মাহরুফ চৌধুরী
মানবসভ্যতার ইতিহাসে মানুষ তার অগ্রযাত্রার পথে অধিকার আদায়ের জন্য বিভিন্ন সময়ে সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছে। প্রতিটি যুগে দাবি আদায়ের পন্থা ও কৌশল সময়ের প্রয়োজনে পাল্টে গেছে, কিন্তু এই প্রশ্নটি আজও প্রাসঙ্গিক- দাবি আদায়ে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করা কি আদৌ নৈতিক? এটি কি সভ্য জাতির পরিচায়ক হতে পারে? ইতিহাসের পাতায় আমরা এমন অনেক আন্দোলনের উদাহরণ দেখতে পাই যেখানে দাবি আদায় হয়েছে ন্যায়সংগত পন্থায়, নিরীহ জনগণের জীবনযাত্রাকে ব্যাহত না করেই। আবার এমন আন্দোলনেরও নজির রয়েছে; যা সমাজের শৃঙ্খলা ভেঙে দিয়েছে এবং সাধারণ মানুষের অসহায়ত্বের কারণ হয়েছে। সভ্য সমাজের মূল বৈশিষ্ট্য হলো সামষ্টিক উন্নয়নে সমঝোতা, সংলাপ এবং সমস্যা সমাধানে গণমানুষের আকাক্সক্ষা ও কল্যাণকে অগ্রাধিকার দেওয়া। দাবি আদায়ে রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া, সরকারি অফিস ঘেরাও করা হরহামেশাই হচ্ছে। জান-মালের ক্ষয়-ক্ষতিসহ প্রতিনিয়ত জনসাধারণের দুর্ভোগ বাড়ছে।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে ইতিহাসের আলোকে দাবি আদায়ের সঠিক পন্থা কি হতে পারে তা নিয়ে আলোচনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উপমহাদেশে ঔপনিবেশিক শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে ভাঙচুর আর জ্বালাওপোড়াওয়ের মতো আত্মঘাতী রাজনৈতিক অপসংস্কৃতির সূচনা। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, সরকার বা শাসক শ্রেণীর কাছ থেকে দাবি আদায়ে জনদুর্ভোগ সৃষ্টিকারী আন্দোলনের যেমন নজির রয়েছে, তেমনি শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মাধ্যমেও উল্লেখযোগ্য সাফল্যের উদাহরণ পাওয়া যায়। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে মহাত্মা গান্ধীর অহিংস আন্দোলন এ ক্ষেত্রে অনন্য উদাহরণ। গান্ধীর নেতৃত্বে পরিচালিত অসহযোগ আন্দোলন ও লবণ সত্যাগ্রহ জনদুর্ভোগমুক্ত ছিল এবং এতে মানবিক মূল্যবোধের প্রতিফলন ঘটেছিল। জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ সত্ত্বেও এসব আন্দোলন অন্যের জীবনযাত্রাকে অচল করে তোলেনি। বাংলাদেশের ইতিহাসেও দাবি আদায়ের জন্য লড়াইয়ের অনন্য উদাহরণ রয়েছে। আমাদের ভাষা আন্দোলন ছিল একটি আদর্শিক ও নীতিনির্ভর সংগ্রাম, যা গণমানুষের চেতনার জাগরণ ঘটিয়েছে, ঐক্যবদ্ধ হতে অনুপ্রাণিত করেছে, কিন্তু জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করেনি।
অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধ ছিল আমাদের স্বাধীনতা ও অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই, যার ফলে শত্রুর মোকাবেলা করতে ব্যবহৃত নানা কৌশলের কিছু অপ্রত্যাশিত প্রভাব জনগণের উপর পড়েছিল। তবে সেটি একটি বৃহত্তর কল্যাণের লক্ষ্য অর্জনে অপরিহার্য ছিল।
পৃথিবীর ইতিহাসে ফরাসি বিপ্লব একটি শিক্ষণীয় উদাহরণ, যেখানে দাবি আদায়ের প্রচেষ্টায় ব্যাপক জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হয়েছিল। খাদ্য সংকট, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং সহিংসতার ফলে সাধারণ মানুষ অমানবিক পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়। বিপ্লবের লক্ষ্য ছিল স্বাধীনতা, সাম্য, এবং ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠাÑযা মহৎ এবং অনুপ্রেরণামূলক। তবে এই লক্ষ্যে পৌঁছানোর পথে সহিংসতা, চরমপন্থা, এবং সুশৃঙ্খলতার অভাব বিপ্লবের মূল উদ্দেশ্যকে আড়াল করে দেয়। এর ফলে সমাজে দীর্ঘমেয়াদী অস্থিরতা এবং সংকট সৃষ্টি হয়, যা সাধারণ মানুষের জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে। ইতিহাসের এইসব উদাহরণ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে দাবি আদায়ের প্রক্রিয়াটি শুধু উদ্দেশ্যেই নয়, পদ্ধতিতেও ন্যায়সংগত এবং মানবিক হওয়া উচিত। আন্দোলনের উপায় যখন জনকল্যাণের বিপরীত দিকে যায়, তখন তা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অগ্রগতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ন্যায্য অধিকার আদায়ের আন্দোলনের প্রতিটি ধাপেই মানবিক মূল্যবোধ এবং জনকল্যাণকে অগ্রাধিকার দেয়া প্রয়োজন। একটি সভ্য জাতির পরিচায়ক হলো তার জনগণের মধ্যে ন্যায়বোধ, মানবিকতা এবং সংহতির সংস্কৃতি।
দর্শন ও নৈতিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে দাবি আদায়ের উপায় এবং উদ্দেশ্য গভীরভাবে বিচার করা জরুরি। উপায় এবং উদ্দেশ্যের মধ্যে সম্পর্ক সবসময়ই বিতর্কের বিষয়। মধ্যযুগের ইতালিয়ান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও দার্শনিক ম্যাকিয়াভেলি (১৪৬৯-১৫২৭) বলেছেন, ‘উদ্দেশ্যই মাধ্যমকে বৈধতা দেয়’, যা ইঙ্গিত করে যে মহৎ লক্ষ্য অর্জনের জন্য যে কোনো উপায় গ্রহণযোগ্য। তবে মহাত্মা গান্ধী (১৮৬৯-১৯৪৮) এ মতবাদ কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এবং বলেছিলেন, ‘অসৎ উপায়ে সৎ উদ্দেশ্য সাধন সম্ভব নয়’। এর অর্থ দাবি আদায়ের পন্থা যদি মানবিক মূল্যবোধ লঙ্ঘন করে, তবে সেটি নৈতিকতার মানদ-ে কখনই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করে দাবি আদায় করা অসৎ উপায় হিসেবে বিবেচিত হতে পারে, কারণ এতে মানবতার প্রতি দায়বদ্ধতার অভাব প্রকট হয়।
রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে সামগ্রিক জনহিত বনাম বিশেষ গোষ্ঠী বা দলের স্বার্থের দ্বন্দ্ব গুরুত্বপূর্ণ। সামাজিক চুক্তি (সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট) তত্ত্বের আলোকে, রাষ্ট্র ও জনগণের মধ্যে একটি পারস্পরিক চুক্তি বিদ্যমান, যেখানে রাষ্ট্র নাগরিকের কল্যাণ নিশ্চিত করবে এবং নাগরিকগণ রাষ্ট্রের শৃঙ্খলা রক্ষা করবে। কিন্তু যখন কোনো গোষ্ঠী তার স্বার্থে জনজীবনে বিপর্যয় সৃষ্টি করে, তখন তা এই সামাজিক চুক্তি লঙ্ঘন করে। জনদুর্ভোগ সৃষ্টিকারী আন্দোলন সামষ্টিক কল্যাণের চেয়ে ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয়, যা একদিকে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। অপরদিকে এটি কল্যাণমুখী রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্য ক্ষতিকর এবং একটি সভ্য সমাজের ভিত্তিকে দুর্বল করে।
প্রকৃতপক্ষে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি না করেও দাবি আদায়ের পন্থা গ্রহণ করা নৈতিকতার উচ্চতম স্তরের প্রকাশ। এটি দেখায় যে আন্দোলনকারীরা শুধু নিজেদের দাবি নয়, বৃহত্তর সমাজের প্রতি দায়িত্বশীল এবং সমাজের অন্যান্য সদস্যদের অধিকারের বিষয়ে সচেতন। জনকল্যাণমুখী আন্দোলনই মানবতার প্রকৃত পরিচয় বহন করে এবং সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনে। মানবাধিকারের প্রশ্নটি এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, প্রত্যেক মানুষের স্বাধীনভাবে চলাফেরা, জীবনযাপন এবং নিজের অধিকার ভোগের নিশ্চয়তা রয়েছে। এই সনদে মানুষের মৌলিক অধিকারসমূহকে সার্বজনীন ও অবিভাজ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। জনদুর্ভোগ সৃষ্টিকারী যেকোনো কর্মকা- এই মৌলিক অধিকারগুলোকে লঙ্ঘন করে। এটি শুধু ব্যক্তির স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ বা আঘাত হানে না, বরং বৃহত্তর সমাজের স্থিতিশীলতাকেও হুমকির মুখে ফেলে। যখন একটি গোষ্ঠী তার দাবি আদায়ের জন্য রাস্তা অবরোধ, যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা বা গুরুত্বপূর্ণ সেবা ব্যবস্থায় বিঘœ ঘটায়, তখন এটি সমাজের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে। দরিদ্র জনগোষ্ঠী, যারা দৈনিক আয়ের উপর নির্ভরশীল, এ ধরনের কর্মকা-ে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে, এই ধরনের আন্দোলন মানবাধিকারের গুরুতর লঙ্ঘনের পাশাপাশি একটি সমতাভিত্তিক সমাজ গঠনের পথে বাধাও সৃষ্টি করে।
মানবাধিকারের মূল দর্শন হলো- একটি সমাজে প্রত্যেকের অধিকার সমানভাবে রক্ষিত হবে এবং এক ব্যক্তির অধিকার কোন অবস্থাতেই অন্যের অধিকার ক্ষুন্ন করবে না। তাই জনদুর্ভোগ সৃষ্টিকারী অধিকার আদায়ের আন্দোলন শুধুমাত্র নৈতিকতার প্রশ্নেই ব্যর্থ হয় না, এটি মানবাধিকারের সার্বজনীন নীতির সঙ্গেও সাংঘর্ষিক। এই দৃষ্টিকোণ থেকে, জনকল্যাণমুখী আন্দোলনই সত্যিকারভাবে মানবাধিকারের চেতনা ধারণ করে এবং একটি সভ্য ও মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার পথে অগ্রসর হয়। তাই সমস্যা সমাধানের জন্য জনদুর্ভোগ এড়িয়ে বিকল্প উপায় এবং কার্যকর পন্থা অবলম্বন অত্যন্ত জরুরি।
আন্দোলনে নামার আগে এর রূপ এবং কাঠামো পরিষ্কারভাবে নির্ধারণ করা উচিত। একটি সভ্য জাতি কখনই অযৌক্তিক বা ধ্বংসাত্মক উপায়ে দাবি আদায়ের পথ বেছে নেয় না। এর পরিবর্তে আলোচনা, সংলাপ, মধ্যস্থতা এবং শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের মতো বিকল্প পন্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। এসব পন্থা শুধু জনজীবনকে স্বাভাবিক রাখে না, বরং আন্দোলনের নৈতিকতা ও গ্রহণযোগ্যতাও বৃদ্ধি করে। প্রযুক্তি এবং তথ্যের এই যুগে দাবি আদায়ের জন্য কার্যকর পন্থা আরও সহজ ও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এখন এমন একটি হাতিয়ার, যা দ্রুত জনমত গঠনে এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তথ্য ও উপাত্তের মাধ্যমে সমস্যা উপস্থাপন এবং জনসমর্থন আদায় করা হলে আন্দোলনের প্রভাব আরও দৃঢ় হয়। গণমাধ্যম এবং প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার আন্দোলনকে গঠনমূলক করে তুলতে পারে এবং সহিংসতা বা অরাজকতার পথ থেকে দূরে রাখতে পারে। তবে, জনদুর্ভোগ এড়াতে আন্দোলনকারীদের পাশাপাশি রাষ্ট্রেরও সমান দায়দায়িত্ব রয়েছে। রাষ্ট্র ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলো যদি সময়মতো উদ্ভুত পরিস্থিতিতে হস্তক্ষেপ করে এবং বঞ্চিতদের অধিকার দিতে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে এবং আন্দোলনকারিদের দাবিকে গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করে, তবে অস্থিরতা অনেকাংশে এড়ানো সম্ভব। একই সঙ্গে আন্দোলনকারীদেরও তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবেÑতাদের কার্যকলাপ যেন সাধারণ মানুষের ভোগান্তির কারণ না হয়, সমাজের শৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতাকে বিঘিœত না করে। এভাবে সমন্বিত দায়বদ্ধতার মাধ্যমে একটি সভ্য ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব।
ইতিহাস যেমন আমাদের ভুল থেকে শিখতে শেখায়, তেমনি এটি আমাদের অনুপ্রাণিত করে এমন একটি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে যেখানে মানুষের দাবি আদায়ের জন্য শান্তিপূর্ণ, যুক্তিবাদী, এবং নৈতিক উপায়গুলো প্রাধান্য পায়। মানবিকতা এবং জনকল্যাণের পথ অনুসরণ করেই একটি জাতি তার সত্যিকারের সভ্যতাবোধ প্রকাশ করতে পারে। অতীতের শিক্ষা থেকে এই উপলব্ধি আসা উচিত যে, আদর্শ এবং উপায়ের মধ্যে সঙ্গতি না থাকলে কোনো আন্দোলনই দীর্ঘমেয়াদে সমাজের জন্য কল্যাণকর হতে পারে না।
আমাদের মনে রাখতে হবে যে, সভ্য জাতির প্রকৃত পরিচয় নিহিত থাকে তার মানবিক মূল্যবোধ, সুশৃঙ্খল আচরণ এবং শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমস্যা সমাধানের সক্ষমতায়। জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করে দাবি আদায় শুধু নিরীহ মানুষের জীবনযাত্রাকে বিপর্যস্ত করে না, বরং এটি একটি জাতির সভ্যতাবোধ এবং নৈতিক অবস্থানের ওপর প্রশ্ন তোলে। একটি জাতির অগ্রগতি এবং মর্যাদা তার সদস্যদের আচরণ এবং সংকট সমাধানের পদ্ধতির মাধ্যমেই প্রতিফলিত হয়। দাবি আদায়ের প্রক্রিয়ায় যদি মানবিকতা এবং নৈতিকতার স্থান হারায়, তবে তা শুধু সাময়িক লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক হলেও দীর্ঘমেয়াদে জাতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। সভ্য জাতির দায়িত্ব হলো সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে সংলাপ, আলোচনার মতো অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং জনকল্যাণমুখী পদ্ধতি অনুসরণ করা।
অধিকার আদায়ের আন্দোলন কখনোই ধ্বংসাত্মক বা জনজীবনকে বিপন্ন করার মাধ্যম হওয়া উচিত নয়। এর পরিবর্তে শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খল প্রতিবাদের মাধ্যমে জনমত গঠন, প্রযুক্তির ব্যবহার এবং গঠনমূলক উপায় অবলম্বন করে দাবি আদায়ের পথ সুগম করতে হবে। রাষ্ট্রপ্রশাসন ও নাগরিকদের পারস্পরিক আস্থা এবং দায়িত্বশীল আচরণের মাধ্যমেই এই লক্ষ্য অর্জন সম্ভব। একটি সভ্য জাতি কখনোই জনদুর্ভোগকে আন্দোলনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে না। বরং এমন সব পন্থা অনুসরণ করে যা মানবিক, নৈতিক এবং জনকল্যাণমূলক। রাষ্ট্রবিনির্মাণে আমাদের রাজনৈতিক অপসংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে ইতিবাচক সংস্কৃতির ক্রমোন্নতির জন্য জন্য আনুষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি গুরুত্বসহকারে জনশিক্ষাকেও ব্যাপকভাবে ব্যবহার করতে হবে। যে জাতি মানবিক মূল্যবোধ এবং শৃঙ্খলার পথ অনুসরণ করে, সে জাতি শুধু বর্তমানের সমস্যাগুলোর সমাধানই করে না, বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি ইতিবাচক, কল্যাণমুখী সংস্কৃতির ভিত্তি স্থাপন করে। আমরা যদি সেই পথে হাঁটতে সক্ষম হই, তবেই না আমাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার গণআকাক্সক্ষা বাস্তবায়ন সম্ভব হবে।
[লেখক : ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি, ইউনিভার্সিটি অব রোহ্যাম্পটন, যুক্তরাজ্য]
মাহরুফ চৌধুরী
মঙ্গলবার, ১৪ জানুয়ারী ২০২৫
মানবসভ্যতার ইতিহাসে মানুষ তার অগ্রযাত্রার পথে অধিকার আদায়ের জন্য বিভিন্ন সময়ে সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছে। প্রতিটি যুগে দাবি আদায়ের পন্থা ও কৌশল সময়ের প্রয়োজনে পাল্টে গেছে, কিন্তু এই প্রশ্নটি আজও প্রাসঙ্গিক- দাবি আদায়ে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করা কি আদৌ নৈতিক? এটি কি সভ্য জাতির পরিচায়ক হতে পারে? ইতিহাসের পাতায় আমরা এমন অনেক আন্দোলনের উদাহরণ দেখতে পাই যেখানে দাবি আদায় হয়েছে ন্যায়সংগত পন্থায়, নিরীহ জনগণের জীবনযাত্রাকে ব্যাহত না করেই। আবার এমন আন্দোলনেরও নজির রয়েছে; যা সমাজের শৃঙ্খলা ভেঙে দিয়েছে এবং সাধারণ মানুষের অসহায়ত্বের কারণ হয়েছে। সভ্য সমাজের মূল বৈশিষ্ট্য হলো সামষ্টিক উন্নয়নে সমঝোতা, সংলাপ এবং সমস্যা সমাধানে গণমানুষের আকাক্সক্ষা ও কল্যাণকে অগ্রাধিকার দেওয়া। দাবি আদায়ে রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া, সরকারি অফিস ঘেরাও করা হরহামেশাই হচ্ছে। জান-মালের ক্ষয়-ক্ষতিসহ প্রতিনিয়ত জনসাধারণের দুর্ভোগ বাড়ছে।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে ইতিহাসের আলোকে দাবি আদায়ের সঠিক পন্থা কি হতে পারে তা নিয়ে আলোচনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উপমহাদেশে ঔপনিবেশিক শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে ভাঙচুর আর জ্বালাওপোড়াওয়ের মতো আত্মঘাতী রাজনৈতিক অপসংস্কৃতির সূচনা। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, সরকার বা শাসক শ্রেণীর কাছ থেকে দাবি আদায়ে জনদুর্ভোগ সৃষ্টিকারী আন্দোলনের যেমন নজির রয়েছে, তেমনি শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মাধ্যমেও উল্লেখযোগ্য সাফল্যের উদাহরণ পাওয়া যায়। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে মহাত্মা গান্ধীর অহিংস আন্দোলন এ ক্ষেত্রে অনন্য উদাহরণ। গান্ধীর নেতৃত্বে পরিচালিত অসহযোগ আন্দোলন ও লবণ সত্যাগ্রহ জনদুর্ভোগমুক্ত ছিল এবং এতে মানবিক মূল্যবোধের প্রতিফলন ঘটেছিল। জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ সত্ত্বেও এসব আন্দোলন অন্যের জীবনযাত্রাকে অচল করে তোলেনি। বাংলাদেশের ইতিহাসেও দাবি আদায়ের জন্য লড়াইয়ের অনন্য উদাহরণ রয়েছে। আমাদের ভাষা আন্দোলন ছিল একটি আদর্শিক ও নীতিনির্ভর সংগ্রাম, যা গণমানুষের চেতনার জাগরণ ঘটিয়েছে, ঐক্যবদ্ধ হতে অনুপ্রাণিত করেছে, কিন্তু জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করেনি।
অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধ ছিল আমাদের স্বাধীনতা ও অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই, যার ফলে শত্রুর মোকাবেলা করতে ব্যবহৃত নানা কৌশলের কিছু অপ্রত্যাশিত প্রভাব জনগণের উপর পড়েছিল। তবে সেটি একটি বৃহত্তর কল্যাণের লক্ষ্য অর্জনে অপরিহার্য ছিল।
পৃথিবীর ইতিহাসে ফরাসি বিপ্লব একটি শিক্ষণীয় উদাহরণ, যেখানে দাবি আদায়ের প্রচেষ্টায় ব্যাপক জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হয়েছিল। খাদ্য সংকট, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং সহিংসতার ফলে সাধারণ মানুষ অমানবিক পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়। বিপ্লবের লক্ষ্য ছিল স্বাধীনতা, সাম্য, এবং ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠাÑযা মহৎ এবং অনুপ্রেরণামূলক। তবে এই লক্ষ্যে পৌঁছানোর পথে সহিংসতা, চরমপন্থা, এবং সুশৃঙ্খলতার অভাব বিপ্লবের মূল উদ্দেশ্যকে আড়াল করে দেয়। এর ফলে সমাজে দীর্ঘমেয়াদী অস্থিরতা এবং সংকট সৃষ্টি হয়, যা সাধারণ মানুষের জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে। ইতিহাসের এইসব উদাহরণ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে দাবি আদায়ের প্রক্রিয়াটি শুধু উদ্দেশ্যেই নয়, পদ্ধতিতেও ন্যায়সংগত এবং মানবিক হওয়া উচিত। আন্দোলনের উপায় যখন জনকল্যাণের বিপরীত দিকে যায়, তখন তা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অগ্রগতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ন্যায্য অধিকার আদায়ের আন্দোলনের প্রতিটি ধাপেই মানবিক মূল্যবোধ এবং জনকল্যাণকে অগ্রাধিকার দেয়া প্রয়োজন। একটি সভ্য জাতির পরিচায়ক হলো তার জনগণের মধ্যে ন্যায়বোধ, মানবিকতা এবং সংহতির সংস্কৃতি।
দর্শন ও নৈতিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে দাবি আদায়ের উপায় এবং উদ্দেশ্য গভীরভাবে বিচার করা জরুরি। উপায় এবং উদ্দেশ্যের মধ্যে সম্পর্ক সবসময়ই বিতর্কের বিষয়। মধ্যযুগের ইতালিয়ান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও দার্শনিক ম্যাকিয়াভেলি (১৪৬৯-১৫২৭) বলেছেন, ‘উদ্দেশ্যই মাধ্যমকে বৈধতা দেয়’, যা ইঙ্গিত করে যে মহৎ লক্ষ্য অর্জনের জন্য যে কোনো উপায় গ্রহণযোগ্য। তবে মহাত্মা গান্ধী (১৮৬৯-১৯৪৮) এ মতবাদ কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এবং বলেছিলেন, ‘অসৎ উপায়ে সৎ উদ্দেশ্য সাধন সম্ভব নয়’। এর অর্থ দাবি আদায়ের পন্থা যদি মানবিক মূল্যবোধ লঙ্ঘন করে, তবে সেটি নৈতিকতার মানদ-ে কখনই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করে দাবি আদায় করা অসৎ উপায় হিসেবে বিবেচিত হতে পারে, কারণ এতে মানবতার প্রতি দায়বদ্ধতার অভাব প্রকট হয়।
রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে সামগ্রিক জনহিত বনাম বিশেষ গোষ্ঠী বা দলের স্বার্থের দ্বন্দ্ব গুরুত্বপূর্ণ। সামাজিক চুক্তি (সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট) তত্ত্বের আলোকে, রাষ্ট্র ও জনগণের মধ্যে একটি পারস্পরিক চুক্তি বিদ্যমান, যেখানে রাষ্ট্র নাগরিকের কল্যাণ নিশ্চিত করবে এবং নাগরিকগণ রাষ্ট্রের শৃঙ্খলা রক্ষা করবে। কিন্তু যখন কোনো গোষ্ঠী তার স্বার্থে জনজীবনে বিপর্যয় সৃষ্টি করে, তখন তা এই সামাজিক চুক্তি লঙ্ঘন করে। জনদুর্ভোগ সৃষ্টিকারী আন্দোলন সামষ্টিক কল্যাণের চেয়ে ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয়, যা একদিকে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। অপরদিকে এটি কল্যাণমুখী রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্য ক্ষতিকর এবং একটি সভ্য সমাজের ভিত্তিকে দুর্বল করে।
প্রকৃতপক্ষে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি না করেও দাবি আদায়ের পন্থা গ্রহণ করা নৈতিকতার উচ্চতম স্তরের প্রকাশ। এটি দেখায় যে আন্দোলনকারীরা শুধু নিজেদের দাবি নয়, বৃহত্তর সমাজের প্রতি দায়িত্বশীল এবং সমাজের অন্যান্য সদস্যদের অধিকারের বিষয়ে সচেতন। জনকল্যাণমুখী আন্দোলনই মানবতার প্রকৃত পরিচয় বহন করে এবং সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনে। মানবাধিকারের প্রশ্নটি এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, প্রত্যেক মানুষের স্বাধীনভাবে চলাফেরা, জীবনযাপন এবং নিজের অধিকার ভোগের নিশ্চয়তা রয়েছে। এই সনদে মানুষের মৌলিক অধিকারসমূহকে সার্বজনীন ও অবিভাজ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। জনদুর্ভোগ সৃষ্টিকারী যেকোনো কর্মকা- এই মৌলিক অধিকারগুলোকে লঙ্ঘন করে। এটি শুধু ব্যক্তির স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ বা আঘাত হানে না, বরং বৃহত্তর সমাজের স্থিতিশীলতাকেও হুমকির মুখে ফেলে। যখন একটি গোষ্ঠী তার দাবি আদায়ের জন্য রাস্তা অবরোধ, যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা বা গুরুত্বপূর্ণ সেবা ব্যবস্থায় বিঘœ ঘটায়, তখন এটি সমাজের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে। দরিদ্র জনগোষ্ঠী, যারা দৈনিক আয়ের উপর নির্ভরশীল, এ ধরনের কর্মকা-ে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে, এই ধরনের আন্দোলন মানবাধিকারের গুরুতর লঙ্ঘনের পাশাপাশি একটি সমতাভিত্তিক সমাজ গঠনের পথে বাধাও সৃষ্টি করে।
মানবাধিকারের মূল দর্শন হলো- একটি সমাজে প্রত্যেকের অধিকার সমানভাবে রক্ষিত হবে এবং এক ব্যক্তির অধিকার কোন অবস্থাতেই অন্যের অধিকার ক্ষুন্ন করবে না। তাই জনদুর্ভোগ সৃষ্টিকারী অধিকার আদায়ের আন্দোলন শুধুমাত্র নৈতিকতার প্রশ্নেই ব্যর্থ হয় না, এটি মানবাধিকারের সার্বজনীন নীতির সঙ্গেও সাংঘর্ষিক। এই দৃষ্টিকোণ থেকে, জনকল্যাণমুখী আন্দোলনই সত্যিকারভাবে মানবাধিকারের চেতনা ধারণ করে এবং একটি সভ্য ও মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার পথে অগ্রসর হয়। তাই সমস্যা সমাধানের জন্য জনদুর্ভোগ এড়িয়ে বিকল্প উপায় এবং কার্যকর পন্থা অবলম্বন অত্যন্ত জরুরি।
আন্দোলনে নামার আগে এর রূপ এবং কাঠামো পরিষ্কারভাবে নির্ধারণ করা উচিত। একটি সভ্য জাতি কখনই অযৌক্তিক বা ধ্বংসাত্মক উপায়ে দাবি আদায়ের পথ বেছে নেয় না। এর পরিবর্তে আলোচনা, সংলাপ, মধ্যস্থতা এবং শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের মতো বিকল্প পন্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। এসব পন্থা শুধু জনজীবনকে স্বাভাবিক রাখে না, বরং আন্দোলনের নৈতিকতা ও গ্রহণযোগ্যতাও বৃদ্ধি করে। প্রযুক্তি এবং তথ্যের এই যুগে দাবি আদায়ের জন্য কার্যকর পন্থা আরও সহজ ও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এখন এমন একটি হাতিয়ার, যা দ্রুত জনমত গঠনে এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তথ্য ও উপাত্তের মাধ্যমে সমস্যা উপস্থাপন এবং জনসমর্থন আদায় করা হলে আন্দোলনের প্রভাব আরও দৃঢ় হয়। গণমাধ্যম এবং প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার আন্দোলনকে গঠনমূলক করে তুলতে পারে এবং সহিংসতা বা অরাজকতার পথ থেকে দূরে রাখতে পারে। তবে, জনদুর্ভোগ এড়াতে আন্দোলনকারীদের পাশাপাশি রাষ্ট্রেরও সমান দায়দায়িত্ব রয়েছে। রাষ্ট্র ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলো যদি সময়মতো উদ্ভুত পরিস্থিতিতে হস্তক্ষেপ করে এবং বঞ্চিতদের অধিকার দিতে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে এবং আন্দোলনকারিদের দাবিকে গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করে, তবে অস্থিরতা অনেকাংশে এড়ানো সম্ভব। একই সঙ্গে আন্দোলনকারীদেরও তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবেÑতাদের কার্যকলাপ যেন সাধারণ মানুষের ভোগান্তির কারণ না হয়, সমাজের শৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতাকে বিঘিœত না করে। এভাবে সমন্বিত দায়বদ্ধতার মাধ্যমে একটি সভ্য ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব।
ইতিহাস যেমন আমাদের ভুল থেকে শিখতে শেখায়, তেমনি এটি আমাদের অনুপ্রাণিত করে এমন একটি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে যেখানে মানুষের দাবি আদায়ের জন্য শান্তিপূর্ণ, যুক্তিবাদী, এবং নৈতিক উপায়গুলো প্রাধান্য পায়। মানবিকতা এবং জনকল্যাণের পথ অনুসরণ করেই একটি জাতি তার সত্যিকারের সভ্যতাবোধ প্রকাশ করতে পারে। অতীতের শিক্ষা থেকে এই উপলব্ধি আসা উচিত যে, আদর্শ এবং উপায়ের মধ্যে সঙ্গতি না থাকলে কোনো আন্দোলনই দীর্ঘমেয়াদে সমাজের জন্য কল্যাণকর হতে পারে না।
আমাদের মনে রাখতে হবে যে, সভ্য জাতির প্রকৃত পরিচয় নিহিত থাকে তার মানবিক মূল্যবোধ, সুশৃঙ্খল আচরণ এবং শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমস্যা সমাধানের সক্ষমতায়। জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করে দাবি আদায় শুধু নিরীহ মানুষের জীবনযাত্রাকে বিপর্যস্ত করে না, বরং এটি একটি জাতির সভ্যতাবোধ এবং নৈতিক অবস্থানের ওপর প্রশ্ন তোলে। একটি জাতির অগ্রগতি এবং মর্যাদা তার সদস্যদের আচরণ এবং সংকট সমাধানের পদ্ধতির মাধ্যমেই প্রতিফলিত হয়। দাবি আদায়ের প্রক্রিয়ায় যদি মানবিকতা এবং নৈতিকতার স্থান হারায়, তবে তা শুধু সাময়িক লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক হলেও দীর্ঘমেয়াদে জাতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। সভ্য জাতির দায়িত্ব হলো সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে সংলাপ, আলোচনার মতো অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং জনকল্যাণমুখী পদ্ধতি অনুসরণ করা।
অধিকার আদায়ের আন্দোলন কখনোই ধ্বংসাত্মক বা জনজীবনকে বিপন্ন করার মাধ্যম হওয়া উচিত নয়। এর পরিবর্তে শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খল প্রতিবাদের মাধ্যমে জনমত গঠন, প্রযুক্তির ব্যবহার এবং গঠনমূলক উপায় অবলম্বন করে দাবি আদায়ের পথ সুগম করতে হবে। রাষ্ট্রপ্রশাসন ও নাগরিকদের পারস্পরিক আস্থা এবং দায়িত্বশীল আচরণের মাধ্যমেই এই লক্ষ্য অর্জন সম্ভব। একটি সভ্য জাতি কখনোই জনদুর্ভোগকে আন্দোলনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে না। বরং এমন সব পন্থা অনুসরণ করে যা মানবিক, নৈতিক এবং জনকল্যাণমূলক। রাষ্ট্রবিনির্মাণে আমাদের রাজনৈতিক অপসংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে ইতিবাচক সংস্কৃতির ক্রমোন্নতির জন্য জন্য আনুষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি গুরুত্বসহকারে জনশিক্ষাকেও ব্যাপকভাবে ব্যবহার করতে হবে। যে জাতি মানবিক মূল্যবোধ এবং শৃঙ্খলার পথ অনুসরণ করে, সে জাতি শুধু বর্তমানের সমস্যাগুলোর সমাধানই করে না, বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি ইতিবাচক, কল্যাণমুখী সংস্কৃতির ভিত্তি স্থাপন করে। আমরা যদি সেই পথে হাঁটতে সক্ষম হই, তবেই না আমাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার গণআকাক্সক্ষা বাস্তবায়ন সম্ভব হবে।
[লেখক : ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি, ইউনিভার্সিটি অব রোহ্যাম্পটন, যুক্তরাজ্য]