জিয়াউদ্দীন আহমেদ
১৬ অক্টোবর আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী ৮২ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেছেন। ইডেন কলেজে অধ্যয়নরত অবস্থায় মতিয়া চৌধুরী ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। এই দেশ গণতন্ত্রের জন্য উপযুক্ত নয়Ñ তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের এমন বিরূপ বক্তব্য শুনে তিনি রাজনীতির প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। সংস্কৃতিমনা ছিলেন বলেই সম্ভবত তিনি ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হন। ১৯৬১-৬২ সালে তিনি ইডেন কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি নির্বাচিত হন। ১৯৬৩-৬৪ সালে ছিলেন ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক, ভিপি ছিলেন রাশেদ খান মেনন। সামরিক শাসক আইয়ুব খানকে ‘ডিস্টার্ব’ করা যাবে নাÑ মওলানা ভাসানীর এমন উক্তির পর ছাত্র ইউনিয়নের মধ্যে চিন্তার বিভক্তির সূত্রপাত ঘটে। ১৯৬৫ সালে ছাত্র ইউনিয়ন দুই ভাগ হয়ে যায়Ñ চীনপন্থী মেনন গ্রুপ এবং রাশিয়াপন্থী মতিয়া গ্রুপ। ১৯৬৫ সালে তিনি ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি নির্বাচিত হন। ছাত্রজীবনে রাজনীতির ইতি টেনে তিনি ১৯৬৭ সালে অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপে যোগ দেন। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি বা সিপিবি প্রকাশ্যে রাজনীতি করার অনুমতি পায়, ১৯৭৩ সালে মতিয়া চৌধুরী ন্যাপ ছেড়ে সিপিবিতে যোগ দেন।
আইয়ুব খানের পাকিস্তান আমলে তিনি চারবার কারাবরণ করেন। শুধু রাজনীতি করার জন্যই প্রয়োজন হয় তার অভিভাবক বদলের। মতিয়া চৌধুরীকে রাজনীতি থেকে নিবৃত্ত করতে না পেরে তার পুলিশ বাবার ওপর আইয়ুব খান সরকারের প্রেসার আসে। এই প্রেসার থেকে বাবাকে মুক্তি দিতে মতিয়া চৌধুরী বিয়ের সিদ্ধান্ত নেন। অর্থাৎ অভিভাবক বদলের সিদ্ধান্ত নেন যাতে পুলিশ বাবা বিভাগীয় শাস্তি থেকে রেহাই পান। ১৯৬৪ সালে বিয়ে করেন সাংবাদিক বজলুর রহমানকে। বজলুর রহমান একই আদর্শের রাজনীতির অনুসারী ছিলেন বিধায় দুজনের মধ্যে পরিচয় ছিল, ঘনিষ্ঠতা ছিল। বিয়ের পর পুলিশ বাবা সরকারের হেনস্তা থেকে রেহাই পেলেও মতিয়া চৌধুরী কিন্তু রেহাই পাননি। বিয়ের এক মাস পরই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। পাকিস্তান আমলে শেষবার গ্রেপ্তার হন ১৯৬৭ সালে এবং দুই বছর জেল খেটে ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানে আইয়ুব খানের পতন হলে অন্যান্য রাজবন্দীর সঙ্গে তিনিও মুক্তি পান। রাজপথে তার এই সদর্প বিচরণ এবং অগ্নিঝরা বক্তব্য তাকে এনে দিয়েছিল ‘অগ্নিকন্যা’র খেতাব।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও জেলখানা তার পেছন ছাড়েনি। তিনি মোট ১৫ বার জেলে গেছেন। স্বাধীন বাংলাদেশে ন্যাপ বা কমিউনিস্ট পার্টির নেত্রী হিসেবে তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের কট্টর সমালোচক। স্বাধীনতা লাভের পর দেশের পুনর্গঠনে নানা অনিয়ম আর দুর্নীতি নিয়ে তিনি বিভিন্ন জনসভায় আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে কড়া কড়া কথা বলেছেন। ভারত থেকে আনা লুঙ্গি আর শাড়ি নিয়ে তিনি নানা ব্যঙ্গাত্মক বক্তব্যও দিয়েছেন। তিনি অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর ৬ দফার প্রচারে দেশের সর্বত্র ঘুরে বেড়িয়েছেন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন, বঙ্গবন্ধু তাকে স্নেহ করতেন। ১৯৬৭ সালে জেলে গেইটে ব্যক্তিগত জিনিসপত্র জমা দেয়ার সময় পেছন থেকে জেলবন্দী বঙ্গবন্ধু মতিয়া চৌধুরীর মাথায় হাত রেখে বলেছিলেনÑ ‘মতিয়া, ভয় পাইয়ো না’। রাজনৈতিক কারণে আওয়ামী লীগের সমালোচনা করলেও বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে কিন্তু তিনি কখনো গ্রেপ্তার হননি। গ্রেপ্তার হয়েছেন জিয়াউর রহমান, হোসেন মোহাম্মদ এরশাদ এবং খালেদা জিয়ার আমলে। এরশাদের আমলে তিনি নয়বার জেল খেটেছেন।
রাজনৈতিক মঞ্চে বক্তব্য দেয়ার শুরুতে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ বলার ব্যাপক প্রচলন হয় জিয়াউর রহমানের আমলে। এর উত্তরে মতিয়া চৌধুরীই জনসভার মঞ্চে প্রথম উল্লেখ করেন যে, সুরা তাওবার শুরুতে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ নেই। এই প্রসঙ্গে তিনি জিয়াউর রহমানকে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম বলার আগে ‘আউজুবিল্লাহি মিনাশ শায়তানির রাজিম’ বলে প্রথমে শয়তান তাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন। তার বাগ্মিতার জন্য তিনি জনপ্রিয় ছিলেন, কিন্তু শাসকরা ছিল রুষ্ট, তাই বঙ্গবন্ধুর মতো মতিয়া চৌধুরীরও জেলখানার জন্য সুটকেস গোছানো থাকত। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে মতিয়া চৌধুরী আবার ন্যাপে এসে রাজনীতি করতে থাকেন এবং ১৯৭৯ সালে ন্যাপ ছেড়ে যোগ দেন আওয়ামী লীগে।
মতিয়া চৌধুরী ১৯৭৯ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দিলেও প্রথমদিকে দলে সমাদৃত ছিলেন না। শেখ হাসিনা দলের নেতৃত্বে আসার পর তাকে কৃষি সম্পাদক করা হয়। পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী ছাড়াও তিনি জাতীয় সংসদের সংসদ উপনেতা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। বাংলাদেশে একটি কৃষি বিপ্লবে নেতৃত্ব দিয়েছেন কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী। অনেকের বিরোধিতা সত্ত্বেও তিনি হাইব্রিড বা জিআই বীজ ব্যবহারে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করেন, তার এই বৈপ্লবিক সিদ্ধান্তে বাংলাদেশে এখন সারা বছর বিভিন্ন ধরনের ফসল, ফল, ফুল, সবজি ইত্যাদির উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে। হাইব্রিড বীজের প্রধান উদ্দেশ্য থাকে উচ্চ ফলন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দশগুণ বেশি ফলন পাওয়া যায়। লোকসংখ্যা ৭ কোটি থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে ১৭ কোটি হয়েছে, হাইব্রিড বীজের ব্যবহার না হলে বাংলাদেশ খাদ্য শস্যের জন্য সম্পূর্ণ আমদানিনির্ভর থাকত।
তিনি মুক্তিযোদ্ধা হয়েও গার্ড অব অনার পাননি, পাননি তিন হাত লম্বা একটি কবরের জায়গাও। তার কবরের জন্য জায়গা চেয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের কাছে আবেদন করা হলে সিটি করপোরেশন থেকে জানানো হয়, প্রধান উপদেষ্টার অফিস থেকে অনুমতি না পেলে প্লট বরাদ্দ দেয়া যাবে না। কিন্তু সিটি করপোরেশন আর কোন উত্তর দেয়নি, অর্থাৎ প্রধান উপদেষ্টার অফিস থেকে অনুমতি মেলেনি। ঢাকা শহরের রাস্তাঘাট আর কবরস্থানের মালিক সিটি করপোরেশন, কবরের জায়গা বরাদ্দ দেয়ার একক ক্ষমতা ও এক্তিয়ার সিটি করপোরেশনেরই, তাহলে তারা মতিয়া চৌধুরীর কবরের তিন হাত জায়গার জন্য প্রধান উপদেষ্টার অফিসের মুখাপেক্ষী হলো কেন? কবরের জায়গা না পাওয়ায় স্বামী বজলুর রহমানের কবরে তাকে দাফন করা হয়েছে। চুয়ান্ন হাজার বর্গ মাইলের বাংলাদেশে একজন নির্লোভ, সৎ, কর্মঠ রাজনৈতিক নেতা ও মুক্তিযোদ্ধার জন্য তিন হাত জায়গা পাওয়া গেল নাÑ এটা জাতির জন্য একটি দুঃখজনক ঘটনা।
মতিয়া চৌধুরীকে কবরের জায়গা দিলে আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যেতÑ সম্ভবত এমন ধারণার বশবর্তী হয়ে কবরের জায়গা দেয়া হয়নি। মতিয়া চৌধুরীর প্রতি মিডিয়ার অতিরিক্ত দরদের কঠোর সমালোচনা করেছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব। তার মতে ‘ফ্যাসিস্ট’ ও দুর্নীতিগ্রস্ত স্বৈরশাসালের অংশ মতিয়া চৌধুরীর শোকগাথা রচনায় প্রশংসাসূচক বন্দনা থাকা অগ্রহণযোগ্য। এছাড়া মতিয়া চৌধুরী নাকি ২০১৮ সালে কোটাবিরোধী আন্দোলনের বিপক্ষে বক্তব্য দিয়েছিলেন। তাই তার প্রতি বৈষম্যবিরোধী অন্তর্র্বর্তী সরকারের দরদ থাকার কথা নয়। এতদসত্বেও রাজনৈতিক জীবনে সাদামাটা জীবনযাপনের জন্য তিনি সর্বস্তরের মানুষের কাছে প্রশংসিত হয়েছেন। মন্ত্রিত্বকালে তার জীবনযাত্রা-বসন-ভূষণে কোনো জৌলুশ পরিদৃষ্ট হয়নি। যখন মন্ত্রী থাকতেন না তখন পাবলিক বাস চেপেই তিনি নিজ নির্বাচনী এলাকায় যাতায়াত করতেন। মতিয়া চৌধুরীই প্রথম নারী যিনি ডাকসুর জিএস হয়েছিলেন, তিনিই প্রথম নারী যিনি একটি ছাত্র সংগঠনের সভাপতি হয়েছিলেন। এজন্যই বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের কাছেও তিনি শ্রদ্ধার পাত্র।
আমার দুই ভাই ডা. জহির উদ্দিন আহমেদ ও ড. মুনির উদ্দিন আহমেদ কলেজ জীবনে ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন বিধায় তাদের দেখে আমিও ছাত্র ইউনিয়নের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়ি। মতিয়া চৌধুরী যখন কমিউনিস্ট পার্টি ছেড়ে আওয়ামী লীগে যোগ দেন তখন আমরা আক্ষেপ করে বলেছিলাম, ‘অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলার, বিবৃতি দেয়ার একজন লোক কমে গেল’। চুয়াত্তরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর বক্তৃতার মঞ্চে তাকে বহুবার দেখেছি। মতিয়া চৌধুরীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে কথা বলার সুযোগ পেয়েছিলাম আমার কূটনৈতিক মুক্তিযোদ্ধা ভাই মহিউদ্দিন আহমদের বাসায়। আমার এই ভাই তার বাসার আঙ্গিনায় দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে প্রায় প্রতি মাসে গানের আসর বসাতেন। সেই আসরে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টির নেতারা ছাড়াও বিভিন্ন মত ও পথের বুদ্ধিজীবী থাকতেন। স্বামী বজলুর রহমানসহ মতিয়া চৌধুরী প্রায় সকল অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতেন। জাতীয় পার্টির জি এম কাদের এবং তার স্ত্রী শরিফা কাদের অনুষ্ঠানে গান গাইলেও মতিয়া চৌধুরী কখনো গান করেননি, অথচ তিনি বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতে গান শিখেছেন।
প্রকৃতপক্ষে মতিয়া চৌধুরী অসময়ে মরেছেন। যে কোন দলীয় সরকারের শাসনামলে মরলেও তার রাজকীয় কবর হতো, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গার্ড অব অনার পেতেন, জানাজার জন্য মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ লাগত। মাটির আলাদা কবর তার জন্য বন্ধ হলেও অগণিত মানুষের অজস্র হৃদয় বন্ধ হয়নি। তিনি বেঁচে থাকবেন মানুষের হৃদয়ে, অমর হয়ে থাকবেন সততার নন্দিত ইতিহাসে। তার মৃত্যুতে আমরা গভীরভাবে শোকাহত।
[লেখক : সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক]
জিয়াউদ্দীন আহমেদ
শনিবার, ২৬ অক্টোবর ২০২৪
১৬ অক্টোবর আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী ৮২ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেছেন। ইডেন কলেজে অধ্যয়নরত অবস্থায় মতিয়া চৌধুরী ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। এই দেশ গণতন্ত্রের জন্য উপযুক্ত নয়Ñ তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের এমন বিরূপ বক্তব্য শুনে তিনি রাজনীতির প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। সংস্কৃতিমনা ছিলেন বলেই সম্ভবত তিনি ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হন। ১৯৬১-৬২ সালে তিনি ইডেন কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি নির্বাচিত হন। ১৯৬৩-৬৪ সালে ছিলেন ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক, ভিপি ছিলেন রাশেদ খান মেনন। সামরিক শাসক আইয়ুব খানকে ‘ডিস্টার্ব’ করা যাবে নাÑ মওলানা ভাসানীর এমন উক্তির পর ছাত্র ইউনিয়নের মধ্যে চিন্তার বিভক্তির সূত্রপাত ঘটে। ১৯৬৫ সালে ছাত্র ইউনিয়ন দুই ভাগ হয়ে যায়Ñ চীনপন্থী মেনন গ্রুপ এবং রাশিয়াপন্থী মতিয়া গ্রুপ। ১৯৬৫ সালে তিনি ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি নির্বাচিত হন। ছাত্রজীবনে রাজনীতির ইতি টেনে তিনি ১৯৬৭ সালে অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপে যোগ দেন। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি বা সিপিবি প্রকাশ্যে রাজনীতি করার অনুমতি পায়, ১৯৭৩ সালে মতিয়া চৌধুরী ন্যাপ ছেড়ে সিপিবিতে যোগ দেন।
আইয়ুব খানের পাকিস্তান আমলে তিনি চারবার কারাবরণ করেন। শুধু রাজনীতি করার জন্যই প্রয়োজন হয় তার অভিভাবক বদলের। মতিয়া চৌধুরীকে রাজনীতি থেকে নিবৃত্ত করতে না পেরে তার পুলিশ বাবার ওপর আইয়ুব খান সরকারের প্রেসার আসে। এই প্রেসার থেকে বাবাকে মুক্তি দিতে মতিয়া চৌধুরী বিয়ের সিদ্ধান্ত নেন। অর্থাৎ অভিভাবক বদলের সিদ্ধান্ত নেন যাতে পুলিশ বাবা বিভাগীয় শাস্তি থেকে রেহাই পান। ১৯৬৪ সালে বিয়ে করেন সাংবাদিক বজলুর রহমানকে। বজলুর রহমান একই আদর্শের রাজনীতির অনুসারী ছিলেন বিধায় দুজনের মধ্যে পরিচয় ছিল, ঘনিষ্ঠতা ছিল। বিয়ের পর পুলিশ বাবা সরকারের হেনস্তা থেকে রেহাই পেলেও মতিয়া চৌধুরী কিন্তু রেহাই পাননি। বিয়ের এক মাস পরই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। পাকিস্তান আমলে শেষবার গ্রেপ্তার হন ১৯৬৭ সালে এবং দুই বছর জেল খেটে ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানে আইয়ুব খানের পতন হলে অন্যান্য রাজবন্দীর সঙ্গে তিনিও মুক্তি পান। রাজপথে তার এই সদর্প বিচরণ এবং অগ্নিঝরা বক্তব্য তাকে এনে দিয়েছিল ‘অগ্নিকন্যা’র খেতাব।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও জেলখানা তার পেছন ছাড়েনি। তিনি মোট ১৫ বার জেলে গেছেন। স্বাধীন বাংলাদেশে ন্যাপ বা কমিউনিস্ট পার্টির নেত্রী হিসেবে তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের কট্টর সমালোচক। স্বাধীনতা লাভের পর দেশের পুনর্গঠনে নানা অনিয়ম আর দুর্নীতি নিয়ে তিনি বিভিন্ন জনসভায় আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে কড়া কড়া কথা বলেছেন। ভারত থেকে আনা লুঙ্গি আর শাড়ি নিয়ে তিনি নানা ব্যঙ্গাত্মক বক্তব্যও দিয়েছেন। তিনি অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর ৬ দফার প্রচারে দেশের সর্বত্র ঘুরে বেড়িয়েছেন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন, বঙ্গবন্ধু তাকে স্নেহ করতেন। ১৯৬৭ সালে জেলে গেইটে ব্যক্তিগত জিনিসপত্র জমা দেয়ার সময় পেছন থেকে জেলবন্দী বঙ্গবন্ধু মতিয়া চৌধুরীর মাথায় হাত রেখে বলেছিলেনÑ ‘মতিয়া, ভয় পাইয়ো না’। রাজনৈতিক কারণে আওয়ামী লীগের সমালোচনা করলেও বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে কিন্তু তিনি কখনো গ্রেপ্তার হননি। গ্রেপ্তার হয়েছেন জিয়াউর রহমান, হোসেন মোহাম্মদ এরশাদ এবং খালেদা জিয়ার আমলে। এরশাদের আমলে তিনি নয়বার জেল খেটেছেন।
রাজনৈতিক মঞ্চে বক্তব্য দেয়ার শুরুতে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ বলার ব্যাপক প্রচলন হয় জিয়াউর রহমানের আমলে। এর উত্তরে মতিয়া চৌধুরীই জনসভার মঞ্চে প্রথম উল্লেখ করেন যে, সুরা তাওবার শুরুতে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ নেই। এই প্রসঙ্গে তিনি জিয়াউর রহমানকে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম বলার আগে ‘আউজুবিল্লাহি মিনাশ শায়তানির রাজিম’ বলে প্রথমে শয়তান তাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন। তার বাগ্মিতার জন্য তিনি জনপ্রিয় ছিলেন, কিন্তু শাসকরা ছিল রুষ্ট, তাই বঙ্গবন্ধুর মতো মতিয়া চৌধুরীরও জেলখানার জন্য সুটকেস গোছানো থাকত। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে মতিয়া চৌধুরী আবার ন্যাপে এসে রাজনীতি করতে থাকেন এবং ১৯৭৯ সালে ন্যাপ ছেড়ে যোগ দেন আওয়ামী লীগে।
মতিয়া চৌধুরী ১৯৭৯ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দিলেও প্রথমদিকে দলে সমাদৃত ছিলেন না। শেখ হাসিনা দলের নেতৃত্বে আসার পর তাকে কৃষি সম্পাদক করা হয়। পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী ছাড়াও তিনি জাতীয় সংসদের সংসদ উপনেতা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। বাংলাদেশে একটি কৃষি বিপ্লবে নেতৃত্ব দিয়েছেন কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী। অনেকের বিরোধিতা সত্ত্বেও তিনি হাইব্রিড বা জিআই বীজ ব্যবহারে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করেন, তার এই বৈপ্লবিক সিদ্ধান্তে বাংলাদেশে এখন সারা বছর বিভিন্ন ধরনের ফসল, ফল, ফুল, সবজি ইত্যাদির উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে। হাইব্রিড বীজের প্রধান উদ্দেশ্য থাকে উচ্চ ফলন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দশগুণ বেশি ফলন পাওয়া যায়। লোকসংখ্যা ৭ কোটি থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে ১৭ কোটি হয়েছে, হাইব্রিড বীজের ব্যবহার না হলে বাংলাদেশ খাদ্য শস্যের জন্য সম্পূর্ণ আমদানিনির্ভর থাকত।
তিনি মুক্তিযোদ্ধা হয়েও গার্ড অব অনার পাননি, পাননি তিন হাত লম্বা একটি কবরের জায়গাও। তার কবরের জন্য জায়গা চেয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের কাছে আবেদন করা হলে সিটি করপোরেশন থেকে জানানো হয়, প্রধান উপদেষ্টার অফিস থেকে অনুমতি না পেলে প্লট বরাদ্দ দেয়া যাবে না। কিন্তু সিটি করপোরেশন আর কোন উত্তর দেয়নি, অর্থাৎ প্রধান উপদেষ্টার অফিস থেকে অনুমতি মেলেনি। ঢাকা শহরের রাস্তাঘাট আর কবরস্থানের মালিক সিটি করপোরেশন, কবরের জায়গা বরাদ্দ দেয়ার একক ক্ষমতা ও এক্তিয়ার সিটি করপোরেশনেরই, তাহলে তারা মতিয়া চৌধুরীর কবরের তিন হাত জায়গার জন্য প্রধান উপদেষ্টার অফিসের মুখাপেক্ষী হলো কেন? কবরের জায়গা না পাওয়ায় স্বামী বজলুর রহমানের কবরে তাকে দাফন করা হয়েছে। চুয়ান্ন হাজার বর্গ মাইলের বাংলাদেশে একজন নির্লোভ, সৎ, কর্মঠ রাজনৈতিক নেতা ও মুক্তিযোদ্ধার জন্য তিন হাত জায়গা পাওয়া গেল নাÑ এটা জাতির জন্য একটি দুঃখজনক ঘটনা।
মতিয়া চৌধুরীকে কবরের জায়গা দিলে আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যেতÑ সম্ভবত এমন ধারণার বশবর্তী হয়ে কবরের জায়গা দেয়া হয়নি। মতিয়া চৌধুরীর প্রতি মিডিয়ার অতিরিক্ত দরদের কঠোর সমালোচনা করেছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব। তার মতে ‘ফ্যাসিস্ট’ ও দুর্নীতিগ্রস্ত স্বৈরশাসালের অংশ মতিয়া চৌধুরীর শোকগাথা রচনায় প্রশংসাসূচক বন্দনা থাকা অগ্রহণযোগ্য। এছাড়া মতিয়া চৌধুরী নাকি ২০১৮ সালে কোটাবিরোধী আন্দোলনের বিপক্ষে বক্তব্য দিয়েছিলেন। তাই তার প্রতি বৈষম্যবিরোধী অন্তর্র্বর্তী সরকারের দরদ থাকার কথা নয়। এতদসত্বেও রাজনৈতিক জীবনে সাদামাটা জীবনযাপনের জন্য তিনি সর্বস্তরের মানুষের কাছে প্রশংসিত হয়েছেন। মন্ত্রিত্বকালে তার জীবনযাত্রা-বসন-ভূষণে কোনো জৌলুশ পরিদৃষ্ট হয়নি। যখন মন্ত্রী থাকতেন না তখন পাবলিক বাস চেপেই তিনি নিজ নির্বাচনী এলাকায় যাতায়াত করতেন। মতিয়া চৌধুরীই প্রথম নারী যিনি ডাকসুর জিএস হয়েছিলেন, তিনিই প্রথম নারী যিনি একটি ছাত্র সংগঠনের সভাপতি হয়েছিলেন। এজন্যই বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের কাছেও তিনি শ্রদ্ধার পাত্র।
আমার দুই ভাই ডা. জহির উদ্দিন আহমেদ ও ড. মুনির উদ্দিন আহমেদ কলেজ জীবনে ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন বিধায় তাদের দেখে আমিও ছাত্র ইউনিয়নের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়ি। মতিয়া চৌধুরী যখন কমিউনিস্ট পার্টি ছেড়ে আওয়ামী লীগে যোগ দেন তখন আমরা আক্ষেপ করে বলেছিলাম, ‘অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলার, বিবৃতি দেয়ার একজন লোক কমে গেল’। চুয়াত্তরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর বক্তৃতার মঞ্চে তাকে বহুবার দেখেছি। মতিয়া চৌধুরীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে কথা বলার সুযোগ পেয়েছিলাম আমার কূটনৈতিক মুক্তিযোদ্ধা ভাই মহিউদ্দিন আহমদের বাসায়। আমার এই ভাই তার বাসার আঙ্গিনায় দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে প্রায় প্রতি মাসে গানের আসর বসাতেন। সেই আসরে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টির নেতারা ছাড়াও বিভিন্ন মত ও পথের বুদ্ধিজীবী থাকতেন। স্বামী বজলুর রহমানসহ মতিয়া চৌধুরী প্রায় সকল অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতেন। জাতীয় পার্টির জি এম কাদের এবং তার স্ত্রী শরিফা কাদের অনুষ্ঠানে গান গাইলেও মতিয়া চৌধুরী কখনো গান করেননি, অথচ তিনি বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতে গান শিখেছেন।
প্রকৃতপক্ষে মতিয়া চৌধুরী অসময়ে মরেছেন। যে কোন দলীয় সরকারের শাসনামলে মরলেও তার রাজকীয় কবর হতো, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গার্ড অব অনার পেতেন, জানাজার জন্য মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ লাগত। মাটির আলাদা কবর তার জন্য বন্ধ হলেও অগণিত মানুষের অজস্র হৃদয় বন্ধ হয়নি। তিনি বেঁচে থাকবেন মানুষের হৃদয়ে, অমর হয়ে থাকবেন সততার নন্দিত ইতিহাসে। তার মৃত্যুতে আমরা গভীরভাবে শোকাহত।
[লেখক : সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক]