বাবুল রবিদাস
দলিত-বঞ্চিত, নিপীড়িত, নির্যাতিত, শোষিত ব্রাত্যজন, অনগ্রসর ও অন্ত্যজ মানবজাতির দুঃখ-দুর্দশা এবং লাঞ্ছনা-গঞ্জনার বিরুদ্ধে যে কয়েকজন মহামানব জীবনভর সংগ্রাম করেছেন, তাদের মধ্যে মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ ম-ল ছিলেন পথিকৃৎ।
২৯ জানুয়ারি ১৯০৪ সালে বরিশাল জেলার গৌরনদী থানার অন্তর্গত মৈস্তারকান্দি গ্রামের এক নমঃশূদ্র কৃষকের ঘরে মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ ম-ল জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম রামদয়াল ম-ল এবং মাতার নাম সন্ধ্যা দেবী।
মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ ম-ল বাল্যকালে গ্রামের পাঠশালায় লেখাপড়া শেষ করে দূরের একটি স্কুল ‘বার্থী তারা ইনস্টিটিউশন’ এ ভর্তি হন। সেখান থেকে ১৯২৪ সালে প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি বরিশালের ব্রজমোহন কলেজে আই.এ. ক্লাসে ভর্তি হন এবং ১৯২৬ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে আই.এ. পাশ করেন।
১৯২৬ সালেই গৌরনদী থানার খাগবাডড় গ্রামের প্রহ্লাদ চন্দ্র বাড়ৈর কন্যা কমলা দেবীর সঙ্গে উভয় পরিবারের সম্মতিক্রমে তার বিয়ে সম্পন্ন হয়। বিয়ের পরও তিনি লেখাপড়ার প্রতি বিশেষ আগ্রহী ছিলেন। তাই মনোযোগ সহকারে বি.এ. ক্লাসে ভর্তি হন এবং ১৯২৯ সালে ব্রজমোহন কলেজ থেকে বি.এ. পাশ করেন। এরপর আইন বিষয়ে পড়াশোনার জন্য কলকাতা বার কাউন্সিল থেকে সনদপ্রাপ্ত হয়ে প্রথমে কলকাতায় শিক্ষানবিশ শুরু করেন এবং পরবর্তীতে ১৯৩৬ সালে বরিশালের সদর কোর্টে আইন পেশা শুরু করেন। এ সময় তিনি দলিত-বঞ্চিত, অন্ত্যজ জাতি, দরিদ্র কৃষক এবং ব্রাত্যজনদের বিনা খরচে মামলা পরিচালনা করে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। ফলে তিনি দ্রুত খ্যাতি অর্জন করেন।
১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের অধীনে ১৯৩৭ সালে বঙ্গীয় আইনসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ ম-ল সেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন এবং বিপুল ভোটে জয়ী হন। আইনসভার সদস্য হিসেবে তিনি তফসিলি ছাত্রছাত্রীদের জন্য বৃত্তি ও ছাত্রাবাসের আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেন।
১৯৪০ সালে কলকাতা কর্পোরেশনের নির্বাচনে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর অনুরোধে কংগ্রেস প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হন। ১৯৪২ সালে ড. বি.আর. আম্বেদকরের নেতৃত্বে ‘সারা ভারত তফসিলি ফেডারেশন’ গঠিত হয় এবং ১৯৪৩ সালে এর বঙ্গীয় শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন।
১৯৪৬ সালে নির্বাচনের পর তিনি বাংলায় মুসলিম লীগের মন্ত্রিসভায় বিচারপূর্ত ও গৃহনির্মাণ দপ্তরের মন্ত্রী হন। তিনি ড. আম্বেদকরকে গণপরিষদে নির্বাচিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
১৯৪৭ সালের ৩ জুন ব্রিটিশ সরকার বাংলার এসেম্বলিতে ভোটাভুটির মাধ্যমে বাংলা ভাগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ২০ জুন ভোটাভুটি অনুষ্ঠিত হয়। মুসলিম লীগ বাংলাভাগের বিপক্ষে ভোট দিলেও হিন্দুদের অধিকাংশ বাংলাভাগের পক্ষে ভোট দেয়। যদিও সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট বাংলাভাগের বিপক্ষে ছিল, তবুও উচ্চবর্ণের হিন্দুদের ষড়যন্ত্রের ফলে বাংলা ভাগ করা হয়।
এ কারণে মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ ম-লকে বাংলা ভাগের জন্য দায়ী করা যায় না। বাংলাভাগের জন্য যারা তাকে দায়ী করেন, তাদের প্রকৃত ইতিহাস জেনে নিতে হবে।
১৯৬৮ সালের ৫ অক্টোবর বনগাঁয় আকস্মিক হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মাত্র ৬৪ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
বাবুল রবিদাস
শনিবার, ২৬ অক্টোবর ২০২৪
দলিত-বঞ্চিত, নিপীড়িত, নির্যাতিত, শোষিত ব্রাত্যজন, অনগ্রসর ও অন্ত্যজ মানবজাতির দুঃখ-দুর্দশা এবং লাঞ্ছনা-গঞ্জনার বিরুদ্ধে যে কয়েকজন মহামানব জীবনভর সংগ্রাম করেছেন, তাদের মধ্যে মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ ম-ল ছিলেন পথিকৃৎ।
২৯ জানুয়ারি ১৯০৪ সালে বরিশাল জেলার গৌরনদী থানার অন্তর্গত মৈস্তারকান্দি গ্রামের এক নমঃশূদ্র কৃষকের ঘরে মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ ম-ল জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম রামদয়াল ম-ল এবং মাতার নাম সন্ধ্যা দেবী।
মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ ম-ল বাল্যকালে গ্রামের পাঠশালায় লেখাপড়া শেষ করে দূরের একটি স্কুল ‘বার্থী তারা ইনস্টিটিউশন’ এ ভর্তি হন। সেখান থেকে ১৯২৪ সালে প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি বরিশালের ব্রজমোহন কলেজে আই.এ. ক্লাসে ভর্তি হন এবং ১৯২৬ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে আই.এ. পাশ করেন।
১৯২৬ সালেই গৌরনদী থানার খাগবাডড় গ্রামের প্রহ্লাদ চন্দ্র বাড়ৈর কন্যা কমলা দেবীর সঙ্গে উভয় পরিবারের সম্মতিক্রমে তার বিয়ে সম্পন্ন হয়। বিয়ের পরও তিনি লেখাপড়ার প্রতি বিশেষ আগ্রহী ছিলেন। তাই মনোযোগ সহকারে বি.এ. ক্লাসে ভর্তি হন এবং ১৯২৯ সালে ব্রজমোহন কলেজ থেকে বি.এ. পাশ করেন। এরপর আইন বিষয়ে পড়াশোনার জন্য কলকাতা বার কাউন্সিল থেকে সনদপ্রাপ্ত হয়ে প্রথমে কলকাতায় শিক্ষানবিশ শুরু করেন এবং পরবর্তীতে ১৯৩৬ সালে বরিশালের সদর কোর্টে আইন পেশা শুরু করেন। এ সময় তিনি দলিত-বঞ্চিত, অন্ত্যজ জাতি, দরিদ্র কৃষক এবং ব্রাত্যজনদের বিনা খরচে মামলা পরিচালনা করে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। ফলে তিনি দ্রুত খ্যাতি অর্জন করেন।
১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের অধীনে ১৯৩৭ সালে বঙ্গীয় আইনসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ ম-ল সেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন এবং বিপুল ভোটে জয়ী হন। আইনসভার সদস্য হিসেবে তিনি তফসিলি ছাত্রছাত্রীদের জন্য বৃত্তি ও ছাত্রাবাসের আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেন।
১৯৪০ সালে কলকাতা কর্পোরেশনের নির্বাচনে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর অনুরোধে কংগ্রেস প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হন। ১৯৪২ সালে ড. বি.আর. আম্বেদকরের নেতৃত্বে ‘সারা ভারত তফসিলি ফেডারেশন’ গঠিত হয় এবং ১৯৪৩ সালে এর বঙ্গীয় শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন।
১৯৪৬ সালে নির্বাচনের পর তিনি বাংলায় মুসলিম লীগের মন্ত্রিসভায় বিচারপূর্ত ও গৃহনির্মাণ দপ্তরের মন্ত্রী হন। তিনি ড. আম্বেদকরকে গণপরিষদে নির্বাচিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
১৯৪৭ সালের ৩ জুন ব্রিটিশ সরকার বাংলার এসেম্বলিতে ভোটাভুটির মাধ্যমে বাংলা ভাগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ২০ জুন ভোটাভুটি অনুষ্ঠিত হয়। মুসলিম লীগ বাংলাভাগের বিপক্ষে ভোট দিলেও হিন্দুদের অধিকাংশ বাংলাভাগের পক্ষে ভোট দেয়। যদিও সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট বাংলাভাগের বিপক্ষে ছিল, তবুও উচ্চবর্ণের হিন্দুদের ষড়যন্ত্রের ফলে বাংলা ভাগ করা হয়।
এ কারণে মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ ম-লকে বাংলা ভাগের জন্য দায়ী করা যায় না। বাংলাভাগের জন্য যারা তাকে দায়ী করেন, তাদের প্রকৃত ইতিহাস জেনে নিতে হবে।
১৯৬৮ সালের ৫ অক্টোবর বনগাঁয় আকস্মিক হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মাত্র ৬৪ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।