শঙ্কর প্রসাদ দে
রোম বিমানবন্দরে অপেক্ষমাণ বাসে চাপলাম ১৪ জন। বেশির ভাগই সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী। উঠেই ড্রাইভারকে ঠিকানা দিয়ে বললাম সে যেন এই বাজারের সামনে দিয়ে যায়। ড্রাইভার বলল, তার জন্য সামান্য ঘুরপথ হয়, তবু সে চেষ্টা করবে। মিনিট-দশেক চলার পর বুঝলাম রোম কেন পর্যটকদের প্রথম পছন্দ।
আজকের যে রাষ্ট্রব্যবস্থা এটির প্রথম উন্মেষ ঘটেছিল গ্রিসের এথেন্স ও রোমে। অবশ্য শহরকেন্দ্রিক কয়েক লাখ লোকের উন্নত জীবন ব্যবস্থাপনার তাগিদ থেকে এসব নগর রাষ্ট্রের উৎপত্তি। মোটামুটি খ্রিস্টপূর্ব ৮ম শতক থেকে খ্রিস্টীয় ৪র্থ শতক পর্যন্ত এই সভ্যতার বিকাশকাল। আজকে পশ্চিমা গণতন্ত্রের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ হয়েছিল প্রাচীন গ্রিস ও রোমে।
দু-পাশের বিস্তীর্ণ গ্রামীণ জনপদ অতিক্রম করার পর দেখা মিলল একেবারে প্রাচীন রোম। ইতালিয়ানরা নিজেদের ঐতিহ্য নিয়ে এতই সচেতন রাজবাড়ী, সরকারি অফিস, কারাগারসহ সবকিছুই সংরক্ষণ করা হচ্ছে দু-হাজার বছর ধরে। শহরের কাছাকাছি আসতেই মাথার ওপর দীর্ঘ এক ড্রেনেজ দেখে বুঝলাম এই ড্রেন দিয়ে পুরো শহরে পানি সরবরাহ করা হতো। অবশ্য বহু প্রাচীন নিদর্শন ধ্বংস হয়ে গেছে কালের প্রয়োজনে। কিছু কিছু সংরক্ষণ করা হচ্ছে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে। স্থাপনাগুলোর ইটের রং আকার ও প্লাস্টারহীন গাঁথুনি থেকে ধারণা করা যায় প্রাচীন রোমের প্রকৌশলীরা গ্রীষ্ম এবং শীতের তাপ নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ঠ সচেতন ছিল। দেয়ালের পুরুত্ব থেকে বোঝা যায় গ্রীষ্মে গৃহাভ্যন্তর শীতল রাখার কৌশল এদের জানা ছিল।
গ্রীষ্মের বিকেল। রাস্তার দু-পাশে ফুটবল মাঠ। বিশ^ ফুটবলে ল্যাতিন আমেরিকার পর ইতালির অবস্থান। দেশটি পৃথিবীখ্যাত বহু ফুটবল প্রতিভার জন্ম ও বিকাশের লালনভূমি। সর্বকালের সেরা ফুটবলার ম্যারাডোনার বিকাশ ঘটেছে মূলত ইতালির শীর্ষক্লাব নেপোলিতে। ড্রাইভার এবার ঘুরপথ ধরল। ইংরেজিতে বলল, একজন যাত্রীর অনুরোধে ‘ফ্লোরি স্কয়ার’ হয়ে যাচ্ছে। রোমের সৌন্দর্য ও ঐতিহ্য দেখতে একেবারে সামনের সিটে বসেছিলাম। অনেকক্ষণ পর চোখে পড়ল এক সুউচ্চ স্ট্যাচু। ড্রাইভার ইশারা করতেই বুঝলাম এটি জিওদার্নো ব্রুনোর। এমনিতে তিনি দীর্ঘদেহি ছিলেন। ইশারায় কয়েক মিনিট দাঁড়াতে বললাম। খুলে গেলে আমার মনের দরজা। পশ্চিমা সভ্যতার আজকের সবচে শক্তিশালী শাখা মহাকাশবিজ্ঞানকে সুনির্দিষ্ট পথ প্রদর্শন করেছেন এই জ্যোতির্বিদ। বলে রাখা ভালো ১৬১০ সালে গ্যালিলিও টেলিস্কোপ আবিষ্কারের পর জ্যোর্তিবিদ্যা ও জ্যোতিষশাস্ত্র থেকে পৃথক হয়ে জ্যোর্তিবিজ্ঞানের দুরন্ত পথ চলা শুরু হয়।
একটু পেছনে অর্থাৎ অন্তত এরিস্টটল পর্যন্ত ফিরে না তাকালে হয় না। খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ শতক। প্লেটোর একাডেমিতে পড়তে পড়তে এরিস্টটল বুঝলেন পৃথিবী চ্যাপ্টা ধারণাটি ভুল। পৃথিবী গোল বলেই জাহাজের অগ্রভাগ প্রথম দেখা যায়। গোল বলেই চন্দ্রগ্রহণ হয়।
কেটে গেল আরও ৫শ বছর। টলেমির জন্ম ১০০ খ্রিস্টাব্দে। তিনি বললেন এরিস্টটল পুরো সত্য বোঝেননি। পৃথিবী গোল এবং পৃথিবীকে কেন্দ্র করে সূর্যসহ মহাবিশে^র সমস্ত গ্রহ-নক্ষত্র অনবরত ঘুরছে। মহাবিশে^র সবকিছু ঘুরছে বক্তব্য সঠিক হলেও পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরছে মর্মে টলেমির বক্তব্য ছিল ভুল। পোলিশ জ্যোর্তিবিদ ও গণিতবিদ ১৫ শতাব্দীতে এসে বললেন আসলে সবকিছু সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। দীর্ঘ প্রায় দেড় হাজার বছরের ভুল পথ থেকে জ্যোর্তিবিজ্ঞান সঠিক পথের সন্ধান পেল। সূর্যকেন্দ্রিক হোলিওসেন্থিক মডেল বিজ্ঞানীদের সামনে আসে ১৫৪৩ সালে কোপার্নিকাসের মৃত্যুর মাত্র কয়েকদিন আগে।
ব্রুনোর জন্ম ১৫৪৮ সালে ইতালিতে। যৌবনে হয়েছিলেন পাদ্রি। গির্জার বই ঘাটতে গিয়ে কোপার্নিকাসের ‘দি রিভিøউশন ওরিবিয়াম কোলেসটিয়াম’ গ্রন্থটি খুলে দিল ব্রুনোর চিন্তার দিগন্ত। কোপার্নিকাস কিন্তু রাতের কোটি কোটি গ্রহ-নক্ষত্র সম্পর্কে ষ্পষ্ট কিছু বললেন না, ব্রুনো বললেন সূর্যকে কেন্দ্র করে সূর্য পরিবারের গ্রহ-উপগ্রহ ঘুরছে এটা ঠিক এবং সূর্যের মতো মিলিয়ন মিলিয়ন সৌর পরিবার মহাবিশে^ বিদ্যমান। এই সৌর পরিবারগুলোই আমরা রাতের আকাশে দেখে থাকি। ব্রুনো বললেন, সৌর পরিবারের কেন্দ্র সূর্য, কিন্তু মহাবিশে^র একক কোন কেন্দ্রবিন্দু নেই। ব্রুনোর এই বক্তব্য স্পষ্টত বাইবেলে বর্ণিত সৃষ্টিতত্ত্বকে অগ্রাহ্য করে। শুরু হলো ধর্মীয় অন্ধবিশ^াস আর বিজ্ঞানমনস্কতার লড়াই।
ব্রুনোকে প্রতারণা করে সুইজারল্যান্ড থেকে রোমে নিয়ে আসা হলো। ব্যস, অতঃপর বন্দী করা হলো। ১৫৯৩ থেকে শুরু হলো ব্রুনোর জেল-জীবন। বিচার শুরু হলো। ব্রুনোকে তথ্য-প্রমাণ দিয়ে বক্তব্য প্রমাণ করতে বলা হলো। ব্রুনোর সময় তো টেলিস্কোপ আবিষ্কৃত হয়নি। দার্শনিক এবং জ্যোর্তিবিদ হিসেবে প্রকৃতিকে নিবিড় পর্যবেক্ষণ করে ব্রুনো বুঝেছিলেন মিলিয়ন মিলিয়ন সৌরজগৎ নিয়ে অসীম মহাবিশ^। তিনি এ-ও বলেছিলেন অন্য কোন সৌরজগতে পৃথিবীর মতো গ্রহ, চাঁদের মতো উপগ্রহ, এমনকি মানুষের মতো উন্নত প্রজাতি, সভ্যতা থাকার সম্ভাবনা আছে।
৭ বছর ধরে অব্যাহত নির্যাতন ও জেরার মুখে ব্রুনো বক্তব্য প্রত্যাহারে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেছিলেন, যে কোন পরিণতির জন্য তিনি প্রস্তুত। তিনি ভুল নন বরং বিচারক ধর্মযাজকরাই ভুল। চিরকুমার ব্রুনোর অনমনীয়তায় ক্ষুব্ধ হয়ে তাকে কম কষ্টকর মৃত্যুদ- দেয়া হয়। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ব্রুনো শান্ত অবিচল। কাঠের খুঁটি দিয়ে তৈরি হলো শশ্মানের মঞ্চ। ব্রুনোর স্ট্যাচুটি যেখানে স্থাপন করা হয়েছে সেখানে হাজির করা হলো ব্রুনোকে। ১৬০০ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি, প্রকাশ্য দিবালোকে ব্রুনোকে শ্মশানের খুঁটির সঙ্গে বাঁধা হলো। জিহ্বায় পেরেক ঢুকিয়ে মুখ বন্ধ করা হলো, যেন চিৎকার করে কথা বলতে না পারে। শত শত মানুষের সামনে অগ্নিসংযোগ করার পরও যাজক বিচারকরা ধৈর্য ধরতে রাজি ছিল না। অর্ধদগ্ধ ব্রুনোকে মঞ্চ থেকে নামিয়ে দড়ি বেঁধে বহুদূর টেনেহিঁচড়ে প্রদর্শিত হলো ঈশ^রদ্রোহীর পরিণতি।
ব্রুনোর মূর্তিটি দেখতে দেখতে কয়েক মিনিটের জন্য হারিয়ে গিয়েছিলাম ভাবনার অতল গহ্বরে। ভাবছিলাম ধর্মের আবির্ভাব না হলে মানবসভ্যতা আজ হয়তো কয়েক হাজার বছর এগিয়ে থাকত। এরপরও সুখকর কথা হলো গ্যালিলিও ব্রুনোর মৃত্যুদ-ের মাত্র ১০ বছর ১৬১০ সালে টেলিস্কোপ আবিষ্কার করে যখন আকাশে চোখ রাখলেন বুঝলেন ব্রুনোর কথাই ঠিক। মহাবিশ^ অসীম ও অনন্ত। এর কোন শেষ নেই।
[লেখক : আইনজীবী, আপিল বিভাগ]
শঙ্কর প্রসাদ দে
রোববার, ২০ এপ্রিল ২০২৫
রোম বিমানবন্দরে অপেক্ষমাণ বাসে চাপলাম ১৪ জন। বেশির ভাগই সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী। উঠেই ড্রাইভারকে ঠিকানা দিয়ে বললাম সে যেন এই বাজারের সামনে দিয়ে যায়। ড্রাইভার বলল, তার জন্য সামান্য ঘুরপথ হয়, তবু সে চেষ্টা করবে। মিনিট-দশেক চলার পর বুঝলাম রোম কেন পর্যটকদের প্রথম পছন্দ।
আজকের যে রাষ্ট্রব্যবস্থা এটির প্রথম উন্মেষ ঘটেছিল গ্রিসের এথেন্স ও রোমে। অবশ্য শহরকেন্দ্রিক কয়েক লাখ লোকের উন্নত জীবন ব্যবস্থাপনার তাগিদ থেকে এসব নগর রাষ্ট্রের উৎপত্তি। মোটামুটি খ্রিস্টপূর্ব ৮ম শতক থেকে খ্রিস্টীয় ৪র্থ শতক পর্যন্ত এই সভ্যতার বিকাশকাল। আজকে পশ্চিমা গণতন্ত্রের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ হয়েছিল প্রাচীন গ্রিস ও রোমে।
দু-পাশের বিস্তীর্ণ গ্রামীণ জনপদ অতিক্রম করার পর দেখা মিলল একেবারে প্রাচীন রোম। ইতালিয়ানরা নিজেদের ঐতিহ্য নিয়ে এতই সচেতন রাজবাড়ী, সরকারি অফিস, কারাগারসহ সবকিছুই সংরক্ষণ করা হচ্ছে দু-হাজার বছর ধরে। শহরের কাছাকাছি আসতেই মাথার ওপর দীর্ঘ এক ড্রেনেজ দেখে বুঝলাম এই ড্রেন দিয়ে পুরো শহরে পানি সরবরাহ করা হতো। অবশ্য বহু প্রাচীন নিদর্শন ধ্বংস হয়ে গেছে কালের প্রয়োজনে। কিছু কিছু সংরক্ষণ করা হচ্ছে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে। স্থাপনাগুলোর ইটের রং আকার ও প্লাস্টারহীন গাঁথুনি থেকে ধারণা করা যায় প্রাচীন রোমের প্রকৌশলীরা গ্রীষ্ম এবং শীতের তাপ নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ঠ সচেতন ছিল। দেয়ালের পুরুত্ব থেকে বোঝা যায় গ্রীষ্মে গৃহাভ্যন্তর শীতল রাখার কৌশল এদের জানা ছিল।
গ্রীষ্মের বিকেল। রাস্তার দু-পাশে ফুটবল মাঠ। বিশ^ ফুটবলে ল্যাতিন আমেরিকার পর ইতালির অবস্থান। দেশটি পৃথিবীখ্যাত বহু ফুটবল প্রতিভার জন্ম ও বিকাশের লালনভূমি। সর্বকালের সেরা ফুটবলার ম্যারাডোনার বিকাশ ঘটেছে মূলত ইতালির শীর্ষক্লাব নেপোলিতে। ড্রাইভার এবার ঘুরপথ ধরল। ইংরেজিতে বলল, একজন যাত্রীর অনুরোধে ‘ফ্লোরি স্কয়ার’ হয়ে যাচ্ছে। রোমের সৌন্দর্য ও ঐতিহ্য দেখতে একেবারে সামনের সিটে বসেছিলাম। অনেকক্ষণ পর চোখে পড়ল এক সুউচ্চ স্ট্যাচু। ড্রাইভার ইশারা করতেই বুঝলাম এটি জিওদার্নো ব্রুনোর। এমনিতে তিনি দীর্ঘদেহি ছিলেন। ইশারায় কয়েক মিনিট দাঁড়াতে বললাম। খুলে গেলে আমার মনের দরজা। পশ্চিমা সভ্যতার আজকের সবচে শক্তিশালী শাখা মহাকাশবিজ্ঞানকে সুনির্দিষ্ট পথ প্রদর্শন করেছেন এই জ্যোতির্বিদ। বলে রাখা ভালো ১৬১০ সালে গ্যালিলিও টেলিস্কোপ আবিষ্কারের পর জ্যোর্তিবিদ্যা ও জ্যোতিষশাস্ত্র থেকে পৃথক হয়ে জ্যোর্তিবিজ্ঞানের দুরন্ত পথ চলা শুরু হয়।
একটু পেছনে অর্থাৎ অন্তত এরিস্টটল পর্যন্ত ফিরে না তাকালে হয় না। খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ শতক। প্লেটোর একাডেমিতে পড়তে পড়তে এরিস্টটল বুঝলেন পৃথিবী চ্যাপ্টা ধারণাটি ভুল। পৃথিবী গোল বলেই জাহাজের অগ্রভাগ প্রথম দেখা যায়। গোল বলেই চন্দ্রগ্রহণ হয়।
কেটে গেল আরও ৫শ বছর। টলেমির জন্ম ১০০ খ্রিস্টাব্দে। তিনি বললেন এরিস্টটল পুরো সত্য বোঝেননি। পৃথিবী গোল এবং পৃথিবীকে কেন্দ্র করে সূর্যসহ মহাবিশে^র সমস্ত গ্রহ-নক্ষত্র অনবরত ঘুরছে। মহাবিশে^র সবকিছু ঘুরছে বক্তব্য সঠিক হলেও পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরছে মর্মে টলেমির বক্তব্য ছিল ভুল। পোলিশ জ্যোর্তিবিদ ও গণিতবিদ ১৫ শতাব্দীতে এসে বললেন আসলে সবকিছু সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। দীর্ঘ প্রায় দেড় হাজার বছরের ভুল পথ থেকে জ্যোর্তিবিজ্ঞান সঠিক পথের সন্ধান পেল। সূর্যকেন্দ্রিক হোলিওসেন্থিক মডেল বিজ্ঞানীদের সামনে আসে ১৫৪৩ সালে কোপার্নিকাসের মৃত্যুর মাত্র কয়েকদিন আগে।
ব্রুনোর জন্ম ১৫৪৮ সালে ইতালিতে। যৌবনে হয়েছিলেন পাদ্রি। গির্জার বই ঘাটতে গিয়ে কোপার্নিকাসের ‘দি রিভিøউশন ওরিবিয়াম কোলেসটিয়াম’ গ্রন্থটি খুলে দিল ব্রুনোর চিন্তার দিগন্ত। কোপার্নিকাস কিন্তু রাতের কোটি কোটি গ্রহ-নক্ষত্র সম্পর্কে ষ্পষ্ট কিছু বললেন না, ব্রুনো বললেন সূর্যকে কেন্দ্র করে সূর্য পরিবারের গ্রহ-উপগ্রহ ঘুরছে এটা ঠিক এবং সূর্যের মতো মিলিয়ন মিলিয়ন সৌর পরিবার মহাবিশে^ বিদ্যমান। এই সৌর পরিবারগুলোই আমরা রাতের আকাশে দেখে থাকি। ব্রুনো বললেন, সৌর পরিবারের কেন্দ্র সূর্য, কিন্তু মহাবিশে^র একক কোন কেন্দ্রবিন্দু নেই। ব্রুনোর এই বক্তব্য স্পষ্টত বাইবেলে বর্ণিত সৃষ্টিতত্ত্বকে অগ্রাহ্য করে। শুরু হলো ধর্মীয় অন্ধবিশ^াস আর বিজ্ঞানমনস্কতার লড়াই।
ব্রুনোকে প্রতারণা করে সুইজারল্যান্ড থেকে রোমে নিয়ে আসা হলো। ব্যস, অতঃপর বন্দী করা হলো। ১৫৯৩ থেকে শুরু হলো ব্রুনোর জেল-জীবন। বিচার শুরু হলো। ব্রুনোকে তথ্য-প্রমাণ দিয়ে বক্তব্য প্রমাণ করতে বলা হলো। ব্রুনোর সময় তো টেলিস্কোপ আবিষ্কৃত হয়নি। দার্শনিক এবং জ্যোর্তিবিদ হিসেবে প্রকৃতিকে নিবিড় পর্যবেক্ষণ করে ব্রুনো বুঝেছিলেন মিলিয়ন মিলিয়ন সৌরজগৎ নিয়ে অসীম মহাবিশ^। তিনি এ-ও বলেছিলেন অন্য কোন সৌরজগতে পৃথিবীর মতো গ্রহ, চাঁদের মতো উপগ্রহ, এমনকি মানুষের মতো উন্নত প্রজাতি, সভ্যতা থাকার সম্ভাবনা আছে।
৭ বছর ধরে অব্যাহত নির্যাতন ও জেরার মুখে ব্রুনো বক্তব্য প্রত্যাহারে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেছিলেন, যে কোন পরিণতির জন্য তিনি প্রস্তুত। তিনি ভুল নন বরং বিচারক ধর্মযাজকরাই ভুল। চিরকুমার ব্রুনোর অনমনীয়তায় ক্ষুব্ধ হয়ে তাকে কম কষ্টকর মৃত্যুদ- দেয়া হয়। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ব্রুনো শান্ত অবিচল। কাঠের খুঁটি দিয়ে তৈরি হলো শশ্মানের মঞ্চ। ব্রুনোর স্ট্যাচুটি যেখানে স্থাপন করা হয়েছে সেখানে হাজির করা হলো ব্রুনোকে। ১৬০০ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি, প্রকাশ্য দিবালোকে ব্রুনোকে শ্মশানের খুঁটির সঙ্গে বাঁধা হলো। জিহ্বায় পেরেক ঢুকিয়ে মুখ বন্ধ করা হলো, যেন চিৎকার করে কথা বলতে না পারে। শত শত মানুষের সামনে অগ্নিসংযোগ করার পরও যাজক বিচারকরা ধৈর্য ধরতে রাজি ছিল না। অর্ধদগ্ধ ব্রুনোকে মঞ্চ থেকে নামিয়ে দড়ি বেঁধে বহুদূর টেনেহিঁচড়ে প্রদর্শিত হলো ঈশ^রদ্রোহীর পরিণতি।
ব্রুনোর মূর্তিটি দেখতে দেখতে কয়েক মিনিটের জন্য হারিয়ে গিয়েছিলাম ভাবনার অতল গহ্বরে। ভাবছিলাম ধর্মের আবির্ভাব না হলে মানবসভ্যতা আজ হয়তো কয়েক হাজার বছর এগিয়ে থাকত। এরপরও সুখকর কথা হলো গ্যালিলিও ব্রুনোর মৃত্যুদ-ের মাত্র ১০ বছর ১৬১০ সালে টেলিস্কোপ আবিষ্কার করে যখন আকাশে চোখ রাখলেন বুঝলেন ব্রুনোর কথাই ঠিক। মহাবিশ^ অসীম ও অনন্ত। এর কোন শেষ নেই।
[লেখক : আইনজীবী, আপিল বিভাগ]