শতদল বড়ুয়া
‘কাট্টোল পাযোগ বিঝু এজোক’Ñ অর্থাৎ, কাঁঠাল পাকবে, বিঝু বা চৈত্রসংক্রান্তি আসবে। এই চিরন্তন বচন দিয়ে শুরু করছি আমার লেখা। যখন বউ-কথা-কও পাখি ডাকতে শুরু করে, কোকিলের কুহু কুহু ধ্বনি ছড়িয়ে পড়ে, তখনই বিঝু বা চৈত্রসংক্রান্তির আগমনী বার্তা পৌঁছে যায়। বিঝুর অপেক্ষায় আবেগে ভরা দিনগুলো কাটে। কখন আসবে সেই মুহূর্ত? এমন প্রতীক্ষার মাঝে হঠাৎ চলে আসে বিঝু, যা ‘বৈসাবি’ নামে পরিচিত।
আজ রবিবার, চৈত্র মাসের ৩০ তারিখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দের শেষ দিন। কাল সোমবার থেকে শুরু হবে নতুন বছরÑ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ১ বৈশাখ। পাহাড়ি সম্প্রদায় এই দিনটিকে ‘বৈসাবি’ উৎসব হিসেবে পালন করে নানা আয়োজনের মাধ্যমে। চাকমা, মারমা, ত্রিপুরাÑ পাহাড়ের তিন সম্প্রদায় এই দিনের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে। বৈসাবি এলে জাতিগত দ্বন্দ্ব ভুলে সকলে একে অপরের সঙ্গে স্নেহ, ভালোবাসা, আর ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়। এই উৎসব যেন অহিংসা, বন্ধুত্ব, আর মৈত্রীর প্রতীক।
বৈসাবির নামকরণ
‘বৈসাবি’ নামটি তিন সম্প্রদায়ের ভাষার সম্মিলন। ‘বৈ’ মানে ‘বৈষু’ (ত্রিপুরা সম্প্রদায়), ‘সা’ মানে ‘সাংগ্রাই’ (মারমা সম্প্রদায়), আর ‘বি’ মানে ‘বিঝু’ (চাকমা সম্প্রদায়)। এই তিনটি শব্দের আদি অক্ষর মিলে গঠিত হয়েছে ‘বৈসাবি’। এখন দেখা যাক, কীভাবে এই তিন সম্প্রদায় বৈসাবি উদযাপন করে।
বৈষু : ত্রিপুরা সম্প্রদায়
পার্বত্য চট্টগ্রামের ত্রিপুরা সম্প্রদায় চৈত্রের শেষ দিনটিকে ‘বৈষু‘ বলে। হিন্দু ধর্মাবলম্বী এই সম্প্রদায় এই দিনে মন্দিরে গিয়ে সুখ-শান্তির জন্য প্রার্থনা করে। কিশোর-কিশোরীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ফুল বিতরণ করে, আর যুবক-যুবতীরা প্রিয়জনকে ফুল দিয়ে ভালোবাসার শুভেচ্ছা জানায়।
বৈষু তিন পর্বে উদযাপিত হয় : হারি বৈষু, বিষুমা বৈষু, আর বিসিকাতাল বৈষু। এই উৎসবে জাতি-ধর্মের ভেদাভেদ ভুলে সকলে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়। পাচন, সেমাই, পিঠাসহ নানা খাবারের আয়োজন থাকে। গরু-মহিষের অক্লান্ত পরিশ্রমের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে তাদের স্নান করানো হয়, গলায় ফুলের মালা পরানো হয়, এবং ধূপ-প্রদীপ জ্বেলে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়।
সাংগ্রাই : মারমা সম্প্রদায়
মারমা সম্প্রদায় বছরের শেষ দিনটিকে ‘সাংগ্রাই‘ নামে অভিহিত করে। বৈশাখের প্রথম দিনে তারা এই উৎসব পালন করে। পিঠা, পাচন, সেমাইয়ের আয়োজনে বাড়ি বাড়ি ঘুরে আনন্দে মেতে ওঠে সব বয়সের মানুষ। তবে দিনের প্রধান আকর্ষণ ‘রিলংপোয়ে’ বা জলোৎসব। এর জন্য প্যান্ডেল তৈরি করা হয়, যেখানে যুবক-যুবতীরা একে অপরের ওপর জল ছিটিয়ে আনন্দে মাতে। বয়োজ্যেষ্ঠরা বিহারে বা মন্দিরে ধর্মীয় আচার পালন করে। ছোটরা অতর্কিতে জল ছিটিয়ে সাংগ্রাইকে বিদায় জানায়।
বিঝু : চাকমা সম্প্রদায়
চাকমারা বিঝু উৎসবকে তিন পর্বে পালন করে: ফুল বিঝু (চৈত্র ২৯), মূল বিঝু (চৈত্র ৩০), এবং গজ্যাপজ্যা বিঝু (১ বৈশাখ)।
ফুল বিঝু : ভোরে স্নান করে কিশোর-কিশোরীরা ফুল সংগ্রহে বের হয়। ফুল চার ভাগে ভাগ করে এক ভাগ দিয়ে বাড়ি সাজায়, এক ভাগ নিয়ে বৌদ্ধ বিহারে গিয়ে বুদ্ধের উপাসনা করে এবং পঞ্চশীল গ্রহণ করে। আরেক ভাগ দিয়ে নদী বা পুকুরপাড়ে পূজাম-প তৈরি করে শান্তিময় জীবনের প্রার্থনা করে। বাকি ফুল প্রিয়জনকে উপহার দেয়া হয়।
মূল বিঝু : এই দিনে ঘরে ঘরে তৈরি হয় পাচন, যাতে ৩০-৪০ প্রকার তরিতরকারি মেশানো হয়। পিঠা, বিনিধানের খই, লাড়–, সেমাইয়ের আয়োজন থাকে। প্রচলিত বিশ্বাস, যত বেশি বাড়িতে পাচন খাওয়া যায়, তত বেশি মঙ্গল হয়। এই দিন সবার দরজা খোলা থাকে। অতিথিদের যথাযথ আপ্যায়ন করা হয়। সন্ধ্যায় বাড়ি, উঠান, গোশালা, আর বিহারে প্রদীপ জ্বেলে মঙ্গল কামনা করা হয়।
গজ্যাপজ্যা বিঝু : নববর্ষের প্রথম দিনে বিশ্রামের মাঝে কাটে সময়। ছোটরা বড়দের নমস্কার করে, তাদের স্নান করিয়ে আশীর্বাদ নেয়। সন্ধ্যায় বিহারে পঞ্চশীল গ্রহণের মাধ্যমে মঙ্গলময় ভবিষ্যতের প্রার্থনা করে এই পর্বের সমাপ্তি হয়।
উপসংহার :
বৈসাবি হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন গড়ে তোলে। এই উৎসব অতীতের দুঃখ, গ্লানি, বেদনা, আর বৈষম্য দূর করে মৈত্রীর সেতুবন্ধন তৈরি করে। একদিকে এটি ধর্মীয় বিধান পালন করে, অন্যদিকে সামাজিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। যদিও বৈসাবি পাহাড়ি সম্প্রদায়ের উৎসব, তবু সবার অংশগ্রহণে এটি পূর্ণতা লাভ করে।
[লেখক : প্রাবন্ধিক]
শতদল বড়ুয়া
রোববার, ১৩ এপ্রিল ২০২৫
‘কাট্টোল পাযোগ বিঝু এজোক’Ñ অর্থাৎ, কাঁঠাল পাকবে, বিঝু বা চৈত্রসংক্রান্তি আসবে। এই চিরন্তন বচন দিয়ে শুরু করছি আমার লেখা। যখন বউ-কথা-কও পাখি ডাকতে শুরু করে, কোকিলের কুহু কুহু ধ্বনি ছড়িয়ে পড়ে, তখনই বিঝু বা চৈত্রসংক্রান্তির আগমনী বার্তা পৌঁছে যায়। বিঝুর অপেক্ষায় আবেগে ভরা দিনগুলো কাটে। কখন আসবে সেই মুহূর্ত? এমন প্রতীক্ষার মাঝে হঠাৎ চলে আসে বিঝু, যা ‘বৈসাবি’ নামে পরিচিত।
আজ রবিবার, চৈত্র মাসের ৩০ তারিখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দের শেষ দিন। কাল সোমবার থেকে শুরু হবে নতুন বছরÑ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ১ বৈশাখ। পাহাড়ি সম্প্রদায় এই দিনটিকে ‘বৈসাবি’ উৎসব হিসেবে পালন করে নানা আয়োজনের মাধ্যমে। চাকমা, মারমা, ত্রিপুরাÑ পাহাড়ের তিন সম্প্রদায় এই দিনের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে। বৈসাবি এলে জাতিগত দ্বন্দ্ব ভুলে সকলে একে অপরের সঙ্গে স্নেহ, ভালোবাসা, আর ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়। এই উৎসব যেন অহিংসা, বন্ধুত্ব, আর মৈত্রীর প্রতীক।
বৈসাবির নামকরণ
‘বৈসাবি’ নামটি তিন সম্প্রদায়ের ভাষার সম্মিলন। ‘বৈ’ মানে ‘বৈষু’ (ত্রিপুরা সম্প্রদায়), ‘সা’ মানে ‘সাংগ্রাই’ (মারমা সম্প্রদায়), আর ‘বি’ মানে ‘বিঝু’ (চাকমা সম্প্রদায়)। এই তিনটি শব্দের আদি অক্ষর মিলে গঠিত হয়েছে ‘বৈসাবি’। এখন দেখা যাক, কীভাবে এই তিন সম্প্রদায় বৈসাবি উদযাপন করে।
বৈষু : ত্রিপুরা সম্প্রদায়
পার্বত্য চট্টগ্রামের ত্রিপুরা সম্প্রদায় চৈত্রের শেষ দিনটিকে ‘বৈষু‘ বলে। হিন্দু ধর্মাবলম্বী এই সম্প্রদায় এই দিনে মন্দিরে গিয়ে সুখ-শান্তির জন্য প্রার্থনা করে। কিশোর-কিশোরীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ফুল বিতরণ করে, আর যুবক-যুবতীরা প্রিয়জনকে ফুল দিয়ে ভালোবাসার শুভেচ্ছা জানায়।
বৈষু তিন পর্বে উদযাপিত হয় : হারি বৈষু, বিষুমা বৈষু, আর বিসিকাতাল বৈষু। এই উৎসবে জাতি-ধর্মের ভেদাভেদ ভুলে সকলে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়। পাচন, সেমাই, পিঠাসহ নানা খাবারের আয়োজন থাকে। গরু-মহিষের অক্লান্ত পরিশ্রমের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে তাদের স্নান করানো হয়, গলায় ফুলের মালা পরানো হয়, এবং ধূপ-প্রদীপ জ্বেলে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়।
সাংগ্রাই : মারমা সম্প্রদায়
মারমা সম্প্রদায় বছরের শেষ দিনটিকে ‘সাংগ্রাই‘ নামে অভিহিত করে। বৈশাখের প্রথম দিনে তারা এই উৎসব পালন করে। পিঠা, পাচন, সেমাইয়ের আয়োজনে বাড়ি বাড়ি ঘুরে আনন্দে মেতে ওঠে সব বয়সের মানুষ। তবে দিনের প্রধান আকর্ষণ ‘রিলংপোয়ে’ বা জলোৎসব। এর জন্য প্যান্ডেল তৈরি করা হয়, যেখানে যুবক-যুবতীরা একে অপরের ওপর জল ছিটিয়ে আনন্দে মাতে। বয়োজ্যেষ্ঠরা বিহারে বা মন্দিরে ধর্মীয় আচার পালন করে। ছোটরা অতর্কিতে জল ছিটিয়ে সাংগ্রাইকে বিদায় জানায়।
বিঝু : চাকমা সম্প্রদায়
চাকমারা বিঝু উৎসবকে তিন পর্বে পালন করে: ফুল বিঝু (চৈত্র ২৯), মূল বিঝু (চৈত্র ৩০), এবং গজ্যাপজ্যা বিঝু (১ বৈশাখ)।
ফুল বিঝু : ভোরে স্নান করে কিশোর-কিশোরীরা ফুল সংগ্রহে বের হয়। ফুল চার ভাগে ভাগ করে এক ভাগ দিয়ে বাড়ি সাজায়, এক ভাগ নিয়ে বৌদ্ধ বিহারে গিয়ে বুদ্ধের উপাসনা করে এবং পঞ্চশীল গ্রহণ করে। আরেক ভাগ দিয়ে নদী বা পুকুরপাড়ে পূজাম-প তৈরি করে শান্তিময় জীবনের প্রার্থনা করে। বাকি ফুল প্রিয়জনকে উপহার দেয়া হয়।
মূল বিঝু : এই দিনে ঘরে ঘরে তৈরি হয় পাচন, যাতে ৩০-৪০ প্রকার তরিতরকারি মেশানো হয়। পিঠা, বিনিধানের খই, লাড়–, সেমাইয়ের আয়োজন থাকে। প্রচলিত বিশ্বাস, যত বেশি বাড়িতে পাচন খাওয়া যায়, তত বেশি মঙ্গল হয়। এই দিন সবার দরজা খোলা থাকে। অতিথিদের যথাযথ আপ্যায়ন করা হয়। সন্ধ্যায় বাড়ি, উঠান, গোশালা, আর বিহারে প্রদীপ জ্বেলে মঙ্গল কামনা করা হয়।
গজ্যাপজ্যা বিঝু : নববর্ষের প্রথম দিনে বিশ্রামের মাঝে কাটে সময়। ছোটরা বড়দের নমস্কার করে, তাদের স্নান করিয়ে আশীর্বাদ নেয়। সন্ধ্যায় বিহারে পঞ্চশীল গ্রহণের মাধ্যমে মঙ্গলময় ভবিষ্যতের প্রার্থনা করে এই পর্বের সমাপ্তি হয়।
উপসংহার :
বৈসাবি হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন গড়ে তোলে। এই উৎসব অতীতের দুঃখ, গ্লানি, বেদনা, আর বৈষম্য দূর করে মৈত্রীর সেতুবন্ধন তৈরি করে। একদিকে এটি ধর্মীয় বিধান পালন করে, অন্যদিকে সামাজিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। যদিও বৈসাবি পাহাড়ি সম্প্রদায়ের উৎসব, তবু সবার অংশগ্রহণে এটি পূর্ণতা লাভ করে।
[লেখক : প্রাবন্ধিক]