মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন
বাঙালির সংস্কৃতিমনস্কতা কি ক্রমেই কমে যাচ্ছে? এ নিয়ে লেখার আগে সংস্কৃতির ভারী সংজ্ঞাটা দেয়া বাঞ্ছনীয়। ‘নিরন্তর চর্চার মাধ্যমে একটা জাতির সভ্যতার উৎকর্ষ সাধন’ এভাবে সংস্কৃতিকে সংজ্ঞায়িত করা যায়। একটা জাতি সংস্কৃতিমনস্ক কিনা সেটা বোঝার জন্যে তারা নাচগান ভালোবাসে কিনা, স্টেজে কেউ উঠলে হাততালি দেয় কিনা তা দিয়ে নির্ধারণ করা যায় না। রিকশাওয়ালার সঙ্গে কথা হচ্ছে; সেখানে একজন সাধারণ বাঙালি কিভাবে কথা বলছে, তার অঙ্গভঙ্গি কেমন, রাজনীতির মঞ্চে একজন নেতা বা নেত্রী বিরোধী দলের একজন নেতা বা নেত্রী সম্পর্কে কি ভাষা প্রয়োগ করে কথা বলছে কিংবা একজন চোরকে যখন ল্যাম্প পোস্টে বেঁধে গণধোলাই দেয়া হচ্ছে একজন সাধারণ পথিক সেখান দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় ছুটে এসেছে চোরকে মারতে না বাঁচাতে? সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘ভাইরাল’ বা আক্রমিত একজন লোককে কদর্য ভাষা ছুড়ে দিতে কতখানি ঝাঁপিয়ে পরছে মানুষ! এসব কিছুই একটা জাতির সংস্কৃতির পরিচায়ক।
যা যুগ! সংস্কৃতিমনস্কতা শব্দটি উচ্চারণ করতেই জিহ্বা জড়িয়ে আসে অনেকের। সোশ্যাল মিডিয়ায় যখন ট্রেন্ডি ‘ভাইরাল রিলসের’ উৎসব চলছে; কদর্য ভিডিও, বাংলা ইংরেজি ভাষা মিলিয়ে মিশিয়ে একদম ‘জগাখিচুড়ি’ বানিয়ে কন্টেন্ট ক্রিয়েটরেরা ভিডিও রেকর্ড করছে এবং সেটাকে নিখাঁদ বিনোদন হিসেবে গ্রহণ করছে আমার প্রজন্ম।
আজ বিনোদন বলতে আমরা মোল্লা নাসিরউদ্দিনের হাস্যরসাত্মক গল্প বুঝি না ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ‘বসন্ত বিলাপ’ দেখি না কিংবা গোপাল ভাঁড়ের নাম শুনি না, সুকুমার রায় পড়িনা। আজকাল বিনোদন মানেই শুধু সোশ্যাল মিডিয়ার সস্তা মিমিক্রি এবং রিল’স। সেক্ষেত্রে বলাই যায়, তলানিতে নেমে গেছে বাঙালির রুচিবোধ।
চারিদিকে চোখ ঘুরালে দেখতে পাওয়া যায় ধর্মান্ধতা, মৌলবাদ, হিংস্রতা, উগ্রবাদিতা। সোশ্যাল মিডিয়া তো বটেই, বাস্তব সমাজেও। প্রযুক্তি এগিয়ে গেছে, কিন্তু এগিয়ে যাইনি আমরা। আমাদের মানসিকতা প্রগতিশীলতায় ঘাটতি রয়েছে বিরাট। এটা বলার সাহস আমার এলো এই ব্যাপারটা ভেবে যে, সংস্কৃতিমনস্কতাকে এভাবেও সংজ্ঞায়িত করা যায় উঁচু সংস্কৃতির প্রতি মনোযোগী হওয়া। এবারে উঁচু সংস্কৃতির সঙ্গে একটা জিনিস আছে। উঁঁচু সংস্কৃতি কিন্তু সহজেই গিলে ফেলা যায় না। সেটা নিয়ে ভাবতে হয়। এক্ষেত্রে সংস্কৃতিমনস্ক জাতিকে আমরা এভাবে সংজ্ঞায়িত করবো ‘যার ভাবতে ভালো লাগে’ ভাবতে মন্দ লাগেনা; ভাবনাটাকে যে তিক্ত জঘন্য বিচ্ছিরি খাটুনি মনে করে না বরং অভিযান হিসেবে ধরে নেয়। আর এখানেই আমাদের প্রজন্মের ঘাটতি। আমাদের প্রজন্মের চিন্তাশীল ভাবনাশীল বৃহৎ ব্যাপার স্যাপারে একটা এলার্জি আছে। ভাবনা ব্যাপারটাই একটা বিশাল ‘আর্ট’! ঋত্বিক ঘটকের সেই কথাটা যেমন, “ভাবো ভাবো, ভাবা প্র্যাকটিস করো”।
একটা বাস্তব উদাহরণ দেয়া যাক, বন্ধুদের মাঝে কোনো আড্ডায় কেউ যদি তুলে “জানিস, শরৎচন্দ্রের একটা বইয়ে... আঁতলামো করিস না, তুই খুব সাহিত্যিক মানুষ, আমরা সেরকম নই।” এদের কি বলা যায় তবে? এটা আমাদের একটা ধরন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংস্কৃতিমনস্কতা তাহলে আসবে কীভাবে? এই ভাবনাশক্তি, কল্পনাশক্তি, চিন্তাশক্তির ব্যাপারটা আগে যাদের ছিল- তাদের সমীহের চোখে দেখা হতো। তবে এ-যুগে তার উল্টো, তুচ্ছতাচ্ছিল্য বা আঁতলামোর চোখে দেখা হয়।
যদি একটা জাতি সংস্কৃতির প্রতি মনোযোগী হয়, তবে সে দারুণ দারুণ সংস্কৃতি গড়বেই। মোদ্দাকথা, কোথায় হয় এখন সেই আগের ‘নক্ষত্রের রাত’ ‘কোথাও কেউ নেই’ এগুলোর মতন বাংলা নাটক? কোথায় সেই বাংলা কবিতা যা আমাদের মনে হয় জার্মান ভাষায় অনুবাদ না হলেই নয়। আবার ধরুন, এখনের সময়ে একটা ছেলে লেখালেখি করছে। অজস্রটা বানান ভুল, শব্দচয়ন ভুল, লিপিকৌশলী তৃপ্তিপূর্ণ নয় কিন্তু তাকে নিয়েই শোরগোল, হইহই কা- হচ্ছে! আমরা পুরোনোতেই আটকে আছি। সেই সত্যজিৎ রায়, সেই মৃণাল সেন, সেই হুমায়ূন আহমেদ, সেই বিভূতি-ভূষণ, সেই রবীন্দ্রনাথ... এরপরে আর উঠতে পারছে না বাঙালি।
দেশে এত সাংস্কৃতিক সংগঠন থাকার পরেও, আসল ভেজালমুক্ত সংস্কৃতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছি আমরা ক্রমেই। অপ-সংস্কৃতির প্রভাব দিনকে দিন ছড়িয়ে পরছে। এ প্রজন্ম এবং এর পরের প্রজন্ম যারা গড়ছে তারা অধিকাংশই বহিরাগত সংস্কৃতি দ্বারা আষ্টেপৃষ্টে প্রভাবিত। বই পড়া এবং বই লেনদেনের ব্যাপারটাই যেন দিনকে দিক কমে আসছে। এদের হাতে যদি বিভূতি-ভূষণ সমগ্র কিংবা বঙ্কিম ধরিয়ে দেয়া হয় এতো গোটা গোটা ভারী বাংলা ভাষা বুঝাই হবে অসাধ্য ব্যাপার যে সেটা গিলে না মাথায় দেয়!?
আমরা চাই না আমাদের প্রজন্ম ইংলিশ বা হিন্দিকে নিজের ভাষা বলে ভাবতে শিখুক। আমরা চাই না আমাদের প্রজন্ম মানুষ গোলাগুলি’র মতো ট্রেন্ডি গেইমে মত্ত থাকুক। আমরা চাই না আমাদের প্রজন্ম ‘ফরেইন কালচার’ নিয়ে বুঁদ হয়ে থাকুক। আবারও ফিরে আসুক ‘পথের পাঁচালি’র অপু-দুর্গা স্ক্রিনে। বাকের ভাইয়ের ফাঁসির তদন্তে উত্তাল হউক দেশ। সালমান শাহ-র মতো নায়কের জন্য দেশের হাজারো তরুণীরা নাওয়া খাওয়া ভুলে গিয়ে চোখের জলে ভাসুক। ‘বং’ বা ‘বেঙ্গলি’ নই ‘আমি বাঙালি’।
জয়িতা চক্রবর্তী
শিক্ষার্থী, ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন
মঙ্গলবার, ১০ ডিসেম্বর ২০২৪
বাঙালির সংস্কৃতিমনস্কতা কি ক্রমেই কমে যাচ্ছে? এ নিয়ে লেখার আগে সংস্কৃতির ভারী সংজ্ঞাটা দেয়া বাঞ্ছনীয়। ‘নিরন্তর চর্চার মাধ্যমে একটা জাতির সভ্যতার উৎকর্ষ সাধন’ এভাবে সংস্কৃতিকে সংজ্ঞায়িত করা যায়। একটা জাতি সংস্কৃতিমনস্ক কিনা সেটা বোঝার জন্যে তারা নাচগান ভালোবাসে কিনা, স্টেজে কেউ উঠলে হাততালি দেয় কিনা তা দিয়ে নির্ধারণ করা যায় না। রিকশাওয়ালার সঙ্গে কথা হচ্ছে; সেখানে একজন সাধারণ বাঙালি কিভাবে কথা বলছে, তার অঙ্গভঙ্গি কেমন, রাজনীতির মঞ্চে একজন নেতা বা নেত্রী বিরোধী দলের একজন নেতা বা নেত্রী সম্পর্কে কি ভাষা প্রয়োগ করে কথা বলছে কিংবা একজন চোরকে যখন ল্যাম্প পোস্টে বেঁধে গণধোলাই দেয়া হচ্ছে একজন সাধারণ পথিক সেখান দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় ছুটে এসেছে চোরকে মারতে না বাঁচাতে? সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘ভাইরাল’ বা আক্রমিত একজন লোককে কদর্য ভাষা ছুড়ে দিতে কতখানি ঝাঁপিয়ে পরছে মানুষ! এসব কিছুই একটা জাতির সংস্কৃতির পরিচায়ক।
যা যুগ! সংস্কৃতিমনস্কতা শব্দটি উচ্চারণ করতেই জিহ্বা জড়িয়ে আসে অনেকের। সোশ্যাল মিডিয়ায় যখন ট্রেন্ডি ‘ভাইরাল রিলসের’ উৎসব চলছে; কদর্য ভিডিও, বাংলা ইংরেজি ভাষা মিলিয়ে মিশিয়ে একদম ‘জগাখিচুড়ি’ বানিয়ে কন্টেন্ট ক্রিয়েটরেরা ভিডিও রেকর্ড করছে এবং সেটাকে নিখাঁদ বিনোদন হিসেবে গ্রহণ করছে আমার প্রজন্ম।
আজ বিনোদন বলতে আমরা মোল্লা নাসিরউদ্দিনের হাস্যরসাত্মক গল্প বুঝি না ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ‘বসন্ত বিলাপ’ দেখি না কিংবা গোপাল ভাঁড়ের নাম শুনি না, সুকুমার রায় পড়িনা। আজকাল বিনোদন মানেই শুধু সোশ্যাল মিডিয়ার সস্তা মিমিক্রি এবং রিল’স। সেক্ষেত্রে বলাই যায়, তলানিতে নেমে গেছে বাঙালির রুচিবোধ।
চারিদিকে চোখ ঘুরালে দেখতে পাওয়া যায় ধর্মান্ধতা, মৌলবাদ, হিংস্রতা, উগ্রবাদিতা। সোশ্যাল মিডিয়া তো বটেই, বাস্তব সমাজেও। প্রযুক্তি এগিয়ে গেছে, কিন্তু এগিয়ে যাইনি আমরা। আমাদের মানসিকতা প্রগতিশীলতায় ঘাটতি রয়েছে বিরাট। এটা বলার সাহস আমার এলো এই ব্যাপারটা ভেবে যে, সংস্কৃতিমনস্কতাকে এভাবেও সংজ্ঞায়িত করা যায় উঁচু সংস্কৃতির প্রতি মনোযোগী হওয়া। এবারে উঁচু সংস্কৃতির সঙ্গে একটা জিনিস আছে। উঁঁচু সংস্কৃতি কিন্তু সহজেই গিলে ফেলা যায় না। সেটা নিয়ে ভাবতে হয়। এক্ষেত্রে সংস্কৃতিমনস্ক জাতিকে আমরা এভাবে সংজ্ঞায়িত করবো ‘যার ভাবতে ভালো লাগে’ ভাবতে মন্দ লাগেনা; ভাবনাটাকে যে তিক্ত জঘন্য বিচ্ছিরি খাটুনি মনে করে না বরং অভিযান হিসেবে ধরে নেয়। আর এখানেই আমাদের প্রজন্মের ঘাটতি। আমাদের প্রজন্মের চিন্তাশীল ভাবনাশীল বৃহৎ ব্যাপার স্যাপারে একটা এলার্জি আছে। ভাবনা ব্যাপারটাই একটা বিশাল ‘আর্ট’! ঋত্বিক ঘটকের সেই কথাটা যেমন, “ভাবো ভাবো, ভাবা প্র্যাকটিস করো”।
একটা বাস্তব উদাহরণ দেয়া যাক, বন্ধুদের মাঝে কোনো আড্ডায় কেউ যদি তুলে “জানিস, শরৎচন্দ্রের একটা বইয়ে... আঁতলামো করিস না, তুই খুব সাহিত্যিক মানুষ, আমরা সেরকম নই।” এদের কি বলা যায় তবে? এটা আমাদের একটা ধরন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংস্কৃতিমনস্কতা তাহলে আসবে কীভাবে? এই ভাবনাশক্তি, কল্পনাশক্তি, চিন্তাশক্তির ব্যাপারটা আগে যাদের ছিল- তাদের সমীহের চোখে দেখা হতো। তবে এ-যুগে তার উল্টো, তুচ্ছতাচ্ছিল্য বা আঁতলামোর চোখে দেখা হয়।
যদি একটা জাতি সংস্কৃতির প্রতি মনোযোগী হয়, তবে সে দারুণ দারুণ সংস্কৃতি গড়বেই। মোদ্দাকথা, কোথায় হয় এখন সেই আগের ‘নক্ষত্রের রাত’ ‘কোথাও কেউ নেই’ এগুলোর মতন বাংলা নাটক? কোথায় সেই বাংলা কবিতা যা আমাদের মনে হয় জার্মান ভাষায় অনুবাদ না হলেই নয়। আবার ধরুন, এখনের সময়ে একটা ছেলে লেখালেখি করছে। অজস্রটা বানান ভুল, শব্দচয়ন ভুল, লিপিকৌশলী তৃপ্তিপূর্ণ নয় কিন্তু তাকে নিয়েই শোরগোল, হইহই কা- হচ্ছে! আমরা পুরোনোতেই আটকে আছি। সেই সত্যজিৎ রায়, সেই মৃণাল সেন, সেই হুমায়ূন আহমেদ, সেই বিভূতি-ভূষণ, সেই রবীন্দ্রনাথ... এরপরে আর উঠতে পারছে না বাঙালি।
দেশে এত সাংস্কৃতিক সংগঠন থাকার পরেও, আসল ভেজালমুক্ত সংস্কৃতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছি আমরা ক্রমেই। অপ-সংস্কৃতির প্রভাব দিনকে দিন ছড়িয়ে পরছে। এ প্রজন্ম এবং এর পরের প্রজন্ম যারা গড়ছে তারা অধিকাংশই বহিরাগত সংস্কৃতি দ্বারা আষ্টেপৃষ্টে প্রভাবিত। বই পড়া এবং বই লেনদেনের ব্যাপারটাই যেন দিনকে দিক কমে আসছে। এদের হাতে যদি বিভূতি-ভূষণ সমগ্র কিংবা বঙ্কিম ধরিয়ে দেয়া হয় এতো গোটা গোটা ভারী বাংলা ভাষা বুঝাই হবে অসাধ্য ব্যাপার যে সেটা গিলে না মাথায় দেয়!?
আমরা চাই না আমাদের প্রজন্ম ইংলিশ বা হিন্দিকে নিজের ভাষা বলে ভাবতে শিখুক। আমরা চাই না আমাদের প্রজন্ম মানুষ গোলাগুলি’র মতো ট্রেন্ডি গেইমে মত্ত থাকুক। আমরা চাই না আমাদের প্রজন্ম ‘ফরেইন কালচার’ নিয়ে বুঁদ হয়ে থাকুক। আবারও ফিরে আসুক ‘পথের পাঁচালি’র অপু-দুর্গা স্ক্রিনে। বাকের ভাইয়ের ফাঁসির তদন্তে উত্তাল হউক দেশ। সালমান শাহ-র মতো নায়কের জন্য দেশের হাজারো তরুণীরা নাওয়া খাওয়া ভুলে গিয়ে চোখের জলে ভাসুক। ‘বং’ বা ‘বেঙ্গলি’ নই ‘আমি বাঙালি’।
জয়িতা চক্রবর্তী
শিক্ষার্থী, ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা