিয়ে গণভোট করতে হলে বিষয়সমূহ আগে নির্বাচিত পার্লামেন্টে আলোচিত হতে হবে এবং সেখানে যতটুকু ঐকমত্য হবে এবং পার্লামেন্টে পাস হবে সেটা নিয়ে গণভোটে যেতে হবে। এটাই স্বাভাবিক ও নিয়মতান্ত্রিক পন্থা। এর বাইরে অসংখ্য দ্বিমত- ভিন্ন মত ও পূর্ব থেকে রাজনৈতিক দলের অজানা প্রস্তাব সহ যে সনদ ও তা কার্যকর করার প্রস্তাব রচিত হয়েছে তা নিয়ে গনভোটে গেলে তা হবে জগাখিচুডি মার্কা গনভোট এবং তা সংবিধান সম্মতও হবে না। মনে রাখা প্রয়োজন সব রাজনৈতিক দল একমত হলেও তাকে আইনসম্মতভাবে জাতীয় ঐকমত্য বলা যায় না।
রাজনীতির এই ঘূর্ণাবর্তে সংঘাতমুক্ত, ‘দোসরমুক্ত’, নীরব-শান্তিপূর্ণ একটি ‘চমৎকার নির্বাচন,’ যা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতিশ্রুতি - তা সহজেই সম্ভব যদি ক্ষমতার অংশীদারিত্বে কোটা নির্ধারণ করে দেয়া যায়! ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে যে সব বিষয় নিয়ে আলোচনাই করেন নাই সেসব বিষয়েও তো সরকারের কাছে প্রস্তাবনা দিয়েছেন। তাই তাদের অসুবিধা কি ছিলো তাদের মতো করে তাদের মিত্রদের জন?্য অন্তত ‘জুলাই যোদ্ধা’ হিসেবে এনসিপির জন্য সংসদে কোটা নির্ধারণ করে দিতে। সে আসনগুলোতে অন?্য কেউ প্রার্থী হতে না পারলেও নির্বাচন কমিশন ঘোষিত নিয়মানুযায়ী ভোট তো হতো। তাদের শুধু লড়তে হতো ‘না’ প্রতীকের সাথে। তাদেরকে সংসদ সদস্য হওয়ার জন্য অন্যদের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হতো না, কাউকে এতো হুমকি ধামকি দেওয়ার প্রয়োজনই থাকতো না। নির্বাচনের দোরগোড়ায় এসে পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হওয়ার সম্ভাবনাও থাকতো না।‘চমৎকার’ নির্বাচনের প্রতিশ্রুতিও পূরণ হ’তো! এবং গুনে মানে শেখ হাসিনার বিনা ভোট, নিশি ভোট ও ড্যামি ভোটের নির্বাচনও এই ‘চমৎকার নির্বাচনের কাছে পরাজিত হতো।
শুধু একটি নৈতিক পরাজয় হতো। কোটা বিরোধী আন্দোলন করে এসে কোটায় সংসদ সদস্য হতে হচ্ছে বা কোটায় মন্ত্রী হতে হচ্ছে! তাতে কি? ধরে নেই কোটাবিরোধী কথাগুলো ঐ সময়ের জন?্য জনতুষ্টিমুলক কিছু কথা ছিলো। রাজনীতিবিদরা হরহামেশা এরকম বলে থাকেন আবার পরিস্থিতি অনুযায়ী পল্টি খান। পার্লামেন্টের স্পীকারেরও খুব সুবিধা হতো। পার্লামেন্টে বিভিন্ন বিষয়ে ভোটাভুটিতে বেশি কথা না বলে, স্পিকারকে শুধু বলতে হতো ‘কোটা জয়যুক্ত হয়েছে, কোটা জয়যুক্ত হয়েছে, কোটা জয়যুক্ত হয়েছে’!
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
[লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা]
