আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে তিন দফায় বৈঠক করেও ‘নির্বাচনী জোট বা সমঝোতার’ বিষয় নির্ধারণ করতে পারেনি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি (জাপা)। সর্বশেষ মঙ্গলবার (১২ ডিসেম্বর) রাতেও চতুর্থ দফায় বৈঠকে মিলিত হয়েছেন দুই দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা।
আগের বৈঠকগুলোর মতো এবারের বৈঠক নিয়েও গোপনীয়তা বজায় রেখেছে উভয় দল। জাপার উচ্চ পর্যায়ের একটি সূত্র জানায়, বৈঠকে আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে জাপার মহাসচিব মজিবুল হক চুন্নু ও সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ অংশ নেন। তবে এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত বৈঠক চলছিল।
যদিও জাপার একজন কো-চেয়ারম্যান দাবি করেন, বৈঠকে আসন ‘ভাগাভাগির’ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হতে পারে।
নির্বাচনকে কীভাবে ‘সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য’ করা যায়, নির্বাচনে কীভাবে ভোটারদের উপস্থিতি নিশ্চিত করা যায়-আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির নেতারা দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে এ নিয়েই আলোচনা হচ্ছে বলে এতোদিন গণমাধ্যমের কাছে দাবি করে আসছেন জাপার মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু।
যদিও জাপার একাধিক সূত্র জানায়, প্রকৃতপক্ষে মূল আলোচনা চলছে ‘আসন-সমঝোতা নিয়েই’। ক্ষমতাসীন দলের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের আসনে ‘জয়ের নিশ্চয়তা’ চায় দলটি।
দলীয় নেতাদের আসনগুলোতে নৌকা ও আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী স্বতন্ত্র প্রার্থী থাকুক, তা চায় না জাপা। এই সমঝোতা না হলে তারা নির্বাচনে জিতে পারবে না বলেও মনে করা হচ্ছে।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে একবার এবং আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে দুই দফা বৈঠক হলেও ‘আসন-সমঝোতার’ বিষয়টি ফয়সালা হয়নি।
জাপার একাধিক সূত্র জানায়, আসন-সমঝোতার লক্ষ্যে জাপার চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ (জিএম) কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু গত ৫ ডিসেম্বর রাতে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করেন।
পরদিন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ দলটির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন জাপার সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু। গত শনিবারও আওয়ামী লীগের সঙ্গে বৈঠক করেন জাপার নেতারা। তবে আসন-সমঝোতা চূড়ান্ত হয়নি।
একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, জাপা এবার শুরুতে ক্ষমতাসীনদের কাছে ৫০টি আসনে ছাড় চেয়েছে। পরবর্তিতে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে জাপা ৪৫ জনের নতুন একটি তালিকা দেয়। এখন সেই তালিকাও কাটছাঁট করে ৩৫ থেকে ৪০টি আসনে ছাড় পাওয়ার দাবিতে অনড় রয়েছে জাপার শীর্ষ নেতৃত্ব।
এমন পরিস্থিতির মধ্যেই মঙ্গলবার গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন দলের নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানো বিরোধীদলীয় নেতা ও পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ। তিনি জাপার সঙ্গে ‘নির্বাচনী জোট বা সমঝোতা’ না করা হয় সেজন্য আওয়ামী লীগের সভাপতির কাছে অনুরোধ করেন বলে রওশনপন্থি নেতা কাজী মামুনুর রশীদ জানিয়েছেন।
ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে জাপার ‘সমঝোতার’ আলোচনার মধ্যে রওশন এরশাদ আবার প্রকাশে এলে দলের অভ্যন্তরীণ ‘বিভেদ’ নিয়ে নতুন মাত্রা পায়। যদিও রওশন এরশাদের তৎপরতায় বিষয়ে জাপার উচ্চ পর্যায়ের একজন নেতা সংবাদকে বলেন, ‘প্রত্যেকটা কাজেই একটা অ্যান্টি পক্ষ থাকে। তারা (রওশনপন্থিরা) হয়ত সেই কাজ করছেন।’ এতে ‘সমঝোতা প্রক্রিয়া’ বা দলের মধ্যে কোনো ‘প্রভাব’ পড়বে না বলেও দাবি জাপা নেতার।
জাপায় রওশন এরশাদ ও জিএম কাদেরের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলছে। আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে তাদের ‘দ্বন্দ্ব’ আরও গভীর হয়। দুই পক্ষই পৃথকভাবে নির্বাচনী তৎপরতা চালায়। নির্বাচন কমিশনেও দলের অবস্থান নিয়ে আলাদাপত্র দাখিল করে।
রওশন এরশাদ চিঠিতে ‘মহাজোটের অধীনে’ নির্বাচনের অংশ নেয়ার কথা জানায়। কিন্তু দলের অন্য পক্ষের সঙ্গে ‘মিল না’ হওয়ায় মনোনয়ন জমা দেয়ার শেষ মূহূর্তে নির্বাচনী মাঠ থেকে সরে যান। যদিও মশিউর রহমান রাঙ্গাসহ তার কয়েকজন অনুসারী নির্বাচনী মাঠে রয়ে গেছেন।
আর এবারের নির্বাচনকে ঘিরে চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের নেতৃত্বে দলটির অন্য অংশ শুরুতে ‘দ্বিধাদ্বন্দ্বের’ মধ্যে থাকলেও পরবর্তিতে নির্বাচনে অংশ নেয়ার কথা জানায়। প্রায় তিনশ’ আসনেই প্রার্থী দিয়েছে তারা। তবে দলীয় অবস্থান এখনও ধোঁয়াশায়।
জাপা নির্বাচনে থাকবে কি না প্রধানমন্ত্রীর ‘সন্দেহ’
জাপা ‘নিজস্ব কৌশলগত’ অবস্থানে রয়েছে জানিয়ে আসলেও প্রকাশে নির্বাচনে ‘এককভাবে’ অংশগ্রহণের কথা বলে আসছেন দলের মহাসচিব মজিবুল হক চুন্নু। তিনি দীর্ঘদিনের সঙ্গী আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন ‘সমঝোতার’ বিষয়টিও নাকচ করে দিচ্ছেন না। আর কৌশলগত ‘যেকোনো সিদ্ধান্ত’ আসতে পারে বলেও ইঙ্গিত দিচ্ছেন তিনি।
এর মধ্যেই গত সোমবার মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে অনির্ধারিত আলোচনায় জাতীয় পার্টি নির্বাচনে থাকবে কি না সেই বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সন্দেহ প্রকাশ করেন। একাধিক সূত্র জানায়, অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় নির্বাচনে জাতীয় পার্টির অংশগ্রহণ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন কয়েকজন মন্ত্রী।
তখন মন্ত্রীদের অনুরোধ নাকচ করে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জাতীয় পার্টি রওশন এরশাদ, তার ছেলে রাহগির আল মাহি এরশাদ (শাদ এরশাদ) ও মসিউর রহমানকে নির্বাচন থেকে সরিয়ে রেখেছে। তারা কখন কী করবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।’
পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, ‘সবাইকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নির্বাচনে জিততে হবে। প্রতিদ্বন্দ্বিতা আমরাও করব, শরিকদেরও করতে হবে। প্রতিদ্বন্দ্বিতার কোনো বিকল্প নেই। প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেই নির্বাচনের রেজাল্ট (ফলাফল) আনতে হবে।’
তবে জাতীয় পার্টি (জাপা) শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে থাকবে কি না, সেই বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সন্দেহ নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে মঙ্গলবার জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক সাংবাদিকদের বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী কী বলেছেন, সেই বিষয়ে আমার কোনো কথা বলার সুযোগ নেই। আমাদের সন্দেহ করবেন কি না বা করেন কি না, সেটা ওনার বিষয়।’
তিনি বলেন, ‘আমি শুধু একটা কথাই বলতে পারি, জাতীয় পার্টি নির্বাচন করার জন্য এসেছে। নির্বাচন থেকে চলে যাওয়ার জন্য আসেনি। আমরা নির্বাচন কমিশন ও সরকারের কাছে একটা জিনিস চেয়েছি, নির্বাচনের পরিবেশ যাতে এমন হয় যে ভোটাররা আস্থা রাখতে পারে।’
প্রধানমন্ত্রীকে কী বললেন রওশন
মঙ্গলবার দুপুরে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যান রওশন এরশাদ। সাক্ষাতে রওশন এরশাদের সঙ্গে ছিলেন তার ছেলে সাদ এরশাদ, রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসীহ্, রওশনপন্থি নেতা মসিউর রহমান রাঙ্গা ও কাজী মামুনুর রশীদ।
রওশন গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বেরিয়ে সাংবাদিকদের কয়েকটি প্রশ্নের উত্তরও দেন। নির্বাচনে অংশ নেয়ার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী কিছু বলেছেন কি না জানতে চাইলে রওশন বলেন, ‘এখন তো আর সময় নেই। আর কী বলবেন।’
জিএম কাদেরের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টির নির্বাচনে যাওয়ার বিষয়ে রওশন বলেন, ‘জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান আমাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেননি। আমার ছেলের জায়গায় উনি ইলেকশন করছেন। ওর কথা তার মনে নেই।’
জাতীয় পার্টির নেতাদের প্রতি সমর্থন আছে কি না জানতে চাইলে রওশন বলেন, ‘আমাদের ইচ্ছা করে বাদ দিয়েছে। কেন সমর্থন থাকবে?’
রওশন এরশাদ সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় মসিউর রহমান রাঙ্গা সাংবাদিকদের বলেন, রওশন এরশাদ কথা বলার মতো অবস্থায় নেই। সাংবাদিকদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলবেন তাদের নেতা কাজী মামুনুর রশিদ।
পরে কাজী মামুনুর রশিদ একটি লিখিত বক্তব্য সাংবাদিকদের সরবরাহ করেন। সেখানে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কী আলোচনা হয়েছে, তা জানানো হয়। লিখিত বক্তব্যে বলা হয়েছে, ‘প্রধানমন্ত্রীকে তিনি (রওশন) বলেছেন জিএম কাদের অবৈধভাবে জাতীয় পার্টির নেতৃত্ব দখল করেছেন। সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির মনোনয়ন চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে সুকৌশলে তাকে, সাদ এরশাদকে ও গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের সরিয়ে দিয়েছেন। দলের মধ্যে ‘ক্যু’ করে নেতৃত্ব গ্রহণ করেছেন।’
রওশন লিখিত বক্তব্যে আরও বলেন, ‘তিনি এসব বিষয় প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছেন। জিএম কাদেরের সঙ্গে কোনো নির্বাচনী জোট না করার অনুরোধ করেছেন।’ রওশন বলেন, ‘নির্বাচন অধিক গ্রহণযোগ্য করার জন্য জাতীয় পার্টি যাতে এককভাবে সারাদেশে প্রতিযোগিতামূলকভাবে নির্বাচন করে, সেটি নিশ্চিত করার অনুরোধ করেছেন তিনি।’
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করা আনকমন বিষয় নয় : জাপা মহাসচিব
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে রওশন এরশাদের সাক্ষাতের বিষয়টি স্বাভাবিক বিষয় হিসেবে দেখছেন জাপা মহাসচিব চুন্নু। মঙ্গলবার এক প্রশ্নের জবাবে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, রওশন এরশাদ গণভবনে গিয়েছেন কি না সেটি আমি জানি না। তবে উনি যেতেই পারেন।
‘যেকোনো মানুষের যাওয়ার সুযোগ আছে। রওশন এরশাদ সংসদের বিরোধদলের নেতা। তিনি সংসদের নেতার (শেখ হাসিনা) সঙ্গে যেকোনো সময়, যেকোনো বিষয়ে দেখা করতেই পারেন। রওশন এরশাদ গণভবনে যেতেই পারেন এটা খুব ইজি বিষয়, আনকমন বিষয় নয়।’
জাপা মহাসচিবের ভাষ্য, তারা চেয়েছিলেন, রওশন এরশাদ নির্বাচনে থাকবেন। এতে পার্টির সুনাম বাড়ত।
‘ম্যাডাম আমাদের পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক। উনি নির্বাচন করুক, উনার ছেলে করুক এবং উনার (রওশন এরশাদ) ইচ্ছামতো আরেকজন করুক। তিনজনের জন্য মনোনয়নপত্র নিয়ে আমরা অপেক্ষা করেছি। মনোনয়ন জমা দেয়ার শেষ দিনের আগের দিন রাত ১০টা পর্যন্ত বসেছিলাম। ওনাকে বলেছি আপনি চাইলে আমি নিজে আপনার বাসায় মনোনয়নপত্র নিয়ে যাবো। কিন্তু উনি আমাকে মনোনয়ন নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেননি। পরে রওশন এরশাদ বলেছেন, তিনি নির্বাচনে যাবেন না। ম্যাডাম ভোটে এলে আমাদের জন্য ভালো হতো, কর্মীরাও খুশি হতো। ম্যাডাম না আসায় আমরা দুঃখিত।’
মঙ্গলবার, ১২ ডিসেম্বর ২০২৩
আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে তিন দফায় বৈঠক করেও ‘নির্বাচনী জোট বা সমঝোতার’ বিষয় নির্ধারণ করতে পারেনি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি (জাপা)। সর্বশেষ মঙ্গলবার (১২ ডিসেম্বর) রাতেও চতুর্থ দফায় বৈঠকে মিলিত হয়েছেন দুই দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা।
আগের বৈঠকগুলোর মতো এবারের বৈঠক নিয়েও গোপনীয়তা বজায় রেখেছে উভয় দল। জাপার উচ্চ পর্যায়ের একটি সূত্র জানায়, বৈঠকে আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে জাপার মহাসচিব মজিবুল হক চুন্নু ও সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ অংশ নেন। তবে এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত বৈঠক চলছিল।
যদিও জাপার একজন কো-চেয়ারম্যান দাবি করেন, বৈঠকে আসন ‘ভাগাভাগির’ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হতে পারে।
নির্বাচনকে কীভাবে ‘সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য’ করা যায়, নির্বাচনে কীভাবে ভোটারদের উপস্থিতি নিশ্চিত করা যায়-আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির নেতারা দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে এ নিয়েই আলোচনা হচ্ছে বলে এতোদিন গণমাধ্যমের কাছে দাবি করে আসছেন জাপার মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু।
যদিও জাপার একাধিক সূত্র জানায়, প্রকৃতপক্ষে মূল আলোচনা চলছে ‘আসন-সমঝোতা নিয়েই’। ক্ষমতাসীন দলের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের আসনে ‘জয়ের নিশ্চয়তা’ চায় দলটি।
দলীয় নেতাদের আসনগুলোতে নৌকা ও আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী স্বতন্ত্র প্রার্থী থাকুক, তা চায় না জাপা। এই সমঝোতা না হলে তারা নির্বাচনে জিতে পারবে না বলেও মনে করা হচ্ছে।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে একবার এবং আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে দুই দফা বৈঠক হলেও ‘আসন-সমঝোতার’ বিষয়টি ফয়সালা হয়নি।
জাপার একাধিক সূত্র জানায়, আসন-সমঝোতার লক্ষ্যে জাপার চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ (জিএম) কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু গত ৫ ডিসেম্বর রাতে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করেন।
পরদিন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ দলটির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন জাপার সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু। গত শনিবারও আওয়ামী লীগের সঙ্গে বৈঠক করেন জাপার নেতারা। তবে আসন-সমঝোতা চূড়ান্ত হয়নি।
একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, জাপা এবার শুরুতে ক্ষমতাসীনদের কাছে ৫০টি আসনে ছাড় চেয়েছে। পরবর্তিতে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে জাপা ৪৫ জনের নতুন একটি তালিকা দেয়। এখন সেই তালিকাও কাটছাঁট করে ৩৫ থেকে ৪০টি আসনে ছাড় পাওয়ার দাবিতে অনড় রয়েছে জাপার শীর্ষ নেতৃত্ব।
এমন পরিস্থিতির মধ্যেই মঙ্গলবার গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন দলের নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানো বিরোধীদলীয় নেতা ও পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ। তিনি জাপার সঙ্গে ‘নির্বাচনী জোট বা সমঝোতা’ না করা হয় সেজন্য আওয়ামী লীগের সভাপতির কাছে অনুরোধ করেন বলে রওশনপন্থি নেতা কাজী মামুনুর রশীদ জানিয়েছেন।
ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে জাপার ‘সমঝোতার’ আলোচনার মধ্যে রওশন এরশাদ আবার প্রকাশে এলে দলের অভ্যন্তরীণ ‘বিভেদ’ নিয়ে নতুন মাত্রা পায়। যদিও রওশন এরশাদের তৎপরতায় বিষয়ে জাপার উচ্চ পর্যায়ের একজন নেতা সংবাদকে বলেন, ‘প্রত্যেকটা কাজেই একটা অ্যান্টি পক্ষ থাকে। তারা (রওশনপন্থিরা) হয়ত সেই কাজ করছেন।’ এতে ‘সমঝোতা প্রক্রিয়া’ বা দলের মধ্যে কোনো ‘প্রভাব’ পড়বে না বলেও দাবি জাপা নেতার।
জাপায় রওশন এরশাদ ও জিএম কাদেরের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলছে। আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে তাদের ‘দ্বন্দ্ব’ আরও গভীর হয়। দুই পক্ষই পৃথকভাবে নির্বাচনী তৎপরতা চালায়। নির্বাচন কমিশনেও দলের অবস্থান নিয়ে আলাদাপত্র দাখিল করে।
রওশন এরশাদ চিঠিতে ‘মহাজোটের অধীনে’ নির্বাচনের অংশ নেয়ার কথা জানায়। কিন্তু দলের অন্য পক্ষের সঙ্গে ‘মিল না’ হওয়ায় মনোনয়ন জমা দেয়ার শেষ মূহূর্তে নির্বাচনী মাঠ থেকে সরে যান। যদিও মশিউর রহমান রাঙ্গাসহ তার কয়েকজন অনুসারী নির্বাচনী মাঠে রয়ে গেছেন।
আর এবারের নির্বাচনকে ঘিরে চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের নেতৃত্বে দলটির অন্য অংশ শুরুতে ‘দ্বিধাদ্বন্দ্বের’ মধ্যে থাকলেও পরবর্তিতে নির্বাচনে অংশ নেয়ার কথা জানায়। প্রায় তিনশ’ আসনেই প্রার্থী দিয়েছে তারা। তবে দলীয় অবস্থান এখনও ধোঁয়াশায়।
জাপা নির্বাচনে থাকবে কি না প্রধানমন্ত্রীর ‘সন্দেহ’
জাপা ‘নিজস্ব কৌশলগত’ অবস্থানে রয়েছে জানিয়ে আসলেও প্রকাশে নির্বাচনে ‘এককভাবে’ অংশগ্রহণের কথা বলে আসছেন দলের মহাসচিব মজিবুল হক চুন্নু। তিনি দীর্ঘদিনের সঙ্গী আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন ‘সমঝোতার’ বিষয়টিও নাকচ করে দিচ্ছেন না। আর কৌশলগত ‘যেকোনো সিদ্ধান্ত’ আসতে পারে বলেও ইঙ্গিত দিচ্ছেন তিনি।
এর মধ্যেই গত সোমবার মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে অনির্ধারিত আলোচনায় জাতীয় পার্টি নির্বাচনে থাকবে কি না সেই বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সন্দেহ প্রকাশ করেন। একাধিক সূত্র জানায়, অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় নির্বাচনে জাতীয় পার্টির অংশগ্রহণ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন কয়েকজন মন্ত্রী।
তখন মন্ত্রীদের অনুরোধ নাকচ করে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জাতীয় পার্টি রওশন এরশাদ, তার ছেলে রাহগির আল মাহি এরশাদ (শাদ এরশাদ) ও মসিউর রহমানকে নির্বাচন থেকে সরিয়ে রেখেছে। তারা কখন কী করবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।’
পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, ‘সবাইকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নির্বাচনে জিততে হবে। প্রতিদ্বন্দ্বিতা আমরাও করব, শরিকদেরও করতে হবে। প্রতিদ্বন্দ্বিতার কোনো বিকল্প নেই। প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেই নির্বাচনের রেজাল্ট (ফলাফল) আনতে হবে।’
তবে জাতীয় পার্টি (জাপা) শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে থাকবে কি না, সেই বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সন্দেহ নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে মঙ্গলবার জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক সাংবাদিকদের বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী কী বলেছেন, সেই বিষয়ে আমার কোনো কথা বলার সুযোগ নেই। আমাদের সন্দেহ করবেন কি না বা করেন কি না, সেটা ওনার বিষয়।’
তিনি বলেন, ‘আমি শুধু একটা কথাই বলতে পারি, জাতীয় পার্টি নির্বাচন করার জন্য এসেছে। নির্বাচন থেকে চলে যাওয়ার জন্য আসেনি। আমরা নির্বাচন কমিশন ও সরকারের কাছে একটা জিনিস চেয়েছি, নির্বাচনের পরিবেশ যাতে এমন হয় যে ভোটাররা আস্থা রাখতে পারে।’
প্রধানমন্ত্রীকে কী বললেন রওশন
মঙ্গলবার দুপুরে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যান রওশন এরশাদ। সাক্ষাতে রওশন এরশাদের সঙ্গে ছিলেন তার ছেলে সাদ এরশাদ, রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসীহ্, রওশনপন্থি নেতা মসিউর রহমান রাঙ্গা ও কাজী মামুনুর রশীদ।
রওশন গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বেরিয়ে সাংবাদিকদের কয়েকটি প্রশ্নের উত্তরও দেন। নির্বাচনে অংশ নেয়ার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী কিছু বলেছেন কি না জানতে চাইলে রওশন বলেন, ‘এখন তো আর সময় নেই। আর কী বলবেন।’
জিএম কাদেরের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টির নির্বাচনে যাওয়ার বিষয়ে রওশন বলেন, ‘জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান আমাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেননি। আমার ছেলের জায়গায় উনি ইলেকশন করছেন। ওর কথা তার মনে নেই।’
জাতীয় পার্টির নেতাদের প্রতি সমর্থন আছে কি না জানতে চাইলে রওশন বলেন, ‘আমাদের ইচ্ছা করে বাদ দিয়েছে। কেন সমর্থন থাকবে?’
রওশন এরশাদ সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় মসিউর রহমান রাঙ্গা সাংবাদিকদের বলেন, রওশন এরশাদ কথা বলার মতো অবস্থায় নেই। সাংবাদিকদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলবেন তাদের নেতা কাজী মামুনুর রশিদ।
পরে কাজী মামুনুর রশিদ একটি লিখিত বক্তব্য সাংবাদিকদের সরবরাহ করেন। সেখানে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কী আলোচনা হয়েছে, তা জানানো হয়। লিখিত বক্তব্যে বলা হয়েছে, ‘প্রধানমন্ত্রীকে তিনি (রওশন) বলেছেন জিএম কাদের অবৈধভাবে জাতীয় পার্টির নেতৃত্ব দখল করেছেন। সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির মনোনয়ন চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে সুকৌশলে তাকে, সাদ এরশাদকে ও গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের সরিয়ে দিয়েছেন। দলের মধ্যে ‘ক্যু’ করে নেতৃত্ব গ্রহণ করেছেন।’
রওশন লিখিত বক্তব্যে আরও বলেন, ‘তিনি এসব বিষয় প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছেন। জিএম কাদেরের সঙ্গে কোনো নির্বাচনী জোট না করার অনুরোধ করেছেন।’ রওশন বলেন, ‘নির্বাচন অধিক গ্রহণযোগ্য করার জন্য জাতীয় পার্টি যাতে এককভাবে সারাদেশে প্রতিযোগিতামূলকভাবে নির্বাচন করে, সেটি নিশ্চিত করার অনুরোধ করেছেন তিনি।’
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করা আনকমন বিষয় নয় : জাপা মহাসচিব
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে রওশন এরশাদের সাক্ষাতের বিষয়টি স্বাভাবিক বিষয় হিসেবে দেখছেন জাপা মহাসচিব চুন্নু। মঙ্গলবার এক প্রশ্নের জবাবে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, রওশন এরশাদ গণভবনে গিয়েছেন কি না সেটি আমি জানি না। তবে উনি যেতেই পারেন।
‘যেকোনো মানুষের যাওয়ার সুযোগ আছে। রওশন এরশাদ সংসদের বিরোধদলের নেতা। তিনি সংসদের নেতার (শেখ হাসিনা) সঙ্গে যেকোনো সময়, যেকোনো বিষয়ে দেখা করতেই পারেন। রওশন এরশাদ গণভবনে যেতেই পারেন এটা খুব ইজি বিষয়, আনকমন বিষয় নয়।’
জাপা মহাসচিবের ভাষ্য, তারা চেয়েছিলেন, রওশন এরশাদ নির্বাচনে থাকবেন। এতে পার্টির সুনাম বাড়ত।
‘ম্যাডাম আমাদের পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক। উনি নির্বাচন করুক, উনার ছেলে করুক এবং উনার (রওশন এরশাদ) ইচ্ছামতো আরেকজন করুক। তিনজনের জন্য মনোনয়নপত্র নিয়ে আমরা অপেক্ষা করেছি। মনোনয়ন জমা দেয়ার শেষ দিনের আগের দিন রাত ১০টা পর্যন্ত বসেছিলাম। ওনাকে বলেছি আপনি চাইলে আমি নিজে আপনার বাসায় মনোনয়নপত্র নিয়ে যাবো। কিন্তু উনি আমাকে মনোনয়ন নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেননি। পরে রওশন এরশাদ বলেছেন, তিনি নির্বাচনে যাবেন না। ম্যাডাম ভোটে এলে আমাদের জন্য ভালো হতো, কর্মীরাও খুশি হতো। ম্যাডাম না আসায় আমরা দুঃখিত।’