মিজানুর রহমান
বৈশ্বিক ও জাতীয় রাজনীতির পালাবদলের কারণে বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে এখন অনেকটাই মন্দাভাব বিরাজ করছে। গত ১৫ বছর বিগত সরকার ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেশের অর্থনীতির বাস্তব চিত্র আড়াল করেছিল। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যখন দেশের দায়িত্বভার গ্রহণ করে, ততক্ষণে দেশের অর্থনীতি অনেকটাই ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। অর্থনীতিতে যখন এরূপ টালমাটাল অবস্থা, ঠিক তখন ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট পেশ করবেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অর্থ উপদেষ্টা।
পত্রিকা ও টেলিভিশনের বিভিন্ন সংবাদ থেকে যতটুকু জানা গেছে এবারের বাজেটের পরিমাণ প্রায় ৮ লাখ কোটি টাকা। বাজেটের সাইজ যেমনই হোক না কেন, যেহেতু এবারের বাজেট প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, ফলে খুব স্বাভাবিকভাবে এটা ধরেই নেয়া যায় এবারের বাজেট কোনভাবেই বিগত দিনগুলোর গতানুগতিক বাজেটের মতো হবে না। বিগত বছরগুলোতে দেখা গিয়েছে বাজেট প্রণয়নের আগে সুশীল সমাজ ও বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের সঙ্গে নামকাওয়াস্তে সংলাপ করা হতো। ফলশ্রুতিতে, বাজেটে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির বাস্তব চিত্র প্রতিফলিত হতো না। এবার যেহেতু পরিস্থিতি ভিন্ন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ইতোমধ্যেই বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে বাজেটের বিভিন্ন স্ট্রাটেজিক বিষয়াদি নিয়ে সংলাপ করছেন, ফলে আশা করা যাচ্ছে এবারের বাজেট যথেষ্ট কার্যকর ও গঠনমূলক হবে।
এবারের বাজেটে অর্থ উপদেষ্টাকে রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রার দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। দেশের ১৮ কোটি মানুষের মাঝে মাত্র ৩০ লাখ করদাতা প্রতি বছর কর দেন। বাজেটে নিয়মিত করদাতাদের জন্য বিশেষ প্রণোদনা রেখে, করযোগ্য করদাতার সংখ্যা বাড়ানোর জন্য বিশেষ নির্দেশনা থাকা উচিত। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে এক্ষেত্রে আরও বেশি সচেষ্ট হতে হবে। প্রয়োজনে আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সহায়তায় কার কয়টি বাড়ি আছে, কার ব্যাংক একাউন্টে কত টাকা আছে, কার কয়টি ক্রেডিট কার্ড আছে, কার নামে কয়টি মোবাইল সিম আছে, মোবাইল ফোনে কে কত টাকা ব্যয় করছে, কে বছরে কয়বার বিদেশ ভ্রমণ করেছেন ইত্যাদির তথ্যের ভিত্তিতে খুব সহজেই করযোগ্য করদাতার সংখ্যা বাড়ানো যেতে পারে।
প্রতি বছর আমাদের জাতীয় বাজেট বাস্তবায়নের পথে মূল প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে ঘাটতি বাজেট। আসলে, আমাদের বাজেট বাস্তবায়ন অনেকাংশেই নির্ভর করছে রাজস্ব কর্মকর্তাদের স্বদিচ্ছার ওপর। ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক থেকে শুরু করে প্রতিটি স্তরের কর্মকর্তার যেমন টার্গেট থাকে, ঠিক তেমনিভাবে রাজস্ব কর্মকর্তাদেরও টার্গেট ঠিক করে দিতে হবে। প্রয়োজনে তাদের জরিমানা করার ক্ষমতা প্রদান করতে হবে। মূসক বিভাগকেও কঠোর হতে হবে। দেশে মাত্র ৪.৫ লাখ প্রতিষ্ঠান মূসক প্রদান করে। এভাবে একটা দেশ চলতে পারে না, যারা কর দেবে না, মূসক দেবে না, তাদের চিহ্নিত করতে হবে, প্রয়োজনে নোটিস দিতে হবে, আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যেই রাজস্ব কর্মকর্তা কাজে অবহেলা করবে, তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে হবে। মোট কথা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে তাদের সক্ষমতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করতে হবে।
রাজস্ব বাড়াতে সব ধরনের তামাকজাত পণ্যের ওপর বর্ধিত হারে বিশেষ সম্পূরক করের প্রস্তাব করা যেতে পারে। এর ফলে সরকার শুধু এক তামাকজাত দ্রব্যাদি থেকেই প্রায় সাড়ে দশ হাজার কোটি টাকা আদায় করতে পারে। বাজারে একধরনের ই-সিগারেট পাওয়া যাচ্ছে, যেগুলোর বস্তুত: কোন আইনগত বৈধতা নেই। এবারের বাজেটে ই-সিগারেট ও করের আওতায় আনতে হবে। বর্ধিত করারোপের ফলে একদিকে যেমন সরকার বিশাল রাজস্ব আদায় করবে, তেমনি অনেকে নিরুৎসাহিত হয়ে ধূমপান ত্যাগ করতে পারে।
বিগত সরকার কোন প্রকারের ফিজিবিলিটি স্টাডি করা ছাড়াই বেশ কিছু মেগা প্রজেক্ট শুরু করেছিল। প্রকৃতপক্ষে, মেট্রোরেল আর পদ্মা সেতু বাদে আর একটারও কোন উপযোগিতা নেই। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী টানেলের দৈনিক অপারেশনাল ব্যয় মেটাতে গিয়ে এখন হিমশিম খেতে হচ্ছে। বাজেটে চলমান প্রকল্পগুলোর জন্য বরাদ্দ রাখা দরকার এবং পাশাপাশি নতুন করে আর কোন বড় প্রকল্প হাত দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে এবং এ-সংক্রান্ত সরকারের পরিকল্পনা বাজেটে তুলে ধরতে হবে।
রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের সড়কব্যবস্থা একেবরেই নাজুক। সড়কে প্রতিদিন ১ কোটির বেশি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলছে যার কোনটারই লাইসেন্স নেই। এভাবে লাইসেন্সবিহীন যানবাহন সড়কে অবাধে চলতে দেয়া ঠিক না। এগুলোকে লাইসেন্সের আওতায় আনা দরকার। অটোরিকশার ব্যাটারি আমদানিতে অধিক হারে কর বসাতে হবে। অনেকেই বলতে পারে এত কঠোর হওয়া ঠিক নাÑ কিন্তু মুক্তবাজার অর্থনীতিতে যেখানে কঠোর হওয়া দরকার, সেখানে কঠোর হতেই হবে। আবেগ দিয়ে দেশ চালানো যাবে না, দেশের মঙ্গলের স্বার্থে যেকোন কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল প্রায়শই কৃষি খাতের ওপর থেকে ভর্তুকি তুলে নেয়ার যে প্রস্তাব করে তা কোনভাবেই মানা যাবে না। বস্তুতপক্ষে সূক্ষ্মভাবে চিন্তা করলে দেখা যাবে কৃষিতে এটা কোন ভর্তুকি না বরং কৃষিতে এই অর্থ বিনিয়োগ করা হয়। বাংলাদেশ কৃষিনির্ভর দেশ হওয়ায় কৃষির ওপর সরকারের সুনজর সব সময়ই থাকতে হবে। আমরা কোভিডের সময়ও দেখেছি অর্থনীতির সবগুলো খাত যখন নি¤œমুখী ছিল, কৃষি খাত ঠিক তখনও ঊর্ধ্বমুখী ছিল। কৃষি খাত আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে যে কী বিশাল ভূমিকা রাখছে তা হয়তোবা খালি চোখে বোঝা যাবে না। আমাদের যদি কৃষিপণ্য আমদানি করতে হতো তাহলে বিশাল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হতো শুধু কৃষিপণ্য আমদানি করতেই। সবদিক বিবেচনা করে কৃষি খাতে ভর্তুকি এবারের বাজেটেও অব্যাহত রাখা উচিত।
বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের সঙ্গে কমবেশি প্রায় ১ কোটি বিনিয়োগকারী জড়িত। আগের সরকারের আমলে দরবেশ এবং তাদের প্রেতাত্মাদের কু-নজরে শেয়ার বাজার থেকে হাজার-হাজার কোটি টাকার পাচার করা হয়েছিল। সর্বস্বান্ত হয়ে পথে বসেছিল হাজার হাজার ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী। এবারের বাজেটে যদি পুঁজিবাজার-সংক্রান্ত বিশেষ কোন প্রণোদনার ঘোষণা থাকে তাহলে বিনিয়োগকারীরা নতুন করে বিনিয়োগে উৎসাহিত হবে।
আমাদের স্থানীয় সরকারকে শুধু সরকারের আর্থিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল না হয়ে বরং নিজেদের অভ্যন্তরীণ আয় বাড়ানোর দিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখতে হবে। দেশের বৃহত্তর স্বার্থে হোল্ডিং ট্যাক্স বাড়াতে হবে। ব্যাংকের খেলাপি ঋণ কমানো এবং ব্যাংকের চলমান তারল্য সমস্যার সমাধানে বিশেষ নির্দেশনা এবারের বাজেটে থাকবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
বাজেটে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর চিকিৎসাসেবার ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করা উচিত। গ্রামীণ বিশাল জনগোষ্ঠীকে হোমিওপ্যাথির মাধ্যমে কীভাবে চিকিৎসাসেবা দেয়া যায় এটি ভেবে দেখতে হবে। পার্শ^বর্তী দেশ ভারত যেভাবে আয়ুর্ভেদ, ইওগা, ইউনানি, সিদ্ধা এবং হোমিওপ্যাথের সমন্বয়ে ‘আয়ুশ’ গঠন করে তাদের বিশাল জনগোষ্ঠীকে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছে, আমাদের দেশেও এমন কিছু করা যায় কিনা এ-সংক্রান্ত বিশেষ নির্দেশনা এই বাজেটে থাকবে বলে আশা করছি।
বাজেটে বিশেষায়িত শিক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করা উচিত। কয়লা, গ্যাস, চা, সমুদ্রবিজ্ঞান ইত্যাদির ওপর বিশেষায়িত বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারের বিশেষ কোন পরিকল্পনা থাকলে তা খুবই প্রশংসনীয় হবে। গণহারে পাবলিক বিশ^বিদ্যালয় না বানিয়ে, বরং বিশেষায়িত বিশ^বিদ্যালয় নির্মাণ করলে তা অনেক বেশি কার্যকর হবে। গত পনের বছরে দেশের নোংরা রাজনীতির কারণে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী দেশের বাহিরে চলে গিয়েছে, এদের কীভাবে আবার দেশে ফেরানো যায় এ-সংক্রান্ত সরকারের পরিকল্পনাও এবারের বাজেটে থাকা উচিত বলে আমি মনে করি। মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থাকে কীভাবে আধুনিক এবং যুগোপযোগী করা যায় এবং চাকরির বাজারের কীভাবে এই বিশাল শিক্ষার্থীদের যোগ্য করে তোলা যায় এটা নিয়েও এবারের বাজেটে বিশেষ নির্দেশনা থাকবে বলে আশা করছি।
প্রতিরক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ বাড়াতে হবে। একদিকে মায়ানমারের সঙ্গে বিদ্যমান রোহিঙ্গা সমস্যা, অন্যদিকে ৫ আগস্টের পর পার্শ^বর্তী দেশ ভারতের সঙ্গেও সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না আমাদের। ফলে খুব স্বাভাবিকভাবেই আমাদের প্রতিরক্ষা বাহিনীকে আরও বেশি দক্ষ করে তুলতে হবে। তাদের প্রশিক্ষণসহ নানা সুযোগ সুবিধাদি বাড়িয়ে যেকোন পরিবেশ-পরিস্থিতি মোকাবিলায় সর্বদা প্রস্তুত রাখতে হবে।
[লেখক : আইনজীবী ও সহযোগী সদস্য, দি ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড সেক্রেটারিজ অব বাংলাদেশ (আইসিএসবি)]
মিজানুর রহমান
রোববার, ২০ এপ্রিল ২০২৫
বৈশ্বিক ও জাতীয় রাজনীতির পালাবদলের কারণে বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে এখন অনেকটাই মন্দাভাব বিরাজ করছে। গত ১৫ বছর বিগত সরকার ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেশের অর্থনীতির বাস্তব চিত্র আড়াল করেছিল। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যখন দেশের দায়িত্বভার গ্রহণ করে, ততক্ষণে দেশের অর্থনীতি অনেকটাই ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। অর্থনীতিতে যখন এরূপ টালমাটাল অবস্থা, ঠিক তখন ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট পেশ করবেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অর্থ উপদেষ্টা।
পত্রিকা ও টেলিভিশনের বিভিন্ন সংবাদ থেকে যতটুকু জানা গেছে এবারের বাজেটের পরিমাণ প্রায় ৮ লাখ কোটি টাকা। বাজেটের সাইজ যেমনই হোক না কেন, যেহেতু এবারের বাজেট প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, ফলে খুব স্বাভাবিকভাবে এটা ধরেই নেয়া যায় এবারের বাজেট কোনভাবেই বিগত দিনগুলোর গতানুগতিক বাজেটের মতো হবে না। বিগত বছরগুলোতে দেখা গিয়েছে বাজেট প্রণয়নের আগে সুশীল সমাজ ও বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের সঙ্গে নামকাওয়াস্তে সংলাপ করা হতো। ফলশ্রুতিতে, বাজেটে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির বাস্তব চিত্র প্রতিফলিত হতো না। এবার যেহেতু পরিস্থিতি ভিন্ন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ইতোমধ্যেই বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে বাজেটের বিভিন্ন স্ট্রাটেজিক বিষয়াদি নিয়ে সংলাপ করছেন, ফলে আশা করা যাচ্ছে এবারের বাজেট যথেষ্ট কার্যকর ও গঠনমূলক হবে।
এবারের বাজেটে অর্থ উপদেষ্টাকে রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রার দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। দেশের ১৮ কোটি মানুষের মাঝে মাত্র ৩০ লাখ করদাতা প্রতি বছর কর দেন। বাজেটে নিয়মিত করদাতাদের জন্য বিশেষ প্রণোদনা রেখে, করযোগ্য করদাতার সংখ্যা বাড়ানোর জন্য বিশেষ নির্দেশনা থাকা উচিত। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে এক্ষেত্রে আরও বেশি সচেষ্ট হতে হবে। প্রয়োজনে আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সহায়তায় কার কয়টি বাড়ি আছে, কার ব্যাংক একাউন্টে কত টাকা আছে, কার কয়টি ক্রেডিট কার্ড আছে, কার নামে কয়টি মোবাইল সিম আছে, মোবাইল ফোনে কে কত টাকা ব্যয় করছে, কে বছরে কয়বার বিদেশ ভ্রমণ করেছেন ইত্যাদির তথ্যের ভিত্তিতে খুব সহজেই করযোগ্য করদাতার সংখ্যা বাড়ানো যেতে পারে।
প্রতি বছর আমাদের জাতীয় বাজেট বাস্তবায়নের পথে মূল প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে ঘাটতি বাজেট। আসলে, আমাদের বাজেট বাস্তবায়ন অনেকাংশেই নির্ভর করছে রাজস্ব কর্মকর্তাদের স্বদিচ্ছার ওপর। ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক থেকে শুরু করে প্রতিটি স্তরের কর্মকর্তার যেমন টার্গেট থাকে, ঠিক তেমনিভাবে রাজস্ব কর্মকর্তাদেরও টার্গেট ঠিক করে দিতে হবে। প্রয়োজনে তাদের জরিমানা করার ক্ষমতা প্রদান করতে হবে। মূসক বিভাগকেও কঠোর হতে হবে। দেশে মাত্র ৪.৫ লাখ প্রতিষ্ঠান মূসক প্রদান করে। এভাবে একটা দেশ চলতে পারে না, যারা কর দেবে না, মূসক দেবে না, তাদের চিহ্নিত করতে হবে, প্রয়োজনে নোটিস দিতে হবে, আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যেই রাজস্ব কর্মকর্তা কাজে অবহেলা করবে, তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে হবে। মোট কথা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে তাদের সক্ষমতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করতে হবে।
রাজস্ব বাড়াতে সব ধরনের তামাকজাত পণ্যের ওপর বর্ধিত হারে বিশেষ সম্পূরক করের প্রস্তাব করা যেতে পারে। এর ফলে সরকার শুধু এক তামাকজাত দ্রব্যাদি থেকেই প্রায় সাড়ে দশ হাজার কোটি টাকা আদায় করতে পারে। বাজারে একধরনের ই-সিগারেট পাওয়া যাচ্ছে, যেগুলোর বস্তুত: কোন আইনগত বৈধতা নেই। এবারের বাজেটে ই-সিগারেট ও করের আওতায় আনতে হবে। বর্ধিত করারোপের ফলে একদিকে যেমন সরকার বিশাল রাজস্ব আদায় করবে, তেমনি অনেকে নিরুৎসাহিত হয়ে ধূমপান ত্যাগ করতে পারে।
বিগত সরকার কোন প্রকারের ফিজিবিলিটি স্টাডি করা ছাড়াই বেশ কিছু মেগা প্রজেক্ট শুরু করেছিল। প্রকৃতপক্ষে, মেট্রোরেল আর পদ্মা সেতু বাদে আর একটারও কোন উপযোগিতা নেই। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী টানেলের দৈনিক অপারেশনাল ব্যয় মেটাতে গিয়ে এখন হিমশিম খেতে হচ্ছে। বাজেটে চলমান প্রকল্পগুলোর জন্য বরাদ্দ রাখা দরকার এবং পাশাপাশি নতুন করে আর কোন বড় প্রকল্প হাত দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে এবং এ-সংক্রান্ত সরকারের পরিকল্পনা বাজেটে তুলে ধরতে হবে।
রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের সড়কব্যবস্থা একেবরেই নাজুক। সড়কে প্রতিদিন ১ কোটির বেশি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলছে যার কোনটারই লাইসেন্স নেই। এভাবে লাইসেন্সবিহীন যানবাহন সড়কে অবাধে চলতে দেয়া ঠিক না। এগুলোকে লাইসেন্সের আওতায় আনা দরকার। অটোরিকশার ব্যাটারি আমদানিতে অধিক হারে কর বসাতে হবে। অনেকেই বলতে পারে এত কঠোর হওয়া ঠিক নাÑ কিন্তু মুক্তবাজার অর্থনীতিতে যেখানে কঠোর হওয়া দরকার, সেখানে কঠোর হতেই হবে। আবেগ দিয়ে দেশ চালানো যাবে না, দেশের মঙ্গলের স্বার্থে যেকোন কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল প্রায়শই কৃষি খাতের ওপর থেকে ভর্তুকি তুলে নেয়ার যে প্রস্তাব করে তা কোনভাবেই মানা যাবে না। বস্তুতপক্ষে সূক্ষ্মভাবে চিন্তা করলে দেখা যাবে কৃষিতে এটা কোন ভর্তুকি না বরং কৃষিতে এই অর্থ বিনিয়োগ করা হয়। বাংলাদেশ কৃষিনির্ভর দেশ হওয়ায় কৃষির ওপর সরকারের সুনজর সব সময়ই থাকতে হবে। আমরা কোভিডের সময়ও দেখেছি অর্থনীতির সবগুলো খাত যখন নি¤œমুখী ছিল, কৃষি খাত ঠিক তখনও ঊর্ধ্বমুখী ছিল। কৃষি খাত আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে যে কী বিশাল ভূমিকা রাখছে তা হয়তোবা খালি চোখে বোঝা যাবে না। আমাদের যদি কৃষিপণ্য আমদানি করতে হতো তাহলে বিশাল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হতো শুধু কৃষিপণ্য আমদানি করতেই। সবদিক বিবেচনা করে কৃষি খাতে ভর্তুকি এবারের বাজেটেও অব্যাহত রাখা উচিত।
বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের সঙ্গে কমবেশি প্রায় ১ কোটি বিনিয়োগকারী জড়িত। আগের সরকারের আমলে দরবেশ এবং তাদের প্রেতাত্মাদের কু-নজরে শেয়ার বাজার থেকে হাজার-হাজার কোটি টাকার পাচার করা হয়েছিল। সর্বস্বান্ত হয়ে পথে বসেছিল হাজার হাজার ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী। এবারের বাজেটে যদি পুঁজিবাজার-সংক্রান্ত বিশেষ কোন প্রণোদনার ঘোষণা থাকে তাহলে বিনিয়োগকারীরা নতুন করে বিনিয়োগে উৎসাহিত হবে।
আমাদের স্থানীয় সরকারকে শুধু সরকারের আর্থিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল না হয়ে বরং নিজেদের অভ্যন্তরীণ আয় বাড়ানোর দিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখতে হবে। দেশের বৃহত্তর স্বার্থে হোল্ডিং ট্যাক্স বাড়াতে হবে। ব্যাংকের খেলাপি ঋণ কমানো এবং ব্যাংকের চলমান তারল্য সমস্যার সমাধানে বিশেষ নির্দেশনা এবারের বাজেটে থাকবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
বাজেটে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর চিকিৎসাসেবার ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করা উচিত। গ্রামীণ বিশাল জনগোষ্ঠীকে হোমিওপ্যাথির মাধ্যমে কীভাবে চিকিৎসাসেবা দেয়া যায় এটি ভেবে দেখতে হবে। পার্শ^বর্তী দেশ ভারত যেভাবে আয়ুর্ভেদ, ইওগা, ইউনানি, সিদ্ধা এবং হোমিওপ্যাথের সমন্বয়ে ‘আয়ুশ’ গঠন করে তাদের বিশাল জনগোষ্ঠীকে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছে, আমাদের দেশেও এমন কিছু করা যায় কিনা এ-সংক্রান্ত বিশেষ নির্দেশনা এই বাজেটে থাকবে বলে আশা করছি।
বাজেটে বিশেষায়িত শিক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করা উচিত। কয়লা, গ্যাস, চা, সমুদ্রবিজ্ঞান ইত্যাদির ওপর বিশেষায়িত বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারের বিশেষ কোন পরিকল্পনা থাকলে তা খুবই প্রশংসনীয় হবে। গণহারে পাবলিক বিশ^বিদ্যালয় না বানিয়ে, বরং বিশেষায়িত বিশ^বিদ্যালয় নির্মাণ করলে তা অনেক বেশি কার্যকর হবে। গত পনের বছরে দেশের নোংরা রাজনীতির কারণে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী দেশের বাহিরে চলে গিয়েছে, এদের কীভাবে আবার দেশে ফেরানো যায় এ-সংক্রান্ত সরকারের পরিকল্পনাও এবারের বাজেটে থাকা উচিত বলে আমি মনে করি। মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থাকে কীভাবে আধুনিক এবং যুগোপযোগী করা যায় এবং চাকরির বাজারের কীভাবে এই বিশাল শিক্ষার্থীদের যোগ্য করে তোলা যায় এটা নিয়েও এবারের বাজেটে বিশেষ নির্দেশনা থাকবে বলে আশা করছি।
প্রতিরক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ বাড়াতে হবে। একদিকে মায়ানমারের সঙ্গে বিদ্যমান রোহিঙ্গা সমস্যা, অন্যদিকে ৫ আগস্টের পর পার্শ^বর্তী দেশ ভারতের সঙ্গেও সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না আমাদের। ফলে খুব স্বাভাবিকভাবেই আমাদের প্রতিরক্ষা বাহিনীকে আরও বেশি দক্ষ করে তুলতে হবে। তাদের প্রশিক্ষণসহ নানা সুযোগ সুবিধাদি বাড়িয়ে যেকোন পরিবেশ-পরিস্থিতি মোকাবিলায় সর্বদা প্রস্তুত রাখতে হবে।
[লেখক : আইনজীবী ও সহযোগী সদস্য, দি ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড সেক্রেটারিজ অব বাংলাদেশ (আইসিএসবি)]