মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন
বাংলাদেশের অর্থনীতির গভীর শিকড়ে যে শক্তি বহু দশক ধরে নীরবে অপেক্ষা করছিল, আজ তা নতুন করে জেগে উঠছে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের পুনর্জাগরণে। দেশের হাজারো গ্রামীণ বাড়ির আঙিনা, মাটির চুলার পাশের ছোট্ট কর্মশালা, বাঁশ-নকশার ঝুড়ি বানানো অভিজ্ঞ হাত, কিংবা স্বনির্ভর হয়ে ওঠার স্বপ্ন বুকে নিয়ে এগিয়ে চলা নারীর অনড় দৃঢ়তা সবকিছু মিলেই এখন তৈরি হচ্ছে এক নতুন অর্থনৈতিক স্রোত। একসময় ঘরোয়া চাহিদা মেটাতেই সীমাবদ্ধ থাকা এই শিল্প এখন স্থানীয় বাজার ছাড়িয়ে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক অর্থনীতির ‘ভ্যালুচেইন’-এ শক্ত অবস্থান তৈরি করতে শুরু করেছে। মানুষের রুচি বদলেছে, দেশীয় পণ্যের প্রতি আস্থা বেড়েছে, আর বাড়ছে ‘নিজস্ব’ সাংস্কৃতিক পরিচয়ের প্রতি গর্ব এই তিন শক্তিই আজ পুনরুজ্জীবনকে আরও ত্বরান্বিত করছে।
এই পুনর্জাগরণের পেছনে আছে এক সুস্পষ্ট পরিবর্তন প্রযুক্তির বিস্তার ও ডিজিটাল যোগাযোগ। মোবাইল ফোনে ছবি তুলে অনলাইন পেজে পোস্ট করা থেকে শুরু করে অনলাইন পেমেন্ট, হোম ডেলিভারি, ডিজিটাল মার্কেটিং সবকিছু মিলে ছোট উদ্যোক্তাদের জীবনে তৈরি হয়েছে নতুন দিগন্ত। আগে যেখানে বাজার সীমাবদ্ধ ছিল কোনো একটি হাট বা এলাকার মধ্যে, সেখানে এখন একজন কারিগরের তৈরি পণ্য দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে পৌঁছে যাচ্ছে। এভাবে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে যুক্ত হচ্ছেন নতুন প্রজন্মের তরুণ-তরুণীরা; তারা ঐতিহ্যবাহী নৈপুণ্যকে আধুনিক বাজারের সঙ্গে মিলিয়ে দিচ্ছেন সৃজনশীল নতুনত্বের স্পর্শে।
হাতে তৈরি শাড়ি, নকশিকাঁথা, মাটির পণ্য, কাঠের কারুকাজ, বেত-পাতার নৈপুণ্য, ঘরোয়া খাদ্যপণ্য এসব পণ্য শুধু একটি অর্থনৈতিক উৎপাদন নয়; এগুলো আমাদের সংস্কৃতি, পরিচয় ও ঐতিহ্যের অংশ। তাই এই শিল্পের পুনর্জাগরণ মানে কেবল কর্মসংস্থান বৃদ্ধি নয়, বরং সাংস্কৃতিক জাগরণেরও এক নতুন অধ্যায়। অর্থনীতিবিদদের মতে, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প বর্তমানে দেশের অন্যতম বৃহৎ কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র বিশেষ করে নারীর অংশগ্রহণের হার এই খাতে অনেক বেশি। এতে পরিবারের আয় বাড়ে, নারীর সামাজিক মর্যাদা শক্ত হয়, এবং গ্রামীণ অর্থনীতিতে টেকসই উন্নয়নের ভিত্তি তৈরি হয়।
কৃষি নির্ভর গ্রামে যেখানে কাজ প্রায়ই মৌসুমি, সেখানে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সারা বছর আয়-রোজগারের সুযোগ তৈরি করে। অনেক পরিবারের জন্য এটি হয়ে উঠেছে প্রধান আয়ের উৎস। কম পুঁজি, কম ঝুঁকি, সহজ কাঁচামাল প্রাপ্যতা এসব কারণে ছোট পরিসরে শুরু করেও বড় স্বপ্ন দেখা যায়, বড় অর্জন করা যায়। একসময় যারা নিজের প্রতিভা বা দক্ষতাকে শুধুই ‘শখ’ হিসেবে দেখতেন, আজ তারা নিজেদেরকে পরিচয় দিচ্ছেন উদ্যোক্তা হিসেবে।
তবে উন্নতির এই পথে কিছু প্রতিবন্ধকতাও আছে। কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়া, বাজারে প্রতিযোগিতা, মান নিয়ন্ত্রণের অভাব, ব্র্যান্ডিং বিষয়ে অজ্ঞতা, এবং পুঁজির সীমাবদ্ধতা সবই বড় চ্যালেঞ্জ। অনেক উদ্যোক্তা প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ বা বাজারজাতকরণ কৌশলের অভাবে ব্যবসা বড় করতে পারেন না। আবার গ্রামীণ কোনো কারিগর তার শ্রমের ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় নিরুৎসাহিত হন। তাই এখন প্রয়োজন একটি আরও শক্তিশালী সমর্থন কাঠামো যেখানে থাকবে সহজ ঋণ, ডিজিটাল প্রশিক্ষণ, সরকারি সহায়তা, ন্যায্য মূল্য নিশ্চিতকরণ এবং আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ।
তবে এসব চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও সত্য একটাই ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের শক্তি থামিয়ে রাখা যায় না। এই শিল্প মানুষের হাতে হাতে সৃষ্টি হয়, মানুষের স্বপ্নে রঙ পায়, আর মানুষের জীবনযাত্রার সঙ্গে গভীরভাবে মিশে যায়। তাই এর বৃদ্ধি মানে শুধু এউচ বাড়া নয়, বরং মানুষের জীবনে আস্থা, আত্মসম্মান এবং পরিবর্তনের উৎস তৈরি হওয়া। এই শিল্প আমাদের শেখায় একটি ছোট উদ্যোগও বড় প্রভাব ফেলতে পারে, একটি কারিগরের হাতে তৈরি পণ্যও দেশের অর্থনৈতিক অভ্যুত্থানের অংশ হতে পারে।
আজ জাতির অর্থনীতির ভেতরে জন্ম নিচ্ছে এক নীরব কিন্তু শক্তিশালী বিপ্লব যেখানে প্রতিটি সুঁই-সুতো, প্রতিটি বতের বাঁক, প্রতিটি মাটির শিল্পকর্ম আর প্রতিটি ঘরোয়া খাদ্যপণ্য এ দেশকে নিয়ে যাচ্ছে এক নতুন পথের দিকে। স্বনির্ভরতার পথ, সাংস্কৃতিক গৌরবের পথ, এবং টেকসই অর্থনৈতিক সম্ভাবনার পথ যার কেন্দ্রে রয়েছে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের মানুষেরা। তাদের হাতেই গড়ে উঠছে বাংলাদেশের আগামী দিনের সৃজনশীল, মানবিক ও শক্তিশালী অর্থনীতি।
তহমিনা ইয়াসমিন
নৃবিজ্ঞান বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন
শুক্রবার, ২৮ নভেম্বর ২০২৫
বাংলাদেশের অর্থনীতির গভীর শিকড়ে যে শক্তি বহু দশক ধরে নীরবে অপেক্ষা করছিল, আজ তা নতুন করে জেগে উঠছে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের পুনর্জাগরণে। দেশের হাজারো গ্রামীণ বাড়ির আঙিনা, মাটির চুলার পাশের ছোট্ট কর্মশালা, বাঁশ-নকশার ঝুড়ি বানানো অভিজ্ঞ হাত, কিংবা স্বনির্ভর হয়ে ওঠার স্বপ্ন বুকে নিয়ে এগিয়ে চলা নারীর অনড় দৃঢ়তা সবকিছু মিলেই এখন তৈরি হচ্ছে এক নতুন অর্থনৈতিক স্রোত। একসময় ঘরোয়া চাহিদা মেটাতেই সীমাবদ্ধ থাকা এই শিল্প এখন স্থানীয় বাজার ছাড়িয়ে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক অর্থনীতির ‘ভ্যালুচেইন’-এ শক্ত অবস্থান তৈরি করতে শুরু করেছে। মানুষের রুচি বদলেছে, দেশীয় পণ্যের প্রতি আস্থা বেড়েছে, আর বাড়ছে ‘নিজস্ব’ সাংস্কৃতিক পরিচয়ের প্রতি গর্ব এই তিন শক্তিই আজ পুনরুজ্জীবনকে আরও ত্বরান্বিত করছে।
এই পুনর্জাগরণের পেছনে আছে এক সুস্পষ্ট পরিবর্তন প্রযুক্তির বিস্তার ও ডিজিটাল যোগাযোগ। মোবাইল ফোনে ছবি তুলে অনলাইন পেজে পোস্ট করা থেকে শুরু করে অনলাইন পেমেন্ট, হোম ডেলিভারি, ডিজিটাল মার্কেটিং সবকিছু মিলে ছোট উদ্যোক্তাদের জীবনে তৈরি হয়েছে নতুন দিগন্ত। আগে যেখানে বাজার সীমাবদ্ধ ছিল কোনো একটি হাট বা এলাকার মধ্যে, সেখানে এখন একজন কারিগরের তৈরি পণ্য দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে পৌঁছে যাচ্ছে। এভাবে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে যুক্ত হচ্ছেন নতুন প্রজন্মের তরুণ-তরুণীরা; তারা ঐতিহ্যবাহী নৈপুণ্যকে আধুনিক বাজারের সঙ্গে মিলিয়ে দিচ্ছেন সৃজনশীল নতুনত্বের স্পর্শে।
হাতে তৈরি শাড়ি, নকশিকাঁথা, মাটির পণ্য, কাঠের কারুকাজ, বেত-পাতার নৈপুণ্য, ঘরোয়া খাদ্যপণ্য এসব পণ্য শুধু একটি অর্থনৈতিক উৎপাদন নয়; এগুলো আমাদের সংস্কৃতি, পরিচয় ও ঐতিহ্যের অংশ। তাই এই শিল্পের পুনর্জাগরণ মানে কেবল কর্মসংস্থান বৃদ্ধি নয়, বরং সাংস্কৃতিক জাগরণেরও এক নতুন অধ্যায়। অর্থনীতিবিদদের মতে, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প বর্তমানে দেশের অন্যতম বৃহৎ কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র বিশেষ করে নারীর অংশগ্রহণের হার এই খাতে অনেক বেশি। এতে পরিবারের আয় বাড়ে, নারীর সামাজিক মর্যাদা শক্ত হয়, এবং গ্রামীণ অর্থনীতিতে টেকসই উন্নয়নের ভিত্তি তৈরি হয়।
কৃষি নির্ভর গ্রামে যেখানে কাজ প্রায়ই মৌসুমি, সেখানে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সারা বছর আয়-রোজগারের সুযোগ তৈরি করে। অনেক পরিবারের জন্য এটি হয়ে উঠেছে প্রধান আয়ের উৎস। কম পুঁজি, কম ঝুঁকি, সহজ কাঁচামাল প্রাপ্যতা এসব কারণে ছোট পরিসরে শুরু করেও বড় স্বপ্ন দেখা যায়, বড় অর্জন করা যায়। একসময় যারা নিজের প্রতিভা বা দক্ষতাকে শুধুই ‘শখ’ হিসেবে দেখতেন, আজ তারা নিজেদেরকে পরিচয় দিচ্ছেন উদ্যোক্তা হিসেবে।
তবে উন্নতির এই পথে কিছু প্রতিবন্ধকতাও আছে। কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়া, বাজারে প্রতিযোগিতা, মান নিয়ন্ত্রণের অভাব, ব্র্যান্ডিং বিষয়ে অজ্ঞতা, এবং পুঁজির সীমাবদ্ধতা সবই বড় চ্যালেঞ্জ। অনেক উদ্যোক্তা প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ বা বাজারজাতকরণ কৌশলের অভাবে ব্যবসা বড় করতে পারেন না। আবার গ্রামীণ কোনো কারিগর তার শ্রমের ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় নিরুৎসাহিত হন। তাই এখন প্রয়োজন একটি আরও শক্তিশালী সমর্থন কাঠামো যেখানে থাকবে সহজ ঋণ, ডিজিটাল প্রশিক্ষণ, সরকারি সহায়তা, ন্যায্য মূল্য নিশ্চিতকরণ এবং আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ।
তবে এসব চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও সত্য একটাই ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের শক্তি থামিয়ে রাখা যায় না। এই শিল্প মানুষের হাতে হাতে সৃষ্টি হয়, মানুষের স্বপ্নে রঙ পায়, আর মানুষের জীবনযাত্রার সঙ্গে গভীরভাবে মিশে যায়। তাই এর বৃদ্ধি মানে শুধু এউচ বাড়া নয়, বরং মানুষের জীবনে আস্থা, আত্মসম্মান এবং পরিবর্তনের উৎস তৈরি হওয়া। এই শিল্প আমাদের শেখায় একটি ছোট উদ্যোগও বড় প্রভাব ফেলতে পারে, একটি কারিগরের হাতে তৈরি পণ্যও দেশের অর্থনৈতিক অভ্যুত্থানের অংশ হতে পারে।
আজ জাতির অর্থনীতির ভেতরে জন্ম নিচ্ছে এক নীরব কিন্তু শক্তিশালী বিপ্লব যেখানে প্রতিটি সুঁই-সুতো, প্রতিটি বতের বাঁক, প্রতিটি মাটির শিল্পকর্ম আর প্রতিটি ঘরোয়া খাদ্যপণ্য এ দেশকে নিয়ে যাচ্ছে এক নতুন পথের দিকে। স্বনির্ভরতার পথ, সাংস্কৃতিক গৌরবের পথ, এবং টেকসই অর্থনৈতিক সম্ভাবনার পথ যার কেন্দ্রে রয়েছে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের মানুষেরা। তাদের হাতেই গড়ে উঠছে বাংলাদেশের আগামী দিনের সৃজনশীল, মানবিক ও শক্তিশালী অর্থনীতি।
তহমিনা ইয়াসমিন
নৃবিজ্ঞান বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়