alt

মুক্ত আলোচনা

অস্তিত্ব সঙ্কটে টাঙ্গুয়ার হাওর

ইমন ইসলাম

: বুধবার, ১৯ মে ২০২১

শীতে পানি কমে গিয়ে বিলগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। হাওরের বিভিন্ন অংশে তখন প্রচুর মানুষের উপস্থিতি বেড়ে যায়। মাছ ধরা, ধান চাষ, গরু চড়ানো আর হাঁস পালনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে তারা। এই হাওরটি পরিযায়ী পাখিদের অভয়ারণ্য হলেও ঐতিহাসিক ভাবে এখানকার মানুষেরা জীবিকার তাগিদে এই হাওরের ওপর পুরোপুরিভাবে নির্ভরশীল।

গত দুই শতাব্দীর পুরো সময়টা হাওরের প্রতিটি চাষযোগ্য জায়গায় ধান চাষ হলেও এর মালিকানা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে পরিবর্তীত হয়। ১৯২০ সাল পর্যন্ত টাঙ্গুয়া এবং এর চারপাশের এলাকাসমূহ জমিদার বংশীকুন্ডের মালিকানায় ছিল। পরবর্তীতে এর মালিকানা পায় গৌরীপুরের জমিদার। ১৯৫০ সালে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলে এসব এলাকা সরকারি খাস জমির আওতাভুক্ত হয়। ১৯৬০ সাল পর্যন্ত এলাকার জমিজমা সব প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সংরক্ষিত হতো। ঐতিহ্যগতভাবে তখন জমির পরিমাণ ও সীমানা নির্ধারণের পত্তর প্রচলন ছিল। হতদরিদ্র হিন্দু-মুসলমান, গারো এবং খাসিয়া পরিবারগুলো তখন ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য এই অঞ্চলে বসতি স্থাপন করা শুরু করে। ’৫০-এর দশকে এ অঞ্চলের লোকেরা গজধাম এবং রবিধামের নেতৃত্বে তেভাগা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে। আর এ কারণেই টাঙ্গুয়ার ওপর নির্ভরশীলতা এখানকার মানুষের সহজাত অধিকারে রূপ নিয়েছে। আর তাই টাঙ্গুয়ায় পাখি ও মানুষের সহাবস্থান লক্ষ্যণীয়।

টাঙ্গুয়ার হাওর শুধুমাত্র নৈস্বর্গিক সৌন্দর্যম-িত পরিযায়ী পাখিদের অভয়ারণ্যই নয় বরং এ হাওরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এখানকার জনবসতিগুলোর এক ঐতিহাসিক সম্পর্ক। তাই হাওরের চারপাশে বসবাসকারীদের সম্পৃক্ত করেই এ হাওর ও এর জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করতে হবে। টাঙ্গুয়ার হাওরের আশপাশে ৮৮টি গ্রাম আছে যেখানে প্রায় ৮০ হাজার লোকের বসবাস। এই বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠী তাদের জীবন ও জীবিকার জন্য পুরোপুরিভাবেই টাঙ্গুয়ার হাওরের উপর নির্ভরশীল। যার কারণে অতিরিক্ত পরিমাণে সম্পদ আহরণের জন্য তারা টাঙ্গুয়ার হাওরের জীববৈচিত্র্যের ওপর হুমকিমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে। এছাড়াও রাতের অন্ধকারে চোরা শিকারিরা বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ পেতে পরিযায়ী পাখি শিকার করছে নির্বিচারে; যা টাঙ্গুয়ার হাওরের জীববৈচিত্র্যের জন্য মারাত্মক বিপর্যয় বয়ে আনছে।

স্বাধীনতার পরবর্তীতে সময়ে এ অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তন লক্ষ্যণীয়। ক্রমান্বয়ে এ অঞ্চলের জল মহল গুলো জেলেদের কাছে থেকে রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের কাছে চলে যায়। সমগ্র এলাকার কর্তৃত্ব নিয়ে নেয় গুটি কয়েক প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। যারা জলমহল গুলোকে শুধুমাত্র অর্থ উপার্জনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতে থাকে। এর ফলে এখানকার জীবিকাপ্রবণ মৎস্য শিকারি জেলেরা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তেমনি এ অঞ্চলের সার্বিক প্রাকৃতিক পরিবেশ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অথচ টাঙ্গুয়ার হাওরের মতো জাতীয় ঐতিহ্যপূর্ণ ও প্রাকৃতিক সম্ভারের গুরুত্ব বুঝে উঠতে আমাদের প্রায় ৪ দশক লেগে গেল।

এক সময় টাঙ্গুয়ার হাওরে পাওয়া যেত ১৪১ প্রজাতির মাছ অথচ বর্তমানে হাতে গোনা ৩২ টি প্রজাতির মাছের সন্ধান পাওয়া গেছে। গত ১৩ বছরে মাছ, গাছ ও পাখি নিধনের মহোৎসবে টাঙ্গুয়ার হাওর এখন কূন্য প্রায়। এক সময় সুদূর সাইবেরিয়াসহ অন্যান্য দেশ থেকে অসংখ্য প্রজাতির পরিযায়ী পাখির সমাগম হতো। দুর্লভ প্রজাতির ফিশ ঈগল, লেনজা, মৌলভী, বালিহাঁস, সরাইল, কাইম, কূলাউরা সহ শতাধিক প্রজাতির লক্ষাধিক পাখির কলকাকলিতে মুখরিত থাকতো টাঙ্গুয়ার হাওর। এখন যেন সেটি রূপকথার গল্পের মতো।

টাঙ্গুয়ার হাওরে ২০৮ প্রজাতির পাখি, ১৪১ প্রজাতির গাছ, ১১ প্রজাতির উভচর প্রাণী, ৩৪ প্রজাতির সরীসৃপ, ৭ প্রজাতির গিরগিটি, ২১ প্রজাতির সাপ, ২০৮ প্রজাতির উদ্ভিদের অবস্থান ছিল। জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ এ হাওরকে নিরাপদ ভেবে প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী পাখির সমাগম ঘটে। অথচ বর্তমানে পাখিদের জন্য নিরাপদ আবাসস্থল ধ্বংস, খাদ্য সংকট, ও পাখি নিধনের কারণে পাখির সংখ্যা কমছে। এদিকে হাওর রক্ষার কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ না করার ফলে ইতিহাস ও ঐতিহ্য খ্যাত দেশের অন্যতম হাওরটি আজ তার অস্তিত্ব রক্ষার সংকটে।

টাঙ্গুয়ার হাওর এলাকায় প্রায় ৮৮টি গ্রামের মানুষের অন্যতম জীবিকা এই হাওর ঘিরে। বলাচলে হাওরই তাদের বাঁচা ও মরার প্রধান কেন্দ্র। তারা টাঙ্গুয়ার হাওরের অংশ বটে। এদিকে হাওর রক্ষায় এ অঞ্চলের মানুষদের উন্নত জীবনমানের ব্যবস্থা করা জরুরি। অথচ আজ কয়েক দশক পেরিয়ে গেলেও না হয়েছে এখানকার মানুষদের জীবনমান উন্নয়ন না হয়েছে টাঙ্গুয়ার হাওরের জীববৈচিত্র্যের রক্ষার কার্যকর পদক্ষেপ। টাঙ্গুয়ার হাওরের নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সম্পদের ভান্ডারটির অস্তিত্ব এখন সংকটময়। আর এই সংকটের প্রধান কারণ রক্ষনাবেক্ষণে ত্রুটি, সীমাহীন দুর্নীতি, অনিয়ম ও লুটতরাজ। টাঙ্গুয়ার হাওরকে ১৯৯৯ সালে প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এছাড়াও ২০০০ সালে রামসার সম্মেলনে ‘বিশ্ব ঐতিহ্য’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

জলবায়ু পরিবর্তন ও স্থানীয়দের জীবিকার জোগান দিতে গিয়ে নষ্ট হচ্ছে টাঙ্গুয়ার হাওরের জীববৈচিত্র্যে। এছাড়াও কয়লা ও পাথরবাহী নৌকা চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় বাড়ছে দূষণ। বিশেষজ্ঞদের ধারণা খুব শীঘ্রই একটি শক্তিশালী সমন্বিত পরিকল্পনা ও কার্যকরী উদ্যোগ না নেয়া হলে টাঙ্গুয়ার হাওর রক্ষা সম্ভব হবে না। যা বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতি সাধন করবে। টাঙ্গুয়ার হাওর নির্ভর স্থানীয়দের উন্নত জীবনমান উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা জরুরি। এছাড়াও প্রশাসনিক জটিলতা ও অসাধু অর্থলোভী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উচ্ছেদ জরুরি।

টাঙ্গুয়ার হাওর রক্ষায় সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি জনসচেতনতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রাকৃতিক বিপর্যয় রোধে হাওর এলাকায় বিভিন্ন ধরনের সভা, করা যেতে পারে। মাইকিং, পোস্টার, ফেস্টুন বানিয়ে মানুষকে সচেতন করা যেতে পারে। এছাড়াও বর্তমান আধুনিক যোগাযোগ প্রযুক্তি ফেসবুক, টুইটারের ব্যবহার করা যেতে পারে। তরুণ প্রজন্মই টাঙ্গুয়ার হাওর রক্ষা করার ক্ষেত্রে একটি উদ্দীপনামূলক ভূমিকা রাখতে পারে। একটি সুন্দর সুশৃঙ্খল তরুণ সমাজের ভাবমূর্তির ওপর সমগ্র দেশের নীতিনৈতিকতা নির্ভর করে। দেশের সব প্রতিষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্ব প্রাজ্ঞ প্রবীণদের ওপর থাকে। তরুণ প্রজন্মের সততা, অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও ন্যায়নিষ্ঠার উপর অনেক কিছু নির্ভর করে। আর এই তরুণ প্রজন্মকে এক করা গেলে দেশের সকল অন্যায়, দুর্নীতি চিরতরে বন্ধ করা সম্ভব হবে। তরুণ প্রজন্মের দুর্বার প্রতিরোধই পারে টাঙ্গুয়ার হাওরের জীববৈচিত্র্যে রক্ষা করতে। এক্ষেত্রে স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থীরা সম্মীলিত উদ্যোগে হাওর রক্ষা নামে সংগঠন খুলতে পারে।

সমাজে জনসচেতনতা সৃষ্টি এবং হাওরের জীববৈচিত্র্যে রক্ষা সম্পর্কে স্থানীয়দের সচেতন করা সম্ভব হবে। এছাড়াও অবৈধ অর্থলোভী চক্রের বিরুদ্ধেও ফেসবুক টুইটারে সচেতনতামূলক ও প্রতিবাদমূলক লেখা পোস্ট করা যেতে পারে। এতে সমগ্র দেশের মানুষ সেই সম্পর্কে জানতে পারবে। আজ দেশের মূল্যবান টাঙ্গুয়ার হাওর সঙ্কটাপন্ন আর এর জন্য দায়ী প্রশাসনিক ও স্থানীয় প্রভাবশালীদের নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির বেড়াজাল। তরুণ প্রজন্ম এসব অন্যায়, অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরোধিতা শুরু করলে দুর্নীতিপরায়ন লোকেরা দুর্নীতি পরিত্যাগ করতে বাধ্য হবে। আর এর জন্য দরকার সরকারি সঠিক উদ্যোগের পাশাপাশি তরুণ প্রজন্মের সম্মিলিত ঐকমত্য ও সংঘবদ্ধতা। ধর্মীয় বিধিবিধান ও আইন-নৈতিকতার কথা জনগণের কাছে সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে উপস্থাপন করা গেলে দেশের সমাজ ও প্রাকৃতিক বিপর্যয় রোধ সম্ভব হবে।

[লেখক : শিক্ষার্থী, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়]

মুজিবনগরে স্বাধীনতার সূর্যোদয়

বঙ্গাব্দ প্রচলনের ইতিকথা

পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব

কেউতো অপেক্ষায় নেই

ফরগেট মি নট

ছবি

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক

স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বীমা শিল্পের গুরুত্ব

একুশে ফেব্রুয়ারি আত্মপরিচয়ের দিন

দিদি, আপা, “বু” খালা

হিজল-করচ-আড়াংবন

ছবি

শেখ হাসিনা, এক উৎসারিত আলোকধারা

মনমাঝি

সেই ইটনা

ছবি

আংকর ওয়াট : উন্নত সভ্যতার স্মৃতিচিহ্ন যেখানে

নিয়ত ও নিয়তি

হারিয়ে যাওয়া ট্রেন

টম সয়ার না রবিনহুড

ছবি

‘ঝড়-বৃষ্টি আঁধার রাতে, আমরা আছি তোমার সাথে’

বাংলাদেশ-জাপান সহযোগিতা স্মারক: স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অনন্য মাইলফলক

রাষ্ট্রের কূটনৈতিক মিশনের পরিবর্তন আশু প্রয়োজন

কুয়েতের জীবনযাত্রার সাতকাহন: পর্ব-১-বিয়ে

বিবেকের লড়াই

ছবি

ছবি যেন শুধু ছবি নয়

বাত ব্যথার কারণ ও আধুনিক চিকিৎসা

ছবি

স্বাধীন স্বদেশে মুক্ত বঙ্গবন্ধু

ছবি

মহান নেতার স্বভূমিতে ফিরে আসা

ছবি

মেট্রোরেল : প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী চিন্তার ফসল

ছবি

আমার মা

ডিজিটাল বাংলাদেশ: প্রগতিশীল প্রযুক্তি, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নতি

ছবি

৩ নভেম্বর: ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডের ধারাবাহিকতা

দেশের ইতিহাসে কলঙ্কজনক দ্বিতীয় অধ্যায়

এইচ এস সি ও সমমান পরীক্ষার্থীদের অনুশীলন

ছবি

ত্রিশ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

শিল্প কারখানার পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনায় এনভায়রনমেন্টাল ইন্জিনিয়ারিং

অসুর: এক পরাজিত বিপ্লবী

অসুর জাতির ইতিহাস

tab

মুক্ত আলোচনা

অস্তিত্ব সঙ্কটে টাঙ্গুয়ার হাওর

ইমন ইসলাম

বুধবার, ১৯ মে ২০২১

শীতে পানি কমে গিয়ে বিলগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। হাওরের বিভিন্ন অংশে তখন প্রচুর মানুষের উপস্থিতি বেড়ে যায়। মাছ ধরা, ধান চাষ, গরু চড়ানো আর হাঁস পালনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে তারা। এই হাওরটি পরিযায়ী পাখিদের অভয়ারণ্য হলেও ঐতিহাসিক ভাবে এখানকার মানুষেরা জীবিকার তাগিদে এই হাওরের ওপর পুরোপুরিভাবে নির্ভরশীল।

গত দুই শতাব্দীর পুরো সময়টা হাওরের প্রতিটি চাষযোগ্য জায়গায় ধান চাষ হলেও এর মালিকানা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে পরিবর্তীত হয়। ১৯২০ সাল পর্যন্ত টাঙ্গুয়া এবং এর চারপাশের এলাকাসমূহ জমিদার বংশীকুন্ডের মালিকানায় ছিল। পরবর্তীতে এর মালিকানা পায় গৌরীপুরের জমিদার। ১৯৫০ সালে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলে এসব এলাকা সরকারি খাস জমির আওতাভুক্ত হয়। ১৯৬০ সাল পর্যন্ত এলাকার জমিজমা সব প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সংরক্ষিত হতো। ঐতিহ্যগতভাবে তখন জমির পরিমাণ ও সীমানা নির্ধারণের পত্তর প্রচলন ছিল। হতদরিদ্র হিন্দু-মুসলমান, গারো এবং খাসিয়া পরিবারগুলো তখন ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য এই অঞ্চলে বসতি স্থাপন করা শুরু করে। ’৫০-এর দশকে এ অঞ্চলের লোকেরা গজধাম এবং রবিধামের নেতৃত্বে তেভাগা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে। আর এ কারণেই টাঙ্গুয়ার ওপর নির্ভরশীলতা এখানকার মানুষের সহজাত অধিকারে রূপ নিয়েছে। আর তাই টাঙ্গুয়ায় পাখি ও মানুষের সহাবস্থান লক্ষ্যণীয়।

টাঙ্গুয়ার হাওর শুধুমাত্র নৈস্বর্গিক সৌন্দর্যম-িত পরিযায়ী পাখিদের অভয়ারণ্যই নয় বরং এ হাওরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এখানকার জনবসতিগুলোর এক ঐতিহাসিক সম্পর্ক। তাই হাওরের চারপাশে বসবাসকারীদের সম্পৃক্ত করেই এ হাওর ও এর জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করতে হবে। টাঙ্গুয়ার হাওরের আশপাশে ৮৮টি গ্রাম আছে যেখানে প্রায় ৮০ হাজার লোকের বসবাস। এই বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠী তাদের জীবন ও জীবিকার জন্য পুরোপুরিভাবেই টাঙ্গুয়ার হাওরের উপর নির্ভরশীল। যার কারণে অতিরিক্ত পরিমাণে সম্পদ আহরণের জন্য তারা টাঙ্গুয়ার হাওরের জীববৈচিত্র্যের ওপর হুমকিমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে। এছাড়াও রাতের অন্ধকারে চোরা শিকারিরা বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ পেতে পরিযায়ী পাখি শিকার করছে নির্বিচারে; যা টাঙ্গুয়ার হাওরের জীববৈচিত্র্যের জন্য মারাত্মক বিপর্যয় বয়ে আনছে।

স্বাধীনতার পরবর্তীতে সময়ে এ অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তন লক্ষ্যণীয়। ক্রমান্বয়ে এ অঞ্চলের জল মহল গুলো জেলেদের কাছে থেকে রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের কাছে চলে যায়। সমগ্র এলাকার কর্তৃত্ব নিয়ে নেয় গুটি কয়েক প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। যারা জলমহল গুলোকে শুধুমাত্র অর্থ উপার্জনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতে থাকে। এর ফলে এখানকার জীবিকাপ্রবণ মৎস্য শিকারি জেলেরা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তেমনি এ অঞ্চলের সার্বিক প্রাকৃতিক পরিবেশ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অথচ টাঙ্গুয়ার হাওরের মতো জাতীয় ঐতিহ্যপূর্ণ ও প্রাকৃতিক সম্ভারের গুরুত্ব বুঝে উঠতে আমাদের প্রায় ৪ দশক লেগে গেল।

এক সময় টাঙ্গুয়ার হাওরে পাওয়া যেত ১৪১ প্রজাতির মাছ অথচ বর্তমানে হাতে গোনা ৩২ টি প্রজাতির মাছের সন্ধান পাওয়া গেছে। গত ১৩ বছরে মাছ, গাছ ও পাখি নিধনের মহোৎসবে টাঙ্গুয়ার হাওর এখন কূন্য প্রায়। এক সময় সুদূর সাইবেরিয়াসহ অন্যান্য দেশ থেকে অসংখ্য প্রজাতির পরিযায়ী পাখির সমাগম হতো। দুর্লভ প্রজাতির ফিশ ঈগল, লেনজা, মৌলভী, বালিহাঁস, সরাইল, কাইম, কূলাউরা সহ শতাধিক প্রজাতির লক্ষাধিক পাখির কলকাকলিতে মুখরিত থাকতো টাঙ্গুয়ার হাওর। এখন যেন সেটি রূপকথার গল্পের মতো।

টাঙ্গুয়ার হাওরে ২০৮ প্রজাতির পাখি, ১৪১ প্রজাতির গাছ, ১১ প্রজাতির উভচর প্রাণী, ৩৪ প্রজাতির সরীসৃপ, ৭ প্রজাতির গিরগিটি, ২১ প্রজাতির সাপ, ২০৮ প্রজাতির উদ্ভিদের অবস্থান ছিল। জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ এ হাওরকে নিরাপদ ভেবে প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী পাখির সমাগম ঘটে। অথচ বর্তমানে পাখিদের জন্য নিরাপদ আবাসস্থল ধ্বংস, খাদ্য সংকট, ও পাখি নিধনের কারণে পাখির সংখ্যা কমছে। এদিকে হাওর রক্ষার কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ না করার ফলে ইতিহাস ও ঐতিহ্য খ্যাত দেশের অন্যতম হাওরটি আজ তার অস্তিত্ব রক্ষার সংকটে।

টাঙ্গুয়ার হাওর এলাকায় প্রায় ৮৮টি গ্রামের মানুষের অন্যতম জীবিকা এই হাওর ঘিরে। বলাচলে হাওরই তাদের বাঁচা ও মরার প্রধান কেন্দ্র। তারা টাঙ্গুয়ার হাওরের অংশ বটে। এদিকে হাওর রক্ষায় এ অঞ্চলের মানুষদের উন্নত জীবনমানের ব্যবস্থা করা জরুরি। অথচ আজ কয়েক দশক পেরিয়ে গেলেও না হয়েছে এখানকার মানুষদের জীবনমান উন্নয়ন না হয়েছে টাঙ্গুয়ার হাওরের জীববৈচিত্র্যের রক্ষার কার্যকর পদক্ষেপ। টাঙ্গুয়ার হাওরের নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সম্পদের ভান্ডারটির অস্তিত্ব এখন সংকটময়। আর এই সংকটের প্রধান কারণ রক্ষনাবেক্ষণে ত্রুটি, সীমাহীন দুর্নীতি, অনিয়ম ও লুটতরাজ। টাঙ্গুয়ার হাওরকে ১৯৯৯ সালে প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এছাড়াও ২০০০ সালে রামসার সম্মেলনে ‘বিশ্ব ঐতিহ্য’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

জলবায়ু পরিবর্তন ও স্থানীয়দের জীবিকার জোগান দিতে গিয়ে নষ্ট হচ্ছে টাঙ্গুয়ার হাওরের জীববৈচিত্র্যে। এছাড়াও কয়লা ও পাথরবাহী নৌকা চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় বাড়ছে দূষণ। বিশেষজ্ঞদের ধারণা খুব শীঘ্রই একটি শক্তিশালী সমন্বিত পরিকল্পনা ও কার্যকরী উদ্যোগ না নেয়া হলে টাঙ্গুয়ার হাওর রক্ষা সম্ভব হবে না। যা বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতি সাধন করবে। টাঙ্গুয়ার হাওর নির্ভর স্থানীয়দের উন্নত জীবনমান উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা জরুরি। এছাড়াও প্রশাসনিক জটিলতা ও অসাধু অর্থলোভী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উচ্ছেদ জরুরি।

টাঙ্গুয়ার হাওর রক্ষায় সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি জনসচেতনতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রাকৃতিক বিপর্যয় রোধে হাওর এলাকায় বিভিন্ন ধরনের সভা, করা যেতে পারে। মাইকিং, পোস্টার, ফেস্টুন বানিয়ে মানুষকে সচেতন করা যেতে পারে। এছাড়াও বর্তমান আধুনিক যোগাযোগ প্রযুক্তি ফেসবুক, টুইটারের ব্যবহার করা যেতে পারে। তরুণ প্রজন্মই টাঙ্গুয়ার হাওর রক্ষা করার ক্ষেত্রে একটি উদ্দীপনামূলক ভূমিকা রাখতে পারে। একটি সুন্দর সুশৃঙ্খল তরুণ সমাজের ভাবমূর্তির ওপর সমগ্র দেশের নীতিনৈতিকতা নির্ভর করে। দেশের সব প্রতিষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্ব প্রাজ্ঞ প্রবীণদের ওপর থাকে। তরুণ প্রজন্মের সততা, অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও ন্যায়নিষ্ঠার উপর অনেক কিছু নির্ভর করে। আর এই তরুণ প্রজন্মকে এক করা গেলে দেশের সকল অন্যায়, দুর্নীতি চিরতরে বন্ধ করা সম্ভব হবে। তরুণ প্রজন্মের দুর্বার প্রতিরোধই পারে টাঙ্গুয়ার হাওরের জীববৈচিত্র্যে রক্ষা করতে। এক্ষেত্রে স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থীরা সম্মীলিত উদ্যোগে হাওর রক্ষা নামে সংগঠন খুলতে পারে।

সমাজে জনসচেতনতা সৃষ্টি এবং হাওরের জীববৈচিত্র্যে রক্ষা সম্পর্কে স্থানীয়দের সচেতন করা সম্ভব হবে। এছাড়াও অবৈধ অর্থলোভী চক্রের বিরুদ্ধেও ফেসবুক টুইটারে সচেতনতামূলক ও প্রতিবাদমূলক লেখা পোস্ট করা যেতে পারে। এতে সমগ্র দেশের মানুষ সেই সম্পর্কে জানতে পারবে। আজ দেশের মূল্যবান টাঙ্গুয়ার হাওর সঙ্কটাপন্ন আর এর জন্য দায়ী প্রশাসনিক ও স্থানীয় প্রভাবশালীদের নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির বেড়াজাল। তরুণ প্রজন্ম এসব অন্যায়, অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরোধিতা শুরু করলে দুর্নীতিপরায়ন লোকেরা দুর্নীতি পরিত্যাগ করতে বাধ্য হবে। আর এর জন্য দরকার সরকারি সঠিক উদ্যোগের পাশাপাশি তরুণ প্রজন্মের সম্মিলিত ঐকমত্য ও সংঘবদ্ধতা। ধর্মীয় বিধিবিধান ও আইন-নৈতিকতার কথা জনগণের কাছে সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে উপস্থাপন করা গেলে দেশের সমাজ ও প্রাকৃতিক বিপর্যয় রোধ সম্ভব হবে।

[লেখক : শিক্ষার্থী, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়]

back to top