এস ডি সুব্রত
হিন্দু তথা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস অনুযায়ী জগন্নাথ হলেন জগতের নাথ বা জগতের ঈশ্বর। যিনি জগতের ঈশ্বর তার অনুগ্রহ ও কৃপা লাভ করলে মানুষের মুক্তি লাভ হবে এটা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস। এই বিশ্বাস থেকেই জগন্নাথদেবের মূর্তি নিয়ে রথযাত্রার আয়োজন করে। রথটানা, হরিনাম সংকীর্ত্তন, বিশ্বশান্তি কামনায় অগ্নিহোত্র যজ্ঞ, মহাপ্রসাদ বিতরণ, আলোচনা সভা, পদাবলী কীর্তন ও গীতাপাঠের মাধ্যমে বাংলাদেশে এই উৎসব পালিত হয়। রথযাত্রা উপলক্ষে বিভিন্ন স্থানে মেলার আয়োজন করা হয়। সনাতন ধর্মাবলম্বী তথা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম একটি বিখ্যাত ধর্মীয় উৎসব হচ্ছে জগন্নাথদেবের রথযাত্রা উৎসব। প্রতি বছর আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে আয়োজিত হয় এ উৎসব। এ উৎসবের কেন্দ্রস্থল হচ্ছে উড়িষ্যা বা ওড়িশা রাজ্যের পূরীতে অবস্থিত জগন্নাথদেবের প্রধান মন্দির। এ উৎসব ভারত, বাংলাদেশ ছাড়াও বিশ্বের অনেক দেশে পালিত হয়ে আসছে।
রথযাত্রা হচ্ছে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের (হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের) দেবতা জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার তিনটি সুসজ্জিত মূর্তি রথে চেপে পুরীর জগন্নাথদেবের মন্দির থেকে মাসির বাড়িতে গুন্ডিচাযাত্রাকে বোঝায়। পুরীর জগন্নাথদেবের রথযাত্রা প্রতি বছর আমরা দেখে থাকি। তার উদ্বোধন করেন সেখানকার রাজা। রাজত্ব না থাকলেও বংশ পরম্পরায় পুরীর রাজ পরিবার আজো আছে। রাজ পরিবারের আছেন উপাধিপ্রাপ্ত রাজা। পুরীর জগন্নাথদেবের রথযাত্রা অনুসরণে বাংলায় রথযাত্রার সূচনা হয়। চৈতন্য মহাপ্রভু নীলাচল থেকে এই ধারাটি বাংলাদেশ এ নিয়ে আসেন। চৈতন্যভক্ত বৈষ্ণবরা বাংলায় পুরীর আদলে রথযাত্রার প্রচলন করেন। রথযাত্রার মাহাত্ম্য সম্পর্কে শাস্ত্রে আছে.......‘রথস্থ বামনং দৃষ্টা পুনর্জম্ন ন বিদ্যতে’। অর্থাৎ রথের ওপর অধিষ্ঠিত বামন জগন্নাথদেবকে দর্শন করলে তার পুনর্জম্ন হয় না।
বাংলাদেশে সবচেয়ে প্রাচীন ও বৃহত্তম রথযাত্রা উৎসব হলো ঢাকার ধামরাইয়ের রথযাত্রা। বাংলাদেশে অনেক আগে থেকেই রথযাত্রা উৎসব পালিত হয়ে আসছে। এ উপলক্ষে ঢাকার ধামরাই, খুলনা, বরিশাল, গোপালগঞ্জ, সিলেট, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, গাজীপুর, নাটোরসহ সারাদেশে রথযাত্রা ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ধামরাই অঞ্চলের যশোমাধবের রথযাত্রা বাংলাদেশে খুবই বিখ্যাত। উল্লেখ্য যে ধামরাইয়ের যশোমাধব মন্দিরে ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে সাটুরিয়া বানিয়াটির জমিদাররা ৬০ ফুট উঁচু যে যে রথ নির্মাণ করে দিয়েছিলেন যুদ্ধের সময় পাকবাহিনী তা পুড়িয়ে দেয়। ত্রিতল বিশিষ্ট রথটি টানতে ২৭ মণ ওজনের দড়ি ব্যবহার করা হতো। রথযাত্রা উপলক্ষে সেখানে মাসব্যাপী মেলা হতো। এখানে প্রথম ছিল বাঁশের রথ।
সর্বশেষ ২০০৬ সালে ভারত সরকারের অনুদানের মাধ্যমে ৩৭ ফুট উঁচু ও ২০ ফুট প্রস্থ কারুকাজ করা রথ তৈরি করা হয়। লোহার খাঁচার উপর সেগুন ও সাম্বল কাঠ খোদাই করে তৈরি করা হয় কারুকাজ করা রথ। এতে ১৫টি চাকা, কাঠের তৈরি দুটি ঘোড়া এবং সারথি আছে। নাটোরের নলডাঙ্গার মধ্যনগরে দেশের রথযাত্রা ১৫০ বছরের পুরনো। এখানে দেশের একমাত্র ১২ চাকা বিশিষ্ট পিতলের তৈরি রথে রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। ১৩টি মূল গেট ও ১১২টি পিলারের সাহায্যে তৈরি দেশের সবচেয়ে বড় পিতলের তৈরি রথ এটি। ১৮শ খ্রিস্টাব্দ থেকে পাহাড় আর সমুদ্রঘেরা শহর চট্টগ্রামে শুরু হয় রথযাত্রা উৎসব। চট্টগ্রামের নন্দন কাননে পাহাড়ঘেরা তুলসীদামে শ্রী শ্রী মদন মোহন নরসিংহ গোপাল জিউর মন্দিরে জগন্নাথদেব, বলরাম ও সুভদ্রার নিত্য পূজা হয়। তুলসীদামে যে পুকুর পাড়ে রথ রেখে স্নান করা হতো সে পুকুরের নাম ছিল রথের পুকুর। বর্তমানে সে পুকুরে উঠেছে বহুতল ভবন।
সিলেটে আন্তর্জাতিক কৃষ্ণ ভাবনামৃত সংঘ ইসকন আয়োজিত রথযাত্রা উৎসবে হাজার হাজার মানুষ সমবেত হয় রিকাবিবাজার ঐতিহ্যবাহী রথযাত্রা প্রাঙ্গণে। এছাড়া গাজীপুরের মানিক্য সাধকের রথযাত্রা, কুমিল্লার মহারাজ বাহাদুরের রথযাত্রা, যশোরের বারইখানি, রংপুরের আদিতমারীর কামার পাড়ার রথযাত্রা উল্লেখযোগ্য। এছাড়া সারাদেশেই এ রথযাত্রার আয়োজন করে থাকে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা।
[লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক]
এস ডি সুব্রত
রোববার, ০৭ জুলাই ২০২৪
হিন্দু তথা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস অনুযায়ী জগন্নাথ হলেন জগতের নাথ বা জগতের ঈশ্বর। যিনি জগতের ঈশ্বর তার অনুগ্রহ ও কৃপা লাভ করলে মানুষের মুক্তি লাভ হবে এটা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস। এই বিশ্বাস থেকেই জগন্নাথদেবের মূর্তি নিয়ে রথযাত্রার আয়োজন করে। রথটানা, হরিনাম সংকীর্ত্তন, বিশ্বশান্তি কামনায় অগ্নিহোত্র যজ্ঞ, মহাপ্রসাদ বিতরণ, আলোচনা সভা, পদাবলী কীর্তন ও গীতাপাঠের মাধ্যমে বাংলাদেশে এই উৎসব পালিত হয়। রথযাত্রা উপলক্ষে বিভিন্ন স্থানে মেলার আয়োজন করা হয়। সনাতন ধর্মাবলম্বী তথা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম একটি বিখ্যাত ধর্মীয় উৎসব হচ্ছে জগন্নাথদেবের রথযাত্রা উৎসব। প্রতি বছর আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে আয়োজিত হয় এ উৎসব। এ উৎসবের কেন্দ্রস্থল হচ্ছে উড়িষ্যা বা ওড়িশা রাজ্যের পূরীতে অবস্থিত জগন্নাথদেবের প্রধান মন্দির। এ উৎসব ভারত, বাংলাদেশ ছাড়াও বিশ্বের অনেক দেশে পালিত হয়ে আসছে।
রথযাত্রা হচ্ছে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের (হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের) দেবতা জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার তিনটি সুসজ্জিত মূর্তি রথে চেপে পুরীর জগন্নাথদেবের মন্দির থেকে মাসির বাড়িতে গুন্ডিচাযাত্রাকে বোঝায়। পুরীর জগন্নাথদেবের রথযাত্রা প্রতি বছর আমরা দেখে থাকি। তার উদ্বোধন করেন সেখানকার রাজা। রাজত্ব না থাকলেও বংশ পরম্পরায় পুরীর রাজ পরিবার আজো আছে। রাজ পরিবারের আছেন উপাধিপ্রাপ্ত রাজা। পুরীর জগন্নাথদেবের রথযাত্রা অনুসরণে বাংলায় রথযাত্রার সূচনা হয়। চৈতন্য মহাপ্রভু নীলাচল থেকে এই ধারাটি বাংলাদেশ এ নিয়ে আসেন। চৈতন্যভক্ত বৈষ্ণবরা বাংলায় পুরীর আদলে রথযাত্রার প্রচলন করেন। রথযাত্রার মাহাত্ম্য সম্পর্কে শাস্ত্রে আছে.......‘রথস্থ বামনং দৃষ্টা পুনর্জম্ন ন বিদ্যতে’। অর্থাৎ রথের ওপর অধিষ্ঠিত বামন জগন্নাথদেবকে দর্শন করলে তার পুনর্জম্ন হয় না।
বাংলাদেশে সবচেয়ে প্রাচীন ও বৃহত্তম রথযাত্রা উৎসব হলো ঢাকার ধামরাইয়ের রথযাত্রা। বাংলাদেশে অনেক আগে থেকেই রথযাত্রা উৎসব পালিত হয়ে আসছে। এ উপলক্ষে ঢাকার ধামরাই, খুলনা, বরিশাল, গোপালগঞ্জ, সিলেট, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, গাজীপুর, নাটোরসহ সারাদেশে রথযাত্রা ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ধামরাই অঞ্চলের যশোমাধবের রথযাত্রা বাংলাদেশে খুবই বিখ্যাত। উল্লেখ্য যে ধামরাইয়ের যশোমাধব মন্দিরে ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে সাটুরিয়া বানিয়াটির জমিদাররা ৬০ ফুট উঁচু যে যে রথ নির্মাণ করে দিয়েছিলেন যুদ্ধের সময় পাকবাহিনী তা পুড়িয়ে দেয়। ত্রিতল বিশিষ্ট রথটি টানতে ২৭ মণ ওজনের দড়ি ব্যবহার করা হতো। রথযাত্রা উপলক্ষে সেখানে মাসব্যাপী মেলা হতো। এখানে প্রথম ছিল বাঁশের রথ।
সর্বশেষ ২০০৬ সালে ভারত সরকারের অনুদানের মাধ্যমে ৩৭ ফুট উঁচু ও ২০ ফুট প্রস্থ কারুকাজ করা রথ তৈরি করা হয়। লোহার খাঁচার উপর সেগুন ও সাম্বল কাঠ খোদাই করে তৈরি করা হয় কারুকাজ করা রথ। এতে ১৫টি চাকা, কাঠের তৈরি দুটি ঘোড়া এবং সারথি আছে। নাটোরের নলডাঙ্গার মধ্যনগরে দেশের রথযাত্রা ১৫০ বছরের পুরনো। এখানে দেশের একমাত্র ১২ চাকা বিশিষ্ট পিতলের তৈরি রথে রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। ১৩টি মূল গেট ও ১১২টি পিলারের সাহায্যে তৈরি দেশের সবচেয়ে বড় পিতলের তৈরি রথ এটি। ১৮শ খ্রিস্টাব্দ থেকে পাহাড় আর সমুদ্রঘেরা শহর চট্টগ্রামে শুরু হয় রথযাত্রা উৎসব। চট্টগ্রামের নন্দন কাননে পাহাড়ঘেরা তুলসীদামে শ্রী শ্রী মদন মোহন নরসিংহ গোপাল জিউর মন্দিরে জগন্নাথদেব, বলরাম ও সুভদ্রার নিত্য পূজা হয়। তুলসীদামে যে পুকুর পাড়ে রথ রেখে স্নান করা হতো সে পুকুরের নাম ছিল রথের পুকুর। বর্তমানে সে পুকুরে উঠেছে বহুতল ভবন।
সিলেটে আন্তর্জাতিক কৃষ্ণ ভাবনামৃত সংঘ ইসকন আয়োজিত রথযাত্রা উৎসবে হাজার হাজার মানুষ সমবেত হয় রিকাবিবাজার ঐতিহ্যবাহী রথযাত্রা প্রাঙ্গণে। এছাড়া গাজীপুরের মানিক্য সাধকের রথযাত্রা, কুমিল্লার মহারাজ বাহাদুরের রথযাত্রা, যশোরের বারইখানি, রংপুরের আদিতমারীর কামার পাড়ার রথযাত্রা উল্লেখযোগ্য। এছাড়া সারাদেশেই এ রথযাত্রার আয়োজন করে থাকে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা।
[লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক]