মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন
শহরের আকাশে যখন ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টে নতুন বছরের ঘোষণা আসে, তখনই যেন প্রকৃতির বুকে নেমে আসে এক অদৃশ্য শোক। আতশবাজির বিকট শব্দে কেঁপে ওঠে গাছের ডাল, ভীত সন্ত্রস্ত পাখিরা দিশেহারা হয়ে ছুটে বেড়ায়, অনেকেই প্রাণ হারায়। যাদের কণ্ঠে ভোরের গান, যাদের ডানায় ছিল আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন-তারা তখন মরার প্রহর গুনে। অথচ এই উৎসবের আনন্দ মানুষ ছাড়া আর কারও জন্য নয়।
গ্রামবাংলায় এমন চিত্র খুব একটা দেখা যায় না। গ্রামে আতশবাজি, মদ্যপান কিংবা পার্টি-কেন্দ্রিক ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’ উদযাপন বিরল। কারণ গ্রামীণ সমাজ এখনও প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থানের গুরুত্ব বোঝে। নতুন বছর সেখানে আসে নীরবে-সূর্যোদয়ের আলোয়, মাঠের সবুজে, নদীর জলে। কিন্তু শহুরে জীবনে পশ্চিমা সংস্কৃতির অনুকরণে এই উৎসব আজ এক ধরনের প্রতিযোগিতায় পরিণত হয়েছে-কে বেশি শব্দ করবে, কে বেশি আলো জ্বালাবে, কে বেশি উন্মাদনায় মেতে উঠবে।
এই উচ্ছ্বাসের প্রতিদান স্বরূপ আত্মদান করছে প্রকৃতির অমূল্য সম্পদ। শুধু পাখিই নয়-পরিবেশ দূষিত হচ্ছে, বায়ু ও শব্দদূষণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশু, বৃদ্ধ ও অসুস্থ মানুষ। অথচ আমরা এই ক্ষতির হিসাব কষি না, কারণ আমাদের আনন্দের মুহূর্তে প্রকৃতির কান্না আমাদের শোনা হয় না।
অন্যদিকে তাকালেই দেখা যায় বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতির অনন্য উৎসব-পহেলা বৈশাখ। নতুন বছরের আগমন তখন হয় আনন্দ, সৌহার্দ্য আর মানবিকতায় ভর করে। মানুষ নতুন পোশাক পরে, ঘরবাড়ি পরিষ্কার করে, বৈশাখী মেলায় মেতে ওঠে। হালখাতা, নৌকাবাইচ, গ্রামীণ খেলাধুলা, পান্তা-ইলিশ, লোকসংগীত-সব মিলিয়ে দেশটা যেন সেজে ওঠে নতুন রঙে। এখানে আনন্দ আছে, কিন্তু অকারণ শব্দ নেই; উৎসব আছে, কিন্তু প্রকৃতির ওপর আঘাত নেই।
তাহলে প্রশ্ন জাগে-পহেলা বৈশাখে যে মানুষ এত শান্ত, এত প্রাণবন্ত, এত মানবিক-পহেলা জানুয়ারিতে তাদের কী এমন অসুখ হয় যে তারা আতশবাজির আগুনে আকাশ পুড়িয়ে দিতে চায়? কেন আনন্দের নামে ধ্বংসকে বেছে নিতে হবে?
আমরা ব্রিটিশ শাসন থেকে ইস্তফা নিয়েছি বহু আগেই, কিন্তু দুঃখজনকভাবে তাদের অনেক সংস্কৃতি আজও আমাদের চিন্তা ও আচরণে গেঁথে আছে। নিজেদের ঐতিহ্যকে অবহেলা করে বিদেশি অনুকরণে মেতে ওঠা যেন আধুনিকতার মাপকাঠি হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ প্রকৃত আধুনিকতা মানে দায়িত্বশীল হওয়া, প্রকৃতি ও সংস্কৃতিকে সম্মান করা।
পরিশেষে বলা যায়, পহেলা জানুয়ারি পালন হোক বাঙালির সংস্কৃতিতে-শব্দহীন, সহনশীল, মানবিক ও পরিবেশবান্ধব রূপে। আনন্দ হোক মানুষের জন্য, কিন্তু তা যেন অন্য প্রাণের কান্নার কারণ না হয়। নতুন বছর আসুক নতুন চেতনায়-প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থানের অঙ্গীকারে।
রাহুল দেবনাথ
শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন
শনিবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫
শহরের আকাশে যখন ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টে নতুন বছরের ঘোষণা আসে, তখনই যেন প্রকৃতির বুকে নেমে আসে এক অদৃশ্য শোক। আতশবাজির বিকট শব্দে কেঁপে ওঠে গাছের ডাল, ভীত সন্ত্রস্ত পাখিরা দিশেহারা হয়ে ছুটে বেড়ায়, অনেকেই প্রাণ হারায়। যাদের কণ্ঠে ভোরের গান, যাদের ডানায় ছিল আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন-তারা তখন মরার প্রহর গুনে। অথচ এই উৎসবের আনন্দ মানুষ ছাড়া আর কারও জন্য নয়।
গ্রামবাংলায় এমন চিত্র খুব একটা দেখা যায় না। গ্রামে আতশবাজি, মদ্যপান কিংবা পার্টি-কেন্দ্রিক ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’ উদযাপন বিরল। কারণ গ্রামীণ সমাজ এখনও প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থানের গুরুত্ব বোঝে। নতুন বছর সেখানে আসে নীরবে-সূর্যোদয়ের আলোয়, মাঠের সবুজে, নদীর জলে। কিন্তু শহুরে জীবনে পশ্চিমা সংস্কৃতির অনুকরণে এই উৎসব আজ এক ধরনের প্রতিযোগিতায় পরিণত হয়েছে-কে বেশি শব্দ করবে, কে বেশি আলো জ্বালাবে, কে বেশি উন্মাদনায় মেতে উঠবে।
এই উচ্ছ্বাসের প্রতিদান স্বরূপ আত্মদান করছে প্রকৃতির অমূল্য সম্পদ। শুধু পাখিই নয়-পরিবেশ দূষিত হচ্ছে, বায়ু ও শব্দদূষণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশু, বৃদ্ধ ও অসুস্থ মানুষ। অথচ আমরা এই ক্ষতির হিসাব কষি না, কারণ আমাদের আনন্দের মুহূর্তে প্রকৃতির কান্না আমাদের শোনা হয় না।
অন্যদিকে তাকালেই দেখা যায় বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতির অনন্য উৎসব-পহেলা বৈশাখ। নতুন বছরের আগমন তখন হয় আনন্দ, সৌহার্দ্য আর মানবিকতায় ভর করে। মানুষ নতুন পোশাক পরে, ঘরবাড়ি পরিষ্কার করে, বৈশাখী মেলায় মেতে ওঠে। হালখাতা, নৌকাবাইচ, গ্রামীণ খেলাধুলা, পান্তা-ইলিশ, লোকসংগীত-সব মিলিয়ে দেশটা যেন সেজে ওঠে নতুন রঙে। এখানে আনন্দ আছে, কিন্তু অকারণ শব্দ নেই; উৎসব আছে, কিন্তু প্রকৃতির ওপর আঘাত নেই।
তাহলে প্রশ্ন জাগে-পহেলা বৈশাখে যে মানুষ এত শান্ত, এত প্রাণবন্ত, এত মানবিক-পহেলা জানুয়ারিতে তাদের কী এমন অসুখ হয় যে তারা আতশবাজির আগুনে আকাশ পুড়িয়ে দিতে চায়? কেন আনন্দের নামে ধ্বংসকে বেছে নিতে হবে?
আমরা ব্রিটিশ শাসন থেকে ইস্তফা নিয়েছি বহু আগেই, কিন্তু দুঃখজনকভাবে তাদের অনেক সংস্কৃতি আজও আমাদের চিন্তা ও আচরণে গেঁথে আছে। নিজেদের ঐতিহ্যকে অবহেলা করে বিদেশি অনুকরণে মেতে ওঠা যেন আধুনিকতার মাপকাঠি হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ প্রকৃত আধুনিকতা মানে দায়িত্বশীল হওয়া, প্রকৃতি ও সংস্কৃতিকে সম্মান করা।
পরিশেষে বলা যায়, পহেলা জানুয়ারি পালন হোক বাঙালির সংস্কৃতিতে-শব্দহীন, সহনশীল, মানবিক ও পরিবেশবান্ধব রূপে। আনন্দ হোক মানুষের জন্য, কিন্তু তা যেন অন্য প্রাণের কান্নার কারণ না হয়। নতুন বছর আসুক নতুন চেতনায়-প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থানের অঙ্গীকারে।
রাহুল দেবনাথ
শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়