alt

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

অপরিকল্পিত বাঁধ-শিল্পায়নে বিপর্যস্ত বরেন্দ্র কৃষি

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন

: শনিবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৫

বরেন্দ্র হলো উত্তরবঙ্গের একটি প্রাচীন ও ঐতিহাসিক অঞ্চল, যা বর্তমানে বাংলাদেশের রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের অংশ। বরেন্দ্র অঞ্চলের ভৌগোলিক অবস্থান হলো-গঙ্গা ও করতোয়া নদীর মধ্যবর্তী এই জনপদটি বর্তমানে বাংলাদেশের রাজশাহী, রংপুর, বগুড়া, পাবনা, দিনাজপুর এবং ভারতের উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিণ দিনাজপুর ও মালদহ জেলার অংশ নিয়ে গঠিত।

এই অঞ্চলের মাটির ধরন মূলত দোআঁশ, যেখানে বিভিন্ন ধরনের ফসল উৎপন্ন হয় এবং এটি প্লাইস্টোসিন যুগের পলল দ্বারা গঠিত। রাজশাহী জেলার বরেন্দ্র অঞ্চলের অধীন ভূমি প্রধানত তানোর ও গোদাগাড়ী উপজেলার। এই দুই উপজেলা ধান উৎপাদনে দেশের অন্যতম।

তবে চলতি আমন মৌসুমে অকালবৃষ্টিতে এখানকার ধানের মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। আধাপাকা ধানগাছ ঝড়ো হাওয়ায় জমিতে পড়ে যায় এবং তা ভারী বর্ষণে তলিয়ে গেছে। এবারের আমন ফলনে কৃষকরা বাম্পার ফলনের আশা করেছিলেন, কিন্তু এই বৃষ্টির কারণে তারা আশাহত হয়েছেন।

গোদাগাড়ী উপজেলায় চলতি বছরের (২০২৫) আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৪,৯৭৫ হেক্টর জমিতে, যা অর্জিত হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে আমনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮০ হাজার ৫০ হেক্টর। লক্ষ্যমাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। ২০২২-২৩ সালে ধান উৎপাদন হয়েছিল ২ লাখা ৮৬ হাজার ১৪৫ মেট্রিক টন। এই উপজেলায় কৃষিজমি কমছে-এ তথ্য থেকেই অনুমান করা যায় যে তিন বছর আগে যেখানে ৮০ হাজার ৫০ হেক্টর জমিতে আমন চাষ হতো, সেখানে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে চাষ হচ্ছে মাত্র ২৪ হাজার ৯৭৫ হেক্টরে। এই জমিগুলোর কী হচ্ছে তা বিশদভাবে জানা প্রয়োজন।

অপরদিকে তানোর উপজেলার চলতি মৌসুমে আমনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২২ হাজার ৬৩৫ হেক্টর। এর মধ্যে হাইব্রিড ২৮ হেক্টর, উফশী জাত ২২ হাজার ১১৭ হেক্টর এবং স্থানীয় জাতের চাষ হয়েছে ৫৫০ হেক্টর। চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৬০ হাজার ২৯৮ মেট্রিক টন।

এই দুই উপজেলার কৃষকেরা অকালবৃষ্টিতে বিপাকে পড়েছেন। গত ত্রিশ বছরে এই প্রথম এ ধরনের বড় বৃষ্টি হলো। গত ২৯ ও ৩০ অক্টোবর ভারী বৃষ্টি ও ঝড়ো হাওয়ায় তানোর ও গোদাগাড়ী উপজেলার আমন ধানের পাকা গাছ নুয়ে পড়েছে। ২৮ অক্টোবর থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত মোট বৃষ্টিপাত হয়েছে ২২৮ মিলিমিটার।

বৃষ্টির পর পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থায় বাধা থাকায় তানোর-গোদাগাড়ীর ফসলের জমিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। প্রায় তিন থেকে সাত দিন পর্যন্ত বৃষ্টির পানি জমে থাকে জমির ওপর, যার ফলে শস্যের ব্যাপক ক্ষতি হয়। গ্রামের উঁচু ভিটেতেও জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। বহু মাটির ঘর এই কারণে ধসে পড়ে।

এই বৃষ্টিতে গোদাগাড়ী ও তানোর উপজেলার প্রান্তিক কৃষকের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। আবহাওয়াবিদ সূত্রে জানা যায়, বরেন্দ্র অঞ্চলে গড় বৃষ্টিপাত প্রায় ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হজার ৩০০ মিলিমিটার, অপরদিকে দেশের গড় বৃষ্টিপাত প্রায় ২ হাজার ৫০০ মিলিমিটার। অর্থাৎ সারা দেশের তুলনায় বরেন্দ্রর বৃষ্টিপাত উল্লেখযোগ্যভাবে কম।

তবে বরেন্দ্র অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ স্থান ও বছরভেদে পরিবর্তিত হয়-যেমন দিনাজপুরে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত প্রায় ১ হাজার ৮১৩ মিমি, রংপুরে ২ হাজার ৩২৪ মিমি এবং রাজশাহীতে ১ হাজার ৭০৫ মিমি। এখানকার জলবায়ু উষ্ণ ও আর্দ্র। কিন্তু এ বছর অকালবৃষ্টিতে কৃষকেরা আতঙ্কে ভুগছেন।

তানোর-গোদাগাড়ীতে পুকুর খনন, বিলে মাছ চাষের জন্য বাঁধ, ছোট-বড় খাড়িতে (খাল) অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণের ফলে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা ব্যাহত হচ্ছে। তাছাড়া শিল্পায়নের কারণে পানি নিষ্কাশন ও শস্য উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটছে। বিশেষ করে রিশিকুল, দেওপাড়া ও পাকড়ি ইউনিয়নে কিছু শিল্পকারখানার বর্জ্য দূষিত পানি কৃষিজমিতে পড়ে জমিগুলো অনুপযোগী হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

সরকারি হিসাবে দেখা যায়, গোদাগাড়ী উপজেলায় বিলের সংখ্যা ১৬টি, পুকুর/দিঘীর সংখ্যা ৫,০৩৮টি, খালের সংখ্যা ৫টি। পদ্মা ও মহানন্দা নদী উপজেলার বৃহৎ অংশ জুড়ে প্রবাহিত এবং এর সীমানা নির্ধারণে ভূমিকা রাখে। এছাড়া রিশিকুল নদী গোদাগাড়ীর একটি স্থানীয় নদী, যা ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং শিব নদীর অংশ। প্রধান পাঁচটি খাল ছাড়াও আছে অসংখ্য ছোট খাল।

তানোর উপজেলায় পুকুর ৫ হাজার ৩৮৪টি এবং শিব নদী এ উপজেলার একমাত্র নদী। নদীটি নওগাঁ ও রাজশাহী জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত। নদীটির দৈর্ঘ্য ৭১ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ৩৭ মিটার এবং প্রকৃতি সর্পিলাকার। এ নদীর সঙ্গে রয়েছে অসংখ্য ছোট খাল।

অপরিকল্পিত মাছ চাষ, মুরগি-হাঁস-গরু পালনের খামার গড়ে ওঠায় এসব জলাশয় এখন আর সঠিকভাবে কাজ করছে না।

গোদাগাড়ী উপজেলায় নতুন বড় শিল্পকারখানা হিসেবে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের একটি ফ্যাক্টরি গড়ে উঠেছে। এছাড়াও স্থানীয়ভাবে গড়ে উঠছে বিভিন্ন কুটির ও হস্তশিল্প-ম্যাঙ্গো পাল্প, ফুড প্রসেসিং, রেশম, নকশিকাঁথা, মৃৎশিল্প ও বিড়ি শিল্প। প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ আমনাতপুরে বরেন্দ্র ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে একটি কারখানা স্থাপন করেছে, যেখানে প্রাথমিকভাবে আম ও মৌসুমী ফল প্রক্রিয়াজাত করা হয়। ভবিষ্যতে এখানে ফ্রোজেন ফুডস, নুডলসসহ নানা খাদ্যপণ্য উৎপাদনের পরিকল্পনা রয়েছে।

উপজেলার সীমানা ঘেঁষে রয়েছে পবা উপজেলার দামকুড়া। গোদাগাড়ী দিয়ে প্রবাহিত নদী এসে পড়েছে দামকুড়া ইউনিয়নে। এসিআই ও ভারতীয় প্রতিষ্ঠান গোদরেজ ১৫২ কোটি টাকা বিনিয়োগে সেখানে ফিশ ফিড শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে। নাহার অটোমোবাইল কারখানা ৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে উৎপাদনে এসেছে। নাবিল গ্রুপ গোদাগাড়ীর ঝিকরাপাড়ায় ৪০ একর জমির ওপর কারখানা স্থাপন করেছে। নাবিল গ্রুপের আরেকটি সফল উদ্যোগ ‘নাবা ক্রপ কেয়ার’ উন্নত জাতের বীজ সংগ্রহ ও উৎপাদন করছে এ এলাকায়।

দেখা যাচ্ছে, বরেন্দ্র অঞ্চলের অপরিকল্পিত বাঁধ ও শিল্পায়নের কারণে কৃষির ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। এর ফলে কৃষিজমিতে জলাবদ্ধতা ও খরা দেখা দিচ্ছে। মাছ চাষের উদ্দেশ্যে নির্মিত অপরিকল্পিত বাঁধ নদী ও খালের স্বাভাবিক প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে, যার ফলে ভাটি অঞ্চলে পানিপ্রবাহ কমে যায় বা জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। এতে বহু জমিতে ভবিষ্যতে ফসল উৎপাদন অসম্ভব হয়ে উঠতে পারে।

অন্যদিকে শিল্পকারখানার বর্জ্য ও অপরিকল্পিত স্থাপনা পরিবেশ ও মাটিকে দূষিত করছে, যা দীর্ঘমেয়াদে কৃষির জন্য বড় হুমকি। বরেন্দ্র এলাকায় অপরিকল্পিত বাঁধ ও রাস্তার কারণে বহু কৃষিজমি জলাবদ্ধতার শিকার হয়েছে। এই দুই উপজেলায় অনেক বাঁধ উজানের পানিপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি করছে। ফলে অঞ্চলে পানির সরবরাহ কমে যায় এবং খরা দেখা দেয়।

গোদাগাড়ীর কিছু এলাকায় শিল্পকারখানার বর্জ্য ও রাসায়নিক পদার্থ বিল, খাল ও কৃষিজমিকে দূষিত করছে। এতে মাটির উর্বরতা নষ্ট হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে উৎপাদন কমে যাবে। অপরিকল্পিত শিল্পায়নের ফলে দ্রুত কৃষিজমি কমে যাচ্ছে, যা খাদ্য নিরাপত্তা ও স্থানীয় অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

এই দুই উপজেলার সামগ্রিক বিষয়টি পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। কারণ শিল্পায়ন, মাছ চাষ, পুকুর খনন, মাটি সমতলকরণ, বাগানবাড়ি নির্মাণ এবং পশুপাখি পালনের খামার কতটা পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে চলছে-তা যাচাই করা জরুরি।

[লেখক : উন্নয়নকর্মী]

নিরাপদ সড়ক ভাবনা

ছবি

মামদানি দেখালেন নেতৃত্বের মূল পরিচয় কী

চেকের মামলায় বৈধ বিনিময়, লেনদেন, দেনা-পাওনা প্রমাণ ছাড়া আর জেল নয়

নবাগত শিক্ষকদের পেশাগত ভাবনা

মাদকাসক্তি: শুধু নিরাময় নয়, চাই সমাজ ব্যবস্থার সংস্কার

আমেরিকার “নো কিংস” আন্দোলন

ঘি তো আমাদের লাগবেই, নো হাংকি পাংকি!

“মামদানি না জামদানি...”

ভাষার বৈচিত্র্য রক্ষায় নীরব বিপ্লব

উপাত্ত সুরক্ষা আইন : গোপনীয়তা রক্ষা নাকি রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ?

সমতা কি ন্যায্যতা নিশ্চিত করে?

ডেঙ্গু সংকট দূরদৃষ্টির ব্যর্থতা

ষাটের দশকে বামপন্থী ভাবনার উত্থান ও বিবর্তন

দেখিতে পাও না তুমি মৃত্যুদূত দাঁড়ায়েছে দ্বারে!

বায়ুর অপর নাম জীবন

ছবি

হাওরের জীবন ও সংস্কৃতি

বিখণ্ডিত আত্মপরিচয়: তরল সহানুভূতিতে নৈতিক মূলধনের সমাজতত্ত্ব

প্রভাষকের ‘প্রভা’ যখন ‘শোক’: শিক্ষা ক্যাডারে পদোন্নতি বঞ্চনা

যুদ্ধ বিরতি গাজাবাসীর জন্য জরুরি ছিল

লবলং খালের মৃত্যু: স্মৃতিতে নদী, বাস্তবে দূষণ

বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা: অর্থনৈতিক স্থিতির পূর্বশর্ত

হায় যম! আর কতক্ষণ, হবে অপেক্ষা করিতে মোরে?

পোশাক শিল্প : অগ্রগতি ও শ্রমিকের অধিকার

গণভোটের রাজনৈতিক গুরুত্ব

বামঘরানার বাটখারা...

বাগদা ফার্ম : স্মারকলিপি, অবরোধ, অনশন, আন্দোলন- কিছুতেই বরফ গলেনি

ব্যাটারি-শকট: নতুন সংকট

মতপ্রকাশ কিংবা দ্বিমত পোষণ: নাগরিক অধিকার ও রাজনৈতিক বাস্তবতা

সরকারি কর্মচারীদের জন্য নতুন ব্যাংক কি আদৌ প্রয়োজন

ট্রাম্প ও শি’র ‘কৌশলগত শান্তি’

আশার সমাজতত্ত্ব: বিভ্রান্তির যুগে ভবিষ্যৎ নির্মাণের বিপ্লবী বিজ্ঞান

পিএইচডি: উচ্চ শিক্ষার মানদণ্ড না প্রতীকী মরীচিকা?

ডিম নয় তবু অশ্বডিম্ব!

ছবি

অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও নির্বাচন

পিএইচডি: উচ্চ শিক্ষার মানদণ্ড না প্রতীকী মরীচিকা?

প্রকৃতার্থে ফকির কারা

tab

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

অপরিকল্পিত বাঁধ-শিল্পায়নে বিপর্যস্ত বরেন্দ্র কৃষি

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন

শনিবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৫

বরেন্দ্র হলো উত্তরবঙ্গের একটি প্রাচীন ও ঐতিহাসিক অঞ্চল, যা বর্তমানে বাংলাদেশের রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের অংশ। বরেন্দ্র অঞ্চলের ভৌগোলিক অবস্থান হলো-গঙ্গা ও করতোয়া নদীর মধ্যবর্তী এই জনপদটি বর্তমানে বাংলাদেশের রাজশাহী, রংপুর, বগুড়া, পাবনা, দিনাজপুর এবং ভারতের উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিণ দিনাজপুর ও মালদহ জেলার অংশ নিয়ে গঠিত।

এই অঞ্চলের মাটির ধরন মূলত দোআঁশ, যেখানে বিভিন্ন ধরনের ফসল উৎপন্ন হয় এবং এটি প্লাইস্টোসিন যুগের পলল দ্বারা গঠিত। রাজশাহী জেলার বরেন্দ্র অঞ্চলের অধীন ভূমি প্রধানত তানোর ও গোদাগাড়ী উপজেলার। এই দুই উপজেলা ধান উৎপাদনে দেশের অন্যতম।

তবে চলতি আমন মৌসুমে অকালবৃষ্টিতে এখানকার ধানের মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। আধাপাকা ধানগাছ ঝড়ো হাওয়ায় জমিতে পড়ে যায় এবং তা ভারী বর্ষণে তলিয়ে গেছে। এবারের আমন ফলনে কৃষকরা বাম্পার ফলনের আশা করেছিলেন, কিন্তু এই বৃষ্টির কারণে তারা আশাহত হয়েছেন।

গোদাগাড়ী উপজেলায় চলতি বছরের (২০২৫) আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৪,৯৭৫ হেক্টর জমিতে, যা অর্জিত হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে আমনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮০ হাজার ৫০ হেক্টর। লক্ষ্যমাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। ২০২২-২৩ সালে ধান উৎপাদন হয়েছিল ২ লাখা ৮৬ হাজার ১৪৫ মেট্রিক টন। এই উপজেলায় কৃষিজমি কমছে-এ তথ্য থেকেই অনুমান করা যায় যে তিন বছর আগে যেখানে ৮০ হাজার ৫০ হেক্টর জমিতে আমন চাষ হতো, সেখানে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে চাষ হচ্ছে মাত্র ২৪ হাজার ৯৭৫ হেক্টরে। এই জমিগুলোর কী হচ্ছে তা বিশদভাবে জানা প্রয়োজন।

অপরদিকে তানোর উপজেলার চলতি মৌসুমে আমনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২২ হাজার ৬৩৫ হেক্টর। এর মধ্যে হাইব্রিড ২৮ হেক্টর, উফশী জাত ২২ হাজার ১১৭ হেক্টর এবং স্থানীয় জাতের চাষ হয়েছে ৫৫০ হেক্টর। চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৬০ হাজার ২৯৮ মেট্রিক টন।

এই দুই উপজেলার কৃষকেরা অকালবৃষ্টিতে বিপাকে পড়েছেন। গত ত্রিশ বছরে এই প্রথম এ ধরনের বড় বৃষ্টি হলো। গত ২৯ ও ৩০ অক্টোবর ভারী বৃষ্টি ও ঝড়ো হাওয়ায় তানোর ও গোদাগাড়ী উপজেলার আমন ধানের পাকা গাছ নুয়ে পড়েছে। ২৮ অক্টোবর থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত মোট বৃষ্টিপাত হয়েছে ২২৮ মিলিমিটার।

বৃষ্টির পর পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থায় বাধা থাকায় তানোর-গোদাগাড়ীর ফসলের জমিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। প্রায় তিন থেকে সাত দিন পর্যন্ত বৃষ্টির পানি জমে থাকে জমির ওপর, যার ফলে শস্যের ব্যাপক ক্ষতি হয়। গ্রামের উঁচু ভিটেতেও জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। বহু মাটির ঘর এই কারণে ধসে পড়ে।

এই বৃষ্টিতে গোদাগাড়ী ও তানোর উপজেলার প্রান্তিক কৃষকের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। আবহাওয়াবিদ সূত্রে জানা যায়, বরেন্দ্র অঞ্চলে গড় বৃষ্টিপাত প্রায় ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হজার ৩০০ মিলিমিটার, অপরদিকে দেশের গড় বৃষ্টিপাত প্রায় ২ হাজার ৫০০ মিলিমিটার। অর্থাৎ সারা দেশের তুলনায় বরেন্দ্রর বৃষ্টিপাত উল্লেখযোগ্যভাবে কম।

তবে বরেন্দ্র অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ স্থান ও বছরভেদে পরিবর্তিত হয়-যেমন দিনাজপুরে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত প্রায় ১ হাজার ৮১৩ মিমি, রংপুরে ২ হাজার ৩২৪ মিমি এবং রাজশাহীতে ১ হাজার ৭০৫ মিমি। এখানকার জলবায়ু উষ্ণ ও আর্দ্র। কিন্তু এ বছর অকালবৃষ্টিতে কৃষকেরা আতঙ্কে ভুগছেন।

তানোর-গোদাগাড়ীতে পুকুর খনন, বিলে মাছ চাষের জন্য বাঁধ, ছোট-বড় খাড়িতে (খাল) অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণের ফলে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা ব্যাহত হচ্ছে। তাছাড়া শিল্পায়নের কারণে পানি নিষ্কাশন ও শস্য উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটছে। বিশেষ করে রিশিকুল, দেওপাড়া ও পাকড়ি ইউনিয়নে কিছু শিল্পকারখানার বর্জ্য দূষিত পানি কৃষিজমিতে পড়ে জমিগুলো অনুপযোগী হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

সরকারি হিসাবে দেখা যায়, গোদাগাড়ী উপজেলায় বিলের সংখ্যা ১৬টি, পুকুর/দিঘীর সংখ্যা ৫,০৩৮টি, খালের সংখ্যা ৫টি। পদ্মা ও মহানন্দা নদী উপজেলার বৃহৎ অংশ জুড়ে প্রবাহিত এবং এর সীমানা নির্ধারণে ভূমিকা রাখে। এছাড়া রিশিকুল নদী গোদাগাড়ীর একটি স্থানীয় নদী, যা ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং শিব নদীর অংশ। প্রধান পাঁচটি খাল ছাড়াও আছে অসংখ্য ছোট খাল।

তানোর উপজেলায় পুকুর ৫ হাজার ৩৮৪টি এবং শিব নদী এ উপজেলার একমাত্র নদী। নদীটি নওগাঁ ও রাজশাহী জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত। নদীটির দৈর্ঘ্য ৭১ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ৩৭ মিটার এবং প্রকৃতি সর্পিলাকার। এ নদীর সঙ্গে রয়েছে অসংখ্য ছোট খাল।

অপরিকল্পিত মাছ চাষ, মুরগি-হাঁস-গরু পালনের খামার গড়ে ওঠায় এসব জলাশয় এখন আর সঠিকভাবে কাজ করছে না।

গোদাগাড়ী উপজেলায় নতুন বড় শিল্পকারখানা হিসেবে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের একটি ফ্যাক্টরি গড়ে উঠেছে। এছাড়াও স্থানীয়ভাবে গড়ে উঠছে বিভিন্ন কুটির ও হস্তশিল্প-ম্যাঙ্গো পাল্প, ফুড প্রসেসিং, রেশম, নকশিকাঁথা, মৃৎশিল্প ও বিড়ি শিল্প। প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ আমনাতপুরে বরেন্দ্র ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে একটি কারখানা স্থাপন করেছে, যেখানে প্রাথমিকভাবে আম ও মৌসুমী ফল প্রক্রিয়াজাত করা হয়। ভবিষ্যতে এখানে ফ্রোজেন ফুডস, নুডলসসহ নানা খাদ্যপণ্য উৎপাদনের পরিকল্পনা রয়েছে।

উপজেলার সীমানা ঘেঁষে রয়েছে পবা উপজেলার দামকুড়া। গোদাগাড়ী দিয়ে প্রবাহিত নদী এসে পড়েছে দামকুড়া ইউনিয়নে। এসিআই ও ভারতীয় প্রতিষ্ঠান গোদরেজ ১৫২ কোটি টাকা বিনিয়োগে সেখানে ফিশ ফিড শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে। নাহার অটোমোবাইল কারখানা ৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে উৎপাদনে এসেছে। নাবিল গ্রুপ গোদাগাড়ীর ঝিকরাপাড়ায় ৪০ একর জমির ওপর কারখানা স্থাপন করেছে। নাবিল গ্রুপের আরেকটি সফল উদ্যোগ ‘নাবা ক্রপ কেয়ার’ উন্নত জাতের বীজ সংগ্রহ ও উৎপাদন করছে এ এলাকায়।

দেখা যাচ্ছে, বরেন্দ্র অঞ্চলের অপরিকল্পিত বাঁধ ও শিল্পায়নের কারণে কৃষির ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। এর ফলে কৃষিজমিতে জলাবদ্ধতা ও খরা দেখা দিচ্ছে। মাছ চাষের উদ্দেশ্যে নির্মিত অপরিকল্পিত বাঁধ নদী ও খালের স্বাভাবিক প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে, যার ফলে ভাটি অঞ্চলে পানিপ্রবাহ কমে যায় বা জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। এতে বহু জমিতে ভবিষ্যতে ফসল উৎপাদন অসম্ভব হয়ে উঠতে পারে।

অন্যদিকে শিল্পকারখানার বর্জ্য ও অপরিকল্পিত স্থাপনা পরিবেশ ও মাটিকে দূষিত করছে, যা দীর্ঘমেয়াদে কৃষির জন্য বড় হুমকি। বরেন্দ্র এলাকায় অপরিকল্পিত বাঁধ ও রাস্তার কারণে বহু কৃষিজমি জলাবদ্ধতার শিকার হয়েছে। এই দুই উপজেলায় অনেক বাঁধ উজানের পানিপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি করছে। ফলে অঞ্চলে পানির সরবরাহ কমে যায় এবং খরা দেখা দেয়।

গোদাগাড়ীর কিছু এলাকায় শিল্পকারখানার বর্জ্য ও রাসায়নিক পদার্থ বিল, খাল ও কৃষিজমিকে দূষিত করছে। এতে মাটির উর্বরতা নষ্ট হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে উৎপাদন কমে যাবে। অপরিকল্পিত শিল্পায়নের ফলে দ্রুত কৃষিজমি কমে যাচ্ছে, যা খাদ্য নিরাপত্তা ও স্থানীয় অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

এই দুই উপজেলার সামগ্রিক বিষয়টি পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। কারণ শিল্পায়ন, মাছ চাষ, পুকুর খনন, মাটি সমতলকরণ, বাগানবাড়ি নির্মাণ এবং পশুপাখি পালনের খামার কতটা পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে চলছে-তা যাচাই করা জরুরি।

[লেখক : উন্নয়নকর্মী]

back to top