alt

opinion » post-editorial

গাজায় মানবিক সংকট

আব্দুর রাজ্জাক

: শনিবার, ০২ নভেম্বর ২০২৪

গাজা পৃথিবীর সর্ববৃহৎ উন্মুক্ত কয়েদখানা, যেখানে বেঁচে থাকা তেইশ লাখ গাজাবাসীর সবাই যেন স্বাভাবিক মৃত্যুর অধিকার হারিয়েছে। ছিয়াত্তর বছরের ইতিহাসে ফিলিস্তিন বহু আগেই হয়ে উঠেছে বিশ্ব মানবতার শশ্মানভূমি। গত বছরের ৭ অক্টোবর গাজাবাসীর ওপর শুরু হওয়া প্রলয় যেন কোনোভাবেই থামছে না। কেমিক্যাল, বায়োলজিক্যাল কিংবা গণবিধ্বংসি সব ধরনের বোমা দিনে-রাতে বৃষ্টির মতো আছড়ে পড়ছে উপত্যকাটিতে। মৃত্যুর সংখ্যা ১০ হাজার থেকে ২০ হাজার ছাড়ালো, ৩০ হাজার পেরিয়ে ৪০ হাজার অতিক্রম করল এরপরও ইসরায়েলকে সন্তুষ্ট করার মতো মৃত ফিলিস্তিনির সংখ্যা যেন সামনে আসেনি পশ্চিমা বিশ্বের কথার দোকান খোলা এমন একজন নেতাকেও পাওয়া গেলো না যিনি বলবেন; অনেক হয়েছে, এবার থামো।

দক্ষিণ ইসরায়েলে হামাসের হামলার পর নেতানিয়াহুর চারটি কৌশল সামনে আসে। জিম্মিদের ফিরিয়ে আনা, ফিলিস্তিন এবং লেবাননের সব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে নিশ্চিহ্ন করা, ইরানের পরমাণু প্রকল্প ধ্বংস ও প্রতিরোধ অক্ষকে দুর্বল করা, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইসরায়েলসহ অঞ্চলটিকে নিজেদের মতো ঢেলে সাজানো। কাজেই তাদের উদ্দেশ্য হলো সব গাজাবাসীকে লেবানন আর মিশরে জোরপূর্বক শরণার্থী হিসেবে ঠেলে পাঠানো এবং এই অঞ্চলে তাদের নিরঙ্কুশ সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা।

ইসরায়েলের এহেন আগ্রাসী দখলদারিত্বের মাসুল গুনতে ফিলিস্তিনীদের ঝাঁকে ঝাঁকে প্রাণ দিতে হচ্ছে, যেখানে মৃত লাশগুলো যেন পরিণত হয়েছে স্রেফ একটি সংখ্যায়। গাজায় এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, যেখানে সমাধি করার জায়গা নেই, শোক প্রকাশের ফুরসত নেই, এমনকি দুঃখিত হওয়ারও সময় নেই গাজাবাসীর।

যারা বেঁচে আছেন তারা ইসরায়েলের অবরোধ, দখল, উপনিবেশায়নে দিশাহারা হয়ে পড়েছে। মৃত্যুর দিনের অপেক্ষা করা, পরিবার-পরিজন, বন্ধু-প্রতিবেশীর মৃত্যু দেখাই তাদের ‘রুটিন ওয়ার্ক’ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

অতিদরিদ্র গাজার পূর্বেকার ৭০ শতাংশ বেকারত্ব এখন শতভাগ ছুয়েছে। বেকারত্ব, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, অঘোষিত মৃত্যুর পরোয়ানা মাথায় বয়ে চলার সঙ্গে সঙ্গে চারিদিকে ধ্বংস আর মৃত্যুর হোলি উৎসবে গাজাবাসী ‘পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডারের’ মধ্যে চলে যাচ্ছে।

হামাসের আক্রমণের পরপরই ইসরায়েল গাজার পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস এবং নেটওয়ার্ক সেবা বন্ধ করে কৃত্রিম মহাদুর্ভিক্ষের আয়োজন করেছে। খাদ্য-পানির সংকটে ২২ লাখ জনসংখ্যার অর্ধেক শিশু রয়েছে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে। পুষ্টির অভাবে এসব শিশু অপূর্ণ মানসিক বিকাশ, বামনত্ব, টাইপ-২ ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ এবং সিজোফ্রেনিয়ার মতো সমস্যা নিয়ে বেড়ে উঠছে। এরইমধ্যে চূড়ান্ত বিজয় নিশ্চিত করতে ইসরায়েল কর্তৃক গাজায় সংক্রামক রোগগুলো ছড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা প্রকাশিত হয়েছে।

অক্সফামের তথ্যমতে, ইসরায়েল ইতোমধ্যে পানি যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত করেছে। গত বছর হামাসের হামলার পরেই তারা রাফাহ সীমান্তে ত্রিশটি নলকূপ বিনষ্ট করেছে, পানির রিজার্ভার ধ্বংস করেছে, সত্তর ভাগের বেশি পয়ঃপ্রণালি এবং অবিশুদ্ধ পানি বিশুদ্ধ করার প্লান্ট সম্পূর্ণ বিধ্বংস করে ফেলেছে। ফলশ্রুতিতে, সুপেয় পানি উৎপাদন কমেছে চুয়াত্তর ভাগ এবং সরবরাহ কমেছে চুরাশি ভাগ। গাজাবাসী পানির জন্য হাহাকার করছে। ফোরাত নদীর উপকূলে কারবালার প্রান্তরে পানির অভাবে ছটফট করা ইমাম হোসেনের কষ্ট যেন তারা চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করছে।

সম্প্রতি পয়ঃনালির পানিতে মিলছে পোলিওর জীবাণু, যেটি অন্ত্রে বাড়ে, রক্তের মাধ্যমে মাসল টিস্যুকে আক্রমণ করে প্যারালাইসিস এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত ঘটায়।

জাতিসংঘের তথ্যমতে, গাজায় ইসরায়েলি হামলায় ইতোমধ্যে জমা হয়েছে সাইত্রিশ লাখ মেট্রিক টন আবর্জনা। এর মধ্যে আছে আট লাখ টন এসবেস্টস। এসবেস্টসকে বলা হয় নীরব মৃত্যুর বীজ। স্বাভাবিক অবস্থায় ক্ষতিকর না হলেও বাতাসের কণার সঙ্গে এসবেস্টসের মাইক্রোমলিকুল মেশে শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। নাইন এলিভেনের টুইন টাওয়ার হামলায় প্রাথমিক মৃত্যুর সংখ্যা ছিল হাজার-তিনেকের কাছাকাছি কিন্তু এসবেস্টস এবং অন্যান্য দূষণ-সংক্রান্ত কারণেই পরবর্তীতে মৃত্যু সংখ্যা সাড়ে চার হাজারে গিয়ে দাঁড়ায়। বাতাসে এসবেস্টসের ঘনত্ব বাড়লে মানুষ মেসোথেলিওমা নামক ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। ফুসফুস এবং পাকস্থলীর বাইরে আবরণ সৃষ্টির মাধ্যমে মানুষকে অকাল মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। এই বিপদ থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হলো গাজাবাসীর ধ্বংসস্তূপের এলাকা পেছনে ফেলে কোনো নিরাপদ আশ্রয়ে শরণার্থী হওয়া।

৫৫ বর্গকিলোমিটারের রাফাহ শহরে সিনাই পর্বতের পার ঘেঁষে গড়ে ওঠা রাফাহ সীমান্ত হলো গাজা থেকে মিশরে যাওয়ার একমাত্র সীমান্ত ক্রসিং। গাজা উপত্যকাটি দৈর্ঘ্যে একচল্লিশ কিলোমিটার, ও প্রস্থে কোথাও ছয় কোথাও আবার বারো কিলোমিটার। গাজার পূর্ব দিকে রয়েছে ইসরায়েলি ট্যাংক আর পশ্চিমে ভূমধ্যসাগরে ইসরায়েলি ফ্রিগেট-সাবমেরিনের কড়া প্রহরা। অপরদিকে রাফাহ সীমান্তের রিমোট কন্ট্রোলও ইসরায়েলের মেজাজ-মর্জিতে আটকা থাকে। বিভিন্ন দেশের পাঠানো খাবার, পানি কিংবা জরুরি ওষুধের মতো ত্রাণসামগ্রীবোঝাই সহগ্র ট্রাকগুলো রাফাহ সীমান্তে দিনের পর দিন অপেক্ষা করার পরও গাজায় ঢুকতে পারে না। একদিকে ইসরালের ভয়াবহ আগ্রাসন, অপরদিকে পর্যাপ্ত খাদ্য ও চিকিৎসার অভাবে দিনেদিনে গাজা পরিণত হচ্ছে ভয়াল মৃত্যুপুরীতে।

গগণস্পর্শী লাশের স্তূপ, মুহূর্তের মধ্যে পরিবার-পরিজন হারিয়ে সহায়-সম্বলহীন হয়ে পড়ার বেদনা, ধুলোমাখা ক্ষুধার্ত শিশুর করুণ আর্তনাদ কোটি মানুষের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটালেও তা এখনো ছুঁতে পারেনি বিশ্বনেতাদের অন্তর। মানবতা জাগ্রত হোক, বিশ্বনেতারা সম্মিলিতভাবে থামিয়ে দিক গাজাবাসীদের মৃত্যুর প্রহর গণনা, এটাই এখন বিশ্ববাসীর প্রাণের দাবি।

[লেখক : শিক্ষক ও জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী]

নরসুন্দর পেশার গুরুত্ব ও সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন

বিভাগভিত্তিক এমপিআর নির্বাচন পদ্ধতি

প্ল্যাটফর্ম সমাজে বাংলাদেশ: জ্ঞানের ভবিষ্যৎ কার হাতে?

আনন্দবেদনার হাসপাতাল: সরকারি ও বেসরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থার বাস্তবতা

ছবি

ভিন্ন ধরনের নির্বাচন, ভিন্ন ধরনের ফল

বেসরকারি খাতে সিআইবি’র যাত্রা: ঋণ ব্যবস্থার নতুন দিগন্ত

স্বাস্থ্যসেবায় মানবিকতা প্রতিষ্ঠা হোক

ছবি

নেপালে সরকার পতন ও বামপন্থীদের ভবিষ্যৎ

ডাকসু নির্বাচন ও সংস্কারপ্রয়াস: রাজনৈতিক চিন্তার নতুন দিগন্ত

নির্বাচন কি সব সমস্যার সমাধান

জিতিয়া উৎসব

ছবি

অলির পর নেপাল কোন পথে?

রম্যগদ্য: “মরেও বাঁচবি নারে পাগলা...”

অপরিকল্পিত নগরায়ন ও শ্রীপুর পৌরসভা

ভূরিভোজ, উচ্ছেদ এবং আদিবাসী পাহাড়িয়া

অনলাইন সংস্কৃতিতে হাস্যরসের সমাজবিজ্ঞান

মামলাজট নিরসনে দেওয়ানি কার্যবিধির সংস্কার

বাস্তব মস্কো বনাম বিভ্রান্ত ইউরোপ

ছাত্রসংসদ নির্বাচন ও ভবিষ্যৎ ছাত্ররাজনীতির গতিপ্রকৃতি

সড়ক দুর্ঘটনা: কারও মৃত্যু সাধারণ, কারও মৃত্যু বিশেষ

ঐকমত্য ছাড়াও কিছু সংস্কার সম্ভব

আবার বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম : সংকটে সাধারণ মানুষ

ডায়াবেটিস রোগীর সেবা ও জনসচেতনতা

ভিন্ন ধরনের ডাকসু নির্বাচন

ডাকসু নির্বাচন : পেছনে ফেলে আসি

প্রসঙ্গ : এলডিসি তালিকা থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ

“কোপা চাটিগাঁ...”

ই-কমার্স হতে পারে প্রবৃদ্ধির ইঞ্জিন

ভারত-চীনের নতুন সমীকরণ

সাইবার যুগে মানুষের মর্যাদা ও নিরাপত্তা

ছবি

ভারত-চীন সম্পর্কে কৌশলগত উষ্ণতার সূচনা

ভারত-চীন সম্পর্কে কৌশলগত উষ্ণতার সূচনা

একজন নাগরিকের অভিমানী বিদায় ও রাষ্ট্রের নৈতিক সংকট

নিষিদ্ধ জালের অভিশাপে হুমকির মুখে সমুদ্রের জীববৈচিত্র্য

আধিপত্যবাদের শৃঙ্খল এবং পুঁজির লুন্ঠন যাদের রক্তাক্ত করে, তাদের চাই একজোটে

জার্মানি : কৃচ্ছসাধনের বোঝা জনগণের কাঁধে

tab

opinion » post-editorial

গাজায় মানবিক সংকট

আব্দুর রাজ্জাক

শনিবার, ০২ নভেম্বর ২০২৪

গাজা পৃথিবীর সর্ববৃহৎ উন্মুক্ত কয়েদখানা, যেখানে বেঁচে থাকা তেইশ লাখ গাজাবাসীর সবাই যেন স্বাভাবিক মৃত্যুর অধিকার হারিয়েছে। ছিয়াত্তর বছরের ইতিহাসে ফিলিস্তিন বহু আগেই হয়ে উঠেছে বিশ্ব মানবতার শশ্মানভূমি। গত বছরের ৭ অক্টোবর গাজাবাসীর ওপর শুরু হওয়া প্রলয় যেন কোনোভাবেই থামছে না। কেমিক্যাল, বায়োলজিক্যাল কিংবা গণবিধ্বংসি সব ধরনের বোমা দিনে-রাতে বৃষ্টির মতো আছড়ে পড়ছে উপত্যকাটিতে। মৃত্যুর সংখ্যা ১০ হাজার থেকে ২০ হাজার ছাড়ালো, ৩০ হাজার পেরিয়ে ৪০ হাজার অতিক্রম করল এরপরও ইসরায়েলকে সন্তুষ্ট করার মতো মৃত ফিলিস্তিনির সংখ্যা যেন সামনে আসেনি পশ্চিমা বিশ্বের কথার দোকান খোলা এমন একজন নেতাকেও পাওয়া গেলো না যিনি বলবেন; অনেক হয়েছে, এবার থামো।

দক্ষিণ ইসরায়েলে হামাসের হামলার পর নেতানিয়াহুর চারটি কৌশল সামনে আসে। জিম্মিদের ফিরিয়ে আনা, ফিলিস্তিন এবং লেবাননের সব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে নিশ্চিহ্ন করা, ইরানের পরমাণু প্রকল্প ধ্বংস ও প্রতিরোধ অক্ষকে দুর্বল করা, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইসরায়েলসহ অঞ্চলটিকে নিজেদের মতো ঢেলে সাজানো। কাজেই তাদের উদ্দেশ্য হলো সব গাজাবাসীকে লেবানন আর মিশরে জোরপূর্বক শরণার্থী হিসেবে ঠেলে পাঠানো এবং এই অঞ্চলে তাদের নিরঙ্কুশ সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা।

ইসরায়েলের এহেন আগ্রাসী দখলদারিত্বের মাসুল গুনতে ফিলিস্তিনীদের ঝাঁকে ঝাঁকে প্রাণ দিতে হচ্ছে, যেখানে মৃত লাশগুলো যেন পরিণত হয়েছে স্রেফ একটি সংখ্যায়। গাজায় এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, যেখানে সমাধি করার জায়গা নেই, শোক প্রকাশের ফুরসত নেই, এমনকি দুঃখিত হওয়ারও সময় নেই গাজাবাসীর।

যারা বেঁচে আছেন তারা ইসরায়েলের অবরোধ, দখল, উপনিবেশায়নে দিশাহারা হয়ে পড়েছে। মৃত্যুর দিনের অপেক্ষা করা, পরিবার-পরিজন, বন্ধু-প্রতিবেশীর মৃত্যু দেখাই তাদের ‘রুটিন ওয়ার্ক’ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

অতিদরিদ্র গাজার পূর্বেকার ৭০ শতাংশ বেকারত্ব এখন শতভাগ ছুয়েছে। বেকারত্ব, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, অঘোষিত মৃত্যুর পরোয়ানা মাথায় বয়ে চলার সঙ্গে সঙ্গে চারিদিকে ধ্বংস আর মৃত্যুর হোলি উৎসবে গাজাবাসী ‘পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডারের’ মধ্যে চলে যাচ্ছে।

হামাসের আক্রমণের পরপরই ইসরায়েল গাজার পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস এবং নেটওয়ার্ক সেবা বন্ধ করে কৃত্রিম মহাদুর্ভিক্ষের আয়োজন করেছে। খাদ্য-পানির সংকটে ২২ লাখ জনসংখ্যার অর্ধেক শিশু রয়েছে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে। পুষ্টির অভাবে এসব শিশু অপূর্ণ মানসিক বিকাশ, বামনত্ব, টাইপ-২ ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ এবং সিজোফ্রেনিয়ার মতো সমস্যা নিয়ে বেড়ে উঠছে। এরইমধ্যে চূড়ান্ত বিজয় নিশ্চিত করতে ইসরায়েল কর্তৃক গাজায় সংক্রামক রোগগুলো ছড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা প্রকাশিত হয়েছে।

অক্সফামের তথ্যমতে, ইসরায়েল ইতোমধ্যে পানি যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত করেছে। গত বছর হামাসের হামলার পরেই তারা রাফাহ সীমান্তে ত্রিশটি নলকূপ বিনষ্ট করেছে, পানির রিজার্ভার ধ্বংস করেছে, সত্তর ভাগের বেশি পয়ঃপ্রণালি এবং অবিশুদ্ধ পানি বিশুদ্ধ করার প্লান্ট সম্পূর্ণ বিধ্বংস করে ফেলেছে। ফলশ্রুতিতে, সুপেয় পানি উৎপাদন কমেছে চুয়াত্তর ভাগ এবং সরবরাহ কমেছে চুরাশি ভাগ। গাজাবাসী পানির জন্য হাহাকার করছে। ফোরাত নদীর উপকূলে কারবালার প্রান্তরে পানির অভাবে ছটফট করা ইমাম হোসেনের কষ্ট যেন তারা চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করছে।

সম্প্রতি পয়ঃনালির পানিতে মিলছে পোলিওর জীবাণু, যেটি অন্ত্রে বাড়ে, রক্তের মাধ্যমে মাসল টিস্যুকে আক্রমণ করে প্যারালাইসিস এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত ঘটায়।

জাতিসংঘের তথ্যমতে, গাজায় ইসরায়েলি হামলায় ইতোমধ্যে জমা হয়েছে সাইত্রিশ লাখ মেট্রিক টন আবর্জনা। এর মধ্যে আছে আট লাখ টন এসবেস্টস। এসবেস্টসকে বলা হয় নীরব মৃত্যুর বীজ। স্বাভাবিক অবস্থায় ক্ষতিকর না হলেও বাতাসের কণার সঙ্গে এসবেস্টসের মাইক্রোমলিকুল মেশে শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। নাইন এলিভেনের টুইন টাওয়ার হামলায় প্রাথমিক মৃত্যুর সংখ্যা ছিল হাজার-তিনেকের কাছাকাছি কিন্তু এসবেস্টস এবং অন্যান্য দূষণ-সংক্রান্ত কারণেই পরবর্তীতে মৃত্যু সংখ্যা সাড়ে চার হাজারে গিয়ে দাঁড়ায়। বাতাসে এসবেস্টসের ঘনত্ব বাড়লে মানুষ মেসোথেলিওমা নামক ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। ফুসফুস এবং পাকস্থলীর বাইরে আবরণ সৃষ্টির মাধ্যমে মানুষকে অকাল মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। এই বিপদ থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হলো গাজাবাসীর ধ্বংসস্তূপের এলাকা পেছনে ফেলে কোনো নিরাপদ আশ্রয়ে শরণার্থী হওয়া।

৫৫ বর্গকিলোমিটারের রাফাহ শহরে সিনাই পর্বতের পার ঘেঁষে গড়ে ওঠা রাফাহ সীমান্ত হলো গাজা থেকে মিশরে যাওয়ার একমাত্র সীমান্ত ক্রসিং। গাজা উপত্যকাটি দৈর্ঘ্যে একচল্লিশ কিলোমিটার, ও প্রস্থে কোথাও ছয় কোথাও আবার বারো কিলোমিটার। গাজার পূর্ব দিকে রয়েছে ইসরায়েলি ট্যাংক আর পশ্চিমে ভূমধ্যসাগরে ইসরায়েলি ফ্রিগেট-সাবমেরিনের কড়া প্রহরা। অপরদিকে রাফাহ সীমান্তের রিমোট কন্ট্রোলও ইসরায়েলের মেজাজ-মর্জিতে আটকা থাকে। বিভিন্ন দেশের পাঠানো খাবার, পানি কিংবা জরুরি ওষুধের মতো ত্রাণসামগ্রীবোঝাই সহগ্র ট্রাকগুলো রাফাহ সীমান্তে দিনের পর দিন অপেক্ষা করার পরও গাজায় ঢুকতে পারে না। একদিকে ইসরালের ভয়াবহ আগ্রাসন, অপরদিকে পর্যাপ্ত খাদ্য ও চিকিৎসার অভাবে দিনেদিনে গাজা পরিণত হচ্ছে ভয়াল মৃত্যুপুরীতে।

গগণস্পর্শী লাশের স্তূপ, মুহূর্তের মধ্যে পরিবার-পরিজন হারিয়ে সহায়-সম্বলহীন হয়ে পড়ার বেদনা, ধুলোমাখা ক্ষুধার্ত শিশুর করুণ আর্তনাদ কোটি মানুষের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটালেও তা এখনো ছুঁতে পারেনি বিশ্বনেতাদের অন্তর। মানবতা জাগ্রত হোক, বিশ্বনেতারা সম্মিলিতভাবে থামিয়ে দিক গাজাবাসীদের মৃত্যুর প্রহর গণনা, এটাই এখন বিশ্ববাসীর প্রাণের দাবি।

[লেখক : শিক্ষক ও জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী]

back to top