alt

উপ-সম্পাদকীয়

ছয় দফা : স্বাধীনতা অভিমুখে চলার মহাসড়ক

শেখর ভট্টাচার্য

: মঙ্গলবার, ০৬ জুন ২০২৩
image

বঙ্গবন্ধু তার রাজনৈতিক জীবনে কোন সময়ই অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি। তিনি যখনই নায্য দাবিনামা আদায়ে শাসক কিংবা শাসকদের বশংবদদের কাছ থেকে প্রত্যখাত হয়েছেন তখনি তিনি ছুটে গেছেন জনগণের কাছে এর বিচারের জন্য। বঙ্গবন্ধুর কাছে সবচেয়ে মূল্যবান ছিল জনমত। তিনি যে কোন কর্মসূচি প্রণয়ন করেই, জনমত যাচাইয়ের জন্য ছুটতেন জনগণের কাছে। বায়ান্ন সালের ভাষা আন্দোলনের বার্তা ছিল তার কাছে স্ফটিক স্বচ্ছ।

ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে মুক্তি পেয়ে বাঙালি আবার যে নব্য পাকিস্তান উপনিবেশের ফাঁদে পাড়া দিয়েছে বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে সে বার্তাটি পেয়ে তিনি ধীরে ধীরে স্বাধিকার আন্দোলনের দিকে এগোতে থাকেন। স্বাধিকার আন্দোলনের পথ পরিক্রমায় বঙ্গবন্ধু ১৯৬৬-র ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে সম্মিলিত বিরোধী দলগুলোর এক কনভেনশনে ‘ছয় দফা’ দাবি উত্থাপন করেন। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন, ছয় দফার আন্দোলন সূচনার আগে এর একটি পূর্ব প্রতিক্রিয়া যাচাই করতে। এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে ছয় দফাকে তিনি কনভেনশনের বিষয়সূচিতে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করেন। কিন্তু সভাপতি চৌধুরী মোহাম্মদ আলী ছয় দফা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনায় অস্বীকৃতি জানান। বঙ্গবন্ধুর উদ্দেশ্য সফল হলো এবং তিনি বুঝতে পারলেন স্বাধিকারের দাবি নিয়ে শুধুমাত্র বাঙালি জনগণই তার সঙ্গী হবে, ঔপনিবেশিক শক্তির সহদোরেরা তাকে কোন অবস্থাতেই সহযোগিতা প্রদান করবে না।

কনভেনশনে যখন ছয় দফা দাবি উত্থাপনে ব্যর্থ হলেন বঙ্গবন্ধু তখন কনভেনশন বর্জন করে বেরিয়ে এসে ছয় দফার বিষয়ে তার দল এবং বাঙালি জাতি কতটুকু আপোসহীন এ’ বার্তাটি শাসকদের দিতে চেষ্টা করেন। ১১ ফেব্রুয়ারি লাহোর থেকে দেশে ফিরে ঢাকা বিমানবন্দরে সংবাদ সম্মেলনে ছয় দফার বিস্তারিত তুলে ধরেন বঙ্গবন্ধু। ২০ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটি ছয় দফাকে দলীয় কর্মসূচি হিসেবে গ্রহণ করে।

এই যে বললাম বাংলার জনগণই ছিল বঙ্গবন্ধুর শেষ ভরসা স্থল। সম্মিলিত বিরোধীদলের অধিবেশনে বাঙালির প্রাণের দাবিকে উপেক্ষা করা হলে তিনি ছয় দফার পক্ষে জনমত সংগঠিত করতে দেশব্যাপী একের পর এক জনসভা করতে থাকেন। কারণ জনগণের নেতার কাছে জনমতই হলো সর্বোচ্চ সমর্থন।

দলবল নিয়ে বঙ্গবন্ধু প্রথমেই যান চট্টগ্রামে। ১৯৬৬-র ২৫ ফেব্রুয়ারির লালদীঘি ময়দানে এক জনসভায় ছয় দফাকে ‘নূতন দিগন্তের নূতন মুক্তিসনদ’ অভিহিত করে চট্টগ্রামবাসীর উদ্দেশে বলেন, ‘একদিন ব্রিটিশ সরকারের জবরদস্তি শাসনব্যবস্থাকে উপেক্ষা করে এই চট্টগ্রামের জালালাবাদ পাহাড়েই বীর চট্টলার বীর সন্তানরা স্বাধীনতার পতাকা উড্ডীন করেছিলেন। আমি চাই যে পূর্ব পাকিস্তানের বঞ্চিত মানুষের জন্য দাবি আদায়ের সংগ্রামী পতাকাও চট্টগ্রামবাসী চট্টগ্রামেই প্রথম উড্ডীন করবেন।’ চট্টগ্রামের জনসভার পর ২৭ ফেব্রুয়ারি নোয়াখালীর মাইজদী ও বেগমগঞ্জ, ১০ মার্চ ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা, ১১ মার্চ ময়মনসিংহ সদর এবং ১৪ মার্চ সিলেটে জনতার দরবারে বঙ্গবন্ধু তার ছয় দফা পেশ করেন।

ছয় দফা প্রচার ও প্রকাশের জন্য বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে গঠিত হয় ছয় সদস্যের এক উপকমিটি। স্বনামে ‘আমাদের বাঁচার দাবি : ছয় দফা কর্মসূচি’ শীর্ষক একটি পুস্তিকাও প্রকাশ করা হয়। ১৮, ১৯ ও ২০ মার্চ আওয়ামী লীগের কাউন্সিল সভায় পুস্তিকাটি বিলি করা হয়। উদ্বোধনী অধিবেশনে গাওয়া হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা’। ছয় দফাকে উপলক্ষ করে সেই কাউন্সিল অধিবেশনটি ছিল বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।

পাঠক উপলব্ধি করার চেষ্টা করুন বঙ্গবন্ধু তার লক্ষ্যে কতটুকু অবিচল ছিলেন। গণতন্ত্রের মূলনীতিকে তিনি কতটুকু শ্রদ্ধা করতেন। ছয় দফা উত্থাপনের জন্য তিনি সম্মিলিত বিরোধী দল, নিজ দল এবং বাংলার সবশ্রেণীর মানুষের কাছ থেকে ম্যান্ডেট নিতে চেয়েছিলেন। জনসংযোগের অংশ হিসেবে ১৭ এপ্রিল ভোর ৪টায় খুলনায় এক জনসভা শেষে ঢাকা ফেরার পথে রমনা থানার ওয়ারেন্টে পাকিস্তান দেশরক্ষা আইনের ৪৭(৫) ধারা বলে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। যশোর মহকুমা হাকিমের এজলাস থেকে তিনি জামিন পান। সেদিনই রাত ৯টায় সিলেটে গ্রেপ্তার, পুনরায় জামিনের আবেদন এবং ২৩ তারিখে জামিন লাভ করেন। ২৪ এপ্রিল ময়মনসিংহে গ্রেপ্তার, ২৫ এপ্রিল জামিন। ছয় দফা প্রচারকালে তিন মাসে আটবার গ্রেপ্তার হন বঙ্গবন্ধু।

এভাবেই স্বৈরাচারী আইয়ুবের দমননীতি চলতে থাকে। ৮ মে নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়ায় মে দিবস স্মরণে শ্রমিক জনতার এক সমাবেশে বঙ্গবন্ধুকে বিপুল সংবর্ধনা এবং পাটের মালায় ভূষিত করে শ্রমিকরা। ভাষণ শেষে রাত ১টায় বাসায় ফেরার পথে পাকিস্তান দেশরক্ষা আইনের ৩২(১) ‘ক’ধারায় ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহকর্মীসহ বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয়। ছয় দফা দেয়াকে অপরাধ গণ্য করে বঙ্গবন্ধুকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ অভিহিত করে স্বৈরশাসক আইয়ুব বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের ওপর অব্যাহত গ্রেপ্তার-নির্যাতন চালাতে থাকেন। সামরিক সরকারের এসব কার্যকলাপের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের আহ্বানে ১৩ মে সমগ্র প্রদেশে ‘প্রতিবাদ দিবস’ পালিত হয়।

প্রতিবাদ দিবসের জনসভায় ছয় দফার প্রতি গণমানুষের বিপুল সমর্থন প্রকাশ পায়। হাজার হাজার শ্রমিক এদিন স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল করে। পল্টনের জনসভায় উপস্থিত হয়ে সরকারের দমননীতির প্রতিবাদ করে। দলের নবনির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদকে গ্রেপ্তার করা হলে সাংগঠনিক সম্পাদক মিজান চৌধুরী অস্থায়ী সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। নেতাদের গ্রেপ্তার- নির্যাতনের বিরুদ্ধে ২০ মে আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটি ৭ জুন সর্বব্যাপী হরতাল আহ্বান করে। ৭ জুনের হরতালের বিষয়ে আমরা সংক্ষিপ্ত কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ বর্ণনা পাই বঙ্গবন্ধুর ‘কারাগারের রোজনামচায়’।

পাঠক সংক্ষিপ্ত বর্ণনাটি পাঠ করলে আমরা কিছুটা উপলব্ধি করতে পারব ৭ জুন ১৯৬৬ সালে কী ঘটেছিল। ৭ জুন হরতাল সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ডায়েরিতে লিখেছেন, ‘১২টার পরে খবর পাকাপাকি পাওয়া গেল যে, হরতাল হয়েছে। জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতাল পালন করেছে। তারা ছয় দফা সমর্থন করে আর মুক্তি চায়। বাঁচতে চায়, খেতে চায়, ব্যক্তিস্বাধীনতা চায়, শ্রমিকের ন্যায্য দাবি, কৃষকদের বাঁচার দাবি তারা চায়, এর প্রমাণ এই হরতালের মধ্যে হয়েই গেল।’ (কারাগারের রোজনামচা, পৃ: ৬৯)

এ কারণে ছয় দফা কর্মসূচিকে বাঙালি জাতির মুক্তির মহাসনদই বলা যায়। এ আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালি জাতি পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর শোষণ ও অবিচারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়। ইতোপূর্বের ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, সংবিধান প্রবর্তন বা সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন পূর্বপাকিস্তানের বিশেষ শ্রেণী তথা শিক্ষিত, সচেতন ও প্রগতিশীল লোকদের মধ্যেই কেবল সীমাবদ্ধ ছিল। এগুলোতে ছাত্রসমাজের ভূমিকাই ছিল মুখ্য। আর গোড়া থেকেই সর্বস্তর ও পেশার মানুষের মুক্তির আন্দোলন হিসেবে ছয় দফা কর্মসূচি সাধারণভাবে গৃহীত হয়েছিল।

বঙ্গবন্ধু এতে সরাসরি নেতৃত্ব প্রদান করেন, এর প্রচারণায় অংশ নেন এবং একে সুসংগঠিত করেন। তার নির্দেশনায় ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়নের পাশাপাশি প্রথমবারের মতো শ্রমিক সংগঠনসমূহ আন্দোলনমুখী হয়। এ কর্মসূচি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে জাতীয় অবিসাংবাদিত নেতায় পরিণত করে। তার নির্দেশনায় ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়নের পাশাপাশি প্রথমবারের মতো শ্রমিক সংগঠনসমূহ আন্দোলনমুখী হয়। এতে পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা প্রশ্নাতীত হয়ে ওঠে। যে কারণে ছয় দফা কর্মসূচির আন্দোলনের সময় শীর্ষ ও মাঝারি সারির প্রায় সব আওয়ামী লীগ নেতা বন্দী হলেও এর আন্দোলন সাধারণ মানুষই অব্যাহত রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন।

ছয় দফা বাঙালিকে এক স্বতন্ত্র আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে চিনতে ও জানতে শিখিয়েছে। ছয় দফার ওপর ভিত্তি করেই আন্দোলন, নির্বাচন ও স্বাধীনতা যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা লাভ করে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ সম্ভব হয়েছে ছয় দফার জন্যই। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানে পাকবাহিনীর নির্বিচার হত্যাযজ্ঞের ফলে একদিকে ছয় দফা কর্মসূচির পরিসমাপ্তি ঘটে এবং নয় মাস মুক্তিযুদ্ধের পর অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের। আর তাই ৬ দফা-ই আজ বাঙালি জাতির ‘ম্যাগনাকার্টা’ হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত।

ছয় দফার তাৎপর্যকে যথার্থভাবে উপস্থাপন করেছেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর তোফায়েল আহমেদ ‘বাঙালির ম্যাগনাকার্টা শীর্ষক তার একটি নিবন্ধে। তিনি এই নিবন্ধে উল্লেখ করেন ‘বঙ্গবন্ধুর কাছে ছয় দফা ছিল একটা সাঁকো, যাতে চেপে স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতায় উন্নীত হওয়া যায়। ছয় দফা না দিলে বঙ্গবন্ধুর ওপর আইয়ুব সরকারের নির্যাতন নেমে আসত না, আগরতলা মামলায়ও তাকে জড়াত না, আর ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানও হতো না, সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ম্যান্ডেটও হয়তো ও রকম হতো না, পরিণতিতে যা এক দফা তথা স্বাধীনতার পথ সুগম করে। ‘ছয় দফা ছিল পাকিস্তানের কফিনে বাঙালির দেয়া শেষ পেরেক। ছয় দফা আন্দোলন আমাদের শিক্ষা দেয় জনগণকেন্দ্রিক আন্দোলনে, জনগণের সহায়তা লাভ করলে, আন্দোলন কোনভাবেই ব্যর্থ হয়ে যায় না। আমরা ছয় দফা আন্দোলনের সাতান্ন বছর পর এই শিক্ষার কথাটি কী মনে রেখেছি?

[লেখক: প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের চ্যালেঞ্জ

ধর্মভিত্তিক জোট কোন পথে

ছবি

বিদায় অগ্নিকন্যা

রিমান্ড সংস্কৃতি : আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে একটি মানবাধিকার পরিপ্রেক্ষিত

ছবি

ডেঙ্গুজ্বর : সচেতনতার বিকল্প নেই

ছবি

উন্নয়ন ও পরিবেশের মধ্যে ভারসাম্য রাখা কেন জরুরি

ছবি

মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ ম-ল

নদীর প্রাণ শুশুক, নিরাপদে বেঁচে থাকুক

ভবন নির্মাণ ও বিল্ডিং কোড

রম্যগদ্য : গণতন্ত্রের গলিতে গলিতে হিটলার

রাষ্ট্র সংস্কার ও আদিবাসী

রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ ইস্যুতে সংবিধান ও অতীত-ইতিহাস

শিক্ষাকে দলীয় রাজনীতির প্রভাবমুক্ত করার উপায়

দিবস যায় দিবস আসে, নিরাপদ হয় না সড়ক

‘ক্ষুদ্রতার মন্দিরেতে বসায়ে আপনারে আপন পায়ে না দিই যেন অর্ঘ্য ভারে ভারে’

একাকিত্ব : নিজেকে আবিষ্কার ও সৃজনশীলতা বিকাশের পথ

লাগামহীন দ্রব্যমূল্য

বাঁশের বংশবৃদ্ধিতে অন্তরায় বাঁশকরুল সংগ্রহ

একতার অভাবে ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত

অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ঝরে পড়া রোধে করণীয়

শিক্ষা খাতে দলীয় রাজনীতির নেতিবাচক প্রভাব

কোন পথে জামায়াতের রাজনীতি?

শ্রমিকের উন্নয়ন ছাড়া গণপরিবহনে শৃঙ্খলা আনা সম্ভব নয়

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় নবায়নযোগ্য জ্বালানির ভূমিকা

ডিমের জারিজুরি

যোগ্য নেতৃত্ব সমাজ-সংগঠনকে এগিয়ে নেয়

ব্যক্তি স্বাধীনতার সংকট

কিল মারার গোঁসাই

ছবি

শেকড়ের সন্ধানে সাঁইজির ধামে

বৈষম্যের অন্ধকারে নিমজ্জিত প্রকৌশল শিক্ষার আরেক জগৎ

প্রশাসনিক সংস্কারে সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা কতটা প্রতিষ্ঠা পাবে?

বাংলার মৃৎশিল্প

প্রবারণা পূর্ণিমার আলোয় আলোকিত হোক মানবজাতি

খেলাপি ঋণের অপসংস্কৃতি

কথার কথা যত কথা

tab

উপ-সম্পাদকীয়

ছয় দফা : স্বাধীনতা অভিমুখে চলার মহাসড়ক

শেখর ভট্টাচার্য

image

মঙ্গলবার, ০৬ জুন ২০২৩

বঙ্গবন্ধু তার রাজনৈতিক জীবনে কোন সময়ই অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি। তিনি যখনই নায্য দাবিনামা আদায়ে শাসক কিংবা শাসকদের বশংবদদের কাছ থেকে প্রত্যখাত হয়েছেন তখনি তিনি ছুটে গেছেন জনগণের কাছে এর বিচারের জন্য। বঙ্গবন্ধুর কাছে সবচেয়ে মূল্যবান ছিল জনমত। তিনি যে কোন কর্মসূচি প্রণয়ন করেই, জনমত যাচাইয়ের জন্য ছুটতেন জনগণের কাছে। বায়ান্ন সালের ভাষা আন্দোলনের বার্তা ছিল তার কাছে স্ফটিক স্বচ্ছ।

ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে মুক্তি পেয়ে বাঙালি আবার যে নব্য পাকিস্তান উপনিবেশের ফাঁদে পাড়া দিয়েছে বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে সে বার্তাটি পেয়ে তিনি ধীরে ধীরে স্বাধিকার আন্দোলনের দিকে এগোতে থাকেন। স্বাধিকার আন্দোলনের পথ পরিক্রমায় বঙ্গবন্ধু ১৯৬৬-র ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে সম্মিলিত বিরোধী দলগুলোর এক কনভেনশনে ‘ছয় দফা’ দাবি উত্থাপন করেন। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন, ছয় দফার আন্দোলন সূচনার আগে এর একটি পূর্ব প্রতিক্রিয়া যাচাই করতে। এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে ছয় দফাকে তিনি কনভেনশনের বিষয়সূচিতে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করেন। কিন্তু সভাপতি চৌধুরী মোহাম্মদ আলী ছয় দফা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনায় অস্বীকৃতি জানান। বঙ্গবন্ধুর উদ্দেশ্য সফল হলো এবং তিনি বুঝতে পারলেন স্বাধিকারের দাবি নিয়ে শুধুমাত্র বাঙালি জনগণই তার সঙ্গী হবে, ঔপনিবেশিক শক্তির সহদোরেরা তাকে কোন অবস্থাতেই সহযোগিতা প্রদান করবে না।

কনভেনশনে যখন ছয় দফা দাবি উত্থাপনে ব্যর্থ হলেন বঙ্গবন্ধু তখন কনভেনশন বর্জন করে বেরিয়ে এসে ছয় দফার বিষয়ে তার দল এবং বাঙালি জাতি কতটুকু আপোসহীন এ’ বার্তাটি শাসকদের দিতে চেষ্টা করেন। ১১ ফেব্রুয়ারি লাহোর থেকে দেশে ফিরে ঢাকা বিমানবন্দরে সংবাদ সম্মেলনে ছয় দফার বিস্তারিত তুলে ধরেন বঙ্গবন্ধু। ২০ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটি ছয় দফাকে দলীয় কর্মসূচি হিসেবে গ্রহণ করে।

এই যে বললাম বাংলার জনগণই ছিল বঙ্গবন্ধুর শেষ ভরসা স্থল। সম্মিলিত বিরোধীদলের অধিবেশনে বাঙালির প্রাণের দাবিকে উপেক্ষা করা হলে তিনি ছয় দফার পক্ষে জনমত সংগঠিত করতে দেশব্যাপী একের পর এক জনসভা করতে থাকেন। কারণ জনগণের নেতার কাছে জনমতই হলো সর্বোচ্চ সমর্থন।

দলবল নিয়ে বঙ্গবন্ধু প্রথমেই যান চট্টগ্রামে। ১৯৬৬-র ২৫ ফেব্রুয়ারির লালদীঘি ময়দানে এক জনসভায় ছয় দফাকে ‘নূতন দিগন্তের নূতন মুক্তিসনদ’ অভিহিত করে চট্টগ্রামবাসীর উদ্দেশে বলেন, ‘একদিন ব্রিটিশ সরকারের জবরদস্তি শাসনব্যবস্থাকে উপেক্ষা করে এই চট্টগ্রামের জালালাবাদ পাহাড়েই বীর চট্টলার বীর সন্তানরা স্বাধীনতার পতাকা উড্ডীন করেছিলেন। আমি চাই যে পূর্ব পাকিস্তানের বঞ্চিত মানুষের জন্য দাবি আদায়ের সংগ্রামী পতাকাও চট্টগ্রামবাসী চট্টগ্রামেই প্রথম উড্ডীন করবেন।’ চট্টগ্রামের জনসভার পর ২৭ ফেব্রুয়ারি নোয়াখালীর মাইজদী ও বেগমগঞ্জ, ১০ মার্চ ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা, ১১ মার্চ ময়মনসিংহ সদর এবং ১৪ মার্চ সিলেটে জনতার দরবারে বঙ্গবন্ধু তার ছয় দফা পেশ করেন।

ছয় দফা প্রচার ও প্রকাশের জন্য বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে গঠিত হয় ছয় সদস্যের এক উপকমিটি। স্বনামে ‘আমাদের বাঁচার দাবি : ছয় দফা কর্মসূচি’ শীর্ষক একটি পুস্তিকাও প্রকাশ করা হয়। ১৮, ১৯ ও ২০ মার্চ আওয়ামী লীগের কাউন্সিল সভায় পুস্তিকাটি বিলি করা হয়। উদ্বোধনী অধিবেশনে গাওয়া হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা’। ছয় দফাকে উপলক্ষ করে সেই কাউন্সিল অধিবেশনটি ছিল বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।

পাঠক উপলব্ধি করার চেষ্টা করুন বঙ্গবন্ধু তার লক্ষ্যে কতটুকু অবিচল ছিলেন। গণতন্ত্রের মূলনীতিকে তিনি কতটুকু শ্রদ্ধা করতেন। ছয় দফা উত্থাপনের জন্য তিনি সম্মিলিত বিরোধী দল, নিজ দল এবং বাংলার সবশ্রেণীর মানুষের কাছ থেকে ম্যান্ডেট নিতে চেয়েছিলেন। জনসংযোগের অংশ হিসেবে ১৭ এপ্রিল ভোর ৪টায় খুলনায় এক জনসভা শেষে ঢাকা ফেরার পথে রমনা থানার ওয়ারেন্টে পাকিস্তান দেশরক্ষা আইনের ৪৭(৫) ধারা বলে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। যশোর মহকুমা হাকিমের এজলাস থেকে তিনি জামিন পান। সেদিনই রাত ৯টায় সিলেটে গ্রেপ্তার, পুনরায় জামিনের আবেদন এবং ২৩ তারিখে জামিন লাভ করেন। ২৪ এপ্রিল ময়মনসিংহে গ্রেপ্তার, ২৫ এপ্রিল জামিন। ছয় দফা প্রচারকালে তিন মাসে আটবার গ্রেপ্তার হন বঙ্গবন্ধু।

এভাবেই স্বৈরাচারী আইয়ুবের দমননীতি চলতে থাকে। ৮ মে নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়ায় মে দিবস স্মরণে শ্রমিক জনতার এক সমাবেশে বঙ্গবন্ধুকে বিপুল সংবর্ধনা এবং পাটের মালায় ভূষিত করে শ্রমিকরা। ভাষণ শেষে রাত ১টায় বাসায় ফেরার পথে পাকিস্তান দেশরক্ষা আইনের ৩২(১) ‘ক’ধারায় ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহকর্মীসহ বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয়। ছয় দফা দেয়াকে অপরাধ গণ্য করে বঙ্গবন্ধুকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ অভিহিত করে স্বৈরশাসক আইয়ুব বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের ওপর অব্যাহত গ্রেপ্তার-নির্যাতন চালাতে থাকেন। সামরিক সরকারের এসব কার্যকলাপের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের আহ্বানে ১৩ মে সমগ্র প্রদেশে ‘প্রতিবাদ দিবস’ পালিত হয়।

প্রতিবাদ দিবসের জনসভায় ছয় দফার প্রতি গণমানুষের বিপুল সমর্থন প্রকাশ পায়। হাজার হাজার শ্রমিক এদিন স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল করে। পল্টনের জনসভায় উপস্থিত হয়ে সরকারের দমননীতির প্রতিবাদ করে। দলের নবনির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদকে গ্রেপ্তার করা হলে সাংগঠনিক সম্পাদক মিজান চৌধুরী অস্থায়ী সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। নেতাদের গ্রেপ্তার- নির্যাতনের বিরুদ্ধে ২০ মে আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটি ৭ জুন সর্বব্যাপী হরতাল আহ্বান করে। ৭ জুনের হরতালের বিষয়ে আমরা সংক্ষিপ্ত কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ বর্ণনা পাই বঙ্গবন্ধুর ‘কারাগারের রোজনামচায়’।

পাঠক সংক্ষিপ্ত বর্ণনাটি পাঠ করলে আমরা কিছুটা উপলব্ধি করতে পারব ৭ জুন ১৯৬৬ সালে কী ঘটেছিল। ৭ জুন হরতাল সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ডায়েরিতে লিখেছেন, ‘১২টার পরে খবর পাকাপাকি পাওয়া গেল যে, হরতাল হয়েছে। জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতাল পালন করেছে। তারা ছয় দফা সমর্থন করে আর মুক্তি চায়। বাঁচতে চায়, খেতে চায়, ব্যক্তিস্বাধীনতা চায়, শ্রমিকের ন্যায্য দাবি, কৃষকদের বাঁচার দাবি তারা চায়, এর প্রমাণ এই হরতালের মধ্যে হয়েই গেল।’ (কারাগারের রোজনামচা, পৃ: ৬৯)

এ কারণে ছয় দফা কর্মসূচিকে বাঙালি জাতির মুক্তির মহাসনদই বলা যায়। এ আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালি জাতি পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর শোষণ ও অবিচারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়। ইতোপূর্বের ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, সংবিধান প্রবর্তন বা সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন পূর্বপাকিস্তানের বিশেষ শ্রেণী তথা শিক্ষিত, সচেতন ও প্রগতিশীল লোকদের মধ্যেই কেবল সীমাবদ্ধ ছিল। এগুলোতে ছাত্রসমাজের ভূমিকাই ছিল মুখ্য। আর গোড়া থেকেই সর্বস্তর ও পেশার মানুষের মুক্তির আন্দোলন হিসেবে ছয় দফা কর্মসূচি সাধারণভাবে গৃহীত হয়েছিল।

বঙ্গবন্ধু এতে সরাসরি নেতৃত্ব প্রদান করেন, এর প্রচারণায় অংশ নেন এবং একে সুসংগঠিত করেন। তার নির্দেশনায় ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়নের পাশাপাশি প্রথমবারের মতো শ্রমিক সংগঠনসমূহ আন্দোলনমুখী হয়। এ কর্মসূচি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে জাতীয় অবিসাংবাদিত নেতায় পরিণত করে। তার নির্দেশনায় ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়নের পাশাপাশি প্রথমবারের মতো শ্রমিক সংগঠনসমূহ আন্দোলনমুখী হয়। এতে পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা প্রশ্নাতীত হয়ে ওঠে। যে কারণে ছয় দফা কর্মসূচির আন্দোলনের সময় শীর্ষ ও মাঝারি সারির প্রায় সব আওয়ামী লীগ নেতা বন্দী হলেও এর আন্দোলন সাধারণ মানুষই অব্যাহত রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন।

ছয় দফা বাঙালিকে এক স্বতন্ত্র আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে চিনতে ও জানতে শিখিয়েছে। ছয় দফার ওপর ভিত্তি করেই আন্দোলন, নির্বাচন ও স্বাধীনতা যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা লাভ করে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ সম্ভব হয়েছে ছয় দফার জন্যই। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানে পাকবাহিনীর নির্বিচার হত্যাযজ্ঞের ফলে একদিকে ছয় দফা কর্মসূচির পরিসমাপ্তি ঘটে এবং নয় মাস মুক্তিযুদ্ধের পর অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের। আর তাই ৬ দফা-ই আজ বাঙালি জাতির ‘ম্যাগনাকার্টা’ হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত।

ছয় দফার তাৎপর্যকে যথার্থভাবে উপস্থাপন করেছেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর তোফায়েল আহমেদ ‘বাঙালির ম্যাগনাকার্টা শীর্ষক তার একটি নিবন্ধে। তিনি এই নিবন্ধে উল্লেখ করেন ‘বঙ্গবন্ধুর কাছে ছয় দফা ছিল একটা সাঁকো, যাতে চেপে স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতায় উন্নীত হওয়া যায়। ছয় দফা না দিলে বঙ্গবন্ধুর ওপর আইয়ুব সরকারের নির্যাতন নেমে আসত না, আগরতলা মামলায়ও তাকে জড়াত না, আর ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানও হতো না, সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ম্যান্ডেটও হয়তো ও রকম হতো না, পরিণতিতে যা এক দফা তথা স্বাধীনতার পথ সুগম করে। ‘ছয় দফা ছিল পাকিস্তানের কফিনে বাঙালির দেয়া শেষ পেরেক। ছয় দফা আন্দোলন আমাদের শিক্ষা দেয় জনগণকেন্দ্রিক আন্দোলনে, জনগণের সহায়তা লাভ করলে, আন্দোলন কোনভাবেই ব্যর্থ হয়ে যায় না। আমরা ছয় দফা আন্দোলনের সাতান্ন বছর পর এই শিক্ষার কথাটি কী মনে রেখেছি?

[লেখক: প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]

back to top