এমএ হোসাইন
যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়া থেকে সামরিক উপস্থিতি প্রত্যাহার করছে, যা সাইগনের দূতাবাস পতনের মতো গর্জন করে নয়, ব্ল্যাক হক ডাউনের মতো নাটকীয়তায় নয়Ñ বরং নীরব, মর্যাদাহীন এবং গুরুত্বহীন এক প্রস্থান। উত্তর-পূর্ব সিরিয়ায় আমেরিকার আটটি সামরিক ঘাঁটির মধ্যে তিনটি বন্ধ হচ্ছে। সেনা সংখ্যা অর্ধেকে নামিয়ে আনা হচ্ছে যেখানে কোনো ঘোষণা নেই, কোনো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নেই, জবাবদিহিতা তো দূরের কথা। প্রান্তিক এক যুদ্ধ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার যে চতুর পদক্ষেপ মনে হচ্ছে, তা আসলে আমেরিকার কৌশলগত দায়বদ্ধতা থেকে আরও একটি সরে আসার ঘটনা। এর মূল্য? শুধু মিত্রদের পরিত্যাগ নয়, প্রতিপক্ষদের ক্ষমতায়ন এবং এক অঞ্চল যা ধীরে ধীরে বিশৃঙ্খলার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
এটা কোনো নতুন মোড় নয়; এটা এক পুনরাবৃত্তি। আফগানিস্তানের মতোই সিরিয়া আমেরিকার কৌশলগত সংকল্পহীনতার আরেকটি পাঠ। যুদ্ধক্ষেত্রে ইসলামিক স্টেটকে পরাজিত করে সেখান থেকে পরিষ্কারভাবে সরে আসা সম্ভব, এই বিভ্রম মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতির বাস্তবতায় ভেঙে পড়েছে। আর ওয়াশিংটন যখন মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে, তখন অঞ্চলটি পুনর্গঠিত হচ্ছে এমন সব শক্তির দ্বারা, যাদের লক্ষ্য স্পষ্ট এবং নৈতিকতার বোঝা কম।
ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে, সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের কোনো বিস্তৃত কৌশল ছিল না। শুরুর লক্ষ্য ছিল সীমিতÑ আইএসকে দুর্বল করা এবং তার পুনরুত্থান ঠেকানো। ২০১৯ সালে আইএসের ঘোষিত খেলাফত ধ্বংস হয়েছিল; কিন্তু তবু একটি মৌলিক প্রশ্ন রয়ে গিয়েছিলÑ এরপর কী?
এই নীরবতাই, যা একাধিক প্রশাসনের মধ্যে চলেছে, এখন সিরিয়ায় আমেরিকার উপস্থিতিকে সংজ্ঞায়িত করছে। বাইডেন প্রশাসন, ট্রাম্পের মতোই, কুর্দি নেতৃত্বাধীন সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সেস (ঝউঋ) এসডিএফকে সামান্য সহায়তা দিয়েছে, কিন্তু কোনো বৃহত্তর রাজনৈতিক বা কূটনৈতিক সম্পৃক্ততা এড়িয়ে গেছে। এই শূন্যস্থান আমেরিকান উপস্থিতিকে একটি স্থিতিশীল শক্তি নয়, বরং একটি সংকুচিত, রাজনৈতিকভাবে অনুসমর্থিত এবং বিদেশে বিশ্বাসযোগ্যতা হারানো অবস্থানে পরিণত করেছে।
এদিকে সিরিয়া পরিবর্তিত হয়েছে। গৃহযুদ্ধের প্রাথমিক গতিশীলতা এখন আর চেনার উপায় নেই। বাশার আল-আসাদ, যিনি একসময় এই সংঘাতের নিরঙ্কুশ খলনায়ক ছিলেন, এখন দেশটি হায়াত তাহরির আল-শাম (ঐঞঝ) এইচটিএসের দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়েছেন; যারা একটি উগ্রবাদী ও বৈশ্বিক লক্ষ্য নিয়ে চলে। একসময় যা ছিল এক নিষ্ঠুর ধর্মনিরপেক্ষ শাসক বনাম নানা বিরোধী গোষ্ঠীর লড়াই, এখন তা পরিণত হয়েছে উগ্রবাদী, ভঙ্গুর মিত্রতা এবং আঞ্চলিক হস্তক্ষেপে ভরা এক অনিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে।
প্রত্যাহারের পক্ষে ওয়াশিংটনের যুক্তি রাজনৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য। আমেরিকান জনগণ ‘অন্তহীন যুদ্ধ’-এ ক্লান্ত। জটিল উপজাতীয় ও সাম্প্রদায়িক সিরিয়ায় দৃশ্যমান কোনো অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক লাভ নেই কিন্তু ভূরাজনীতি কখনো জনমত নির্ভর নয়, তা বাস্তবতার ওপর নির্ভরশীল এবং বাস্তবতা হলো, যুক্তরাষ্ট্র কোনো যুদ্ধ থেকে নয়, বরং একটি ভূকৌশলগত ক্ষেত্র থেকে সরে দাঁড়াচ্ছে।
এই শূন্যতা খালি থাকবে না। রাশিয়া, ইরান এবং তুরস্ক ইতোমধ্যেই সিরিয়াকে নতুন করে গঠন করতে তৎপর। মস্কো এর বিমান শক্তি এবং কূটনৈতিক তৎপরতা দিয়ে তার উপস্থিতি পাকাপোক্ত করছে। ইরান তার শিয়া মিলিশিয়া এবং প্রক্সি নেটওয়ার্কের মাধ্যমে বহুদিনের আকাক্সিক্ষত ভূমধ্যসাগরীয় করিডোর তৈরির পথে এগোচ্ছে। তুরস্ক, সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানের অজুহাতে, কুর্দি অঞ্চলগুলোতে আক্রমণ চালিয়ে উত্তর সিরিয়ায় নিজের প্রভাব বিস্তার করছে। আর উগ্রবাদী দলগুলো এই অনিশ্চয়তার সুযোগ নিয়ে আবারও অঞ্চল পুনর্দখল ও বৈধতা পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছে।
ওয়াশিংটন যদি ধরে নেয় যে এই ফলাফল গুরুত্বহীন, তাহলে তা শুধু ফাঁকিবাজি নয় বরং এটা বিপজ্জনক। সিরিয়া শুধু আরেকটি মধ্যপ্রাচ্যীয় জটিলতা নয়, এটি আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক শক্তির সংঘাতের ছেদবিন্দু। এটি রাশিয়া ও ইরান কতদূর পশ্চিমকে অগ্রাহ্য করতে পারে তার একটি পরীক্ষাগার। এটি ন্যাটোর দক্ষিণ সীমান্তের একটি চুড়ান্ত বিন্দু। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, এখানে কয়েক হাজার আইএস যোদ্ধা এখনো অস্থায়ী কারাগারে বন্দি, যাদের পাহারা দিচ্ছে ক্রমেই পরিত্যক্ত ও দুর্বল হয়ে পড়া কুর্দি বাহিনী।
এসডিএফের সঙ্গে এই বিশ্বাসঘাতকতা আমেরিকার বিশ্বাসযোগ্যতার উপর এক গভীর কলঙ্ক। এই বাহিনী, যার মূল চালিকা শক্তি ছিল কুর্দিরা, আইএসের বিরুদ্ধে মূল যুদ্ধটি লড়েছে। তারা কোনো বিমান শক্তি, সাঁজোয়া বাহিনী বা বৈশ্বিক কূটনৈতিক সমর্থন ছাড়াই এক পা এক পা করে যুদ্ধ করেছে, হাজার হাজার প্রাণ দিয়েছেÑ শুধু স্বীকৃতি ও সমর্থনের বিনিময়ে। এখন তারা পড়ে রয়েছে তুরস্কের গোলাবর্ষণ এবং জিহাদি প্রতিশোধের সামনে।
এটা শুধু নৈতিক ব্যর্থতা নয়Ñএটা এক কৌশলগত ভুল। বিশ্বজুড়ে মিত্ররা লক্ষ্য করছে যুক্তরাষ্ট্র তার অংশীদারদের কিভাবে ব্যবহার করে, তারপর ত্যাগ করে। সিরিয়া থেকে পাঠানো বার্তা স্পষ্ট: যুক্তরাষ্ট্র তোমাকে ব্যবহার করবে, তারপর ছুড়ে ফেলবে। তাই তাইপেই, কিয়েভ, এবং তিবলিসির করিডোরে এই বার্তা ভয়ংকরভাবে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।
যারা মনে করে সিরিয়ায় উপস্থিতি অযথা ব্যয়, তারা গাছ দেখে বন দেখতে ভুল করছে। আমেরিকার উপস্থিতির লক্ষ্য ছিল- না দামেস্ক দখল কিংবা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা; বরং একটি কৌশলগত পয়েন্টে অবস্থান বজায় রাখা, যাতে অন্যান্য শক্তিগুলো সেই শূন্যতা পূরণ না করে। আইএস-এর পুনরুত্থান প্রতিরোধ করা, যাতে তা বিশ্বব্যাপী হুমকি হয়ে না দাঁড়ায়। এর বাইরেও এটা ছিল এক বার্তাÑ যুক্তরাষ্ট্র এখনো বৈশ্বিক ঘটনাপ্রবাহ গঠনের সক্ষমতা ও সদিচ্ছা রাখে। ভূরাজনীতিতে প্রচলিত ধারণা অনেক সময় শক্তির চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ; কিন্তু এই নীরব প্রস্থান একেবারে ভিন্ন বার্তা দিচ্ছে তাহলো ক্লান্তি, সিদ্ধান্তহীনতা এবং কৌশলগত বিশৃঙ্খলা।
পছন্দটা আসলে অন্তহীন যুদ্ধ ও সম্পূর্ণ প্রত্যাহারের মধ্যে নয়। এর মাঝেও একটি পথ আছেÑ বাস্তববাদ, দায়িত্ববোধ ও সংকল্পে ভরপুর একটি মধ্যপন্থা। সিরিয়া থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার আঞ্চলিক অরাষ্ট্রীয় শক্তিগুলোর মাঝে দীর্ঘদিনের ভারসাম্যকেও ভেঙে দিচ্ছে। আমেরিকার প্রতিরোধী ভূমিকাটি বিলুপ্ত হওয়ায় হিজবুল্লাহ এবং ইরাকের পিএমএফের মতো গোষ্ঠীগুলো সীমান্ত অতিক্রমে নতুন কৌশলগত করিডোর পেতে পারে। ইসরায়েল এখন বাধ্য হচ্ছে আরও একক, আগাম আক্রমণ চালাতে, কারণ মার্কিন সমন্বয় সেখানে আর নেই।
উপসাগরীয় রাজতন্ত্রগুলোও এখন এক নতুন পরাশক্তি-শূন্যতায় নিজেদের প্রক্সি বিনিয়োগে দ্বিগুণ মনোযোগ দেবে, যা সাম্প্রদায়িক বিভাজন আরও বাড়াবে। এদিকে চীনের নিঃশব্দ কিন্তু ধারাবাহিক কূটনৈতিক তৎপরতা সিরিয়ার সংকটে এক ইউরেশীয় স্তর যোগ করতে পারে। এই প্রত্যাহার শুধু আমেরিকার প্রভাব কমাচ্ছে নাÑ এটা সিরিয়াকে এক এমন কেন্দ্রে পরিণত করছে, যেখানে বহু-মেরু প্রতিযোগিতা, উগ্রবাদের পুনরুত্থান এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তাহীনতা অবাধে মিলছে।
সিরিয়া শুধু একটি দূরবর্তী সংঘাত নয়। এটি আমেরিকার পররাষ্ট্র নীতির পছন্দ, সংকল্প ও মূল্যবোধের প্রতিচ্ছবি। একটি দেশ যে উগ্রবাদীদের পুনরায় জমি দখলের সুযোগ দেয়, যার মিত্রদের তুর্কি ড্রোন আর রুশ কূটনীতি কেড়ে নেয়- তা নেতৃত্ব নয়, আত্মসমর্পণ। বিশ্ব তাকিয়ে আছে। ইউক্রেন, তাইওয়ানসহ আরও অনেকে এই মুহূর্তটিকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। যদি ওয়াশিংটন সিরিয়ায় নিজ অবস্থান ধরে রাখতে না পারে, তাহলে অন্য কোথাও রাখবে কিভাবে? উত্তরটা ক্রমেই স্পষ্টÑ কোথাও নয়।
[লেখক: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক]
এমএ হোসাইন
বৃহস্পতিবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৫
যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়া থেকে সামরিক উপস্থিতি প্রত্যাহার করছে, যা সাইগনের দূতাবাস পতনের মতো গর্জন করে নয়, ব্ল্যাক হক ডাউনের মতো নাটকীয়তায় নয়Ñ বরং নীরব, মর্যাদাহীন এবং গুরুত্বহীন এক প্রস্থান। উত্তর-পূর্ব সিরিয়ায় আমেরিকার আটটি সামরিক ঘাঁটির মধ্যে তিনটি বন্ধ হচ্ছে। সেনা সংখ্যা অর্ধেকে নামিয়ে আনা হচ্ছে যেখানে কোনো ঘোষণা নেই, কোনো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নেই, জবাবদিহিতা তো দূরের কথা। প্রান্তিক এক যুদ্ধ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার যে চতুর পদক্ষেপ মনে হচ্ছে, তা আসলে আমেরিকার কৌশলগত দায়বদ্ধতা থেকে আরও একটি সরে আসার ঘটনা। এর মূল্য? শুধু মিত্রদের পরিত্যাগ নয়, প্রতিপক্ষদের ক্ষমতায়ন এবং এক অঞ্চল যা ধীরে ধীরে বিশৃঙ্খলার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
এটা কোনো নতুন মোড় নয়; এটা এক পুনরাবৃত্তি। আফগানিস্তানের মতোই সিরিয়া আমেরিকার কৌশলগত সংকল্পহীনতার আরেকটি পাঠ। যুদ্ধক্ষেত্রে ইসলামিক স্টেটকে পরাজিত করে সেখান থেকে পরিষ্কারভাবে সরে আসা সম্ভব, এই বিভ্রম মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতির বাস্তবতায় ভেঙে পড়েছে। আর ওয়াশিংটন যখন মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে, তখন অঞ্চলটি পুনর্গঠিত হচ্ছে এমন সব শক্তির দ্বারা, যাদের লক্ষ্য স্পষ্ট এবং নৈতিকতার বোঝা কম।
ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে, সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের কোনো বিস্তৃত কৌশল ছিল না। শুরুর লক্ষ্য ছিল সীমিতÑ আইএসকে দুর্বল করা এবং তার পুনরুত্থান ঠেকানো। ২০১৯ সালে আইএসের ঘোষিত খেলাফত ধ্বংস হয়েছিল; কিন্তু তবু একটি মৌলিক প্রশ্ন রয়ে গিয়েছিলÑ এরপর কী?
এই নীরবতাই, যা একাধিক প্রশাসনের মধ্যে চলেছে, এখন সিরিয়ায় আমেরিকার উপস্থিতিকে সংজ্ঞায়িত করছে। বাইডেন প্রশাসন, ট্রাম্পের মতোই, কুর্দি নেতৃত্বাধীন সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সেস (ঝউঋ) এসডিএফকে সামান্য সহায়তা দিয়েছে, কিন্তু কোনো বৃহত্তর রাজনৈতিক বা কূটনৈতিক সম্পৃক্ততা এড়িয়ে গেছে। এই শূন্যস্থান আমেরিকান উপস্থিতিকে একটি স্থিতিশীল শক্তি নয়, বরং একটি সংকুচিত, রাজনৈতিকভাবে অনুসমর্থিত এবং বিদেশে বিশ্বাসযোগ্যতা হারানো অবস্থানে পরিণত করেছে।
এদিকে সিরিয়া পরিবর্তিত হয়েছে। গৃহযুদ্ধের প্রাথমিক গতিশীলতা এখন আর চেনার উপায় নেই। বাশার আল-আসাদ, যিনি একসময় এই সংঘাতের নিরঙ্কুশ খলনায়ক ছিলেন, এখন দেশটি হায়াত তাহরির আল-শাম (ঐঞঝ) এইচটিএসের দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়েছেন; যারা একটি উগ্রবাদী ও বৈশ্বিক লক্ষ্য নিয়ে চলে। একসময় যা ছিল এক নিষ্ঠুর ধর্মনিরপেক্ষ শাসক বনাম নানা বিরোধী গোষ্ঠীর লড়াই, এখন তা পরিণত হয়েছে উগ্রবাদী, ভঙ্গুর মিত্রতা এবং আঞ্চলিক হস্তক্ষেপে ভরা এক অনিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে।
প্রত্যাহারের পক্ষে ওয়াশিংটনের যুক্তি রাজনৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য। আমেরিকান জনগণ ‘অন্তহীন যুদ্ধ’-এ ক্লান্ত। জটিল উপজাতীয় ও সাম্প্রদায়িক সিরিয়ায় দৃশ্যমান কোনো অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক লাভ নেই কিন্তু ভূরাজনীতি কখনো জনমত নির্ভর নয়, তা বাস্তবতার ওপর নির্ভরশীল এবং বাস্তবতা হলো, যুক্তরাষ্ট্র কোনো যুদ্ধ থেকে নয়, বরং একটি ভূকৌশলগত ক্ষেত্র থেকে সরে দাঁড়াচ্ছে।
এই শূন্যতা খালি থাকবে না। রাশিয়া, ইরান এবং তুরস্ক ইতোমধ্যেই সিরিয়াকে নতুন করে গঠন করতে তৎপর। মস্কো এর বিমান শক্তি এবং কূটনৈতিক তৎপরতা দিয়ে তার উপস্থিতি পাকাপোক্ত করছে। ইরান তার শিয়া মিলিশিয়া এবং প্রক্সি নেটওয়ার্কের মাধ্যমে বহুদিনের আকাক্সিক্ষত ভূমধ্যসাগরীয় করিডোর তৈরির পথে এগোচ্ছে। তুরস্ক, সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানের অজুহাতে, কুর্দি অঞ্চলগুলোতে আক্রমণ চালিয়ে উত্তর সিরিয়ায় নিজের প্রভাব বিস্তার করছে। আর উগ্রবাদী দলগুলো এই অনিশ্চয়তার সুযোগ নিয়ে আবারও অঞ্চল পুনর্দখল ও বৈধতা পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছে।
ওয়াশিংটন যদি ধরে নেয় যে এই ফলাফল গুরুত্বহীন, তাহলে তা শুধু ফাঁকিবাজি নয় বরং এটা বিপজ্জনক। সিরিয়া শুধু আরেকটি মধ্যপ্রাচ্যীয় জটিলতা নয়, এটি আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক শক্তির সংঘাতের ছেদবিন্দু। এটি রাশিয়া ও ইরান কতদূর পশ্চিমকে অগ্রাহ্য করতে পারে তার একটি পরীক্ষাগার। এটি ন্যাটোর দক্ষিণ সীমান্তের একটি চুড়ান্ত বিন্দু। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, এখানে কয়েক হাজার আইএস যোদ্ধা এখনো অস্থায়ী কারাগারে বন্দি, যাদের পাহারা দিচ্ছে ক্রমেই পরিত্যক্ত ও দুর্বল হয়ে পড়া কুর্দি বাহিনী।
এসডিএফের সঙ্গে এই বিশ্বাসঘাতকতা আমেরিকার বিশ্বাসযোগ্যতার উপর এক গভীর কলঙ্ক। এই বাহিনী, যার মূল চালিকা শক্তি ছিল কুর্দিরা, আইএসের বিরুদ্ধে মূল যুদ্ধটি লড়েছে। তারা কোনো বিমান শক্তি, সাঁজোয়া বাহিনী বা বৈশ্বিক কূটনৈতিক সমর্থন ছাড়াই এক পা এক পা করে যুদ্ধ করেছে, হাজার হাজার প্রাণ দিয়েছেÑ শুধু স্বীকৃতি ও সমর্থনের বিনিময়ে। এখন তারা পড়ে রয়েছে তুরস্কের গোলাবর্ষণ এবং জিহাদি প্রতিশোধের সামনে।
এটা শুধু নৈতিক ব্যর্থতা নয়Ñএটা এক কৌশলগত ভুল। বিশ্বজুড়ে মিত্ররা লক্ষ্য করছে যুক্তরাষ্ট্র তার অংশীদারদের কিভাবে ব্যবহার করে, তারপর ত্যাগ করে। সিরিয়া থেকে পাঠানো বার্তা স্পষ্ট: যুক্তরাষ্ট্র তোমাকে ব্যবহার করবে, তারপর ছুড়ে ফেলবে। তাই তাইপেই, কিয়েভ, এবং তিবলিসির করিডোরে এই বার্তা ভয়ংকরভাবে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।
যারা মনে করে সিরিয়ায় উপস্থিতি অযথা ব্যয়, তারা গাছ দেখে বন দেখতে ভুল করছে। আমেরিকার উপস্থিতির লক্ষ্য ছিল- না দামেস্ক দখল কিংবা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা; বরং একটি কৌশলগত পয়েন্টে অবস্থান বজায় রাখা, যাতে অন্যান্য শক্তিগুলো সেই শূন্যতা পূরণ না করে। আইএস-এর পুনরুত্থান প্রতিরোধ করা, যাতে তা বিশ্বব্যাপী হুমকি হয়ে না দাঁড়ায়। এর বাইরেও এটা ছিল এক বার্তাÑ যুক্তরাষ্ট্র এখনো বৈশ্বিক ঘটনাপ্রবাহ গঠনের সক্ষমতা ও সদিচ্ছা রাখে। ভূরাজনীতিতে প্রচলিত ধারণা অনেক সময় শক্তির চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ; কিন্তু এই নীরব প্রস্থান একেবারে ভিন্ন বার্তা দিচ্ছে তাহলো ক্লান্তি, সিদ্ধান্তহীনতা এবং কৌশলগত বিশৃঙ্খলা।
পছন্দটা আসলে অন্তহীন যুদ্ধ ও সম্পূর্ণ প্রত্যাহারের মধ্যে নয়। এর মাঝেও একটি পথ আছেÑ বাস্তববাদ, দায়িত্ববোধ ও সংকল্পে ভরপুর একটি মধ্যপন্থা। সিরিয়া থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার আঞ্চলিক অরাষ্ট্রীয় শক্তিগুলোর মাঝে দীর্ঘদিনের ভারসাম্যকেও ভেঙে দিচ্ছে। আমেরিকার প্রতিরোধী ভূমিকাটি বিলুপ্ত হওয়ায় হিজবুল্লাহ এবং ইরাকের পিএমএফের মতো গোষ্ঠীগুলো সীমান্ত অতিক্রমে নতুন কৌশলগত করিডোর পেতে পারে। ইসরায়েল এখন বাধ্য হচ্ছে আরও একক, আগাম আক্রমণ চালাতে, কারণ মার্কিন সমন্বয় সেখানে আর নেই।
উপসাগরীয় রাজতন্ত্রগুলোও এখন এক নতুন পরাশক্তি-শূন্যতায় নিজেদের প্রক্সি বিনিয়োগে দ্বিগুণ মনোযোগ দেবে, যা সাম্প্রদায়িক বিভাজন আরও বাড়াবে। এদিকে চীনের নিঃশব্দ কিন্তু ধারাবাহিক কূটনৈতিক তৎপরতা সিরিয়ার সংকটে এক ইউরেশীয় স্তর যোগ করতে পারে। এই প্রত্যাহার শুধু আমেরিকার প্রভাব কমাচ্ছে নাÑ এটা সিরিয়াকে এক এমন কেন্দ্রে পরিণত করছে, যেখানে বহু-মেরু প্রতিযোগিতা, উগ্রবাদের পুনরুত্থান এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তাহীনতা অবাধে মিলছে।
সিরিয়া শুধু একটি দূরবর্তী সংঘাত নয়। এটি আমেরিকার পররাষ্ট্র নীতির পছন্দ, সংকল্প ও মূল্যবোধের প্রতিচ্ছবি। একটি দেশ যে উগ্রবাদীদের পুনরায় জমি দখলের সুযোগ দেয়, যার মিত্রদের তুর্কি ড্রোন আর রুশ কূটনীতি কেড়ে নেয়- তা নেতৃত্ব নয়, আত্মসমর্পণ। বিশ্ব তাকিয়ে আছে। ইউক্রেন, তাইওয়ানসহ আরও অনেকে এই মুহূর্তটিকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। যদি ওয়াশিংটন সিরিয়ায় নিজ অবস্থান ধরে রাখতে না পারে, তাহলে অন্য কোথাও রাখবে কিভাবে? উত্তরটা ক্রমেই স্পষ্টÑ কোথাও নয়।
[লেখক: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক]