মাহমুদুল হাছান
প্রত্যেক সন্তানই তার বাবা-মায়ের কাছে অন্ধের ষষ্টী ও আদর-সোহাগের একমাত্র অবলম্বন। জীবনের সর্বোচ্চটা দিয়ে তারা তাদের সন্তানকে ভালোবাসেন। তাদের সন্তান একজন ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে উঠুক তা তারা সকলেই প্রত্যাশা করেন এবং এজন্য স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করা ছাড়াও তারা সন্তানের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করেন। সন্তানকে সফল দেখতে, তাদের সাফল্যে ভূমিকা রাখতে সন্তান ছোট থাকতেই মা-বাবাকে কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে এবং মায়ের ভূমিকা এক্ষেত্রে বিশেষভাবে বিবেচ্য। স্মার্ট প্যারেন্টিং কৌশলে সন্তানের কাছে মা-ই হলেন সাফল্যের রোল মডেল। এজন্য সন্তান পালনে একজন মাকে নিম্নের কিছু পদক্ষেপ গ্রহন করতে হবেঃ
১। নৈতিক মূল্যবোধ শিক্ষা ঃ সন্তানের উন্নতি ও সফলতার জন্য তাদেরকে নৈতিক সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ শিক্ষা দিতে হবে। আমরা সাধারণত ধন-দৌলত, টাকা-পয়সা, যশ-খ্যাতিকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জীবনের সফলতা ভাবি। কিন্তু জীবনের সবচেয়ে বড় সফলতা হচ্ছে সন্তানকে ভালো ও আলোকিত মনের মানুষ বানানো এবং এর জন্য সাধনা করে যাওয়া। মা-বাবাকে বুঝতে হবে- ভালো চাকরি ও পর্যাপ্ত টাকা জীবনের জন্য দরকার হলেও এগুলি তাদের প্রকৃত সম্পদ নয়, বরং প্রকৃত সম্পদ হলো তাদের আদর্শ সন্তান। তাই ছোট থেকেই মা যদি তার সন্তানদের নৈতিক মূল্যবোধ, সত্য-মিথ্যার পার্থক্য, ন্যায়পরায়ণতা, সততা, বিনয় ও ধৈর্যের শিক্ষা দেন, তাহলে সন্তান হবে আদর্শ ও মানবিক গুনাবলীসম্পন্ন একটি পূর্ণাঙ্গ মানুষ।
২। সন্তানের রোল মডেল হওয়াঃ জীবনে যারা সফল হয়েছেন, তারা কারো না কারোর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছেন প্রত্যক্ষভাবে বা পরোক্ষভাবে। তাদের অনেককে আমরা রোল মডেল মনে করি। কিন্তু একজন সন্তানের কাছে তার বড় রোল মডেল হলো তার বাবা-মা। শিশুরা অনুকরণপ্রিয়। তারা সবসময় তাদের বাবা-মাকে আদর্শ ভাবে এবং তাদের সবকিছু অনুকরণ করে তাদের মতো হতে চায়। এই কারণে বাবা-মাকে বেশি সতর্ক থাকতে হবে এবং প্রকৃত পক্ষেই সন্তানের সুন্দর আগামীর জন্য সন্তানের সামনে নিজেদেরকে রোল মডেল হিসেবে তৈরি করে উপস্থাপন করতে হবে। মনোবিজ্ঞানীদের মতে, শিশুর প্রথম রোল মডেল হলেন তার মা। সুতরাং মায়ের সকল কর্মের বাস্তব প্রতিচ্ছবি হয়ে থাকে তার সন্তান।
৩। ভুলের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করাঃ মানুষ মাত্রই ভুল করে থাকে। পরিবারে মা যখন আভ্যন্তরীণ গৃহস্থালি সকল কর্ম সম্পাদন করেন, তখন তার অজ্ঞতাবশত ভুল হতে পারে। এমনকি সন্তান পালন বা প্যারেন্টিং স্টাইলেও নানা ধরণের ভুল করতে পারেন কিংবা বাবা-মায়ের মাঝেও ভুল বুঝাবুঝি হতে পারে। এক্ষেত্রে অবশ্যই যিনি ভুল করবেন তিনি তার ভুলের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবেন। এতে সন্তানও শিখবে, যে ভুল করলে দুঃখ প্রকাশ করে ক্ষমা চাইতে হয়। পরিবারে এক্ষেত্রে মায়ের ভুমিকা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। মা-ই হলেন সন্তানের প্রথম শিক্ষিকা।
৪। কারোর ব্যক্তিগত বা ব্যবহার্য জিনিস নেয়ার আগে অনুমতি নেয়াঃ পরিবারের প্রত্যেকটা মানুষেরই কিছুনা কিছু ব্যক্তিগত ব্যবহার্য জিনিস থাকে এবং তা অনেকক্ষেত্রে ভাগাভাগি করেও ব্যবহার করা যায়। তবুও অন্যের জিনিস ব্যবহারের ক্ষেত্রে তার অনুমতি প্রয়োজন। এমনকি সন্তানের কোন বস্তু ব্যবহারের জন্য মাকেও অনুমতি নিতে হবে। তাহলে মায়ের এ অনুমতি গ্রহনের চর্চা থেকে সন্তানও শিক্ষা নিতে পারবে এবং সে কখনো কারো জিনিস না বলে ধরবে না। পরিবার বা বাইরের কারো জিনিস না বলে নেয়াটা লজ্জার, এটা অনেক ক্ষেত্রে চুরির পর্যায়ে পড়ে তা সন্তানকে বুঝতে ও শিখতে দিতে হবে।
৫। উপকারীর উপকার স্বিকার করাঃ পরিবারের কেউ কাউকে উপকার করলে তা স্বিকার করতে হবে এবং উপকারীকে ধন্যবাদ দিতে হবে। ঘরের মানুষ কিংবা পরিবারের সদস্য বলে তাকে ধন্যবাদ দেয়া যাবে না বা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা যাবে না, এই ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। মা যদি এ ধন্যবাদ প্রদান প্রথা চালু করেন, তার সন্তানরাও এটি করতে অভ্যস্ত হবে এবং তাদেরকে কৃতজ্ঞতাবোধ শিক্ষা দিবে।
৬। সোশ্যাল মিডিয়াতে প্রয়োজনের বেশি সময় না দেয়াঃ মোবাইল এখন সামাজিক যোগাযোগ রক্ষার প্রধান একটি মাধ্যম। অনেক পরিবারে অকর্মজীবি মায়েরা বাসায় বসে মোবাইলের সাথে অনেক বেশি সময় কাটান। এতে সন্তান তার মায়ের কাছ থেকে মান সম্মত সময় পায় না। ফলে সন্তানেরা মোবাইলের প্রতি বেশি আসক্ত হয়ে পড়ে। কারণে-অকারণে বা নানা অজুহাতে তারা মায়ের কাছ থেকে মোবাইল নেয়ার সুযোগ খুজতে থাকে এবং ধীরে ধীরে গেম বা অডিও-ভিডিও ব্যবহারে আসক্ত হয়ে পড়ে, যা তাদের ভবিশ্যত গড়ায় অন্তরায়। সোশ্যাল মিডিয়াতে বেশি সময় না দিয়ে সন্তানের জীবন গড়তে সময় দেয়া উচিৎ।
৭। মিথ্যাচার না করাঃ পরিবারে মিথ্যা কথা, মিথ্য কাজ বা যেকোন ধরণের মিথ্যাচার করা থেকে মাকে বিরত থাকতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, বাসায়
কেউ আসলে বা ফোন কল দিলে মা সন্তানকে দিয়ে মিথ্যা বলিয়ে থাকেন। যেমন তিনি বাসায় থেকেও বলেন, `বলে দাও, বাবা/মা বাসায় নেই ‘বা মা/বাবা ওয়াশরুমে আছে’ ইত্যাদি ।` এই ধরনের মিথ্যা কথা সন্তান যদি মা-বাবার কাছ থেকে শিক্ষা পায়, সেই সন্তান বড় হলে মা-বাবাকেও এভাবেই মিথ্যা বলতে পারে এবং তাদের মধ্যে মিথ্যাচারের অভ্যাস তৈরি হতে পারে। সুতরাং কোনভাবেই বাসা-বাড়িতে মিথ্যার চর্চা করা উচিত নয়।
৮। সামাজিক আচার-প্রথা শিক্ষা দেয়াঃ সমাজে বাস করে সামাজিক আচার-প্রথা না জানলে সন্তানের আদর্শ জীবন গঠন ব্যাহত হয়। সামাজিকতার শিক্ষা সন্তানের জন্য আবশ্যক। অসামাজিক মানুষ সহজে সফল হতে পারে না। কারণ জীবনের প্রতিক্ষেত্রে নিজের যোগ্যতার পাশাপাশি অন্যের সাহায্য বা বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ আমাদের এগিয়ে যেতে অনুপ্রাণিত করে। তাই শৈশবকাল থেকেই সন্তানকে সামাজিক হবার সুযোগ করে দিতে হবে। তার সমবয়সি বাচ্চার সঙ্গে খেলতে দেয়া, কোনো সমস্যা হলে মা-বাবার সাহায্য না নিয়ে তার বন্ধুদের নিয়ে তার সমস্যা সমাধানের জন্য উৎসাহ দেয়া। কিন্তু অবশ্যই মা-বাবাকে দেখতে হবে সন্তান সামাজিকতা শিখতে গিয়ে যেন ভুল পথে কিংবা বিপথে না চলে। কিছুক্ষেত্রে দূর থেকেই নজর রাখতে হবে। বাড়ির ছোট ছোট কাজ করতে দেয়া সন্তানকে ৫ বছরের পর থেকেই বাড়ির ছোট ছোট দায়িত্ব দিতে হবে। এর মাধ্যমে তার দায়িত্ববোধ গড়ে উঠবে। এই দায়িত্ববোধের জ্ঞান তাকে জীবনের নানা ক্ষেত্রে সফল হতে সাহায্য করবে। দায়িত্বশীল মানুষ একদিন না একদিন জীবনে সফলতা পায়। তাই শিশুকে তার বয়স অনুপাতে দায়িত্ব দিতে হবে। যেমন খেলার পর খেলনা গুছিয়ে রাখা, পড়ার টেবিল পরিষ্কার রাখা, জুতার ফিতা বাঁধতে শেখা ইত্যাদি।
৯। সন্তানের মানিসিক দুশ্চিন্তার কারণ হতে এমন কাজ না করাঃ ছোট থেকেই দায়িত্বজ্ঞান শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে দেখতে হবে কোনো কিছুই যেন সন্তানের মানসিক চাপের কারণ না হয়। পড়াশুনা নিয়ে কখনোই সন্তানকে অতিরিক্ত চাপ দেয়া ঠিক নয়। তাছাড়াও বাবা-মায়ের মাঝে মানসিক দোটানা থাকলে সন্তানও মানসিক চাপে পড়ে, যা আগামীতে তার জীবনের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। মা-বাবা নিজেদের মধ্যে আলাপ করে দু`য়ের মধ্যকার সকল সমস্যার সমাধান করে ফেলতে পারেন। সংসার বা অন্য যে কোন কারণে মা-বাবা মানসিক চাপে থাকলে তা সন্তানকে বুঝতে দেয়া উচিত নয়। বাবা কিংবা মা কেউই একে অপরের দোষত্রুটি নিয়ে সন্তানের সাথে আলাপ করা ঠিক নয়। এমনকি সন্তান সম্পর্কিত দু`য়ের মধ্যকার আলোচনা বা সিদ্ধান্ত একে অপরের অনুপস্থিতিতে সন্তানের সাথে কিছুতেই শেয়ার করা উচিত নয়।। এক্ষেত্রে যথেষ্ঠ সচেতনভাবেই মাকে পরিবারের কল্যাণে কাজ করতে হবে।
১০। সন্তানের মধ্যে সাধনা ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা গড়ে তোলাঃ
জীবনে সফল হতে হলে লক্ষ্য থাকতে হয়, সেই সঙ্গে থাকতে হয় সাধনা আর উচ্চাকাঙ্খা। সন্তানকে লক্ষ্য অর্জনের প্রতি আগ্রহী করতে হবে মা-বাবাকে। বুঝাতে হবে সাধনার গুরুত্ব ও ভূমিকা। সেই সঙ্গে তাকে উচ্চাকাঙ্খী করে গড়ে তুলতে হবে। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে উচ্চাকাঙ্খা যেন এমন পর্যায়ে চলে না যায়, যেখানে সাফল্য পাবার জন্য সন্তান মিথ্যা বা অসৎ উপায় গ্রহণ করে।
১১। পুষ্টিজ্ঞান সম্পর্কে ধারণাঃ সন্তানের সুন্দর জীবন ও সাফল্য অর্জনের জন্য ছোট থেকেই তার শরীর ও মস্তিষ্কের বিকাশের দিকে খেয়াল রাখতে হবে। সেজন্য তার খাদ্য তালিকা হওয়া উচিত পুষ্টিসমৃদ্ধ। তাই খাবারের পুষ্টিজ্ঞান সম্পর্কে মায়ের সঠিক জ্ঞান থাকা দরকার। সেই অনুসারে সন্তানকে খাবার দিলে সন্তানের সুস্বাস্থ্য যেমন নিশ্চিত হবে, তেমনি আগামীও হবে সুন্দর।
অতএব, মা হলেন সন্তানের আদর্শ জীবন গড়ার মূল কারিগর। মায়ের শিক্ষা-দীক্ষা, কৃষ্টি-কালচার, ধর্ম-কর্ম, নীতি-নৈতিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গির উপরে সন্তানের সাফল্য ও ব্যর্থতা নির্ভর করে। মায়ের সফলতা মানেই সন্তানের সফলতা। মা যদি উচ্চ শিক্ষিত । মায়ের দৃষ্টিভঙ্গি যদি পজিটিভ হয়, সন্তানও পজিটিভভাবে প্রতিপালিত হবে। মায়ের আচরণ সুন্দর হলে সন্তানের আচরণও ভালো হবে। এককথায়, মা গুণেই সন্তান। স্মার্ট প্যারেন্টিং-এ সন্তান লালন-পালনের ক্ষেত্রে বাবা-মায়ের ভূমিকা সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ হলেও মায়ের ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সন্তানের ভূমিষ্ট হওয়া থেকে শুরু করে তৎপরবর্তীকালে বেড়ে ওঠার জন্য একজন মা-ই তাকে খুব কাছ থেকে নিবিড়ভাবে তত্বাবধান করে থাকেন। আর এ সময়টিই হলো সন্তানের আদর্শিক পাঠদানের অন্যতম সময়, যা মায়ের পক্ষেই সম্ভব। তাইতো, নেপোলিয়ন বোনাপার্ট যথার্থই বলেছিলেন, "আমাকে একজন শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদেরকে একটি শিক্ষিত জাতি দিবো।" সুতরাং প্যারেন্টিং কৌশলে একজন মা-ই হলেন সন্তানের রোল মডেল।
[লেখক: প্রিন্সিপাল, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, ঢাকা]
মাহমুদুল হাছান
বুধবার, ১১ মে ২০২২
প্রত্যেক সন্তানই তার বাবা-মায়ের কাছে অন্ধের ষষ্টী ও আদর-সোহাগের একমাত্র অবলম্বন। জীবনের সর্বোচ্চটা দিয়ে তারা তাদের সন্তানকে ভালোবাসেন। তাদের সন্তান একজন ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে উঠুক তা তারা সকলেই প্রত্যাশা করেন এবং এজন্য স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করা ছাড়াও তারা সন্তানের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করেন। সন্তানকে সফল দেখতে, তাদের সাফল্যে ভূমিকা রাখতে সন্তান ছোট থাকতেই মা-বাবাকে কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে এবং মায়ের ভূমিকা এক্ষেত্রে বিশেষভাবে বিবেচ্য। স্মার্ট প্যারেন্টিং কৌশলে সন্তানের কাছে মা-ই হলেন সাফল্যের রোল মডেল। এজন্য সন্তান পালনে একজন মাকে নিম্নের কিছু পদক্ষেপ গ্রহন করতে হবেঃ
১। নৈতিক মূল্যবোধ শিক্ষা ঃ সন্তানের উন্নতি ও সফলতার জন্য তাদেরকে নৈতিক সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ শিক্ষা দিতে হবে। আমরা সাধারণত ধন-দৌলত, টাকা-পয়সা, যশ-খ্যাতিকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জীবনের সফলতা ভাবি। কিন্তু জীবনের সবচেয়ে বড় সফলতা হচ্ছে সন্তানকে ভালো ও আলোকিত মনের মানুষ বানানো এবং এর জন্য সাধনা করে যাওয়া। মা-বাবাকে বুঝতে হবে- ভালো চাকরি ও পর্যাপ্ত টাকা জীবনের জন্য দরকার হলেও এগুলি তাদের প্রকৃত সম্পদ নয়, বরং প্রকৃত সম্পদ হলো তাদের আদর্শ সন্তান। তাই ছোট থেকেই মা যদি তার সন্তানদের নৈতিক মূল্যবোধ, সত্য-মিথ্যার পার্থক্য, ন্যায়পরায়ণতা, সততা, বিনয় ও ধৈর্যের শিক্ষা দেন, তাহলে সন্তান হবে আদর্শ ও মানবিক গুনাবলীসম্পন্ন একটি পূর্ণাঙ্গ মানুষ।
২। সন্তানের রোল মডেল হওয়াঃ জীবনে যারা সফল হয়েছেন, তারা কারো না কারোর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছেন প্রত্যক্ষভাবে বা পরোক্ষভাবে। তাদের অনেককে আমরা রোল মডেল মনে করি। কিন্তু একজন সন্তানের কাছে তার বড় রোল মডেল হলো তার বাবা-মা। শিশুরা অনুকরণপ্রিয়। তারা সবসময় তাদের বাবা-মাকে আদর্শ ভাবে এবং তাদের সবকিছু অনুকরণ করে তাদের মতো হতে চায়। এই কারণে বাবা-মাকে বেশি সতর্ক থাকতে হবে এবং প্রকৃত পক্ষেই সন্তানের সুন্দর আগামীর জন্য সন্তানের সামনে নিজেদেরকে রোল মডেল হিসেবে তৈরি করে উপস্থাপন করতে হবে। মনোবিজ্ঞানীদের মতে, শিশুর প্রথম রোল মডেল হলেন তার মা। সুতরাং মায়ের সকল কর্মের বাস্তব প্রতিচ্ছবি হয়ে থাকে তার সন্তান।
৩। ভুলের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করাঃ মানুষ মাত্রই ভুল করে থাকে। পরিবারে মা যখন আভ্যন্তরীণ গৃহস্থালি সকল কর্ম সম্পাদন করেন, তখন তার অজ্ঞতাবশত ভুল হতে পারে। এমনকি সন্তান পালন বা প্যারেন্টিং স্টাইলেও নানা ধরণের ভুল করতে পারেন কিংবা বাবা-মায়ের মাঝেও ভুল বুঝাবুঝি হতে পারে। এক্ষেত্রে অবশ্যই যিনি ভুল করবেন তিনি তার ভুলের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবেন। এতে সন্তানও শিখবে, যে ভুল করলে দুঃখ প্রকাশ করে ক্ষমা চাইতে হয়। পরিবারে এক্ষেত্রে মায়ের ভুমিকা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। মা-ই হলেন সন্তানের প্রথম শিক্ষিকা।
৪। কারোর ব্যক্তিগত বা ব্যবহার্য জিনিস নেয়ার আগে অনুমতি নেয়াঃ পরিবারের প্রত্যেকটা মানুষেরই কিছুনা কিছু ব্যক্তিগত ব্যবহার্য জিনিস থাকে এবং তা অনেকক্ষেত্রে ভাগাভাগি করেও ব্যবহার করা যায়। তবুও অন্যের জিনিস ব্যবহারের ক্ষেত্রে তার অনুমতি প্রয়োজন। এমনকি সন্তানের কোন বস্তু ব্যবহারের জন্য মাকেও অনুমতি নিতে হবে। তাহলে মায়ের এ অনুমতি গ্রহনের চর্চা থেকে সন্তানও শিক্ষা নিতে পারবে এবং সে কখনো কারো জিনিস না বলে ধরবে না। পরিবার বা বাইরের কারো জিনিস না বলে নেয়াটা লজ্জার, এটা অনেক ক্ষেত্রে চুরির পর্যায়ে পড়ে তা সন্তানকে বুঝতে ও শিখতে দিতে হবে।
৫। উপকারীর উপকার স্বিকার করাঃ পরিবারের কেউ কাউকে উপকার করলে তা স্বিকার করতে হবে এবং উপকারীকে ধন্যবাদ দিতে হবে। ঘরের মানুষ কিংবা পরিবারের সদস্য বলে তাকে ধন্যবাদ দেয়া যাবে না বা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা যাবে না, এই ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। মা যদি এ ধন্যবাদ প্রদান প্রথা চালু করেন, তার সন্তানরাও এটি করতে অভ্যস্ত হবে এবং তাদেরকে কৃতজ্ঞতাবোধ শিক্ষা দিবে।
৬। সোশ্যাল মিডিয়াতে প্রয়োজনের বেশি সময় না দেয়াঃ মোবাইল এখন সামাজিক যোগাযোগ রক্ষার প্রধান একটি মাধ্যম। অনেক পরিবারে অকর্মজীবি মায়েরা বাসায় বসে মোবাইলের সাথে অনেক বেশি সময় কাটান। এতে সন্তান তার মায়ের কাছ থেকে মান সম্মত সময় পায় না। ফলে সন্তানেরা মোবাইলের প্রতি বেশি আসক্ত হয়ে পড়ে। কারণে-অকারণে বা নানা অজুহাতে তারা মায়ের কাছ থেকে মোবাইল নেয়ার সুযোগ খুজতে থাকে এবং ধীরে ধীরে গেম বা অডিও-ভিডিও ব্যবহারে আসক্ত হয়ে পড়ে, যা তাদের ভবিশ্যত গড়ায় অন্তরায়। সোশ্যাল মিডিয়াতে বেশি সময় না দিয়ে সন্তানের জীবন গড়তে সময় দেয়া উচিৎ।
৭। মিথ্যাচার না করাঃ পরিবারে মিথ্যা কথা, মিথ্য কাজ বা যেকোন ধরণের মিথ্যাচার করা থেকে মাকে বিরত থাকতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, বাসায়
কেউ আসলে বা ফোন কল দিলে মা সন্তানকে দিয়ে মিথ্যা বলিয়ে থাকেন। যেমন তিনি বাসায় থেকেও বলেন, `বলে দাও, বাবা/মা বাসায় নেই ‘বা মা/বাবা ওয়াশরুমে আছে’ ইত্যাদি ।` এই ধরনের মিথ্যা কথা সন্তান যদি মা-বাবার কাছ থেকে শিক্ষা পায়, সেই সন্তান বড় হলে মা-বাবাকেও এভাবেই মিথ্যা বলতে পারে এবং তাদের মধ্যে মিথ্যাচারের অভ্যাস তৈরি হতে পারে। সুতরাং কোনভাবেই বাসা-বাড়িতে মিথ্যার চর্চা করা উচিত নয়।
৮। সামাজিক আচার-প্রথা শিক্ষা দেয়াঃ সমাজে বাস করে সামাজিক আচার-প্রথা না জানলে সন্তানের আদর্শ জীবন গঠন ব্যাহত হয়। সামাজিকতার শিক্ষা সন্তানের জন্য আবশ্যক। অসামাজিক মানুষ সহজে সফল হতে পারে না। কারণ জীবনের প্রতিক্ষেত্রে নিজের যোগ্যতার পাশাপাশি অন্যের সাহায্য বা বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ আমাদের এগিয়ে যেতে অনুপ্রাণিত করে। তাই শৈশবকাল থেকেই সন্তানকে সামাজিক হবার সুযোগ করে দিতে হবে। তার সমবয়সি বাচ্চার সঙ্গে খেলতে দেয়া, কোনো সমস্যা হলে মা-বাবার সাহায্য না নিয়ে তার বন্ধুদের নিয়ে তার সমস্যা সমাধানের জন্য উৎসাহ দেয়া। কিন্তু অবশ্যই মা-বাবাকে দেখতে হবে সন্তান সামাজিকতা শিখতে গিয়ে যেন ভুল পথে কিংবা বিপথে না চলে। কিছুক্ষেত্রে দূর থেকেই নজর রাখতে হবে। বাড়ির ছোট ছোট কাজ করতে দেয়া সন্তানকে ৫ বছরের পর থেকেই বাড়ির ছোট ছোট দায়িত্ব দিতে হবে। এর মাধ্যমে তার দায়িত্ববোধ গড়ে উঠবে। এই দায়িত্ববোধের জ্ঞান তাকে জীবনের নানা ক্ষেত্রে সফল হতে সাহায্য করবে। দায়িত্বশীল মানুষ একদিন না একদিন জীবনে সফলতা পায়। তাই শিশুকে তার বয়স অনুপাতে দায়িত্ব দিতে হবে। যেমন খেলার পর খেলনা গুছিয়ে রাখা, পড়ার টেবিল পরিষ্কার রাখা, জুতার ফিতা বাঁধতে শেখা ইত্যাদি।
৯। সন্তানের মানিসিক দুশ্চিন্তার কারণ হতে এমন কাজ না করাঃ ছোট থেকেই দায়িত্বজ্ঞান শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে দেখতে হবে কোনো কিছুই যেন সন্তানের মানসিক চাপের কারণ না হয়। পড়াশুনা নিয়ে কখনোই সন্তানকে অতিরিক্ত চাপ দেয়া ঠিক নয়। তাছাড়াও বাবা-মায়ের মাঝে মানসিক দোটানা থাকলে সন্তানও মানসিক চাপে পড়ে, যা আগামীতে তার জীবনের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। মা-বাবা নিজেদের মধ্যে আলাপ করে দু`য়ের মধ্যকার সকল সমস্যার সমাধান করে ফেলতে পারেন। সংসার বা অন্য যে কোন কারণে মা-বাবা মানসিক চাপে থাকলে তা সন্তানকে বুঝতে দেয়া উচিত নয়। বাবা কিংবা মা কেউই একে অপরের দোষত্রুটি নিয়ে সন্তানের সাথে আলাপ করা ঠিক নয়। এমনকি সন্তান সম্পর্কিত দু`য়ের মধ্যকার আলোচনা বা সিদ্ধান্ত একে অপরের অনুপস্থিতিতে সন্তানের সাথে কিছুতেই শেয়ার করা উচিত নয়।। এক্ষেত্রে যথেষ্ঠ সচেতনভাবেই মাকে পরিবারের কল্যাণে কাজ করতে হবে।
১০। সন্তানের মধ্যে সাধনা ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা গড়ে তোলাঃ
জীবনে সফল হতে হলে লক্ষ্য থাকতে হয়, সেই সঙ্গে থাকতে হয় সাধনা আর উচ্চাকাঙ্খা। সন্তানকে লক্ষ্য অর্জনের প্রতি আগ্রহী করতে হবে মা-বাবাকে। বুঝাতে হবে সাধনার গুরুত্ব ও ভূমিকা। সেই সঙ্গে তাকে উচ্চাকাঙ্খী করে গড়ে তুলতে হবে। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে উচ্চাকাঙ্খা যেন এমন পর্যায়ে চলে না যায়, যেখানে সাফল্য পাবার জন্য সন্তান মিথ্যা বা অসৎ উপায় গ্রহণ করে।
১১। পুষ্টিজ্ঞান সম্পর্কে ধারণাঃ সন্তানের সুন্দর জীবন ও সাফল্য অর্জনের জন্য ছোট থেকেই তার শরীর ও মস্তিষ্কের বিকাশের দিকে খেয়াল রাখতে হবে। সেজন্য তার খাদ্য তালিকা হওয়া উচিত পুষ্টিসমৃদ্ধ। তাই খাবারের পুষ্টিজ্ঞান সম্পর্কে মায়ের সঠিক জ্ঞান থাকা দরকার। সেই অনুসারে সন্তানকে খাবার দিলে সন্তানের সুস্বাস্থ্য যেমন নিশ্চিত হবে, তেমনি আগামীও হবে সুন্দর।
অতএব, মা হলেন সন্তানের আদর্শ জীবন গড়ার মূল কারিগর। মায়ের শিক্ষা-দীক্ষা, কৃষ্টি-কালচার, ধর্ম-কর্ম, নীতি-নৈতিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গির উপরে সন্তানের সাফল্য ও ব্যর্থতা নির্ভর করে। মায়ের সফলতা মানেই সন্তানের সফলতা। মা যদি উচ্চ শিক্ষিত । মায়ের দৃষ্টিভঙ্গি যদি পজিটিভ হয়, সন্তানও পজিটিভভাবে প্রতিপালিত হবে। মায়ের আচরণ সুন্দর হলে সন্তানের আচরণও ভালো হবে। এককথায়, মা গুণেই সন্তান। স্মার্ট প্যারেন্টিং-এ সন্তান লালন-পালনের ক্ষেত্রে বাবা-মায়ের ভূমিকা সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ হলেও মায়ের ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সন্তানের ভূমিষ্ট হওয়া থেকে শুরু করে তৎপরবর্তীকালে বেড়ে ওঠার জন্য একজন মা-ই তাকে খুব কাছ থেকে নিবিড়ভাবে তত্বাবধান করে থাকেন। আর এ সময়টিই হলো সন্তানের আদর্শিক পাঠদানের অন্যতম সময়, যা মায়ের পক্ষেই সম্ভব। তাইতো, নেপোলিয়ন বোনাপার্ট যথার্থই বলেছিলেন, "আমাকে একজন শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদেরকে একটি শিক্ষিত জাতি দিবো।" সুতরাং প্যারেন্টিং কৌশলে একজন মা-ই হলেন সন্তানের রোল মডেল।
[লেখক: প্রিন্সিপাল, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, ঢাকা]