alt

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

প্রভাষকের ‘প্রভা’ যখন ‘শোক’: শিক্ষা ক্যাডারে পদোন্নতি বঞ্চনা

সাব্রী সাবেরীন ও সৌরভ জাকারিয়া

: শনিবার, ০৮ নভেম্বর ২০২৫

যারা শিক্ষার্থীর মেধা, মনন, চিন্তা ও মূল্যবোধের উৎকর্ষ সাধনের মাধ্যমে জাতির ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের ব্রত নিয়ে শিক্ষকতা পেশায় আসেন, তাদের পদবী হলো-প্রভাষক। এই নামের গভীরে লুকিয়ে আছে ‘প্রকৃষ্ট রূপে শিক্ষাদানকারী’র সম্মান, অথবা ‘প্রভা’ অর্থাৎ জ্ঞানের আলো ছড়ানো’র পবিত্র অঙ্গীকার। কিন্তু অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনকভাবে, সেই প্রভাষকগণ আজ নিজেদের কর্মজীবনে দেখছেন কেবলই ক্রমবর্ধমান অন্ধকার। প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনা, খামখেয়ালী ও দীর্ঘসূত্রিতার জাতাকলে বন্দী হয়ে তাদের সেই ‘প্রভা’ এখন ‘শোক’-এর প্রতীকে পরিণত হয়েছে। ১০/১২ বছরেও চাকরিজীবনে একটিমাত্র পদোন্নতির দেখা মেলেনি। তাদের এই চরম বঞ্চনা কেবল ব্যক্তিগত হতাশা সৃষ্টি করছে না, বরং রাষ্ট্রের সর্বাধিক মর্যাদাপূর্ণ কর্মকাঠামোÑসিভিল সার্ভিসের ভেতরেই ব্যাপক বিশৃঙ্খলা ও ধ্বসের এক ভয়াবহ পূর্বাভাস দিচ্ছে।

শিক্ষা ক্যাডারের ৩২তম থেকে ৩৭তম বিসিএসের প্রায় ২৫০০ কর্মকর্তা পদোন্নতির সকল শর্ত পূরণ করার পরও পদোন্নতিবঞ্চিত। প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতিতে দীর্ঘসূত্রীতা ও অচলাবস্থার কারণে পদোন্নতির জ্যেষ্ঠতা তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে হতে আজকে কয়েক হাজার ছাড়িয়েছে। এর ফলস্বরুপ, ৩২তম ও ৩৩তম বিসিএস ব্যাচের প্রায় চার শতাধিক প্রভাষক চাকরিতে যোগদানের এক যুগ পরেও প্রথম পদোন্নতির দেখা পাননি। এর পাশাপাশি, ৩৪তম বিসিএস ১০ বছর, ৩৫তম বিসিএস ৯ বছর, ৩৬তম বিসিএস ৮ বছর এবং ৩৭তম বিসিএস ৭ বছরে পদার্পণ করেছে, কিন্তু প্রথম পদোন্নতির দেখা নেই।

অথচ এই প্রভাষকদের সাথে একই বিসিএসে যোগদান করা অন্যান্য ক্যাডারের ৩৬ তম ও ৩৭ তম ব্যাচ পদোন্নতি পেয়েছে যথাক্রমে ২০২৩ ও ২০২৪ সালে। এমনকি তাদের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করা অনেকে সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপকও হয়েছেন। শুধু তাই নয়, বেসরকারি কলেজে যোগদান করা তাদের অনেক বন্ধু-সহপাঠীও ইতোমধ্যে সহকারী অধ্যাপক পদ অলংকৃত করেছেন। আর শিক্ষা ক্যাডারে এসে তারা হয়েছেন প্রভাষক থেকে ‘প্রভাশোক’!

এই বঞ্চিত প্রভাষকরা সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক, বীমা, নামীদামী কর্পোরেট সংস্হা এবং সরকারি ১ম শ্রেণীর নন-ক্যাডার গেজেটেড চাকরী ছেড়ে শুধু ক্যাডার সার্ভিসে প্রবেশের প্রবল ইচ্ছায় এই পেশা বেছে নিয়েছেন। তারা একটি অভিন্ন বিসিএস, অভিন্ন সিলেবাস, অভিন্ন প্রশ্নপত্র, অভিন্ন পরীক্ষা এবং বহুস্তর বিশিষ্ট, জাতীয় ভিত্তিক তীব্র প্রতিযোগিতার মাধ্যমে একইরকম যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ায় নিয়োগ পেয়েছেন। তারা ‘সকল ক্যাডারের জন্য’ নির্ধারিত পদোন্নতির সকল শর্তও সফলভাবে পূরণ করেছেন।

বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস নিয়োগ বিধিমালা ১৯৮১ এর বিধি ৫ ও ৭ অনুযায়ী চাকরিতে যোগদান করা একজন নবীন কর্মকর্তাকে পদোন্নতির জন্য বেশ কিছু যোগ্যতা ও সময়ের শর্ত পূরণ করতে হয়। এর মধ্যে রয়েছে- ৬ মাসের বুনিয়াদী প্রশিক্ষণে শৃঙ্খলা ও সফলতার সাথে উত্তীর্ণ হওয়া, তিন পত্রবিশিষ্ট বিভাগীয় পরীক্ষায় ৬০% নম্বর পেয়ে উত্তীর্ণ হওয়া, এই দুই যোগ্যতা অর্জন শেষে যোগিদানের ২ বছর পর চাকরি স্থায়ীকরণ, ৪ বছর পর আবারও তিন পত্রবিশিষ্ট সিনিয়র স্কেল পদোন্নতি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া এবং ‘সন্তোষজনকভাবে’ চাকরি ৫ বছর পূর্ণ করা। পদোন্নতির এতসব কঠিন শর্ত পূরণ করার পরও শিক্ষা ক্যাডারের প্রভাষকদের ৬ষ্ঠ গ্রেড কিংবা সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি কোনোটাই ভাগ্যে জুটছে না।

২০২৫ সালের ১৭ এপ্রিল ও ৪ জুন দুবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ডিপার্টমেন্টাল প্রমোশন কমিটি (উচঈ) বৈঠকে বসেছিল প্রভাষকদের পদোন্নতি নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে। কিন্তু দুই বৈঠকের কোনোটিতেই আসেনি প্রত্যাশিত ফলাফল। প্রতি বছরই যেমন অজুহাতের ফুলঝুরি দেখা যায়, তেমনি এবারও বলা হচ্ছে, পদ শূন্য না থাকার কথা, সাথে আত্মীকৃত শিক্ষকদের মামলার অজুহাতও আছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, আদালতের কোনো নির্দেশনায় পদোন্নতি স্থগিত রাখার কথা বলা হয়নি।

অন্যদিকে প্রশাসন, পুলিশ, কৃষি ক্যাডারসহ অন্যান্য ক্যাডারে শূন্য পদ না থাকলেও কর্মকর্তারা পাঁচ বছর পূর্তিতে ৬ষ্ঠ গ্রেডের সিনিয়র স্কেলে পদোন্নতি পাচ্ছেন। এমনকি সম্প্রতি স্বাস্থ্য ক্যাডারে সুপারনিউমারারি পদে ৫০০ জন চিকিৎসককে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু শিক্ষা ক্যাডারে সেই একই প্রক্রিয়ায় সুপারনিউমারারি বা রিজার্ভ পদ সৃষ্টির ফাইল যেন অনন্ত দীর্ঘসূত্রিতার বেড়াজালে আটকে থাকে।

দীর্ঘদিন পদোন্নতি বঞ্চিত হয়ে একদিকে প্রভাষকরা বিপুল আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন, অন্যদিকে সামাজিক মর্যাদা ও কর্মস্পৃহা হারিয়ে চরম হতাশায় নিমজ্জিত হয়েছেন। সেই হতাশা থেকে তারা শ্রেণিকক্ষের বাইরে বেরিয়ে এসে প্রথমে মাউশি ও মন্ত্রণালয়ের ডেস্কে ডেস্কে ধরনা দিতে বাধ্য হয়েছেন। কোনো প্রতিকার না পেয়ে অবশেষে তারা গিয়েছেন মাউশি-তে; দাবি নিয়ে দাঁড়িয়েছেন সংলগ্ন রাজপথে। গত ২৮ সেপ্টেম্বর ৩২ ও ৩৩তম ব্যাচের প্রভাষকরা মানববন্ধন করেছিলেন মাউশির সামনে। আর গত ৩০ অক্টোবর ৩২ থেকে ৩৭তম বিসিএসের প্রায় সাত শতাধিক কর্মকর্তা একই স্থানে অবস্থান কর্মসূচি, মানববন্ধন ও সংবাদ সম্মেলন করেছেন। তাদের সাথে সংহতি জানিয়েছেন অন্যান্য ব্যাচের বহু সিনিয়র ও জুনিয়র কর্মকর্তা।

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এত আবেদন-নিবেদন-আন্দোলন কিংবা হুশিয়ারির পরও টানেলের কোনো প্রান্তেই এখনও পদোন্নতির আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে না। উলটো শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে পদোন্নতিযোগ্য প্রভাষকদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি, বিভাগীয়, দুর্নীতি বা শৃঙ্খলাজনিত মামলার তথ্য চেয়ে ২৯ অক্টোবর জারি করা অথচ ৩০ অক্টোবর শেষ বিকেলে আলোর মুখ দেখা নতুন আদেশের কারণে প্রভাষকদের পদোন্নতির রোদন আরও ভারী হবে বলে আশংকা করা হচ্ছে। সংক্ষুব্ধ প্রভাষকরা তাই আগামী ১২ নভেম্বরের মধ্যে যোগ্য সকল প্রভাষককে পদোন্নতি দেওয়ার দাবি জানিয়ে কর্মবিরতি শুরু করার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।

বৈষম্যবিরোধী এরকম রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্রের মৌলিক এবং জাতি গঠনের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটি সার্ভিসে ‘প্রথম পদোন্নতি’ পেতেই যদি ১২ বছর লাগে, তাহলে মেধাবীগণ এ সার্ভিসে কেন আসতে এবং থাকতে চাইবে- এ প্রশ্ন আজ অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। ২৪ এর গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে যেখানে মরণোত্তর পদোন্নতি, ভূতাপেক্ষ পদোন্নতির ছড়াছড়ি, সেখানে শিক্ষা ক্যাডারের প্রভাষকগণের ‘প্রথম পদোন্নতি’র জন্য রাস্তায় নামতে হচ্ছে কেন? শিক্ষা ক্যাডারের প্রভাষকদের একটিমাত্র পদোন্নতির দাবী কেন বারবার অরণ্যে রোদন হয়ে ফিরেছে?

এই ভয়াবহ বৈষম্য দূর করতে এখনই প্রয়োজন দৃঢ় রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও সুনির্দিষ্ট নীতিনির্ধারনী পদক্ষেপ। অন্যথায়, দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষকতার পেশা থেকে মেধাবীরা ক্রমেই মুখ ফিরিয়ে নেবে- যা জাতির ভবিষ্যতের জন্য গভীর বিপর্যয় ডেকে আনবে। শিক্ষা ক্যাডারে প্রভাষকসহ বিভিন্ন টায়ারে পদোন্নতি সংকট নিরসনে এ পর্যন্ত বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়ার বিষয়ে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা এসসিয়েশনসহ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) কিংবা ক্যাডার চিন্তকদের ভাবনায় উঠে এসেছে। কিন্তু প্রশাসনিক সদিচ্ছা ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের অভাবে সেগুলো আলোর মুখ দেখেনি।

শিক্ষা ক্যাডারে পদোন্নতি সমস্যার পেছনে প্রায়ই “শূন্যপদের অপ্রতুলতা”কে প্রধান অজুহাত হিসেবে সামনে আনা হয়। অথচ সুপারনিউমেরারি বা সংখ্যাতিরিক্ত পদ সৃষ্টি করে এই সমস্যার আশু সমাধান করা একেবারেই সম্ভব। অন্যান্য ক্যাডারে ইতোমধ্যেই এমন পদ সৃষ্টি করে কর্মকর্তাদের পদোন্নতির নজির বহুবার দেখা গেছে। শিক্ষা ক্যাডার থেকেও অতীতে এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। ২০১৩ সালে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) থেকে সুপারনিউমেরারি পদ সৃষ্টির একটি প্রস্তাব জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে প্রেরিত হলেও তা প্রত্যাখ্যাত হয় এই যুক্তিতে যে, “পদোন্নতি প্রদানের জন্য সুপারনিউমেরারি পদ সৃজনের কোন সুযোগ নেই।” পরবর্তীতে উপসচিব থেকে সচিব পর্যায় পর্যন্ত পদোন্নতির ক্ষেত্রে সেই একই মন্ত্রণালয় বলেছে, “উপসচিব হতে সচিব পদসমূহ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পদ; এসব পদে সকল ক্যাডারের কর্মকর্তাগণ পদোন্নতি পেয়ে থাকেন। শিক্ষা ক্যাডারও এর অন্তর্ভুক্ত।”

কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন চিত্র তুলে ধরে। এ যুক্তি যে কেবল শিক্ষা ক্যাডারকে বঞ্চিত রাখার একটি প্রশাসনিক কৌশল, তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন গত ২২ অক্টোবর স্বাস্থ্য ক্যাডারের ৫৯৯ জন কর্মকর্তাকে সুপারনিউমেরারি পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। অর্থাৎ, একই রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভেতরে এক ক্যাডারে সংখ্যাতিরিক্ত পদ সৃষ্টি সম্ভব হলেও, শিক্ষা ক্যাডারের ক্ষেত্রে সেটি “অসম্ভব” বলে দেখানো হচ্ছে- যা নিঃসন্দেহে বৈষম্যমূলক এবং নীতিগতভাবে অন্যায্য। এরই মধ্যে মাউশি থেকে গত সেপ্টেম্বরে ৩৫৯২টি সুপারনিউমেরারি পদ সৃষ্টির প্রস্তাবনা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হলেও দুই মাস পেরিয়ে গেলেও সেই ফাইলের কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে না।

বর্তমানে শিক্ষা ক্যাডারের প্রভাষক পর্যায়ে ৩২তম থেকে ৩৭তম পর্যন্ত অন্তত ছয়টি ব্যাচ পদোন্নতিযোগ্য অবস্থায় রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে ব্যাচভিত্তিক পদোন্নতি কার্যক্রম চালু না থাকায় এ ব্যাচগুলোর কর্মকর্তাগণ বছরের পর বছর পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। অন্যদিকে, অন্যান্য ক্যাডারে যেখানে ব্যাচভিত্তিক পদোন্নতির নিয়ম অনুসৃত হয়, সেখানে শিক্ষা ক্যাডারে বিষয়ভিত্তিক পদোন্নতি পদ্ধতি চালু থাকায় এক বিষয়ের জুনিয়র ব্যাচের কর্মকর্তা প্রায়শই অন্য বিষয়ের সিনিয়র ব্যাচের কর্মকর্তার আগেই পদোন্নতি পান। ফলে একদিকে যেমন সিনিয়রদের মনোবল ভেঙে পড়ে, অন্যদিকে তাতে সৃষ্টি হয় একাডেমিক ও প্রশাসনিক জটিলতা। উল্লেখ্য, বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপক পদে ব্যাচভিত্তিক পদোন্নতির ব্যবস্থা চালু করা হলেও অজ্ঞাত কারণে প্রভাষক পর্যায়ে সেই নীতি কার্যকর করা হয়নি। ফলে শিক্ষা ক্যাডারের সবচেয়ে বৃহৎ অংশটি আজও পদোন্নতির অনিশ্চয়তা ও বৈষম্যের বেড়াজালে আবদ্ধ।

শিক্ষা ক্যাডারে পদোন্নতির আরেকটি কার্যকর উপায় হতে পারে রিজার্ভ পদ সৃষ্টি। বিভিন্ন সার্ভিসে সাধারণত মোট পদের প্রায় ১০ শতাংশ অতিরিক্ত পদ রিজার্ভ হিসেবে রাখা হয়- প্রশিক্ষণ, ছুটি, উচ্চশিক্ষা বা লিয়েন ইত্যাদি কারণে সাময়িক শূন্যতা পূরণের লক্ষ্যে। কিন্তু শিক্ষা ক্যাডারের ক্ষেত্রে এ নিয়ম কার্যত উপেক্ষিত। বর্তমানে শিক্ষা ক্যাডারে মোট অনুমোদিত পদ ১৯,০৪৯টি হলেও রিজার্ভ পদ রয়েছে মাত্র ৮১৬টি; অর্থাৎ প্রাপ্যতার চেয়ে আরও ১,০৮৯টি পদ কম। গত আগস্টে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) থেকে এই ১,০৮৯টি রিজার্ভ পদ সৃষ্টির প্রস্তাব পাঠানো হইয়েছে, মাসের পর মাস পেরিয়ে গেলেও সে ফাইল এখনও আলোর মুখ দেখেনি। অথচ পর্যাপ্ত রিজার্ভ পদ থাকলে ২০০৮ সালের মত এবারও প্রভাষকদের রিজার্ভ পদের বিপরীতে পদোন্নতি দিয়ে পদোন্নতি জট কমানো যেত।

বিশ্লেষণে দেখা গেছে, শিক্ষা ক্যাডারের ৩২তম থেকে ৩৪তম ব্যাচের প্রভাষকদের পদোন্নতি প্রদান করলে সরকারের অতিরিক্ত কোনো ব্যয় হবে না। এ ক্ষেত্রে কর্মকর্তাদের ইনসিটু (অর্থাৎ বর্তমান পদ ও কর্মস্থল থেকেই) পদোন্নতি দেওয়া সম্ভব, ফলে পর্যাপ্ত শূন্যপদ না থাকার অজুহাতও অচল হয়ে যায়। এছাড়া আত্মীকৃত শিক্ষকদের মামলার বিষয়টি সামনে আনা হলেও, বাস্তবে মামলার বাদী ৯৯ জন শিক্ষকের জন্য পৃথকভাবে পদ সংরক্ষিত রেখে বাকি যোগ্য কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দেওয়া যেতে পারে। এতে আইনি প্রক্রিয়াও সম্মানিত থাকবে এবং প্রশাসনিক অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হবে না। তদুপরি, ডিপিসি সভা যেন নিয়মিত বিরতিতে অনুষ্ঠিত হয় এবং সভায় গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো দ্রুততম সময়ের মধ্যে বাস্তবায়ন করা হয়- এ বিষয়েও কার্যকর প্রশাসনিক তদারকি জরুরি। কেবল নিয়মিত সভা ও দ্রুত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের মাধ্যমে পদোন্নতি-সংকটের বড় একটি অংশই নিরসন সম্ভব।

শিক্ষা ক্যাডারে পদোন্নতি সমস্যার সবচেয়ে কার্যকর ও স্থায়ী সমাধান হতে পারে নতুন পদ সৃষ্টি। কিন্তু এই প্রক্রিয়া বছরের পর বছর ধরে আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় আটকে আছে। ২০১৭ সাল থেকেই কেন্দ্রীয়ভাবে ১২,৫৮৮টি নতুন পদ সৃষ্টির প্রস্তাব মাউশি, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে ঘুরপাক খেয়ে চলেছে। দীর্ঘ সময় ধরে ফাইল চালাচালির পরও কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়নি। অবশেষে ২০২৩ সালে এসে নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত হয়-কেন্দ্রীয়ভাবে নয়, বরং কলেজভিত্তিকভাবে পদ সৃষ্টি করা হবে। এরই ধারাবাহিকতায় প্রথম দফায় ২০২৪ সালের ১০ নভেম্বর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ১,৪৬১টি নতুন পদ সৃষ্টিতে সম্মতি জানায়। দ্বিতীয় দফায় একই বছরের ১৭ ডিসেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয় ২০টি কলেজে মোট ৩,১১৭টি পদ সৃষ্টির প্রস্তাব পাঠায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে। কিন্তু প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও সেই প্রস্তাবগুলোর চূড়ান্ত অনুমোদন বা প্রজ্ঞাপন এখনও জারি হয়নি। ফলে পদোন্নতি-সংকট নিরসনের সবচেয়ে বাস্তবসম্মত উদ্যোগও থেকে গেছে প্রশাসনিক জটের গহ্বরে।

পদোন্নতি প্রক্রিয়ায় দির্ঘদিনের অচলাবস্থা এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অমনোযোগিতার ফলে বঞ্চিত কর্মকর্তাগণের মধ্যে দিনেদিনে প্রচন্ড হতাশা, অসন্তোষ, ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হয়ে বিস্ফোরণ্মুখ অবস্থা ধারণ করেছে। একইসাথে এদের উল্লেখযোগ্য একটা অংশের মধ্যেই ‘সুবিধাভোগী’ কোনো ক্যাডারে চলে যাওয়ার চেষ্টা ক্রমাগত যেমন বেড়েছে, তেমনই অনিবার্য হয়েও উঠেছে। আমাদের সরকার এবং রাজনীতিবিদগণ এ প্রবণতা রোধে ব্যর্থ হলে রাষ্ট্রের সর্বাধিক মর্যাদাপূর্ণ কর্মকাঠামোর (বিসিএস ক্যাডার সার্ভিসে) অভ্যন্তরে ব্যাপক বিরোধ, বিশৃঙ্খলা এবং ধ্বস প্রত্যক্ষ করতে জাতিকে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হবে না। শিক্ষা ক্যাডারের এই ‘প্রভাশোক’ দূর করা এখন কেবল ব্যক্তিগত হতাশা নিরসন নয়, বরং জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার মেরুদ- রক্ষার জন্য জরুরি। পদোন্নতি সমস্যা নিরসনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন দ্রুত করা হলে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের প্রভাষকদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে, ক্যাডার সার্ভিসের প্রতি মেধাবীদের আকর্ষণ বজায় থাকবে এবং দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা ও ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে।

(মতামত লেখকদের নিজস্ব)

[লেখকদ্বয়: শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তা ও সদস্য, দি অ্যাডভাইজরস: থিংক ট্যাংক অব সিভিল এডুকেশন]

যুদ্ধ বিরতি গাজাবাসীর জন্য জরুরি ছিল

লবলং খালের মৃত্যু: স্মৃতিতে নদী, বাস্তবে দূষণ

বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা: অর্থনৈতিক স্থিতির পূর্বশর্ত

হায় যম! আর কতক্ষণ, হবে অপেক্ষা করিতে মোরে?

পোশাক শিল্প : অগ্রগতি ও শ্রমিকের অধিকার

গণভোটের রাজনৈতিক গুরুত্ব

বামঘরানার বাটখারা...

বাগদা ফার্ম : স্মারকলিপি, অবরোধ, অনশন, আন্দোলন- কিছুতেই বরফ গলেনি

ব্যাটারি-শকট: নতুন সংকট

মতপ্রকাশ কিংবা দ্বিমত পোষণ: নাগরিক অধিকার ও রাজনৈতিক বাস্তবতা

সরকারি কর্মচারীদের জন্য নতুন ব্যাংক কি আদৌ প্রয়োজন

ট্রাম্প ও শি’র ‘কৌশলগত শান্তি’

আশার সমাজতত্ত্ব: বিভ্রান্তির যুগে ভবিষ্যৎ নির্মাণের বিপ্লবী বিজ্ঞান

পিএইচডি: উচ্চ শিক্ষার মানদণ্ড না প্রতীকী মরীচিকা?

ডিম নয় তবু অশ্বডিম্ব!

ছবি

অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও নির্বাচন

পিএইচডি: উচ্চ শিক্ষার মানদণ্ড না প্রতীকী মরীচিকা?

প্রকৃতার্থে ফকির কারা

এনসিপি চায় অবিনাশী জুলাই সনদ

পিএইচডি: উচ্চ শিক্ষার মানদণ্ড না প্রতীকী মরীচিকা?

আলুর প্রাচুর্যে কৃষকের সংকট

তাহলে কী ‘কোটা’ই জয়যুক্ত হবে!

ব্যাংকিং খাতে বিষফোঁড়া: বাংলাদেশের অর্থনীতির ধমনী বিষাক্ত হয়ে উঠছে

ছবি

ঢাকার নদী ও খালের দখল-দূষণ: পুনরুদ্ধার কোন পথে

জমি কী মূলে রেকর্ড হয়েছে, দলিল মূলে না উত্তরাধিকার মূলে?

কার্বন-নিরপেক্ষ শিশুর অনুপ্রেরণায় দেশ

এবার আমরা সভ্য হলাম!

সোনার প্রাসাদের দেয়ালে ঘামের দাগ

নিরাপদ সড়ক চাই কিন্তু কার্যকর উদ্যোগ কোথায়?

অবহেলিত শিক্ষার দুর্দশা বাড়ছে

টেকসই উন্নয়নের পূর্বশর্ত নিরাপদ সড়ক

বাংলার সংস্কৃতি কি মূলধারা হারিয়ে ফেলবে?

ছবি

সমদৃষ্টি, বহুত্ববাদী সমাজ এবং সহিষ্ণুতা

খাদ্য অপচয় : ক্ষুধার্ত পৃথিবীর এক নিঃশব্দ ট্র্যাজেডি

টেকসই বাংলাদেশ গঠনে পরিবেশ সংস্কার কেন অপরিহার্য

সে এক রূপকথারই দেশ

tab

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

প্রভাষকের ‘প্রভা’ যখন ‘শোক’: শিক্ষা ক্যাডারে পদোন্নতি বঞ্চনা

সাব্রী সাবেরীন ও সৌরভ জাকারিয়া

শনিবার, ০৮ নভেম্বর ২০২৫

যারা শিক্ষার্থীর মেধা, মনন, চিন্তা ও মূল্যবোধের উৎকর্ষ সাধনের মাধ্যমে জাতির ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের ব্রত নিয়ে শিক্ষকতা পেশায় আসেন, তাদের পদবী হলো-প্রভাষক। এই নামের গভীরে লুকিয়ে আছে ‘প্রকৃষ্ট রূপে শিক্ষাদানকারী’র সম্মান, অথবা ‘প্রভা’ অর্থাৎ জ্ঞানের আলো ছড়ানো’র পবিত্র অঙ্গীকার। কিন্তু অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনকভাবে, সেই প্রভাষকগণ আজ নিজেদের কর্মজীবনে দেখছেন কেবলই ক্রমবর্ধমান অন্ধকার। প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনা, খামখেয়ালী ও দীর্ঘসূত্রিতার জাতাকলে বন্দী হয়ে তাদের সেই ‘প্রভা’ এখন ‘শোক’-এর প্রতীকে পরিণত হয়েছে। ১০/১২ বছরেও চাকরিজীবনে একটিমাত্র পদোন্নতির দেখা মেলেনি। তাদের এই চরম বঞ্চনা কেবল ব্যক্তিগত হতাশা সৃষ্টি করছে না, বরং রাষ্ট্রের সর্বাধিক মর্যাদাপূর্ণ কর্মকাঠামোÑসিভিল সার্ভিসের ভেতরেই ব্যাপক বিশৃঙ্খলা ও ধ্বসের এক ভয়াবহ পূর্বাভাস দিচ্ছে।

শিক্ষা ক্যাডারের ৩২তম থেকে ৩৭তম বিসিএসের প্রায় ২৫০০ কর্মকর্তা পদোন্নতির সকল শর্ত পূরণ করার পরও পদোন্নতিবঞ্চিত। প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতিতে দীর্ঘসূত্রীতা ও অচলাবস্থার কারণে পদোন্নতির জ্যেষ্ঠতা তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে হতে আজকে কয়েক হাজার ছাড়িয়েছে। এর ফলস্বরুপ, ৩২তম ও ৩৩তম বিসিএস ব্যাচের প্রায় চার শতাধিক প্রভাষক চাকরিতে যোগদানের এক যুগ পরেও প্রথম পদোন্নতির দেখা পাননি। এর পাশাপাশি, ৩৪তম বিসিএস ১০ বছর, ৩৫তম বিসিএস ৯ বছর, ৩৬তম বিসিএস ৮ বছর এবং ৩৭তম বিসিএস ৭ বছরে পদার্পণ করেছে, কিন্তু প্রথম পদোন্নতির দেখা নেই।

অথচ এই প্রভাষকদের সাথে একই বিসিএসে যোগদান করা অন্যান্য ক্যাডারের ৩৬ তম ও ৩৭ তম ব্যাচ পদোন্নতি পেয়েছে যথাক্রমে ২০২৩ ও ২০২৪ সালে। এমনকি তাদের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করা অনেকে সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপকও হয়েছেন। শুধু তাই নয়, বেসরকারি কলেজে যোগদান করা তাদের অনেক বন্ধু-সহপাঠীও ইতোমধ্যে সহকারী অধ্যাপক পদ অলংকৃত করেছেন। আর শিক্ষা ক্যাডারে এসে তারা হয়েছেন প্রভাষক থেকে ‘প্রভাশোক’!

এই বঞ্চিত প্রভাষকরা সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক, বীমা, নামীদামী কর্পোরেট সংস্হা এবং সরকারি ১ম শ্রেণীর নন-ক্যাডার গেজেটেড চাকরী ছেড়ে শুধু ক্যাডার সার্ভিসে প্রবেশের প্রবল ইচ্ছায় এই পেশা বেছে নিয়েছেন। তারা একটি অভিন্ন বিসিএস, অভিন্ন সিলেবাস, অভিন্ন প্রশ্নপত্র, অভিন্ন পরীক্ষা এবং বহুস্তর বিশিষ্ট, জাতীয় ভিত্তিক তীব্র প্রতিযোগিতার মাধ্যমে একইরকম যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ায় নিয়োগ পেয়েছেন। তারা ‘সকল ক্যাডারের জন্য’ নির্ধারিত পদোন্নতির সকল শর্তও সফলভাবে পূরণ করেছেন।

বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস নিয়োগ বিধিমালা ১৯৮১ এর বিধি ৫ ও ৭ অনুযায়ী চাকরিতে যোগদান করা একজন নবীন কর্মকর্তাকে পদোন্নতির জন্য বেশ কিছু যোগ্যতা ও সময়ের শর্ত পূরণ করতে হয়। এর মধ্যে রয়েছে- ৬ মাসের বুনিয়াদী প্রশিক্ষণে শৃঙ্খলা ও সফলতার সাথে উত্তীর্ণ হওয়া, তিন পত্রবিশিষ্ট বিভাগীয় পরীক্ষায় ৬০% নম্বর পেয়ে উত্তীর্ণ হওয়া, এই দুই যোগ্যতা অর্জন শেষে যোগিদানের ২ বছর পর চাকরি স্থায়ীকরণ, ৪ বছর পর আবারও তিন পত্রবিশিষ্ট সিনিয়র স্কেল পদোন্নতি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া এবং ‘সন্তোষজনকভাবে’ চাকরি ৫ বছর পূর্ণ করা। পদোন্নতির এতসব কঠিন শর্ত পূরণ করার পরও শিক্ষা ক্যাডারের প্রভাষকদের ৬ষ্ঠ গ্রেড কিংবা সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি কোনোটাই ভাগ্যে জুটছে না।

২০২৫ সালের ১৭ এপ্রিল ও ৪ জুন দুবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ডিপার্টমেন্টাল প্রমোশন কমিটি (উচঈ) বৈঠকে বসেছিল প্রভাষকদের পদোন্নতি নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে। কিন্তু দুই বৈঠকের কোনোটিতেই আসেনি প্রত্যাশিত ফলাফল। প্রতি বছরই যেমন অজুহাতের ফুলঝুরি দেখা যায়, তেমনি এবারও বলা হচ্ছে, পদ শূন্য না থাকার কথা, সাথে আত্মীকৃত শিক্ষকদের মামলার অজুহাতও আছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, আদালতের কোনো নির্দেশনায় পদোন্নতি স্থগিত রাখার কথা বলা হয়নি।

অন্যদিকে প্রশাসন, পুলিশ, কৃষি ক্যাডারসহ অন্যান্য ক্যাডারে শূন্য পদ না থাকলেও কর্মকর্তারা পাঁচ বছর পূর্তিতে ৬ষ্ঠ গ্রেডের সিনিয়র স্কেলে পদোন্নতি পাচ্ছেন। এমনকি সম্প্রতি স্বাস্থ্য ক্যাডারে সুপারনিউমারারি পদে ৫০০ জন চিকিৎসককে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু শিক্ষা ক্যাডারে সেই একই প্রক্রিয়ায় সুপারনিউমারারি বা রিজার্ভ পদ সৃষ্টির ফাইল যেন অনন্ত দীর্ঘসূত্রিতার বেড়াজালে আটকে থাকে।

দীর্ঘদিন পদোন্নতি বঞ্চিত হয়ে একদিকে প্রভাষকরা বিপুল আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন, অন্যদিকে সামাজিক মর্যাদা ও কর্মস্পৃহা হারিয়ে চরম হতাশায় নিমজ্জিত হয়েছেন। সেই হতাশা থেকে তারা শ্রেণিকক্ষের বাইরে বেরিয়ে এসে প্রথমে মাউশি ও মন্ত্রণালয়ের ডেস্কে ডেস্কে ধরনা দিতে বাধ্য হয়েছেন। কোনো প্রতিকার না পেয়ে অবশেষে তারা গিয়েছেন মাউশি-তে; দাবি নিয়ে দাঁড়িয়েছেন সংলগ্ন রাজপথে। গত ২৮ সেপ্টেম্বর ৩২ ও ৩৩তম ব্যাচের প্রভাষকরা মানববন্ধন করেছিলেন মাউশির সামনে। আর গত ৩০ অক্টোবর ৩২ থেকে ৩৭তম বিসিএসের প্রায় সাত শতাধিক কর্মকর্তা একই স্থানে অবস্থান কর্মসূচি, মানববন্ধন ও সংবাদ সম্মেলন করেছেন। তাদের সাথে সংহতি জানিয়েছেন অন্যান্য ব্যাচের বহু সিনিয়র ও জুনিয়র কর্মকর্তা।

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এত আবেদন-নিবেদন-আন্দোলন কিংবা হুশিয়ারির পরও টানেলের কোনো প্রান্তেই এখনও পদোন্নতির আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে না। উলটো শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে পদোন্নতিযোগ্য প্রভাষকদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি, বিভাগীয়, দুর্নীতি বা শৃঙ্খলাজনিত মামলার তথ্য চেয়ে ২৯ অক্টোবর জারি করা অথচ ৩০ অক্টোবর শেষ বিকেলে আলোর মুখ দেখা নতুন আদেশের কারণে প্রভাষকদের পদোন্নতির রোদন আরও ভারী হবে বলে আশংকা করা হচ্ছে। সংক্ষুব্ধ প্রভাষকরা তাই আগামী ১২ নভেম্বরের মধ্যে যোগ্য সকল প্রভাষককে পদোন্নতি দেওয়ার দাবি জানিয়ে কর্মবিরতি শুরু করার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।

বৈষম্যবিরোধী এরকম রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্রের মৌলিক এবং জাতি গঠনের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটি সার্ভিসে ‘প্রথম পদোন্নতি’ পেতেই যদি ১২ বছর লাগে, তাহলে মেধাবীগণ এ সার্ভিসে কেন আসতে এবং থাকতে চাইবে- এ প্রশ্ন আজ অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। ২৪ এর গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে যেখানে মরণোত্তর পদোন্নতি, ভূতাপেক্ষ পদোন্নতির ছড়াছড়ি, সেখানে শিক্ষা ক্যাডারের প্রভাষকগণের ‘প্রথম পদোন্নতি’র জন্য রাস্তায় নামতে হচ্ছে কেন? শিক্ষা ক্যাডারের প্রভাষকদের একটিমাত্র পদোন্নতির দাবী কেন বারবার অরণ্যে রোদন হয়ে ফিরেছে?

এই ভয়াবহ বৈষম্য দূর করতে এখনই প্রয়োজন দৃঢ় রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও সুনির্দিষ্ট নীতিনির্ধারনী পদক্ষেপ। অন্যথায়, দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষকতার পেশা থেকে মেধাবীরা ক্রমেই মুখ ফিরিয়ে নেবে- যা জাতির ভবিষ্যতের জন্য গভীর বিপর্যয় ডেকে আনবে। শিক্ষা ক্যাডারে প্রভাষকসহ বিভিন্ন টায়ারে পদোন্নতি সংকট নিরসনে এ পর্যন্ত বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়ার বিষয়ে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা এসসিয়েশনসহ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) কিংবা ক্যাডার চিন্তকদের ভাবনায় উঠে এসেছে। কিন্তু প্রশাসনিক সদিচ্ছা ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের অভাবে সেগুলো আলোর মুখ দেখেনি।

শিক্ষা ক্যাডারে পদোন্নতি সমস্যার পেছনে প্রায়ই “শূন্যপদের অপ্রতুলতা”কে প্রধান অজুহাত হিসেবে সামনে আনা হয়। অথচ সুপারনিউমেরারি বা সংখ্যাতিরিক্ত পদ সৃষ্টি করে এই সমস্যার আশু সমাধান করা একেবারেই সম্ভব। অন্যান্য ক্যাডারে ইতোমধ্যেই এমন পদ সৃষ্টি করে কর্মকর্তাদের পদোন্নতির নজির বহুবার দেখা গেছে। শিক্ষা ক্যাডার থেকেও অতীতে এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। ২০১৩ সালে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) থেকে সুপারনিউমেরারি পদ সৃষ্টির একটি প্রস্তাব জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে প্রেরিত হলেও তা প্রত্যাখ্যাত হয় এই যুক্তিতে যে, “পদোন্নতি প্রদানের জন্য সুপারনিউমেরারি পদ সৃজনের কোন সুযোগ নেই।” পরবর্তীতে উপসচিব থেকে সচিব পর্যায় পর্যন্ত পদোন্নতির ক্ষেত্রে সেই একই মন্ত্রণালয় বলেছে, “উপসচিব হতে সচিব পদসমূহ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পদ; এসব পদে সকল ক্যাডারের কর্মকর্তাগণ পদোন্নতি পেয়ে থাকেন। শিক্ষা ক্যাডারও এর অন্তর্ভুক্ত।”

কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন চিত্র তুলে ধরে। এ যুক্তি যে কেবল শিক্ষা ক্যাডারকে বঞ্চিত রাখার একটি প্রশাসনিক কৌশল, তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন গত ২২ অক্টোবর স্বাস্থ্য ক্যাডারের ৫৯৯ জন কর্মকর্তাকে সুপারনিউমেরারি পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। অর্থাৎ, একই রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভেতরে এক ক্যাডারে সংখ্যাতিরিক্ত পদ সৃষ্টি সম্ভব হলেও, শিক্ষা ক্যাডারের ক্ষেত্রে সেটি “অসম্ভব” বলে দেখানো হচ্ছে- যা নিঃসন্দেহে বৈষম্যমূলক এবং নীতিগতভাবে অন্যায্য। এরই মধ্যে মাউশি থেকে গত সেপ্টেম্বরে ৩৫৯২টি সুপারনিউমেরারি পদ সৃষ্টির প্রস্তাবনা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হলেও দুই মাস পেরিয়ে গেলেও সেই ফাইলের কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে না।

বর্তমানে শিক্ষা ক্যাডারের প্রভাষক পর্যায়ে ৩২তম থেকে ৩৭তম পর্যন্ত অন্তত ছয়টি ব্যাচ পদোন্নতিযোগ্য অবস্থায় রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে ব্যাচভিত্তিক পদোন্নতি কার্যক্রম চালু না থাকায় এ ব্যাচগুলোর কর্মকর্তাগণ বছরের পর বছর পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। অন্যদিকে, অন্যান্য ক্যাডারে যেখানে ব্যাচভিত্তিক পদোন্নতির নিয়ম অনুসৃত হয়, সেখানে শিক্ষা ক্যাডারে বিষয়ভিত্তিক পদোন্নতি পদ্ধতি চালু থাকায় এক বিষয়ের জুনিয়র ব্যাচের কর্মকর্তা প্রায়শই অন্য বিষয়ের সিনিয়র ব্যাচের কর্মকর্তার আগেই পদোন্নতি পান। ফলে একদিকে যেমন সিনিয়রদের মনোবল ভেঙে পড়ে, অন্যদিকে তাতে সৃষ্টি হয় একাডেমিক ও প্রশাসনিক জটিলতা। উল্লেখ্য, বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপক পদে ব্যাচভিত্তিক পদোন্নতির ব্যবস্থা চালু করা হলেও অজ্ঞাত কারণে প্রভাষক পর্যায়ে সেই নীতি কার্যকর করা হয়নি। ফলে শিক্ষা ক্যাডারের সবচেয়ে বৃহৎ অংশটি আজও পদোন্নতির অনিশ্চয়তা ও বৈষম্যের বেড়াজালে আবদ্ধ।

শিক্ষা ক্যাডারে পদোন্নতির আরেকটি কার্যকর উপায় হতে পারে রিজার্ভ পদ সৃষ্টি। বিভিন্ন সার্ভিসে সাধারণত মোট পদের প্রায় ১০ শতাংশ অতিরিক্ত পদ রিজার্ভ হিসেবে রাখা হয়- প্রশিক্ষণ, ছুটি, উচ্চশিক্ষা বা লিয়েন ইত্যাদি কারণে সাময়িক শূন্যতা পূরণের লক্ষ্যে। কিন্তু শিক্ষা ক্যাডারের ক্ষেত্রে এ নিয়ম কার্যত উপেক্ষিত। বর্তমানে শিক্ষা ক্যাডারে মোট অনুমোদিত পদ ১৯,০৪৯টি হলেও রিজার্ভ পদ রয়েছে মাত্র ৮১৬টি; অর্থাৎ প্রাপ্যতার চেয়ে আরও ১,০৮৯টি পদ কম। গত আগস্টে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) থেকে এই ১,০৮৯টি রিজার্ভ পদ সৃষ্টির প্রস্তাব পাঠানো হইয়েছে, মাসের পর মাস পেরিয়ে গেলেও সে ফাইল এখনও আলোর মুখ দেখেনি। অথচ পর্যাপ্ত রিজার্ভ পদ থাকলে ২০০৮ সালের মত এবারও প্রভাষকদের রিজার্ভ পদের বিপরীতে পদোন্নতি দিয়ে পদোন্নতি জট কমানো যেত।

বিশ্লেষণে দেখা গেছে, শিক্ষা ক্যাডারের ৩২তম থেকে ৩৪তম ব্যাচের প্রভাষকদের পদোন্নতি প্রদান করলে সরকারের অতিরিক্ত কোনো ব্যয় হবে না। এ ক্ষেত্রে কর্মকর্তাদের ইনসিটু (অর্থাৎ বর্তমান পদ ও কর্মস্থল থেকেই) পদোন্নতি দেওয়া সম্ভব, ফলে পর্যাপ্ত শূন্যপদ না থাকার অজুহাতও অচল হয়ে যায়। এছাড়া আত্মীকৃত শিক্ষকদের মামলার বিষয়টি সামনে আনা হলেও, বাস্তবে মামলার বাদী ৯৯ জন শিক্ষকের জন্য পৃথকভাবে পদ সংরক্ষিত রেখে বাকি যোগ্য কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দেওয়া যেতে পারে। এতে আইনি প্রক্রিয়াও সম্মানিত থাকবে এবং প্রশাসনিক অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হবে না। তদুপরি, ডিপিসি সভা যেন নিয়মিত বিরতিতে অনুষ্ঠিত হয় এবং সভায় গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো দ্রুততম সময়ের মধ্যে বাস্তবায়ন করা হয়- এ বিষয়েও কার্যকর প্রশাসনিক তদারকি জরুরি। কেবল নিয়মিত সভা ও দ্রুত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের মাধ্যমে পদোন্নতি-সংকটের বড় একটি অংশই নিরসন সম্ভব।

শিক্ষা ক্যাডারে পদোন্নতি সমস্যার সবচেয়ে কার্যকর ও স্থায়ী সমাধান হতে পারে নতুন পদ সৃষ্টি। কিন্তু এই প্রক্রিয়া বছরের পর বছর ধরে আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় আটকে আছে। ২০১৭ সাল থেকেই কেন্দ্রীয়ভাবে ১২,৫৮৮টি নতুন পদ সৃষ্টির প্রস্তাব মাউশি, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে ঘুরপাক খেয়ে চলেছে। দীর্ঘ সময় ধরে ফাইল চালাচালির পরও কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়নি। অবশেষে ২০২৩ সালে এসে নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত হয়-কেন্দ্রীয়ভাবে নয়, বরং কলেজভিত্তিকভাবে পদ সৃষ্টি করা হবে। এরই ধারাবাহিকতায় প্রথম দফায় ২০২৪ সালের ১০ নভেম্বর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ১,৪৬১টি নতুন পদ সৃষ্টিতে সম্মতি জানায়। দ্বিতীয় দফায় একই বছরের ১৭ ডিসেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয় ২০টি কলেজে মোট ৩,১১৭টি পদ সৃষ্টির প্রস্তাব পাঠায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে। কিন্তু প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও সেই প্রস্তাবগুলোর চূড়ান্ত অনুমোদন বা প্রজ্ঞাপন এখনও জারি হয়নি। ফলে পদোন্নতি-সংকট নিরসনের সবচেয়ে বাস্তবসম্মত উদ্যোগও থেকে গেছে প্রশাসনিক জটের গহ্বরে।

পদোন্নতি প্রক্রিয়ায় দির্ঘদিনের অচলাবস্থা এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অমনোযোগিতার ফলে বঞ্চিত কর্মকর্তাগণের মধ্যে দিনেদিনে প্রচন্ড হতাশা, অসন্তোষ, ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হয়ে বিস্ফোরণ্মুখ অবস্থা ধারণ করেছে। একইসাথে এদের উল্লেখযোগ্য একটা অংশের মধ্যেই ‘সুবিধাভোগী’ কোনো ক্যাডারে চলে যাওয়ার চেষ্টা ক্রমাগত যেমন বেড়েছে, তেমনই অনিবার্য হয়েও উঠেছে। আমাদের সরকার এবং রাজনীতিবিদগণ এ প্রবণতা রোধে ব্যর্থ হলে রাষ্ট্রের সর্বাধিক মর্যাদাপূর্ণ কর্মকাঠামোর (বিসিএস ক্যাডার সার্ভিসে) অভ্যন্তরে ব্যাপক বিরোধ, বিশৃঙ্খলা এবং ধ্বস প্রত্যক্ষ করতে জাতিকে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হবে না। শিক্ষা ক্যাডারের এই ‘প্রভাশোক’ দূর করা এখন কেবল ব্যক্তিগত হতাশা নিরসন নয়, বরং জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার মেরুদ- রক্ষার জন্য জরুরি। পদোন্নতি সমস্যা নিরসনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন দ্রুত করা হলে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের প্রভাষকদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে, ক্যাডার সার্ভিসের প্রতি মেধাবীদের আকর্ষণ বজায় থাকবে এবং দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা ও ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে।

(মতামত লেখকদের নিজস্ব)

[লেখকদ্বয়: শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তা ও সদস্য, দি অ্যাডভাইজরস: থিংক ট্যাংক অব সিভিল এডুকেশন]

back to top