alt

মতামত » চিঠিপত্র

মেধা হারাচ্ছে দেশ

: শনিবার, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৫

মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন

বাংলাদেশের তরুণ সমাজ আজ ক্রমশ বিদেশমুখী হচ্ছে। একসময় বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ মানে ছিল জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অর্জন করে দেশে ফিরে কাজ করা, কিন্তু এখন সেটি পরিণত হয়েছে স্থায়ীভাবে প্রবাসে চলে যাওয়ার প্রবণতায়। দেশের সবচেয়ে মেধাবী ও যোগ্য তরুণরা বিদেশে পড়াশোনা শেষে আর ফিরে আসছে না। তারা থেকে যাচ্ছে উন্নত সুযোগ-সুবিধার দেশে। এ যেন এক নীরব মেধা-পলায়ন, যা দেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়ন ও সম্ভাবনাকে ধীরে ধীরে ক্ষয় করছে।

মেধা হারানোর এই প্রবণতার পেছনে রয়েছে একাধিক কারণ। প্রথমত, দেশে মানসম্মত শিক্ষা ও গবেষণার সুযোগ এখনো সীমিত। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে আধুনিক ল্যাব, গবেষণা তহবিল এবং আন্তর্জাতিক মানের একাডেমিক পরিবেশের অভাব রয়েছে। যে তরুণরা গবেষণা বা উদ্ভাবনে আগ্রহী, তারা উন্নত পরিকাঠামো ও স্বাধীন চিন্তার পরিবেশের খোঁজে বিদেশে চলে যায়। দ্বিতীয়ত, দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগও সীমিত। অনেক সময় যোগ্যতার সঙ্গে বেতনের সামঞ্জস্য থাকে না, আবার প্রশাসনিক জটিলতা ও দুর্নীতির কারণে তরুণরা প্রাপ্য সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। ফলে তারা এমন দেশে যেতে চায়, যেখানে যোগ্যতার মূল্যায়ন হয় এবং শ্রমের যথাযথ প্রতিদান মেলে।

এর পাশাপাশি দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, আইনের দুর্বল শাসন ও সামাজিক অনিরাপত্তাও মেধাবীদের নিরুৎসাহিত করছে। একজন তরুণ যখন দেখে যে পরিশ্রম বা দক্ষতার চেয়ে দলীয় পরিচয় বা সম্পর্কই সাফল্যের পথ, তখন তার মনে দেশে থাকার আগ্রহ কমে যায়। তাছাড়া উন্নত দেশগুলোতে স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, পরিবেশ ও জীবনের মান তুলনামূলক ভালো যা পরিবার ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য অধিক নিরাপদ বলে মনে হয়। তাই অনেকে নিজেদের সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেও বিদেশে স্থায়ী হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

এই মেধা-পলায়নের প্রভাব জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে গভীরভাবে পড়ছে। প্রশাসন, শিক্ষা, গবেষণা ও প্রযুক্তি খাতে দক্ষ জনবলের ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। যারা বিদেশে থেকে সফলভাবে কাজ করছে, তাদের উদ্ভাবনী শক্তি, নেতৃত্ব ও উদ্যোগী মনোভাব দেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে পারছে না। ফলে দেশ এক ধরনের “innovation gap”-এর মুখোমুখি হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যোগ্য শিক্ষক ও গবেষকের অভাব শিক্ষার মানকে আরও নিচে নামিয়ে দিচ্ছে। একইসঙ্গে যারা দেশে থেকে সংগ্রাম করছে, তারা দেখছে যে এখানে যোগ্যতার চেয়ে সম্পর্ক ও তোষণই বেশি গুরুত্ব পায়। এতে হতাশা ও বঞ্চনার অনুভূতি বাড়ছে, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যেও দেশপ্রেম ও আত্মবিশ্বাস ক্ষয়ে দিচ্ছে।

তবে এখনই যদি বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়া যায়, এই প্রবণতাকে অনেকটা রোধ করা সম্ভব। প্রথমেই প্রয়োজন মানসম্মত শিক্ষা ও গবেষণায় বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাঠ্যক্রমকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করতে হবে এবং গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত তহবিল ও প্রযুক্তিগত সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। একইসঙ্গে কর্মসংস্থানের পরিধি বাড়াতে হবে, বেসরকারি ও সরকারি খাতে মেধা অনুযায়ী বেতন কাঠামো ও পদোন্নতির স্বচ্ছ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত প্রশাসন ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুললে তরুণরা নিজেদের যোগ্যতার যথাযথ মূল্যায়ন দেখতে পাবে, যা তাদের দেশে রাখার অনুপ্রেরণা জোগাবে।

এ ছাড়া বিদেশে থাকা মেধাবীদের দেশে ফেরার জন্যও কার্যকর নীতি নেওয়া যেতে পারে। যারা বিদেশে পড়াশোনা বা কাজ করে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে, তাদের গবেষণা, নীতিনির্ধারণ বা শিক্ষা খাতে যুক্ত করার সুযোগ দিতে হবে। অনেক দেশ “Reverse Brain Drain” নীতি গ্রহণ করে সফল হয়েছে বাংলাদেশও তা অনুসরণ করতে পারে।

সবশেষে বলা যায়, একটি দেশের আসল সম্পদ হলো তার মানুষ, বিশেষ করে মেধাবী মানুষ। যদি সেই মেধা অন্য দেশে চলে যায়, তাহলে উন্নয়নের ভিত দুর্বল হয়ে পড়ে। বাংলাদেশকে সেই মেধা ধরে রাখতে হলে প্রয়োজন সুযোগ, সুশাসন ও সম্মান। তরুণদের এমন পরিবেশ দিতে হবে, যেখানে তারা বিশ্বাস করবে যে এখানেই তাদের স্বপ্ন পূরণ সম্ভব। কারণ, উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন পূরণ হবে তখনই, যখন দেশের মেধা, শ্রম ও ভালোবাসা এই মাটিতেই বিকশিত হবে।

সাদিয়া সুলতানা রিমি

শিক্ষার্থী, গণিত বিভাগ

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় : অযৌক্তিক ফি, সেশনজট ও প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলায় বিপর্যস্ত শিক্ষার্থী

সামাজিক মাধ্যমের ভুবনে জনতুষ্টিবাদের নতুন রূপ

ভেজাল খেজুরগুড় ও স্বাস্থ্যঝুঁকি

হাসপাতাল ব্যবস্থাপনায় প্রশাসনিক ক্যাডারের প্রয়োজনীয়তা

প্লাস্টিক বর্জ্যে মাছের মৃত্যু: সমাধান কোথায়

খোলা ম্যানহোল: ঢাকার রাজপথে এক নীরব মরণফাঁদ

গণপরিবহন: প্রতিদিনের যন্ত্রণার শেষ কবে?

ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের পুনর্জাগরণ

সাইবার বুলিং ও ভার্চুয়াল অপরাধ: তরুণদের অদৃশ্য বিপদ

ওয়াসার খোঁড়াখুঁড়িতে নগরজীবনের চরম ভোগান্তি

রাবি মেডিকেল সেন্টারের সংস্কার চাই

চিংড়ি শিল্পের পরিবেশগত প্রভাব

কক্সবাজার: উন্নয়নের পথে, বিপন্ন প্রকৃতি

চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রেক্ষাপটে নতুন সম্ভাবনার ভোর

প্রাথমিক শিক্ষকদের বঞ্চনা দূর না হলে মানোন্নয়ন অসম্ভব

রাবির আবাসন সংকট

সব হাসপাতালে ফিজিক্যাল মেডিসিন ও রিহ্যাবিলিটেশন সেবা চালু করা হোক

ডেঙ্গু মোকাবিলায় সচেতনতা

পানি সংকট: জীবন ও সভ্যতার জন্য বিরাট হুমকি

ই-লার্নিং: সীমান্তহীন শিক্ষার নতুন দিগন্ত

আজিমপুর কলোনির অব্যবস্থাপনা

জনস্বাস্থ্যের নীরব ঘাতক : তামাকজাত পণ্য

বিশ্ব র‌্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়: অবস্থান, চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

ইন্দো-প্যাসিফিক রাজনীতি ও বাংলাদেশের সমুদ্রকৌশল

বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট: দীর্ঘসূত্রতা ও ভোগান্তির শেষ কোথায়?

পুরান ঢাকার রাস্তাগুলোর বেহাল অবস্থা

নিরাপদ শিশু খাদ্য: জাতির ভবিষ্যতের প্রশ্ন

ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয়: প্রতিদিনের দুঃস্বপ্ন

পানি ও খাদ্য নিরাপত্তা

হেমন্ত আসে হিম কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়ে

জীবনের অভিধানে প্রবীণদের স্থান কোথায়?

নীরবতা নয়, বলতে শেখ

সুন্দরবনে টেকসই পর্যটন মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়নের সম্ভাবনা ও করণীয়

প্রথার নামে প্রথাগত শোষণ: উচ্চ কাবিনের ফাঁদ

শিক্ষা ব্যবস্থা পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা

মধ্যবিত্তের সঞ্চয়ে বিশ্ব অর্থনৈতিক জায়ান্টদের মাস্টার প্ল্যান

tab

মতামত » চিঠিপত্র

মেধা হারাচ্ছে দেশ

মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন

শনিবার, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৫

বাংলাদেশের তরুণ সমাজ আজ ক্রমশ বিদেশমুখী হচ্ছে। একসময় বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ মানে ছিল জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অর্জন করে দেশে ফিরে কাজ করা, কিন্তু এখন সেটি পরিণত হয়েছে স্থায়ীভাবে প্রবাসে চলে যাওয়ার প্রবণতায়। দেশের সবচেয়ে মেধাবী ও যোগ্য তরুণরা বিদেশে পড়াশোনা শেষে আর ফিরে আসছে না। তারা থেকে যাচ্ছে উন্নত সুযোগ-সুবিধার দেশে। এ যেন এক নীরব মেধা-পলায়ন, যা দেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়ন ও সম্ভাবনাকে ধীরে ধীরে ক্ষয় করছে।

মেধা হারানোর এই প্রবণতার পেছনে রয়েছে একাধিক কারণ। প্রথমত, দেশে মানসম্মত শিক্ষা ও গবেষণার সুযোগ এখনো সীমিত। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে আধুনিক ল্যাব, গবেষণা তহবিল এবং আন্তর্জাতিক মানের একাডেমিক পরিবেশের অভাব রয়েছে। যে তরুণরা গবেষণা বা উদ্ভাবনে আগ্রহী, তারা উন্নত পরিকাঠামো ও স্বাধীন চিন্তার পরিবেশের খোঁজে বিদেশে চলে যায়। দ্বিতীয়ত, দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগও সীমিত। অনেক সময় যোগ্যতার সঙ্গে বেতনের সামঞ্জস্য থাকে না, আবার প্রশাসনিক জটিলতা ও দুর্নীতির কারণে তরুণরা প্রাপ্য সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। ফলে তারা এমন দেশে যেতে চায়, যেখানে যোগ্যতার মূল্যায়ন হয় এবং শ্রমের যথাযথ প্রতিদান মেলে।

এর পাশাপাশি দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, আইনের দুর্বল শাসন ও সামাজিক অনিরাপত্তাও মেধাবীদের নিরুৎসাহিত করছে। একজন তরুণ যখন দেখে যে পরিশ্রম বা দক্ষতার চেয়ে দলীয় পরিচয় বা সম্পর্কই সাফল্যের পথ, তখন তার মনে দেশে থাকার আগ্রহ কমে যায়। তাছাড়া উন্নত দেশগুলোতে স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, পরিবেশ ও জীবনের মান তুলনামূলক ভালো যা পরিবার ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য অধিক নিরাপদ বলে মনে হয়। তাই অনেকে নিজেদের সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেও বিদেশে স্থায়ী হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

এই মেধা-পলায়নের প্রভাব জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে গভীরভাবে পড়ছে। প্রশাসন, শিক্ষা, গবেষণা ও প্রযুক্তি খাতে দক্ষ জনবলের ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। যারা বিদেশে থেকে সফলভাবে কাজ করছে, তাদের উদ্ভাবনী শক্তি, নেতৃত্ব ও উদ্যোগী মনোভাব দেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে পারছে না। ফলে দেশ এক ধরনের “innovation gap”-এর মুখোমুখি হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যোগ্য শিক্ষক ও গবেষকের অভাব শিক্ষার মানকে আরও নিচে নামিয়ে দিচ্ছে। একইসঙ্গে যারা দেশে থেকে সংগ্রাম করছে, তারা দেখছে যে এখানে যোগ্যতার চেয়ে সম্পর্ক ও তোষণই বেশি গুরুত্ব পায়। এতে হতাশা ও বঞ্চনার অনুভূতি বাড়ছে, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যেও দেশপ্রেম ও আত্মবিশ্বাস ক্ষয়ে দিচ্ছে।

তবে এখনই যদি বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়া যায়, এই প্রবণতাকে অনেকটা রোধ করা সম্ভব। প্রথমেই প্রয়োজন মানসম্মত শিক্ষা ও গবেষণায় বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাঠ্যক্রমকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করতে হবে এবং গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত তহবিল ও প্রযুক্তিগত সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। একইসঙ্গে কর্মসংস্থানের পরিধি বাড়াতে হবে, বেসরকারি ও সরকারি খাতে মেধা অনুযায়ী বেতন কাঠামো ও পদোন্নতির স্বচ্ছ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত প্রশাসন ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুললে তরুণরা নিজেদের যোগ্যতার যথাযথ মূল্যায়ন দেখতে পাবে, যা তাদের দেশে রাখার অনুপ্রেরণা জোগাবে।

এ ছাড়া বিদেশে থাকা মেধাবীদের দেশে ফেরার জন্যও কার্যকর নীতি নেওয়া যেতে পারে। যারা বিদেশে পড়াশোনা বা কাজ করে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে, তাদের গবেষণা, নীতিনির্ধারণ বা শিক্ষা খাতে যুক্ত করার সুযোগ দিতে হবে। অনেক দেশ “Reverse Brain Drain” নীতি গ্রহণ করে সফল হয়েছে বাংলাদেশও তা অনুসরণ করতে পারে।

সবশেষে বলা যায়, একটি দেশের আসল সম্পদ হলো তার মানুষ, বিশেষ করে মেধাবী মানুষ। যদি সেই মেধা অন্য দেশে চলে যায়, তাহলে উন্নয়নের ভিত দুর্বল হয়ে পড়ে। বাংলাদেশকে সেই মেধা ধরে রাখতে হলে প্রয়োজন সুযোগ, সুশাসন ও সম্মান। তরুণদের এমন পরিবেশ দিতে হবে, যেখানে তারা বিশ্বাস করবে যে এখানেই তাদের স্বপ্ন পূরণ সম্ভব। কারণ, উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন পূরণ হবে তখনই, যখন দেশের মেধা, শ্রম ও ভালোবাসা এই মাটিতেই বিকশিত হবে।

সাদিয়া সুলতানা রিমি

শিক্ষার্থী, গণিত বিভাগ

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

back to top