alt

উপ-সম্পাদকীয়

লিগ্যাল অ্যানালাইটিক্স ও আধুনিক প্রযুক্তি যেভাবে আইন পেশাকে বদলে দিচ্ছে

রাইসুল সৌরভ

: বৃহস্পতিবার, ০৪ জুলাই ২০২৪

বিচার প্রক্রিয়া সহজতর করার জন্য অন্যান্য পেশার মতো আইন জগতেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), মেশিন লার্নিং (ML) বা যন্ত্র শিক্ষণ, ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রসেসিং (NLP) বা স্বাভাবিক ভাষা প্রক্রিয়াকরণ, প্যাটার্ন ম্যাচিং বা বিন্যাস মিলকরণ প্রযুক্তির ন্যায় আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে। যদিও ঐতিহাসিকভাবে বিচারপ্রার্থীদের দূর্দশা লাঘবে আইন এবং প্রযুক্তির অত্যাবশ্যকীয় মেলবন্ধন অতীতে দেখা যায়নি। এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয়তার পাশাপাশি পর্যাপ্ত চাহিদা থাকা সত্ত্বেও আইন পেশার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ এবং ব্যবহার উপযোগী বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবনের এতদিন অভাব ছিল। আইনের সহজাত দুর্বোধ্যতা অথবা আইনি পরিষেবার সঙ্গে খাপ খাইয়ে প্রযুক্তিকে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার জন্য সুচিন্তিত ও যথাযথ গবেষণার অভাবও এর জন্য দায়ী হতে পারে। তবে বিশেষত কোভিড-১৯ এর সময় সারা পৃথিবীব্যাপী বিচারিক প্রক্রিয়ায় আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ব্যাপকভাবে সুফল বয়ে নিয়ে আসায় আইনাঙ্গনে প্রযুক্তির ব্যবহার দারুণভাবে গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা পেয়েছে। যার ফলে এখন প্রায়শই এক্ষেত্রে নিত্য-নতুন উদ্ভাবন পরিলক্ষিত হচ্ছে।

বর্তমানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি এবং দ্রুত বিকাশমান ডিজিটাল সমাজের বিশাল স্রোতে আইনি সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানসমূহও (যেমনঃ আদালত, ল ফার্ম) এসব নতুন নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে নিজেদেরকে রূপান্তরিত করে নিচ্ছে। আধুনিক সময়ে প্রায় প্রতিটি সেক্টরেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জয়জয়কার চলছে এবং দ্রুততার সাথে এর উন্নয়ন সারা বিশ্বের বিচার ব্যবস্থার জন্য প্রভূত সুযোগ তৈরি করেছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো সর্বাধুনিক বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবন বিচারাঙ্গনে সচ্ছতা, জবাবদিহিতা, ন্যায্যতা, দ্রুত নিষ্পত্তি ও বিচারপ্রাপ্তি ইত্যাদি আনয়নের সঙ্গে সঙ্গে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মৌলিক নীতিগুলোর (যেমন- আইনের শাসন, নিরপেক্ষতা, সমতা, সুবিচার প্রভৃতি) প্রতি প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের মাধ্যমে ঐতিহ্যগত আইন পেশার চিরায়িত পরিবেশ বদলে দিতে পারে।

লিগ্যাল অ্যানালাইটিক্স বলতে সাধারণত গাণিতিক তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে আইন ব্যবস্থায় চলমান ক্রিয়াকলাপ ও উদ্যোগের সমন্বিত তথ্য প্রযুক্তিগতভাবে বিশ্লেষণের কৌশলকে বুঝায়। লিগ্যাল অ্যানালাইটিক্স বা প্রযুক্তিগতভাবে আইনি বিশ্লেষণের বিভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বর্তমান সময়ে কিছু এআই সফটওয়্যার তৈরি হয়েছে; যা মোকদ্দমা দায়েরের পূর্বেই একই প্রকৃতির বহু বছরের প্রচুর মোকদ্দমার ফলাফল গাণিতিকভাবে বিশ্লেষণ করে মোকদ্দমার সম্ভাব্য রায় সম্পর্কে পূর্বাভাস দেয়ার চেষ্টা করে। কোন কোন এআই সফটওয়্যার আবার নির্দিষ্ট একজন বিচারকের দেয়া সমস্ত রায় বিশ্লেষণ করে উক্ত বিচারকের রায়ের প্রবণতা সনাক্ত করে। অন্য কিছু প্রযুক্তি বিচারের ক্ষেত্রে ব্যবহার্য বিভিন্ন জটিল সাক্ষ্য-প্রমাণ গাণিতিকভাবে বিশ্লেষণ করে, যা মানুষের দ্বারা বিশ্লেষণ করা খুবই সময়, শ্রম ও ব্যয় সাপেক্ষ হতো। অপর কিছু সফটওয়্যার আবার বিচারিক নথির বিশাল অংশ থেকে সুনির্দিষ্ট তথ্য নিমিষে খুঁজে দিতে পারে; আইনি প্রাত্যহিক দলিলাদি মুসাবিদা করতে পারে, আইনজীবীদের চেম্বার ব্যবস্থাপনার কাজে সহায়তা করতে পারে প্রভৃতি।

এ ধরনের আধুনিক প্রযুক্তি বহু বছরের পুরনো উপাত্ত ও অন্যান্য পরিসংখ্যান ব্যবহার করে এমনকি নিজ থেকে মানুষের (আইনজীবীর) সহায়তা ছাড়াই সাধারণ কিছু বিষয়ে আইনি পরামর্শ দিতেও সক্ষম। যার ফলে বিচার কাজে আইনজীবী, বিচারক, আদালত কর্মকর্তা-কর্মচারী, বিচার প্রার্থীদের বিপুল সময়, অর্থ এবং শ্রম সাশ্রয় হতে পারে। উপরন্তু, এর মাধ্যমে নির্ভুলভাবে কার্য সম্পাদন হওয়ার সম্ভাবনা বেশি, যেখানে মানুষের মাধ্যমে সম্পন্ন যেকোন কাজেই সহজাতভাবে ভুল-ত্রুটির সম্ভাবনা থেকে যায়।

তবে ইদানীং বেশ কিছু এআই সফটওয়্যার বাস্তবে অস্তিত্ব নেই এমন কিছু মামলা-মোকদ্দমার নজির ভুলভাবে উল্লেখ করে ব্যাপকভাবে সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছে; যাকে এআইয়ের কল্পনা বা হ্যালুসিনেশন বলা হচ্ছে এবং এগুলি যাচাই-বাছাই ছাড়াই আদালতের কার্যক্রমে ব্যবহার করায় সংশ্লিষ্ট আইনজীবীগণও ভৎসনা এমনকি সাজার সম্মুখীন হয়েছেন। সুতরাং, প্রযুক্তির প্রভূত উন্নয়ন হলেও এসবাই আধুনিক প্রযুক্তি এখনও আইনাঙ্গনে পুরোপুরি গলদমুক্ত ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারেনি। হয়তো অধিক ও সুচারু গবেষণার ফলে এসব সফটওয়্যার/এআই টুলসের উপযোগিতা আইনাঙ্গনে অদূর ভবিষ্যতে আরও বাড়বে।

আজকের দিনে প্রযুক্তিতে আচ্ছন্ন ও বিজ্ঞান মনস্ক মক্কেলগণও তাদের মোকদ্দমায় আইনজীবীদের প্রমাণযোগ্য দক্ষতা, গুণমান এবং দ্রুত সময়ে মামলার আরও ভাল ফলাফল প্রত্যাশা করেন। তাই মৌলিক ও চলমান কম্পিউটার প্রযুক্তির সাথে সাথে লিগ্যাল অ্যানালাইটিক্স কৌশলের মতো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত সফটওয়্যার বিনামূল্যের আইনি সেবা সহায়তা প্রদান সংস্থা, আদালত থেকে শুরু করে বঙ বড় ল ফার্ম, কর্পোরেট অফিসসমূহের আইন বিভাগ এবং সরকারি আইনি প্রতিষ্ঠানেও জায়গা করে নিচ্ছে। এই যুগান্তকারী আবিষ্কার আইনজীবী এবং আদালত উভয়ের কাজের চাপ হ্রাস করে যেমন অধিক গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল মামলায় আগের চেয়ে পর্যাপ্ত সময় নিয়ে মনোনিবেশ ও গবেষণার সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে; ঠিক তেমনি আবার বিচারপ্রার্থী জনগণ ও রাষ্ট্রের খরচ কমিয়ে দিচ্ছে। সেই সঙ্গে উপরি হিসেবে সবাইর মূল্যবান সময় বাঁচানোর নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। ফলে বিচার বিভাগের পূর্বের চেয়ে অধিক জনবান্ধব হওয়ার পথ সুগম হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এতসব ব্যবহারিক উপযোগিতার কারণেই লিগ্যাল অ্যানালাইটিক্স প্রযুক্তি সারা বিশ্বে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। যদিও পরিতাপের বিষয় হল, দেশে ডিজিটাল বাংলাদেশ সেøাগান জনপ্রিয়তা পেলেও বিচারাঙ্গনে ডিজিটালাইজেশনের অভাব, ব্যবহারকারীদের (আইনজীবী, বিচারক ও আদালত স্টাফ) একাংশের অনাগ্রহ ও অজ্ঞতার কারণে এটি আমাদের বিচার ব্যবস্থায় এখনও পরিচিতি লাভ করেনি।

অথচ ল চেম্বার ও আদালত তাদের মক্কেলদের জন্য আরও বেশি সেবা যোগ করতে তাদের দৈনন্দিন আইনি কার্যাবলী যেমন আইন বিশ্লেষণ, গবেষণা, নজির খোঁজা, মামলা ব্যবস্থাপনা, সাক্ষ্য বিশ্লেষণ, আদেশ লেখা, স্বয়ংক্রিয় চুক্তি পর্যালোচনা, বিভিন্ন আবেদন এবং চুক্তি মুসাবিদা করা প্রভৃতি কাজে এআই সফটওয়্যার ব্যবহার করতে পারে। তবে যেহেতু এসবাই সফটওয়্যার এখনও সম্পূর্ণ নির্ভুল তথ্য-উপাত্ত প্রদানে নির্ভরযোগ্য হয়নি, তাই এ ধরনের সফটওয়্যার ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যই বিচারক ও আইনজীবীগণকে অধিক সতর্কতা অবলম্বন পেশাগত দায়িত্ব ও সেবার মান সমুন্নত রাখতে হবে।

এছাড়া নতুন এই প্রযুক্তি এমন সম্ভাবনাও তৈরি করেছে যে, যারা আইনজীবী নন, অথবা যাদের আইন পেশা পরিচালনার স্বীকৃতি-সনদ নেই তারাও চাইলে এসবাই সফটওয়্যারের সহায়তা নিয়ে বিচারপ্রার্থীদের আইনি পরামর্শ বা সেবা দিতে পারে। আধুনিক এই কম্পিউটেশনাল প্রযুক্তির বিচারপ্রার্থীদের কাছে বিভিন্ন আইনি পরিষেবাসমূহ স্বয়ংক্রিয় উপায়ে সরবরাহ করার সক্ষমতা রয়েছে। সেই সাথে দৈনন্দিন জীবনের সাধারণ আইন সম্পর্কিত জটিল সমস্যা বুঝতে এবং সেগুলোর সম্ভাব্য সমাধান প্রদান করতেও সক্ষম। তাই কারও আইনি প্রয়োজনের ক্ষেত্রে, আইনি পরামর্শ বা পরিষেবা, এমনকি স্মার্টফোন বা অন্যান্য যন্ত্রের দ্বারা অ্যাপের মাধ্যমেও গ্রাহকের দোরগোড়ায় তা পৌঁছে দেয়া সম্ভব। ফলশ্রুতিতে সেবার মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠার সুযোগ যেমন তৈরি হবে তেমনি আইন পেশার মতো অত্যন্ত নিয়ন্ত্রিত একটি পেশা লাগামহীন হয়ে মানহীন ও অপ্রয়োজনীয় পরামর্শের দরুন সাধারণ জনগণের স্বার্থহানী ঘটাতে পারে। কারণ আদালতে মামলা পরিচালনা করার সময় আইনজীবীদের নির্দিষ্ট মান এবং দক্ষতা বজায় রাখতে হয়; যেখানে আইনি পরিষেবার মান অবশ্যই অ-আইনজীবীদের দ্বারা যে বজায় থাকবে না তা বলাই বাহুল্য এবং আখেরে তা বিচারপ্রার্থীদের আইনগত অধিকার মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।

তাছাড়া আইনজীবীগণের তাদের মক্কেলকে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব এবং স্পষ্ট তথ্য প্রদান করার পেশাগত দায়-দায়িত্ব রয়েছে, যা এই অ্যাপভিত্তিক প্রক্রিয়ায় পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব নয়। অন্য দিকে কোন বিচারকের রায় দেয়ার নির্দিষ্ট প্যাটার্ন বা প্রবণতা খুঁজে বের করার ফলে বিচারকদের প্রফাইলিংয়ের মাধ্যমে আরেকটি উল্লেখযোগ্য উদ্বেগ হলো- বিচারকরা সেক্ষেত্রে তাদের দায়িত্ব চাপমুক্ত ও নির্ভীকভাবে পালন করার জন্য বাহ্যিক চাপ অনুভব করতে পারেন; যা দিন শেষে সমগ্র বিচারক সম্প্রদায় সম্পর্কে সমাজে নেতিবাচক ধারণা বয়ে নিয়ে আসতে পারে।

অতএব, এটি স্পষ্ট যে সুবিধার পাশাপাশি এসব প্রযুক্তির বহুল ব্যবহার আইন পেশা সম্পর্কিত বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জও তৈরি করেছে। এর মধ্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাচালিত রোবট আগামী দিনে আদালতে মানব বিচারক এবং আইনজীবীদের প্রতিস্থাপন করতে চলেছে কিনা তা এখন একটি উল্লেখযোগ্য প্রশ্ন। এ প্রযুক্তি বিচারাঙ্গনে প্রচলিত চিন্তাধারা, কাজের প্রক্রিয়া এবং বিদ্যমান আইন ও প্রবিধানের প্রয়োগকেও প্রচ-ভাবে চ্যালেঞ্জ করে। তাই অন্যভাবে আবার বলা যায়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আইন পেশার জন্য কিছু ক্ষেত্রে হুমকি এবং সম্ভাব্য ঝুঁকির কারণও বটে!

উপরিউক্ত কারণসমূহ ছাড়াও আইন পেশায় লিগ্যাল অ্যানালাইটিক্স প্রযুক্তি অন্তর্ভুক্ত করার ফলে নৈতিকতা এবং পেশাগত সততা, বৈষম্য, পক্ষপাত, তথ্য সুরক্ষা, গোপনীয়তা ইত্যাদি সম্পর্কিত নানা সমস্যা তৈরি হতে পারে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি সাধারণত পূর্বনজিরসহ মানুষের দ্বারা প্রদেয় বিরাজমান উপাত্তের মাধ্যমে প্রশিক্ষিত হয়। ফলস্বরূপ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা শুধুমাত্র পূর্ববর্তী সিদ্ধান্তগুলোর সাথে চিন্তাভাবনা এবং কাজ করার জন্য প্রশিক্ষিত হয়; যেগুলির মধ্যে ঐতিহাসিকভাবে প্রচুর পক্ষপাতিত্ব এবং বৈষম্যমূলক উপাদান রয়েছে; যার ফলে আইনের অধীনে ন্যায্যতা এবং সবার জন্য সমান সুরক্ষার নীতি লঙ্ঘনের প্রবল ঝুঁকি রয়েছে। উপরন্তু, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রায়শই সংবেদনশীল আইনি তথ্য এবং নথিতে প্রবেশাধিকার প্রয়োজন হয়। যথাযথ তথ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা এবং অননুমোদিত প্রবেশাধিকার প্রতিরোধ করা না গেলে এসব ক্ষেত্রে রাষ্ট্র বা মক্কেলের গোপনীয়তা বজায় রাখা এবং গোপনীয়তার প্রবিধান মেনে চলা অত্যন্ত দুরূহ হবে।

প্রত্যেকটি মামলার নিজস্ব স্বকিয়তা, জটিলতা, স্বতন্ত্র প্রেক্ষাপট, আবেগ, আবেদন, অবস্থা অনুধাবন এবং মানবীয় বিবিধ কারণে সাধারণ নাগরিকবৃন্দ আইনজীবী এবং বিচারকদের নিকট বুদ্ধিবিত্তিক, সৃজনশীল ও মানবিক স্বত্বার প্রয়োগের মাধ্যমে আইনি সমস্যার সমাধান প্রত্যাশা করেন।

অপরদিকে এআই এখনো মানুষের মতো সৃজনশীল চিন্তাভাবনার ব্যবহার করতে উপযুক্ত নয়, যা একজন ভালো আইন পেশাজীবী হওয়ার অন্যতম প্রধান মানদ-। সুতরাং, নব্য এই উদ্ভাবন আইন পেশাজীবীদের প্রাত্যহিক কাজ ত্বরান্বিত করার জন্য মান বজায় রেখে ও অন্যান্য আশঙ্কা দূর করে কিভাবে কল্যাণকর পদ্ধতিতে ব্যবহৃত হতে পারে, সম্ভাব্য ঝুঁকিসমূহ অনুধাবন ও নির্ধারণ, তার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার উপায় এবং সফটওয়্যারের কার্যপদ্ধতি সম্পর্কে ব্যবহারকারীদের সম্যক ধারণা থাকা আবশ্যক।

উল্লিখিত কারণে এটি স্পষ্ট যে, নতুন এআই প্রযুক্তিসমৃদ্ধ লিগ্যাল অ্যানালাইটিক্স কৌশল আইন জগতের জন্য উপকারী হতে পারে যদি না আমরা তা বিচার বিভাগের মৌলিক মূলনীতি সমুন্নত রেখে দায়িত্বশীলভাবে বিচারাঙ্গনে এর ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারি। সেক্ষেত্রে অবধারিতভাবেই আমাদের আইনের শাসনের ধারণা, মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা, বৈষম্যহীনতা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সাথে দঢ় নৈতিক দিকনির্দেশনা এবং এ প্রযুক্তির যৌক্তিক ব্যবহারকে নিশ্চিত করতে হবে।

[লেখক : আয়ারল্যান্ডের গলওয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে লিগ্যাল অ্যানালাইটিক্স বিষয়ক ডক্টরাল গবেষক; গলওয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের নির্বাচিত এথনিক মাইনরিটি অফিসার ও আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট]।

গার্মেন্টস খাতে সংকট

সরকারি হাসপাতালের টয়লেট ব্যবস্থাপনায় করুণ দশা

ডেঙ্গু থেকে বাঁচার উপায় কী

শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণের হার বাড়াতে

বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির দুর্বলতা

ইরানের কেন কৌশলগত পরিবর্তন

শিক্ষা ও মানবসম্পদ উন্নয়ন একে অন্যের পরিপূরক

রামু ট্র্যাজেডির এক যুগ

প্রত্যাশিত শিক্ষা কমিশনের প্রস্তাবিত রূপরেখা

ব্যাংক খাতের সংস্কার

শিক্ষার একটি স্থায়ী কমিশন সময়ের দাবি

ছবি

ক্ষমতা এখন ‘মব’-এর হাতে

উচ্চ ফলনশীল বারি মসুর-৮

শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে বামপন্থির উত্থান

আমন ধানে আগাম ফুল আসার কারণ

উচ্চ ফলনশীল বারি মসুর-৮

কী হবে আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ রাজনীতি

রম্যগদ্য : ‘বল করে দুর্বল...’

মধ্যপ্রাচ্যে প্রযুক্তিগত যুদ্ধ

বন্যাপরবর্তী কৃষি উৎপাদনে সময়োপযোগী সহায়তা প্রদান

গুণগত উন্নয়নই সমাজের প্রকৃত উন্নতির চাবিকাঠি

বিশেষ শিশু ও বিশেষ শিক্ষালয়

বিশ্ব ফার্মাসিস্ট দিবস

সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার অধিকার

উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি

প্রসঙ্গ : আনসার বাহিনী

শান্তির সংস্কৃতি : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

মব লিঞ্চিং আইনের শাসনের পরিপন্থি

মব জাস্টিসের মতো বর্বরতা বন্ধ হোক

বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে রাজনীতি

জাতীয় সংগীত নিয়ে বিতর্ক

জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে বিতর্ক

ভূমি অধিগ্রহণে কোনো প্রশ্ন উত্থাপিত হলে কী করবেন?

ছবি

নিবেদিত প্রাণ এক কৃষিবিজ্ঞানী

জনমনে স্বস্তি ফিরুক

দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের শিক্ষার সুযোগ

tab

উপ-সম্পাদকীয়

লিগ্যাল অ্যানালাইটিক্স ও আধুনিক প্রযুক্তি যেভাবে আইন পেশাকে বদলে দিচ্ছে

রাইসুল সৌরভ

বৃহস্পতিবার, ০৪ জুলাই ২০২৪

বিচার প্রক্রিয়া সহজতর করার জন্য অন্যান্য পেশার মতো আইন জগতেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), মেশিন লার্নিং (ML) বা যন্ত্র শিক্ষণ, ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রসেসিং (NLP) বা স্বাভাবিক ভাষা প্রক্রিয়াকরণ, প্যাটার্ন ম্যাচিং বা বিন্যাস মিলকরণ প্রযুক্তির ন্যায় আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে। যদিও ঐতিহাসিকভাবে বিচারপ্রার্থীদের দূর্দশা লাঘবে আইন এবং প্রযুক্তির অত্যাবশ্যকীয় মেলবন্ধন অতীতে দেখা যায়নি। এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয়তার পাশাপাশি পর্যাপ্ত চাহিদা থাকা সত্ত্বেও আইন পেশার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ এবং ব্যবহার উপযোগী বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবনের এতদিন অভাব ছিল। আইনের সহজাত দুর্বোধ্যতা অথবা আইনি পরিষেবার সঙ্গে খাপ খাইয়ে প্রযুক্তিকে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার জন্য সুচিন্তিত ও যথাযথ গবেষণার অভাবও এর জন্য দায়ী হতে পারে। তবে বিশেষত কোভিড-১৯ এর সময় সারা পৃথিবীব্যাপী বিচারিক প্রক্রিয়ায় আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ব্যাপকভাবে সুফল বয়ে নিয়ে আসায় আইনাঙ্গনে প্রযুক্তির ব্যবহার দারুণভাবে গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা পেয়েছে। যার ফলে এখন প্রায়শই এক্ষেত্রে নিত্য-নতুন উদ্ভাবন পরিলক্ষিত হচ্ছে।

বর্তমানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি এবং দ্রুত বিকাশমান ডিজিটাল সমাজের বিশাল স্রোতে আইনি সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানসমূহও (যেমনঃ আদালত, ল ফার্ম) এসব নতুন নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে নিজেদেরকে রূপান্তরিত করে নিচ্ছে। আধুনিক সময়ে প্রায় প্রতিটি সেক্টরেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জয়জয়কার চলছে এবং দ্রুততার সাথে এর উন্নয়ন সারা বিশ্বের বিচার ব্যবস্থার জন্য প্রভূত সুযোগ তৈরি করেছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো সর্বাধুনিক বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবন বিচারাঙ্গনে সচ্ছতা, জবাবদিহিতা, ন্যায্যতা, দ্রুত নিষ্পত্তি ও বিচারপ্রাপ্তি ইত্যাদি আনয়নের সঙ্গে সঙ্গে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মৌলিক নীতিগুলোর (যেমন- আইনের শাসন, নিরপেক্ষতা, সমতা, সুবিচার প্রভৃতি) প্রতি প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের মাধ্যমে ঐতিহ্যগত আইন পেশার চিরায়িত পরিবেশ বদলে দিতে পারে।

লিগ্যাল অ্যানালাইটিক্স বলতে সাধারণত গাণিতিক তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে আইন ব্যবস্থায় চলমান ক্রিয়াকলাপ ও উদ্যোগের সমন্বিত তথ্য প্রযুক্তিগতভাবে বিশ্লেষণের কৌশলকে বুঝায়। লিগ্যাল অ্যানালাইটিক্স বা প্রযুক্তিগতভাবে আইনি বিশ্লেষণের বিভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বর্তমান সময়ে কিছু এআই সফটওয়্যার তৈরি হয়েছে; যা মোকদ্দমা দায়েরের পূর্বেই একই প্রকৃতির বহু বছরের প্রচুর মোকদ্দমার ফলাফল গাণিতিকভাবে বিশ্লেষণ করে মোকদ্দমার সম্ভাব্য রায় সম্পর্কে পূর্বাভাস দেয়ার চেষ্টা করে। কোন কোন এআই সফটওয়্যার আবার নির্দিষ্ট একজন বিচারকের দেয়া সমস্ত রায় বিশ্লেষণ করে উক্ত বিচারকের রায়ের প্রবণতা সনাক্ত করে। অন্য কিছু প্রযুক্তি বিচারের ক্ষেত্রে ব্যবহার্য বিভিন্ন জটিল সাক্ষ্য-প্রমাণ গাণিতিকভাবে বিশ্লেষণ করে, যা মানুষের দ্বারা বিশ্লেষণ করা খুবই সময়, শ্রম ও ব্যয় সাপেক্ষ হতো। অপর কিছু সফটওয়্যার আবার বিচারিক নথির বিশাল অংশ থেকে সুনির্দিষ্ট তথ্য নিমিষে খুঁজে দিতে পারে; আইনি প্রাত্যহিক দলিলাদি মুসাবিদা করতে পারে, আইনজীবীদের চেম্বার ব্যবস্থাপনার কাজে সহায়তা করতে পারে প্রভৃতি।

এ ধরনের আধুনিক প্রযুক্তি বহু বছরের পুরনো উপাত্ত ও অন্যান্য পরিসংখ্যান ব্যবহার করে এমনকি নিজ থেকে মানুষের (আইনজীবীর) সহায়তা ছাড়াই সাধারণ কিছু বিষয়ে আইনি পরামর্শ দিতেও সক্ষম। যার ফলে বিচার কাজে আইনজীবী, বিচারক, আদালত কর্মকর্তা-কর্মচারী, বিচার প্রার্থীদের বিপুল সময়, অর্থ এবং শ্রম সাশ্রয় হতে পারে। উপরন্তু, এর মাধ্যমে নির্ভুলভাবে কার্য সম্পাদন হওয়ার সম্ভাবনা বেশি, যেখানে মানুষের মাধ্যমে সম্পন্ন যেকোন কাজেই সহজাতভাবে ভুল-ত্রুটির সম্ভাবনা থেকে যায়।

তবে ইদানীং বেশ কিছু এআই সফটওয়্যার বাস্তবে অস্তিত্ব নেই এমন কিছু মামলা-মোকদ্দমার নজির ভুলভাবে উল্লেখ করে ব্যাপকভাবে সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছে; যাকে এআইয়ের কল্পনা বা হ্যালুসিনেশন বলা হচ্ছে এবং এগুলি যাচাই-বাছাই ছাড়াই আদালতের কার্যক্রমে ব্যবহার করায় সংশ্লিষ্ট আইনজীবীগণও ভৎসনা এমনকি সাজার সম্মুখীন হয়েছেন। সুতরাং, প্রযুক্তির প্রভূত উন্নয়ন হলেও এসবাই আধুনিক প্রযুক্তি এখনও আইনাঙ্গনে পুরোপুরি গলদমুক্ত ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারেনি। হয়তো অধিক ও সুচারু গবেষণার ফলে এসব সফটওয়্যার/এআই টুলসের উপযোগিতা আইনাঙ্গনে অদূর ভবিষ্যতে আরও বাড়বে।

আজকের দিনে প্রযুক্তিতে আচ্ছন্ন ও বিজ্ঞান মনস্ক মক্কেলগণও তাদের মোকদ্দমায় আইনজীবীদের প্রমাণযোগ্য দক্ষতা, গুণমান এবং দ্রুত সময়ে মামলার আরও ভাল ফলাফল প্রত্যাশা করেন। তাই মৌলিক ও চলমান কম্পিউটার প্রযুক্তির সাথে সাথে লিগ্যাল অ্যানালাইটিক্স কৌশলের মতো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত সফটওয়্যার বিনামূল্যের আইনি সেবা সহায়তা প্রদান সংস্থা, আদালত থেকে শুরু করে বঙ বড় ল ফার্ম, কর্পোরেট অফিসসমূহের আইন বিভাগ এবং সরকারি আইনি প্রতিষ্ঠানেও জায়গা করে নিচ্ছে। এই যুগান্তকারী আবিষ্কার আইনজীবী এবং আদালত উভয়ের কাজের চাপ হ্রাস করে যেমন অধিক গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল মামলায় আগের চেয়ে পর্যাপ্ত সময় নিয়ে মনোনিবেশ ও গবেষণার সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে; ঠিক তেমনি আবার বিচারপ্রার্থী জনগণ ও রাষ্ট্রের খরচ কমিয়ে দিচ্ছে। সেই সঙ্গে উপরি হিসেবে সবাইর মূল্যবান সময় বাঁচানোর নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। ফলে বিচার বিভাগের পূর্বের চেয়ে অধিক জনবান্ধব হওয়ার পথ সুগম হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এতসব ব্যবহারিক উপযোগিতার কারণেই লিগ্যাল অ্যানালাইটিক্স প্রযুক্তি সারা বিশ্বে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। যদিও পরিতাপের বিষয় হল, দেশে ডিজিটাল বাংলাদেশ সেøাগান জনপ্রিয়তা পেলেও বিচারাঙ্গনে ডিজিটালাইজেশনের অভাব, ব্যবহারকারীদের (আইনজীবী, বিচারক ও আদালত স্টাফ) একাংশের অনাগ্রহ ও অজ্ঞতার কারণে এটি আমাদের বিচার ব্যবস্থায় এখনও পরিচিতি লাভ করেনি।

অথচ ল চেম্বার ও আদালত তাদের মক্কেলদের জন্য আরও বেশি সেবা যোগ করতে তাদের দৈনন্দিন আইনি কার্যাবলী যেমন আইন বিশ্লেষণ, গবেষণা, নজির খোঁজা, মামলা ব্যবস্থাপনা, সাক্ষ্য বিশ্লেষণ, আদেশ লেখা, স্বয়ংক্রিয় চুক্তি পর্যালোচনা, বিভিন্ন আবেদন এবং চুক্তি মুসাবিদা করা প্রভৃতি কাজে এআই সফটওয়্যার ব্যবহার করতে পারে। তবে যেহেতু এসবাই সফটওয়্যার এখনও সম্পূর্ণ নির্ভুল তথ্য-উপাত্ত প্রদানে নির্ভরযোগ্য হয়নি, তাই এ ধরনের সফটওয়্যার ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যই বিচারক ও আইনজীবীগণকে অধিক সতর্কতা অবলম্বন পেশাগত দায়িত্ব ও সেবার মান সমুন্নত রাখতে হবে।

এছাড়া নতুন এই প্রযুক্তি এমন সম্ভাবনাও তৈরি করেছে যে, যারা আইনজীবী নন, অথবা যাদের আইন পেশা পরিচালনার স্বীকৃতি-সনদ নেই তারাও চাইলে এসবাই সফটওয়্যারের সহায়তা নিয়ে বিচারপ্রার্থীদের আইনি পরামর্শ বা সেবা দিতে পারে। আধুনিক এই কম্পিউটেশনাল প্রযুক্তির বিচারপ্রার্থীদের কাছে বিভিন্ন আইনি পরিষেবাসমূহ স্বয়ংক্রিয় উপায়ে সরবরাহ করার সক্ষমতা রয়েছে। সেই সাথে দৈনন্দিন জীবনের সাধারণ আইন সম্পর্কিত জটিল সমস্যা বুঝতে এবং সেগুলোর সম্ভাব্য সমাধান প্রদান করতেও সক্ষম। তাই কারও আইনি প্রয়োজনের ক্ষেত্রে, আইনি পরামর্শ বা পরিষেবা, এমনকি স্মার্টফোন বা অন্যান্য যন্ত্রের দ্বারা অ্যাপের মাধ্যমেও গ্রাহকের দোরগোড়ায় তা পৌঁছে দেয়া সম্ভব। ফলশ্রুতিতে সেবার মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠার সুযোগ যেমন তৈরি হবে তেমনি আইন পেশার মতো অত্যন্ত নিয়ন্ত্রিত একটি পেশা লাগামহীন হয়ে মানহীন ও অপ্রয়োজনীয় পরামর্শের দরুন সাধারণ জনগণের স্বার্থহানী ঘটাতে পারে। কারণ আদালতে মামলা পরিচালনা করার সময় আইনজীবীদের নির্দিষ্ট মান এবং দক্ষতা বজায় রাখতে হয়; যেখানে আইনি পরিষেবার মান অবশ্যই অ-আইনজীবীদের দ্বারা যে বজায় থাকবে না তা বলাই বাহুল্য এবং আখেরে তা বিচারপ্রার্থীদের আইনগত অধিকার মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।

তাছাড়া আইনজীবীগণের তাদের মক্কেলকে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব এবং স্পষ্ট তথ্য প্রদান করার পেশাগত দায়-দায়িত্ব রয়েছে, যা এই অ্যাপভিত্তিক প্রক্রিয়ায় পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব নয়। অন্য দিকে কোন বিচারকের রায় দেয়ার নির্দিষ্ট প্যাটার্ন বা প্রবণতা খুঁজে বের করার ফলে বিচারকদের প্রফাইলিংয়ের মাধ্যমে আরেকটি উল্লেখযোগ্য উদ্বেগ হলো- বিচারকরা সেক্ষেত্রে তাদের দায়িত্ব চাপমুক্ত ও নির্ভীকভাবে পালন করার জন্য বাহ্যিক চাপ অনুভব করতে পারেন; যা দিন শেষে সমগ্র বিচারক সম্প্রদায় সম্পর্কে সমাজে নেতিবাচক ধারণা বয়ে নিয়ে আসতে পারে।

অতএব, এটি স্পষ্ট যে সুবিধার পাশাপাশি এসব প্রযুক্তির বহুল ব্যবহার আইন পেশা সম্পর্কিত বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জও তৈরি করেছে। এর মধ্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাচালিত রোবট আগামী দিনে আদালতে মানব বিচারক এবং আইনজীবীদের প্রতিস্থাপন করতে চলেছে কিনা তা এখন একটি উল্লেখযোগ্য প্রশ্ন। এ প্রযুক্তি বিচারাঙ্গনে প্রচলিত চিন্তাধারা, কাজের প্রক্রিয়া এবং বিদ্যমান আইন ও প্রবিধানের প্রয়োগকেও প্রচ-ভাবে চ্যালেঞ্জ করে। তাই অন্যভাবে আবার বলা যায়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আইন পেশার জন্য কিছু ক্ষেত্রে হুমকি এবং সম্ভাব্য ঝুঁকির কারণও বটে!

উপরিউক্ত কারণসমূহ ছাড়াও আইন পেশায় লিগ্যাল অ্যানালাইটিক্স প্রযুক্তি অন্তর্ভুক্ত করার ফলে নৈতিকতা এবং পেশাগত সততা, বৈষম্য, পক্ষপাত, তথ্য সুরক্ষা, গোপনীয়তা ইত্যাদি সম্পর্কিত নানা সমস্যা তৈরি হতে পারে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি সাধারণত পূর্বনজিরসহ মানুষের দ্বারা প্রদেয় বিরাজমান উপাত্তের মাধ্যমে প্রশিক্ষিত হয়। ফলস্বরূপ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা শুধুমাত্র পূর্ববর্তী সিদ্ধান্তগুলোর সাথে চিন্তাভাবনা এবং কাজ করার জন্য প্রশিক্ষিত হয়; যেগুলির মধ্যে ঐতিহাসিকভাবে প্রচুর পক্ষপাতিত্ব এবং বৈষম্যমূলক উপাদান রয়েছে; যার ফলে আইনের অধীনে ন্যায্যতা এবং সবার জন্য সমান সুরক্ষার নীতি লঙ্ঘনের প্রবল ঝুঁকি রয়েছে। উপরন্তু, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রায়শই সংবেদনশীল আইনি তথ্য এবং নথিতে প্রবেশাধিকার প্রয়োজন হয়। যথাযথ তথ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা এবং অননুমোদিত প্রবেশাধিকার প্রতিরোধ করা না গেলে এসব ক্ষেত্রে রাষ্ট্র বা মক্কেলের গোপনীয়তা বজায় রাখা এবং গোপনীয়তার প্রবিধান মেনে চলা অত্যন্ত দুরূহ হবে।

প্রত্যেকটি মামলার নিজস্ব স্বকিয়তা, জটিলতা, স্বতন্ত্র প্রেক্ষাপট, আবেগ, আবেদন, অবস্থা অনুধাবন এবং মানবীয় বিবিধ কারণে সাধারণ নাগরিকবৃন্দ আইনজীবী এবং বিচারকদের নিকট বুদ্ধিবিত্তিক, সৃজনশীল ও মানবিক স্বত্বার প্রয়োগের মাধ্যমে আইনি সমস্যার সমাধান প্রত্যাশা করেন।

অপরদিকে এআই এখনো মানুষের মতো সৃজনশীল চিন্তাভাবনার ব্যবহার করতে উপযুক্ত নয়, যা একজন ভালো আইন পেশাজীবী হওয়ার অন্যতম প্রধান মানদ-। সুতরাং, নব্য এই উদ্ভাবন আইন পেশাজীবীদের প্রাত্যহিক কাজ ত্বরান্বিত করার জন্য মান বজায় রেখে ও অন্যান্য আশঙ্কা দূর করে কিভাবে কল্যাণকর পদ্ধতিতে ব্যবহৃত হতে পারে, সম্ভাব্য ঝুঁকিসমূহ অনুধাবন ও নির্ধারণ, তার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার উপায় এবং সফটওয়্যারের কার্যপদ্ধতি সম্পর্কে ব্যবহারকারীদের সম্যক ধারণা থাকা আবশ্যক।

উল্লিখিত কারণে এটি স্পষ্ট যে, নতুন এআই প্রযুক্তিসমৃদ্ধ লিগ্যাল অ্যানালাইটিক্স কৌশল আইন জগতের জন্য উপকারী হতে পারে যদি না আমরা তা বিচার বিভাগের মৌলিক মূলনীতি সমুন্নত রেখে দায়িত্বশীলভাবে বিচারাঙ্গনে এর ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারি। সেক্ষেত্রে অবধারিতভাবেই আমাদের আইনের শাসনের ধারণা, মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা, বৈষম্যহীনতা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সাথে দঢ় নৈতিক দিকনির্দেশনা এবং এ প্রযুক্তির যৌক্তিক ব্যবহারকে নিশ্চিত করতে হবে।

[লেখক : আয়ারল্যান্ডের গলওয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে লিগ্যাল অ্যানালাইটিক্স বিষয়ক ডক্টরাল গবেষক; গলওয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের নির্বাচিত এথনিক মাইনরিটি অফিসার ও আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট]।

back to top