তাজুল ইসলাম
বর্তমান সময়ে ব্যবসায়ীক সফলতা নির্ভর করে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মার্কেটিং পলিসির উপর। আমরা যদি বিশ্বের নামীদামী ব্রান্ডগুলোর দিকে তাকায় তাহলে দেখা যাবে তারা আজ এই অবস্থানে এসেছে তাদের ইউনিক মার্কেটিং স্ট্রাটেজি দিয়ে। যুগোপযোগী মার্কেটিং পলিসি ছাড়া তীব্র প্রতিযোগিতায় ব্যবসা টিকিয়ে রাখা কোনভাবেই সম্ভব না।
কার্যকর মার্কেটিং পলিসি তৈরির জন্য প্রয়োজন সুদক্ষ, সৃষ্টিশীল, দূরদর্শী মার্কেটারের। পলিসি তৈরির ক্ষেত্রে ছোটখাটো একটি ভুলও অনেক সময় ব্যবসাকে পথে বসাতে পারে। মার্কেটারদের দূরদর্শিতার অভাব এবং ভুল ডিসিশন মেকিং অনেক ফেমাস কোম্পানিকেও দেউলিয়া করেছে। মার্কেটিং পলিসি মেকিং-এ মার্কেটাররা অনেক ভুল করে থাকে আর তাদের সবচেয়ে বড় ভুল হল- "মার্কেটিং মাইওপিয়া"
হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউতে থিওডোর লেভিটের একটি নিবন্ধে তিনি প্রথম "মার্কেটিং মাইওপিয়া" শব্দটি ব্যবহার করেছেন। মাইওপিয়া মূলত একটি চোখের রোগ। মাইওপিয়া বা ক্ষীণদৃষ্টি আক্রান্ত চোখ খুব কাছের বস্তু বেশ ভালো দেখলেও দূরের বস্তু ঝাপসা দেখে।
মার্কেটিং মাইওপিয়া বলতে ঐ অবস্থাকে বুঝায় যখন কোন কোম্পানি নিজেরা নিজেদের বাজারের রাজা ভাবতে শুরু করতে। তারা মনে করে তারা সবসময় সঠিক। তাদের পণ্য সেরা এবং বাজারে অনেক সময় ধরে টিকে থাকবে। তাদের সমকক্ষ বা প্রতিদ্বন্দ্বী কেউ নেই। বাজারে থাকা কোম্পানীগুলোকে তারা তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতে চাই না। মার্কেটিং মতবাদের মূল লক্ষ্য হল ক্রেতা সন্তুষ্টির মাধ্যমে ক্রেতার প্রয়োজন ও চাহিদা পূরণ। ক্রেতা সন্তুষ্টি অর্জন করতে হলে প্রথমে ক্রেতার প্রয়োজন, চাহিদা সম্পর্কে বুঝতে হবে। কিন্তু মার্কেটিং মাইওপিয়ায় কোম্পানি সবসময় নিজের লাভের কথা ভাবে। ক্রেতাদের প্রয়োজন চাহিদা নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই। তাই তারা মানসম্মত পণ্য বাজারে আনলেও তা ক্রেতা সন্তুষ্টি অর্জনে সক্ষম হয়না। কারণ তাদের পণ্য ক্রেতার চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হয়।
নোকিয়া হল মার্কেটিং মাইওপিয়ার সর্বোকৃষ্ট উদাহারণ। ২০১১ সাল পর্যন্ত নোকিয়া ছিল বিশ্বের সর্ববৃহৎ মোবাইল ফোন উৎপাদনকারী কোম্পানি। ১৯৮১ সালে নোকিয়া বাজারে আনে তাদের প্রথম সেলুলার ফোন "ঘগঞ-৪৫০"। আশির দশকের দিকে ধীরে ধীরে নোকিয়া সকলের নিকট পরিচিতি লাভ করতে থাকে। ১৯৯৮ সালের মধ্যে নোকিয়া বেস্টসেলিং ফোন ব্র্যান্ড হিসেবে খেতাব পায়। বিশ্বের এখন অবদি সবচেয়ে বিক্রিত ফোনের তালিকার প্রথম দুটি স্থানও নোকিয়ার হাতের মুঠোতেই। ২০০৮ সালে নোকিয়া ৪৬৮ মিলিয়ন ইউনিট ফোন বিক্রি করে। ২০০৩ সালে রিলিজ হওয়া নোকিয়া ১১০০ এবং ২০০৫ সালে রিলিজ হওয়া নোকিয়া ব্রান্ডের ১১১০ মডেলের ফোন দুটি ২৫০ মিলিয়নেরও বেশি বিক্রি হয়েছিলো।
ফোন দুইটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী সবচেয়ে বেশি বিক্রিত মোবাইল ফোন। এছাড়াও ১৯৯৯ সালে রিলিজ হওয়া নোকিয়া ৩২১০ মোবাইলটি প্রায় ১৫০ মিলিয়ন, ২০০০ সালে রিলিজ হওয়া নোকিয়া ৩৩১০ মোবাইলটি প্রায় ১৩৬ মিলিয়নের বেশি, ২০০৩ সালে রিলিজ হওয়া নোকিয়া ১৬০০ এবং নোকিয়া ৬৬০০ মোবাইল দুটি প্রায় ১৫০ মিলিয়নের বেশি, ২০০৪ সালে রিলিজ হওয়া নোকিয়ার ২৬০০ মডেলটি প্রায় ১৩৫ মিলিয়নের বেশি, ২০০৭ সালে রিলিজ হওয়া নোকিয়া ১২০০ মোবাইলটি ১৫০ মিলিয়নের বেশি বিক্রি হয়। ২০০৯ সালে নোকিয়া কোম্পানি নোকিয়া ৫২৩০ মডেলের প্রথম প্রাথমিক পর্যায়ের একটি স্মার্টফোন রিলিজ করে যেটি সারাবিশ্বে প্রায় ১৫০ মিলিয়নের বেশি বিক্রি হয়।
এতো সফলতার পরেও ২০১২ সাল থেকে নোকিয়ার পতন শুরু হয় এবং শেয়ার মূল্য দাঁড়ায় মাত্র ২ ডলারে।বর্তমানে নোকিয়ার ১ শতাংশ শেয়ার বাজারে আছে। নোকিয়ার উত্থান পতন বিষয়টি খেয়াল করলে আমরা মার্কেটিং মাইওপিয়া বিষয়টি বুঝতে পারবো। কেন নোকিয়া এতো পতন? অ্যানড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেম যখন বাজারে আসে তখন তারা নোকিয়াকে তাদের সাথে ব্যবসা করার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু নোকিয়া অ্যানড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেম না দেখেই সে প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়। তখন নোকিয়ার অপারেটিং সিস্টেম ছিল "সিম্বিয়ান" যা আপগ্রেড করা ছিলো ভীষণ কষ্টসাধ্য এবং সুযোগ সুবিধা ছিল সীমিত। নোকিয়ার ফোনের অ্যাপ ডেভেলপমেন্ট করাটা ছিলো কষ্টসাধ্য। যার কারণে নোকিয়ার জনপ্রিয়তা কমতে থাকে এবং তাদের কাস্টমাররা অন্য ফোনের দিকে ঝুঁকতে থাকে। পরে ২০১১ সালে সিম্বিয়ান এর বদলে উইন্ডোজ এর অপারেটিং সিস্টেম ইউজ করে উইন্ডোজ ৭ অপারেটিং সিস্টেমের নোকিয়া লুমিয়ার মডেল "লুমিয়া ৭১০" বাজারে ছাড়লেও তেমন সুবিধা করতে পারেনি। অথচ স্যামসাং মোবাইল কোম্পানি অ্যানড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহার করে মার্কেটে শক্তপোক্ত অবস্থান করে নিয়েছে।
একসময় আমরা ক্যামেরা বলতেই কোডাক ব্রান্ডকেই বুঝতাম। এই কোম্পানিটিই প্রথম সাধারণ মানুষকে ছবি তুলার সুযোগ করে দিয়েছিল। ১৯৮০-র দশকে এই কোম্পানির কর্মী সংখ্যা ছিল প্রায় দেড় লাখের মত৷ ১৯৬০-এর দশকে মার্কিন মহাকাশ সংস্থা নাসার চন্দ্র প্রদক্ষিণকারী যানগুলো কোডাক ফিল্মেই ধরে আনে চন্দ্রপৃষ্ঠের প্রথম কিছু ছবি৷ চাঁদে পা রাখা প্রথম নভোচারীরা তাদের ঐতিহাসিক মহাকাশযাত্রার বিরল ছবিগুলো তুলেছিল এই কোডাক ক্যামেরা দিয়েই৷ আর সেই কোম্পানিটি কিনা ক্রমাগত লসের ফলে ২০১২ সালে নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করে। ডিজিটাল ক্যামেরা বাজারে আসার ফলে কমতে থাকে এই ক্যামেরার চাহিদা। কারণ ডিজিটাল ক্যামেরা আসার পর ছবি প্রিন্ট করার প্রয়োজনীয়তা প্রায় ফুরিয়ে যায়।মানুষ তাদের বিশেষ মূহুর্তের ছবি মেমোরিতে সংরক্ষণ করে রাখতে শুরু করে৷ কোডাক তাদের টেকনোলজি আপডেটে বড্ড দেরি করে ফেলেছিল যার কারণে তাদের দেউলিয়া হতে হয়।
প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য ভোক্তার প্রয়োজন এবং চাহিদা উপলব্ধি করা এবং সে চাহিদা মোতাবেক পণ্য ভোক্তার নিকট পৌঁছে দেয়ার কোন বিকল্প নেই। আর প্রতিযোগিতায় প্রতিদ্বন্দ্বী থেকে একধাপ এগিয়ে থাকার জন্য প্রয়োজন কার্যকরী বাজার গবেষণা। পণ্য যতো ভালো মানের হোক যদি তা ভোক্তার চাহিদা পূরণ করতে না পারে তাহলে সেটি বাজারে টিকবে না। মার্কেটিং-এর সকল কার্যক্রম হবে ভোক্তাকে কেন্দ্র করে কারণ মার্কেটিং মতবাদে ভোক্তাই রাজা।
কোমল পানীয় হিসেবে আমরা কোকাকোলার নাম শুনিনি বা খাইনি এমন মানুষ পাওয়া যাবেনা। ১৮৮৬ সালে যাত্রা শুরু করা ৫ সেন্ট প্রতি গ্লাস কোমল পানীয়র প্রথম বছর বিক্রি হয়েছিল মাত্র নয় গ্লাস। বর্তমানে সমগ্র পৃথিবীতে কোমল পানীয় হিসেবে প্রতিদিন কোকা-কোলা বিক্রয় হয় প্রায় ১৬০ কোটি।কোকা-কোলার বর্তমানে ২০০টিরও অধিক দেশ বা অঞ্চলে ৫০০টিরও অধিক ব্র্যান্ড রয়েছে। কোকাকোলা ভোক্তার কথা চিন্তা করে একটি ফ্লেভারে বসে থাকেনি বাজারের ছেড়েছে বিভিন্ন ধরণের কোমল পানীয়। স্বাস্থ্য সচেতন ভোক্তাদের জন্য এনেছে ডায়েট কোক। এছাড়াও স্প্রাইট, ফান্টার মতো কোমল পানীয়গুলো কোকাকোলা কোম্পানির তৈরি।
প্রতিটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে বিশ্বাস করতে হবে, "কাস্টমার আর অলওয়েজ রাইট" কোনভাবেই ভোক্তাদের চাহিদাকে ছোট করে দেখা যাবেনা। বিক্রি যতো ভালো থাকুক, কোম্পানি যতোই ভালো অবস্থানে থাকুক সময়ের সাথে সাথে সবসময় নিজেকে আপডেট করে যেতেই হবে। অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বী ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে নিজেকে একধাপ এগিয়ে রাখতে হবে। নিত্যনতুন ভোক্তার চাহিদা পূরণে সক্ষম পণ্য দিয়ে ভোক্তাদের সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমে ব্যবসা চালিয়ে যেতে হবে। তাহলে তীব্র প্রতিযোগিতার মধ্যেও ব্যবসা টিকিয়ে রাখা সম্ভব।
[লেখক: শিক্ষা, মার্কেটিং বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া]
তাজুল ইসলাম
সোমবার, ১২ জুলাই ২০২১
বর্তমান সময়ে ব্যবসায়ীক সফলতা নির্ভর করে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মার্কেটিং পলিসির উপর। আমরা যদি বিশ্বের নামীদামী ব্রান্ডগুলোর দিকে তাকায় তাহলে দেখা যাবে তারা আজ এই অবস্থানে এসেছে তাদের ইউনিক মার্কেটিং স্ট্রাটেজি দিয়ে। যুগোপযোগী মার্কেটিং পলিসি ছাড়া তীব্র প্রতিযোগিতায় ব্যবসা টিকিয়ে রাখা কোনভাবেই সম্ভব না।
কার্যকর মার্কেটিং পলিসি তৈরির জন্য প্রয়োজন সুদক্ষ, সৃষ্টিশীল, দূরদর্শী মার্কেটারের। পলিসি তৈরির ক্ষেত্রে ছোটখাটো একটি ভুলও অনেক সময় ব্যবসাকে পথে বসাতে পারে। মার্কেটারদের দূরদর্শিতার অভাব এবং ভুল ডিসিশন মেকিং অনেক ফেমাস কোম্পানিকেও দেউলিয়া করেছে। মার্কেটিং পলিসি মেকিং-এ মার্কেটাররা অনেক ভুল করে থাকে আর তাদের সবচেয়ে বড় ভুল হল- "মার্কেটিং মাইওপিয়া"
হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউতে থিওডোর লেভিটের একটি নিবন্ধে তিনি প্রথম "মার্কেটিং মাইওপিয়া" শব্দটি ব্যবহার করেছেন। মাইওপিয়া মূলত একটি চোখের রোগ। মাইওপিয়া বা ক্ষীণদৃষ্টি আক্রান্ত চোখ খুব কাছের বস্তু বেশ ভালো দেখলেও দূরের বস্তু ঝাপসা দেখে।
মার্কেটিং মাইওপিয়া বলতে ঐ অবস্থাকে বুঝায় যখন কোন কোম্পানি নিজেরা নিজেদের বাজারের রাজা ভাবতে শুরু করতে। তারা মনে করে তারা সবসময় সঠিক। তাদের পণ্য সেরা এবং বাজারে অনেক সময় ধরে টিকে থাকবে। তাদের সমকক্ষ বা প্রতিদ্বন্দ্বী কেউ নেই। বাজারে থাকা কোম্পানীগুলোকে তারা তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতে চাই না। মার্কেটিং মতবাদের মূল লক্ষ্য হল ক্রেতা সন্তুষ্টির মাধ্যমে ক্রেতার প্রয়োজন ও চাহিদা পূরণ। ক্রেতা সন্তুষ্টি অর্জন করতে হলে প্রথমে ক্রেতার প্রয়োজন, চাহিদা সম্পর্কে বুঝতে হবে। কিন্তু মার্কেটিং মাইওপিয়ায় কোম্পানি সবসময় নিজের লাভের কথা ভাবে। ক্রেতাদের প্রয়োজন চাহিদা নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই। তাই তারা মানসম্মত পণ্য বাজারে আনলেও তা ক্রেতা সন্তুষ্টি অর্জনে সক্ষম হয়না। কারণ তাদের পণ্য ক্রেতার চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হয়।
নোকিয়া হল মার্কেটিং মাইওপিয়ার সর্বোকৃষ্ট উদাহারণ। ২০১১ সাল পর্যন্ত নোকিয়া ছিল বিশ্বের সর্ববৃহৎ মোবাইল ফোন উৎপাদনকারী কোম্পানি। ১৯৮১ সালে নোকিয়া বাজারে আনে তাদের প্রথম সেলুলার ফোন "ঘগঞ-৪৫০"। আশির দশকের দিকে ধীরে ধীরে নোকিয়া সকলের নিকট পরিচিতি লাভ করতে থাকে। ১৯৯৮ সালের মধ্যে নোকিয়া বেস্টসেলিং ফোন ব্র্যান্ড হিসেবে খেতাব পায়। বিশ্বের এখন অবদি সবচেয়ে বিক্রিত ফোনের তালিকার প্রথম দুটি স্থানও নোকিয়ার হাতের মুঠোতেই। ২০০৮ সালে নোকিয়া ৪৬৮ মিলিয়ন ইউনিট ফোন বিক্রি করে। ২০০৩ সালে রিলিজ হওয়া নোকিয়া ১১০০ এবং ২০০৫ সালে রিলিজ হওয়া নোকিয়া ব্রান্ডের ১১১০ মডেলের ফোন দুটি ২৫০ মিলিয়নেরও বেশি বিক্রি হয়েছিলো।
ফোন দুইটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী সবচেয়ে বেশি বিক্রিত মোবাইল ফোন। এছাড়াও ১৯৯৯ সালে রিলিজ হওয়া নোকিয়া ৩২১০ মোবাইলটি প্রায় ১৫০ মিলিয়ন, ২০০০ সালে রিলিজ হওয়া নোকিয়া ৩৩১০ মোবাইলটি প্রায় ১৩৬ মিলিয়নের বেশি, ২০০৩ সালে রিলিজ হওয়া নোকিয়া ১৬০০ এবং নোকিয়া ৬৬০০ মোবাইল দুটি প্রায় ১৫০ মিলিয়নের বেশি, ২০০৪ সালে রিলিজ হওয়া নোকিয়ার ২৬০০ মডেলটি প্রায় ১৩৫ মিলিয়নের বেশি, ২০০৭ সালে রিলিজ হওয়া নোকিয়া ১২০০ মোবাইলটি ১৫০ মিলিয়নের বেশি বিক্রি হয়। ২০০৯ সালে নোকিয়া কোম্পানি নোকিয়া ৫২৩০ মডেলের প্রথম প্রাথমিক পর্যায়ের একটি স্মার্টফোন রিলিজ করে যেটি সারাবিশ্বে প্রায় ১৫০ মিলিয়নের বেশি বিক্রি হয়।
এতো সফলতার পরেও ২০১২ সাল থেকে নোকিয়ার পতন শুরু হয় এবং শেয়ার মূল্য দাঁড়ায় মাত্র ২ ডলারে।বর্তমানে নোকিয়ার ১ শতাংশ শেয়ার বাজারে আছে। নোকিয়ার উত্থান পতন বিষয়টি খেয়াল করলে আমরা মার্কেটিং মাইওপিয়া বিষয়টি বুঝতে পারবো। কেন নোকিয়া এতো পতন? অ্যানড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেম যখন বাজারে আসে তখন তারা নোকিয়াকে তাদের সাথে ব্যবসা করার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু নোকিয়া অ্যানড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেম না দেখেই সে প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়। তখন নোকিয়ার অপারেটিং সিস্টেম ছিল "সিম্বিয়ান" যা আপগ্রেড করা ছিলো ভীষণ কষ্টসাধ্য এবং সুযোগ সুবিধা ছিল সীমিত। নোকিয়ার ফোনের অ্যাপ ডেভেলপমেন্ট করাটা ছিলো কষ্টসাধ্য। যার কারণে নোকিয়ার জনপ্রিয়তা কমতে থাকে এবং তাদের কাস্টমাররা অন্য ফোনের দিকে ঝুঁকতে থাকে। পরে ২০১১ সালে সিম্বিয়ান এর বদলে উইন্ডোজ এর অপারেটিং সিস্টেম ইউজ করে উইন্ডোজ ৭ অপারেটিং সিস্টেমের নোকিয়া লুমিয়ার মডেল "লুমিয়া ৭১০" বাজারে ছাড়লেও তেমন সুবিধা করতে পারেনি। অথচ স্যামসাং মোবাইল কোম্পানি অ্যানড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহার করে মার্কেটে শক্তপোক্ত অবস্থান করে নিয়েছে।
একসময় আমরা ক্যামেরা বলতেই কোডাক ব্রান্ডকেই বুঝতাম। এই কোম্পানিটিই প্রথম সাধারণ মানুষকে ছবি তুলার সুযোগ করে দিয়েছিল। ১৯৮০-র দশকে এই কোম্পানির কর্মী সংখ্যা ছিল প্রায় দেড় লাখের মত৷ ১৯৬০-এর দশকে মার্কিন মহাকাশ সংস্থা নাসার চন্দ্র প্রদক্ষিণকারী যানগুলো কোডাক ফিল্মেই ধরে আনে চন্দ্রপৃষ্ঠের প্রথম কিছু ছবি৷ চাঁদে পা রাখা প্রথম নভোচারীরা তাদের ঐতিহাসিক মহাকাশযাত্রার বিরল ছবিগুলো তুলেছিল এই কোডাক ক্যামেরা দিয়েই৷ আর সেই কোম্পানিটি কিনা ক্রমাগত লসের ফলে ২০১২ সালে নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করে। ডিজিটাল ক্যামেরা বাজারে আসার ফলে কমতে থাকে এই ক্যামেরার চাহিদা। কারণ ডিজিটাল ক্যামেরা আসার পর ছবি প্রিন্ট করার প্রয়োজনীয়তা প্রায় ফুরিয়ে যায়।মানুষ তাদের বিশেষ মূহুর্তের ছবি মেমোরিতে সংরক্ষণ করে রাখতে শুরু করে৷ কোডাক তাদের টেকনোলজি আপডেটে বড্ড দেরি করে ফেলেছিল যার কারণে তাদের দেউলিয়া হতে হয়।
প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য ভোক্তার প্রয়োজন এবং চাহিদা উপলব্ধি করা এবং সে চাহিদা মোতাবেক পণ্য ভোক্তার নিকট পৌঁছে দেয়ার কোন বিকল্প নেই। আর প্রতিযোগিতায় প্রতিদ্বন্দ্বী থেকে একধাপ এগিয়ে থাকার জন্য প্রয়োজন কার্যকরী বাজার গবেষণা। পণ্য যতো ভালো মানের হোক যদি তা ভোক্তার চাহিদা পূরণ করতে না পারে তাহলে সেটি বাজারে টিকবে না। মার্কেটিং-এর সকল কার্যক্রম হবে ভোক্তাকে কেন্দ্র করে কারণ মার্কেটিং মতবাদে ভোক্তাই রাজা।
কোমল পানীয় হিসেবে আমরা কোকাকোলার নাম শুনিনি বা খাইনি এমন মানুষ পাওয়া যাবেনা। ১৮৮৬ সালে যাত্রা শুরু করা ৫ সেন্ট প্রতি গ্লাস কোমল পানীয়র প্রথম বছর বিক্রি হয়েছিল মাত্র নয় গ্লাস। বর্তমানে সমগ্র পৃথিবীতে কোমল পানীয় হিসেবে প্রতিদিন কোকা-কোলা বিক্রয় হয় প্রায় ১৬০ কোটি।কোকা-কোলার বর্তমানে ২০০টিরও অধিক দেশ বা অঞ্চলে ৫০০টিরও অধিক ব্র্যান্ড রয়েছে। কোকাকোলা ভোক্তার কথা চিন্তা করে একটি ফ্লেভারে বসে থাকেনি বাজারের ছেড়েছে বিভিন্ন ধরণের কোমল পানীয়। স্বাস্থ্য সচেতন ভোক্তাদের জন্য এনেছে ডায়েট কোক। এছাড়াও স্প্রাইট, ফান্টার মতো কোমল পানীয়গুলো কোকাকোলা কোম্পানির তৈরি।
প্রতিটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে বিশ্বাস করতে হবে, "কাস্টমার আর অলওয়েজ রাইট" কোনভাবেই ভোক্তাদের চাহিদাকে ছোট করে দেখা যাবেনা। বিক্রি যতো ভালো থাকুক, কোম্পানি যতোই ভালো অবস্থানে থাকুক সময়ের সাথে সাথে সবসময় নিজেকে আপডেট করে যেতেই হবে। অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বী ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে নিজেকে একধাপ এগিয়ে রাখতে হবে। নিত্যনতুন ভোক্তার চাহিদা পূরণে সক্ষম পণ্য দিয়ে ভোক্তাদের সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমে ব্যবসা চালিয়ে যেতে হবে। তাহলে তীব্র প্রতিযোগিতার মধ্যেও ব্যবসা টিকিয়ে রাখা সম্ভব।
[লেখক: শিক্ষা, মার্কেটিং বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া]