alt

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

যুদ্ধ বিরতি গাজাবাসীর জন্য জরুরি ছিল

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

: শনিবার, ০৮ নভেম্বর ২০২৫

যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ১০ অক্টোবর থেকে গাজা উপত্যকায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর করা হয়েছে। ২০২৩ সনে ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের অভ্যন্তরে হামাসের সশস্ত্র যোদ্ধারা ঢুকে ১ হাজার ১৩৯ জন নিরস্ত্র ইসরায়েলিকে হত্যা করে এবং দুই শতাধিক ইসরালিকে বন্দী করে গাজায় নিয়ে আসে।

হামাসদের সহায়তা করারও এখন আর কেউ নেই। লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হেজবুল্লাহকে পঙ্গু করে দেওয়া হয়েছে, ইয়েমেনের হুতিদের থামিয়ে দেওয়া হয়েছে, সিরিয়ায় ইসরায়েল বিদ্বেষী শাসকদের বদল হয়েছে। ইরানের শুধু যুদ্ধ করার খায়েশ নয়, ইসরায়েল বিরোধী কথাও বন্ধ হয়ে গেছে

সেদিন থেকেই গাজা উপত্যকায় ইসরায়েল ইতিহাসের বর্বরতম ও নৃশংস হামলা চালিয়ে এসেছে, পৃথিবীর কারো কথায় হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করেনি। মানুষ হত্যায় এত আগ্রহ ও একগুয়েমি সাম্প্রতিককালের ইতিহাসে আর একটিও খুঁজে পাওয়া যাবে না। ২০২৩ সন থেকে যুদ্ধবিরতি পর্যন্ত গাজায় ইসরায়েলি হামলায় ৬৮ হাজারের বেশি মানুষ নিহত এবং ১ লাখ ৭০ হাজার মানুষ আহত হয়েছে। গাজায় ইসরায়েলের হত্যাযজ্ঞকে জাতিসংঘ-সমর্থিত কমিশন ছাড়াও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা জাতিগত নিধন হিসেবে উল্লেখ করেছে। তবে ইসরায়েল এমন নির্বিচার হত্যাযজ্ঞের দায় নিতে চায় না। এই ব্যাপারে তাদের যুক্তি হচ্ছে, কোন এলাকা আক্রমণের আগে সেই এলাকা থেকে জনসাধারণকে সরে যেতে বারবার সতর্ক করা হয়েছে, কিন্তু জনসাধারণ ইসরায়েলের সতর্ক বার্তাকে গ্রাহ্য করেনি, তারা হামাস যোদ্ধাদের মৃত্যুমুখে রেখে নিরাপদ স্থানে যাওয়ার গরজ বোধ করেনি, হামাস যোদ্ধাদের সঙ্গে তারা অকাতরে জীবন দিয়েছে, তাই নিরস্ত্র মানুষের মৃত্যুর দায় ইসরায়েল নিতে চায় না।

ইসরায়েলের বড় ব্যর্থতা দুই বছর যুদ্ধ করেও তারা জিম্মিদের হদিস পায়নি। ইসরায়েল-আমেরিকার স্যাটেলাইট নজরদারি এড়িয়ে, ইসরায়েলের সৈন্যদের ফাঁকি দিয়ে জিম্মিদের এক স্থান থেকে অন্যস্থানে স্থানান্তর করা হামাস যোদ্ধাদের জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ ছিল, এই চ্যালেঞ্জ হামাস যোদ্ধারা সফলতার সঙ্গে মোকাবিলাযও করেছে। জিম্মিদের জীবিত রাখার চ্যালেঞ্জও হামাসদের গ্রহণ করতে হয়েছে; কারণ দর কষাকষির সুবধার্থে জিম্মিদের জীবিত রাখা অপরিহার্য ছিল। এত ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞের পরও যুদ্ধবিরতি কার্যকর করার পর ২০ জন জীবিত জিম্মিকে ফেরত দেওয়া সম্ভব হয়েছে। তবে এত সতর্কতা অবলম্বন করা সত্বেও ২৮ জন জিম্মির মৃত্যু ঠেকানো যায়নি, অবশ্য তারা মরেছে ইসরায়েলের বোমার আঘাতে। ২৮টির মধ্যে ১২টি মরদেহ ইসরায়েলকে ফেরত দেওয়া হয়েছে, বাকি মরদেহ ধ্বংসস্তুপের নিচে পড়ে আছে। ২০ জন জীবিত জিম্মি ও ২৮টি মরদেহের বিনিময়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত ২৫০ জন ফিলিস্তিনি বন্দীকে ইসরায়েলের মুক্তি দেওয়ার শর্ত রয়েছে। এছাড়াও যুদ্ধ চলাকালীন গাজা থেকে আটক আরও ১,৭০০ জন ফিলিস্তিনকেও ইসরায়েল ছেড়ে দেবে।

২০ দফা শান্তি পরিকল্পনার কোথাও বলা নেই যে ইসরায়েল গাজা থাকে তাদের সব সৈন্য তাদের দেশে ফিরিয়ে নেবে, বরং একটি টেকসই ও স্থায়ী শান্তির পথে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ইসরায়েল তাদের সৈন্যদের একটি নির্দিষ্ট সীমানায় ফিরিয়ে আনবে, যাতে কিছুদিন ৫৩ শতাংশ ভূমি তাদের আয়ত্বাধীনে থাকবে। পরবর্তীকালে আয়ত্বাধীন ভূমি ক্রমান্বয়ে কমিয়ে দ্বিতীয় পর্যায়ে ৪০ শতাংশ এবং সর্বশেষে ১৫ শতাংশে হ্রাস করা হবে। এমন পরিকল্পনা থেকে মনে হয় ইসরায়েল গাজার ভূখণ্ড ব্যবহার করে একটি বাফার জোন বা ইসরায়েলের জন্য একটি নিরাপদ সীমান্ত এলাকা গড়ে তুলবে। তবে শান্তিচুক্তির শর্ত মোতাবেক গাজার নিয়ন্ত্রণ বা শাসনভার হামাসদের হাতে আর থাকবে না, থাকবে একটি নির্জীব ফিলিস্তিনি টেকনোক্র?্যাট কমিটির হাতে, অন্তর্বর্তীকালীন এই কমিটির কার্যক্রম তদারকি করবে একটি ‘শান্তি বোর্ড’, যার নেতৃত্বে থাকবেন ডনাল্ড ট্রাম্প নিজেই। দীর্ঘদিন পর্যবেক্ষণের পর অনুকূল পরিবেশে গাজার শাসনভার হস্তান্তর করা হবে ‘ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষে’র কাছে, কর্তৃপক্ষ মানে কিন্তু সরকার নয়।এর ফলে গাজা ভূখণ্ডের উপর হামাস বা ফিলিস্তিনিদের আগে যতটুকু নিয়ন্ত্রণ ছিল এখন আর সেই নিয়ন্ত্রণটুকুও থাকল না।

শান্তি চুক্তির মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের আত্মসমর্পনের দৃশ্যমান শর্ত হচ্ছে নিরস্ত্রীকরণ, যে শর্ত অনুযায়ী গাজায় কোন অস্ত্র থাকবে না, এবং সেখানকার সব সামরিক ও সন্ত্রাসী অবকাঠামো ধ্বংস করে দেওয়া হবে। আরও অপমানজনক শর্ত হচ্ছে, হামাসদের অস্ত্র ফেলে দিয়ে নিরীহ ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে মিলেমিশে নিরুপদ্রব জীবনযাপন করতে হবে, এর অন্যথা হলে তাদের গাজা ছেড়ে চলে যেতে হবে। তবে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত হামাস অস্ত্র সমর্পণ করবে না বলে গোঁ ধরেছে, তবে তাদের কোন কথাই আর মানা হবে না, এখন যে কোন শর্তে শান্তি চুক্তি প্রয়োজন, নতুবা হামাস ও গাজার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে। এখন না খেয়েই গাজার ফিলিস্তিনিরা মারা যাচ্ছে, পানি নেই, বিদ্যুৎ নেই, থাকার ঘর নেই, আছে শুধু গণকবর। হামাসদের সহায়তা করারও এখন আর কেউ নেই। লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হেজবুল্লাহকে পঙ্গু করে দেওয়া হয়েছে, ইয়েমেনের হুতিদের থামিয়ে দেওয়া হয়েছে, সিরিয়ায় ইসরায়েল বিদ্বেষী শাসকদের বদল হয়েছে। ইরানের শুধু যুদ্ধ করার খায়েশ নয়, ইসরায়েল বিরোধী কথাও বন্ধ হয়ে গেছে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ফিলিস্তিন ছিল তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে। এই ভূমিতে তখন মুসলিম, ইহুদী, খ্রিস্টান এবং ক্ষুদ্র ধর্মীয় গোষ্ঠী দ্রুজেরা শান্তিতে বসবাস করতো। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্ক বা অটোমানরা জার্মানির পক্ষ নিয়ে হেরে গেলে উসমানীয় সাম্রাজ্যের বিভিন্ন এলাকা ফ্রান্স এবং ব্রিটেনের মধ্যে ভাগাভাগি হয়ে যায়, ফিলিস্তিন পড়ে যায় ব্রিটেনের অধীনে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে থেকেই ইউরোপ থেকে কিছু কিছু ইহুদি ফিলিস্তিনে মাইগ্রেট করেছে; যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর সম্পদশালী ও জ্ঞানী ইহুদীদের প্রয়োজন পড়ায় ব্রিটিশরা ‘বেলফোর ডিক্লারেশন’-এর মাধ্যমে ফিলিস্তিন এলাকায় ইহুদিদের জন্য এই স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গড়ে দেওয়ার আশ্বাস দেয়। এই আশ্বাসে আস্থা রেখে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে ইহুদীরা ব্রিটিশ ফিলিস্তিনে এসে স্থানীয় ফিলিস্তিনিদের কাছ থেকে জমি কিনে নতুন নতুন বসতি গড়ে তোলে। নতুন নতুন বসতি গড়ে তোলার বিরুদ্ধে বৃটেন বাধা দিলে ইহুদিরা ফিলিস্তিনে বৃটেন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। আবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের গণহারে ইহুদি নিধন শুরু হলে হাজার হাজার ইহুদি ইউরোপ থেকে পালিয়ে চলে আসে ফিলিস্তিনে।

আস্তে আস্তে অভিবাসী ইহুদিদের সঙ্গে স্থানীয় ফিলিস্তিনিদের সংঘাত বেড়েই যাচ্ছিল, যা ব্রিটিশরাও আর সামলাতে পারছিল না। এই অবস্থায় জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলোর সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে ১৯৪৭ সনে ফিলিস্তিনে দুটি দেশ- ৫৫ শতাংশ এলাকা নিয়ে ইহুদিদের জন্য ‘ইসরাইল’, আর বাকি ৪৫ শতাংশ নিয়ে আরবদের জন্য ‘ফিলিস্তিন’ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে বৃটেনের প্রস্তাব অনুমোদিত হয়। এই প্রস্তাবে জেরুজালেমকে কোন দেশের অন্তর্ভুক্ত না করে একটা বিশেষ আন্তর্জাতিক এলাকা হিসাবে ঘোষণা করা হয়। ইহুদিরা এই প্রস্তাবে রাজি থাকলেও ফিলিস্তিনের স্থানীয় আরবরা এবং আশেপাশের আরব দেশগুলো জাতিসংঘের সিদ্ধান্তে সম্মত হয়নি। দুই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফিলিস্তিনে বসবাসরত ইহুদি ও মুসলমানদের মধ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। ১৯৪৮ সনের মে মাসের ১৫ তারিখে ব্রিটিশদের ফিলিস্তিন ত্যাগের একদিন আগে বেন গুরিয়ন জাতিসংঘের ১৮১ নম্বর রেজোল্যুশন মোতাবেক ইসরাইল রাষ্ট্রের জন্ম ঘোষণা করেন, এবং এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।

আরব লীগের সদস্য সাতটি দেশের সেনাবাহিনী মিশর, জর্ডান, সিরিয়া আর লেবানন সীমান্ত দিয়ে মধ্যরাতে ফিলিস্তিনে ঢুকে পড়ে। কিন্তু ৭টি দেশ মিলেও ইসরায়েলের এক ইঞ্চি জায়গা দখল করতে পারল না, বরং যুদ্ধ শেষে দেখা গেল ইসরায়েলের জন্য জাতিসংঘের বরাদ্দকৃত ৫৫ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৬০ শতাংশ হয়ে গেছে। এই যুদ্ধের কারণে বরং ফিলিস্তিনিদের জন্য বরাদ্দকৃত ভূমিটি বেহাত হয়ে যায়, তাদের গাজা উপত্যকা দখল করে মিশর, জর্ডান নদীর পশ্চিম তীর দখল করে জর্ডান, আর সামান্য বাকি অংশটুকু দখল করে নেয় ইসরায়েল। ফলে যুদ্ধ শেষে দেখা গেল জাতিসংঘের মানচিত্রে চিহ্নিত ফিলিস্তিন নামক দেশের আর কোনো বাস্তব অস্তিত্ব নেই। অন্যদিকে ‘বিশেষ আন্তর্জাতিক এলাকা’ জেরুজালেমের এক অংশ দখল করল ইসরায়েল, আর আল আকসা কমপ্লেক্সসহ পূর্ব জেরুজালেম দখল করল জর্ডান। শুধু দখল করে জর্ডান থেমে যায়নি, ফিলিস্তিনিদের পশ্চিম তীর এলাকাকে নিজ দেশের অন্তর্ভুক্ত করে ১৯৫০ সনে প্রণীত আইনের মাধ্যমে সেখানকার ফিলিস্তিনিদের জর্ডানের নাগরিকত্ব প্রদান করে।

ফিলিস্তিনিদের জন্য বরাদ্দকৃত ভূমি ১৯৪৮ সনের যুদ্ধে বেহাত হয়ে গেলে সাড়ে সাত লাখ ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তু হয়ে বিভিন্ন দেশের শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়, যাদের সংখ্যা বর্তমানে ৭০ লাখ। সুয়েজ খাল এবং তিরান প্রণালি দিয়ে ইসরায়েলের পথ অবরোধের কারণে মিশরের সঙ্গে ইসরায়েলের ১৯৫৬ এবং ১৯৬৭ সনে দুটি যুদ্ধ হয়। ১৯৫৬ সনে ইসরায়েলের বিমান হামলায় মিশর কাবু হয়ে যায়। ১৯৬৭ সনে মিশর ইসরায়েলের জাহাজকে তিরান প্রণালীতে পুনরায় বাধা দিলে আবার যুদ্ধ শুরু হয়। জর্ডান এবং সিরিয়াও মিশরের পক্ষে যুদ্ধে যোগ দেয়। কিন্তু মাত্র ৬ দিনের যুদ্ধে এই ৩টি দেশের শোচনীয় পরাজয় ঘটে। এই যুদ্ধে ইসরায়েল শুধু মিশরের দখলে থাকা ফিলিস্তিনিদের গাজা উপত্যকা নয়, মিশরের সিনাই উপত্যকাও ছিনিয়ে নেয়। অন্যদিকে জর্ডান বাহিনীকে তাড়িয়ে দিয়ে ফিলিস্তিনিদের কাছ থেকে ১৯৪৮ সনের যুদ্ধে দখল করা পশ্চিম তীরও ইসরায়েল দখল করে নেয়। আর সিরিয়া বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে তাদের গোলান হাইটস দখল করে নেয় ইসরায়েল। ১৯৭৩ সনে মিশর তাদের সিনাই উপত্যকা উদ্ধার করতে আবার যুদ্ধ শুরু করে, সিরিয়াও মিশরের পক্ষে যুদ্ধে নামে, ফলাফল আগের মতোই শূন্য। মিশর ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তি চুক্তি করতে বাধ্য হয়ে, এবং ইসরায়েল সিনাই উপত্যকা মিশরকে ফেরত দিয়ে দেয়। কিন্তু ১৯৪৮ সনের যুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের কাছ থেকে মিশরের দখল করা গাজা উপত্যকা, যা ১৯৬৭ সনের যুদ্ধে ইসরায়েল মিশর থেকে দখল করে নিয়েছিল, তা আর মিশরকে ফেরত দেয়নি। ফিলিস্তিনিদের ভূমি ১৯৪৮ সনে দখল করল মিশর আর জর্ডান, আর ১৯৬৭ সনে সেই ভূমি মিশর এবং জর্ডান থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল ইসরায়েল।

যুদ্ধ করে যে ইসরায়েলকে নিশ্চিহ্ন করা যাবে না তা প্রথম উপলব্ধি করেন পিএলও বা প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের চেয়ারম্যান ইয়াসির আরাফাত। এই উপলব্ধি থেকেই তিনি ইসরায়েলের সঙ্গে একটি শান্তি চুক্তি করেন। ১৯৯৩ সনে সম্পাদিত এই শান্তি চুক্তির বদৌলতে ইসরায়েল তাদের দখলে থাকা পশ্চিম তীর এবং গাজা উপত্যকা ফিলিস্তিনিদের ছেড়ে দেয় এবং সেখানে ‘প্যালেসটাইন অথোরিটি’ নামে একটি অন্তর্বতীকালীন সরকার গঠিত হয়, যারা গাজা উপত্যকা এবং পশ্চিম তীর এই দুইটি এলাকায় শুধু স্বায়ত্বশাসনের ভিত্তিতে শাসনকার্য পরিচালনা করবে। পাঁচ বছর পর্যবেক্ষণপূর্বক ফিলিস্তিনিদের স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিষয়টি বিবেচিত হবে বলেও শান্তি চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু বহু পাঁচ বছর অতিবাহিত হওয়ার পরও ফিলিস্তিদের জন্য স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের বিবেচনার বাস্তবায়ন হয়নি। কারণ ইহুদিদের সঙ্গে সহাবস্থানে থাকার এই শান্তি চুক্তি হামাসের মতো উগ্রপন্থী ফিলিস্তিনিরা মেনে নেয়নি, যদিও ইসরায়েলের জনসংখ্যার ১৮ শতাংশ মুসলমান ইসরায়েলের ভিতর ইহুদিদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে ইসরায়েলের নাগরিক হয়ে বসবাস করছে। ইহুদিদের মধ্যেও আবার উগ্র ডানপন্থী জায়োনিস্ট রয়েছে যারা ফিলিস্তিনিদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র মেনে নিতে চায় না। ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গিও উভয় পক্ষের উগ্রপন্থার উদ্ভবের কারণ। ৭৬ বছর ধরে হতাশাগ্রস্ত বাস্তুহারা ফিলিস্তিনিরা তাই শান্তিচুক্তির পরিবর্তে হামাসদের সমর্থন করেছে, কিন্তু আজ হামাসও প্রায় বিলীয়মান।

মধ্যপ্রাচ্যে মুসলমান এবং ইহুদিদের সহাবস্থানের বাস্তবতা না মেনে আর উপায় নেই। অতি সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও বৃটেন ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে। অনেকগুলো আরব দেশ অনেক আগেই ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিয়েছে। পৃথিবীর ৮৫ শতাংশ দেশ ইসরায়েলকে স্বার্বভৌম দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দানকারী প্রথম মুসলিম দেশ তুরস্ক এবং দ্বিতীয় দেশ ছিল ইরান। পরবর্তীকালে আরও অনেকগুলো মুসলিম দেশের সঙ্গে ইসরায়েলের কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, গাজা-যুদ্ধ না হলে আরও কিছু দেশ ইতোমধ্যে ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করার পদক্ষেপ নিতো। ধারণা করা হয়, আরব দেশগুলোর সঙ্গে যাতে ইসরায়েলের সম্পর্ক স্বাভাবিক না হয় সেজন্যই হামাস যোদ্ধারা ইসরায়েলের অভ্যন্তরে ঢুকে আক্রমণ করেছিল।

স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের পর সউদি আরব ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করার শর্ত দিয়েছে। তার উত্তরে জ্ঞান-বিজ্ঞানে পিছিয়ে থাকা মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলো সম্পর্কে ইসরাইলের অর্থমন্ত্রী বলেন তা আরবের মুসলমানদের জন্য অপমানজনক, ‘বন্ধুরা, -না, ধন্যবাদ। সৌদি আরবের মরুভূমিতে উটে চড়া অব্যাহত রাখুন’।

[লেখক: সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক ও সাবেক এমডি, টাকশাল]

প্রভাষকের ‘প্রভা’ যখন ‘শোক’: শিক্ষা ক্যাডারে পদোন্নতি বঞ্চনা

লবলং খালের মৃত্যু: স্মৃতিতে নদী, বাস্তবে দূষণ

বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা: অর্থনৈতিক স্থিতির পূর্বশর্ত

হায় যম! আর কতক্ষণ, হবে অপেক্ষা করিতে মোরে?

পোশাক শিল্প : অগ্রগতি ও শ্রমিকের অধিকার

গণভোটের রাজনৈতিক গুরুত্ব

বামঘরানার বাটখারা...

বাগদা ফার্ম : স্মারকলিপি, অবরোধ, অনশন, আন্দোলন- কিছুতেই বরফ গলেনি

ব্যাটারি-শকট: নতুন সংকট

মতপ্রকাশ কিংবা দ্বিমত পোষণ: নাগরিক অধিকার ও রাজনৈতিক বাস্তবতা

সরকারি কর্মচারীদের জন্য নতুন ব্যাংক কি আদৌ প্রয়োজন

ট্রাম্প ও শি’র ‘কৌশলগত শান্তি’

আশার সমাজতত্ত্ব: বিভ্রান্তির যুগে ভবিষ্যৎ নির্মাণের বিপ্লবী বিজ্ঞান

পিএইচডি: উচ্চ শিক্ষার মানদণ্ড না প্রতীকী মরীচিকা?

ডিম নয় তবু অশ্বডিম্ব!

ছবি

অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও নির্বাচন

পিএইচডি: উচ্চ শিক্ষার মানদণ্ড না প্রতীকী মরীচিকা?

প্রকৃতার্থে ফকির কারা

এনসিপি চায় অবিনাশী জুলাই সনদ

পিএইচডি: উচ্চ শিক্ষার মানদণ্ড না প্রতীকী মরীচিকা?

আলুর প্রাচুর্যে কৃষকের সংকট

তাহলে কী ‘কোটা’ই জয়যুক্ত হবে!

ব্যাংকিং খাতে বিষফোঁড়া: বাংলাদেশের অর্থনীতির ধমনী বিষাক্ত হয়ে উঠছে

ছবি

ঢাকার নদী ও খালের দখল-দূষণ: পুনরুদ্ধার কোন পথে

জমি কী মূলে রেকর্ড হয়েছে, দলিল মূলে না উত্তরাধিকার মূলে?

কার্বন-নিরপেক্ষ শিশুর অনুপ্রেরণায় দেশ

এবার আমরা সভ্য হলাম!

সোনার প্রাসাদের দেয়ালে ঘামের দাগ

নিরাপদ সড়ক চাই কিন্তু কার্যকর উদ্যোগ কোথায়?

অবহেলিত শিক্ষার দুর্দশা বাড়ছে

টেকসই উন্নয়নের পূর্বশর্ত নিরাপদ সড়ক

বাংলার সংস্কৃতি কি মূলধারা হারিয়ে ফেলবে?

ছবি

সমদৃষ্টি, বহুত্ববাদী সমাজ এবং সহিষ্ণুতা

খাদ্য অপচয় : ক্ষুধার্ত পৃথিবীর এক নিঃশব্দ ট্র্যাজেডি

টেকসই বাংলাদেশ গঠনে পরিবেশ সংস্কার কেন অপরিহার্য

সে এক রূপকথারই দেশ

tab

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

যুদ্ধ বিরতি গাজাবাসীর জন্য জরুরি ছিল

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

শনিবার, ০৮ নভেম্বর ২০২৫

যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ১০ অক্টোবর থেকে গাজা উপত্যকায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর করা হয়েছে। ২০২৩ সনে ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের অভ্যন্তরে হামাসের সশস্ত্র যোদ্ধারা ঢুকে ১ হাজার ১৩৯ জন নিরস্ত্র ইসরায়েলিকে হত্যা করে এবং দুই শতাধিক ইসরালিকে বন্দী করে গাজায় নিয়ে আসে।

হামাসদের সহায়তা করারও এখন আর কেউ নেই। লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হেজবুল্লাহকে পঙ্গু করে দেওয়া হয়েছে, ইয়েমেনের হুতিদের থামিয়ে দেওয়া হয়েছে, সিরিয়ায় ইসরায়েল বিদ্বেষী শাসকদের বদল হয়েছে। ইরানের শুধু যুদ্ধ করার খায়েশ নয়, ইসরায়েল বিরোধী কথাও বন্ধ হয়ে গেছে

সেদিন থেকেই গাজা উপত্যকায় ইসরায়েল ইতিহাসের বর্বরতম ও নৃশংস হামলা চালিয়ে এসেছে, পৃথিবীর কারো কথায় হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করেনি। মানুষ হত্যায় এত আগ্রহ ও একগুয়েমি সাম্প্রতিককালের ইতিহাসে আর একটিও খুঁজে পাওয়া যাবে না। ২০২৩ সন থেকে যুদ্ধবিরতি পর্যন্ত গাজায় ইসরায়েলি হামলায় ৬৮ হাজারের বেশি মানুষ নিহত এবং ১ লাখ ৭০ হাজার মানুষ আহত হয়েছে। গাজায় ইসরায়েলের হত্যাযজ্ঞকে জাতিসংঘ-সমর্থিত কমিশন ছাড়াও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা জাতিগত নিধন হিসেবে উল্লেখ করেছে। তবে ইসরায়েল এমন নির্বিচার হত্যাযজ্ঞের দায় নিতে চায় না। এই ব্যাপারে তাদের যুক্তি হচ্ছে, কোন এলাকা আক্রমণের আগে সেই এলাকা থেকে জনসাধারণকে সরে যেতে বারবার সতর্ক করা হয়েছে, কিন্তু জনসাধারণ ইসরায়েলের সতর্ক বার্তাকে গ্রাহ্য করেনি, তারা হামাস যোদ্ধাদের মৃত্যুমুখে রেখে নিরাপদ স্থানে যাওয়ার গরজ বোধ করেনি, হামাস যোদ্ধাদের সঙ্গে তারা অকাতরে জীবন দিয়েছে, তাই নিরস্ত্র মানুষের মৃত্যুর দায় ইসরায়েল নিতে চায় না।

ইসরায়েলের বড় ব্যর্থতা দুই বছর যুদ্ধ করেও তারা জিম্মিদের হদিস পায়নি। ইসরায়েল-আমেরিকার স্যাটেলাইট নজরদারি এড়িয়ে, ইসরায়েলের সৈন্যদের ফাঁকি দিয়ে জিম্মিদের এক স্থান থেকে অন্যস্থানে স্থানান্তর করা হামাস যোদ্ধাদের জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ ছিল, এই চ্যালেঞ্জ হামাস যোদ্ধারা সফলতার সঙ্গে মোকাবিলাযও করেছে। জিম্মিদের জীবিত রাখার চ্যালেঞ্জও হামাসদের গ্রহণ করতে হয়েছে; কারণ দর কষাকষির সুবধার্থে জিম্মিদের জীবিত রাখা অপরিহার্য ছিল। এত ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞের পরও যুদ্ধবিরতি কার্যকর করার পর ২০ জন জীবিত জিম্মিকে ফেরত দেওয়া সম্ভব হয়েছে। তবে এত সতর্কতা অবলম্বন করা সত্বেও ২৮ জন জিম্মির মৃত্যু ঠেকানো যায়নি, অবশ্য তারা মরেছে ইসরায়েলের বোমার আঘাতে। ২৮টির মধ্যে ১২টি মরদেহ ইসরায়েলকে ফেরত দেওয়া হয়েছে, বাকি মরদেহ ধ্বংসস্তুপের নিচে পড়ে আছে। ২০ জন জীবিত জিম্মি ও ২৮টি মরদেহের বিনিময়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত ২৫০ জন ফিলিস্তিনি বন্দীকে ইসরায়েলের মুক্তি দেওয়ার শর্ত রয়েছে। এছাড়াও যুদ্ধ চলাকালীন গাজা থেকে আটক আরও ১,৭০০ জন ফিলিস্তিনকেও ইসরায়েল ছেড়ে দেবে।

২০ দফা শান্তি পরিকল্পনার কোথাও বলা নেই যে ইসরায়েল গাজা থাকে তাদের সব সৈন্য তাদের দেশে ফিরিয়ে নেবে, বরং একটি টেকসই ও স্থায়ী শান্তির পথে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ইসরায়েল তাদের সৈন্যদের একটি নির্দিষ্ট সীমানায় ফিরিয়ে আনবে, যাতে কিছুদিন ৫৩ শতাংশ ভূমি তাদের আয়ত্বাধীনে থাকবে। পরবর্তীকালে আয়ত্বাধীন ভূমি ক্রমান্বয়ে কমিয়ে দ্বিতীয় পর্যায়ে ৪০ শতাংশ এবং সর্বশেষে ১৫ শতাংশে হ্রাস করা হবে। এমন পরিকল্পনা থেকে মনে হয় ইসরায়েল গাজার ভূখণ্ড ব্যবহার করে একটি বাফার জোন বা ইসরায়েলের জন্য একটি নিরাপদ সীমান্ত এলাকা গড়ে তুলবে। তবে শান্তিচুক্তির শর্ত মোতাবেক গাজার নিয়ন্ত্রণ বা শাসনভার হামাসদের হাতে আর থাকবে না, থাকবে একটি নির্জীব ফিলিস্তিনি টেকনোক্র?্যাট কমিটির হাতে, অন্তর্বর্তীকালীন এই কমিটির কার্যক্রম তদারকি করবে একটি ‘শান্তি বোর্ড’, যার নেতৃত্বে থাকবেন ডনাল্ড ট্রাম্প নিজেই। দীর্ঘদিন পর্যবেক্ষণের পর অনুকূল পরিবেশে গাজার শাসনভার হস্তান্তর করা হবে ‘ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষে’র কাছে, কর্তৃপক্ষ মানে কিন্তু সরকার নয়।এর ফলে গাজা ভূখণ্ডের উপর হামাস বা ফিলিস্তিনিদের আগে যতটুকু নিয়ন্ত্রণ ছিল এখন আর সেই নিয়ন্ত্রণটুকুও থাকল না।

শান্তি চুক্তির মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের আত্মসমর্পনের দৃশ্যমান শর্ত হচ্ছে নিরস্ত্রীকরণ, যে শর্ত অনুযায়ী গাজায় কোন অস্ত্র থাকবে না, এবং সেখানকার সব সামরিক ও সন্ত্রাসী অবকাঠামো ধ্বংস করে দেওয়া হবে। আরও অপমানজনক শর্ত হচ্ছে, হামাসদের অস্ত্র ফেলে দিয়ে নিরীহ ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে মিলেমিশে নিরুপদ্রব জীবনযাপন করতে হবে, এর অন্যথা হলে তাদের গাজা ছেড়ে চলে যেতে হবে। তবে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত হামাস অস্ত্র সমর্পণ করবে না বলে গোঁ ধরেছে, তবে তাদের কোন কথাই আর মানা হবে না, এখন যে কোন শর্তে শান্তি চুক্তি প্রয়োজন, নতুবা হামাস ও গাজার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে। এখন না খেয়েই গাজার ফিলিস্তিনিরা মারা যাচ্ছে, পানি নেই, বিদ্যুৎ নেই, থাকার ঘর নেই, আছে শুধু গণকবর। হামাসদের সহায়তা করারও এখন আর কেউ নেই। লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হেজবুল্লাহকে পঙ্গু করে দেওয়া হয়েছে, ইয়েমেনের হুতিদের থামিয়ে দেওয়া হয়েছে, সিরিয়ায় ইসরায়েল বিদ্বেষী শাসকদের বদল হয়েছে। ইরানের শুধু যুদ্ধ করার খায়েশ নয়, ইসরায়েল বিরোধী কথাও বন্ধ হয়ে গেছে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ফিলিস্তিন ছিল তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে। এই ভূমিতে তখন মুসলিম, ইহুদী, খ্রিস্টান এবং ক্ষুদ্র ধর্মীয় গোষ্ঠী দ্রুজেরা শান্তিতে বসবাস করতো। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্ক বা অটোমানরা জার্মানির পক্ষ নিয়ে হেরে গেলে উসমানীয় সাম্রাজ্যের বিভিন্ন এলাকা ফ্রান্স এবং ব্রিটেনের মধ্যে ভাগাভাগি হয়ে যায়, ফিলিস্তিন পড়ে যায় ব্রিটেনের অধীনে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে থেকেই ইউরোপ থেকে কিছু কিছু ইহুদি ফিলিস্তিনে মাইগ্রেট করেছে; যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর সম্পদশালী ও জ্ঞানী ইহুদীদের প্রয়োজন পড়ায় ব্রিটিশরা ‘বেলফোর ডিক্লারেশন’-এর মাধ্যমে ফিলিস্তিন এলাকায় ইহুদিদের জন্য এই স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গড়ে দেওয়ার আশ্বাস দেয়। এই আশ্বাসে আস্থা রেখে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে ইহুদীরা ব্রিটিশ ফিলিস্তিনে এসে স্থানীয় ফিলিস্তিনিদের কাছ থেকে জমি কিনে নতুন নতুন বসতি গড়ে তোলে। নতুন নতুন বসতি গড়ে তোলার বিরুদ্ধে বৃটেন বাধা দিলে ইহুদিরা ফিলিস্তিনে বৃটেন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। আবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের গণহারে ইহুদি নিধন শুরু হলে হাজার হাজার ইহুদি ইউরোপ থেকে পালিয়ে চলে আসে ফিলিস্তিনে।

আস্তে আস্তে অভিবাসী ইহুদিদের সঙ্গে স্থানীয় ফিলিস্তিনিদের সংঘাত বেড়েই যাচ্ছিল, যা ব্রিটিশরাও আর সামলাতে পারছিল না। এই অবস্থায় জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলোর সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে ১৯৪৭ সনে ফিলিস্তিনে দুটি দেশ- ৫৫ শতাংশ এলাকা নিয়ে ইহুদিদের জন্য ‘ইসরাইল’, আর বাকি ৪৫ শতাংশ নিয়ে আরবদের জন্য ‘ফিলিস্তিন’ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে বৃটেনের প্রস্তাব অনুমোদিত হয়। এই প্রস্তাবে জেরুজালেমকে কোন দেশের অন্তর্ভুক্ত না করে একটা বিশেষ আন্তর্জাতিক এলাকা হিসাবে ঘোষণা করা হয়। ইহুদিরা এই প্রস্তাবে রাজি থাকলেও ফিলিস্তিনের স্থানীয় আরবরা এবং আশেপাশের আরব দেশগুলো জাতিসংঘের সিদ্ধান্তে সম্মত হয়নি। দুই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফিলিস্তিনে বসবাসরত ইহুদি ও মুসলমানদের মধ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। ১৯৪৮ সনের মে মাসের ১৫ তারিখে ব্রিটিশদের ফিলিস্তিন ত্যাগের একদিন আগে বেন গুরিয়ন জাতিসংঘের ১৮১ নম্বর রেজোল্যুশন মোতাবেক ইসরাইল রাষ্ট্রের জন্ম ঘোষণা করেন, এবং এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।

আরব লীগের সদস্য সাতটি দেশের সেনাবাহিনী মিশর, জর্ডান, সিরিয়া আর লেবানন সীমান্ত দিয়ে মধ্যরাতে ফিলিস্তিনে ঢুকে পড়ে। কিন্তু ৭টি দেশ মিলেও ইসরায়েলের এক ইঞ্চি জায়গা দখল করতে পারল না, বরং যুদ্ধ শেষে দেখা গেল ইসরায়েলের জন্য জাতিসংঘের বরাদ্দকৃত ৫৫ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৬০ শতাংশ হয়ে গেছে। এই যুদ্ধের কারণে বরং ফিলিস্তিনিদের জন্য বরাদ্দকৃত ভূমিটি বেহাত হয়ে যায়, তাদের গাজা উপত্যকা দখল করে মিশর, জর্ডান নদীর পশ্চিম তীর দখল করে জর্ডান, আর সামান্য বাকি অংশটুকু দখল করে নেয় ইসরায়েল। ফলে যুদ্ধ শেষে দেখা গেল জাতিসংঘের মানচিত্রে চিহ্নিত ফিলিস্তিন নামক দেশের আর কোনো বাস্তব অস্তিত্ব নেই। অন্যদিকে ‘বিশেষ আন্তর্জাতিক এলাকা’ জেরুজালেমের এক অংশ দখল করল ইসরায়েল, আর আল আকসা কমপ্লেক্সসহ পূর্ব জেরুজালেম দখল করল জর্ডান। শুধু দখল করে জর্ডান থেমে যায়নি, ফিলিস্তিনিদের পশ্চিম তীর এলাকাকে নিজ দেশের অন্তর্ভুক্ত করে ১৯৫০ সনে প্রণীত আইনের মাধ্যমে সেখানকার ফিলিস্তিনিদের জর্ডানের নাগরিকত্ব প্রদান করে।

ফিলিস্তিনিদের জন্য বরাদ্দকৃত ভূমি ১৯৪৮ সনের যুদ্ধে বেহাত হয়ে গেলে সাড়ে সাত লাখ ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তু হয়ে বিভিন্ন দেশের শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়, যাদের সংখ্যা বর্তমানে ৭০ লাখ। সুয়েজ খাল এবং তিরান প্রণালি দিয়ে ইসরায়েলের পথ অবরোধের কারণে মিশরের সঙ্গে ইসরায়েলের ১৯৫৬ এবং ১৯৬৭ সনে দুটি যুদ্ধ হয়। ১৯৫৬ সনে ইসরায়েলের বিমান হামলায় মিশর কাবু হয়ে যায়। ১৯৬৭ সনে মিশর ইসরায়েলের জাহাজকে তিরান প্রণালীতে পুনরায় বাধা দিলে আবার যুদ্ধ শুরু হয়। জর্ডান এবং সিরিয়াও মিশরের পক্ষে যুদ্ধে যোগ দেয়। কিন্তু মাত্র ৬ দিনের যুদ্ধে এই ৩টি দেশের শোচনীয় পরাজয় ঘটে। এই যুদ্ধে ইসরায়েল শুধু মিশরের দখলে থাকা ফিলিস্তিনিদের গাজা উপত্যকা নয়, মিশরের সিনাই উপত্যকাও ছিনিয়ে নেয়। অন্যদিকে জর্ডান বাহিনীকে তাড়িয়ে দিয়ে ফিলিস্তিনিদের কাছ থেকে ১৯৪৮ সনের যুদ্ধে দখল করা পশ্চিম তীরও ইসরায়েল দখল করে নেয়। আর সিরিয়া বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে তাদের গোলান হাইটস দখল করে নেয় ইসরায়েল। ১৯৭৩ সনে মিশর তাদের সিনাই উপত্যকা উদ্ধার করতে আবার যুদ্ধ শুরু করে, সিরিয়াও মিশরের পক্ষে যুদ্ধে নামে, ফলাফল আগের মতোই শূন্য। মিশর ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তি চুক্তি করতে বাধ্য হয়ে, এবং ইসরায়েল সিনাই উপত্যকা মিশরকে ফেরত দিয়ে দেয়। কিন্তু ১৯৪৮ সনের যুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের কাছ থেকে মিশরের দখল করা গাজা উপত্যকা, যা ১৯৬৭ সনের যুদ্ধে ইসরায়েল মিশর থেকে দখল করে নিয়েছিল, তা আর মিশরকে ফেরত দেয়নি। ফিলিস্তিনিদের ভূমি ১৯৪৮ সনে দখল করল মিশর আর জর্ডান, আর ১৯৬৭ সনে সেই ভূমি মিশর এবং জর্ডান থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল ইসরায়েল।

যুদ্ধ করে যে ইসরায়েলকে নিশ্চিহ্ন করা যাবে না তা প্রথম উপলব্ধি করেন পিএলও বা প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের চেয়ারম্যান ইয়াসির আরাফাত। এই উপলব্ধি থেকেই তিনি ইসরায়েলের সঙ্গে একটি শান্তি চুক্তি করেন। ১৯৯৩ সনে সম্পাদিত এই শান্তি চুক্তির বদৌলতে ইসরায়েল তাদের দখলে থাকা পশ্চিম তীর এবং গাজা উপত্যকা ফিলিস্তিনিদের ছেড়ে দেয় এবং সেখানে ‘প্যালেসটাইন অথোরিটি’ নামে একটি অন্তর্বতীকালীন সরকার গঠিত হয়, যারা গাজা উপত্যকা এবং পশ্চিম তীর এই দুইটি এলাকায় শুধু স্বায়ত্বশাসনের ভিত্তিতে শাসনকার্য পরিচালনা করবে। পাঁচ বছর পর্যবেক্ষণপূর্বক ফিলিস্তিনিদের স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিষয়টি বিবেচিত হবে বলেও শান্তি চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু বহু পাঁচ বছর অতিবাহিত হওয়ার পরও ফিলিস্তিদের জন্য স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের বিবেচনার বাস্তবায়ন হয়নি। কারণ ইহুদিদের সঙ্গে সহাবস্থানে থাকার এই শান্তি চুক্তি হামাসের মতো উগ্রপন্থী ফিলিস্তিনিরা মেনে নেয়নি, যদিও ইসরায়েলের জনসংখ্যার ১৮ শতাংশ মুসলমান ইসরায়েলের ভিতর ইহুদিদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে ইসরায়েলের নাগরিক হয়ে বসবাস করছে। ইহুদিদের মধ্যেও আবার উগ্র ডানপন্থী জায়োনিস্ট রয়েছে যারা ফিলিস্তিনিদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র মেনে নিতে চায় না। ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গিও উভয় পক্ষের উগ্রপন্থার উদ্ভবের কারণ। ৭৬ বছর ধরে হতাশাগ্রস্ত বাস্তুহারা ফিলিস্তিনিরা তাই শান্তিচুক্তির পরিবর্তে হামাসদের সমর্থন করেছে, কিন্তু আজ হামাসও প্রায় বিলীয়মান।

মধ্যপ্রাচ্যে মুসলমান এবং ইহুদিদের সহাবস্থানের বাস্তবতা না মেনে আর উপায় নেই। অতি সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও বৃটেন ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে। অনেকগুলো আরব দেশ অনেক আগেই ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিয়েছে। পৃথিবীর ৮৫ শতাংশ দেশ ইসরায়েলকে স্বার্বভৌম দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দানকারী প্রথম মুসলিম দেশ তুরস্ক এবং দ্বিতীয় দেশ ছিল ইরান। পরবর্তীকালে আরও অনেকগুলো মুসলিম দেশের সঙ্গে ইসরায়েলের কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, গাজা-যুদ্ধ না হলে আরও কিছু দেশ ইতোমধ্যে ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করার পদক্ষেপ নিতো। ধারণা করা হয়, আরব দেশগুলোর সঙ্গে যাতে ইসরায়েলের সম্পর্ক স্বাভাবিক না হয় সেজন্যই হামাস যোদ্ধারা ইসরায়েলের অভ্যন্তরে ঢুকে আক্রমণ করেছিল।

স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের পর সউদি আরব ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করার শর্ত দিয়েছে। তার উত্তরে জ্ঞান-বিজ্ঞানে পিছিয়ে থাকা মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলো সম্পর্কে ইসরাইলের অর্থমন্ত্রী বলেন তা আরবের মুসলমানদের জন্য অপমানজনক, ‘বন্ধুরা, -না, ধন্যবাদ। সৌদি আরবের মরুভূমিতে উটে চড়া অব্যাহত রাখুন’।

[লেখক: সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক ও সাবেক এমডি, টাকশাল]

back to top