মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন
একটি শিশুর জন্ম কেবল একটি পরিবারের নয়, পুরো জাতির আনন্দ। কিন্তু সেই শিশুই যদি জন্মের পর থেকেই অনিরাপদ খাদ্য, বিষমিশ্রিত দুধ বা ভেজাল পুষ্টির শিকার হয়, তাহলে আনন্দের জায়গায় আসে ভয়াবহ উদ্বেগ। বর্তমানে বাংলাদেশের শিশু খাদ্যের বাজারে ভয়ংকর বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে। দুধ, সিরিয়াল, চকলেট, জুস, এমনকি শিশুদের জন্য নির্ধারিত স্যুপ-সবখানেই চলছে ভেজাল, অনিয়ম ও প্রতারণা। মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য নতুন প্যাকেটে বিক্রি হচ্ছে, রাসায়নিক সংরক্ষণকারীর মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক মান, ফলে শিশুরা নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
দেশে নিরাপদ খাদ্য আইন, বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, বিএসটিআই, ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর-সবই আছে; কিন্তু সমন্বয়হীনতা, জনবল সংকট, রাজনৈতিক প্রভাব ও দুর্নীতির কারণে কার্যত নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থা। রাজধানীর সুপারশপ থেকে শুরু করে গ্রামের দোকান-সবখানেই নাম না জানা ব্র্যান্ডের শিশুখাদ্য বিক্রি হচ্ছে, যার উৎপত্তি বা উপাদান কেউ জানে না। এটি শুধু একটি স্বাস্থ্য সমস্যা নয়, একটি বড় নৈতিক ও রাষ্ট্রীয় সংকট।
জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদে বলা হয়েছে, প্রতিটি শিশুর নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্য পাওয়ার অধিকার রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে এই অধিকার আজও বাস্তবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। শিশুখাদ্যের মান নিয়ন্ত্রণ, বার্ষিক পর্যবেক্ষণ বা সুনির্দিষ্ট নীতি প্রণয়ন-কোনোটিই কার্যকর নয়। উৎপাদকরা লাভের আশায় মান কমায়, সরকার আইন করেও তা বাস্তবায়ন করে না, আর ভোক্তারা চটকদার বিজ্ঞাপনে প্রতারিত হয়।
ঢাকার একটি নামী প্রতিষ্ঠানের শিশু সিরিয়ালে শিশুর সহনক্ষমতার তিনগুণ বেশি চিনি পাওয়া গেছে। আবার বিদেশি দুধে সীসা ও আর্সেনিকের মতো বিষাক্ত ধাতব উপাদান শনাক্ত হয়েছে, যা শিশুর স্নায়ুতন্ত্র, কিডনি ও মস্তিষ্কের বিকাশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। অথচ এসব নিয়ে তেমন প্রতিবাদ নেই। শিশুর কান্না আমরা ঠান্ডা-জ্বর ভেবে এড়িয়ে যাই, কিন্তু তা হতে পারে ভেতরের বিষক্রিয়ার ইঙ্গিত।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের প্রায় ৩০ শতাংশ শিশু স্টান্টিংয়ে ভুগছে-অর্থাৎ বয়স অনুযায়ী তাদের বৃদ্ধি থেমে গেছে। এটি দারিদ্র্যরে চেয়ে খাদ্যের মান ও নিরাপত্তাহীনতার ফল। তাই শিশু খাদ্যের নিরাপত্তা এখন জাতির ভবিষ্যতের প্রশ্ন। সরকার চাইলে শিশু খাদ্যকে “জরুরি স্বাস্থ্যপণ্য” ঘোষণা করে বিশেষ সুরক্ষার আওতায় আনতে পারে। প্রতিটি ব্র্যান্ডের উৎপাদন প্রক্রিয়া নিয়মিতভাবে পরীক্ষা করে ফলাফল প্রকাশ করা জরুরি।
অভিভাবকদেরও সচেতন হতে হবে। শিশুর খাদ্যে ঘরোয়া ও প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহার করতে হবে। ছয় মাস বয়স পর্যন্ত শুধুই মায়ের দুধই শিশুর জন্য যথেষ্ট-এই সত্য বিশ্বাস করতে হবে। অন্যদিকে, গণমাধ্যম ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো শিশু খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়ে জনসচেতনতা বাড়াতে পারে।
সবশেষে মনে রাখতে হবে, শিশুর নিরাপত্তা মানে শুধু দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা নয়; এটি তার প্রথম আহার, প্রথম পুষ্টির সঙ্গে সম্পর্কিত। শিশুর শরীরে প্রবেশ করা প্রতিটি খাদ্যকণা যেন জীবনের উৎস হয়, মৃত্যুর নয়-এটাই আমাদের দায়িত্ব। শিশুর নিরাপদ খাদ্য মানেই নিরাপদ জাতি, নিরাপদ ভবিষ্যৎ। তাই আজই আমাদের এক কণ্ঠে বলতে হবে-নিরাপদ শিশু খাদ্য চাই, এখনই চাই।
শাকিলা খাতুন
তেকানীচুকাইনগর, সোনাতলা, বগুড়া।
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন
শনিবার, ০৮ নভেম্বর ২০২৫
একটি শিশুর জন্ম কেবল একটি পরিবারের নয়, পুরো জাতির আনন্দ। কিন্তু সেই শিশুই যদি জন্মের পর থেকেই অনিরাপদ খাদ্য, বিষমিশ্রিত দুধ বা ভেজাল পুষ্টির শিকার হয়, তাহলে আনন্দের জায়গায় আসে ভয়াবহ উদ্বেগ। বর্তমানে বাংলাদেশের শিশু খাদ্যের বাজারে ভয়ংকর বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে। দুধ, সিরিয়াল, চকলেট, জুস, এমনকি শিশুদের জন্য নির্ধারিত স্যুপ-সবখানেই চলছে ভেজাল, অনিয়ম ও প্রতারণা। মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য নতুন প্যাকেটে বিক্রি হচ্ছে, রাসায়নিক সংরক্ষণকারীর মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক মান, ফলে শিশুরা নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
দেশে নিরাপদ খাদ্য আইন, বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, বিএসটিআই, ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর-সবই আছে; কিন্তু সমন্বয়হীনতা, জনবল সংকট, রাজনৈতিক প্রভাব ও দুর্নীতির কারণে কার্যত নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থা। রাজধানীর সুপারশপ থেকে শুরু করে গ্রামের দোকান-সবখানেই নাম না জানা ব্র্যান্ডের শিশুখাদ্য বিক্রি হচ্ছে, যার উৎপত্তি বা উপাদান কেউ জানে না। এটি শুধু একটি স্বাস্থ্য সমস্যা নয়, একটি বড় নৈতিক ও রাষ্ট্রীয় সংকট।
জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদে বলা হয়েছে, প্রতিটি শিশুর নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্য পাওয়ার অধিকার রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে এই অধিকার আজও বাস্তবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। শিশুখাদ্যের মান নিয়ন্ত্রণ, বার্ষিক পর্যবেক্ষণ বা সুনির্দিষ্ট নীতি প্রণয়ন-কোনোটিই কার্যকর নয়। উৎপাদকরা লাভের আশায় মান কমায়, সরকার আইন করেও তা বাস্তবায়ন করে না, আর ভোক্তারা চটকদার বিজ্ঞাপনে প্রতারিত হয়।
ঢাকার একটি নামী প্রতিষ্ঠানের শিশু সিরিয়ালে শিশুর সহনক্ষমতার তিনগুণ বেশি চিনি পাওয়া গেছে। আবার বিদেশি দুধে সীসা ও আর্সেনিকের মতো বিষাক্ত ধাতব উপাদান শনাক্ত হয়েছে, যা শিশুর স্নায়ুতন্ত্র, কিডনি ও মস্তিষ্কের বিকাশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। অথচ এসব নিয়ে তেমন প্রতিবাদ নেই। শিশুর কান্না আমরা ঠান্ডা-জ্বর ভেবে এড়িয়ে যাই, কিন্তু তা হতে পারে ভেতরের বিষক্রিয়ার ইঙ্গিত।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের প্রায় ৩০ শতাংশ শিশু স্টান্টিংয়ে ভুগছে-অর্থাৎ বয়স অনুযায়ী তাদের বৃদ্ধি থেমে গেছে। এটি দারিদ্র্যরে চেয়ে খাদ্যের মান ও নিরাপত্তাহীনতার ফল। তাই শিশু খাদ্যের নিরাপত্তা এখন জাতির ভবিষ্যতের প্রশ্ন। সরকার চাইলে শিশু খাদ্যকে “জরুরি স্বাস্থ্যপণ্য” ঘোষণা করে বিশেষ সুরক্ষার আওতায় আনতে পারে। প্রতিটি ব্র্যান্ডের উৎপাদন প্রক্রিয়া নিয়মিতভাবে পরীক্ষা করে ফলাফল প্রকাশ করা জরুরি।
অভিভাবকদেরও সচেতন হতে হবে। শিশুর খাদ্যে ঘরোয়া ও প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহার করতে হবে। ছয় মাস বয়স পর্যন্ত শুধুই মায়ের দুধই শিশুর জন্য যথেষ্ট-এই সত্য বিশ্বাস করতে হবে। অন্যদিকে, গণমাধ্যম ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো শিশু খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়ে জনসচেতনতা বাড়াতে পারে।
সবশেষে মনে রাখতে হবে, শিশুর নিরাপত্তা মানে শুধু দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা নয়; এটি তার প্রথম আহার, প্রথম পুষ্টির সঙ্গে সম্পর্কিত। শিশুর শরীরে প্রবেশ করা প্রতিটি খাদ্যকণা যেন জীবনের উৎস হয়, মৃত্যুর নয়-এটাই আমাদের দায়িত্ব। শিশুর নিরাপদ খাদ্য মানেই নিরাপদ জাতি, নিরাপদ ভবিষ্যৎ। তাই আজই আমাদের এক কণ্ঠে বলতে হবে-নিরাপদ শিশু খাদ্য চাই, এখনই চাই।
শাকিলা খাতুন
তেকানীচুকাইনগর, সোনাতলা, বগুড়া।