ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ : বিপাশা মন্ডল
সাক্ষাৎকারটি শিল্প-সাহিত্যবিষয়ক ওয়েব ম্যাগাজিন ‘বুকানিস্তা’য় ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত হয়েছিল। সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন বুকানিস্তা-সম্পাদক মার্ক রেনল্ড। তাঁর সঙ্গে ছিলেন কাংয়ের অনুবাদক দেবরাহ স্মিথ এবং দোভাষী কিম সু কেয়ং। মূল সাক্ষাৎকারটি অনেক দীর্ঘ হওয়ায় সেখান থেকে চুম্বক অংশ বাংলায় অনুবাদ করে প্রকাশ করা হলো।
[ইংরেজি ভাষায় হান কাং-এর প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস দ্য ভেজিটারিয়ান, উপন্যাসটিতে লেখক লজ্জা, নিঃসঙ্গতা, ক্রোধ, ক্ষোভ, রূপান্তর এবং সমকালীন দক্ষিণ কোরিয়ার মানুষের আশা-আকাক্সক্ষাকে চমকপ্রদ, ভয়জাগানিয়া ও কাব্যসুলভ ভঙ্গিতে উপস্থাপন করেছেন। এ উপন্যাসে বিধৃত আত্মপরিচয় এবং মানবিকতার বিষয়টি সাক্ষাৎকারে প্রাধান্য পেয়েছে।]
মার্ক রেনল্ড : তিনটি ছোটো নভেলা হিসেবে ‘দ্য ভেজিটারিয়ান’ কোরিয়াতে প্রকাশিত হয়েছিল। ওখানে কি সবসময় এভাবেই বই প্রকাশ করে? প্রথমবার প্রকাশের আগে কি তিনটাই লিখে শেষ করে ফেলেছিলেন? ছোটো আকারের উপন্যাসের ধারাবাহিক প্রকাশনা করা কোরিয়াতে কি এতোটাই অস্বাভাবিক যে সেই প্রকাশনা এখানে করতে হবে?
হান কাং : কোরিয়াতে এটা চলে, সিক্যুয়েল উপন্যাস প্রথমে আলাদা করে ছাপা হয়, পরে একত্রে ছাপা হয়। অনেক হচ্ছে এমন নয়, কিন্তু আমি বলবো আমাদের এখানে যুক্তরাজ্যের চেয়ে বেশি সিরিয়াল উপন্যাস রয়েছে। আমি এই গল্পগুলো ২০০০ সালে লিখতে শুরু করি, প্রথম দু’খ- দু’বছরের মধ্যে লিখে ফেলি, এরপর এগুলো প্রকাশিত হয়। অনেক পরে তৃতীয় খ- লিখি।
মা. রে. : দেবরাহ, আপনি প্রথম কখন ‘দ্য ভেজিটারিয়ান’ উপন্যাসটা দেখেন, এবং এর অনুবাদক কীভাবে হলেন?
দেবরাহ স্মিথ : ‘এন্ড আদার স্টোরিস’ বইটা হাতে পাই ২০১১ সালের দিকে, আমাকে বলা হয়েছিল একজন পাঠকের প্রতিক্রিয়া হিসাবে কিছু লিখে দিতে, এছাড়া এই বইয়ের লেখার উদাহরণ হিসেবে টেক্সটের একটা ক্ষুদ্র অংশও অনুবাদ করতে। তখন মোটে দেড় বছর হয় আমি কোরিয়ান ভাষা শিখছি, তাই বইটা সম্পর্কে জানতাম, কারণ কোরিয়ান সাহিত্য অনুবাদ করতে আমি আগ্রহীও ছিলাম, কিন্তু প্রকাশ করার মতো কিছু করতে পারিনি, এবং তখন আমি সত্যিই জানতাম না পাঠকের প্রতিক্রিয়া কীভাবে লেখা হয়, উদাহরণ হিসেবে নমুনা টেক্সট কীভাবে বাছাই ও অনুবাদ করতে হয় আমার তখন সে ধারণাও ছিল না। অতি উৎসাহে আমি হ্যাঁ তো বলে দিয়েছিলাম, কিন্তু পরে অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে তাদের গিয়ে জানালাম যে, আমি এর আগে কোনো কোরিয়ান ভাষায় লেখা বই পড়িনি। কাজেই আমি একটি অত্যন্ত বাজে নমুনা টেক্সট নিয়ে ছিলাম, তারা আর বইটির কাজ নেয়নি।
এরপর বছর দুয়েক বাদে যখন আমি লন্ডন বুক ফেয়ারে গিয়েছিলাম, কোরিয়ার বইয়ের বাজারকে বিশেষভাবে সামনে আনার একবছর আগে, যখন তাদের কাছে এর মধ্যেই তৈরি হওয়া প্রতিশ্রুতিশীল কয়েকজন কোরিয়ান লেখকও ছিলেন, তাঁরা আমাকেও দাওয়াত দেন, তখন সম্পাদক ম্যাক্স পোর্টারের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। তিনি তখন কোনো কোরিয়ান ভালো মানের বইয়ের বিষয়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, সঙ্গে সঙ্গেই আমার মনে হয় যে ‘দ্য ভেজিটারিয়ান’ বইটা তাদের জন্য ঠিক হবে। আমি তাঁকে ঘষে-মেজে যতœ করে সম্পাদনা করে অপেক্ষাকৃত ভালো একটা টেক্সটের নমুনা পাঠিয়েছিলাম, সেই সঙ্গে বইটার সর্বজনীন তথ্য। পরের দিন ফিরতি ই-মেইলে তিনি জানান যে, বইটা তাঁর পছন্দ হয়েছে।
মা. রে. : কোরিয়ায় একজন মানুষের নিরামিশাষী হওয়া কি অস্বাভাবিক বিষয়, আপনি কেন এরকম একটা বিশেষ অসঙ্গতিপূর্ণ বিষয়কে নীরিক্ষার জন্য বেছে নিলেন?
হা. কা. : প্রথমত, পশ্চিমাদের মতো আমরা কোরিয়ানরা এত বেশি মাংস খাই না। আমরা টোফু, বীন কার্ড এবং অন্যান্য শাকসবজি বেশি খাই। কোরিয়ানরা নিরামিশাষী হলেও ওভাবে বলে না, কারণ তাদের খাবার টেবিলে মাংস পরিবেশন করা হলেও প্রচুর শাকসবজির প্রাচুর্য থাকার কারণে ব্যক্তিগত খাবার থেকে চাইলেই মাংস বাদ দিয়ে দিতে পারেন। কাজেই যেভাবে আমার প্রধান চরিত্র ইয়ং-হাই বলেছেন ‘আমি একজন নিরামিশাষী’, ওভাবে বলাটা একটা বিশাল ঘোষণা। ইয়ং-হাইয়ের জন্য নিরামিষ খাওয়াটা ছিল মানুষের জীবনের বিরুদ্ধে, সহিংসতার বিরুদ্ধে একটা প্রতিবাদ এবং যেটাকে সে হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করেছে। এ কারণেই নিরামিষ ভোজনকে বিশুদ্ধ হওয়ার পরিপূর্ণতাবাদী উপায় হিসেবে দেখেছেন, এই প্রতিবাদ, কোনো ধরনের সহিংসতা ছাড়াই বিশুদ্ধতা।
মা. রে. : আপনার সৃজনশীলতায় কী পরিমাণ রূপান্তর, আত্মপরিচয় অনুসন্ধান এবং আত্মপ্রতিষ্ঠার মতো বার বার ব্যবহৃত হওয়া বিষয়গুলো অবলম্বিত হয়েছে?
হা. কা. : আমার মধ্যে এ প্রশ্নটা সবসময় ছিল, মানুষ হয়ে ওঠা কি, মানুষ হওয়া হলো অনবরত অন্তহীনতার সঙ্গে বেঁচে থাকা।
বছরখানেক আগে ২০১৩ সালে একজন কিশোরকে নিয়ে একটা গল্প লিখেছিলাম, ১৯৮০ সালের গাওয়ানজু গণহত্যার সঙ্গে সম্পর্কিত, ঐ সময় আমার বয়স ছিল নয় বছর, এই ঘটনাটা আমার লেখালেখিতে বিশাল প্রভাব ফেলেছে। ওটাই ছিল সেই অনন্ত প্রশ্নের ভিত্তি, এটার মানে হলো আমাদের মানবিক হতে হবে এবং আমাদের এই বিষয়টা মেনে নিতে হবে যে আমরা মানুষ। এই বইয়ে ইয়ং-হাই তার শরীরকে রূপান্তর করতে চেয়েছেন। “গ্রিক লেসন” নামে আরেকটা উপন্যাসে একটা চরিত্র ছিল যে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল, ভাষাকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। তো তাই, যে তিনটি বিষয় আপনি উল্লেখ করেছেন, সেগুলো নিশ্চয়ই আমার উপন্যাসের বিষয় হিসেবে ব্যবহৃত হতেই থাকে।
মা. রে. : মলিন, গতানুগতিক এবং নিরাপদ-দূরত্বে থাকা মি. চেং নিশ্চিতভাবেই কিন্তু স্ফুলিঙ্গ ছড়ানো ইয়ং-হাইকে তার নিষ্ক্রিয় প্রতিবাদ এবং মানসিক অস্থিরতার বিষয়ে দোষারোপ করতে পারেন; সেখানে ইন-হাইয়ের স্বামী ‘জে’ সামাজিক আচরণের সীমাকে মাত্রাছাড়া করেছেন। যাকে এই বইয়ের সর্বোচ্চ বিধ্বংসী অথবা সবচেয়ে বেশি বিপজ্জনক চরিত্র হিসেবে আপনি দেখিয়েছেন?
হা. কা. : প্রথমত, ইয়ং-হাই মানবতার রক্ষার জন্য আত্মত্যাগের সামর্থ্যের বিষয়ে সচেতন ছিলেন, এভাবে বলা যায়, এমন একটা ছোট্ট শিশু যে কিনা ট্রেনের লাইনের মধ্যে পড়ে গেছে। কিন্তু ইয়ং-হাই একই সঙ্গে সেই চূড়ান্ত সহিংসতার বিষয়টাকে সহ্য করার ক্ষেত্রেও সমর্থ জগতের বাকি পরিপূর্ণ মানবাত্মার মতোই। মানুষের প্রকৃতির এই বিস্তৃত বর্ণচ্ছটার বিষয়ে সচেতন থেকেই, ইয়ং-হাই এসব নির্মূল করতে চেষ্টা করে গেছেন, মানুষ হবার জন্য হিংসাত্মক দিক থেকে নিজেকে পুরোপুরি মুক্ত করতে চেষ্টা করে গেছেন, এবং সে কারণেই তিনি একজন নিরামিষভোজী হতে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আমি উদ্দেশ্যমূলকভাবেই ইয়ং-হাইকে কোনো কণ্ঠস্বর দিইনি। তাকে একসময়কার ঘৃণার বস্তু, ভীতির বস্তু অথবা করুণা বা সহানুভূতির বস্তু হিসেবে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে, এবং কখনো এই বস্তুকে পুরোপুরি ভুল বোঝা হয়েছে। আমি চাই যে পাঠকেরাই তার সত্যিকারের চেহারা তৈরি করুক। কারণ এই সবকিছুর তির্যক দিক তার কাছেই নিয়ে যায়, আমরা তার প্রকৃত সত্যটাকে সত্যিই দেখতে পাই না, কিন্তু আমি আশা করি যে যদি আপনি এই তির্যক দিকগুলোকে অনুসরণ করতে থাকেন, আপনি শেষাবধি ইয়ং-হাইকে পেয়েই যাবেন।
মা. রে. : শুধু একবার আমরা ইয়ং-হাইকে শুনতে পাই সেই স্বপ্ন-পরম্পরার মধ্যে, যেটা আসলে বিশেষভাবে আঘাতমূলক।
হা. কা. : হ্যাঁ শুধুমাত্র সেই একবারই।
দেবরাহ স্মিথ : আমার কাছে মনে হয়, উপন্যাসের সবচেয়ে বিধ্বংসী চরিত্র হিসেবে যাকে উপস্থাপন করা হয়েছে, অথবা যে চরিত্রটা সবচেয়ে কৌতূহলোদ্দীপক চরিত্র হিসেবে সামনে এসেছে, কারণ অন্য পার্শ্বচরিত্রগুলো ইয়ং-হাইয়ের বোন ইন-হাইকে কীভাবে দেখে, এভাবে দেখা বেশ সোজা যে ইয়ং হাই একজন ভয়-জাগানিয়া কিছু অথবা সম্মান হারানোর মতো বা আকাক্সক্ষার অবদমনকারী একজন, কিন্তু একেবারে শেষে গিয়ে ইন-হাই ইয়ং-হাইকে ঈর্ষা করার লক্ষ্যবস্তু হিসেবে খুঁজে পেল। ইন-হাই নিজে একজন কর্তব্যপরায়ণ কন্যা, স্ত্রী, মা বোন, সে নিজে একটি সম্পূর্ণ গতানুগতিক সামাজিক জীবন যাপন করেন, আর তার বোন সেখানে মলিনতর হচ্ছে। ইন-হাই তাকে খুব দয়া করত, সে বোনকে বুঝতে চায়, সে রেগে ওঠে, কিন্তু ইয়ং-হাই যেভাবে সম্পূর্ণ ভয় মুক্ত যে অবস্থাটা সে নিজের জন্যও প্রত্যাশা করে, তখন এটাতে সে ঈর্ষাকাতর হয়ে পড়ে বোনের প্রতি। এখানে একটা অনুচ্ছেদ আছে যেখানে সে ইয়ং-হাইয়ের মতো কিছু একটা বলে যেটা অনেক অনেক উচ্চে উড়ান দিতে চায়, এবং তাকে মাটিতেই ফেলে রেখে যায়। সে অনুভব করে যে ইয়ং-হাইয়ের আত্মত্যাগের মধ্যে একধরনের মুক্তির স্বাদ লুকানো আছে, এমনকি যদিও সেখানে নিশ্চিতভাবে তাকে বেশ বড় ধরনের মূল্য পরিশোধ করতে হয়।
মা. রে. : ‘মঙ্গোলিয়ান মার্ক’ প্রবল তীব্র এবং যৌনতায় অভিযুক্ত মধ্যম গল্প, আমাকে ইয়ানসুরি কাওয়াবাতার ‘হাউজ অব দ্য স্লিপিং বিউটিস’-এর কথা মনে করিয়ে দেয়। কোন লেখক, যদি কেউ থাকেন, আপনার লেখাকে সবচেয়ে কে বেশি প্রভাবিত করেছেন?
হা. কা. : আমি ঐ গল্পটা সম্পর্কে জানি না। সম্ভবত এই গল্পটা কোরিয়ান ভাষায় অনূদিত হয়নি। ‘দ্য ভেজিটারিয়ান’ লেখার আগে, ‘দ্যা ফ্রুট অব মাই ওম্যান’ নামের একটা ছোটো গল্প লিখেছিলাম, ওটা ছিল এমন একজন নারীর বিষয়ে যিনি গাছে রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছিলেন, তিনি গাছ হয়ে যাবার পরে তার স্বামী তাকে একটা টবের মধ্যে রেখে দিয়েছিলেন, কিন্তু তখন পর্যন্ত স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্ক ভালো ছিল না। আমি গল্পটাকে আরো বড় করে লিখতে চেয়েছিলাম, এবং এরপর আমি বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়েই এই বইটা লিখতে শুরু করি, কিন্তু বইটা সম্পূর্ণ ভিন্ন চেহারা নিয়ে নেয়, ভীষণ অন্ধকার। সম্প্রতি আমি বার্লিনে একটা পাঠচক্রে যোগ দিই এবং সেখানের বিষয়বস্তু ছিল কাফকার মেটামরফোসিসের সঙ্গে আমার বইকে তুলনা করা। একজন আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, আমি কি কাফকার লেখা থেকে অনুপ্রাণিত? কিন্তু আমার মনে হয়, প্রত্যেকেই তার প্রাক-কৈশোরে কাফকা পড়ে ফেলে, এবং আমার এও মনে হয় মেটামরফোসিস আমাদের জীবনের অংশ হয়ে ওঠে, কাজেই আমি এটা বলতে পারবো না যে এটা কোনো সরাসরি প্রভাব। একজন প-িতের বিষয়ে একটা প্রাচীন কোরিয়ান গল্প প্রচলিত আছে, যিনি একবার সারাদিনের কঠোর পরিশ্রম শেষে একটা কক্ষের দরজা খুললেন, ভিতরে ঢুকলেন, সেই ঘরটা গাছে ভর্তি ছিল। তিনি গাছগুলোর সঙ্গে কথা বললেন এবং তিনি গাছগুলোর মধ্যে ঘুমালেন এবং এভাবেই তিনি নিজের শান্তিকে খুঁজে নিলেন। এটাও এমন নয় যে আমি ঐ গল্পকথকের পদচিহ্ন ধরে নিজের গল্পটা লিখেছি, কিন্তু আমি মনে করি, এসব ছোটো ছোটো ঘটনাই আমার অনুপ্রেরণা হিসেবে সংযুক্ত হতে থাকে। এটা খুব চমৎকার একটা প্রতিমূর্তি, এই ইমেজ আমাকে অনুপ্রাণিত করে যে একজন নারী একটি গাছে বদলে গেল।
মা. রে. : আরেকটা বিস্তারিত প্রশ্ন করতে চাই, কোরিয়ার পুরনো মূল্যবোধের জায়গাটা কি চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে,Ñ আর পরম্পরাগত সমাজব্যবস্থার দৃষ্টিভঙ্গিই বা কী, যদি থেকে থাকে, এগুলো কি মূল্যবান?
হা. কা. : কোরিয়া খুব দ্রুত অনেক রকম পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু আমি বলবো না যে সবকিছুই ভেঙ্গেচুরে যাচ্ছে বা ধ্বসে পড়ছে। অন্যদিকে প্রচুর বিষয় একরকম বর্ণসঙ্করও তৈরি হচ্ছে, মিশ্র সংস্কৃতি। আমার জন্ম ১৯৭০ সালে এবং ১৯৮০ সালে সিউলে চলে আসার পূর্ব পর্যন্ত আমি গ্রামে একটা পরম্পরাগত সামাজিক অবস্থার মধ্যে বসবাস করতাম, যেখানে আমি একধরনের ঘনিষ্ঠ পারিবারিক সামাজিক বাতাবরণের মধ্যে ছিলাম। লোকজন সেখানে একে অন্যের প্রতিবেশিদের চিনত জানত। কিন্তু ওটা ছিল আমার জন্য সংক্ষিপ্ত একটা সময়, এবং সিউলে চলে আসার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত সীমায়িত। আমার মনে হয় ওটা ছিল আমাদের কোরিয়ার পরম্পরাবোধের একটা বিশেষ অংশ।
মা. রে. : কোরিয়ার নারী লেখকেরা তাদের নতুন অভিযাত্রায় ১৯৮০ সাল থেকে কীভাবে তাদের সাহিত্যিক মানচিত্র বদলে ফেললেন?
হা. কা. : ১৯৯৩ সালে আমার প্রথম গ্রন্থ প্রকাশের সময়ে, কোরিয়ায় প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, কাজেই মানুষ তখন বিভিন্ন ধরনের লেখা লিখছিল। তখন পর্যন্ত বিশেষ করে ১৯৮০-র লেখকেরা, গণতন্ত্রীকরণ অথবা সরকারের বিরুদ্ধে যাওয়া রচনার বিষয়গুলোকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে, এবং আমি মনে করি, তারা বরং এসব নিয়ে চাপের মধ্যেই ছিল। আমার সৌভাগ্য যে আমাকে ওসব বিষয়ের চাপ নিতে হয়নি। কাজেই আমিসহ নব্বই দশকের লেখকেরা আশির দশকের লেখকদের চেয়ে অনেক বেশি প্রাগ্রসর হতে পেরেছি।
দে স্মি : আমার মনে হয় কাং শুধু নারী লেখক নন, সকল লেখকদের বিষয়ে সাধারণভাবে কথাটা বলেছেন। এখানে আরও বিস্তৃত বিষয় আছে যেগুলোকে অন্বেষণ করা যায়, বেশ শক্তিশালী, আদর্শগত, রাজনৈতিক, সমাজ-বাস্তবতার বিষয়গুলো লেখা হয়েছে, যেগুলো বিশেষভাবে পুরুষ লেখকদের চেয়ে নারী লেখকেরা বেশি গুরুত্ব দিয়েছে, এর কারণ সাহিত্যচর্চার এই ক্ষেত্রগুলো পুরুষলেখকদের চেয়ে নারীদের ক্ষেত্রে অনেক বেশি সম্ভাবনাময় ছিলো। গণতন্ত্রায়ণের পর একেবারে ব্যক্তিগত বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করার জন্য অনেক বেশি অবসর পাওয়া গেছে, যে বিষয়গুলো কোনো জাতীয় অথবা সামরিক বিষয় নয়, অথবা পুরুষমানুষ সহজে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে এমন বাহ্যিক বিষয়ও নয়, অনেক বেশি অর্ন্তগত বিষয় যেগুলোতে নারীরা কাজ করেছে।
মা. রে. : এই বইটা তো এর মধ্যেই কোরিয়ায় প্রকাশিত হয়ে গেছে, সাড়া কেমন পাচ্ছেন?
হা. কা. : যথেষ্ট সাড়া ফেলেছে।
মা. রে. : অন্য কোন কোরিয়ান লেখকদের লেখা পাঠ করা উচিত?
হা. কা. : আমি মনে করি বেশি বয়সী, প্রতিষ্ঠিত লেখকদের যথেষ্ট পরিচিত আছে, আমি বরং সমকালীন লেখকদের সামনে দেখতে চাই, যেমন হোয়ান জাং-ইয়ুয়েন।
মা. রে. : লেখক কোরিয়ান নন, এমন কোন লেখকের লেখা বই সম্প্রতি আপনি পড়েছেন?
হা. কা. : গত বছর সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত আমি পোল্যান্ডে ছিলাম, তখন আমি প্রচুর পোলিশ লেখকদের লেখা পড়েছি। ওলগা তোকারজুকের বই পাঠ আমি সত্যিই উপভোগ করেছি। এছাড়াও দেবরাহ লেভি-র ‘সুইমিং হোম’ বইটা পড়ে আনন্দ পেয়েছি।
মা. রে. : কাং আপনি ক্রিয়েটিভ রাইটিং পড়ান, আপনার শিক্ষার্থীদের জন্য আপনি প্রথম কি উপদেশ দেন?
হা. কা. : সাত বছর হলো আমি পড়ানো শুরু করেছি, এবং সবসময় এটা নিয়ে ভাবি যে সাহিত্যের কোন অংশটা আমি সত্যিই শেখাতে পারব। আমার মনে হয় ছাত্রদের নিজেদেরই শেখা উচিত, তাই আমার প্রথম পরামর্শ হলো প্রচুর পড়ো, পড়ার মধ্যে ডুবে যাও। ব্যাস এটাই।
মা. রে. : আর দেবরাহ, যদি কেউ সাহিত্যের অনুবাদক হতে চায়, তো তার জন্য আপনার কী পরামর্শ থাকবে?
দে স্মি : একেবারে সেই একই পরামর্শ, প্রচুর পড়ো। অনুবাদ করার ক্ষেত্রে সাহিত্যিক সংবেদনশীলতা হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিশেষ করে কোরিয়ার ক্ষেত্রে এখন যে সব বিষয়ে চোখ রাখা হচ্ছে সে সব বিষয় নয় কিন্তু। অনুবাদের ক্ষেত্রে আসল হলো সাংস্কৃতিক জ্ঞান-সেই সঙ্গে পর্যাপ্ত ভাষাগত জ্ঞান থাকা দরকার বলে মনে করি। কারণ, আমার বেড়ে ওঠা সম্পূর্ণ আলাদা প্রতিবেশ, পরিবেশ ও সংস্কৃতি থেকে, প্রত্যেকটা শব্দের অর্থ কী হবে সেটা জানা থেকেও আমি বিশেষভাবে জোর দিতে চাই একটা বিস্তৃত সাহিত্যিক সচেতনতাকে। যখন অনুবাদ শুরু করি তখন কিন্তু আমি নিশ্চিতভাবে জানি না যে প্রতিটি শব্দের মানে কী হবে, এবং প্রতিটি আলাদা আলাদা শব্দের আলাদা করে অর্থ কী হবে আমি এখনো কিন্তু জানি না, তবে, কেয়ং-সু-এর মতো আমার বেশ কয়েকজন কোরিয়ান বন্ধু আছে, যাদের আমি জিজ্ঞাসা করতে পারি, এবং এখন ইন্টারনেট আছে, ডিকশনারিও আছে। কিন্তু পৃথিবীতে এমন কোনো ডিকশনারি নেই যেটা আপনাকে বলে দেবে সাহিত্য কী। একেবারে চর্চাগত জায়গা থেকে, অন্যান্য অনুবাদকের সঙ্গে কথা বলুন, এমনকি আপনি যে ভাষা নিয়ে কাজ করছেন তারা যদি সেই ভাষা নিয়ে কাজ না-ও করে থাকেন তাহলেও কথা বলুন। লন্ডনে, আমরা সৌভাগ্যবান যে, আমাদের এমার্জিং ট্রান্স্লেশন নেটওয়ার্ক আছে। আমেরিকান লিটারেরি ট্রানস্লেশন অ্যাসোসিয়েশন এই একইভাবে সৃষ্টি হয়েছে, এবং কোরিয়ায় সাহিত্যিক অনুবাদ সংস্থা অবিশ্বাস্যভাবে তেমন-ই সহযোগিতামূলক এবং এদের যোগাযোগের মাত্রা খুবই ভাল। কাজেই নিজের জায়গায় বসে কোনো চেষ্টা করবেন না আর ভাববেন, এসব কিছু এমনি এমনি হয়ে যাবে, এমন হয় না।
পরিচিতি :
হান কাং কোরিয়ার গাওয়ানজু প্রদেশে ১৯৭০ সালে জন্মগ্রহন করেন এবং দশ বছর বয়সে রাজধানী সিউলে চলে যান, পরে তিনি ইয়োনসেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোরিয়ান সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা শেষ করেন। ১৯৯৩ সালে তিনি একজন কবি হিসেবে নিজের সাহিত্যিক পরিচয়ে আত্মপ্রকাশ করেন। এরপর তার কয়েকটি গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয় যার মধ্যে রয়েছে, লাভ ইন ইয়েসু, এ ইয়েলো প্যাটার্ন ইটারনিটি, এবং দ্য ফ্রুটস অব মাই ওম্যান। আরও প্রকাশিত হয় উপন্যাস ইয়োর কোল্ড হ্যান্ড, ব্ল্যাক ডিয়ার, গ্রিক লেসনস এবং দ্যা ভেজিটারিয়ান। তাঁর সাহিত্য যেসকল উল্লেখযোগ্য সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছে সেগুলো হল ই স্যাং লিটারারি প্রাইজ, টুডেস ইয়াং আর্টিস্ট অ্যাওয়ার্ড এবং কোরিয়ান লিটারেচার নভেল অ্যাওয়ার্ড। সিউল ইনস্টিটিউট অব আর্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি সম্প্রতি শিক্ষকতা করছেন। দ্য ভেজিটারিয়ান পোর্তোবেলো বুকস প্রকাশনি থেকে প্রকাশিত হয়েছে।
*
দেবরাহ স্মিথ হান কাং-এর উপন্যাস ‘দ্য ভেজিটারিয়ান’ অনুবাদ করেছেন, যেটা জানুয়ারি ২০১৬ সালে প্রকাশিত হয়েছে। এই দ্য ভেজিটারিয়ান উপন্যাস অনুবাদের পাশাপাশি তিনি বে সুহ-র বেশ কয়েকটা বই অনুবাদ করেছেন, যার মধ্যে রয়েছে, ইজিয়েস্ট ডেস্ক এবং দ্য লো হিল অব সিউল। তিনি সম্প্রতি কোরিয়ান সাহিত্যে এসওএএস থেকে পিএইচডি ডিগ্রি সম্পন্ন করেছেন, এবং নন-ইউরোপিয়ান ভাষার প্রেস টাইটেল এক্সিস নামে নট-ফর-প্রফিট প্রেস স্থাপিত করেছেন।
কেয়ং-সু কিম একজন ফ্রিল্যান্সার দোভাষী যিনি কোরিয়ান লিটারেচার ইন ট্রান্সেলেশন বিষয়ে এসওএএস থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জনের জন্য চেষ্টা করছেন।
মার্ক রেনল্ড একজন ফ্রিল্যান্স সম্পাদক এবং লেখক, এবং ‘বুকানিস্তা’র একজন প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক।
ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ : বিপাশা মন্ডল
বৃহস্পতিবার, ১৭ অক্টোবর ২০২৪
সাক্ষাৎকারটি শিল্প-সাহিত্যবিষয়ক ওয়েব ম্যাগাজিন ‘বুকানিস্তা’য় ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত হয়েছিল। সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন বুকানিস্তা-সম্পাদক মার্ক রেনল্ড। তাঁর সঙ্গে ছিলেন কাংয়ের অনুবাদক দেবরাহ স্মিথ এবং দোভাষী কিম সু কেয়ং। মূল সাক্ষাৎকারটি অনেক দীর্ঘ হওয়ায় সেখান থেকে চুম্বক অংশ বাংলায় অনুবাদ করে প্রকাশ করা হলো।
[ইংরেজি ভাষায় হান কাং-এর প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস দ্য ভেজিটারিয়ান, উপন্যাসটিতে লেখক লজ্জা, নিঃসঙ্গতা, ক্রোধ, ক্ষোভ, রূপান্তর এবং সমকালীন দক্ষিণ কোরিয়ার মানুষের আশা-আকাক্সক্ষাকে চমকপ্রদ, ভয়জাগানিয়া ও কাব্যসুলভ ভঙ্গিতে উপস্থাপন করেছেন। এ উপন্যাসে বিধৃত আত্মপরিচয় এবং মানবিকতার বিষয়টি সাক্ষাৎকারে প্রাধান্য পেয়েছে।]
মার্ক রেনল্ড : তিনটি ছোটো নভেলা হিসেবে ‘দ্য ভেজিটারিয়ান’ কোরিয়াতে প্রকাশিত হয়েছিল। ওখানে কি সবসময় এভাবেই বই প্রকাশ করে? প্রথমবার প্রকাশের আগে কি তিনটাই লিখে শেষ করে ফেলেছিলেন? ছোটো আকারের উপন্যাসের ধারাবাহিক প্রকাশনা করা কোরিয়াতে কি এতোটাই অস্বাভাবিক যে সেই প্রকাশনা এখানে করতে হবে?
হান কাং : কোরিয়াতে এটা চলে, সিক্যুয়েল উপন্যাস প্রথমে আলাদা করে ছাপা হয়, পরে একত্রে ছাপা হয়। অনেক হচ্ছে এমন নয়, কিন্তু আমি বলবো আমাদের এখানে যুক্তরাজ্যের চেয়ে বেশি সিরিয়াল উপন্যাস রয়েছে। আমি এই গল্পগুলো ২০০০ সালে লিখতে শুরু করি, প্রথম দু’খ- দু’বছরের মধ্যে লিখে ফেলি, এরপর এগুলো প্রকাশিত হয়। অনেক পরে তৃতীয় খ- লিখি।
মা. রে. : দেবরাহ, আপনি প্রথম কখন ‘দ্য ভেজিটারিয়ান’ উপন্যাসটা দেখেন, এবং এর অনুবাদক কীভাবে হলেন?
দেবরাহ স্মিথ : ‘এন্ড আদার স্টোরিস’ বইটা হাতে পাই ২০১১ সালের দিকে, আমাকে বলা হয়েছিল একজন পাঠকের প্রতিক্রিয়া হিসাবে কিছু লিখে দিতে, এছাড়া এই বইয়ের লেখার উদাহরণ হিসেবে টেক্সটের একটা ক্ষুদ্র অংশও অনুবাদ করতে। তখন মোটে দেড় বছর হয় আমি কোরিয়ান ভাষা শিখছি, তাই বইটা সম্পর্কে জানতাম, কারণ কোরিয়ান সাহিত্য অনুবাদ করতে আমি আগ্রহীও ছিলাম, কিন্তু প্রকাশ করার মতো কিছু করতে পারিনি, এবং তখন আমি সত্যিই জানতাম না পাঠকের প্রতিক্রিয়া কীভাবে লেখা হয়, উদাহরণ হিসেবে নমুনা টেক্সট কীভাবে বাছাই ও অনুবাদ করতে হয় আমার তখন সে ধারণাও ছিল না। অতি উৎসাহে আমি হ্যাঁ তো বলে দিয়েছিলাম, কিন্তু পরে অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে তাদের গিয়ে জানালাম যে, আমি এর আগে কোনো কোরিয়ান ভাষায় লেখা বই পড়িনি। কাজেই আমি একটি অত্যন্ত বাজে নমুনা টেক্সট নিয়ে ছিলাম, তারা আর বইটির কাজ নেয়নি।
এরপর বছর দুয়েক বাদে যখন আমি লন্ডন বুক ফেয়ারে গিয়েছিলাম, কোরিয়ার বইয়ের বাজারকে বিশেষভাবে সামনে আনার একবছর আগে, যখন তাদের কাছে এর মধ্যেই তৈরি হওয়া প্রতিশ্রুতিশীল কয়েকজন কোরিয়ান লেখকও ছিলেন, তাঁরা আমাকেও দাওয়াত দেন, তখন সম্পাদক ম্যাক্স পোর্টারের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। তিনি তখন কোনো কোরিয়ান ভালো মানের বইয়ের বিষয়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, সঙ্গে সঙ্গেই আমার মনে হয় যে ‘দ্য ভেজিটারিয়ান’ বইটা তাদের জন্য ঠিক হবে। আমি তাঁকে ঘষে-মেজে যতœ করে সম্পাদনা করে অপেক্ষাকৃত ভালো একটা টেক্সটের নমুনা পাঠিয়েছিলাম, সেই সঙ্গে বইটার সর্বজনীন তথ্য। পরের দিন ফিরতি ই-মেইলে তিনি জানান যে, বইটা তাঁর পছন্দ হয়েছে।
মা. রে. : কোরিয়ায় একজন মানুষের নিরামিশাষী হওয়া কি অস্বাভাবিক বিষয়, আপনি কেন এরকম একটা বিশেষ অসঙ্গতিপূর্ণ বিষয়কে নীরিক্ষার জন্য বেছে নিলেন?
হা. কা. : প্রথমত, পশ্চিমাদের মতো আমরা কোরিয়ানরা এত বেশি মাংস খাই না। আমরা টোফু, বীন কার্ড এবং অন্যান্য শাকসবজি বেশি খাই। কোরিয়ানরা নিরামিশাষী হলেও ওভাবে বলে না, কারণ তাদের খাবার টেবিলে মাংস পরিবেশন করা হলেও প্রচুর শাকসবজির প্রাচুর্য থাকার কারণে ব্যক্তিগত খাবার থেকে চাইলেই মাংস বাদ দিয়ে দিতে পারেন। কাজেই যেভাবে আমার প্রধান চরিত্র ইয়ং-হাই বলেছেন ‘আমি একজন নিরামিশাষী’, ওভাবে বলাটা একটা বিশাল ঘোষণা। ইয়ং-হাইয়ের জন্য নিরামিষ খাওয়াটা ছিল মানুষের জীবনের বিরুদ্ধে, সহিংসতার বিরুদ্ধে একটা প্রতিবাদ এবং যেটাকে সে হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করেছে। এ কারণেই নিরামিষ ভোজনকে বিশুদ্ধ হওয়ার পরিপূর্ণতাবাদী উপায় হিসেবে দেখেছেন, এই প্রতিবাদ, কোনো ধরনের সহিংসতা ছাড়াই বিশুদ্ধতা।
মা. রে. : আপনার সৃজনশীলতায় কী পরিমাণ রূপান্তর, আত্মপরিচয় অনুসন্ধান এবং আত্মপ্রতিষ্ঠার মতো বার বার ব্যবহৃত হওয়া বিষয়গুলো অবলম্বিত হয়েছে?
হা. কা. : আমার মধ্যে এ প্রশ্নটা সবসময় ছিল, মানুষ হয়ে ওঠা কি, মানুষ হওয়া হলো অনবরত অন্তহীনতার সঙ্গে বেঁচে থাকা।
বছরখানেক আগে ২০১৩ সালে একজন কিশোরকে নিয়ে একটা গল্প লিখেছিলাম, ১৯৮০ সালের গাওয়ানজু গণহত্যার সঙ্গে সম্পর্কিত, ঐ সময় আমার বয়স ছিল নয় বছর, এই ঘটনাটা আমার লেখালেখিতে বিশাল প্রভাব ফেলেছে। ওটাই ছিল সেই অনন্ত প্রশ্নের ভিত্তি, এটার মানে হলো আমাদের মানবিক হতে হবে এবং আমাদের এই বিষয়টা মেনে নিতে হবে যে আমরা মানুষ। এই বইয়ে ইয়ং-হাই তার শরীরকে রূপান্তর করতে চেয়েছেন। “গ্রিক লেসন” নামে আরেকটা উপন্যাসে একটা চরিত্র ছিল যে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল, ভাষাকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। তো তাই, যে তিনটি বিষয় আপনি উল্লেখ করেছেন, সেগুলো নিশ্চয়ই আমার উপন্যাসের বিষয় হিসেবে ব্যবহৃত হতেই থাকে।
মা. রে. : মলিন, গতানুগতিক এবং নিরাপদ-দূরত্বে থাকা মি. চেং নিশ্চিতভাবেই কিন্তু স্ফুলিঙ্গ ছড়ানো ইয়ং-হাইকে তার নিষ্ক্রিয় প্রতিবাদ এবং মানসিক অস্থিরতার বিষয়ে দোষারোপ করতে পারেন; সেখানে ইন-হাইয়ের স্বামী ‘জে’ সামাজিক আচরণের সীমাকে মাত্রাছাড়া করেছেন। যাকে এই বইয়ের সর্বোচ্চ বিধ্বংসী অথবা সবচেয়ে বেশি বিপজ্জনক চরিত্র হিসেবে আপনি দেখিয়েছেন?
হা. কা. : প্রথমত, ইয়ং-হাই মানবতার রক্ষার জন্য আত্মত্যাগের সামর্থ্যের বিষয়ে সচেতন ছিলেন, এভাবে বলা যায়, এমন একটা ছোট্ট শিশু যে কিনা ট্রেনের লাইনের মধ্যে পড়ে গেছে। কিন্তু ইয়ং-হাই একই সঙ্গে সেই চূড়ান্ত সহিংসতার বিষয়টাকে সহ্য করার ক্ষেত্রেও সমর্থ জগতের বাকি পরিপূর্ণ মানবাত্মার মতোই। মানুষের প্রকৃতির এই বিস্তৃত বর্ণচ্ছটার বিষয়ে সচেতন থেকেই, ইয়ং-হাই এসব নির্মূল করতে চেষ্টা করে গেছেন, মানুষ হবার জন্য হিংসাত্মক দিক থেকে নিজেকে পুরোপুরি মুক্ত করতে চেষ্টা করে গেছেন, এবং সে কারণেই তিনি একজন নিরামিষভোজী হতে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আমি উদ্দেশ্যমূলকভাবেই ইয়ং-হাইকে কোনো কণ্ঠস্বর দিইনি। তাকে একসময়কার ঘৃণার বস্তু, ভীতির বস্তু অথবা করুণা বা সহানুভূতির বস্তু হিসেবে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে, এবং কখনো এই বস্তুকে পুরোপুরি ভুল বোঝা হয়েছে। আমি চাই যে পাঠকেরাই তার সত্যিকারের চেহারা তৈরি করুক। কারণ এই সবকিছুর তির্যক দিক তার কাছেই নিয়ে যায়, আমরা তার প্রকৃত সত্যটাকে সত্যিই দেখতে পাই না, কিন্তু আমি আশা করি যে যদি আপনি এই তির্যক দিকগুলোকে অনুসরণ করতে থাকেন, আপনি শেষাবধি ইয়ং-হাইকে পেয়েই যাবেন।
মা. রে. : শুধু একবার আমরা ইয়ং-হাইকে শুনতে পাই সেই স্বপ্ন-পরম্পরার মধ্যে, যেটা আসলে বিশেষভাবে আঘাতমূলক।
হা. কা. : হ্যাঁ শুধুমাত্র সেই একবারই।
দেবরাহ স্মিথ : আমার কাছে মনে হয়, উপন্যাসের সবচেয়ে বিধ্বংসী চরিত্র হিসেবে যাকে উপস্থাপন করা হয়েছে, অথবা যে চরিত্রটা সবচেয়ে কৌতূহলোদ্দীপক চরিত্র হিসেবে সামনে এসেছে, কারণ অন্য পার্শ্বচরিত্রগুলো ইয়ং-হাইয়ের বোন ইন-হাইকে কীভাবে দেখে, এভাবে দেখা বেশ সোজা যে ইয়ং হাই একজন ভয়-জাগানিয়া কিছু অথবা সম্মান হারানোর মতো বা আকাক্সক্ষার অবদমনকারী একজন, কিন্তু একেবারে শেষে গিয়ে ইন-হাই ইয়ং-হাইকে ঈর্ষা করার লক্ষ্যবস্তু হিসেবে খুঁজে পেল। ইন-হাই নিজে একজন কর্তব্যপরায়ণ কন্যা, স্ত্রী, মা বোন, সে নিজে একটি সম্পূর্ণ গতানুগতিক সামাজিক জীবন যাপন করেন, আর তার বোন সেখানে মলিনতর হচ্ছে। ইন-হাই তাকে খুব দয়া করত, সে বোনকে বুঝতে চায়, সে রেগে ওঠে, কিন্তু ইয়ং-হাই যেভাবে সম্পূর্ণ ভয় মুক্ত যে অবস্থাটা সে নিজের জন্যও প্রত্যাশা করে, তখন এটাতে সে ঈর্ষাকাতর হয়ে পড়ে বোনের প্রতি। এখানে একটা অনুচ্ছেদ আছে যেখানে সে ইয়ং-হাইয়ের মতো কিছু একটা বলে যেটা অনেক অনেক উচ্চে উড়ান দিতে চায়, এবং তাকে মাটিতেই ফেলে রেখে যায়। সে অনুভব করে যে ইয়ং-হাইয়ের আত্মত্যাগের মধ্যে একধরনের মুক্তির স্বাদ লুকানো আছে, এমনকি যদিও সেখানে নিশ্চিতভাবে তাকে বেশ বড় ধরনের মূল্য পরিশোধ করতে হয়।
মা. রে. : ‘মঙ্গোলিয়ান মার্ক’ প্রবল তীব্র এবং যৌনতায় অভিযুক্ত মধ্যম গল্প, আমাকে ইয়ানসুরি কাওয়াবাতার ‘হাউজ অব দ্য স্লিপিং বিউটিস’-এর কথা মনে করিয়ে দেয়। কোন লেখক, যদি কেউ থাকেন, আপনার লেখাকে সবচেয়ে কে বেশি প্রভাবিত করেছেন?
হা. কা. : আমি ঐ গল্পটা সম্পর্কে জানি না। সম্ভবত এই গল্পটা কোরিয়ান ভাষায় অনূদিত হয়নি। ‘দ্য ভেজিটারিয়ান’ লেখার আগে, ‘দ্যা ফ্রুট অব মাই ওম্যান’ নামের একটা ছোটো গল্প লিখেছিলাম, ওটা ছিল এমন একজন নারীর বিষয়ে যিনি গাছে রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছিলেন, তিনি গাছ হয়ে যাবার পরে তার স্বামী তাকে একটা টবের মধ্যে রেখে দিয়েছিলেন, কিন্তু তখন পর্যন্ত স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্ক ভালো ছিল না। আমি গল্পটাকে আরো বড় করে লিখতে চেয়েছিলাম, এবং এরপর আমি বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়েই এই বইটা লিখতে শুরু করি, কিন্তু বইটা সম্পূর্ণ ভিন্ন চেহারা নিয়ে নেয়, ভীষণ অন্ধকার। সম্প্রতি আমি বার্লিনে একটা পাঠচক্রে যোগ দিই এবং সেখানের বিষয়বস্তু ছিল কাফকার মেটামরফোসিসের সঙ্গে আমার বইকে তুলনা করা। একজন আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, আমি কি কাফকার লেখা থেকে অনুপ্রাণিত? কিন্তু আমার মনে হয়, প্রত্যেকেই তার প্রাক-কৈশোরে কাফকা পড়ে ফেলে, এবং আমার এও মনে হয় মেটামরফোসিস আমাদের জীবনের অংশ হয়ে ওঠে, কাজেই আমি এটা বলতে পারবো না যে এটা কোনো সরাসরি প্রভাব। একজন প-িতের বিষয়ে একটা প্রাচীন কোরিয়ান গল্প প্রচলিত আছে, যিনি একবার সারাদিনের কঠোর পরিশ্রম শেষে একটা কক্ষের দরজা খুললেন, ভিতরে ঢুকলেন, সেই ঘরটা গাছে ভর্তি ছিল। তিনি গাছগুলোর সঙ্গে কথা বললেন এবং তিনি গাছগুলোর মধ্যে ঘুমালেন এবং এভাবেই তিনি নিজের শান্তিকে খুঁজে নিলেন। এটাও এমন নয় যে আমি ঐ গল্পকথকের পদচিহ্ন ধরে নিজের গল্পটা লিখেছি, কিন্তু আমি মনে করি, এসব ছোটো ছোটো ঘটনাই আমার অনুপ্রেরণা হিসেবে সংযুক্ত হতে থাকে। এটা খুব চমৎকার একটা প্রতিমূর্তি, এই ইমেজ আমাকে অনুপ্রাণিত করে যে একজন নারী একটি গাছে বদলে গেল।
মা. রে. : আরেকটা বিস্তারিত প্রশ্ন করতে চাই, কোরিয়ার পুরনো মূল্যবোধের জায়গাটা কি চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে,Ñ আর পরম্পরাগত সমাজব্যবস্থার দৃষ্টিভঙ্গিই বা কী, যদি থেকে থাকে, এগুলো কি মূল্যবান?
হা. কা. : কোরিয়া খুব দ্রুত অনেক রকম পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু আমি বলবো না যে সবকিছুই ভেঙ্গেচুরে যাচ্ছে বা ধ্বসে পড়ছে। অন্যদিকে প্রচুর বিষয় একরকম বর্ণসঙ্করও তৈরি হচ্ছে, মিশ্র সংস্কৃতি। আমার জন্ম ১৯৭০ সালে এবং ১৯৮০ সালে সিউলে চলে আসার পূর্ব পর্যন্ত আমি গ্রামে একটা পরম্পরাগত সামাজিক অবস্থার মধ্যে বসবাস করতাম, যেখানে আমি একধরনের ঘনিষ্ঠ পারিবারিক সামাজিক বাতাবরণের মধ্যে ছিলাম। লোকজন সেখানে একে অন্যের প্রতিবেশিদের চিনত জানত। কিন্তু ওটা ছিল আমার জন্য সংক্ষিপ্ত একটা সময়, এবং সিউলে চলে আসার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত সীমায়িত। আমার মনে হয় ওটা ছিল আমাদের কোরিয়ার পরম্পরাবোধের একটা বিশেষ অংশ।
মা. রে. : কোরিয়ার নারী লেখকেরা তাদের নতুন অভিযাত্রায় ১৯৮০ সাল থেকে কীভাবে তাদের সাহিত্যিক মানচিত্র বদলে ফেললেন?
হা. কা. : ১৯৯৩ সালে আমার প্রথম গ্রন্থ প্রকাশের সময়ে, কোরিয়ায় প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, কাজেই মানুষ তখন বিভিন্ন ধরনের লেখা লিখছিল। তখন পর্যন্ত বিশেষ করে ১৯৮০-র লেখকেরা, গণতন্ত্রীকরণ অথবা সরকারের বিরুদ্ধে যাওয়া রচনার বিষয়গুলোকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে, এবং আমি মনে করি, তারা বরং এসব নিয়ে চাপের মধ্যেই ছিল। আমার সৌভাগ্য যে আমাকে ওসব বিষয়ের চাপ নিতে হয়নি। কাজেই আমিসহ নব্বই দশকের লেখকেরা আশির দশকের লেখকদের চেয়ে অনেক বেশি প্রাগ্রসর হতে পেরেছি।
দে স্মি : আমার মনে হয় কাং শুধু নারী লেখক নন, সকল লেখকদের বিষয়ে সাধারণভাবে কথাটা বলেছেন। এখানে আরও বিস্তৃত বিষয় আছে যেগুলোকে অন্বেষণ করা যায়, বেশ শক্তিশালী, আদর্শগত, রাজনৈতিক, সমাজ-বাস্তবতার বিষয়গুলো লেখা হয়েছে, যেগুলো বিশেষভাবে পুরুষ লেখকদের চেয়ে নারী লেখকেরা বেশি গুরুত্ব দিয়েছে, এর কারণ সাহিত্যচর্চার এই ক্ষেত্রগুলো পুরুষলেখকদের চেয়ে নারীদের ক্ষেত্রে অনেক বেশি সম্ভাবনাময় ছিলো। গণতন্ত্রায়ণের পর একেবারে ব্যক্তিগত বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করার জন্য অনেক বেশি অবসর পাওয়া গেছে, যে বিষয়গুলো কোনো জাতীয় অথবা সামরিক বিষয় নয়, অথবা পুরুষমানুষ সহজে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে এমন বাহ্যিক বিষয়ও নয়, অনেক বেশি অর্ন্তগত বিষয় যেগুলোতে নারীরা কাজ করেছে।
মা. রে. : এই বইটা তো এর মধ্যেই কোরিয়ায় প্রকাশিত হয়ে গেছে, সাড়া কেমন পাচ্ছেন?
হা. কা. : যথেষ্ট সাড়া ফেলেছে।
মা. রে. : অন্য কোন কোরিয়ান লেখকদের লেখা পাঠ করা উচিত?
হা. কা. : আমি মনে করি বেশি বয়সী, প্রতিষ্ঠিত লেখকদের যথেষ্ট পরিচিত আছে, আমি বরং সমকালীন লেখকদের সামনে দেখতে চাই, যেমন হোয়ান জাং-ইয়ুয়েন।
মা. রে. : লেখক কোরিয়ান নন, এমন কোন লেখকের লেখা বই সম্প্রতি আপনি পড়েছেন?
হা. কা. : গত বছর সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত আমি পোল্যান্ডে ছিলাম, তখন আমি প্রচুর পোলিশ লেখকদের লেখা পড়েছি। ওলগা তোকারজুকের বই পাঠ আমি সত্যিই উপভোগ করেছি। এছাড়াও দেবরাহ লেভি-র ‘সুইমিং হোম’ বইটা পড়ে আনন্দ পেয়েছি।
মা. রে. : কাং আপনি ক্রিয়েটিভ রাইটিং পড়ান, আপনার শিক্ষার্থীদের জন্য আপনি প্রথম কি উপদেশ দেন?
হা. কা. : সাত বছর হলো আমি পড়ানো শুরু করেছি, এবং সবসময় এটা নিয়ে ভাবি যে সাহিত্যের কোন অংশটা আমি সত্যিই শেখাতে পারব। আমার মনে হয় ছাত্রদের নিজেদেরই শেখা উচিত, তাই আমার প্রথম পরামর্শ হলো প্রচুর পড়ো, পড়ার মধ্যে ডুবে যাও। ব্যাস এটাই।
মা. রে. : আর দেবরাহ, যদি কেউ সাহিত্যের অনুবাদক হতে চায়, তো তার জন্য আপনার কী পরামর্শ থাকবে?
দে স্মি : একেবারে সেই একই পরামর্শ, প্রচুর পড়ো। অনুবাদ করার ক্ষেত্রে সাহিত্যিক সংবেদনশীলতা হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিশেষ করে কোরিয়ার ক্ষেত্রে এখন যে সব বিষয়ে চোখ রাখা হচ্ছে সে সব বিষয় নয় কিন্তু। অনুবাদের ক্ষেত্রে আসল হলো সাংস্কৃতিক জ্ঞান-সেই সঙ্গে পর্যাপ্ত ভাষাগত জ্ঞান থাকা দরকার বলে মনে করি। কারণ, আমার বেড়ে ওঠা সম্পূর্ণ আলাদা প্রতিবেশ, পরিবেশ ও সংস্কৃতি থেকে, প্রত্যেকটা শব্দের অর্থ কী হবে সেটা জানা থেকেও আমি বিশেষভাবে জোর দিতে চাই একটা বিস্তৃত সাহিত্যিক সচেতনতাকে। যখন অনুবাদ শুরু করি তখন কিন্তু আমি নিশ্চিতভাবে জানি না যে প্রতিটি শব্দের মানে কী হবে, এবং প্রতিটি আলাদা আলাদা শব্দের আলাদা করে অর্থ কী হবে আমি এখনো কিন্তু জানি না, তবে, কেয়ং-সু-এর মতো আমার বেশ কয়েকজন কোরিয়ান বন্ধু আছে, যাদের আমি জিজ্ঞাসা করতে পারি, এবং এখন ইন্টারনেট আছে, ডিকশনারিও আছে। কিন্তু পৃথিবীতে এমন কোনো ডিকশনারি নেই যেটা আপনাকে বলে দেবে সাহিত্য কী। একেবারে চর্চাগত জায়গা থেকে, অন্যান্য অনুবাদকের সঙ্গে কথা বলুন, এমনকি আপনি যে ভাষা নিয়ে কাজ করছেন তারা যদি সেই ভাষা নিয়ে কাজ না-ও করে থাকেন তাহলেও কথা বলুন। লন্ডনে, আমরা সৌভাগ্যবান যে, আমাদের এমার্জিং ট্রান্স্লেশন নেটওয়ার্ক আছে। আমেরিকান লিটারেরি ট্রানস্লেশন অ্যাসোসিয়েশন এই একইভাবে সৃষ্টি হয়েছে, এবং কোরিয়ায় সাহিত্যিক অনুবাদ সংস্থা অবিশ্বাস্যভাবে তেমন-ই সহযোগিতামূলক এবং এদের যোগাযোগের মাত্রা খুবই ভাল। কাজেই নিজের জায়গায় বসে কোনো চেষ্টা করবেন না আর ভাববেন, এসব কিছু এমনি এমনি হয়ে যাবে, এমন হয় না।
পরিচিতি :
হান কাং কোরিয়ার গাওয়ানজু প্রদেশে ১৯৭০ সালে জন্মগ্রহন করেন এবং দশ বছর বয়সে রাজধানী সিউলে চলে যান, পরে তিনি ইয়োনসেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোরিয়ান সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা শেষ করেন। ১৯৯৩ সালে তিনি একজন কবি হিসেবে নিজের সাহিত্যিক পরিচয়ে আত্মপ্রকাশ করেন। এরপর তার কয়েকটি গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয় যার মধ্যে রয়েছে, লাভ ইন ইয়েসু, এ ইয়েলো প্যাটার্ন ইটারনিটি, এবং দ্য ফ্রুটস অব মাই ওম্যান। আরও প্রকাশিত হয় উপন্যাস ইয়োর কোল্ড হ্যান্ড, ব্ল্যাক ডিয়ার, গ্রিক লেসনস এবং দ্যা ভেজিটারিয়ান। তাঁর সাহিত্য যেসকল উল্লেখযোগ্য সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছে সেগুলো হল ই স্যাং লিটারারি প্রাইজ, টুডেস ইয়াং আর্টিস্ট অ্যাওয়ার্ড এবং কোরিয়ান লিটারেচার নভেল অ্যাওয়ার্ড। সিউল ইনস্টিটিউট অব আর্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি সম্প্রতি শিক্ষকতা করছেন। দ্য ভেজিটারিয়ান পোর্তোবেলো বুকস প্রকাশনি থেকে প্রকাশিত হয়েছে।
*
দেবরাহ স্মিথ হান কাং-এর উপন্যাস ‘দ্য ভেজিটারিয়ান’ অনুবাদ করেছেন, যেটা জানুয়ারি ২০১৬ সালে প্রকাশিত হয়েছে। এই দ্য ভেজিটারিয়ান উপন্যাস অনুবাদের পাশাপাশি তিনি বে সুহ-র বেশ কয়েকটা বই অনুবাদ করেছেন, যার মধ্যে রয়েছে, ইজিয়েস্ট ডেস্ক এবং দ্য লো হিল অব সিউল। তিনি সম্প্রতি কোরিয়ান সাহিত্যে এসওএএস থেকে পিএইচডি ডিগ্রি সম্পন্ন করেছেন, এবং নন-ইউরোপিয়ান ভাষার প্রেস টাইটেল এক্সিস নামে নট-ফর-প্রফিট প্রেস স্থাপিত করেছেন।
কেয়ং-সু কিম একজন ফ্রিল্যান্সার দোভাষী যিনি কোরিয়ান লিটারেচার ইন ট্রান্সেলেশন বিষয়ে এসওএএস থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জনের জন্য চেষ্টা করছেন।
মার্ক রেনল্ড একজন ফ্রিল্যান্স সম্পাদক এবং লেখক, এবং ‘বুকানিস্তা’র একজন প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক।