অনন্ত মাহফুজ
সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার প্রদানের বিষয়টি ক্রমাগত সাহিত্যানুরাগী এবং সাহিত্যবোদ্ধাদের কল্পনার বাইরে চলে যাচ্ছে। ২০২৪ সালের সাহিত্যে নোবেল কোথায় যাবে, তা নিয়ে বিস্তর আলাপ ও বিতর্ক হয়েছে। কেউ কেউ সম্ভাব্য লেখকদের নিয়ে তালিকা প্রকাশ করেছেন। তবে দক্ষিণ কোরিয়ার তিপ্পান্ন বছর বয়সী ঔপন্যাসিক হান কাংয়ের কথা বোধহয় তেমন কেউ ভাবেননি। যাকে নোবেল দেওয়া হয় তাঁর লেখার একটি বিশেষ দিক বিবেচনা করে নোবেল কমিটি। হান কাংয়ের বেলায় কমিটির বিবেচনায় এসেছে তাঁর ‘প্রগাঢ় কাব্যিক গদ্যÑ যা ঐতিহাসিক ট্রমার মুখোমুখি হয়ে মানব জীবনের ভঙ্গুরতা প্রকাশ করে’।
সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার নিয়ে দীর্ঘ সময়ের ধারাবাহিক আলোচনার সাথে সাম্প্রতিক অতীতে দুটি বিষয়ে তুমুল বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। প্রথমত, অনেকেই দাবি করেছেন, নোবেল পাওয়ার ক্ষেত্রে ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকার লেখকগণ প্রাধান্য পেয়ে থাকেন। দ্বিতীয়ত, ১৯০১ সাল থেকে ২০২৩ পর্যন্ত ১২০ জনকে সাহিত্যে নোবেল প্রদান করা হয়। তার মধ্যে মাত্র ১৭ জন নারী। হান কাংয়ের নোবেল প্রাপ্তিতে এই দুটো বিতর্কেরই খানিকটা হলেও নিরসন হয়েছে বলেই মনে করা হচ্ছে। এর আগে ২০২২ সালে ফ্রান্সের লেখক অ্যানি এরনক্স ১৭তম নারী হিসেবে নোবেল পেয়েছিলেন।
এ বছর সাহিত্যে নোবেল ঘোষিত হবার পর অনেক সাহিত্য-সমালোচক বলেছেন, বয়স ও কাজ বিবেচনায় হান কাং অনেকের থেকে পিছিয়ে থাকেন। বার বার নাম শোনা গেলেও বিশ^খ্যাত অনেক সাহিত্যিক নোবেল পাচ্ছেন না। অনেক তিক্ত সমালোচনা থাকলেও এ বিষয়ে কখনো পাত্তা দেয়নি এ-সংক্রান্ত নোবেল কমিটি। এ বছরে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের বাজির তালিকায় প্রথমেই ছিলেন চীনের নিরীক্ষাধর্মী কথাসাহিত্যিক এবং সাহিত্য-সমালোচক ক্যান জুয়ে। ক্যান জুয়ে সমকালীন বিশ্বসাহিত্যে নতুনত্ব এনেছেন বলে অনেক সমালোচক মনে করেন। সম্ভাবনার তালিকায় ছিলেন চীনের আরেক লেখক ইয়ান লিয়াংও। দীর্ঘ সময় ধরে জাপানের কথাসাহিত্যিক হারুকি মোরাকামির নাম শোনা গেলেও তিনি এখনো নোবেল পাননি। মোরাকামি বিশে^র প্রায় সব দেশের সাহিত্যবোদ্ধা ও পাঠকদের কাছে পরিচিত। পঞ্চাশটিরও বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে তাঁর লেখা। জাপানের আরেকজন নোবেল-সম্ভাব্য লেখক হলেন ইওকো ওগাওয়া। কথাসাহিত্যিক ওগাওয়া জাপানের প্রধান সাহিত্য পুরস্কারসহ আন্তর্জাতিক একাধিক পুরস্কার পেয়েছেন। আর্জেন্টিনার কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক সিজার আয়রাও অনেকের তালিকায় স্থান করে নিয়েছিলেন। তালিকায় ছিলেন গ্রিক কথাসাহিত্যিক ও কবি এর্সি সটাইরোপুলাস। এছাড়া সম্ভাবনার তালিকায় ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার লেখক জেরাল্ড মারনেন। বিশ্বসাহিত্যের পাঠকের কাছে অতি পরিচিত ও পছন্দের কানাডার পঁচাশি বছর বয়সী কবি, কথাসাহিত্যিক ও সাহিত্য-সমালোচক মার্গারেট অ্যাটউড। সবচেয়ে বেশি বয়সে দ্বিতীয়বার বুকার পাওয়া অ্যাটউড বহুমাত্রিক বিষয় নিয়ে বিরতিহীনভাবে লিখে চলেছেন। প্রতি বছর তাঁর নাম সম্ভাব্য নোবেল প্রাপ্তির তালিকায় থাকলেও এখনো নোবেল পাননি তিনি। কেনিয়ার কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, প্রবন্ধকার, সম্পাদক ও শিক্ষাবিদ নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো বিশ^ব্যাপী পরিচিত এক নাম। মোরাকামি ও অ্যাটউডের মতো তাঁর নামটিও প্রতি বছর নোবেল ঘোষণার আগে শোনা যায়, যেমন শোনা গিয়েছিল এবছরও। অথচ সব জল্পনাকে উড়িয়ে দিয়ে এবারের সাহিত্যে নোবেল দেওয়া হলো অধিকতর কম বয়সের এবং অনেকের মতে কম অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হান কাংকে।
আমরা দেখি যে, হান কাংয়ের সাহিত্যিক হিসেবে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় ১৯৯৩ সালে কয়েকটি কবিতা প্রকাশের মাধ্যমে। সে বছর ত্রৈমাসিক লিটরেচার এন্ড সোসাইটি পত্রিকায় ‘উইন্টার ইন সিউল’সহ পাঁচটি কবিতা প্রকাশিত হয় তার এবং এর পরের বছর কথাসাহিত্যিক হিসেবে কাংয়ের আত্মপ্রকাশ ঘটে। কাংয়ের প্রথম গল্প সংকলন লাভ ইন ইয়েসু ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত হয়। এ রচনার মাধ্যমে তিনি কোরিয়ার পাঠক মহলের মনোযোগ আকর্ষণ করতে সমর্থ হন। তবে ২০০৭ সালে প্রকাশিত দ্য ভেজিটারিয়ান উপন্যাস তাঁকে বিশ^জুড়ে খ্যাতি এনে দেয়। এ উপন্যাসটি কোরিয়ান ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেন ডেবোরাহ স্মিথ। ইতোমধ্যে উপন্যাসটি ত্রিশটিরও অধিক ভাষায় অনূদিত হয়েছে। দ্য ভেজিটারিয়ান উপন্যাসের জন্য হান কাং এবং অনুবাদক ডেবোরা স্মিথ ২০১৬ সালে ম্যান বুকার আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করেন। কাং এ উপন্যাসটি লেখেন তাঁরই লেখা এবং ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত একটি ছোটগল্প ‘দ্য ফ্রুট অব মাই ওম্যান’ থেকে। টাইম ম্যাগাজিনের করা ২০১৬ সালের ‘শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ’ তালিকায় এ উপন্যাসটিকে স্থান দেওয়া হয়েছিল। দ্য ভেজিটেরিয়ান আন্তর্জাতিকভাবে সবচেয়ে সুপরিচিত কোরিয়ান উপন্যাসগুলোর মধ্যে একটি। কাংয়ের নোবেলপ্রাপ্তি এ উপন্যাসকে পুনরায় সামনে নিয়ে এসেছে।
এক সাক্ষাৎকারে হান কাং বলেছিলেন, কলেজে পড়ার সময় কবি ই সাংয়ের একটি উক্তি “আমি বিশ্বাস করি, মানুষের গাছপালার মতো বাঁচা উচিৎ” তাকে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। এই একটি লাইন দ্য ভেজিটারিয়ান লেখার অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে উঠেছিল। উপন্যাসের মূল চরিত্র সিউলে বসবাসকারী ইয়ং-হাই। দ্য ভেজিটারিয়ান খাবারের তালিকা থেকে মাংস বাদ দেওয়ার পরে পারিবারিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে লড়াই করতে থাকা এক নারীর গল্প। ইয়ং-হাই বিবাহিত, সংসারী এবং একটি অফিসে চাকরিও করে সে। তার তেমন কোনো উচ্চাভিলাষ নেই, সংসারে খুব একটা অসুখীও নয়। তার স্বামী মি. চেওং কোনো এক প্রতিষ্ঠানে মাঝারিমানের চাকরিজীবী। তাদের সাধারণ জীবনযাপনে কোনো একসময় অস্থিরতা তৈরি হয়। ইয়ং-হাই এক রাতে পশু হত্যার একটার পর একটা বীভৎস স্বপ্ন দেখে। এই সিরিজ স্বপ্ন হাইয়ের মনোজগতে অমোচনীয় প্রভাব ফেলে। সে মাংস খাওয়া বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়। তার সিদ্ধান্ত পরিবার ও সমাজে বিরূপ প্রভাব তৈরি করে। চরম সংকট তৈরি করে তার সংসারেও। মাংস না খাওয়ার সিদ্ধান্ত তাকে তার পরিবার এবং সমাজ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়।
প্রায় প্রতিটি উপন্যাসের আঙ্গিক নিয়ে নিজের মতো নিরীক্ষা করেন হান কাং। প্রথমত ইয়ং-হাইয়ের ধীর মানসিক অবক্ষয়ের গল্পটি উপস্থাপনের জন্য হান উপন্যাসটিকে তিন ভাগে ভাগ করেছেন: ‘দ্য ভেজিটেরিয়ান’, ‘মঙ্গোলিয়ান মার্ক’ এবং ‘ফ্লেমিং ট্রিস’। তারপর তিনটি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ এবং তিনটি ভিন্ন বর্ণনাশৈলী বা ন্যারেটিভ টেকনিকের মাধ্যমে আখ্যানগুলো বর্ণনা করা হয়েছে। প্রথম অংশটি ইয়ং-হাইয়ের স্বামী মি. চেওংয়ের ভাষ্যে ফার্স্ট পার্সন বা প্রথম পুরুষে বর্ণনা করা হয়েছে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় অংশ যথাক্রমে ইয়ং-হাইয়ের ননদের স্বামী এবং তার বোনকে কেন্দ্র করে। শেষের দুই অংশই থার্ড পার্সন সিঙ্গুলার ন্যারেটিভ টেকনিকে বা তৃতীয় ব্যক্তিতে বর্ণনা করা হয়েছে, যদিও ভগ্নিপতি অতীত কালের এবং বোন বেশিরভাগই বর্তমান সময়ের কথা বলে। দ্য ভেজিটারিয়ান কেবল একজন নিরামিষভোজীর গল্প নয়; এ উপন্যাসের ভিতর দিয়ে প্রাণির প্রতি নির্মমতা ও এর প্রভাবের দিকটিও তুলে আনা হয়েছে। তাই হাইয়ের মাংস না খাওয়ার সিদ্ধান্তটি পিতৃতান্ত্রিক কোরিয়ান সমাজে নাড়া দেয়। অনেকে এটিকে দক্ষিণ কোরিয়ার রাজনৈতিক অস্থিরতার রূপক হিসেবে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন। অনেকে আবার পিতৃতান্ত্রিক আধিপত্যের অন্ধকার চিত্র হিসেবেও ব্যাখ্যা করেছেন। ২০০ পৃষ্ঠারও কম ভলিউমের এ উপন্যাসে বিষয়-বিন্যাসের জটিলতা পাঠককে বিভ্রান্ত এবং বিমোহিত করে। পারিবারিক কর্মহীনতা, লিঙ্গ সম্পর্ক, বৈবাহিক ধর্ষণ, শরীরচিত্র, খাদ্যাভ্যাসের বিশৃঙ্খলা, মানসিক অসুস্থতা এবং আত্মহত্যার ধারণার মতো গুরুতর সমস্যাগুলো উপস্থাপিত হয়েছে এ উপন্যাসে।
হান কাংয়ের জীবন খুব একটা সংক্ষুব্ধ সময়ের ভিতর দিয়ে অতিবাহিত হয়নি। বলা যায়, উন্নত দেশ দক্ষিণ কোরিয়ায় স্বাভাবিক ও নিরালম্ব তাঁর জীবন। হান কাং ১৯৭০ সালে সিওল থেকে ২৭০ কিলোমিটার দূরের শহর গুয়াংজুতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বয়স যখন দশ, তখন তাঁর পরিবার সিউলের সুয়ুরিতে চলে যায়। সেখানেই তিনি বেড়ে ওঠেন। পড়াশোনা করেছেন ইয়নসেই বিশ্ববিদ্যালয়ে কোরিয়ান সাহিত্য নিয়ে। তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য প্রকাশনা হলো ব্ল্যাক ডিয়ার (১৯৯৮), ফ্রুটস অফ মাই ওম্যান (২০০০), ইওর কোল্ড হ্যান্ডস (২০০২), ব্রেথ ফাইটিং (২০১০), গ্রিক লেসনস (২০১১), ফায়ার সালামান্ডার (২০১২), হিউম্যান অ্যাক্টস (২০১৪), দ্য হোয়াইট বুক (২০১৬) ও আই ডু নট বিড ফেয়ারওয়েল (২০২১)। ২০১৩ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর একটি কবিতা সংকলন, সন্ধ্যেটা আমি ড্রয়ারে রেখেছিলাম। দেশে এবং দেশের বাইরে অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন হান। সর্বশেষ পেলেন পুরস্কারের জগতের সবচেয়ে আলোচিত নোবেল পুরস্কার। হান কাং প্রথম দক্ষিণ কোরিয়ান এবং ১৮তম নারী যিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার অর্জন করলেন।
হান কাংয়ের গ্রিক লেসনস প্রকাশিত হয় ২০১১ সালে। এ গ্রন্থটির অনুবাদক ডেবোরাহ স্মিথ এবং এমিলি ইয়ে ওয়ান। এ উপন্যাসে দুইজন গুরুত্বপূর্ণ প্রোটাগোনিস্ট আছে। এই দুইজনের একজন পুরুষ যিনি প্রাচীন গ্রিক পাঠদানকারী শিক্ষক। অন্যজন একজন বোবা নারী যিনি এই শিক্ষকের কাছে প্রাচীন গ্রিক নিয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। তারা তাদের জীবনের ঘটনাগুলো পালা করে বর্ণনা করেন। শিক্ষক তার নিজের অক্ষমতার বিষয়ে কথা বলেন। তার দৃষ্টিশক্তি ক্ষয় হচ্ছে এবং সম্পূর্ণ অন্ধত্ব আসন্ন। তিনি একা অন্ধকারে বসবাসকারী জীবনের মুখোমুখি হন। তিনি বলেন, “এটি একটি সাধারণ বিশ্বাস যে অন্ধ বা আংশিকভাবে দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন লোকেরা প্রথমে এবং সর্বাগ্রে শব্দগুলি গ্রহণ করবে, কিন্তু আমার ক্ষেত্রে তা হয় না। প্রথম যে জিনিসটি আমি উপলব্ধি করি তা হলো সময়।”
অন্যদিকে প্রাচীন গ্রিক বিষয়ে প্রশিক্ষণগ্রহণকারী নারী তালাকপ্রাপ্ত। তার নয় বছর বয়সী ছেলে তার প্রাক্তন স্বামীর হেফাজতে। এই নারী একটি প্রাইভেট একাডেমিতে প্রাচীন গ্রিক পাঠে অংশ নিতে শুরু করার পর তাদের মধ্যে একটি সম্পর্ক বিকশিত হতে শুরু করে। দেখা যায়, গল্প বলার নিজস্ব ধরনটি এ উপন্যাসেও প্রয়োগ করেন হান। এ উপন্যাসের গল্পটিও দুই ভাগে বলা হয়েছে। প্রতিটি ভাগে একজন প্রোটাগোনিস্টকে উন্মোচিত করা হয়। প্রথম অংশটি শিক্ষকের যা ফার্স্ট পার্সন ন্যারেটিভ টেকনিকে বলা হয়েছে। শিক্ষকের নিজের বিবরণীতে উঠে আসে তার অতীত, জার্মানিতে তার জীবন (যেখানে তিনি তার জীবনের প্রায় বিশ বছর কাটিয়েছেন), ধীরে ধীরে অন্ধ হয়ে যাওয়া চোখের অবস্থা। প্রাচীন গ্রিক পাঠ নেওয়া নারীর গল্পটি থার্ড পার্সন বা তৃতীয় পুরুষে বলা। এ অংশটিতে উদ্দেশ্যহীন এক নারীর জীবনকে উপস্থাপন করা হয়েছে। উপন্যাসের দুই অংশ শেষের দিকে এমনভাবে মিলতে থাকে যেন তা পুরুষ এবং নারীর কাছাকাছি আসার সাথে তুলনীয় হয়ে ওঠে। উপন্যাসের দুই চরিত্র জীবনে প্রায় একই রকম গভীর সমস্যার মুখোমুখি হতে হতে এ পর্যায়ে এসেছেন। এ গল্পের নির্মম আয়রনি হলো, যিনি গ্রিক শিখছেন তার কণ্ঠস্বর নেই বা তিনি কথা বলতে পারেন না। আর যিনি শেখাচ্ছেন তার দৃষ্টিশক্তি শেষের পথে।
হান কাংয়ের দ্য হোয়াইট বুক গবেষণাধর্মী উপন্যাস। আখ্যানের কথক আর কাহিনির বিন্যাস নিয়ে সুনিপুণ গবেষণা করেছেন হান। এ উপন্যাস দ্বিতীয় বিশ^ যুদ্ধোত্তর পোলান্ডের ওয়ারশ শহরের এক যুবকের কষ্ট ও বিষণœতার গল্প। দ্য হোয়াইট বুক একটি কাব্যিক উপন্যাস যা সাদা রঙের কিছু বস্তুকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। উপন্যাসটিতে কোনো প্রথাগত শক্ত কাঠামো বা প্লট নেই। অধ্যায় বিভাজনও নেই। সাদা রঙের সাথে সম্পর্কিত কথকের নিজের চিন্তাভাবনা এবং তার জীবনের কিছু ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট কিছু সাদা বস্তু দিয়ে অধ্যায়ের সূচনা। পাঠকের মনে হতে পারে উপন্যাসটি অনেকটাই জার্নাল কিংবা কবিতার বই কিংবা সাদা বস্তুকে গভীর সংশ্লিষ্টায় উৎসর্গ করা কোনো কিছু। এ উপন্যাসটিও তিন ভাগে বিভক্ত: ‘আমি’, ‘সে’ এবং ‘সমস্ত শুভ্রতা’। উপন্যাসের ‘আমি’ অংশে পাঠকদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় কথকের সাথে যে এই সাদা বস্তুর বর্ণনাকারী। এখানে পাঠকরা বিভিন্ন সাদা বস্তুর উপর বর্ণনাকারীর চিন্তাভাবনা এবং ব্যাখ্যা প্রত্যক্ষ করেন। ‘সে’ অংশটি বর্ণনাকারীর দৃষ্টিকোণে লেখা হয় না। মনে হয় সাদা বস্তুগুলো এমন একজনের দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা হয় যে সারাজীবন বর্ণনাকারীকে পর্যবেক্ষণ করেছে। অবশেষে, ‘অল থিংস হোয়াইট’ বা ‘সমস্ত শুভ্রতা’য় কথক ফিরে আসে এবং আবার বর্ণনায় যুক্ত হয়। অনেক সাহিত্য-সমালোচক মনে করেন, উপন্যাসের কাঠামো নিয়ে ক্রমাগত এমন নিরীক্ষা কিছুটা যান্ত্রিক বটে।
তবে এ উপন্যাসের বিষয়বস্তু পাঠককে উৎসুক করে তোলে। পাঠকগণ শীঘ্রই আবিষ্কার করেন যে, বর্ণনাকারী বা কথক তার বোনের মৃত্যুর অপরাধবোধ এবং অমীমাংসিত এক শোকের সাথে লড়াই করছে। সেই অর্থে, উপন্যাসটি মৃত বোনের কাছে লেখা একটি চিঠির মতো যে বোনের সাথে তার কখনো দেখা হয়নি। তার বড় বোন জন্মের পরেই মারা যায়। কিন্তু কথক অপরাধবোধের অনুভূতি বহন করে কারণ সে মনে করে, সে কোনো-না-কোনোভাবে তার বোনের জীবনটাই চুরি করেছে। কথকের মাধ্যমে পাঠকরা অমীমাংসিত দুঃখের পরিণতি, কীভাবে এই শোক শিশুদের ভিতর প্রবাহিত হয় এবং তাদের মানসিকতাকে প্রভাবিত করতে পারে তা প্রত্যক্ষ করেন। আখ্যানের কথকের মা যে সীমাহীন দুঃখ বহন করেছিলেন তা-ও তাকে প্রভাবিত করে।
হান কাং বিভিন্ন সময়ে তার উপন্যাসগুলোর জন্য দেশে ও বিদেশে উল্লেখযোগ্য পুরস্কার পেয়েছেন। ২০১৪ সালে প্রকাশিত হিউম্যান অ্যাক্টস বইয়ের জন্য পেয়েছেন মানহাই সাহিত্য পুরস্কার। হোয়েন ওয়ান স্নোফ্লেক মেল্টস উপন্যাসের জন্য হোয়াং সান সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন ২০১৫ সালে। তার সাম্প্রতিকতম উপন্যাস আই ডো নট বিড ফেয়ারওয়েল ২০২৩ সালে ফ্রান্সের প্রিক্স মেডিসিস পুরস্কার এবং ২০২৪ সালে এমাইল গুইমেট এশিয়ান লিটারারি পুরস্কারে ভূষিত হয়। এ উপন্যাসে জীবন ও মৃত্যু, স্মৃতি ও ইতিহাস এবং মানব অস্তিত্বের ভঙ্গুরতাকে মূল উপজীব্য করা হয়েছে। উপন্যাসের আখ্যান কিউংহাকে নিয়ে। ঐতিহাসিক গণহত্যার পুনরাবৃত্তির দুঃস্বপ্ন দেখে বিরক্ত একজন নারী তার বন্ধু ইনসেনকে সাহায্য করার জন্য জেজু দ্বীপে যায়। তার বন্ধু দুর্ঘটনায় আহত এবং হাসপাতালে ভর্তি। উপন্যাসটি ব্যক্তিগত ট্রমা এবং যৌথ ঐতিহাসিক স্মৃতি উভয়ই অন্বেষণ করে। হান কাং কাব্যিক কিন্তু শীতল গদ্য ব্যবহার করে ভুলে যাওয়া ট্র্যাজেডির ভয়াবহতা জাগিয়ে তোলেন। পাশাপাশি মানব সম্পর্কের শক্তি, বিশেষ করে স্থায়ী বন্ধুত্বের বন্ধনকেও উপস্থান করেন। উপন্যাসটি প্রকাশের আগে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে হান কাং জানান, তার প্রকাশিতব্য উপন্যাসের মূল বিষয় ভালোবাসা। তিনি এ-ও বলেন, উপন্যাসটি মৃত্যু থেকে জীবনের দিকে যাত্রা।
নোবেল কমিটির চেয়ার অ্যান্ডার্স ওলসন বলেছেন, “অরক্ষিত, বিশেষ করে নারীর, জীবনের প্রতি তাঁর সহানুভূতি স্পষ্ট, এবং তাঁর রূপক গদ্যের মাধ্যমে সেই উপস্থাপন শক্তিশালী হয়।” হান কাংয়ের নোবেলপ্রাপ্তিতে বিশে^র অনেক লেখক তাঁকে অভিনন্দিত করেছেন। হান কাংয়ের দ্য ভেজেটারিয়ান উপন্যাসের ইংরেজি অনুবাদের পা-ুলিপি সম্পাদনা করেছিলেন ঔপন্যাসিক ম্যাক্স পোর্টার। তিনি হান সম্পর্কে বলেছেন, “হান একজন গুরুত্বপূর্ণ কণ্ঠস্বর এবং অসাধারণ মানবতার লেখক। তাঁর কাজ আমাদের সকলের জন্য উপহার। তিনি নোবেল কমিটি কর্তৃক স্বীকৃত হওয়ায় আমি রোমাঞ্চিত। নতুন পাঠকরা তাঁর অলৌকিক কাজ আবিষ্কার করবে এবং তাঁর দ্বারা পরিবর্তিত হবে।”
পুরস্কারপ্রাপ্তির পর লেখককে অভিনন্দন জানানো একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হলেও তাতে সাহিত্যে নোবেল নিয়ে বিতর্ক কমে না। দীর্ঘ সময় ধরে লিখে যাওয়া আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন লেখকগণ কেন নোবেল পান না, তারও কোনো সুরাহা দেখা যায় না। চমক দেওয়ার জন্য সাহিত্যে নোবেল দেওয়া হয়, এমন তত্ত্বে বিশ^াস করা মানুষের সংখ্যা একেবারে কম না হলেও বিষয়টি অনেকে আমলে নেন না কারণ যাকে পুরস্কারটি দেওয়া হয় তাঁকে নতুন নতুন পাঠক নতুন করে আবিষ্কার করেন। বিশ্বসাহিত্যে এ প্রাপ্তিটুকুও কম নয়। হান কাং সে অর্থে বিশে^র কোটি কোটি পাঠকের কাছে পৌঁছাবেন, পৌঁছাবে কোরিয়ার সাহিত্যও।
অনন্ত মাহফুজ
বৃহস্পতিবার, ১৭ অক্টোবর ২০২৪
সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার প্রদানের বিষয়টি ক্রমাগত সাহিত্যানুরাগী এবং সাহিত্যবোদ্ধাদের কল্পনার বাইরে চলে যাচ্ছে। ২০২৪ সালের সাহিত্যে নোবেল কোথায় যাবে, তা নিয়ে বিস্তর আলাপ ও বিতর্ক হয়েছে। কেউ কেউ সম্ভাব্য লেখকদের নিয়ে তালিকা প্রকাশ করেছেন। তবে দক্ষিণ কোরিয়ার তিপ্পান্ন বছর বয়সী ঔপন্যাসিক হান কাংয়ের কথা বোধহয় তেমন কেউ ভাবেননি। যাকে নোবেল দেওয়া হয় তাঁর লেখার একটি বিশেষ দিক বিবেচনা করে নোবেল কমিটি। হান কাংয়ের বেলায় কমিটির বিবেচনায় এসেছে তাঁর ‘প্রগাঢ় কাব্যিক গদ্যÑ যা ঐতিহাসিক ট্রমার মুখোমুখি হয়ে মানব জীবনের ভঙ্গুরতা প্রকাশ করে’।
সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার নিয়ে দীর্ঘ সময়ের ধারাবাহিক আলোচনার সাথে সাম্প্রতিক অতীতে দুটি বিষয়ে তুমুল বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। প্রথমত, অনেকেই দাবি করেছেন, নোবেল পাওয়ার ক্ষেত্রে ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকার লেখকগণ প্রাধান্য পেয়ে থাকেন। দ্বিতীয়ত, ১৯০১ সাল থেকে ২০২৩ পর্যন্ত ১২০ জনকে সাহিত্যে নোবেল প্রদান করা হয়। তার মধ্যে মাত্র ১৭ জন নারী। হান কাংয়ের নোবেল প্রাপ্তিতে এই দুটো বিতর্কেরই খানিকটা হলেও নিরসন হয়েছে বলেই মনে করা হচ্ছে। এর আগে ২০২২ সালে ফ্রান্সের লেখক অ্যানি এরনক্স ১৭তম নারী হিসেবে নোবেল পেয়েছিলেন।
এ বছর সাহিত্যে নোবেল ঘোষিত হবার পর অনেক সাহিত্য-সমালোচক বলেছেন, বয়স ও কাজ বিবেচনায় হান কাং অনেকের থেকে পিছিয়ে থাকেন। বার বার নাম শোনা গেলেও বিশ^খ্যাত অনেক সাহিত্যিক নোবেল পাচ্ছেন না। অনেক তিক্ত সমালোচনা থাকলেও এ বিষয়ে কখনো পাত্তা দেয়নি এ-সংক্রান্ত নোবেল কমিটি। এ বছরে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের বাজির তালিকায় প্রথমেই ছিলেন চীনের নিরীক্ষাধর্মী কথাসাহিত্যিক এবং সাহিত্য-সমালোচক ক্যান জুয়ে। ক্যান জুয়ে সমকালীন বিশ্বসাহিত্যে নতুনত্ব এনেছেন বলে অনেক সমালোচক মনে করেন। সম্ভাবনার তালিকায় ছিলেন চীনের আরেক লেখক ইয়ান লিয়াংও। দীর্ঘ সময় ধরে জাপানের কথাসাহিত্যিক হারুকি মোরাকামির নাম শোনা গেলেও তিনি এখনো নোবেল পাননি। মোরাকামি বিশে^র প্রায় সব দেশের সাহিত্যবোদ্ধা ও পাঠকদের কাছে পরিচিত। পঞ্চাশটিরও বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে তাঁর লেখা। জাপানের আরেকজন নোবেল-সম্ভাব্য লেখক হলেন ইওকো ওগাওয়া। কথাসাহিত্যিক ওগাওয়া জাপানের প্রধান সাহিত্য পুরস্কারসহ আন্তর্জাতিক একাধিক পুরস্কার পেয়েছেন। আর্জেন্টিনার কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক সিজার আয়রাও অনেকের তালিকায় স্থান করে নিয়েছিলেন। তালিকায় ছিলেন গ্রিক কথাসাহিত্যিক ও কবি এর্সি সটাইরোপুলাস। এছাড়া সম্ভাবনার তালিকায় ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার লেখক জেরাল্ড মারনেন। বিশ্বসাহিত্যের পাঠকের কাছে অতি পরিচিত ও পছন্দের কানাডার পঁচাশি বছর বয়সী কবি, কথাসাহিত্যিক ও সাহিত্য-সমালোচক মার্গারেট অ্যাটউড। সবচেয়ে বেশি বয়সে দ্বিতীয়বার বুকার পাওয়া অ্যাটউড বহুমাত্রিক বিষয় নিয়ে বিরতিহীনভাবে লিখে চলেছেন। প্রতি বছর তাঁর নাম সম্ভাব্য নোবেল প্রাপ্তির তালিকায় থাকলেও এখনো নোবেল পাননি তিনি। কেনিয়ার কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, প্রবন্ধকার, সম্পাদক ও শিক্ষাবিদ নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো বিশ^ব্যাপী পরিচিত এক নাম। মোরাকামি ও অ্যাটউডের মতো তাঁর নামটিও প্রতি বছর নোবেল ঘোষণার আগে শোনা যায়, যেমন শোনা গিয়েছিল এবছরও। অথচ সব জল্পনাকে উড়িয়ে দিয়ে এবারের সাহিত্যে নোবেল দেওয়া হলো অধিকতর কম বয়সের এবং অনেকের মতে কম অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হান কাংকে।
আমরা দেখি যে, হান কাংয়ের সাহিত্যিক হিসেবে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় ১৯৯৩ সালে কয়েকটি কবিতা প্রকাশের মাধ্যমে। সে বছর ত্রৈমাসিক লিটরেচার এন্ড সোসাইটি পত্রিকায় ‘উইন্টার ইন সিউল’সহ পাঁচটি কবিতা প্রকাশিত হয় তার এবং এর পরের বছর কথাসাহিত্যিক হিসেবে কাংয়ের আত্মপ্রকাশ ঘটে। কাংয়ের প্রথম গল্প সংকলন লাভ ইন ইয়েসু ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত হয়। এ রচনার মাধ্যমে তিনি কোরিয়ার পাঠক মহলের মনোযোগ আকর্ষণ করতে সমর্থ হন। তবে ২০০৭ সালে প্রকাশিত দ্য ভেজিটারিয়ান উপন্যাস তাঁকে বিশ^জুড়ে খ্যাতি এনে দেয়। এ উপন্যাসটি কোরিয়ান ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেন ডেবোরাহ স্মিথ। ইতোমধ্যে উপন্যাসটি ত্রিশটিরও অধিক ভাষায় অনূদিত হয়েছে। দ্য ভেজিটারিয়ান উপন্যাসের জন্য হান কাং এবং অনুবাদক ডেবোরা স্মিথ ২০১৬ সালে ম্যান বুকার আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করেন। কাং এ উপন্যাসটি লেখেন তাঁরই লেখা এবং ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত একটি ছোটগল্প ‘দ্য ফ্রুট অব মাই ওম্যান’ থেকে। টাইম ম্যাগাজিনের করা ২০১৬ সালের ‘শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ’ তালিকায় এ উপন্যাসটিকে স্থান দেওয়া হয়েছিল। দ্য ভেজিটেরিয়ান আন্তর্জাতিকভাবে সবচেয়ে সুপরিচিত কোরিয়ান উপন্যাসগুলোর মধ্যে একটি। কাংয়ের নোবেলপ্রাপ্তি এ উপন্যাসকে পুনরায় সামনে নিয়ে এসেছে।
এক সাক্ষাৎকারে হান কাং বলেছিলেন, কলেজে পড়ার সময় কবি ই সাংয়ের একটি উক্তি “আমি বিশ্বাস করি, মানুষের গাছপালার মতো বাঁচা উচিৎ” তাকে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। এই একটি লাইন দ্য ভেজিটারিয়ান লেখার অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে উঠেছিল। উপন্যাসের মূল চরিত্র সিউলে বসবাসকারী ইয়ং-হাই। দ্য ভেজিটারিয়ান খাবারের তালিকা থেকে মাংস বাদ দেওয়ার পরে পারিবারিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে লড়াই করতে থাকা এক নারীর গল্প। ইয়ং-হাই বিবাহিত, সংসারী এবং একটি অফিসে চাকরিও করে সে। তার তেমন কোনো উচ্চাভিলাষ নেই, সংসারে খুব একটা অসুখীও নয়। তার স্বামী মি. চেওং কোনো এক প্রতিষ্ঠানে মাঝারিমানের চাকরিজীবী। তাদের সাধারণ জীবনযাপনে কোনো একসময় অস্থিরতা তৈরি হয়। ইয়ং-হাই এক রাতে পশু হত্যার একটার পর একটা বীভৎস স্বপ্ন দেখে। এই সিরিজ স্বপ্ন হাইয়ের মনোজগতে অমোচনীয় প্রভাব ফেলে। সে মাংস খাওয়া বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়। তার সিদ্ধান্ত পরিবার ও সমাজে বিরূপ প্রভাব তৈরি করে। চরম সংকট তৈরি করে তার সংসারেও। মাংস না খাওয়ার সিদ্ধান্ত তাকে তার পরিবার এবং সমাজ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়।
প্রায় প্রতিটি উপন্যাসের আঙ্গিক নিয়ে নিজের মতো নিরীক্ষা করেন হান কাং। প্রথমত ইয়ং-হাইয়ের ধীর মানসিক অবক্ষয়ের গল্পটি উপস্থাপনের জন্য হান উপন্যাসটিকে তিন ভাগে ভাগ করেছেন: ‘দ্য ভেজিটেরিয়ান’, ‘মঙ্গোলিয়ান মার্ক’ এবং ‘ফ্লেমিং ট্রিস’। তারপর তিনটি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ এবং তিনটি ভিন্ন বর্ণনাশৈলী বা ন্যারেটিভ টেকনিকের মাধ্যমে আখ্যানগুলো বর্ণনা করা হয়েছে। প্রথম অংশটি ইয়ং-হাইয়ের স্বামী মি. চেওংয়ের ভাষ্যে ফার্স্ট পার্সন বা প্রথম পুরুষে বর্ণনা করা হয়েছে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় অংশ যথাক্রমে ইয়ং-হাইয়ের ননদের স্বামী এবং তার বোনকে কেন্দ্র করে। শেষের দুই অংশই থার্ড পার্সন সিঙ্গুলার ন্যারেটিভ টেকনিকে বা তৃতীয় ব্যক্তিতে বর্ণনা করা হয়েছে, যদিও ভগ্নিপতি অতীত কালের এবং বোন বেশিরভাগই বর্তমান সময়ের কথা বলে। দ্য ভেজিটারিয়ান কেবল একজন নিরামিষভোজীর গল্প নয়; এ উপন্যাসের ভিতর দিয়ে প্রাণির প্রতি নির্মমতা ও এর প্রভাবের দিকটিও তুলে আনা হয়েছে। তাই হাইয়ের মাংস না খাওয়ার সিদ্ধান্তটি পিতৃতান্ত্রিক কোরিয়ান সমাজে নাড়া দেয়। অনেকে এটিকে দক্ষিণ কোরিয়ার রাজনৈতিক অস্থিরতার রূপক হিসেবে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন। অনেকে আবার পিতৃতান্ত্রিক আধিপত্যের অন্ধকার চিত্র হিসেবেও ব্যাখ্যা করেছেন। ২০০ পৃষ্ঠারও কম ভলিউমের এ উপন্যাসে বিষয়-বিন্যাসের জটিলতা পাঠককে বিভ্রান্ত এবং বিমোহিত করে। পারিবারিক কর্মহীনতা, লিঙ্গ সম্পর্ক, বৈবাহিক ধর্ষণ, শরীরচিত্র, খাদ্যাভ্যাসের বিশৃঙ্খলা, মানসিক অসুস্থতা এবং আত্মহত্যার ধারণার মতো গুরুতর সমস্যাগুলো উপস্থাপিত হয়েছে এ উপন্যাসে।
হান কাংয়ের জীবন খুব একটা সংক্ষুব্ধ সময়ের ভিতর দিয়ে অতিবাহিত হয়নি। বলা যায়, উন্নত দেশ দক্ষিণ কোরিয়ায় স্বাভাবিক ও নিরালম্ব তাঁর জীবন। হান কাং ১৯৭০ সালে সিওল থেকে ২৭০ কিলোমিটার দূরের শহর গুয়াংজুতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বয়স যখন দশ, তখন তাঁর পরিবার সিউলের সুয়ুরিতে চলে যায়। সেখানেই তিনি বেড়ে ওঠেন। পড়াশোনা করেছেন ইয়নসেই বিশ্ববিদ্যালয়ে কোরিয়ান সাহিত্য নিয়ে। তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য প্রকাশনা হলো ব্ল্যাক ডিয়ার (১৯৯৮), ফ্রুটস অফ মাই ওম্যান (২০০০), ইওর কোল্ড হ্যান্ডস (২০০২), ব্রেথ ফাইটিং (২০১০), গ্রিক লেসনস (২০১১), ফায়ার সালামান্ডার (২০১২), হিউম্যান অ্যাক্টস (২০১৪), দ্য হোয়াইট বুক (২০১৬) ও আই ডু নট বিড ফেয়ারওয়েল (২০২১)। ২০১৩ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর একটি কবিতা সংকলন, সন্ধ্যেটা আমি ড্রয়ারে রেখেছিলাম। দেশে এবং দেশের বাইরে অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন হান। সর্বশেষ পেলেন পুরস্কারের জগতের সবচেয়ে আলোচিত নোবেল পুরস্কার। হান কাং প্রথম দক্ষিণ কোরিয়ান এবং ১৮তম নারী যিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার অর্জন করলেন।
হান কাংয়ের গ্রিক লেসনস প্রকাশিত হয় ২০১১ সালে। এ গ্রন্থটির অনুবাদক ডেবোরাহ স্মিথ এবং এমিলি ইয়ে ওয়ান। এ উপন্যাসে দুইজন গুরুত্বপূর্ণ প্রোটাগোনিস্ট আছে। এই দুইজনের একজন পুরুষ যিনি প্রাচীন গ্রিক পাঠদানকারী শিক্ষক। অন্যজন একজন বোবা নারী যিনি এই শিক্ষকের কাছে প্রাচীন গ্রিক নিয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। তারা তাদের জীবনের ঘটনাগুলো পালা করে বর্ণনা করেন। শিক্ষক তার নিজের অক্ষমতার বিষয়ে কথা বলেন। তার দৃষ্টিশক্তি ক্ষয় হচ্ছে এবং সম্পূর্ণ অন্ধত্ব আসন্ন। তিনি একা অন্ধকারে বসবাসকারী জীবনের মুখোমুখি হন। তিনি বলেন, “এটি একটি সাধারণ বিশ্বাস যে অন্ধ বা আংশিকভাবে দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন লোকেরা প্রথমে এবং সর্বাগ্রে শব্দগুলি গ্রহণ করবে, কিন্তু আমার ক্ষেত্রে তা হয় না। প্রথম যে জিনিসটি আমি উপলব্ধি করি তা হলো সময়।”
অন্যদিকে প্রাচীন গ্রিক বিষয়ে প্রশিক্ষণগ্রহণকারী নারী তালাকপ্রাপ্ত। তার নয় বছর বয়সী ছেলে তার প্রাক্তন স্বামীর হেফাজতে। এই নারী একটি প্রাইভেট একাডেমিতে প্রাচীন গ্রিক পাঠে অংশ নিতে শুরু করার পর তাদের মধ্যে একটি সম্পর্ক বিকশিত হতে শুরু করে। দেখা যায়, গল্প বলার নিজস্ব ধরনটি এ উপন্যাসেও প্রয়োগ করেন হান। এ উপন্যাসের গল্পটিও দুই ভাগে বলা হয়েছে। প্রতিটি ভাগে একজন প্রোটাগোনিস্টকে উন্মোচিত করা হয়। প্রথম অংশটি শিক্ষকের যা ফার্স্ট পার্সন ন্যারেটিভ টেকনিকে বলা হয়েছে। শিক্ষকের নিজের বিবরণীতে উঠে আসে তার অতীত, জার্মানিতে তার জীবন (যেখানে তিনি তার জীবনের প্রায় বিশ বছর কাটিয়েছেন), ধীরে ধীরে অন্ধ হয়ে যাওয়া চোখের অবস্থা। প্রাচীন গ্রিক পাঠ নেওয়া নারীর গল্পটি থার্ড পার্সন বা তৃতীয় পুরুষে বলা। এ অংশটিতে উদ্দেশ্যহীন এক নারীর জীবনকে উপস্থাপন করা হয়েছে। উপন্যাসের দুই অংশ শেষের দিকে এমনভাবে মিলতে থাকে যেন তা পুরুষ এবং নারীর কাছাকাছি আসার সাথে তুলনীয় হয়ে ওঠে। উপন্যাসের দুই চরিত্র জীবনে প্রায় একই রকম গভীর সমস্যার মুখোমুখি হতে হতে এ পর্যায়ে এসেছেন। এ গল্পের নির্মম আয়রনি হলো, যিনি গ্রিক শিখছেন তার কণ্ঠস্বর নেই বা তিনি কথা বলতে পারেন না। আর যিনি শেখাচ্ছেন তার দৃষ্টিশক্তি শেষের পথে।
হান কাংয়ের দ্য হোয়াইট বুক গবেষণাধর্মী উপন্যাস। আখ্যানের কথক আর কাহিনির বিন্যাস নিয়ে সুনিপুণ গবেষণা করেছেন হান। এ উপন্যাস দ্বিতীয় বিশ^ যুদ্ধোত্তর পোলান্ডের ওয়ারশ শহরের এক যুবকের কষ্ট ও বিষণœতার গল্প। দ্য হোয়াইট বুক একটি কাব্যিক উপন্যাস যা সাদা রঙের কিছু বস্তুকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। উপন্যাসটিতে কোনো প্রথাগত শক্ত কাঠামো বা প্লট নেই। অধ্যায় বিভাজনও নেই। সাদা রঙের সাথে সম্পর্কিত কথকের নিজের চিন্তাভাবনা এবং তার জীবনের কিছু ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট কিছু সাদা বস্তু দিয়ে অধ্যায়ের সূচনা। পাঠকের মনে হতে পারে উপন্যাসটি অনেকটাই জার্নাল কিংবা কবিতার বই কিংবা সাদা বস্তুকে গভীর সংশ্লিষ্টায় উৎসর্গ করা কোনো কিছু। এ উপন্যাসটিও তিন ভাগে বিভক্ত: ‘আমি’, ‘সে’ এবং ‘সমস্ত শুভ্রতা’। উপন্যাসের ‘আমি’ অংশে পাঠকদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় কথকের সাথে যে এই সাদা বস্তুর বর্ণনাকারী। এখানে পাঠকরা বিভিন্ন সাদা বস্তুর উপর বর্ণনাকারীর চিন্তাভাবনা এবং ব্যাখ্যা প্রত্যক্ষ করেন। ‘সে’ অংশটি বর্ণনাকারীর দৃষ্টিকোণে লেখা হয় না। মনে হয় সাদা বস্তুগুলো এমন একজনের দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা হয় যে সারাজীবন বর্ণনাকারীকে পর্যবেক্ষণ করেছে। অবশেষে, ‘অল থিংস হোয়াইট’ বা ‘সমস্ত শুভ্রতা’য় কথক ফিরে আসে এবং আবার বর্ণনায় যুক্ত হয়। অনেক সাহিত্য-সমালোচক মনে করেন, উপন্যাসের কাঠামো নিয়ে ক্রমাগত এমন নিরীক্ষা কিছুটা যান্ত্রিক বটে।
তবে এ উপন্যাসের বিষয়বস্তু পাঠককে উৎসুক করে তোলে। পাঠকগণ শীঘ্রই আবিষ্কার করেন যে, বর্ণনাকারী বা কথক তার বোনের মৃত্যুর অপরাধবোধ এবং অমীমাংসিত এক শোকের সাথে লড়াই করছে। সেই অর্থে, উপন্যাসটি মৃত বোনের কাছে লেখা একটি চিঠির মতো যে বোনের সাথে তার কখনো দেখা হয়নি। তার বড় বোন জন্মের পরেই মারা যায়। কিন্তু কথক অপরাধবোধের অনুভূতি বহন করে কারণ সে মনে করে, সে কোনো-না-কোনোভাবে তার বোনের জীবনটাই চুরি করেছে। কথকের মাধ্যমে পাঠকরা অমীমাংসিত দুঃখের পরিণতি, কীভাবে এই শোক শিশুদের ভিতর প্রবাহিত হয় এবং তাদের মানসিকতাকে প্রভাবিত করতে পারে তা প্রত্যক্ষ করেন। আখ্যানের কথকের মা যে সীমাহীন দুঃখ বহন করেছিলেন তা-ও তাকে প্রভাবিত করে।
হান কাং বিভিন্ন সময়ে তার উপন্যাসগুলোর জন্য দেশে ও বিদেশে উল্লেখযোগ্য পুরস্কার পেয়েছেন। ২০১৪ সালে প্রকাশিত হিউম্যান অ্যাক্টস বইয়ের জন্য পেয়েছেন মানহাই সাহিত্য পুরস্কার। হোয়েন ওয়ান স্নোফ্লেক মেল্টস উপন্যাসের জন্য হোয়াং সান সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন ২০১৫ সালে। তার সাম্প্রতিকতম উপন্যাস আই ডো নট বিড ফেয়ারওয়েল ২০২৩ সালে ফ্রান্সের প্রিক্স মেডিসিস পুরস্কার এবং ২০২৪ সালে এমাইল গুইমেট এশিয়ান লিটারারি পুরস্কারে ভূষিত হয়। এ উপন্যাসে জীবন ও মৃত্যু, স্মৃতি ও ইতিহাস এবং মানব অস্তিত্বের ভঙ্গুরতাকে মূল উপজীব্য করা হয়েছে। উপন্যাসের আখ্যান কিউংহাকে নিয়ে। ঐতিহাসিক গণহত্যার পুনরাবৃত্তির দুঃস্বপ্ন দেখে বিরক্ত একজন নারী তার বন্ধু ইনসেনকে সাহায্য করার জন্য জেজু দ্বীপে যায়। তার বন্ধু দুর্ঘটনায় আহত এবং হাসপাতালে ভর্তি। উপন্যাসটি ব্যক্তিগত ট্রমা এবং যৌথ ঐতিহাসিক স্মৃতি উভয়ই অন্বেষণ করে। হান কাং কাব্যিক কিন্তু শীতল গদ্য ব্যবহার করে ভুলে যাওয়া ট্র্যাজেডির ভয়াবহতা জাগিয়ে তোলেন। পাশাপাশি মানব সম্পর্কের শক্তি, বিশেষ করে স্থায়ী বন্ধুত্বের বন্ধনকেও উপস্থান করেন। উপন্যাসটি প্রকাশের আগে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে হান কাং জানান, তার প্রকাশিতব্য উপন্যাসের মূল বিষয় ভালোবাসা। তিনি এ-ও বলেন, উপন্যাসটি মৃত্যু থেকে জীবনের দিকে যাত্রা।
নোবেল কমিটির চেয়ার অ্যান্ডার্স ওলসন বলেছেন, “অরক্ষিত, বিশেষ করে নারীর, জীবনের প্রতি তাঁর সহানুভূতি স্পষ্ট, এবং তাঁর রূপক গদ্যের মাধ্যমে সেই উপস্থাপন শক্তিশালী হয়।” হান কাংয়ের নোবেলপ্রাপ্তিতে বিশে^র অনেক লেখক তাঁকে অভিনন্দিত করেছেন। হান কাংয়ের দ্য ভেজেটারিয়ান উপন্যাসের ইংরেজি অনুবাদের পা-ুলিপি সম্পাদনা করেছিলেন ঔপন্যাসিক ম্যাক্স পোর্টার। তিনি হান সম্পর্কে বলেছেন, “হান একজন গুরুত্বপূর্ণ কণ্ঠস্বর এবং অসাধারণ মানবতার লেখক। তাঁর কাজ আমাদের সকলের জন্য উপহার। তিনি নোবেল কমিটি কর্তৃক স্বীকৃত হওয়ায় আমি রোমাঞ্চিত। নতুন পাঠকরা তাঁর অলৌকিক কাজ আবিষ্কার করবে এবং তাঁর দ্বারা পরিবর্তিত হবে।”
পুরস্কারপ্রাপ্তির পর লেখককে অভিনন্দন জানানো একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হলেও তাতে সাহিত্যে নোবেল নিয়ে বিতর্ক কমে না। দীর্ঘ সময় ধরে লিখে যাওয়া আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন লেখকগণ কেন নোবেল পান না, তারও কোনো সুরাহা দেখা যায় না। চমক দেওয়ার জন্য সাহিত্যে নোবেল দেওয়া হয়, এমন তত্ত্বে বিশ^াস করা মানুষের সংখ্যা একেবারে কম না হলেও বিষয়টি অনেকে আমলে নেন না কারণ যাকে পুরস্কারটি দেওয়া হয় তাঁকে নতুন নতুন পাঠক নতুন করে আবিষ্কার করেন। বিশ্বসাহিত্যে এ প্রাপ্তিটুকুও কম নয়। হান কাং সে অর্থে বিশে^র কোটি কোটি পাঠকের কাছে পৌঁছাবেন, পৌঁছাবে কোরিয়ার সাহিত্যও।