গাজী তারেক আজিজ
বাংলাদেশে প্রায় সব দল রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণ চায় বলে বেশ ঢালাও করে প্রচার করলেও খুব যে নিশ্চিত করেছে তা কিন্তু নয়। স্বাধীনতার পর থেকে এই পর্যন্ত দেশের প্রধানমন্ত্রী একাধিকবার একাধিক সংখ্যক নারী নির্বাচিত হয়েছেন। বিরোধী দলেও ছিলেন এবং আছেন নারী নেতৃত্ব। প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হয়েছেন নারী। যেমন স্পিকার, মিনিস্টার, পার্লামেন্টারিয়ান। সেনা, নৌ ও পুলিশ বাহিনী তথা সচিব, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিচারক তো আছেনই।
বাংলাদেশে প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি (জাপা), ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), গণফোরাম, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মননগত মিল বেশ প্রকট। এর কারণ প্রায়ই একই। আমরা যারা পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব মুছতে সক্ষম নই তাদের কাছে উদারতা কিংবা আইনি বাধ্যবাধকতা মেনে নেয়াও নিজ নিজ দল এবং ব্যক্তি বিশেষে মানসিকতার সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থান থাকাটাই এর কারণ বলে প্রাথমিকভাবে ধরে নেয়া যেতে পারে।
নারীর অংশগ্রহণ কার্যকরে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরবর্তী সময়ে একটি আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল। তা হচ্ছে আরপিও বা গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২। তারপর ধারাবাহিকভাবে বহুবার বহু পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে সর্বশেষ ২০২৩ সালে আইনটিতে সংশোধনী আনা হয়ে থাকে। তবে এই আইনটি সবচেয়ে আলোচনায় আসে বিগত ২০০৭ সালে। সেই সময়ের তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে। দুই বছরে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনা হয়েছিল এ আইনে। তখনকার সময় খুব জোরেশোরে আলোচিত হয়েছিল এই আইনটি। নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু করবার লক্ষ্যে সর্বমোট ১৪৫টি ধারার সন্নিবেশ ঘটানো হয়ে থাকে আইনটিতে।
যার সবগুলোই নির্বাচন সংশ্লিষ্ট। বিশ্লেষকদের মতে নির্বাচনের মূল ভিত্তি সংবিধান। সেই সংবিধানের অধীনেই করা হয়েছিল গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২ (রিপ্রেজেন্টেটিভ পিপলস অর্ডার ১৯৭২), যা এ পর্যন্ত অনেকবার সংস্কার হয়েছে। তবে কোনবারই কোন দল তা পরিপূর্ণভাবে না মানায় বারবার সময় দেয়া হয়েছে। তাহলে এবার যে এত এত সংস্কারের গল্প আমরা শুনতে পাচ্ছি তা কি নিছক গালগল্প হয়েই থাকছে? নাকি দেশের নাগরিকরা এবার আইন মেনে ভালো কিছু পেতে চলেছেন, তা দেখার বিষয়! ১৯৭২ সালের গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ৯০ অনুচ্ছেদে সংশোধনী অনুযায়ী ২০২০ সালের মধ্যে সব রাজনৈতিক দলের
কমিটিতে ৩৩ শতাংশ নারী সদস্য রাখার কথা থাকলেও আজ ২০২২ সালেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। তাই আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে ৩৩ শতাংশ নারী প্রতিনিধিত্ব রাখার সুস্পষ্ট বিধানসহ পূর্ণাঙ্গ আইন হিসাবে পাস করে আরপিওতেযুক্ত করার জন্য আহ্বান জানানো হয় বিভিন্ন মহল থেকে। দলগুলো নির্বাচনের আগে যে প্রতিশ্রুতি প্রদান করে পরবর্তী সময়ে ভোজবাজির মতো করে তা উল্টে যায়। যা
তাদের প্রাত্যহিক চরিত্রের মতোই দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। ধরা হয়ে থাকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রধান দুই দল কিছুটা হলেও উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রচলনে বিশ্বাসী। আদতে তা কতটুকু? তা কেবলই দেশের জনগণই জানে। আবার বাংলাদেশের মানুষের পুরুষতান্ত্রিকতাও এক্ষেত্রে অনেকাংশে দায়ী বলে ধরে নেয়া যেতে পারে।
৩৩ শতাংশ নারী অন্তর্ভুক্তি করতে গেলে একটা সুবিধা হবে যেসব রাজনৈতিক দলের নেতারা সরাসরি রাজনীতিতে সম্পৃক্ত সে-সকল দলে নেতাদের স্ত্রীকে অবলীলায় অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। আর এই ক্ষেত্রে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী অনেকাংশে এগিয়ে থাকছে। যদিও এই মুহূর্তে দলটির নিবন্ধন নেই। কারণ কৌশলগতভাবে তাদের প্রায় সব নেতাকর্মীর স্ত্রী একেকটি মহিলা শাখার সদস্য ও দায়িত্বপ্রাপ্ত। কিন্তু নির্বাচন কমিশন বিধিমালায় যেখানে স্পষ্ট আরো একটি বিধান রয়েছে আর সেটা হলো বিধর্মী বা ভিন্নধর্মীদের অংশগ্রহণও ৩৩ শতাংশ বা এক তৃতীয়াংশ রাখা বাধ্যতামূলক। সেক্ষেত্রে জামায়াত পুরোপুরি ধরাশায়ী যা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল তথা বিএনপির জন্য বেশ সহায়ক। কারণ তারা ইতোমধ্যেই দলে ভিন্নধর্মীদের ভিড়িয়েছে। আর এদিকটায় আওয়ামী লীগ বেশ এগিয়ে। কারণ শুরু থেকে আওয়ামী লীগ ধর্মনিরপেক্ষতা মূলমন্ত্রে রাজনীতি করার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠাকালীন ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি ছেঁটে ফেলেছিল। আর জামায়াত অনেক কৌশলের আশ্রয় নিয়ে হিন্দু বা সনাতনীদের নিয়ে কমিটি করলে বেশ সমালোচনা হয় তারই পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তীতে সে কমিটি গঠনের কথা তারা অস্বীকার করে বসে।
যেটা অতিসম্প্রতি হওয়ায় মানুষও মনে রেখেছে সরল নিয়মে। তবে সম্প্রতি তারা কমিটি ও দলে ভিড়িয়ে আরপিও তথা গণপ্রতিনিধিত্ব আইনের বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে থাকতে চাইছে। আর তাদের শীর্ষ নেতৃত্বের তেমনটাই ইঙ্গিত! তবে নারীর ক্ষমতায়ন যতটুকু হয়েছে রাজনীতিতে নারী অংশগ্রহণ কতটুকু হয়নি। দেশে ২য় সর্বোচ্চ ও ৩য় সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদে নারীর আসীন ঘটেছে ঠিকই মর্যাদাগতভাবে নারী কর্মক্ষেত্রে সমান সুযোগ বা ক্ষেত্রবিশেষে তারও অধিক হয়তো ভোগ করেন। কিন্তু স্বাধীনতার দীর্ঘ ৫৩ বছর পার করলেও এখনও পর্যন্ত দেশের সর্বোচ্চ পদে আসীন হতে পারেনি। অর্থাৎ বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পদে এখনো কোন নারী আসীন হতে না পারা কেবলই রাজনীতিকদের হঠকারিতার বহিঃপ্রকাশ মাত্র। বাংলাদেশের ব্যাংক, বীমা সবক্ষেত্রেই নারীদের অংশগ্রহণ। সম্প্রতি মোটর গাড়ির চালকও রয়েছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক। নিশ্চয়ই সমাজ সচেতন সবাই রাজনীতি করবেন এমনটাও কথা নয়। সবার আগ্রহ সবকিছুতে থাকে না। তথাপিও প্রয়োজনে আইন সংশোধন করে নারীদের অংশগ্রহণ কিংবা সদস্য হিসেবে দলভুক্তি করতে সংখ্যার হেরফের করা যেতে পারে। সেটা কমিয়ে বা বাড়িয়ে অন্যূন ২০-২৫ শতাংশ করাই সমীচীন মনে হচ্ছে। না হলে
আইন প্রণয়নের যথার্থতা বিনষ্ট হয়। যদিও জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরবর্তী নির্বাচিত দলের প্রাপ্ত আসন সংখ্যার অনুপাতে ৫০টি আসন সংরক্ষিত করা আছে। পাশাপাশি সাধারণ আসনেও ভোটে লড়ে নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ থাকলেও বৃহৎ সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রতিনিধিত্ব করছে কি? উল্লেখিত সংরক্ষিত ৫০ আসন হয়তো নারীদের এগিয়ে রাখছে। তাই বলে দলে প্রতিনিধিত্ব কতটুকু নিশ্চিত হচ্ছে বা কতটুকু সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্ত হচ্ছে? যদিও নির্বাচন কমিশন আইন অনুযায়ী নিবন্ধন পেতে গেলে নির্ধারিত শর্তের পাশাপাশি মোটা দাগে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বশীল হওয়ার বিকল্প না থাকলেও কীভাবে কীভাবে যেন ঠিকই পার পেয়ে যায়। অর্থাৎ নিবন্ধন পেয়ে যায়। আর এই অবস্থা যাচাই-বাছাই করার দায়িত্বও নিশ্চয়ই নির্বাচন কমিশনের। তাহলে ভূঁইফোড় দলগুলো হুমকিতে পড়তে পারে। এক অর্থে তারা পার্ট টাইম রাজনীতিবিদ। আর যাদের
একমাত্র পেশা রাজনীতি তাদেরসহ সবার সম্পদের হিসেব লিপিবদ্ধ থাকা যে খুব জরুরি। কারণ সরকারের মেয়াদ শেষ হলে দুর্নীতির নানা ফিরিস্তি শুনতে শুনতে জাতি বয়রা হওয়ার জোগাড়! তবে এ ধরনের ৩৩ শতাংশ নারী থাকা বাধ্যতামূলক করলে আরেকটি সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করতে পারে। আর তা হলো পছন্দমতো দল করার অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে পারে। আর স্বাভাবিকতই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীদের নিজস্ব চিন্তার বলয় খুব যে কাজে আসে না। সেই হিসেবে পরিবারের প্রধান পুরুষ যে দলের সদস্য হবেন তিনি অপরাপর মহিলা তথা নারী সদস্যদের নিজ দলে ভিড়তে বাধ্য করতে পারেন। আর সেক্ষেত্রে নারীর নিজস্ব
স্বকীয়তা বিনষ্ট হয়ে হুমকিতে পড়তে পারে।
রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নারীদের সঠিক মূল্যায়নের শক্তি রাজনৈতিক দলগুলোর থাকতে হবে। তাহলে নারী নেতৃত্ব এগিয়ে নেয়া সম্ভব। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুযায়ী রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের শর্ত মোতাবেক ২০২০ সালের মধ্যে ৩৩ শতাংশ নারী পদ পূরণের বিধান থাকলেও তা যে কার্যকর হয়নি সে-ও দৃশ্যমান। তবে এই বিধান বাস্তবায়ন করতে পারেনি দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগ। কার্যত দুই দলের রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়লেও নারী নেতৃত্বে অংশগ্রহণ বাড়েনি। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের নারী নেতৃত্ব রয়েছে শতকরা ১৮ শতাংশ। আর বিএনপির সব স্তরের কমিটিতে ১৫ শতাংশ নারী সদস্য রয়েছেন। একই অবস্থা ছোট ছোট সব রাজনৈতিক দলের। তারাও নিজেদের কমিটিতে ৩৩ শতাংশ নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারেনি। ঠিক কতদিনে এসব দলে নারীর নির্ধারিত কোটা পূরণ হবেÑ তা নিয়ে রয়েছে ধোঁয়াশা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশের যে কোনো গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয়ার নজিরও গড়েছেন নারীরা। রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ, মিছিল-মিটিং কিংবা আন্দোলন সংগ্রামের দৃশ্যমান উপস্থিতি থাকে তাদের। মাঠের আন্দোলনে নির্যাতন, নিপীড়ন ও জেল-জুলুমেও পিছপা হন না তারা, সাম্প্রতিক বিভিন্ন আন্দোলনেও দেখা গেছে।
সর্বশেষ ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন এই দেশের হাজার হাজার নারী। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাঠের আন্দোলনে সবসময় সরব ছিলেন তারা। তবুও নারীদের দেশের রাজনীতিতে সঠিক মূল্যায়ন হচ্ছে না। কোনো দলই আদতে নারীদের সে সুযোগ দিতে চায় না। কার্যত তাদের মুখের কথার সঙ্গে কাজের খুব একটা মিল পাওয়াও দুষ্কর।
রাজনীতিতে নারীদের সামনে আনতে ২০০৮ সালে আইনের পরিবর্তন করেছিল নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ওই সময় গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন করে রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য ২০২০ সালের মধ্যে সর্বস্তরে ৩৩ শতাংশ নারীর অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। কেন্দ্রীয় পর্যায়ে নারীদের সীমিত অংশগ্রহণ থাকলেও সব রাজনৈতিক দলের জেলা-উপজেলা পর্যায়ের কমিটিগুলো পুরুষনিয়ন্ত্রিত, সেখানে নারীদের অংশগ্রহণ অনেক কম বলেও জানা গেছে।
নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ধর্মাশ্রয়ী (ইসলামপন্থী) অধিকাংশ দলই কমিটিতে নারীদের অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক করার বিপক্ষে। তবে কয়েকটি দল বলছে, তারা পৃথক সহযোগী সংগঠন করে নারীদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিয়েছে। একাধিক দল বলছে, ইসি এই আইনে দলের নিবন্ধন বাতিল করলে আদালতে যাবে তারা, যা থেকে দৃষ্ট হয় রাজনীতিতে নারীর স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে বিরাট অন্তরায়। দেশের সংবিধানের ২৮(২) অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরের নারী-পুরুষ সমান অধিকার লাভ করিবেন।’ তাহলে রাজনৈতিক ময়দানে নারীর আসন কেন সীমিত? আবার যেটুকু বরাদ্দ করা হয়েছে, তারও সঠিক বাস্তবায়ন নেই কেন? তাহলে আমরা কি ধরে নেব সংবিধান নারী সুরক্ষা দিতে পুরোপুরি সক্ষম নয়? আর বিচার বিভাগকে বলা হয়ে থাকে সংবিধানের হেফাজতকারী। সংবিধান বলবৎ থাকা অবস্থায়ও কেন তাহলে এই বৈষম্য? নারীরা রাজপথে নেমে আন্দোলন করলেই কি সে অধিকার নিশ্চিত হবে? নাকি শুধু নারীদের আলাদা এক বা একাধিক দলের প্রয়োজনীয়তা উঠে আসে? আমরা হয়তো ভবিষ্যতে তেমন কিছুই দেখতে পাব! যে দল শুধু নারীদের কল্যাণের কথা বলবে। দাবী তুলবে। আর দাবি বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখবে। অন্যথায় তারা উপেক্ষিত-ই থেকে যাবে পূর্বের ন্যায়! তবে আরেকটি বিষয় পরিষ্কার হওয়াও জরুরি। আর তা হচ্ছে আরপিওতে নির্ধারিত মতে রাজনৈতিক দলে
৩৩ শতাংশ নারীর অংশগ্রহণের কথা বলা হলেও রাজনৈতিক দলগুলো সুকৌশলে নেতৃত্বের দিকে ঠেলে দিচ্ছে অর্থাৎ সব স্তরের কমিটিতে উক্ত অংশের অংশীজন হওয়ার কথা বলে একটা হঠকারী চাল চেলে মানুষজনকে বোকা বানিয়ে যাচ্ছে বোধ করি। কারণ পুরো একটা দলে উল্লেখিত সংখ্যক অংশগ্রহণ করা আর নেতৃত্বের মধ্যে উক্ত সংখ্যক অংশ নির্ধারিত করা যে এক নয় তা সবাই বুঝলেও রাজনৈতিক নেতারা অংকের হিসেবে তা বুঝতে চাইছেন না। আবার তাতেও কত গড়িমসি! তবে এই বিষয়টিও নিশ্চয়ই নির্বাচন কমিশন তথা সংস্কার কমিশন বিবেচনায় নিয়ে খোলাসা করবেন আশা করি।
সর্বস্তরে নারী নেতৃত্ব গড়ে তুলতে নারীদের প্রতি বৈষম্যমূলক পরিস্থিতির এখনই পরিবর্তন হওয়া সময়ের দাবি। রাষ্ট্রীয় বিধান মতে, নারীদের সমান অধিকার দেয়া হয়েছে। কিন্তু আইনের বাস্তবায়ন আজও হয়নি। সরকার প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীকে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন যা আগে হয়নি। এমনটা শুনতে পেলেও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নারীরা কেন পিছিয়ে থাকবেন? নাকি পিছিয়ে থাকতে কর্মপরিকল্পনা তৈরি করা হচ্ছে। নারীর যোগ্যতা ও দক্ষতা অনুযায়ী ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে হবে। সেটা যুগযুগান্তরের চাওয়া। নারীর অংশগ্রহণ তথা
নেতৃত্ব নিশ্চিত করা অবশ্যই আইনি নির্ধারিত পথে হওয়ার বিকল্প নেই। অথবা আলোচনা পর্যালোচনা করেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। না হলে রাজনীতি তথা সর্বত্র একটা ভারসাম্যহীন সমাজ ব্যবস্থা থিতু হয়ে পড়বে, যা কাম্য নয়।
[লেখক : অ্যাডভোকেট, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ফেনী]
গাজী তারেক আজিজ
শনিবার, ১১ জানুয়ারী ২০২৫
বাংলাদেশে প্রায় সব দল রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণ চায় বলে বেশ ঢালাও করে প্রচার করলেও খুব যে নিশ্চিত করেছে তা কিন্তু নয়। স্বাধীনতার পর থেকে এই পর্যন্ত দেশের প্রধানমন্ত্রী একাধিকবার একাধিক সংখ্যক নারী নির্বাচিত হয়েছেন। বিরোধী দলেও ছিলেন এবং আছেন নারী নেতৃত্ব। প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হয়েছেন নারী। যেমন স্পিকার, মিনিস্টার, পার্লামেন্টারিয়ান। সেনা, নৌ ও পুলিশ বাহিনী তথা সচিব, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিচারক তো আছেনই।
বাংলাদেশে প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি (জাপা), ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), গণফোরাম, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মননগত মিল বেশ প্রকট। এর কারণ প্রায়ই একই। আমরা যারা পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব মুছতে সক্ষম নই তাদের কাছে উদারতা কিংবা আইনি বাধ্যবাধকতা মেনে নেয়াও নিজ নিজ দল এবং ব্যক্তি বিশেষে মানসিকতার সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থান থাকাটাই এর কারণ বলে প্রাথমিকভাবে ধরে নেয়া যেতে পারে।
নারীর অংশগ্রহণ কার্যকরে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরবর্তী সময়ে একটি আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল। তা হচ্ছে আরপিও বা গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২। তারপর ধারাবাহিকভাবে বহুবার বহু পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে সর্বশেষ ২০২৩ সালে আইনটিতে সংশোধনী আনা হয়ে থাকে। তবে এই আইনটি সবচেয়ে আলোচনায় আসে বিগত ২০০৭ সালে। সেই সময়ের তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে। দুই বছরে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনা হয়েছিল এ আইনে। তখনকার সময় খুব জোরেশোরে আলোচিত হয়েছিল এই আইনটি। নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু করবার লক্ষ্যে সর্বমোট ১৪৫টি ধারার সন্নিবেশ ঘটানো হয়ে থাকে আইনটিতে।
যার সবগুলোই নির্বাচন সংশ্লিষ্ট। বিশ্লেষকদের মতে নির্বাচনের মূল ভিত্তি সংবিধান। সেই সংবিধানের অধীনেই করা হয়েছিল গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২ (রিপ্রেজেন্টেটিভ পিপলস অর্ডার ১৯৭২), যা এ পর্যন্ত অনেকবার সংস্কার হয়েছে। তবে কোনবারই কোন দল তা পরিপূর্ণভাবে না মানায় বারবার সময় দেয়া হয়েছে। তাহলে এবার যে এত এত সংস্কারের গল্প আমরা শুনতে পাচ্ছি তা কি নিছক গালগল্প হয়েই থাকছে? নাকি দেশের নাগরিকরা এবার আইন মেনে ভালো কিছু পেতে চলেছেন, তা দেখার বিষয়! ১৯৭২ সালের গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ৯০ অনুচ্ছেদে সংশোধনী অনুযায়ী ২০২০ সালের মধ্যে সব রাজনৈতিক দলের
কমিটিতে ৩৩ শতাংশ নারী সদস্য রাখার কথা থাকলেও আজ ২০২২ সালেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। তাই আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে ৩৩ শতাংশ নারী প্রতিনিধিত্ব রাখার সুস্পষ্ট বিধানসহ পূর্ণাঙ্গ আইন হিসাবে পাস করে আরপিওতেযুক্ত করার জন্য আহ্বান জানানো হয় বিভিন্ন মহল থেকে। দলগুলো নির্বাচনের আগে যে প্রতিশ্রুতি প্রদান করে পরবর্তী সময়ে ভোজবাজির মতো করে তা উল্টে যায়। যা
তাদের প্রাত্যহিক চরিত্রের মতোই দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। ধরা হয়ে থাকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রধান দুই দল কিছুটা হলেও উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রচলনে বিশ্বাসী। আদতে তা কতটুকু? তা কেবলই দেশের জনগণই জানে। আবার বাংলাদেশের মানুষের পুরুষতান্ত্রিকতাও এক্ষেত্রে অনেকাংশে দায়ী বলে ধরে নেয়া যেতে পারে।
৩৩ শতাংশ নারী অন্তর্ভুক্তি করতে গেলে একটা সুবিধা হবে যেসব রাজনৈতিক দলের নেতারা সরাসরি রাজনীতিতে সম্পৃক্ত সে-সকল দলে নেতাদের স্ত্রীকে অবলীলায় অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। আর এই ক্ষেত্রে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী অনেকাংশে এগিয়ে থাকছে। যদিও এই মুহূর্তে দলটির নিবন্ধন নেই। কারণ কৌশলগতভাবে তাদের প্রায় সব নেতাকর্মীর স্ত্রী একেকটি মহিলা শাখার সদস্য ও দায়িত্বপ্রাপ্ত। কিন্তু নির্বাচন কমিশন বিধিমালায় যেখানে স্পষ্ট আরো একটি বিধান রয়েছে আর সেটা হলো বিধর্মী বা ভিন্নধর্মীদের অংশগ্রহণও ৩৩ শতাংশ বা এক তৃতীয়াংশ রাখা বাধ্যতামূলক। সেক্ষেত্রে জামায়াত পুরোপুরি ধরাশায়ী যা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল তথা বিএনপির জন্য বেশ সহায়ক। কারণ তারা ইতোমধ্যেই দলে ভিন্নধর্মীদের ভিড়িয়েছে। আর এদিকটায় আওয়ামী লীগ বেশ এগিয়ে। কারণ শুরু থেকে আওয়ামী লীগ ধর্মনিরপেক্ষতা মূলমন্ত্রে রাজনীতি করার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠাকালীন ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি ছেঁটে ফেলেছিল। আর জামায়াত অনেক কৌশলের আশ্রয় নিয়ে হিন্দু বা সনাতনীদের নিয়ে কমিটি করলে বেশ সমালোচনা হয় তারই পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তীতে সে কমিটি গঠনের কথা তারা অস্বীকার করে বসে।
যেটা অতিসম্প্রতি হওয়ায় মানুষও মনে রেখেছে সরল নিয়মে। তবে সম্প্রতি তারা কমিটি ও দলে ভিড়িয়ে আরপিও তথা গণপ্রতিনিধিত্ব আইনের বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে থাকতে চাইছে। আর তাদের শীর্ষ নেতৃত্বের তেমনটাই ইঙ্গিত! তবে নারীর ক্ষমতায়ন যতটুকু হয়েছে রাজনীতিতে নারী অংশগ্রহণ কতটুকু হয়নি। দেশে ২য় সর্বোচ্চ ও ৩য় সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদে নারীর আসীন ঘটেছে ঠিকই মর্যাদাগতভাবে নারী কর্মক্ষেত্রে সমান সুযোগ বা ক্ষেত্রবিশেষে তারও অধিক হয়তো ভোগ করেন। কিন্তু স্বাধীনতার দীর্ঘ ৫৩ বছর পার করলেও এখনও পর্যন্ত দেশের সর্বোচ্চ পদে আসীন হতে পারেনি। অর্থাৎ বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পদে এখনো কোন নারী আসীন হতে না পারা কেবলই রাজনীতিকদের হঠকারিতার বহিঃপ্রকাশ মাত্র। বাংলাদেশের ব্যাংক, বীমা সবক্ষেত্রেই নারীদের অংশগ্রহণ। সম্প্রতি মোটর গাড়ির চালকও রয়েছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক। নিশ্চয়ই সমাজ সচেতন সবাই রাজনীতি করবেন এমনটাও কথা নয়। সবার আগ্রহ সবকিছুতে থাকে না। তথাপিও প্রয়োজনে আইন সংশোধন করে নারীদের অংশগ্রহণ কিংবা সদস্য হিসেবে দলভুক্তি করতে সংখ্যার হেরফের করা যেতে পারে। সেটা কমিয়ে বা বাড়িয়ে অন্যূন ২০-২৫ শতাংশ করাই সমীচীন মনে হচ্ছে। না হলে
আইন প্রণয়নের যথার্থতা বিনষ্ট হয়। যদিও জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরবর্তী নির্বাচিত দলের প্রাপ্ত আসন সংখ্যার অনুপাতে ৫০টি আসন সংরক্ষিত করা আছে। পাশাপাশি সাধারণ আসনেও ভোটে লড়ে নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ থাকলেও বৃহৎ সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রতিনিধিত্ব করছে কি? উল্লেখিত সংরক্ষিত ৫০ আসন হয়তো নারীদের এগিয়ে রাখছে। তাই বলে দলে প্রতিনিধিত্ব কতটুকু নিশ্চিত হচ্ছে বা কতটুকু সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্ত হচ্ছে? যদিও নির্বাচন কমিশন আইন অনুযায়ী নিবন্ধন পেতে গেলে নির্ধারিত শর্তের পাশাপাশি মোটা দাগে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বশীল হওয়ার বিকল্প না থাকলেও কীভাবে কীভাবে যেন ঠিকই পার পেয়ে যায়। অর্থাৎ নিবন্ধন পেয়ে যায়। আর এই অবস্থা যাচাই-বাছাই করার দায়িত্বও নিশ্চয়ই নির্বাচন কমিশনের। তাহলে ভূঁইফোড় দলগুলো হুমকিতে পড়তে পারে। এক অর্থে তারা পার্ট টাইম রাজনীতিবিদ। আর যাদের
একমাত্র পেশা রাজনীতি তাদেরসহ সবার সম্পদের হিসেব লিপিবদ্ধ থাকা যে খুব জরুরি। কারণ সরকারের মেয়াদ শেষ হলে দুর্নীতির নানা ফিরিস্তি শুনতে শুনতে জাতি বয়রা হওয়ার জোগাড়! তবে এ ধরনের ৩৩ শতাংশ নারী থাকা বাধ্যতামূলক করলে আরেকটি সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করতে পারে। আর তা হলো পছন্দমতো দল করার অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে পারে। আর স্বাভাবিকতই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীদের নিজস্ব চিন্তার বলয় খুব যে কাজে আসে না। সেই হিসেবে পরিবারের প্রধান পুরুষ যে দলের সদস্য হবেন তিনি অপরাপর মহিলা তথা নারী সদস্যদের নিজ দলে ভিড়তে বাধ্য করতে পারেন। আর সেক্ষেত্রে নারীর নিজস্ব
স্বকীয়তা বিনষ্ট হয়ে হুমকিতে পড়তে পারে।
রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নারীদের সঠিক মূল্যায়নের শক্তি রাজনৈতিক দলগুলোর থাকতে হবে। তাহলে নারী নেতৃত্ব এগিয়ে নেয়া সম্ভব। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুযায়ী রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের শর্ত মোতাবেক ২০২০ সালের মধ্যে ৩৩ শতাংশ নারী পদ পূরণের বিধান থাকলেও তা যে কার্যকর হয়নি সে-ও দৃশ্যমান। তবে এই বিধান বাস্তবায়ন করতে পারেনি দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগ। কার্যত দুই দলের রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়লেও নারী নেতৃত্বে অংশগ্রহণ বাড়েনি। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের নারী নেতৃত্ব রয়েছে শতকরা ১৮ শতাংশ। আর বিএনপির সব স্তরের কমিটিতে ১৫ শতাংশ নারী সদস্য রয়েছেন। একই অবস্থা ছোট ছোট সব রাজনৈতিক দলের। তারাও নিজেদের কমিটিতে ৩৩ শতাংশ নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারেনি। ঠিক কতদিনে এসব দলে নারীর নির্ধারিত কোটা পূরণ হবেÑ তা নিয়ে রয়েছে ধোঁয়াশা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশের যে কোনো গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয়ার নজিরও গড়েছেন নারীরা। রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ, মিছিল-মিটিং কিংবা আন্দোলন সংগ্রামের দৃশ্যমান উপস্থিতি থাকে তাদের। মাঠের আন্দোলনে নির্যাতন, নিপীড়ন ও জেল-জুলুমেও পিছপা হন না তারা, সাম্প্রতিক বিভিন্ন আন্দোলনেও দেখা গেছে।
সর্বশেষ ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন এই দেশের হাজার হাজার নারী। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাঠের আন্দোলনে সবসময় সরব ছিলেন তারা। তবুও নারীদের দেশের রাজনীতিতে সঠিক মূল্যায়ন হচ্ছে না। কোনো দলই আদতে নারীদের সে সুযোগ দিতে চায় না। কার্যত তাদের মুখের কথার সঙ্গে কাজের খুব একটা মিল পাওয়াও দুষ্কর।
রাজনীতিতে নারীদের সামনে আনতে ২০০৮ সালে আইনের পরিবর্তন করেছিল নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ওই সময় গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন করে রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য ২০২০ সালের মধ্যে সর্বস্তরে ৩৩ শতাংশ নারীর অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। কেন্দ্রীয় পর্যায়ে নারীদের সীমিত অংশগ্রহণ থাকলেও সব রাজনৈতিক দলের জেলা-উপজেলা পর্যায়ের কমিটিগুলো পুরুষনিয়ন্ত্রিত, সেখানে নারীদের অংশগ্রহণ অনেক কম বলেও জানা গেছে।
নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ধর্মাশ্রয়ী (ইসলামপন্থী) অধিকাংশ দলই কমিটিতে নারীদের অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক করার বিপক্ষে। তবে কয়েকটি দল বলছে, তারা পৃথক সহযোগী সংগঠন করে নারীদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিয়েছে। একাধিক দল বলছে, ইসি এই আইনে দলের নিবন্ধন বাতিল করলে আদালতে যাবে তারা, যা থেকে দৃষ্ট হয় রাজনীতিতে নারীর স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে বিরাট অন্তরায়। দেশের সংবিধানের ২৮(২) অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরের নারী-পুরুষ সমান অধিকার লাভ করিবেন।’ তাহলে রাজনৈতিক ময়দানে নারীর আসন কেন সীমিত? আবার যেটুকু বরাদ্দ করা হয়েছে, তারও সঠিক বাস্তবায়ন নেই কেন? তাহলে আমরা কি ধরে নেব সংবিধান নারী সুরক্ষা দিতে পুরোপুরি সক্ষম নয়? আর বিচার বিভাগকে বলা হয়ে থাকে সংবিধানের হেফাজতকারী। সংবিধান বলবৎ থাকা অবস্থায়ও কেন তাহলে এই বৈষম্য? নারীরা রাজপথে নেমে আন্দোলন করলেই কি সে অধিকার নিশ্চিত হবে? নাকি শুধু নারীদের আলাদা এক বা একাধিক দলের প্রয়োজনীয়তা উঠে আসে? আমরা হয়তো ভবিষ্যতে তেমন কিছুই দেখতে পাব! যে দল শুধু নারীদের কল্যাণের কথা বলবে। দাবী তুলবে। আর দাবি বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখবে। অন্যথায় তারা উপেক্ষিত-ই থেকে যাবে পূর্বের ন্যায়! তবে আরেকটি বিষয় পরিষ্কার হওয়াও জরুরি। আর তা হচ্ছে আরপিওতে নির্ধারিত মতে রাজনৈতিক দলে
৩৩ শতাংশ নারীর অংশগ্রহণের কথা বলা হলেও রাজনৈতিক দলগুলো সুকৌশলে নেতৃত্বের দিকে ঠেলে দিচ্ছে অর্থাৎ সব স্তরের কমিটিতে উক্ত অংশের অংশীজন হওয়ার কথা বলে একটা হঠকারী চাল চেলে মানুষজনকে বোকা বানিয়ে যাচ্ছে বোধ করি। কারণ পুরো একটা দলে উল্লেখিত সংখ্যক অংশগ্রহণ করা আর নেতৃত্বের মধ্যে উক্ত সংখ্যক অংশ নির্ধারিত করা যে এক নয় তা সবাই বুঝলেও রাজনৈতিক নেতারা অংকের হিসেবে তা বুঝতে চাইছেন না। আবার তাতেও কত গড়িমসি! তবে এই বিষয়টিও নিশ্চয়ই নির্বাচন কমিশন তথা সংস্কার কমিশন বিবেচনায় নিয়ে খোলাসা করবেন আশা করি।
সর্বস্তরে নারী নেতৃত্ব গড়ে তুলতে নারীদের প্রতি বৈষম্যমূলক পরিস্থিতির এখনই পরিবর্তন হওয়া সময়ের দাবি। রাষ্ট্রীয় বিধান মতে, নারীদের সমান অধিকার দেয়া হয়েছে। কিন্তু আইনের বাস্তবায়ন আজও হয়নি। সরকার প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীকে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন যা আগে হয়নি। এমনটা শুনতে পেলেও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নারীরা কেন পিছিয়ে থাকবেন? নাকি পিছিয়ে থাকতে কর্মপরিকল্পনা তৈরি করা হচ্ছে। নারীর যোগ্যতা ও দক্ষতা অনুযায়ী ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে হবে। সেটা যুগযুগান্তরের চাওয়া। নারীর অংশগ্রহণ তথা
নেতৃত্ব নিশ্চিত করা অবশ্যই আইনি নির্ধারিত পথে হওয়ার বিকল্প নেই। অথবা আলোচনা পর্যালোচনা করেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। না হলে রাজনীতি তথা সর্বত্র একটা ভারসাম্যহীন সমাজ ব্যবস্থা থিতু হয়ে পড়বে, যা কাম্য নয়।
[লেখক : অ্যাডভোকেট, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ফেনী]