মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন
দক্ষিণ এশিয়ার সমাজ, বিশেষ করে বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের বিভিন্ন সংস্কৃতিতে কন্যা সন্তানদের ছোটবেলা থেকেই একটি নির্দিষ্ট ছাঁচে গড়ে তোলার প্রবণতা আজও প্রবল। জন্মের পর থেকেই তাদের চারপাশে তৈরি হয় এক অদৃশ্য সামাজিক শৃঙ্খল, যা তাদের আচরণ, চলাফেরা, কথা বলা, এমনকি স্বপ্ন দেখার স্বাধীনতাকেও নিয়ন্ত্রণ করে। পরিবার, সমাজ কিংবা আত্মীয়পরিজনের অনেকেই মনে করেন, মেয়েদের নীরব, শান্ত, ভদ্র ও সংযত হয়ে বড় হওয়া উচিত।
একটি শিশুর বিকাশে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো আত্মবিশ্বাস। আত্মবিশ্বাসই শেখায় নতুন কিছু জানার আগ্রহ, ভুল থেকে শেখার মানসিকতা, নিজের মতামত প্রকাশের সাহস এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর শক্তি। কিন্তু যখন ছোটবেলা থেকেই মেয়েদের শেখানো হয় কথা কম বলতে, প্রশ্ন না করতে বা নিজের মতামত প্রকাশ না করতে, তখন তারা ভেতরে ভেতরে সংকুচিত হয়ে যায়। সমাজ তাদের মনে এমন ধারণা গেঁথে দেয় যে নীরবতাই মেয়েদের সৌন্দর্য। অথচ সত্য হলো-নীরবতা নয়, নিজের অধিকার নিয়ে কথা বলার সাহসই নারীর আসল সৌন্দর্য ও মর্যাদা।
দক্ষিণ এশিয়ার নারীরা দীর্ঘদিন ধরেই বৈষম্যের শিকার। শিক্ষা, কর্মসংস্থান, রাজনীতি কিংবা পারিবারিক সিদ্ধান্তে নারীর মতামতকে এখনো অবহেলা করা হয়। অথচ ইতিহাস সাক্ষী, যখনই নারীরা নিজের কণ্ঠস্বর তুলে ধরেছেন, তখনই সমাজ এগিয়েছে। বেগম রোকেয়া, সুফিয়া কামাল, সারওয়ার জাহান কিংবা ইন্দিরা গান্ধীÑএঁরা সবাই ছোটবেলার সীমাবদ্ধতা ভেঙে নিজের মতামত প্রকাশের সাহস দেখিয়েছিলেন বলেই পরিবর্তনের প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন।
মেয়েদের নীরব করে রাখা মানে তাদের সম্ভাবনাকে অচল করে দেওয়া। একজন ছেলে যখন নিজের মত প্রকাশ করে, তখন তাকে বলা হয় ‘স্মার্ট’; কিন্তু একই কাজ মেয়েরা করলে তাদের বলা হয় ‘বেয়াদব’ বা ‘অভদ্র’। এই দ্বৈত মানসিকতাই নারী ক্ষমতায়নের পথে সবচেয়ে বড় অন্তরায়। মেয়েদের ছোটবেলা থেকেই শেখানো উচিত যে তাদের কণ্ঠস্বরও সমান গুরুত্বপূর্ণ, তাদের চিন্তাভাবনাও মূল্যবান, আর তাদের প্রশ্ন করবার অধিকারও অনস্বীকার্য।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো এই পরিবর্তনে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। স্কুলে মেয়েদের মতামত প্রকাশে উৎসাহিত করা, বিতর্ক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও নেতৃত্বমূলক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ বাড়ানো তাদের আত্মবিশ্বাস গড়ে তুলতে সাহায্য করে। পরিবারেও একইভাবে তাদের কথা শোনার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। একজন মেয়ে যদি পরিবারের মধ্যে নিজের মতামত দিতে শেখে, তবে সে সমাজ, কর্মক্ষেত্র বা রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে নিজের অবস্থান প্রকাশ করতে পারবে।
নারীর ক্ষমতায়নের মূল দর্শন হলো-নারী যেন নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়, নিজের জীবন নিজের মতো করে গড়ার স্বাধীনতা পায়। ক্ষমতায়ন মানে শুধু অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা নয়, বরং মানসিক ও সামাজিকভাবে শক্ত হয়ে ওঠা। এজন্য ছোটবেলা থেকেই মেয়েদের শেখাতে হবে নিজেদের মূল্য দেওয়া, নিজের কণ্ঠকে শ্রদ্ধা করা এবং অন্যায়ের প্রতিবাদে সাহসী হওয়া।
বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার অনেক পরিবারে এখনো পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা কাজ করে, যেখানে মেয়েদের চুপ থাকতে শেখানো হয়, সিদ্ধান্তে অংশ না নিতে বলা হয়। অথচ সমাজের পূর্ণ বিকাশ তখনই সম্ভব, যখন নারী-পুরুষ উভয়ের মতামত ও অংশগ্রহণ সমানভাবে নিশ্চিত হয়। অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে নীরব করে রাখলে সেই সমাজ কখনোই টেকসই উন্নয়নে পৌঁছাতে পারবে না।
আজকের বিশ্ব সমান সুযোগের কথা বলে, টেকসই উন্নয়ন ও জেন্ডার সমতার কথা বলে। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার পঞ্চম লক্ষ্যই হলো-জেন্ডার সমতা ও নারীর ক্ষমতায়ন। বাংলাদেশও সে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু বাস্তবে আজও দেখা যায়-গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত মেয়েদের নীরবতার শিক্ষা দেওয়া হয়। এ বাস্তবতা বদলাতে হলে পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম এবং রাষ্ট্রের সমন্বিত প্রয়াস প্রয়োজন।
আমরা যদি সত্যিই নারীর ক্ষমতায়ন চাই, তবে প্রথম পদক্ষেপ হতে হবে-মেয়েদের ছোটবেলা থেকেই শেখানো যে তারা নীরব থাকার জন্য জন্মায়নি, বরং নিজের কণ্ঠে পৃথিবী বদলানোর জন্য জন্মেছে। সমাজকে বুঝতে হবে, মেয়ে মানে কেবল দায়িত্বশীল বা আজ্ঞাবহ মানুষ নয়, বরং একজন স্বাধীন সত্তা, যার নিজের মত, চিন্তা ও স্বপ্ন আছে।
শেষ পর্যন্ত নারীর ক্ষমতায়ন তখনই সম্ভব, যখন একজন নারী অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে, নিজের অধিকার দাবি করে এবং নিজের কণ্ঠস্বরকে শ্রদ্ধা করে। মেয়েদের নীরবতা নয়, তাদের কথা বলার সাহস শেখানোই হবে আগামী প্রজন্মকে আলোকিত করার প্রথম শর্ত।
সাইফুন নাহার সায়লা
বগুড়া সদর, বগুড়া।
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন
রোববার, ০২ নভেম্বর ২০২৫
দক্ষিণ এশিয়ার সমাজ, বিশেষ করে বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের বিভিন্ন সংস্কৃতিতে কন্যা সন্তানদের ছোটবেলা থেকেই একটি নির্দিষ্ট ছাঁচে গড়ে তোলার প্রবণতা আজও প্রবল। জন্মের পর থেকেই তাদের চারপাশে তৈরি হয় এক অদৃশ্য সামাজিক শৃঙ্খল, যা তাদের আচরণ, চলাফেরা, কথা বলা, এমনকি স্বপ্ন দেখার স্বাধীনতাকেও নিয়ন্ত্রণ করে। পরিবার, সমাজ কিংবা আত্মীয়পরিজনের অনেকেই মনে করেন, মেয়েদের নীরব, শান্ত, ভদ্র ও সংযত হয়ে বড় হওয়া উচিত।
একটি শিশুর বিকাশে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো আত্মবিশ্বাস। আত্মবিশ্বাসই শেখায় নতুন কিছু জানার আগ্রহ, ভুল থেকে শেখার মানসিকতা, নিজের মতামত প্রকাশের সাহস এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর শক্তি। কিন্তু যখন ছোটবেলা থেকেই মেয়েদের শেখানো হয় কথা কম বলতে, প্রশ্ন না করতে বা নিজের মতামত প্রকাশ না করতে, তখন তারা ভেতরে ভেতরে সংকুচিত হয়ে যায়। সমাজ তাদের মনে এমন ধারণা গেঁথে দেয় যে নীরবতাই মেয়েদের সৌন্দর্য। অথচ সত্য হলো-নীরবতা নয়, নিজের অধিকার নিয়ে কথা বলার সাহসই নারীর আসল সৌন্দর্য ও মর্যাদা।
দক্ষিণ এশিয়ার নারীরা দীর্ঘদিন ধরেই বৈষম্যের শিকার। শিক্ষা, কর্মসংস্থান, রাজনীতি কিংবা পারিবারিক সিদ্ধান্তে নারীর মতামতকে এখনো অবহেলা করা হয়। অথচ ইতিহাস সাক্ষী, যখনই নারীরা নিজের কণ্ঠস্বর তুলে ধরেছেন, তখনই সমাজ এগিয়েছে। বেগম রোকেয়া, সুফিয়া কামাল, সারওয়ার জাহান কিংবা ইন্দিরা গান্ধীÑএঁরা সবাই ছোটবেলার সীমাবদ্ধতা ভেঙে নিজের মতামত প্রকাশের সাহস দেখিয়েছিলেন বলেই পরিবর্তনের প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন।
মেয়েদের নীরব করে রাখা মানে তাদের সম্ভাবনাকে অচল করে দেওয়া। একজন ছেলে যখন নিজের মত প্রকাশ করে, তখন তাকে বলা হয় ‘স্মার্ট’; কিন্তু একই কাজ মেয়েরা করলে তাদের বলা হয় ‘বেয়াদব’ বা ‘অভদ্র’। এই দ্বৈত মানসিকতাই নারী ক্ষমতায়নের পথে সবচেয়ে বড় অন্তরায়। মেয়েদের ছোটবেলা থেকেই শেখানো উচিত যে তাদের কণ্ঠস্বরও সমান গুরুত্বপূর্ণ, তাদের চিন্তাভাবনাও মূল্যবান, আর তাদের প্রশ্ন করবার অধিকারও অনস্বীকার্য।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো এই পরিবর্তনে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। স্কুলে মেয়েদের মতামত প্রকাশে উৎসাহিত করা, বিতর্ক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও নেতৃত্বমূলক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ বাড়ানো তাদের আত্মবিশ্বাস গড়ে তুলতে সাহায্য করে। পরিবারেও একইভাবে তাদের কথা শোনার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। একজন মেয়ে যদি পরিবারের মধ্যে নিজের মতামত দিতে শেখে, তবে সে সমাজ, কর্মক্ষেত্র বা রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে নিজের অবস্থান প্রকাশ করতে পারবে।
নারীর ক্ষমতায়নের মূল দর্শন হলো-নারী যেন নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়, নিজের জীবন নিজের মতো করে গড়ার স্বাধীনতা পায়। ক্ষমতায়ন মানে শুধু অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা নয়, বরং মানসিক ও সামাজিকভাবে শক্ত হয়ে ওঠা। এজন্য ছোটবেলা থেকেই মেয়েদের শেখাতে হবে নিজেদের মূল্য দেওয়া, নিজের কণ্ঠকে শ্রদ্ধা করা এবং অন্যায়ের প্রতিবাদে সাহসী হওয়া।
বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার অনেক পরিবারে এখনো পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা কাজ করে, যেখানে মেয়েদের চুপ থাকতে শেখানো হয়, সিদ্ধান্তে অংশ না নিতে বলা হয়। অথচ সমাজের পূর্ণ বিকাশ তখনই সম্ভব, যখন নারী-পুরুষ উভয়ের মতামত ও অংশগ্রহণ সমানভাবে নিশ্চিত হয়। অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে নীরব করে রাখলে সেই সমাজ কখনোই টেকসই উন্নয়নে পৌঁছাতে পারবে না।
আজকের বিশ্ব সমান সুযোগের কথা বলে, টেকসই উন্নয়ন ও জেন্ডার সমতার কথা বলে। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার পঞ্চম লক্ষ্যই হলো-জেন্ডার সমতা ও নারীর ক্ষমতায়ন। বাংলাদেশও সে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু বাস্তবে আজও দেখা যায়-গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত মেয়েদের নীরবতার শিক্ষা দেওয়া হয়। এ বাস্তবতা বদলাতে হলে পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম এবং রাষ্ট্রের সমন্বিত প্রয়াস প্রয়োজন।
আমরা যদি সত্যিই নারীর ক্ষমতায়ন চাই, তবে প্রথম পদক্ষেপ হতে হবে-মেয়েদের ছোটবেলা থেকেই শেখানো যে তারা নীরব থাকার জন্য জন্মায়নি, বরং নিজের কণ্ঠে পৃথিবী বদলানোর জন্য জন্মেছে। সমাজকে বুঝতে হবে, মেয়ে মানে কেবল দায়িত্বশীল বা আজ্ঞাবহ মানুষ নয়, বরং একজন স্বাধীন সত্তা, যার নিজের মত, চিন্তা ও স্বপ্ন আছে।
শেষ পর্যন্ত নারীর ক্ষমতায়ন তখনই সম্ভব, যখন একজন নারী অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে, নিজের অধিকার দাবি করে এবং নিজের কণ্ঠস্বরকে শ্রদ্ধা করে। মেয়েদের নীরবতা নয়, তাদের কথা বলার সাহস শেখানোই হবে আগামী প্রজন্মকে আলোকিত করার প্রথম শর্ত।
সাইফুন নাহার সায়লা
বগুড়া সদর, বগুড়া।