সৌরভ জাকারিয়া
উচ্চ শিক্ষায় পিএইচডি ডিগ্রিধারী শিক্ষকের প্রয়োজনীয়তা সম্প্রতি ব্যাপক আলোচিত হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের কয়েকটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কিছু শিক্ষক ও সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার উচ্চ শিক্ষার মানোন্নয়নের যুক্তি দেখিয়ে “পিএইচডি ডিগ্রিধারী শিক্ষক”-এর অপরিহার্যতার প্রশ্নটি সামনে এনেছেন। ঢাকার সাত সরকারি কলেজের কিছু শিক্ষার্থীও তাদের একাডেমিক ও প্রশাসনিক সমস্যার অন্যতম কারণ হিসেবে পিএইচডি ডিগ্রিধারী শিক্ষকের আবশ্যকতাকে চিহ্নিত করে আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবী তুলেছেন। এ প্রেক্ষিতে ঢাকার সাত কলেজকে বিলুপ্তির পথে ঠেলে দিয়ে “ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি” প্রতিষ্ঠার একটি খসড়া অধ্যাদেশও জারি হয়েছে। এই আলোচনার কেন্দ্রে একটি মৌলিক প্রশ্ন উত্থাপন জরুরী- পিএইচডি ডিগ্রিই কি উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতার একমাত্র যোগ্যতা?
পিএইচডি হলো গবেষণা পরিচালনা ও মৌলিক জ্ঞান সৃষ্টির প্রক্রিয়ায় আনুষ্ঠানিক দক্ষতা অর্জনের একটি উচ্চতর একাডেমিক ডিগ্রি। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই ডিগ্রিটি ক্রমশ একটি প্রতীকী মর্যাদার উপকরণে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, পিএইচডি অনেক সময় উচ্চ শিক্ষার প্রকৃত মানদণ্ডের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে মর্যাদা, পদোন্নতি ও সামাজিক স্বীকৃতির প্রতীক হিসেবে। ফলে প্রশ্ন থেকেই যায়, পিএইচডি কি সত্যিই উচ্চশিক্ষার মানদণ্ড, নাকি এটি কেবল একটি “প্রতীকী মরীচিকা”, যেখানে জ্ঞানের চেয়ে সম্মানই বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে? শিক্ষার ইতিহাস, দর্শন ও বাস্তবতার আলোকে এর উত্তর খুঁজতে পিএইচডি ডিগ্রির উৎপত্তি ও প্রেক্ষাপট পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণের প্রয়োজন।
পিএইচডি-র দার্শনিক উৎস ও ঐতিহাসিক বিবর্তন
পিএইচডি বা ডক্টর অব ফিলোসফিকে দর্শনের ডাক্তার কিংবা দর্শনশাস্ত্রের ডিগ্রি হিসেবে প্রতিভাত হলেও আদতে তা নয়। প্রাচীন গ্রিসে দর্শন কোনো নির্দিষ্ট শিক্ষাক্ষেত্রের নাম ছিল না; বরং এটি বোঝাত বিশ্ব, অস্তিত্ব, যুক্তি ও নীতিশাস্ত্র বিষয়ে মৌলিক জ্ঞান ও প্রজ্ঞার সার্বিক সাধনাকে। জ্ঞান অর্জনের এই অবিরাম অন্বেষণই পরবর্তীকালে পিএইচডি ডিগ্রির মূল দার্শনিক ভিত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
প্রাচীনতম রেকর্ড অনুসারে, ‘ডক্টর’ শব্দটি মূলত যিশুর বার্তাবাহক এবং চার্চ ফাদারদের বিভিন্ন খ্রিস্টীয় কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ করত, যারা বাইবেল শিক্ষা দিতেন ও এর ব্যাখ্যা করতেন। তবে সময়ের আবর্তনে ডক্টর শব্দটি ধর্মীয় আবহমুক্ত হয়ে শিক্ষাবিশ্বে প্রথমে একটি পেশাগত এবং পরবর্তীতে একাডেমিক ডিগ্রিতে পরিণত হয়। ‘ডক্টর’ শব্দটির উদ্ভব ল্যাটিন শব্দ “ডসের” থেকে, যার অর্থ “শিক্ষা দেওয়া”, ‘শিক্ষক’ বা “জ্ঞানের অধিকারী ব্যক্তি”। মধ্যযুগীয় ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে (যেমন-বোলোগনা বিশ্ববিদ্যালয়, প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়) যিনি কোনো বিষয়ে সর্বোচ্চ জ্ঞান অর্জন করে অন্যদের শেখানোর যোগ্যতা অর্জন করতেন, তাকেই “ডক্টর” উপাধিতে ভূষিত করা হতো। অন্যদিকে, ফিলোসফি শব্দটির উৎস গ্রিক ‘ফিলোসফিয়া’ যেখানে ফিলো অর্থ অনুরাগ বা প্রেম এবং সফিয়া অর্থ জ্ঞান বা প্রজ্ঞা। ফলে ‘ফিলোসফিয়া’ মানে দাঁড়ায় লাভ অব উইসডম বা “জ্ঞানপ্রেম”। সুতরাং ডক্টর অব ফিলোসফির প্রকৃত অর্থ হলো ‘জ্ঞানের শিক্ষক’ বা ‘জ্ঞানের প্রতি অনুরাগী শিক্ষক’।
পিএইচডি পদ্ধতির উৎপত্তি মধ্যযুগীয় ইউরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থায়, যা শুরু হয়েছিল ১২শ শতকে। সেসময় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চারটি অনুষদের তিনটিতে সর্বোচ্চ ডিগ্রি ছিল ডক্টর অফ থিওলজি (ধর্মতত্ত্ব), ডক্টর অফ ল (আইনশাস্ত্র) এবং ডক্টর অফ মেডিসিন (চিকিৎসাবিজ্ঞান)- যেগুলো ছিল পেশাভিত্তিক ও বিশেষায়িত। চতুর্থ অনুষদটি ছিল ফিলোসফিয়া বা আর্টস, যেখানে যুক্তি, বিজ্ঞান, সাহিত্য, নৈতিকতাসহ জ্ঞানের অন্যান্য সকল শাখা পড়ানো হতো। এ অনূষদ থেকে প্রদত্ত ডিগ্রিই ছিল “ডক্টর অব ফিলোসফি” (পিএইচডি)। তবে তখনকার এই ডিগ্রি গবেষণাভিত্তিক না হয়ে মূলত সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে শিক্ষাদানের একটি লাইসেন্স বা অনুমতিপত্র ছিল।
ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করার মানে ছিল এই, আপনি একটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে বিদ্যমান জ্ঞান আয়ত্ত করেছেন এবং তা অন্যদের কাছে হস্তান্তর করার যোগ্যতা অর্জন করেছেন। শিক্ষকতার লাইসেন্স থেকে লাভ অব উইসডম বা জ্ঞানের প্রতি অনুরাগের স্বীকৃত ডিগ্রিতে পরিণত হওয়ার জন্য আরও কয়েক শতাব্দী লেগে যায়। মধ্যযুগ পেরিয়ে ইউরোপে নবজাগরণ (রেনেসাঁ) ও আলোকপ্রাপ্তি যুগে জ্ঞানের ক্ষেত্রগুলো ধর্মীয় বা পেশাগত সীমানা অতিক্রম করতে থাকে। বিজ্ঞানের বিকাশ, যুক্তিনির্ভর অনুসন্ধান এবং প্রমাণনির্ভর গবেষণাপদ্ধতি মানবচিন্তার কেন্দ্রে চলে আসে। এই পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে “ফিলোসফিয়া” শব্দটি নতুন অর্থ লাভ করে; এটি কেবল বিমূর্ত চিন্তা নয়, বরং জ্ঞান অনুসন্ধানের একটি বৈজ্ঞানিক ও যুক্তিনির্ভর পদ্ধতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
আধুনিক গবেষণাভিত্তিক পিএইচডি ডিগ্রির সূচনা ঘটে ঊনবিংশ শতাব্দীর জার্মানিতে। ১৮১০ সালে উইলহেম ফন হামবোল্ট প্রতিষ্ঠিত বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয় আধুনিক গবেষণাভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয়ব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন করে। এই মডেলেই প্রথমবারের মতো “ডক্টর অব ফিলোসফি” ডিগ্রি নতুন জ্ঞান সৃষ্টির প্রমাণনির্ভর গবেষণার ডিগ্রিতে রূপ নেয়। এখানেই “ডক্টরাল থিসিস”, “সুপারভাইজার”, ও “থিসিস ডিফেন্স” প্রথা চালু হয়, যা আজও পিএইচডি প্রক্রিয়ার মূল কাঠামো। জার্মান শিক্ষাব্যবস্থার প্রভাবে পরবর্তীতে কেমব্রিজ ও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা বিশ্বে পিএইচডি বা ডি. ফিল. ডিগ্রি প্রচলিত হয়। এভাবেই পিএইচডি ডিগ্রি একাডেমিক বিশ্বের সর্বোচ্চ বৌদ্ধিক অর্জন হিসেবে স্বীকৃতি পায়-যার লক্ষ্য কেবল জ্ঞান অর্জন নয়, বরং নতুন জ্ঞান সৃষ্টি। সময়ের পরিক্রমায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসর বেড়েছে- “ধর্মতত্ত্ব”, “আইন”, “চিকিৎসা” ও “দর্শন” ছাড়াও যুক্ত হয়েছে অসংখ্য শাখা। তবু সেই ঐতিহ্যবাহী নাম “ডক্টর অব ফিলোসফি” এখনও বহাল আছে, কারণ এটি জ্ঞানের প্রতি মানুষের চিরন্তন অনুসন্ধানী মানসিকতাকে প্রতিফলিত করে।
(বাকি অংশ আগামীকাল)
[লেখক: শিক্ষক ও সদস্য, দি অ্যাডভাইজরস: থিংক ট্যাংক অব সিভিল এডুকেশন]
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
সৌরভ জাকারিয়া
শুক্রবার, ৩১ অক্টোবর ২০২৫
উচ্চ শিক্ষায় পিএইচডি ডিগ্রিধারী শিক্ষকের প্রয়োজনীয়তা সম্প্রতি ব্যাপক আলোচিত হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের কয়েকটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কিছু শিক্ষক ও সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার উচ্চ শিক্ষার মানোন্নয়নের যুক্তি দেখিয়ে “পিএইচডি ডিগ্রিধারী শিক্ষক”-এর অপরিহার্যতার প্রশ্নটি সামনে এনেছেন। ঢাকার সাত সরকারি কলেজের কিছু শিক্ষার্থীও তাদের একাডেমিক ও প্রশাসনিক সমস্যার অন্যতম কারণ হিসেবে পিএইচডি ডিগ্রিধারী শিক্ষকের আবশ্যকতাকে চিহ্নিত করে আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবী তুলেছেন। এ প্রেক্ষিতে ঢাকার সাত কলেজকে বিলুপ্তির পথে ঠেলে দিয়ে “ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি” প্রতিষ্ঠার একটি খসড়া অধ্যাদেশও জারি হয়েছে। এই আলোচনার কেন্দ্রে একটি মৌলিক প্রশ্ন উত্থাপন জরুরী- পিএইচডি ডিগ্রিই কি উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতার একমাত্র যোগ্যতা?
পিএইচডি হলো গবেষণা পরিচালনা ও মৌলিক জ্ঞান সৃষ্টির প্রক্রিয়ায় আনুষ্ঠানিক দক্ষতা অর্জনের একটি উচ্চতর একাডেমিক ডিগ্রি। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই ডিগ্রিটি ক্রমশ একটি প্রতীকী মর্যাদার উপকরণে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, পিএইচডি অনেক সময় উচ্চ শিক্ষার প্রকৃত মানদণ্ডের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে মর্যাদা, পদোন্নতি ও সামাজিক স্বীকৃতির প্রতীক হিসেবে। ফলে প্রশ্ন থেকেই যায়, পিএইচডি কি সত্যিই উচ্চশিক্ষার মানদণ্ড, নাকি এটি কেবল একটি “প্রতীকী মরীচিকা”, যেখানে জ্ঞানের চেয়ে সম্মানই বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে? শিক্ষার ইতিহাস, দর্শন ও বাস্তবতার আলোকে এর উত্তর খুঁজতে পিএইচডি ডিগ্রির উৎপত্তি ও প্রেক্ষাপট পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণের প্রয়োজন।
পিএইচডি-র দার্শনিক উৎস ও ঐতিহাসিক বিবর্তন
পিএইচডি বা ডক্টর অব ফিলোসফিকে দর্শনের ডাক্তার কিংবা দর্শনশাস্ত্রের ডিগ্রি হিসেবে প্রতিভাত হলেও আদতে তা নয়। প্রাচীন গ্রিসে দর্শন কোনো নির্দিষ্ট শিক্ষাক্ষেত্রের নাম ছিল না; বরং এটি বোঝাত বিশ্ব, অস্তিত্ব, যুক্তি ও নীতিশাস্ত্র বিষয়ে মৌলিক জ্ঞান ও প্রজ্ঞার সার্বিক সাধনাকে। জ্ঞান অর্জনের এই অবিরাম অন্বেষণই পরবর্তীকালে পিএইচডি ডিগ্রির মূল দার্শনিক ভিত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
প্রাচীনতম রেকর্ড অনুসারে, ‘ডক্টর’ শব্দটি মূলত যিশুর বার্তাবাহক এবং চার্চ ফাদারদের বিভিন্ন খ্রিস্টীয় কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ করত, যারা বাইবেল শিক্ষা দিতেন ও এর ব্যাখ্যা করতেন। তবে সময়ের আবর্তনে ডক্টর শব্দটি ধর্মীয় আবহমুক্ত হয়ে শিক্ষাবিশ্বে প্রথমে একটি পেশাগত এবং পরবর্তীতে একাডেমিক ডিগ্রিতে পরিণত হয়। ‘ডক্টর’ শব্দটির উদ্ভব ল্যাটিন শব্দ “ডসের” থেকে, যার অর্থ “শিক্ষা দেওয়া”, ‘শিক্ষক’ বা “জ্ঞানের অধিকারী ব্যক্তি”। মধ্যযুগীয় ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে (যেমন-বোলোগনা বিশ্ববিদ্যালয়, প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়) যিনি কোনো বিষয়ে সর্বোচ্চ জ্ঞান অর্জন করে অন্যদের শেখানোর যোগ্যতা অর্জন করতেন, তাকেই “ডক্টর” উপাধিতে ভূষিত করা হতো। অন্যদিকে, ফিলোসফি শব্দটির উৎস গ্রিক ‘ফিলোসফিয়া’ যেখানে ফিলো অর্থ অনুরাগ বা প্রেম এবং সফিয়া অর্থ জ্ঞান বা প্রজ্ঞা। ফলে ‘ফিলোসফিয়া’ মানে দাঁড়ায় লাভ অব উইসডম বা “জ্ঞানপ্রেম”। সুতরাং ডক্টর অব ফিলোসফির প্রকৃত অর্থ হলো ‘জ্ঞানের শিক্ষক’ বা ‘জ্ঞানের প্রতি অনুরাগী শিক্ষক’।
পিএইচডি পদ্ধতির উৎপত্তি মধ্যযুগীয় ইউরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থায়, যা শুরু হয়েছিল ১২শ শতকে। সেসময় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চারটি অনুষদের তিনটিতে সর্বোচ্চ ডিগ্রি ছিল ডক্টর অফ থিওলজি (ধর্মতত্ত্ব), ডক্টর অফ ল (আইনশাস্ত্র) এবং ডক্টর অফ মেডিসিন (চিকিৎসাবিজ্ঞান)- যেগুলো ছিল পেশাভিত্তিক ও বিশেষায়িত। চতুর্থ অনুষদটি ছিল ফিলোসফিয়া বা আর্টস, যেখানে যুক্তি, বিজ্ঞান, সাহিত্য, নৈতিকতাসহ জ্ঞানের অন্যান্য সকল শাখা পড়ানো হতো। এ অনূষদ থেকে প্রদত্ত ডিগ্রিই ছিল “ডক্টর অব ফিলোসফি” (পিএইচডি)। তবে তখনকার এই ডিগ্রি গবেষণাভিত্তিক না হয়ে মূলত সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে শিক্ষাদানের একটি লাইসেন্স বা অনুমতিপত্র ছিল।
ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করার মানে ছিল এই, আপনি একটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে বিদ্যমান জ্ঞান আয়ত্ত করেছেন এবং তা অন্যদের কাছে হস্তান্তর করার যোগ্যতা অর্জন করেছেন। শিক্ষকতার লাইসেন্স থেকে লাভ অব উইসডম বা জ্ঞানের প্রতি অনুরাগের স্বীকৃত ডিগ্রিতে পরিণত হওয়ার জন্য আরও কয়েক শতাব্দী লেগে যায়। মধ্যযুগ পেরিয়ে ইউরোপে নবজাগরণ (রেনেসাঁ) ও আলোকপ্রাপ্তি যুগে জ্ঞানের ক্ষেত্রগুলো ধর্মীয় বা পেশাগত সীমানা অতিক্রম করতে থাকে। বিজ্ঞানের বিকাশ, যুক্তিনির্ভর অনুসন্ধান এবং প্রমাণনির্ভর গবেষণাপদ্ধতি মানবচিন্তার কেন্দ্রে চলে আসে। এই পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে “ফিলোসফিয়া” শব্দটি নতুন অর্থ লাভ করে; এটি কেবল বিমূর্ত চিন্তা নয়, বরং জ্ঞান অনুসন্ধানের একটি বৈজ্ঞানিক ও যুক্তিনির্ভর পদ্ধতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
আধুনিক গবেষণাভিত্তিক পিএইচডি ডিগ্রির সূচনা ঘটে ঊনবিংশ শতাব্দীর জার্মানিতে। ১৮১০ সালে উইলহেম ফন হামবোল্ট প্রতিষ্ঠিত বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয় আধুনিক গবেষণাভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয়ব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন করে। এই মডেলেই প্রথমবারের মতো “ডক্টর অব ফিলোসফি” ডিগ্রি নতুন জ্ঞান সৃষ্টির প্রমাণনির্ভর গবেষণার ডিগ্রিতে রূপ নেয়। এখানেই “ডক্টরাল থিসিস”, “সুপারভাইজার”, ও “থিসিস ডিফেন্স” প্রথা চালু হয়, যা আজও পিএইচডি প্রক্রিয়ার মূল কাঠামো। জার্মান শিক্ষাব্যবস্থার প্রভাবে পরবর্তীতে কেমব্রিজ ও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা বিশ্বে পিএইচডি বা ডি. ফিল. ডিগ্রি প্রচলিত হয়। এভাবেই পিএইচডি ডিগ্রি একাডেমিক বিশ্বের সর্বোচ্চ বৌদ্ধিক অর্জন হিসেবে স্বীকৃতি পায়-যার লক্ষ্য কেবল জ্ঞান অর্জন নয়, বরং নতুন জ্ঞান সৃষ্টি। সময়ের পরিক্রমায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসর বেড়েছে- “ধর্মতত্ত্ব”, “আইন”, “চিকিৎসা” ও “দর্শন” ছাড়াও যুক্ত হয়েছে অসংখ্য শাখা। তবু সেই ঐতিহ্যবাহী নাম “ডক্টর অব ফিলোসফি” এখনও বহাল আছে, কারণ এটি জ্ঞানের প্রতি মানুষের চিরন্তন অনুসন্ধানী মানসিকতাকে প্রতিফলিত করে।
(বাকি অংশ আগামীকাল)
[লেখক: শিক্ষক ও সদস্য, দি অ্যাডভাইজরস: থিংক ট্যাংক অব সিভিল এডুকেশন]