মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন
বাংলাদেশের মানচিত্রে এমন একটি নাম আছে, যা উচ্চারণ করলেই মন জুড়ে ভেসে ওঠে নীল সমুদ্র, সোনালি বালু আর ঢেউয়ের মায়াবী শব্দ কক্সবাজার। পৃথিবীর দীর্ঘতম প্রাকৃতিক সমুদ্রসৈকতটি শুধু একটি ভৌগোলিক বিস্ময় নয়, এটি আমাদের জাতীয় গর্ব, আমাদের প্রকৃতির সঙ্গে গভীর মমতার প্রতীক।
প্রতিদিন হাজারো মানুষ ছুটে আসে কক্সবাজারের দিকে কেউ শান্তি খুঁজতে, কেউ আনন্দে ভাসতে, কেউ শুধু ঢেউয়ের শব্দ শুনে কিছুটা নিঃশ্বাস নিতে। লাবণী, সুগন্ধা, কলাতলি কিংবা ইনানী প্রতিটি সৈকতেরই নিজস্ব মেজাজ। সকালে সূর্যোদয়ের সোনালি আলো ঢেউয়ে নেচে ওঠে, আবার বিকেলের লাল আভায় সমুদ্র যেন আপন মনে গেয়ে ওঠে বিদায়ের গান। এই নৈসর্গিক সৌন্দর্য কক্সবাজারকে শুধু একটি ভ্রমণ গন্তব্য নয়, এক ধরনের মানসিক আশ্রয়ে পরিণত করেছে।
কক্সবাজারের সৌন্দর্যের পেছনে আছে তার মানুষের জীবন ও সংগ্রাম। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এখানে বসবাস করছে রাখাইন জনগোষ্ঠী, যাদের ধর্মীয় আচার, মন্দির, পোশাক ও খাদ্যাভ্যাস কক্সবাজারকে দিয়েছে এক অনন্য সাংস্কৃতিক পরিচয়। অন্যদিকে, জেলেদের নৌকা, জাল, ও ভোরের সমুদ্রযাত্রা এই শহরের জীবনচিত্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
প্রতিবছর প্রায় ৫০ লাখের বেশি পর্যটক আসে কক্সবাজারে। এই প্রবাহ অর্থনীতিতে গতি এনেছে, কর্মসংস্থানের নতুন দিগন্ত খুলেছে। হোটেল, রিসোর্ট, রেস্টুরেন্ট, ও স্থানীয় পণ্যের ব্যবসা এখন কোটি টাকার শিল্প। কিন্তু পর্যটনের এই আশীর্বাদ সঙ্গে করে এনেছে এক অদৃশ্য অভিশাপও।
সমুদ্রতটে বর্জ্যের স্তূপ, প্লাস্টিকের বোতল, অপরিকল্পিত নির্মাণ, এবং শব্দদূষণ কক্সবাজারের পরিবেশকে ধীরে ধীরে গ্রাস করছে। অনেক স্থানে সৈকতের প্রাকৃতিক গঠন নষ্ট হচ্ছে, কচ্ছপ ও অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণীর প্রজনন ব্যাহত হচ্ছে। যেভাবে অগোছালোভাবে হোটেল-রিসোর্ট গড়ে উঠছে, তাতে মনে হয় আমরা সৌন্দর্য সংরক্ষণের চেয়ে লাভের দৌড়ে নেমেছি।
কক্সবাজার এখন উন্নয়নের এক উত্তাল সময় পার করছে। আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, মেরিন ড্রাইভ, গভীর সমুদ্রবন্দর, ও পর্যটন নগর প্রকল্প এগুলো এই অঞ্চলকে অর্থনৈতিকভাবে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারে। টেকনাফ থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রাস্তা আজ আধুনিক, বিদ্যুৎ ও যোগাযোগ ব্যবস্থাও দ্রুত বদলে যাচ্ছে।
তবে উন্নয়নের এই ঢেউয়ের পেছনে রয়েছে প্রশ্ন ,আমরা কি প্রকৃতিকে এই গতির সঙ্গে তাল মেলাতে দিচ্ছি? অপরিকল্পিত উন্নয়ন প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট করছে; পাহাড় কাটা, বন ধ্বংস, ও উপকূলীয় জীববৈচিত্র?্যরে ক্ষতি এখনই চোখে পড়ছে। কক্সবাজার যদি শুধু কংক্রিটের শহরে পরিণত হয়, তাহলে হারিয়ে যাবে সেই নীলের শান্তি, যার জন্য মানুষ এখানে আসে।
কক্সবাজারকে রক্ষা করতে হলে দরকার টেকসই উন্নয়নের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, সমুদ্রদূষণ নিয়ন্ত্রণ, বন ও পাহাড় সংরক্ষণ এসবকে গুরুত্ব দিতে হবে নীতিনির্ধারণে। একই সঙ্গে পর্যটকদের মধ্যেও সচেতনতা বাড়ানো জরুরি।
“দায়িত্বশীল পর্যটন” এই ধারণাটিকে কেবল কথায় নয়, কাজে রূপ দিতে হবে। স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করতে হবে উন্নয়নের মূল ধারায়, যেন তারাও প্রকৃতি সংরক্ষণের অংশ হতে পারে।
এই সমুদ্রের প্রতিটি ঢেউ যেন আমাদের শেখায় যতই উন্নয়ন হোক, প্রকৃতির হাসি টিকিয়ে রাখাই সবচেয়ে বড় অর্জন।
কক্সবাজার কেবল একটি ভ্রমণস্থান নয়, এটি এক অনুভূতির নাম। এখানে এসে মানুষ মুক্তির স্বাদ পায়, জীবনের ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলতে পারে। তাই কক্সবাজারকে রক্ষা করা মানে আমাদের আত্মপরিচয়কে রক্ষা করা।
সুরাইয়া বিনতে হাসান
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন
রোববার, ২৩ নভেম্বর ২০২৫
বাংলাদেশের মানচিত্রে এমন একটি নাম আছে, যা উচ্চারণ করলেই মন জুড়ে ভেসে ওঠে নীল সমুদ্র, সোনালি বালু আর ঢেউয়ের মায়াবী শব্দ কক্সবাজার। পৃথিবীর দীর্ঘতম প্রাকৃতিক সমুদ্রসৈকতটি শুধু একটি ভৌগোলিক বিস্ময় নয়, এটি আমাদের জাতীয় গর্ব, আমাদের প্রকৃতির সঙ্গে গভীর মমতার প্রতীক।
প্রতিদিন হাজারো মানুষ ছুটে আসে কক্সবাজারের দিকে কেউ শান্তি খুঁজতে, কেউ আনন্দে ভাসতে, কেউ শুধু ঢেউয়ের শব্দ শুনে কিছুটা নিঃশ্বাস নিতে। লাবণী, সুগন্ধা, কলাতলি কিংবা ইনানী প্রতিটি সৈকতেরই নিজস্ব মেজাজ। সকালে সূর্যোদয়ের সোনালি আলো ঢেউয়ে নেচে ওঠে, আবার বিকেলের লাল আভায় সমুদ্র যেন আপন মনে গেয়ে ওঠে বিদায়ের গান। এই নৈসর্গিক সৌন্দর্য কক্সবাজারকে শুধু একটি ভ্রমণ গন্তব্য নয়, এক ধরনের মানসিক আশ্রয়ে পরিণত করেছে।
কক্সবাজারের সৌন্দর্যের পেছনে আছে তার মানুষের জীবন ও সংগ্রাম। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এখানে বসবাস করছে রাখাইন জনগোষ্ঠী, যাদের ধর্মীয় আচার, মন্দির, পোশাক ও খাদ্যাভ্যাস কক্সবাজারকে দিয়েছে এক অনন্য সাংস্কৃতিক পরিচয়। অন্যদিকে, জেলেদের নৌকা, জাল, ও ভোরের সমুদ্রযাত্রা এই শহরের জীবনচিত্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
প্রতিবছর প্রায় ৫০ লাখের বেশি পর্যটক আসে কক্সবাজারে। এই প্রবাহ অর্থনীতিতে গতি এনেছে, কর্মসংস্থানের নতুন দিগন্ত খুলেছে। হোটেল, রিসোর্ট, রেস্টুরেন্ট, ও স্থানীয় পণ্যের ব্যবসা এখন কোটি টাকার শিল্প। কিন্তু পর্যটনের এই আশীর্বাদ সঙ্গে করে এনেছে এক অদৃশ্য অভিশাপও।
সমুদ্রতটে বর্জ্যের স্তূপ, প্লাস্টিকের বোতল, অপরিকল্পিত নির্মাণ, এবং শব্দদূষণ কক্সবাজারের পরিবেশকে ধীরে ধীরে গ্রাস করছে। অনেক স্থানে সৈকতের প্রাকৃতিক গঠন নষ্ট হচ্ছে, কচ্ছপ ও অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণীর প্রজনন ব্যাহত হচ্ছে। যেভাবে অগোছালোভাবে হোটেল-রিসোর্ট গড়ে উঠছে, তাতে মনে হয় আমরা সৌন্দর্য সংরক্ষণের চেয়ে লাভের দৌড়ে নেমেছি।
কক্সবাজার এখন উন্নয়নের এক উত্তাল সময় পার করছে। আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, মেরিন ড্রাইভ, গভীর সমুদ্রবন্দর, ও পর্যটন নগর প্রকল্প এগুলো এই অঞ্চলকে অর্থনৈতিকভাবে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারে। টেকনাফ থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রাস্তা আজ আধুনিক, বিদ্যুৎ ও যোগাযোগ ব্যবস্থাও দ্রুত বদলে যাচ্ছে।
তবে উন্নয়নের এই ঢেউয়ের পেছনে রয়েছে প্রশ্ন ,আমরা কি প্রকৃতিকে এই গতির সঙ্গে তাল মেলাতে দিচ্ছি? অপরিকল্পিত উন্নয়ন প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট করছে; পাহাড় কাটা, বন ধ্বংস, ও উপকূলীয় জীববৈচিত্র?্যরে ক্ষতি এখনই চোখে পড়ছে। কক্সবাজার যদি শুধু কংক্রিটের শহরে পরিণত হয়, তাহলে হারিয়ে যাবে সেই নীলের শান্তি, যার জন্য মানুষ এখানে আসে।
কক্সবাজারকে রক্ষা করতে হলে দরকার টেকসই উন্নয়নের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, সমুদ্রদূষণ নিয়ন্ত্রণ, বন ও পাহাড় সংরক্ষণ এসবকে গুরুত্ব দিতে হবে নীতিনির্ধারণে। একই সঙ্গে পর্যটকদের মধ্যেও সচেতনতা বাড়ানো জরুরি।
“দায়িত্বশীল পর্যটন” এই ধারণাটিকে কেবল কথায় নয়, কাজে রূপ দিতে হবে। স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করতে হবে উন্নয়নের মূল ধারায়, যেন তারাও প্রকৃতি সংরক্ষণের অংশ হতে পারে।
এই সমুদ্রের প্রতিটি ঢেউ যেন আমাদের শেখায় যতই উন্নয়ন হোক, প্রকৃতির হাসি টিকিয়ে রাখাই সবচেয়ে বড় অর্জন।
কক্সবাজার কেবল একটি ভ্রমণস্থান নয়, এটি এক অনুভূতির নাম। এখানে এসে মানুষ মুক্তির স্বাদ পায়, জীবনের ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলতে পারে। তাই কক্সবাজারকে রক্ষা করা মানে আমাদের আত্মপরিচয়কে রক্ষা করা।
সুরাইয়া বিনতে হাসান