alt

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

বাংলাদেশেও কি শ্রীলঙ্কার মতো পরিস্থিতি হতে পারে

রেজাউল করিম খোকন

: বৃহস্পতিবার, ১২ মে ২০২২

আমদানি ব্যয় বেশি হওয়ায় ও মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে যাওয়ায় সার্বিকভাবে দেশের অর্থনীতিতে চাপ বেড়েছে। এ অবস্থায় রিজার্ভ বেশি থাকলে, ব্যাংকে তারল্য প্রবাহ পর্যাপ্ত হলে, কাক্সিক্ষত মাত্রায় বিনিয়োগ ও ঋণপ্রবাহ চলমান থাকলে ঝুঁকি মোকাবিলা সহজ হতো। সাম্প্রতিক সময়ে রেমিট্যান্স প্রবাহ কম থাকায় তা দিয়ে আমদানিসহ অন্যান্য ব্যয় মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। বিনিয়োগে মন্দা পরিস্থিতি বিদ্যমান থাকায় দেশের অর্থনীতিতে ঝুঁকি মোকাবিলার সক্ষমতাও কমছে। এদিকে আমদানি ব্যয় মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি পাওয়া এবং রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাওয়ায় বৈদেশিক সম্পদের প্রবৃদ্ধি কমেছে। এ পরিস্থিতিতে বৈদেশিক মুদ্রার অনাকাক্সিক্ষত ব্যয় কমিয়ে আয় বাড়ানোর পদক্ষেপ নিতে হবে। রপ্তানিপণ্য বহুমুখীকরণে জোর দেওয়ার পাশাপাশি ছোট ও মাঝারি শিল্প খাতকে চাঙ্গা করে কর্মসংস্থান বাড়ানোর পদক্ষেপ নিতে হবে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ধরে রাখতে দেশের দরিদ্রপ্রবণ এলাকাগুলোতে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বাড়ানোর পদক্ষেপ নিতে হবে। দীর্ঘমেয়াদে দেশের অর্থনৈতিক সংকট কাটানোর লক্ষ্যে শ্রমনির্ভর রপ্তানি পণ্যের পরিবর্তে মেধানির্ভর রপ্তানিপণ্যে গুরুত্ব বাড়াতে হবে। একইসঙ্গে অর্থনীতিতে ঝুঁকি মোকাবিলায় সক্ষমতা বাড়াতে আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে রপ্তানি বাড়ানোর পদক্ষেপ নিতে হবে।

শ্রীলঙ্কায় অর্থনৈতিক বিপর্যয় দেখা দেওয়ায় এখন তারা সারাবিশ্বে আলোচনার তুঙ্গে। এদিকে শ্রীলঙ্কার বর্তমান পরিস্থিতির মতো বিপর্যয়ে বাংলাদেশও পড়তে পারে বলে কেউ কেউ আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু এখনই সতর্ক হলে এ ধরনের সমস্যা সৃষ্টি নাও হতে পারে। বাংলাদেশের ঋণ ব্যবস্থাপনা খুবই ভালো। তাই অর্থনৈতিক সংকটে পড়ার আশঙ্কা নেই। বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা খুব ভালো। যেটা শ্রীলঙ্কার ছিল না। এজন্যই অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে দেশটি। এছাড়া জিডিপির তুলনায় আমাদের ঋণের অনুপাত সহনীয় মাত্রায় রয়েছে, বাংলাদেশের ভয়ের কোনো কারণ নেই। তাই শ্রীলঙ্কার মতো অর্থনৈতিক সংকটে পড়বে না বাংলাদেশ।

বাংলাদেশ নেওয়া মেগা প্রকল্পগুলোর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। একটিও অপ্রয়োজনীয় নয়। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এসব থেকে রিটার্ন আসবে। ফলে দেশে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান হবে। এতে করে বাড়বে জিডিপিও। বাংলাদেশের আমদানি ব্যয় বাড়ার পরও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখনো প্রায় ৪২ বিলিয়ন ডলার । যা দিয়ে আমরা প্রায় ছয় মাসের আমদানি ব্যয় মেটাতে পারব। অন্যদিকে শ্রীলঙ্কার তা দুই বিলিয়ন ডলারেরও কম। যা দিয়ে এক সপ্তাহের আমদানি ব্যয় মেটানোও সম্ভব নয়। তাই শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা করা চলে না। শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকট বিষয়ে বাংলাদেশ অত্যন্ত সতর্ক।

বাংলাদেশকে প্রতি বছর ঋণ বাবদ পরিশোধ করতে হয় ২ বিলিয়ন ডলার। আর শ্রীলঙ্কাকে করতে হয় ৭ থেকে ৮ বিলিয়ন ডলার। শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ হলো তার জিডিপির ৬১ শতাংশ। আর বাংলাদেশের তা ১৩ শতাংশ। এছাড়া দেশটির মোট ঋণ (ঋণ জিডিপি অনুপাত) ১২০ শতাংশের কাছাকাছি, বাংলাদেশের তা ৪৫ শতাংশ। শ্রীলঙ্কার বেশির ভাগ বৈদেশিক ঋণ কঠিন শর্তে নেওয়া। পক্ষান্তরে সহজ শর্তে এসব ঋণ নিয়েছে বাংলাদেশ।

শ্রীলঙ্কার প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের উৎস হলো পর্যটন খাত। করোনা মাহামারির কারণে গত দুই বছর এই খাতে ব্যাপক ধস নামে। যার আঘাত লাগে সরাসরি রাজস্ব আয়ে। অপরদিকে বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য নেওয়া বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক ঋণের কিস্তি ঠিকই পরিশোধ করতে হয় দেশটিকে। শ্রীলঙ্কায় পর্যটক বাড়াতেই এসব প্রকল্প নেওয়া হয়। এর পাশাপাশি শিল্প উৎপাদনে ধস এবং রফতানি আয় ও রেমিট্যান্স প্রবাহও নিচের দিকে নেমে যায়। তার ওপর কর ও ভ্যাট কমায় দেশটির বর্তমান সরকার। এছাড়াও চাষাবাদে রাসায়নিক সারের ব্যবহার বাদ দিয়ে অর্গানিক খাদ্য উৎপাদনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ফলে সেখানে খাদ্য ঘাটতি দেখা দেয়। এমনকি এর প্রভাবে দেশটিতে চায়ের উৎপাদনও কমে যায়। এসব কারণে শ্রীলঙ্কায় এই অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিয়েছে ।

এদিকে বাংলাদেশের নেওয়া বেশির ভাগ মেগা প্রকল্পগুলো মূলত যোগাযোগ ও জ্বালানি উৎপাদনের জন্য। এর মধ্যে পদ্মাসেতু, কর্তফুলী টানেল, মেট্রো রেল, ঢাকার এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র, রামপাল কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র, মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র, পায়রা সমুদ্রবন্দর ও গভীর সমুদ্রবন্দর অন্যতম। এর মধ্যে পদ্মা সেতু ছাড়া বাকি সবগুলো প্রকল্প বৈদেশিক ঋণে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। তবে ঋণ পরিশোধের বিষয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। বর্তমানে বাংলাদেশের ঋণের হার জিডিপির ৩৮ শতাংশ। গত বছরের জুন পর্যন্ত মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ১১ লাখ ৪৪ হাজার ২৯৭ কোটি টাকা। বৈদেশিক ঋণের এই হার জিডিপির ১৩ শতাংশ।

আইএমএফের মতে বৈদেশিক ঋণের হার ৫৫ শতাংশের বেশি হলেই তা যেকোনো দেশের জন্য সংকট তৈরি করতে পারে। শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নেমে এসেছে ২ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারে। এর বিপরীতে ঋণ পরিশোধ করতে হবে ৪ বিলিয়ন ডলার। তার ওপর খাদ্য ও বিদ্যুৎ সংকট দেখা দিয়েছে। কারণ শ্রীলঙ্কার নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করার মতো অর্থ নেই। তাই শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা করার কিছু নেই।

শ্রীলঙ্কার এই অভিজ্ঞতা থেকে বাংলাদেশ, ভারতসহ অন্য সব দেশ শিক্ষা নিতে পারে। এক্ষেত্রে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির দিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। বাস্তব পরিস্থিতির নিরিখে নীতি প্রণয়ন করতে হবে। মেগা প্রকল্প বা বিনিয়োগগুলো যেন সুশাসনের সঙ্গে নির্ধারিত সময়ে ও সাশ্রয়ীভাবে বাস্তবায়ন করা যায় তা নিশ্চিত করতে হবে। আর যেসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে, সেগুলো থেকে যে আয় আসবে তার প্রাক্কলন এবং সেগুলোর ঋণ পরিশোধের প্রাক্কলনের মধ্যে যেন সামঞ্জস্য থাকে তা নিশ্চিত করতে হবে। একদিনে এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হয় না, ধীরে ধীরে হয়। তাই যেকোনো উন্নয়নশীল দেশকে এ বিষয়ে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। বিশেষ করে যখন আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে, আমদানিকৃত পণ্যের মূল্যস্ফীতি হচ্ছে। সেক্ষেত্রে আমাদের বৈদেশিক বিনিময় হার যেন স্থিতিশীল থাকে। আমদানি যেন সময়মতো করা হয়। একইসঙ্গে আমাদের পণ্য ও বাজার বৈচিত্র্যকরণের দিকে নজর দেওয়াসহ এক্সচেঞ্জ ব্যয় ম্যানেজমেন্ট করা দরকার।

আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আছে। তবে আমরা এখন অনেক প্রকল্প বাস্তায়ন করছি। এসব কর্মসূচি যেন সময় মতো, সাশ্রয়ী ও দুর্নীতিমুক্তভাবে শেষ হয় সে বিষয়ে নজর দিতে হবে। দেশে বাস্তবায়নাধীন মেগা প্রকল্পগুলোর নির্ধারিত সময়ে মধ্যে প্রকল্প শেষ করতে হবে। এরপর এসব প্রকল্প থেকে ঋণ পরিশোধ করা, যাকে অর্থনীতির ভাষায় বলা হয় আইইআর (ইনটার্নাল রেট অব রিটার্ন, ইকোনমিক রেট অব রিটার্ন ও ফিন্যান্সিয়াল রেট অব রিটার্ন)- এগুলো যেন আমাদের ঠিক মতো আসে। শ্রীলঙ্কায় অনেক প্রকল্প সময়মতো শেষ করতে পারেনি। অনেক প্রকল্প দীর্ঘতর হয়েছে। ফলে সেগুলোর আয় দিয়ে ঋণ পরিশোধ করতে পারেনি। আবার অনেক প্রকল্প নেওয়া হয়েছে যেগুলোর দরকার ছিল না। তাই প্রকল্প নেওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার ঠিক করা উচিত। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেকটা ভালো অবস্থানে আছে। তবে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে যাতে সব প্রকল্পের ঋণ পরিষেবার দায়ভার যেন একসঙ্গে না হয়।

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে খরচের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। আগামী দিনগুলোতে আরো নতুন নতুন অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক সংকটে পড়তে পারি আমরা। সেরকম চিন্তা মাথায় রেখে এখন থেকে সাবধানতা অবলম্বন করে অর্থনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। পরিকল্পনার যথাযথ বাস্তবায়ন এবং উন্নয়ন প্রকল্প ব্যয় কোনোভাবেই সীমা অতিক্রম না করে সেদিক খেয়াল রাখতে হবে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণজনিত ক্ষতি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ঝুঁকি মোকাবিলার সক্ষমতা কমছে। করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে অর্থনীতিতে ঝুঁকির মাত্রা বেড়েছে। বিশেষ করে আমদানি ও কর্মসংস্থানজনিত ঝুঁকিই বেশি। এর মধ্যে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমায় আমদানি ব্যয় মেটানোর সক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। মাঝখানে রেমিট্যান্স কমায় রিজার্ভ বাড়ার গতি থেমে গিয়েছিল।

আমদানি ব্যয় মেটাতে ব্যাংকগুলোতে ডলারের সংকট হওয়ায় এর দাম বেড়ে টাকার মান কমে যাচ্ছে। ফলে কমছে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা। ব্যাংকগুলোতে আমানত প্রবাহ কমা এবং ঋণপ্রবাহ বাড়ায় তারল্য ব্যবস্থাপনায় ভারসাম্যহীনতা দেখা দিয়েছে। ব্যাংকগুলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বাড়তি তারল্যের জোগান দিতে গিয়ে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে যাচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে বাজারে। এসব মিলে অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকগুলোর অবস্থান আগের চেয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছে। এখন আমদানি ব্যয় বেশি হওয়ায় ও মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে যাওয়ায় সার্বিকভাবে অর্থনীতিতে চাপ বেড়েছে। এ অবস্থায় রিজার্ভ বেশি থাকলে, ব্যাংকে তারল্যপ্রবাহ পর্যাপ্ত হলে, বিনিয়োগ ও ঋণপ্রবাহ বাড়লে ঝুঁকি মোকাবিলা সহজ হতো; কিন্তু এগুলো হচ্ছে না। এখন বৈদেশিক মুদ্রার অনাকাক্সিক্ষত ব্যয় কমিয়ে আয় বাড়ানোর পদক্ষেপ নিতে হবে। ব্যাংকে সঞ্চয় বাড়িয়ে তারল্য বৃদ্ধি করতে হবে। ছোট ও মাঝারি শিল্প খাতকে চাঙ্গা করে কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ধরে রাখতে দরিদ্রপ্রবণ এলাকাগুলোতে অর্থের প্রবাহ বাড়াতে হবে।

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]

প্রভাষকের ‘প্রভা’ যখন ‘শোক’: শিক্ষা ক্যাডারে পদোন্নতি বঞ্চনা

যুদ্ধ বিরতি গাজাবাসীর জন্য জরুরি ছিল

লবলং খালের মৃত্যু: স্মৃতিতে নদী, বাস্তবে দূষণ

বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা: অর্থনৈতিক স্থিতির পূর্বশর্ত

হায় যম! আর কতক্ষণ, হবে অপেক্ষা করিতে মোরে?

পোশাক শিল্প : অগ্রগতি ও শ্রমিকের অধিকার

গণভোটের রাজনৈতিক গুরুত্ব

বামঘরানার বাটখারা...

বাগদা ফার্ম : স্মারকলিপি, অবরোধ, অনশন, আন্দোলন- কিছুতেই বরফ গলেনি

ব্যাটারি-শকট: নতুন সংকট

মতপ্রকাশ কিংবা দ্বিমত পোষণ: নাগরিক অধিকার ও রাজনৈতিক বাস্তবতা

সরকারি কর্মচারীদের জন্য নতুন ব্যাংক কি আদৌ প্রয়োজন

ট্রাম্প ও শি’র ‘কৌশলগত শান্তি’

আশার সমাজতত্ত্ব: বিভ্রান্তির যুগে ভবিষ্যৎ নির্মাণের বিপ্লবী বিজ্ঞান

পিএইচডি: উচ্চ শিক্ষার মানদণ্ড না প্রতীকী মরীচিকা?

ডিম নয় তবু অশ্বডিম্ব!

ছবি

অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও নির্বাচন

পিএইচডি: উচ্চ শিক্ষার মানদণ্ড না প্রতীকী মরীচিকা?

প্রকৃতার্থে ফকির কারা

এনসিপি চায় অবিনাশী জুলাই সনদ

পিএইচডি: উচ্চ শিক্ষার মানদণ্ড না প্রতীকী মরীচিকা?

আলুর প্রাচুর্যে কৃষকের সংকট

তাহলে কী ‘কোটা’ই জয়যুক্ত হবে!

ব্যাংকিং খাতে বিষফোঁড়া: বাংলাদেশের অর্থনীতির ধমনী বিষাক্ত হয়ে উঠছে

ছবি

ঢাকার নদী ও খালের দখল-দূষণ: পুনরুদ্ধার কোন পথে

জমি কী মূলে রেকর্ড হয়েছে, দলিল মূলে না উত্তরাধিকার মূলে?

কার্বন-নিরপেক্ষ শিশুর অনুপ্রেরণায় দেশ

এবার আমরা সভ্য হলাম!

সোনার প্রাসাদের দেয়ালে ঘামের দাগ

নিরাপদ সড়ক চাই কিন্তু কার্যকর উদ্যোগ কোথায়?

অবহেলিত শিক্ষার দুর্দশা বাড়ছে

টেকসই উন্নয়নের পূর্বশর্ত নিরাপদ সড়ক

বাংলার সংস্কৃতি কি মূলধারা হারিয়ে ফেলবে?

ছবি

সমদৃষ্টি, বহুত্ববাদী সমাজ এবং সহিষ্ণুতা

খাদ্য অপচয় : ক্ষুধার্ত পৃথিবীর এক নিঃশব্দ ট্র্যাজেডি

টেকসই বাংলাদেশ গঠনে পরিবেশ সংস্কার কেন অপরিহার্য

tab

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

বাংলাদেশেও কি শ্রীলঙ্কার মতো পরিস্থিতি হতে পারে

রেজাউল করিম খোকন

বৃহস্পতিবার, ১২ মে ২০২২

আমদানি ব্যয় বেশি হওয়ায় ও মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে যাওয়ায় সার্বিকভাবে দেশের অর্থনীতিতে চাপ বেড়েছে। এ অবস্থায় রিজার্ভ বেশি থাকলে, ব্যাংকে তারল্য প্রবাহ পর্যাপ্ত হলে, কাক্সিক্ষত মাত্রায় বিনিয়োগ ও ঋণপ্রবাহ চলমান থাকলে ঝুঁকি মোকাবিলা সহজ হতো। সাম্প্রতিক সময়ে রেমিট্যান্স প্রবাহ কম থাকায় তা দিয়ে আমদানিসহ অন্যান্য ব্যয় মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। বিনিয়োগে মন্দা পরিস্থিতি বিদ্যমান থাকায় দেশের অর্থনীতিতে ঝুঁকি মোকাবিলার সক্ষমতাও কমছে। এদিকে আমদানি ব্যয় মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি পাওয়া এবং রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাওয়ায় বৈদেশিক সম্পদের প্রবৃদ্ধি কমেছে। এ পরিস্থিতিতে বৈদেশিক মুদ্রার অনাকাক্সিক্ষত ব্যয় কমিয়ে আয় বাড়ানোর পদক্ষেপ নিতে হবে। রপ্তানিপণ্য বহুমুখীকরণে জোর দেওয়ার পাশাপাশি ছোট ও মাঝারি শিল্প খাতকে চাঙ্গা করে কর্মসংস্থান বাড়ানোর পদক্ষেপ নিতে হবে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ধরে রাখতে দেশের দরিদ্রপ্রবণ এলাকাগুলোতে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বাড়ানোর পদক্ষেপ নিতে হবে। দীর্ঘমেয়াদে দেশের অর্থনৈতিক সংকট কাটানোর লক্ষ্যে শ্রমনির্ভর রপ্তানি পণ্যের পরিবর্তে মেধানির্ভর রপ্তানিপণ্যে গুরুত্ব বাড়াতে হবে। একইসঙ্গে অর্থনীতিতে ঝুঁকি মোকাবিলায় সক্ষমতা বাড়াতে আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে রপ্তানি বাড়ানোর পদক্ষেপ নিতে হবে।

শ্রীলঙ্কায় অর্থনৈতিক বিপর্যয় দেখা দেওয়ায় এখন তারা সারাবিশ্বে আলোচনার তুঙ্গে। এদিকে শ্রীলঙ্কার বর্তমান পরিস্থিতির মতো বিপর্যয়ে বাংলাদেশও পড়তে পারে বলে কেউ কেউ আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু এখনই সতর্ক হলে এ ধরনের সমস্যা সৃষ্টি নাও হতে পারে। বাংলাদেশের ঋণ ব্যবস্থাপনা খুবই ভালো। তাই অর্থনৈতিক সংকটে পড়ার আশঙ্কা নেই। বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা খুব ভালো। যেটা শ্রীলঙ্কার ছিল না। এজন্যই অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে দেশটি। এছাড়া জিডিপির তুলনায় আমাদের ঋণের অনুপাত সহনীয় মাত্রায় রয়েছে, বাংলাদেশের ভয়ের কোনো কারণ নেই। তাই শ্রীলঙ্কার মতো অর্থনৈতিক সংকটে পড়বে না বাংলাদেশ।

বাংলাদেশ নেওয়া মেগা প্রকল্পগুলোর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। একটিও অপ্রয়োজনীয় নয়। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এসব থেকে রিটার্ন আসবে। ফলে দেশে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান হবে। এতে করে বাড়বে জিডিপিও। বাংলাদেশের আমদানি ব্যয় বাড়ার পরও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখনো প্রায় ৪২ বিলিয়ন ডলার । যা দিয়ে আমরা প্রায় ছয় মাসের আমদানি ব্যয় মেটাতে পারব। অন্যদিকে শ্রীলঙ্কার তা দুই বিলিয়ন ডলারেরও কম। যা দিয়ে এক সপ্তাহের আমদানি ব্যয় মেটানোও সম্ভব নয়। তাই শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা করা চলে না। শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকট বিষয়ে বাংলাদেশ অত্যন্ত সতর্ক।

বাংলাদেশকে প্রতি বছর ঋণ বাবদ পরিশোধ করতে হয় ২ বিলিয়ন ডলার। আর শ্রীলঙ্কাকে করতে হয় ৭ থেকে ৮ বিলিয়ন ডলার। শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ হলো তার জিডিপির ৬১ শতাংশ। আর বাংলাদেশের তা ১৩ শতাংশ। এছাড়া দেশটির মোট ঋণ (ঋণ জিডিপি অনুপাত) ১২০ শতাংশের কাছাকাছি, বাংলাদেশের তা ৪৫ শতাংশ। শ্রীলঙ্কার বেশির ভাগ বৈদেশিক ঋণ কঠিন শর্তে নেওয়া। পক্ষান্তরে সহজ শর্তে এসব ঋণ নিয়েছে বাংলাদেশ।

শ্রীলঙ্কার প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের উৎস হলো পর্যটন খাত। করোনা মাহামারির কারণে গত দুই বছর এই খাতে ব্যাপক ধস নামে। যার আঘাত লাগে সরাসরি রাজস্ব আয়ে। অপরদিকে বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য নেওয়া বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক ঋণের কিস্তি ঠিকই পরিশোধ করতে হয় দেশটিকে। শ্রীলঙ্কায় পর্যটক বাড়াতেই এসব প্রকল্প নেওয়া হয়। এর পাশাপাশি শিল্প উৎপাদনে ধস এবং রফতানি আয় ও রেমিট্যান্স প্রবাহও নিচের দিকে নেমে যায়। তার ওপর কর ও ভ্যাট কমায় দেশটির বর্তমান সরকার। এছাড়াও চাষাবাদে রাসায়নিক সারের ব্যবহার বাদ দিয়ে অর্গানিক খাদ্য উৎপাদনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ফলে সেখানে খাদ্য ঘাটতি দেখা দেয়। এমনকি এর প্রভাবে দেশটিতে চায়ের উৎপাদনও কমে যায়। এসব কারণে শ্রীলঙ্কায় এই অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিয়েছে ।

এদিকে বাংলাদেশের নেওয়া বেশির ভাগ মেগা প্রকল্পগুলো মূলত যোগাযোগ ও জ্বালানি উৎপাদনের জন্য। এর মধ্যে পদ্মাসেতু, কর্তফুলী টানেল, মেট্রো রেল, ঢাকার এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র, রামপাল কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র, মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র, পায়রা সমুদ্রবন্দর ও গভীর সমুদ্রবন্দর অন্যতম। এর মধ্যে পদ্মা সেতু ছাড়া বাকি সবগুলো প্রকল্প বৈদেশিক ঋণে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। তবে ঋণ পরিশোধের বিষয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। বর্তমানে বাংলাদেশের ঋণের হার জিডিপির ৩৮ শতাংশ। গত বছরের জুন পর্যন্ত মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ১১ লাখ ৪৪ হাজার ২৯৭ কোটি টাকা। বৈদেশিক ঋণের এই হার জিডিপির ১৩ শতাংশ।

আইএমএফের মতে বৈদেশিক ঋণের হার ৫৫ শতাংশের বেশি হলেই তা যেকোনো দেশের জন্য সংকট তৈরি করতে পারে। শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নেমে এসেছে ২ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারে। এর বিপরীতে ঋণ পরিশোধ করতে হবে ৪ বিলিয়ন ডলার। তার ওপর খাদ্য ও বিদ্যুৎ সংকট দেখা দিয়েছে। কারণ শ্রীলঙ্কার নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করার মতো অর্থ নেই। তাই শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা করার কিছু নেই।

শ্রীলঙ্কার এই অভিজ্ঞতা থেকে বাংলাদেশ, ভারতসহ অন্য সব দেশ শিক্ষা নিতে পারে। এক্ষেত্রে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির দিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। বাস্তব পরিস্থিতির নিরিখে নীতি প্রণয়ন করতে হবে। মেগা প্রকল্প বা বিনিয়োগগুলো যেন সুশাসনের সঙ্গে নির্ধারিত সময়ে ও সাশ্রয়ীভাবে বাস্তবায়ন করা যায় তা নিশ্চিত করতে হবে। আর যেসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে, সেগুলো থেকে যে আয় আসবে তার প্রাক্কলন এবং সেগুলোর ঋণ পরিশোধের প্রাক্কলনের মধ্যে যেন সামঞ্জস্য থাকে তা নিশ্চিত করতে হবে। একদিনে এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হয় না, ধীরে ধীরে হয়। তাই যেকোনো উন্নয়নশীল দেশকে এ বিষয়ে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। বিশেষ করে যখন আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে, আমদানিকৃত পণ্যের মূল্যস্ফীতি হচ্ছে। সেক্ষেত্রে আমাদের বৈদেশিক বিনিময় হার যেন স্থিতিশীল থাকে। আমদানি যেন সময়মতো করা হয়। একইসঙ্গে আমাদের পণ্য ও বাজার বৈচিত্র্যকরণের দিকে নজর দেওয়াসহ এক্সচেঞ্জ ব্যয় ম্যানেজমেন্ট করা দরকার।

আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আছে। তবে আমরা এখন অনেক প্রকল্প বাস্তায়ন করছি। এসব কর্মসূচি যেন সময় মতো, সাশ্রয়ী ও দুর্নীতিমুক্তভাবে শেষ হয় সে বিষয়ে নজর দিতে হবে। দেশে বাস্তবায়নাধীন মেগা প্রকল্পগুলোর নির্ধারিত সময়ে মধ্যে প্রকল্প শেষ করতে হবে। এরপর এসব প্রকল্প থেকে ঋণ পরিশোধ করা, যাকে অর্থনীতির ভাষায় বলা হয় আইইআর (ইনটার্নাল রেট অব রিটার্ন, ইকোনমিক রেট অব রিটার্ন ও ফিন্যান্সিয়াল রেট অব রিটার্ন)- এগুলো যেন আমাদের ঠিক মতো আসে। শ্রীলঙ্কায় অনেক প্রকল্প সময়মতো শেষ করতে পারেনি। অনেক প্রকল্প দীর্ঘতর হয়েছে। ফলে সেগুলোর আয় দিয়ে ঋণ পরিশোধ করতে পারেনি। আবার অনেক প্রকল্প নেওয়া হয়েছে যেগুলোর দরকার ছিল না। তাই প্রকল্প নেওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার ঠিক করা উচিত। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেকটা ভালো অবস্থানে আছে। তবে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে যাতে সব প্রকল্পের ঋণ পরিষেবার দায়ভার যেন একসঙ্গে না হয়।

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে খরচের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। আগামী দিনগুলোতে আরো নতুন নতুন অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক সংকটে পড়তে পারি আমরা। সেরকম চিন্তা মাথায় রেখে এখন থেকে সাবধানতা অবলম্বন করে অর্থনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। পরিকল্পনার যথাযথ বাস্তবায়ন এবং উন্নয়ন প্রকল্প ব্যয় কোনোভাবেই সীমা অতিক্রম না করে সেদিক খেয়াল রাখতে হবে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণজনিত ক্ষতি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ঝুঁকি মোকাবিলার সক্ষমতা কমছে। করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে অর্থনীতিতে ঝুঁকির মাত্রা বেড়েছে। বিশেষ করে আমদানি ও কর্মসংস্থানজনিত ঝুঁকিই বেশি। এর মধ্যে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমায় আমদানি ব্যয় মেটানোর সক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। মাঝখানে রেমিট্যান্স কমায় রিজার্ভ বাড়ার গতি থেমে গিয়েছিল।

আমদানি ব্যয় মেটাতে ব্যাংকগুলোতে ডলারের সংকট হওয়ায় এর দাম বেড়ে টাকার মান কমে যাচ্ছে। ফলে কমছে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা। ব্যাংকগুলোতে আমানত প্রবাহ কমা এবং ঋণপ্রবাহ বাড়ায় তারল্য ব্যবস্থাপনায় ভারসাম্যহীনতা দেখা দিয়েছে। ব্যাংকগুলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বাড়তি তারল্যের জোগান দিতে গিয়ে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে যাচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে বাজারে। এসব মিলে অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকগুলোর অবস্থান আগের চেয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছে। এখন আমদানি ব্যয় বেশি হওয়ায় ও মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে যাওয়ায় সার্বিকভাবে অর্থনীতিতে চাপ বেড়েছে। এ অবস্থায় রিজার্ভ বেশি থাকলে, ব্যাংকে তারল্যপ্রবাহ পর্যাপ্ত হলে, বিনিয়োগ ও ঋণপ্রবাহ বাড়লে ঝুঁকি মোকাবিলা সহজ হতো; কিন্তু এগুলো হচ্ছে না। এখন বৈদেশিক মুদ্রার অনাকাক্সিক্ষত ব্যয় কমিয়ে আয় বাড়ানোর পদক্ষেপ নিতে হবে। ব্যাংকে সঞ্চয় বাড়িয়ে তারল্য বৃদ্ধি করতে হবে। ছোট ও মাঝারি শিল্প খাতকে চাঙ্গা করে কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ধরে রাখতে দরিদ্রপ্রবণ এলাকাগুলোতে অর্থের প্রবাহ বাড়াতে হবে।

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]

back to top