মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন
বর্তমান বিশ্ব প্রযুক্তির এক নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করেছে, যার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। একসময় যে বিষয়টিকে কল্পবিজ্ঞান মনে করা হতো, আজ তা বাস্তবে রূপ নিয়েছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এমন এক প্রযুক্তি, যা যন্ত্রকে মানুষসদৃশ চিন্তা, শেখা, বিশ্লেষণ ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা প্রদান করে। এর বিকাশ যেমন মানুষের জীবনকে সহজতর করছে, তেমনি নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের মুখেও ফেলছে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মূলত এমন এক প্রক্রিয়া, যেখানে যন্ত্রে নির্দিষ্ট অ্যালগরিদম ও তথ্য (ডেটা) সংযুক্ত করা হয়, যার ভিত্তিতে যন্ত্র নিজেই শেখে, চিন্তা করে ও সিদ্ধান্ত নেয়। এর সহায়ক উপাদানগুলোর মধ্যে রয়েছে মেশিন লার্নিং, ডিপ লার্নিং ও রোবোটিক্স। গত এক দশকে এই প্রযুক্তির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। নিউরাল নেটওয়ার্ক, ডিপ লার্নিং ও মেশিন লার্নিং এখন ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। জেনারেটিভ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (যেমন-চ্যাটজিপিটি, দাল-ই) মানুষের মতো করে লেখা তৈরি করতে পারে, ছবি আঁকতে পারে, এমনকি প্রোগ্রাম কোডও লিখতে পারে।
বর্তমানে চিকিৎসা, কৃষি ও শিক্ষা-সব খাতেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহৃত হচ্ছে। চিকিৎসায় এটি রোগ নির্ণয়, ওষুধ আবিষ্কার ও রোগীর তথ্য বিশ্লেষণে সহায়তা করছে। কৃষিতে ফসলের পূর্বাভাস, পোকামাকড় শনাক্তকরণ ও জমির উৎপাদনশীলতা বাড়াতে ব্যবহার হচ্ছে। শিক্ষা খাতে এটি শিক্ষার্থীদের জন্য ব্যক্তিকেন্দ্রিক পাঠদানকে সহজ করছে।
এই প্রযুক্তির দ্রুত বিস্তার ও উন্নয়ন আমাদের জীবনকে সহজ ও গতিশীল করে তুলেছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো-এই ‘সহজতা’ বা ‘দক্ষতা’ আমাদের সমাজ ও মানবিক মূল্যবোধে কী প্রভাব ফেলছে?
বাংলাদেশেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দ্রুত জনপ্রিয় হচ্ছে। ২০২৪ সালের এক জরিপে দেখা গেছে, দেশের প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ নতুন কিছু শেখা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় এআই ব্যবহার করতে আগ্রহী। তবে ৩৫ শতাংশ মানুষ মনে করে এটি ভালো, ২৫ শতাংশ মনে করে এটি ক্ষতিকর। অন্যদিকে ৯০ শতাংশ প্রতিষ্ঠান মনে করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবসার জন্য অত্যন্ত কার্যকর, কারণ এটি অল্প সময়ে অধিক কাজ সম্পন্ন করতে সক্ষম। ফলে ব্যবসার গতি ও দক্ষতা উভয়ই বাড়ছে।
তবে এই সম্ভাবনার আড়ালে লুকিয়ে আছে কিছু গুরুতর নৈতিক ও সামাজিক প্রশ্ন। যদি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বহু খাতে মানুষের কাজের বিকল্প হয়ে ওঠে, তাহলে বিপুলসংখ্যক মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়বে। যেহেতু এটি তথ্য বিশ্লেষণে সক্ষম, তাই ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কাও থাকে। অনেক সময় এআই-এর অ্যালগরিদম মানবিক পক্ষপাত পুনরুত্পাদন করে, ফলে বিচার, নিয়োগ কিংবা ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে অন্যায় ঘটতে পারে। উপরন্তু, বিশ্বজুড়ে এআই নিয়ন্ত্রণে কার্যকর আইন বা নীতিমালা এখনো পর্যাপ্ত নয়, ফলে এর অপব্যবহারের ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে।
এই প্রযুক্তির সুফল সম্পূর্ণভাবে কাজে লাগাতে এবং ক্ষতি কমাতে এখনই প্রয়োজন কার্যকর উদ্যোগ। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এআই ব্যবহারের একটি নৈতিক কাঠামো তৈরি করতে হবে এবং এর মাধ্যমে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিঃসন্দেহে একটি যুগান্তরকারী প্রযুক্তি, যা মানুষের জীবনকে সহজতর করেছে ও নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে। তবে এর মানবিক ও নৈতিক ব্যবহার নিশ্চিত করা আজকের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে আমাদের মূল্যবোধ, নৈতিকতা ও মানবিকতাকেও সমান তালে এগিয়ে নিতে হবে-তবেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উত্থান মানবসভ্যতার জন্য আশীর্বাদ হবে, অভিশাপ নয়।
রাতিয়া খাতুন
দর্শন বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন
শনিবার, ২০ ডিসেম্বর ২০২৫
বর্তমান বিশ্ব প্রযুক্তির এক নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করেছে, যার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। একসময় যে বিষয়টিকে কল্পবিজ্ঞান মনে করা হতো, আজ তা বাস্তবে রূপ নিয়েছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এমন এক প্রযুক্তি, যা যন্ত্রকে মানুষসদৃশ চিন্তা, শেখা, বিশ্লেষণ ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা প্রদান করে। এর বিকাশ যেমন মানুষের জীবনকে সহজতর করছে, তেমনি নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের মুখেও ফেলছে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মূলত এমন এক প্রক্রিয়া, যেখানে যন্ত্রে নির্দিষ্ট অ্যালগরিদম ও তথ্য (ডেটা) সংযুক্ত করা হয়, যার ভিত্তিতে যন্ত্র নিজেই শেখে, চিন্তা করে ও সিদ্ধান্ত নেয়। এর সহায়ক উপাদানগুলোর মধ্যে রয়েছে মেশিন লার্নিং, ডিপ লার্নিং ও রোবোটিক্স। গত এক দশকে এই প্রযুক্তির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। নিউরাল নেটওয়ার্ক, ডিপ লার্নিং ও মেশিন লার্নিং এখন ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। জেনারেটিভ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (যেমন-চ্যাটজিপিটি, দাল-ই) মানুষের মতো করে লেখা তৈরি করতে পারে, ছবি আঁকতে পারে, এমনকি প্রোগ্রাম কোডও লিখতে পারে।
বর্তমানে চিকিৎসা, কৃষি ও শিক্ষা-সব খাতেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহৃত হচ্ছে। চিকিৎসায় এটি রোগ নির্ণয়, ওষুধ আবিষ্কার ও রোগীর তথ্য বিশ্লেষণে সহায়তা করছে। কৃষিতে ফসলের পূর্বাভাস, পোকামাকড় শনাক্তকরণ ও জমির উৎপাদনশীলতা বাড়াতে ব্যবহার হচ্ছে। শিক্ষা খাতে এটি শিক্ষার্থীদের জন্য ব্যক্তিকেন্দ্রিক পাঠদানকে সহজ করছে।
এই প্রযুক্তির দ্রুত বিস্তার ও উন্নয়ন আমাদের জীবনকে সহজ ও গতিশীল করে তুলেছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো-এই ‘সহজতা’ বা ‘দক্ষতা’ আমাদের সমাজ ও মানবিক মূল্যবোধে কী প্রভাব ফেলছে?
বাংলাদেশেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দ্রুত জনপ্রিয় হচ্ছে। ২০২৪ সালের এক জরিপে দেখা গেছে, দেশের প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ নতুন কিছু শেখা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় এআই ব্যবহার করতে আগ্রহী। তবে ৩৫ শতাংশ মানুষ মনে করে এটি ভালো, ২৫ শতাংশ মনে করে এটি ক্ষতিকর। অন্যদিকে ৯০ শতাংশ প্রতিষ্ঠান মনে করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবসার জন্য অত্যন্ত কার্যকর, কারণ এটি অল্প সময়ে অধিক কাজ সম্পন্ন করতে সক্ষম। ফলে ব্যবসার গতি ও দক্ষতা উভয়ই বাড়ছে।
তবে এই সম্ভাবনার আড়ালে লুকিয়ে আছে কিছু গুরুতর নৈতিক ও সামাজিক প্রশ্ন। যদি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বহু খাতে মানুষের কাজের বিকল্প হয়ে ওঠে, তাহলে বিপুলসংখ্যক মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়বে। যেহেতু এটি তথ্য বিশ্লেষণে সক্ষম, তাই ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কাও থাকে। অনেক সময় এআই-এর অ্যালগরিদম মানবিক পক্ষপাত পুনরুত্পাদন করে, ফলে বিচার, নিয়োগ কিংবা ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে অন্যায় ঘটতে পারে। উপরন্তু, বিশ্বজুড়ে এআই নিয়ন্ত্রণে কার্যকর আইন বা নীতিমালা এখনো পর্যাপ্ত নয়, ফলে এর অপব্যবহারের ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে।
এই প্রযুক্তির সুফল সম্পূর্ণভাবে কাজে লাগাতে এবং ক্ষতি কমাতে এখনই প্রয়োজন কার্যকর উদ্যোগ। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এআই ব্যবহারের একটি নৈতিক কাঠামো তৈরি করতে হবে এবং এর মাধ্যমে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিঃসন্দেহে একটি যুগান্তরকারী প্রযুক্তি, যা মানুষের জীবনকে সহজতর করেছে ও নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে। তবে এর মানবিক ও নৈতিক ব্যবহার নিশ্চিত করা আজকের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে আমাদের মূল্যবোধ, নৈতিকতা ও মানবিকতাকেও সমান তালে এগিয়ে নিতে হবে-তবেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উত্থান মানবসভ্যতার জন্য আশীর্বাদ হবে, অভিশাপ নয়।
রাতিয়া খাতুন
দর্শন বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়