জিয়াউদ্দীন আহমেদ
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দুর্নীতির মাত্রা ও ব্যাপকতা বোঝাতে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বেশ কিছুদিন আগে উল্লেখ করে বলেছিলেন, বিদেশে পড়তে যাওয়া ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে একজনের একটি সেমিস্টারের টিউশন ফি হিসেবে ৪০০ কোটি টাকা বিদেশে পাঠানো হয়েছে। কথাটি অবাস্তব ও উদ্ভট প্রতীয়মান হওয়ায় গুরুত্ব না দিয়ে এড়িয়ে যাই। কিন্তু দেশবাসীকে ঈদের শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ ইউনূস বিষয়টির পুনরুল্লেখ করেন। প্রধান উপদেষ্টার মুখ থেকে কথাটি পুনরায় শোনার পর আমার অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান নিয়ে সন্দেহ জেগেছে। এমন ঘটনা যে হতে পারে তা প্রেস সচিবের মুখ থেকে শোনার পর বিশ্বাস হয়নি, এখন মনে হচ্ছে হতে পারে। কারণ প্রধান উপদেষ্টা অসত্য কথা কোনভাবেই দেশবাসীকে জানাবেন না। প্রেস সচিব অর্থ পাচারের এই তথ্য ফাঁস করেছেন বিদেশে পাচার করা অর্থ দেশে ফেরত আনার জন্য গঠিত টাস্কফোর্সের সভায়, এই সভায় প্রধান উপদেষ্টাও উপস্থিত ছিলেন।
সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা এনবিআর বিদেশে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের জন্য ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রেরিত অর্থের পরিসংখ্যান সংগ্রহ করেছে, প্রাপ্ত পরিসংখ্যান থেকেই জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান এই তথ্য সরবরাহ করেছেন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান নিশ্চয়ই সঠিক তথ্য পরিবেশন করেছেন এবং প্রেস সচিব বা প্রধান উপদেষ্টাও অধিকতর নিশ্চিত হয়েই তা দেশবাসীকে অবহিত করেছেন। আমি পরিবেশিত তথ্য নিয়ে দ্বিধান্বিত থাকলেও তথ্য পরিবেশনকারী উক্ত তিনজনের জ্ঞান-গরিমার ওপর জনগণের অগাধ বিশ্বাস আছে। বিশ্বাস আর বাস্তবতার বিরাট পার্থক্যের সংকট থেকে উত্তরণের কোন পথ খুঁজে না পেয়ে পরিশেষে প্রাসঙ্গিক কিছু কথা নিয়ে পাঠকের দ্বারে উপস্থিত হয়েছি। সরকারের উক্ত তিনজনের কেউ ঘটনার সঙ্গে জড়িত কারো নাম-ঠিকানা উল্লেখ করেননি; তদন্তের স্বার্থে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নাম উল্লেখ করা হয়নি বলে প্রেস সচিব জানিয়েছেন। কিন্তু তথ্যটির সত্যাসত্য নিরূপনে এতদিন লাগার কথা নয়, কেন লাগছে তা-ও রহস্যময়।
আমি ১৯৮১ সালের মার্চ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকে চাকরি করেছি, কিন্তু বিদেশে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের জন্য অর্থ প্রেরণের প্রক্রিয়া-পদ্ধতি সম্পর্কে কোন প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারিনি, কারণ কাজটির সম্পাদন বাণিজ্যিক ব্যাংক বা তপশিলি ব্যাংকগুলোর ওপর বাংলাদেশ ব্যাংক ছেড়ে দিয়েছে। পরিদর্শন বিভাগে কাজ না করায় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর এই অর্থ প্রেরণ সংশ্লিষ্ট কর্মকা- নিয়েও সম্যক ধারণা লাভ করার সুযোগ পাইনি। শুধু এই লেখাটির জন্য আমাকে পড়তে হয়েছে, জানতে হয়েছে। আগ্রহী যে কোন ব্যক্তি যে কোন ব্যাংকের বৈদেশিক বিনিময় শাখায় গিয়ে এসব তথ্য সংগ্রহ করতে পারবেন, বিষয়টি পোপনীয় নয়। যারা বিদেশে পড়তে যায় তারা মোটামুটি মেধাবী, তাদের আইইএলটিএস, জিআরই, জিএমএটি, টিওএফইএল ইত্যাদি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। এছাড়া এসএসসি, এইচএসসি বা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট না থাকলে বিদেশের নামকরা কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া যায় না। উপরিল্লিখিত পরীক্ষার ভালো ফলাফলসহ আবেদন করা হলেই যে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তা গ্রহণ করবে তারও কোন নিশ্চয়তা নেই।
কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন ছাত্র বা ছাত্রীর ভর্তি নিশ্চিত হলে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় তা কনফার্মেশন অব অ্যাক্সেপট্যান্স লেটার বা কনফার্মেশন অব এনরোলমেন্ট বা ভর্তির নিশ্চয়তা সংবলিত চিঠি দিয়ে জানাবে; এই লেটারে প্রতি সেমিস্টার বা কোর্সে কত টাকার টিউশন ফি দিতে হবে তারও উল্লেখ থাকে। অনার্স বা মাস্টার্স সম্পন্ন করতে মোট কত টাকা লাগবে তা সহজেই বের করা সম্ভব। প্রতি সেমিস্টারে বিশ্ববিদ্যালয়ভেদে ৬ হাজার থেকে ১৫ হাজার মার্কিন ডলার টিউশন ফি দিতে হয়। অখ্যাত কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফি আরও কম। আবার অন্যদিকে আমেরিকার কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতি সেমিস্টারে ২০ হাজার মার্কিন ডলারেরও বেশি টিউশন ফি দিতে হয়; তাই বলে ৪০০ কোটি বা ৩.৩৬ কোটি মার্কিন ডলার নয়। বছরে সর্বোচ্চ চারটি সেমিস্টার থাকতে পারে। নরওয়ে, সুইডেন, জার্মানি, ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া, চেক প্রজাতন্ত্র প্রভৃতি দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উচ্চতর শিক্ষায় বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে টিউশন ফি নেই, থাকলেও অতি সামান্য। থাকা-খাওয়ার খরচ আলাদা। দেশভেদে থাকা-খাওয়ার খরচ কমবেশি হয়ে থাকে, তবে প্রতি মাসে সর্বোচ্চ দুই হাজার মার্কিন ডলার লাগার কথা, এর বেশি নয়; দুর্নীতিগ্রস্ত পরিবারের সন্তানদের হাত খরচের হিসাব করা কঠিন। থাকা-খাওয়ার খরচের হিসাব আমাদের আজকের আলোচ্য বিষয় নয়, আমাদের আলোচ্য বিষয় কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফি।
ধনী ঘরের সন্তান ব্যতীত অন্য ছাত্রছাত্রীরা অধ্যয়নের পাশাপাশি পার্ট টাইম চাকরি করে থাকে। তাই সব অভিভাবককে শিক্ষার্থীর জন্য নিয়মিত অর্থ প্রেরণ করার প্রয়োজন হয় না। অনেক শিক্ষার্থী বৃত্তির টাকা দিয়ে লেখাপড়া করে থাকে। এই শিক্ষার্থীরাই লেখাপড়া শেষ করে উচ্চতর বেতনে চাকরি করে দেশে ডলার পাঠায়। ছাত্র থাকাকালীন এদের টিউশন ফি ও থাকা খাওয়ার খরচ প্রেরণ করা হয় ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে। বিদেশগামী প্রতি শিক্ষার্থীকে সংশ্লিষ্ট কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির কাগজপত্রাদি নিয়ে যে কোন তপশিলি ব্যাংকের বৈদেশিক শাখায় অ্যাকাউন্ট খুলতে হয়, এই অ্যাকাউন্টকে বলা হয় ‘স্টুডেন্ট ফাইল’ এবং এই অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর টিউশন ফি ও থাকা-খাওয়ার খরচ পাঠানো হয়। থাকা-খাওয়ার খরচ পাঠানো হয় শিক্ষার্থীর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে আর টিউশন ফি পাঠানো হয় সংশ্লিষ্ট কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টে। ভুলক্রমে বেশি অর্থ প্রেরিত হয়ে গেলে কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রেরিত অতিরিক্ত অর্থ আবার বাংলাদেশে প্রেরকের অ্যাকাউন্টে ফেরত পাঠিয়ে দেবে, শিক্ষার্থীকে দেবে না।
একজন শিক্ষার্থীর এক সেমিস্টারের টিউশন ফি কখনো ৩.৩৬ কোটি মার্কিন ডলার বা ৪০০ কোটি টাকা হতে পারে না। অন্তর্বর্তী সরকার বলছে, এই অর্থ টিউশন ফির নামে পাচার হয়েছে। সরকারের কথা সত্য হলে পাচার করা অর্থ গ্রহণ করেছে কোন একটি কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় যদি সত্যি সত্যি এত বিপুল পরিমাণ অর্থ গ্রহণ করে থাকে তা তো পাচার নয়, অবাস্তব হলেও তা হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফি। স্বচ্ছ ট্রান্সফার, কোন রাখঢাক নেই। এই অর্থ তো অন্য কারো হাতে যাওয়ার কোন সুযোগই নেই। প্রেরক যদি সংশ্লিষ্ট কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিক হন তাহলে এভাবে পাচার করা সম্ভব। কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রতি টিউশন ফির চাহিদাপত্র প্রেরণ করে থাকে, ব্যাংক চাহিদাপত্র মোতাবেক টিউশন ফি প্রেরণ করে। তবে প্রশ্ন আছে, এবং প্রশ্নটি হচ্ছেÑ এত বিপুল পরিমাণ টিউশন ফির অস্তিত্ব পৃথিবীতে না থাকা সত্ত্বেও ব্যাংক তা যাচাই না করে পাঠাল কেন? এই রেমিট্যান্সের তথ্য নিশ্চয়ই বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানো হয়েছে, বা বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে তা শনাক্ত হওয়ার কথা। এছাড়া বিষয়টি এনবিআরের জানার আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের জানার কথা। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিনিয়ত অফসাইট এবং অনসাইট সুপারভিশনের মাধ্যমে তপশিলি ব্যাংকের কার্যক্রম মনিটরিং করে থাকে। এমন একটি অস্বাভাবিক রেমিট্যান্স বাংলাদেশ ব্যাংকের অগোচরে থাকার কথা নয়।
প্রধান উপদেষ্টা সদ্য প্রকাশিত দুর্নীতির শ্বেতপত্র থেকে উল্লেখ করেছেন যে, বিগত ১৫ বছরে ২৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে। শুধু সরকারপ্রধান নন, ব্যাংকিং সেক্টর থেকে ১৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিদেশে পাচার হওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন বর্তমান গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। কিন্তু এসব হিসাব ধারণা বা অনুমাননির্ভর। অনুমান বা ধারণা দিয়ে কোন কিছু প্রতিষ্ঠা করা যায় না; কারণ শ্বেতপত্র বলছে, দুর্নীতি নিয়ে গাওয়া কাহিনী কোনভাবেই প্রমাণক দ্বারা সমর্থিত নয়। তাই শ্বেতপত্র মনের মাধুরী মিশিয়ে রচিত অনুমিত কল্পকাহিনী। অনুমিত কল্পকাহিনী বলেই পাচার করা অর্থের পরিমাণ কীভাবে নিরূপিত হয়েছে তার ব্যাখ্যা কোথাও পাওয়া যায় না।
ইন্টারেস্টিং বিষয় হচ্ছে এই শ্বেতপত্র বিগত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়নের জয়গানও করেছে। দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে ১২ জন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদের প্রণীত শ্বেতপত্র উল্লেখ করেছে যে, বাংলাদেশে যে অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে তাতে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে গ্র্যাজুয়েশন লাভের সব মানদ- পূরণ করেছে; এর অর্থ হচ্ছে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দেশে অভাবনীয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দুর্নীতিও হয়েছে; তবে দুর্নীতি তো সব সরকারের আমলেই হয়েছে। বিএনপির সরকারের আমলে বাংলাদেশ বেশ কয়েকবার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। দুর্নীতি অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও হচ্ছে। ক্ষমতায় থাকলে দলবাজদের দুর্নীতির বিচার হয় না, বিচার হয় ক্ষমতা হারালে। অবশ্য বিচার হলেও কোন সমস্যা নেই, আবার ক্ষমতায় এলে সব মামলায় বেকসুর খালাস পাওয়া সম্ভব। এইক্ষেত্রে দুর্নীতিবাজদের কোন কারসাজি নেই, আদালতের মাধ্যমেই তারা অপরাধী হন, আবার আদালতের মাধ্যমেই সাফসুতরো হয়ে যান, জনগণ আবার ভোট দিয়ে ‘মার্কা’কে জয়ী করে, তারা নিজ দলের নেতাদের কখনো দুর্নীতিবাজ মনে করে না।
বিদেশে অধ্যয়নরত একজন শিক্ষার্থীর এক সেমিস্টারের টিউশন ফি ৪০০ কোটি টাকা পাচার হওয়া সম্পর্কিত যে অবাস্তব ও অস্বাভাবিক রেমিট্যান্সের তথ্য প্রেস সচিব বা প্রধান উপদেষ্টা দিয়েছেন তার মধ্যে একটি গ্যাপ থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। তদন্ত হচ্ছে, সত্য জানার জন্য আমরা সবাই উদগ্রীব। কিন্তু সত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে কোন তথ্যের গোয়েবলীয় প্রচারণা স্বৈরাচারী সরকারদের সত্য ঢাকার অপকৌশলের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, এতে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর জনগণের আস্থা নষ্ট হচ্ছে।
[লেখক : সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক ]
জিয়াউদ্দীন আহমেদ
রোববার, ২০ এপ্রিল ২০২৫
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দুর্নীতির মাত্রা ও ব্যাপকতা বোঝাতে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বেশ কিছুদিন আগে উল্লেখ করে বলেছিলেন, বিদেশে পড়তে যাওয়া ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে একজনের একটি সেমিস্টারের টিউশন ফি হিসেবে ৪০০ কোটি টাকা বিদেশে পাঠানো হয়েছে। কথাটি অবাস্তব ও উদ্ভট প্রতীয়মান হওয়ায় গুরুত্ব না দিয়ে এড়িয়ে যাই। কিন্তু দেশবাসীকে ঈদের শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ ইউনূস বিষয়টির পুনরুল্লেখ করেন। প্রধান উপদেষ্টার মুখ থেকে কথাটি পুনরায় শোনার পর আমার অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান নিয়ে সন্দেহ জেগেছে। এমন ঘটনা যে হতে পারে তা প্রেস সচিবের মুখ থেকে শোনার পর বিশ্বাস হয়নি, এখন মনে হচ্ছে হতে পারে। কারণ প্রধান উপদেষ্টা অসত্য কথা কোনভাবেই দেশবাসীকে জানাবেন না। প্রেস সচিব অর্থ পাচারের এই তথ্য ফাঁস করেছেন বিদেশে পাচার করা অর্থ দেশে ফেরত আনার জন্য গঠিত টাস্কফোর্সের সভায়, এই সভায় প্রধান উপদেষ্টাও উপস্থিত ছিলেন।
সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা এনবিআর বিদেশে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের জন্য ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রেরিত অর্থের পরিসংখ্যান সংগ্রহ করেছে, প্রাপ্ত পরিসংখ্যান থেকেই জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান এই তথ্য সরবরাহ করেছেন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান নিশ্চয়ই সঠিক তথ্য পরিবেশন করেছেন এবং প্রেস সচিব বা প্রধান উপদেষ্টাও অধিকতর নিশ্চিত হয়েই তা দেশবাসীকে অবহিত করেছেন। আমি পরিবেশিত তথ্য নিয়ে দ্বিধান্বিত থাকলেও তথ্য পরিবেশনকারী উক্ত তিনজনের জ্ঞান-গরিমার ওপর জনগণের অগাধ বিশ্বাস আছে। বিশ্বাস আর বাস্তবতার বিরাট পার্থক্যের সংকট থেকে উত্তরণের কোন পথ খুঁজে না পেয়ে পরিশেষে প্রাসঙ্গিক কিছু কথা নিয়ে পাঠকের দ্বারে উপস্থিত হয়েছি। সরকারের উক্ত তিনজনের কেউ ঘটনার সঙ্গে জড়িত কারো নাম-ঠিকানা উল্লেখ করেননি; তদন্তের স্বার্থে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নাম উল্লেখ করা হয়নি বলে প্রেস সচিব জানিয়েছেন। কিন্তু তথ্যটির সত্যাসত্য নিরূপনে এতদিন লাগার কথা নয়, কেন লাগছে তা-ও রহস্যময়।
আমি ১৯৮১ সালের মার্চ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকে চাকরি করেছি, কিন্তু বিদেশে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের জন্য অর্থ প্রেরণের প্রক্রিয়া-পদ্ধতি সম্পর্কে কোন প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারিনি, কারণ কাজটির সম্পাদন বাণিজ্যিক ব্যাংক বা তপশিলি ব্যাংকগুলোর ওপর বাংলাদেশ ব্যাংক ছেড়ে দিয়েছে। পরিদর্শন বিভাগে কাজ না করায় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর এই অর্থ প্রেরণ সংশ্লিষ্ট কর্মকা- নিয়েও সম্যক ধারণা লাভ করার সুযোগ পাইনি। শুধু এই লেখাটির জন্য আমাকে পড়তে হয়েছে, জানতে হয়েছে। আগ্রহী যে কোন ব্যক্তি যে কোন ব্যাংকের বৈদেশিক বিনিময় শাখায় গিয়ে এসব তথ্য সংগ্রহ করতে পারবেন, বিষয়টি পোপনীয় নয়। যারা বিদেশে পড়তে যায় তারা মোটামুটি মেধাবী, তাদের আইইএলটিএস, জিআরই, জিএমএটি, টিওএফইএল ইত্যাদি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। এছাড়া এসএসসি, এইচএসসি বা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট না থাকলে বিদেশের নামকরা কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া যায় না। উপরিল্লিখিত পরীক্ষার ভালো ফলাফলসহ আবেদন করা হলেই যে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তা গ্রহণ করবে তারও কোন নিশ্চয়তা নেই।
কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন ছাত্র বা ছাত্রীর ভর্তি নিশ্চিত হলে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় তা কনফার্মেশন অব অ্যাক্সেপট্যান্স লেটার বা কনফার্মেশন অব এনরোলমেন্ট বা ভর্তির নিশ্চয়তা সংবলিত চিঠি দিয়ে জানাবে; এই লেটারে প্রতি সেমিস্টার বা কোর্সে কত টাকার টিউশন ফি দিতে হবে তারও উল্লেখ থাকে। অনার্স বা মাস্টার্স সম্পন্ন করতে মোট কত টাকা লাগবে তা সহজেই বের করা সম্ভব। প্রতি সেমিস্টারে বিশ্ববিদ্যালয়ভেদে ৬ হাজার থেকে ১৫ হাজার মার্কিন ডলার টিউশন ফি দিতে হয়। অখ্যাত কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফি আরও কম। আবার অন্যদিকে আমেরিকার কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতি সেমিস্টারে ২০ হাজার মার্কিন ডলারেরও বেশি টিউশন ফি দিতে হয়; তাই বলে ৪০০ কোটি বা ৩.৩৬ কোটি মার্কিন ডলার নয়। বছরে সর্বোচ্চ চারটি সেমিস্টার থাকতে পারে। নরওয়ে, সুইডেন, জার্মানি, ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া, চেক প্রজাতন্ত্র প্রভৃতি দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উচ্চতর শিক্ষায় বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে টিউশন ফি নেই, থাকলেও অতি সামান্য। থাকা-খাওয়ার খরচ আলাদা। দেশভেদে থাকা-খাওয়ার খরচ কমবেশি হয়ে থাকে, তবে প্রতি মাসে সর্বোচ্চ দুই হাজার মার্কিন ডলার লাগার কথা, এর বেশি নয়; দুর্নীতিগ্রস্ত পরিবারের সন্তানদের হাত খরচের হিসাব করা কঠিন। থাকা-খাওয়ার খরচের হিসাব আমাদের আজকের আলোচ্য বিষয় নয়, আমাদের আলোচ্য বিষয় কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফি।
ধনী ঘরের সন্তান ব্যতীত অন্য ছাত্রছাত্রীরা অধ্যয়নের পাশাপাশি পার্ট টাইম চাকরি করে থাকে। তাই সব অভিভাবককে শিক্ষার্থীর জন্য নিয়মিত অর্থ প্রেরণ করার প্রয়োজন হয় না। অনেক শিক্ষার্থী বৃত্তির টাকা দিয়ে লেখাপড়া করে থাকে। এই শিক্ষার্থীরাই লেখাপড়া শেষ করে উচ্চতর বেতনে চাকরি করে দেশে ডলার পাঠায়। ছাত্র থাকাকালীন এদের টিউশন ফি ও থাকা খাওয়ার খরচ প্রেরণ করা হয় ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে। বিদেশগামী প্রতি শিক্ষার্থীকে সংশ্লিষ্ট কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির কাগজপত্রাদি নিয়ে যে কোন তপশিলি ব্যাংকের বৈদেশিক শাখায় অ্যাকাউন্ট খুলতে হয়, এই অ্যাকাউন্টকে বলা হয় ‘স্টুডেন্ট ফাইল’ এবং এই অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর টিউশন ফি ও থাকা-খাওয়ার খরচ পাঠানো হয়। থাকা-খাওয়ার খরচ পাঠানো হয় শিক্ষার্থীর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে আর টিউশন ফি পাঠানো হয় সংশ্লিষ্ট কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টে। ভুলক্রমে বেশি অর্থ প্রেরিত হয়ে গেলে কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রেরিত অতিরিক্ত অর্থ আবার বাংলাদেশে প্রেরকের অ্যাকাউন্টে ফেরত পাঠিয়ে দেবে, শিক্ষার্থীকে দেবে না।
একজন শিক্ষার্থীর এক সেমিস্টারের টিউশন ফি কখনো ৩.৩৬ কোটি মার্কিন ডলার বা ৪০০ কোটি টাকা হতে পারে না। অন্তর্বর্তী সরকার বলছে, এই অর্থ টিউশন ফির নামে পাচার হয়েছে। সরকারের কথা সত্য হলে পাচার করা অর্থ গ্রহণ করেছে কোন একটি কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় যদি সত্যি সত্যি এত বিপুল পরিমাণ অর্থ গ্রহণ করে থাকে তা তো পাচার নয়, অবাস্তব হলেও তা হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফি। স্বচ্ছ ট্রান্সফার, কোন রাখঢাক নেই। এই অর্থ তো অন্য কারো হাতে যাওয়ার কোন সুযোগই নেই। প্রেরক যদি সংশ্লিষ্ট কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিক হন তাহলে এভাবে পাচার করা সম্ভব। কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রতি টিউশন ফির চাহিদাপত্র প্রেরণ করে থাকে, ব্যাংক চাহিদাপত্র মোতাবেক টিউশন ফি প্রেরণ করে। তবে প্রশ্ন আছে, এবং প্রশ্নটি হচ্ছেÑ এত বিপুল পরিমাণ টিউশন ফির অস্তিত্ব পৃথিবীতে না থাকা সত্ত্বেও ব্যাংক তা যাচাই না করে পাঠাল কেন? এই রেমিট্যান্সের তথ্য নিশ্চয়ই বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানো হয়েছে, বা বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে তা শনাক্ত হওয়ার কথা। এছাড়া বিষয়টি এনবিআরের জানার আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের জানার কথা। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিনিয়ত অফসাইট এবং অনসাইট সুপারভিশনের মাধ্যমে তপশিলি ব্যাংকের কার্যক্রম মনিটরিং করে থাকে। এমন একটি অস্বাভাবিক রেমিট্যান্স বাংলাদেশ ব্যাংকের অগোচরে থাকার কথা নয়।
প্রধান উপদেষ্টা সদ্য প্রকাশিত দুর্নীতির শ্বেতপত্র থেকে উল্লেখ করেছেন যে, বিগত ১৫ বছরে ২৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে। শুধু সরকারপ্রধান নন, ব্যাংকিং সেক্টর থেকে ১৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিদেশে পাচার হওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন বর্তমান গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। কিন্তু এসব হিসাব ধারণা বা অনুমাননির্ভর। অনুমান বা ধারণা দিয়ে কোন কিছু প্রতিষ্ঠা করা যায় না; কারণ শ্বেতপত্র বলছে, দুর্নীতি নিয়ে গাওয়া কাহিনী কোনভাবেই প্রমাণক দ্বারা সমর্থিত নয়। তাই শ্বেতপত্র মনের মাধুরী মিশিয়ে রচিত অনুমিত কল্পকাহিনী। অনুমিত কল্পকাহিনী বলেই পাচার করা অর্থের পরিমাণ কীভাবে নিরূপিত হয়েছে তার ব্যাখ্যা কোথাও পাওয়া যায় না।
ইন্টারেস্টিং বিষয় হচ্ছে এই শ্বেতপত্র বিগত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়নের জয়গানও করেছে। দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে ১২ জন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদের প্রণীত শ্বেতপত্র উল্লেখ করেছে যে, বাংলাদেশে যে অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে তাতে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে গ্র্যাজুয়েশন লাভের সব মানদ- পূরণ করেছে; এর অর্থ হচ্ছে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দেশে অভাবনীয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দুর্নীতিও হয়েছে; তবে দুর্নীতি তো সব সরকারের আমলেই হয়েছে। বিএনপির সরকারের আমলে বাংলাদেশ বেশ কয়েকবার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। দুর্নীতি অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও হচ্ছে। ক্ষমতায় থাকলে দলবাজদের দুর্নীতির বিচার হয় না, বিচার হয় ক্ষমতা হারালে। অবশ্য বিচার হলেও কোন সমস্যা নেই, আবার ক্ষমতায় এলে সব মামলায় বেকসুর খালাস পাওয়া সম্ভব। এইক্ষেত্রে দুর্নীতিবাজদের কোন কারসাজি নেই, আদালতের মাধ্যমেই তারা অপরাধী হন, আবার আদালতের মাধ্যমেই সাফসুতরো হয়ে যান, জনগণ আবার ভোট দিয়ে ‘মার্কা’কে জয়ী করে, তারা নিজ দলের নেতাদের কখনো দুর্নীতিবাজ মনে করে না।
বিদেশে অধ্যয়নরত একজন শিক্ষার্থীর এক সেমিস্টারের টিউশন ফি ৪০০ কোটি টাকা পাচার হওয়া সম্পর্কিত যে অবাস্তব ও অস্বাভাবিক রেমিট্যান্সের তথ্য প্রেস সচিব বা প্রধান উপদেষ্টা দিয়েছেন তার মধ্যে একটি গ্যাপ থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। তদন্ত হচ্ছে, সত্য জানার জন্য আমরা সবাই উদগ্রীব। কিন্তু সত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে কোন তথ্যের গোয়েবলীয় প্রচারণা স্বৈরাচারী সরকারদের সত্য ঢাকার অপকৌশলের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, এতে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর জনগণের আস্থা নষ্ট হচ্ছে।
[লেখক : সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক ]