মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন
শারীরিক সামর্থ্য কমে যাওয়া, বয়সের ভারে দেহে স্পষ্ট পরিবর্তন দেখা দেওয়া-এসবই মানুষের স্বাভাবিক জীবনচক্রের অংশ। বার্ধক্যজনিত সীমাবদ্ধতায় অনেক প্রবীণ মানুষের চলাফেরা ও কর্মক্ষমতা সংকুচিত হয়। অথচ তাঁরাই একসময় পরিবারকে আগলে রেখেছেন, সমাজ–রাষ্ট্রের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন। যাঁরা অতীতে শিশুদের মানুষ করেছেন, শিক্ষার পথ দেখিয়েছেন, চিকিৎসা–ভরণপোষণের দায়িত্ব নিয়েছেন, আজ তাঁরা অনেকটাই আমাদের অগোচরে। প্রবীণদের প্রাত্যহিক জীবন, তাঁদের ভাবনা, আকাক্সক্ষা-এসব বিষয়ে জানতে বা ভাবতে আমাদের অনাগ্রহই বেশি দেখা যায়। ফলে তাঁদের চিকিৎসা, সেবা শুশ্রূষা
ও মানসিক চাহিদা প্রায়ই উপেক্ষিত থেকে যায়।
বিশ্বব্যাপী পরিসংখ্যান বলছে, প্রতি দশজন মানুষের একজন প্রবীণ-অর্থাৎ ৬০ বছর বা তার বেশি বয়সী। ধারণা করা হচ্ছে, ২০৫০ সালে প্রতি পাঁচজনের একজন এবং ২১৫০ সালে প্রতি তিনজনের একজন প্রবীণ হবেন। এই সংখ্যা কেবল জনমিতিক পরিবর্তনই দেখায় না, বরং ভবিষ্যতের একটি বাস্তব সংকটের ইঙ্গিতও বহন করে-অগণিত প্রবীণ মানুষকে সেবা দেওয়ার মতো সক্ষম কর্মক্ষম জনসংখ্যা কি তখন পর্যাপ্ত থাকবে? আগামী প্রজন্মের প্রবীণ–বান্ধব মনোভাব ও বার্ধক্যকে মর্যাদার সঙ্গে গ্রহণ করার মানসিকতাই এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখবে। সে কারণেই এখনকার তরুণদের নিজেদের ভবিষ্যৎ বিবেচনায় হোক কিংবা নৈতিক দায়িত্ববোধ থেকে হোক, প্রবীণদের প্রতি মনোযোগী হওয়া জরুরি।
১৯২৫ সালে উপমহাদেশে সরকারী কর্মচারীদের জন্য পেনশন সুবিধা শুরু হলেও সমাজের অধিকাংশ প্রবীণ আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে থেকে যান। অনেকেই ভিক্ষাবৃত্তিতে নামেন, কেউ অবহেলা ও কটাক্ষের শিকার হয়ে জীবন কাটান, কেউ প্রতারণায় নিঃস্ব হন। বহু বছর পর ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশে বয়স্কভাতা চালু হলেও বিশাল প্রবীণ জনগোষ্ঠীর অনেকেই এ সুবিধার বাইরে রয়ে গেছেন। অন্যদিকে, আত্মমর্যাদাবোধের কারণে অনেক প্রবীণ সরকারি অনুদান গ্রহণ করতেও চান না। তাছাড়া রাষ্ট্রীয়ভাবে সব প্রবীণকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া বাস্তবসম্মত নয়। তাই পরিবারের সামর্থ্যবান সদস্যদের দায়িত্ববোধই প্রবীণদের প্রধান ভরসা-তাঁদের চিকিৎসা, প্রয়োজনীয় সুবিধা ও আর্থিক নিরাপত্তার দায়িত্ব পরিবারের সদস্যদেরই নিতে হবে। আর পরিবারে সামর্থ্য না থাকলে সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে।
প্রবীণ জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে সামাজিক সংহতি ও স্থানীয় সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন সংস্থার সহযোগিতা জোরদার করা প্রয়োজন। অতি দরিদ্র প্রবীণদের জন্য বিশেষ ঋণ সুবিধা, উপযোগী প্রশিক্ষণ, প্রবীণ–বান্ধব সামাজিক কেন্দ্র, নিয়মিত স্বাস্থ্যসেবা ও ফিজিওথেরাপি–সহায়তা প্রদান করা যেতে পারে। প্রবীণদের প্রতি দায়িত্ববোধ উৎসাহিত করতে প্রবীণদের সেবা–শুশ্রূষাকারী সন্তানদের ‘শ্রেষ্ঠ সন্তান সম্মাননা’ এবং সমাজ–রাষ্ট্রে আজীবন অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে যোগ্য প্রবীণদের ‘শ্রেষ্ঠ প্রবীণ সম্মাননা’ দেওয়া যেতে পারে। অসচ্ছল প্রবীণদের জন্য পরিপোষক–ভাতা, আর অপেক্ষাকৃত সচ্ছলদের জন্য বিশেষ সঞ্চয় ও পেনশন–স্কিম চালুর বিষয়টিও বিবেচনা করা যেতে পারে।
একই সঙ্গে প্রবীণদের অধিকার ও মর্যাদা রক্ষায় রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বিশেষ গণসচেতনতা গড়ে তোলা জরুরি। ‘সকল বয়সের জন্য ডিজিটাল সমতা’ নিশ্চিত করা এখন আধুনিক সমাজের মূল শর্ত। প্রবীণদের দারিদ্রমুক্ত, মর্যাদাপূর্ণ, কর্মময় ও নিরাপদ পারিবারিক–সামাজিক জীবন নিশ্চিত না হলে একটি সমাজ কখনোই প্রকৃত অর্থে আধুনিক হতে পারে না।
যে সমাজ প্রবীণদের সম্মান করে, আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে-সেই সমাজই সত্যিকারের নবীন, নিরাপদ ও সমৃদ্ধ সমাজ।
শাহ নেওয়াজ
বন্দর, চট্টগ্রাম
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন
বুধবার, ১০ ডিসেম্বর ২০২৫
শারীরিক সামর্থ্য কমে যাওয়া, বয়সের ভারে দেহে স্পষ্ট পরিবর্তন দেখা দেওয়া-এসবই মানুষের স্বাভাবিক জীবনচক্রের অংশ। বার্ধক্যজনিত সীমাবদ্ধতায় অনেক প্রবীণ মানুষের চলাফেরা ও কর্মক্ষমতা সংকুচিত হয়। অথচ তাঁরাই একসময় পরিবারকে আগলে রেখেছেন, সমাজ–রাষ্ট্রের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন। যাঁরা অতীতে শিশুদের মানুষ করেছেন, শিক্ষার পথ দেখিয়েছেন, চিকিৎসা–ভরণপোষণের দায়িত্ব নিয়েছেন, আজ তাঁরা অনেকটাই আমাদের অগোচরে। প্রবীণদের প্রাত্যহিক জীবন, তাঁদের ভাবনা, আকাক্সক্ষা-এসব বিষয়ে জানতে বা ভাবতে আমাদের অনাগ্রহই বেশি দেখা যায়। ফলে তাঁদের চিকিৎসা, সেবা শুশ্রূষা
ও মানসিক চাহিদা প্রায়ই উপেক্ষিত থেকে যায়।
বিশ্বব্যাপী পরিসংখ্যান বলছে, প্রতি দশজন মানুষের একজন প্রবীণ-অর্থাৎ ৬০ বছর বা তার বেশি বয়সী। ধারণা করা হচ্ছে, ২০৫০ সালে প্রতি পাঁচজনের একজন এবং ২১৫০ সালে প্রতি তিনজনের একজন প্রবীণ হবেন। এই সংখ্যা কেবল জনমিতিক পরিবর্তনই দেখায় না, বরং ভবিষ্যতের একটি বাস্তব সংকটের ইঙ্গিতও বহন করে-অগণিত প্রবীণ মানুষকে সেবা দেওয়ার মতো সক্ষম কর্মক্ষম জনসংখ্যা কি তখন পর্যাপ্ত থাকবে? আগামী প্রজন্মের প্রবীণ–বান্ধব মনোভাব ও বার্ধক্যকে মর্যাদার সঙ্গে গ্রহণ করার মানসিকতাই এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখবে। সে কারণেই এখনকার তরুণদের নিজেদের ভবিষ্যৎ বিবেচনায় হোক কিংবা নৈতিক দায়িত্ববোধ থেকে হোক, প্রবীণদের প্রতি মনোযোগী হওয়া জরুরি।
১৯২৫ সালে উপমহাদেশে সরকারী কর্মচারীদের জন্য পেনশন সুবিধা শুরু হলেও সমাজের অধিকাংশ প্রবীণ আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে থেকে যান। অনেকেই ভিক্ষাবৃত্তিতে নামেন, কেউ অবহেলা ও কটাক্ষের শিকার হয়ে জীবন কাটান, কেউ প্রতারণায় নিঃস্ব হন। বহু বছর পর ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশে বয়স্কভাতা চালু হলেও বিশাল প্রবীণ জনগোষ্ঠীর অনেকেই এ সুবিধার বাইরে রয়ে গেছেন। অন্যদিকে, আত্মমর্যাদাবোধের কারণে অনেক প্রবীণ সরকারি অনুদান গ্রহণ করতেও চান না। তাছাড়া রাষ্ট্রীয়ভাবে সব প্রবীণকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া বাস্তবসম্মত নয়। তাই পরিবারের সামর্থ্যবান সদস্যদের দায়িত্ববোধই প্রবীণদের প্রধান ভরসা-তাঁদের চিকিৎসা, প্রয়োজনীয় সুবিধা ও আর্থিক নিরাপত্তার দায়িত্ব পরিবারের সদস্যদেরই নিতে হবে। আর পরিবারে সামর্থ্য না থাকলে সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে।
প্রবীণ জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে সামাজিক সংহতি ও স্থানীয় সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন সংস্থার সহযোগিতা জোরদার করা প্রয়োজন। অতি দরিদ্র প্রবীণদের জন্য বিশেষ ঋণ সুবিধা, উপযোগী প্রশিক্ষণ, প্রবীণ–বান্ধব সামাজিক কেন্দ্র, নিয়মিত স্বাস্থ্যসেবা ও ফিজিওথেরাপি–সহায়তা প্রদান করা যেতে পারে। প্রবীণদের প্রতি দায়িত্ববোধ উৎসাহিত করতে প্রবীণদের সেবা–শুশ্রূষাকারী সন্তানদের ‘শ্রেষ্ঠ সন্তান সম্মাননা’ এবং সমাজ–রাষ্ট্রে আজীবন অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে যোগ্য প্রবীণদের ‘শ্রেষ্ঠ প্রবীণ সম্মাননা’ দেওয়া যেতে পারে। অসচ্ছল প্রবীণদের জন্য পরিপোষক–ভাতা, আর অপেক্ষাকৃত সচ্ছলদের জন্য বিশেষ সঞ্চয় ও পেনশন–স্কিম চালুর বিষয়টিও বিবেচনা করা যেতে পারে।
একই সঙ্গে প্রবীণদের অধিকার ও মর্যাদা রক্ষায় রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বিশেষ গণসচেতনতা গড়ে তোলা জরুরি। ‘সকল বয়সের জন্য ডিজিটাল সমতা’ নিশ্চিত করা এখন আধুনিক সমাজের মূল শর্ত। প্রবীণদের দারিদ্রমুক্ত, মর্যাদাপূর্ণ, কর্মময় ও নিরাপদ পারিবারিক–সামাজিক জীবন নিশ্চিত না হলে একটি সমাজ কখনোই প্রকৃত অর্থে আধুনিক হতে পারে না।
যে সমাজ প্রবীণদের সম্মান করে, আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে-সেই সমাজই সত্যিকারের নবীন, নিরাপদ ও সমৃদ্ধ সমাজ।
শাহ নেওয়াজ
বন্দর, চট্টগ্রাম