alt

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

মামদানি দেখালেন নেতৃত্বের মূল পরিচয় কী

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

: শনিবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৫
image

জোহরান মামদানি

যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের নতুন মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী জোহরান মামদানি। নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের সাবেক গভর্নর ও স্বতন্ত্র প্রার্থী অ্যান্ড্রু কুমোকে হারিয়ে তিনি এই জয় পেয়েছেন। তার জয়ের সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে উল্লাস পরিলক্ষিত হচ্ছে, কারণ তিনি নাকি ‘মুসলমান’। ভারতীয় বংশোদ্ভূত এবং আফ্রিকায় জন্মগ্রহণকারী মামদানির বিজয়ে নিউইয়র্ক শহরেও আনন্দের বন্যা বয়ে গেছে। জোহরান মামদানি আমেরিকার লোক ছিলেন না, তিনি অভিবাসী এবং অভিবাসী বাবা-মায়ের সন্তান। তাই নিউইয়র্কের অভিবাসীরা তাকে সমর্থন করেছে। তিনি উগাণ্ডার মাহমুদ মামদানি ও ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা মীরা নায়ারের ছেলে। মীরা নায়ার মুসলমান হয়ে গেছেন, এমন কথা কোথাও লেখা নেই। মামদানি বিয়ে করেছেন সিরীয় শিল্পী রামা দুওয়াজিকে। রামা দুয়াজী একজন এনিমেটর এবং আর্টিস্ট, ‘হাতাকাটা’ এবং ‘বডি রিভিলিং’ জামা পরেন। মামদানীর বাবা মুসলমান বটে, কিন্তু শিয়া। মামদানি স্পষ্টবাদী, নির্বাচনী প্রচারে গাজায় ফিলিস্তিনিদের নির্বিচারে হত্যাকে তিনি ‘গণহত্যা’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। এছাড়া নিউইয়র্কে এলে তিনি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে গ্রেফতার করার হুমকি দিয়েছেন। তাই বলে তিনি কিন্তু ইহুদি বিদ্বেষী নন।

নিউইয়র্কের মেয়র নির্বাচন মামদানি বনাম ডনাল্ড ট্রাম্পের লড়াইয়ে পরিণত হয়েছিল। মামদানি মেয়র নির্বাচিত হলে কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থ নিউইয়র্কে দেওয়া হবে না বলে ট্রাম্পের হুশিয়ারিও কোন কাজে আসেনি। কিন্তু আমাদের দেশে দল ক্ষমতায় থাকলে প্রধানমন্ত্রীর কিছু বলার প্রয়োজন হয় না, প্রশাসন আপনাআপনি প্রভাবিত হয়, প্রশাসন প্রভাবিত হলে ভোট প্রভাবিত হয়। বিএনপি ক্ষমতায় আসবে সম্ভবত এই ভাবনায় এক পুলিশ সদস্যকে রাস্তায় বিএনপির নেতা রুহুল কবির রিজভী আহমেদকে পা ধরে সালাম করতে দেখা গেল। আমাদের দেশের রাজনৈতিক চরিত্র এত ভ্রষ্ট যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারও দলভুক্ত হয়ে যায়। সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটার দেশ পরিচালনার জন্য যে দলকে বিশ্বাস করে, সেই ভোটারই আবার নির্বাচন পরিচালনার জন্য নির্বাচিত সরকারকে বিশ্বাস করে না। প্রশ্ন হলো, নির্বাচন পরিচালনায় অসৎ প্রতিপন্ন হলে, দেশ পরিচালনায় সৎ হয় কী করে! জনগণের চরিত্রও বোঝা যায় না,- নির্বাচিত দলীয় সরকারের চাঁদাবাজি, ঘুষ, দুর্নীতি, অর্থ পাচার সব মেনে নিলেও সেই দলকেই ক্ষমতায় বসাতে চায় সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে। সৎ নির্বাচন করে অসৎ সরকার ক্ষমতায় বসানোর এত গরজ কেন জনগণের তা বোধগম্য হয় না। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে প্রতিটি দল স্বৈরাচার, জনগণও স্বৈরাচার পছন্দ করে, এবং এই কারণেই মামদানির মতো লোকেরা দলের মনোনয়ন পায় না, জনগণ ভোটও দেয় না, কিন্তু আমেরিকার মামদানিকে পছন্দ করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাদরেল প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের হুমকিও নিউইয়র্কের ভোটার বা প্রশাসনকে টলাতে পারেনি।

মামদানি মুসলমান হলেও ভারতীয় হিন্দু মায়ের গর্ভের মুসলমান। তার নির্বাচনে ব্যাপক প্রভাব রেখেছে ভারতের বলিউড। তাই ভারতের হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ই খুশি। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ঋষি সুনাককে নিয়েও কেনিয়া এবং ভারতের লোকজন খুশিতে আত্মহারা হয়েছিল। অবশ্য ঋষি সুনাককে নিয়ে পাকিস্তানও গর্ববোধ করছে, কারণ ভারত-পাকিস্তান হওয়ার আগে ১৯৩৫ সনে ঋষি সুনাকের দাদা-দাদী ভারতবর্ষের অবিভক্ত পাঞ্জাব থেকে পরিবার নিয়ে আফ্রিকার দেশ কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবিতে চলে যান এবং সেখান থেকে ১৯৬০ সনে বৃটেনে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। এই হিসেবে বাংলাদেশও ঋষি সুনাককে নিয়ে গর্ববোধ করতে পারতো, কিন্তু করেনি। বাংলাদেশের লোকজন ঋষি সুনাককে স্বকীয় মনে না করলেও তিনি কিন্তু হাঁটু গেড়ে চেয়ারের পাশে বসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সম্মান জানিয়েছিলেন। দুঃখজনক হচ্ছে, যে ঋষি সুনাককে নিয়ে ভারত, কেনিয়া ও পাকিস্তানের হিন্দু-মুসলমান গর্বিত সেই ঋষি সুনাকের দাদা-দাদীকে অবিভক্ত পাঞ্জাব ত্যাগ করতে হয়েছিল হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার কারণে।

ভারতকে পছন্দ করে না, অথচ ভারতীয় বংশোদ্ভূত মুসলমান মামদানিকে পছন্দ করে এমন একজনকে কারণ জিজ্ঞাসা করে উত্তর পেলাম, ‘পৃথিবীর যে কোন প্রান্তের কোন মুসলমানের অর্জনে আমার অন্তরে অনুরণন তোলে’। এই সম্প্রদায়প্রীতি শুধু মুসলামানদের মধ্যে নয়, সব ধর্মের লোকদের মধ্যেই পরিলক্ষিত হয়। শুধু কি ধর্ম? না, ধর্মের বাইরেও প্রীতিবোধের অনুভূতি রয়েছে। দেশের বাইরে হলে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে একই দেশের প্রবাসীরা পরষ্পরের প্রতি মমত্ববোধ অনুভব করে, আর দেশের ভেতরে হলে থাকে জেলাপ্রীতি, অঞ্চলপ্রীতি।দলীয় অনুভূতি গাঢ় হওয়ার আগে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে নদী-খাল-রাস্তা ইত্যাদির এপার-ওপারের জনগণের মধ্যে বিভাজন ছিল, আরও ছিল উত্তরপাড়া-দক্ষিণপাড়া অথবা পূর্বপাড়া-পশ্চিমপাড়ার দ্বন্দ্ব। নির্বাচনের পরও এই বিভাজনের বিলুপ্তি হয় না। রাজনীতি এখন অনেকের নিত্যদিনের জীবনসঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে, এই কারণে অফিস-আদালত, রাস্তা-ঘাট, বাড়ি-ঘর সর্বত্র ‘দলপ্রীতি’ চরম উগ্রতায় বিভৎস রূপ ধারণ করেছে।

জোহরান মামদানির জন্ম উগাণ্ডায়, ১৯৯১ সনে, বিয়ে করেছেন ২০২৫ সনে, বয়স মাত্র ৩৪ বছর। জন্মসূত্রে উগাণ্ডার সন্তান হলেও তিনি সাত বছর বয়স থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসিত হয়ে নিউইয়র্ক সিটিতে স্থায়ী হন। তিনি লেখাপড়া করেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, তার ক্যারিয়ারও গড়ে উঠেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। আমেরিকার লোকজন তাকে কখনো ভারতীয় বা উগাণ্ডার লোক মনে করে না। উগাণ্ডা বা ভারতীয় বংশোদ্ভূত বা মুসলমান পরিচয় নিয়ে আমরা গর্ববোধ করলেও তিনি কখনো আমেরিকার স্বার্থ বিকিয়ে মুসলমান বা ভারতের সেবা করবেন না। নিউইয়র্কবাসী তাকে নিউইয়র্কের সেবা করার জন্য মেয়রের আসনে বসিয়েছে। মামদানি মুসলমান পিতার ঔরসে এবং হিন্দু মায়ের গর্ভে জন্ম নিলেও মেয়র হওয়ার পর তার কর্মকাণ্ডে ধর্ম, বর্ণ বা গোত্রের কোনো বৈষম্য বা সংশ্লেষ থাকবে না। কারণ আমেরিকান মুসলমান মামদানি এবং অন্য দেশের সমর্থক মুসলমানদের মধ্যে একটি মনস্তাত্ত্বিক পার্থক্য রয়েছে। পার্থক্য রয়েছে বলেই নিউইয়র্কের অভিবাসী ও কৃষ্ণাঙ্গ নারীর পাশাপাশি ট্রান্স কমিউনিটির সদস্য এবং একক মা’কে তাদের সংগ্রামে পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন মামদানি।বাংলাদেশ হলে তাকে কোন মুসলমান ভোট দিত না, কারণ তিনি রূপান্তরিত লিঙ্গ বা ট্রান্সজেন্ডারদের সমর্থক।কিন্তু আমেরিকার ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই তাকে ভোট দিয়েছে, কারণ গণতান্ত্রিক ভোটের মাঠে ধর্ম বিবেচ্য বিষয় নয়, রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে ধর্ম অপ্রয়োজনীয়।

বিবিসি বাংলার ভাষ্যমতে, বিশ্বে ভারতই একমাত্র দেশ যে দেশের বংশোদ্ভূতরা ৩০টিরও বেশি দেশ শাসন করেছে বা এখনও ক্ষমতার শীর্ষে রয়েছে। ভারতীয় বংশোদ্ভূত প্রীতি প্যাটেল এক সময় ব্রিটেনের হোম সেক্রেটারি ছিলেন। আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার তৈরি রোবট-যান পারসিভিয়ারেন্স মঙ্গলের মাটি ছুঁয়েছে। তার নেপথ্যেও রয়েছেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত বিজ্ঞানী স্বাতী মোহন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকানদের আধিপত্য বাড়ছে মর্মে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন মন্তব্য করেছিলেন। বারাক হুসেইন ওবামা এবং ডনাল্ড ট্রাম্পের আগের আমলেও প্রশাসনে ভারতীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকানদের প্রাধান্য ছিল। ভাইস প্রেসিডেন্ট কামালা হ্যারিসও ভারতীয় বংশোদ্ভূত। তিনি ভাইস প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ভারতে মিষ্টি বিতরণ হয়েছে। কিন্তু কামালা হ্যারিস ভাইস প্রেসিডেন্ট হওয়ায় ভারতের কি কোন লাভ হয়েছে? ভারতের প্রেসিডেন্ট মুসলমান হলে বাংলাদেশের মুসলমানেরা খুশী হয়। কেনিয়া বংশোদ্ভূত বারাক হুসেইন ওবামা আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর বাংলাদেশে খুশীর বন্যা বয়ে যায়। কিন্তু তিনি পররাষ্ট্র নীতির বাস্তবায়নে মুসলমানদের একটুও ছাড় দেননি। আমেরিকা বা ইউরোপের কোন দেশে যখন বাংলাদেশ, পাকিস্তান বা ভারতীয় বংশোদ্ভূত কেউ প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী বা এমপি বা মেয়র হয় তখন আমাদের মিডিয়া এমনভাবে প্রচার করে যেন আমাদেরই আত্মীয়-স্বজন কেউ প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী কিংবা এমপি বা মেয়র হয়েছেন। গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর এমন ব্যক্তিগণের মনে পূর্ব পুরুষদের আবাসভূমি প্রকৃতপক্ষে কোন আবেগ তৈরি করে না। ইংল্যাণ্ডের জাতীয় ক্রিকেট দলে মঈন আলী, আদিল রশিদ খেলে। তারা কিন্তু প্রতিপক্ষ ইণ্ডিয়া, পাকিস্তানকে ছাড় দিয়ে খেলে না।

বেশ কিছুদিন আগে ফেইসবুক এবং পত্র পত্রিকায় আফগান বংশোদ্ভূত নারী ফুটবলার নাদিয়া নাদিমের সংবাদ বেশ প্রচার পেয়েছিল। তালিবানদের ভয়ে তিনি পালিয়ে ডেনমার্কের শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়ে ডেনমার্কে ফুটবল খেলতে শুরু করেন এবং অসাধারণ প্রতিভার পরিচয় দিয়ে ডেনমার্কের জাতীয় ফুটবল দলে অন্তর্ভুক্ত হন। ২০১৮ সনে ফোর্বস ম্যাগাজিন ‘মোস্ট পাওয়ারফুল উইমেন ইন ইন্টারন্যাশনাল স্পোর্টস’ তালিকায় তার নাম ঘোষণা করে। নাদিয়া ফুটবলার হিসেবে বিশ্বসেরা হওয়ার পর মুসলমানেরা তার সঙ্গে এক ধরনের আত্মীয়তার সম্পর্ক অনুভব করতে থাকেন। প্রতিভা বিকাশের অফুরন্ত সুযোগ থাকায় নাদিয়া, ঋষি সুনাক বা জোহরান মামদানি স্বদেশ ছেড়ে ইউরোপ এবং আমেরিকায় পাড়ি দেয়। পশ্চিমা দেশের শরণার্থী শিবির থেকেও বিশ্ব-আইকন গড়ে ওঠে, কিন্তু আমাদের মতো দেশের স্বচ্ছল পরিবার থেকেও এরা গড়পড়তা হয়ে যায়। পশ্চিমারা ধর্মের পরিচয়ে নয়, কর্মের পরিচয়ে মানুষ বিচার করে। আমাদের দেশের কেউ বিদেশে গিয়ে কর্মের বিচারে যখন শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে তখন তাদের অর্জনের ভাগীদার হয়ে নিজেদের দীনতা আর অক্ষমতাকে ঢাকার চেষ্টা করি।

ভারতীয় বংশোদ্ভূত ঋষি সুনাক যখন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী, তখন পাকিস্তান বংশোদ্ভূত হামজা ইউসুফ স্কটল্যান্ডের ফার্স্ট মিনিস্টার, স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতা নিয়ে নেগোসিয়েশন টেবিলের দুই পাশে দুইজন, অনেকটাই জিন্নাহ আর নেহেরুর রূপে। বৃটেনের ভারত ভাগের মতো স্কটল্যাণ্ডকে বৃটেন থেকে স্বাধীন করতেই ছিল ওই বৈঠক। কিন্তু হয়নি, কারণ কয়েক প্রজন্মের ব্যবধানে এই দুইজনের মধ্যে ভারত-পাকিস্তানের বিদ্বেষের জিন ছিল না। জোহরান মামদানির মধ্যেও উগাণ্ডা বা ভারতের জিন অনুপস্থিত, তাই ‘মুসলমান’ বা ‘হিন্দু’ অভিধায় অভিষিক্ত করে কোন সম্প্রদায়ের অতিরিক্ত স্বার্থ উদ্ধারের কোন সুযোগ নেই। ২০২৩ সনের জনমিতির হিসাব অনুযায়ী নিউইয়র্ক সিটিতে খ্রিস্টান ৪৮ শতাংশ, ইহুদি ১১ শতাংশ, মুসলিম ৯ শতাংশ, অন্যান্য ধর্মাবলম্বী ৬ শতাংশ এবং ২৬ শতাংশ লোক কোন ধর্মই মানে না। তাই মামদানিকে শুধু মুসলমান ভোট দেয়নি, ‘মানুষ’ ভোট দিয়েছে। ধর্ম দিয়ে ‘মানুষ’ বিচার না করে, মানবতা দিয়ে ‘মানুষ’ বিবেচিত হওয়া উচিত। মানবতাকে গৌণ করে ধর্মভিত্তিক হিন্দু-মুসলমান-ইহুদি-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান বিচার করা হলে গাজার ফিলিস্তিনিদের পক্ষে খ্রিস্টান অধ্যুষিত দেশ দক্ষিণ আফ্রিকা, কলম্বিয়া প্রভৃতি দেশের জোরালো সমর্থন অর্থহীন হয়ে যায়।

[লেখক: সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক; সাবেক এমডি, টাকশাল]

নিরাপদ সড়ক ভাবনা

অপরিকল্পিত বাঁধ-শিল্পায়নে বিপর্যস্ত বরেন্দ্র কৃষি

চেকের মামলায় বৈধ বিনিময়, লেনদেন, দেনা-পাওনা প্রমাণ ছাড়া আর জেল নয়

নবাগত শিক্ষকদের পেশাগত ভাবনা

মাদকাসক্তি: শুধু নিরাময় নয়, চাই সমাজ ব্যবস্থার সংস্কার

আমেরিকার “নো কিংস” আন্দোলন

ঘি তো আমাদের লাগবেই, নো হাংকি পাংকি!

“মামদানি না জামদানি...”

ভাষার বৈচিত্র্য রক্ষায় নীরব বিপ্লব

উপাত্ত সুরক্ষা আইন : গোপনীয়তা রক্ষা নাকি রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ?

সমতা কি ন্যায্যতা নিশ্চিত করে?

ডেঙ্গু সংকট দূরদৃষ্টির ব্যর্থতা

ষাটের দশকে বামপন্থী ভাবনার উত্থান ও বিবর্তন

দেখিতে পাও না তুমি মৃত্যুদূত দাঁড়ায়েছে দ্বারে!

বায়ুর অপর নাম জীবন

ছবি

হাওরের জীবন ও সংস্কৃতি

বিখণ্ডিত আত্মপরিচয়: তরল সহানুভূতিতে নৈতিক মূলধনের সমাজতত্ত্ব

প্রভাষকের ‘প্রভা’ যখন ‘শোক’: শিক্ষা ক্যাডারে পদোন্নতি বঞ্চনা

যুদ্ধ বিরতি গাজাবাসীর জন্য জরুরি ছিল

লবলং খালের মৃত্যু: স্মৃতিতে নদী, বাস্তবে দূষণ

বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা: অর্থনৈতিক স্থিতির পূর্বশর্ত

হায় যম! আর কতক্ষণ, হবে অপেক্ষা করিতে মোরে?

পোশাক শিল্প : অগ্রগতি ও শ্রমিকের অধিকার

গণভোটের রাজনৈতিক গুরুত্ব

বামঘরানার বাটখারা...

বাগদা ফার্ম : স্মারকলিপি, অবরোধ, অনশন, আন্দোলন- কিছুতেই বরফ গলেনি

ব্যাটারি-শকট: নতুন সংকট

মতপ্রকাশ কিংবা দ্বিমত পোষণ: নাগরিক অধিকার ও রাজনৈতিক বাস্তবতা

সরকারি কর্মচারীদের জন্য নতুন ব্যাংক কি আদৌ প্রয়োজন

ট্রাম্প ও শি’র ‘কৌশলগত শান্তি’

আশার সমাজতত্ত্ব: বিভ্রান্তির যুগে ভবিষ্যৎ নির্মাণের বিপ্লবী বিজ্ঞান

পিএইচডি: উচ্চ শিক্ষার মানদণ্ড না প্রতীকী মরীচিকা?

ডিম নয় তবু অশ্বডিম্ব!

ছবি

অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও নির্বাচন

পিএইচডি: উচ্চ শিক্ষার মানদণ্ড না প্রতীকী মরীচিকা?

প্রকৃতার্থে ফকির কারা

tab

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

মামদানি দেখালেন নেতৃত্বের মূল পরিচয় কী

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

image

জোহরান মামদানি

শনিবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৫

যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের নতুন মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী জোহরান মামদানি। নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের সাবেক গভর্নর ও স্বতন্ত্র প্রার্থী অ্যান্ড্রু কুমোকে হারিয়ে তিনি এই জয় পেয়েছেন। তার জয়ের সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে উল্লাস পরিলক্ষিত হচ্ছে, কারণ তিনি নাকি ‘মুসলমান’। ভারতীয় বংশোদ্ভূত এবং আফ্রিকায় জন্মগ্রহণকারী মামদানির বিজয়ে নিউইয়র্ক শহরেও আনন্দের বন্যা বয়ে গেছে। জোহরান মামদানি আমেরিকার লোক ছিলেন না, তিনি অভিবাসী এবং অভিবাসী বাবা-মায়ের সন্তান। তাই নিউইয়র্কের অভিবাসীরা তাকে সমর্থন করেছে। তিনি উগাণ্ডার মাহমুদ মামদানি ও ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা মীরা নায়ারের ছেলে। মীরা নায়ার মুসলমান হয়ে গেছেন, এমন কথা কোথাও লেখা নেই। মামদানি বিয়ে করেছেন সিরীয় শিল্পী রামা দুওয়াজিকে। রামা দুয়াজী একজন এনিমেটর এবং আর্টিস্ট, ‘হাতাকাটা’ এবং ‘বডি রিভিলিং’ জামা পরেন। মামদানীর বাবা মুসলমান বটে, কিন্তু শিয়া। মামদানি স্পষ্টবাদী, নির্বাচনী প্রচারে গাজায় ফিলিস্তিনিদের নির্বিচারে হত্যাকে তিনি ‘গণহত্যা’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। এছাড়া নিউইয়র্কে এলে তিনি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে গ্রেফতার করার হুমকি দিয়েছেন। তাই বলে তিনি কিন্তু ইহুদি বিদ্বেষী নন।

নিউইয়র্কের মেয়র নির্বাচন মামদানি বনাম ডনাল্ড ট্রাম্পের লড়াইয়ে পরিণত হয়েছিল। মামদানি মেয়র নির্বাচিত হলে কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থ নিউইয়র্কে দেওয়া হবে না বলে ট্রাম্পের হুশিয়ারিও কোন কাজে আসেনি। কিন্তু আমাদের দেশে দল ক্ষমতায় থাকলে প্রধানমন্ত্রীর কিছু বলার প্রয়োজন হয় না, প্রশাসন আপনাআপনি প্রভাবিত হয়, প্রশাসন প্রভাবিত হলে ভোট প্রভাবিত হয়। বিএনপি ক্ষমতায় আসবে সম্ভবত এই ভাবনায় এক পুলিশ সদস্যকে রাস্তায় বিএনপির নেতা রুহুল কবির রিজভী আহমেদকে পা ধরে সালাম করতে দেখা গেল। আমাদের দেশের রাজনৈতিক চরিত্র এত ভ্রষ্ট যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারও দলভুক্ত হয়ে যায়। সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটার দেশ পরিচালনার জন্য যে দলকে বিশ্বাস করে, সেই ভোটারই আবার নির্বাচন পরিচালনার জন্য নির্বাচিত সরকারকে বিশ্বাস করে না। প্রশ্ন হলো, নির্বাচন পরিচালনায় অসৎ প্রতিপন্ন হলে, দেশ পরিচালনায় সৎ হয় কী করে! জনগণের চরিত্রও বোঝা যায় না,- নির্বাচিত দলীয় সরকারের চাঁদাবাজি, ঘুষ, দুর্নীতি, অর্থ পাচার সব মেনে নিলেও সেই দলকেই ক্ষমতায় বসাতে চায় সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে। সৎ নির্বাচন করে অসৎ সরকার ক্ষমতায় বসানোর এত গরজ কেন জনগণের তা বোধগম্য হয় না। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে প্রতিটি দল স্বৈরাচার, জনগণও স্বৈরাচার পছন্দ করে, এবং এই কারণেই মামদানির মতো লোকেরা দলের মনোনয়ন পায় না, জনগণ ভোটও দেয় না, কিন্তু আমেরিকার মামদানিকে পছন্দ করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাদরেল প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের হুমকিও নিউইয়র্কের ভোটার বা প্রশাসনকে টলাতে পারেনি।

মামদানি মুসলমান হলেও ভারতীয় হিন্দু মায়ের গর্ভের মুসলমান। তার নির্বাচনে ব্যাপক প্রভাব রেখেছে ভারতের বলিউড। তাই ভারতের হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ই খুশি। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ঋষি সুনাককে নিয়েও কেনিয়া এবং ভারতের লোকজন খুশিতে আত্মহারা হয়েছিল। অবশ্য ঋষি সুনাককে নিয়ে পাকিস্তানও গর্ববোধ করছে, কারণ ভারত-পাকিস্তান হওয়ার আগে ১৯৩৫ সনে ঋষি সুনাকের দাদা-দাদী ভারতবর্ষের অবিভক্ত পাঞ্জাব থেকে পরিবার নিয়ে আফ্রিকার দেশ কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবিতে চলে যান এবং সেখান থেকে ১৯৬০ সনে বৃটেনে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। এই হিসেবে বাংলাদেশও ঋষি সুনাককে নিয়ে গর্ববোধ করতে পারতো, কিন্তু করেনি। বাংলাদেশের লোকজন ঋষি সুনাককে স্বকীয় মনে না করলেও তিনি কিন্তু হাঁটু গেড়ে চেয়ারের পাশে বসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সম্মান জানিয়েছিলেন। দুঃখজনক হচ্ছে, যে ঋষি সুনাককে নিয়ে ভারত, কেনিয়া ও পাকিস্তানের হিন্দু-মুসলমান গর্বিত সেই ঋষি সুনাকের দাদা-দাদীকে অবিভক্ত পাঞ্জাব ত্যাগ করতে হয়েছিল হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার কারণে।

ভারতকে পছন্দ করে না, অথচ ভারতীয় বংশোদ্ভূত মুসলমান মামদানিকে পছন্দ করে এমন একজনকে কারণ জিজ্ঞাসা করে উত্তর পেলাম, ‘পৃথিবীর যে কোন প্রান্তের কোন মুসলমানের অর্জনে আমার অন্তরে অনুরণন তোলে’। এই সম্প্রদায়প্রীতি শুধু মুসলামানদের মধ্যে নয়, সব ধর্মের লোকদের মধ্যেই পরিলক্ষিত হয়। শুধু কি ধর্ম? না, ধর্মের বাইরেও প্রীতিবোধের অনুভূতি রয়েছে। দেশের বাইরে হলে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে একই দেশের প্রবাসীরা পরষ্পরের প্রতি মমত্ববোধ অনুভব করে, আর দেশের ভেতরে হলে থাকে জেলাপ্রীতি, অঞ্চলপ্রীতি।দলীয় অনুভূতি গাঢ় হওয়ার আগে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে নদী-খাল-রাস্তা ইত্যাদির এপার-ওপারের জনগণের মধ্যে বিভাজন ছিল, আরও ছিল উত্তরপাড়া-দক্ষিণপাড়া অথবা পূর্বপাড়া-পশ্চিমপাড়ার দ্বন্দ্ব। নির্বাচনের পরও এই বিভাজনের বিলুপ্তি হয় না। রাজনীতি এখন অনেকের নিত্যদিনের জীবনসঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে, এই কারণে অফিস-আদালত, রাস্তা-ঘাট, বাড়ি-ঘর সর্বত্র ‘দলপ্রীতি’ চরম উগ্রতায় বিভৎস রূপ ধারণ করেছে।

জোহরান মামদানির জন্ম উগাণ্ডায়, ১৯৯১ সনে, বিয়ে করেছেন ২০২৫ সনে, বয়স মাত্র ৩৪ বছর। জন্মসূত্রে উগাণ্ডার সন্তান হলেও তিনি সাত বছর বয়স থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসিত হয়ে নিউইয়র্ক সিটিতে স্থায়ী হন। তিনি লেখাপড়া করেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, তার ক্যারিয়ারও গড়ে উঠেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। আমেরিকার লোকজন তাকে কখনো ভারতীয় বা উগাণ্ডার লোক মনে করে না। উগাণ্ডা বা ভারতীয় বংশোদ্ভূত বা মুসলমান পরিচয় নিয়ে আমরা গর্ববোধ করলেও তিনি কখনো আমেরিকার স্বার্থ বিকিয়ে মুসলমান বা ভারতের সেবা করবেন না। নিউইয়র্কবাসী তাকে নিউইয়র্কের সেবা করার জন্য মেয়রের আসনে বসিয়েছে। মামদানি মুসলমান পিতার ঔরসে এবং হিন্দু মায়ের গর্ভে জন্ম নিলেও মেয়র হওয়ার পর তার কর্মকাণ্ডে ধর্ম, বর্ণ বা গোত্রের কোনো বৈষম্য বা সংশ্লেষ থাকবে না। কারণ আমেরিকান মুসলমান মামদানি এবং অন্য দেশের সমর্থক মুসলমানদের মধ্যে একটি মনস্তাত্ত্বিক পার্থক্য রয়েছে। পার্থক্য রয়েছে বলেই নিউইয়র্কের অভিবাসী ও কৃষ্ণাঙ্গ নারীর পাশাপাশি ট্রান্স কমিউনিটির সদস্য এবং একক মা’কে তাদের সংগ্রামে পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন মামদানি।বাংলাদেশ হলে তাকে কোন মুসলমান ভোট দিত না, কারণ তিনি রূপান্তরিত লিঙ্গ বা ট্রান্সজেন্ডারদের সমর্থক।কিন্তু আমেরিকার ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই তাকে ভোট দিয়েছে, কারণ গণতান্ত্রিক ভোটের মাঠে ধর্ম বিবেচ্য বিষয় নয়, রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে ধর্ম অপ্রয়োজনীয়।

বিবিসি বাংলার ভাষ্যমতে, বিশ্বে ভারতই একমাত্র দেশ যে দেশের বংশোদ্ভূতরা ৩০টিরও বেশি দেশ শাসন করেছে বা এখনও ক্ষমতার শীর্ষে রয়েছে। ভারতীয় বংশোদ্ভূত প্রীতি প্যাটেল এক সময় ব্রিটেনের হোম সেক্রেটারি ছিলেন। আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার তৈরি রোবট-যান পারসিভিয়ারেন্স মঙ্গলের মাটি ছুঁয়েছে। তার নেপথ্যেও রয়েছেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত বিজ্ঞানী স্বাতী মোহন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকানদের আধিপত্য বাড়ছে মর্মে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন মন্তব্য করেছিলেন। বারাক হুসেইন ওবামা এবং ডনাল্ড ট্রাম্পের আগের আমলেও প্রশাসনে ভারতীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকানদের প্রাধান্য ছিল। ভাইস প্রেসিডেন্ট কামালা হ্যারিসও ভারতীয় বংশোদ্ভূত। তিনি ভাইস প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ভারতে মিষ্টি বিতরণ হয়েছে। কিন্তু কামালা হ্যারিস ভাইস প্রেসিডেন্ট হওয়ায় ভারতের কি কোন লাভ হয়েছে? ভারতের প্রেসিডেন্ট মুসলমান হলে বাংলাদেশের মুসলমানেরা খুশী হয়। কেনিয়া বংশোদ্ভূত বারাক হুসেইন ওবামা আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর বাংলাদেশে খুশীর বন্যা বয়ে যায়। কিন্তু তিনি পররাষ্ট্র নীতির বাস্তবায়নে মুসলমানদের একটুও ছাড় দেননি। আমেরিকা বা ইউরোপের কোন দেশে যখন বাংলাদেশ, পাকিস্তান বা ভারতীয় বংশোদ্ভূত কেউ প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী বা এমপি বা মেয়র হয় তখন আমাদের মিডিয়া এমনভাবে প্রচার করে যেন আমাদেরই আত্মীয়-স্বজন কেউ প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী কিংবা এমপি বা মেয়র হয়েছেন। গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর এমন ব্যক্তিগণের মনে পূর্ব পুরুষদের আবাসভূমি প্রকৃতপক্ষে কোন আবেগ তৈরি করে না। ইংল্যাণ্ডের জাতীয় ক্রিকেট দলে মঈন আলী, আদিল রশিদ খেলে। তারা কিন্তু প্রতিপক্ষ ইণ্ডিয়া, পাকিস্তানকে ছাড় দিয়ে খেলে না।

বেশ কিছুদিন আগে ফেইসবুক এবং পত্র পত্রিকায় আফগান বংশোদ্ভূত নারী ফুটবলার নাদিয়া নাদিমের সংবাদ বেশ প্রচার পেয়েছিল। তালিবানদের ভয়ে তিনি পালিয়ে ডেনমার্কের শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়ে ডেনমার্কে ফুটবল খেলতে শুরু করেন এবং অসাধারণ প্রতিভার পরিচয় দিয়ে ডেনমার্কের জাতীয় ফুটবল দলে অন্তর্ভুক্ত হন। ২০১৮ সনে ফোর্বস ম্যাগাজিন ‘মোস্ট পাওয়ারফুল উইমেন ইন ইন্টারন্যাশনাল স্পোর্টস’ তালিকায় তার নাম ঘোষণা করে। নাদিয়া ফুটবলার হিসেবে বিশ্বসেরা হওয়ার পর মুসলমানেরা তার সঙ্গে এক ধরনের আত্মীয়তার সম্পর্ক অনুভব করতে থাকেন। প্রতিভা বিকাশের অফুরন্ত সুযোগ থাকায় নাদিয়া, ঋষি সুনাক বা জোহরান মামদানি স্বদেশ ছেড়ে ইউরোপ এবং আমেরিকায় পাড়ি দেয়। পশ্চিমা দেশের শরণার্থী শিবির থেকেও বিশ্ব-আইকন গড়ে ওঠে, কিন্তু আমাদের মতো দেশের স্বচ্ছল পরিবার থেকেও এরা গড়পড়তা হয়ে যায়। পশ্চিমারা ধর্মের পরিচয়ে নয়, কর্মের পরিচয়ে মানুষ বিচার করে। আমাদের দেশের কেউ বিদেশে গিয়ে কর্মের বিচারে যখন শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে তখন তাদের অর্জনের ভাগীদার হয়ে নিজেদের দীনতা আর অক্ষমতাকে ঢাকার চেষ্টা করি।

ভারতীয় বংশোদ্ভূত ঋষি সুনাক যখন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী, তখন পাকিস্তান বংশোদ্ভূত হামজা ইউসুফ স্কটল্যান্ডের ফার্স্ট মিনিস্টার, স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতা নিয়ে নেগোসিয়েশন টেবিলের দুই পাশে দুইজন, অনেকটাই জিন্নাহ আর নেহেরুর রূপে। বৃটেনের ভারত ভাগের মতো স্কটল্যাণ্ডকে বৃটেন থেকে স্বাধীন করতেই ছিল ওই বৈঠক। কিন্তু হয়নি, কারণ কয়েক প্রজন্মের ব্যবধানে এই দুইজনের মধ্যে ভারত-পাকিস্তানের বিদ্বেষের জিন ছিল না। জোহরান মামদানির মধ্যেও উগাণ্ডা বা ভারতের জিন অনুপস্থিত, তাই ‘মুসলমান’ বা ‘হিন্দু’ অভিধায় অভিষিক্ত করে কোন সম্প্রদায়ের অতিরিক্ত স্বার্থ উদ্ধারের কোন সুযোগ নেই। ২০২৩ সনের জনমিতির হিসাব অনুযায়ী নিউইয়র্ক সিটিতে খ্রিস্টান ৪৮ শতাংশ, ইহুদি ১১ শতাংশ, মুসলিম ৯ শতাংশ, অন্যান্য ধর্মাবলম্বী ৬ শতাংশ এবং ২৬ শতাংশ লোক কোন ধর্মই মানে না। তাই মামদানিকে শুধু মুসলমান ভোট দেয়নি, ‘মানুষ’ ভোট দিয়েছে। ধর্ম দিয়ে ‘মানুষ’ বিচার না করে, মানবতা দিয়ে ‘মানুষ’ বিবেচিত হওয়া উচিত। মানবতাকে গৌণ করে ধর্মভিত্তিক হিন্দু-মুসলমান-ইহুদি-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান বিচার করা হলে গাজার ফিলিস্তিনিদের পক্ষে খ্রিস্টান অধ্যুষিত দেশ দক্ষিণ আফ্রিকা, কলম্বিয়া প্রভৃতি দেশের জোরালো সমর্থন অর্থহীন হয়ে যায়।

[লেখক: সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক; সাবেক এমডি, টাকশাল]

back to top