অনুবাদ: বিনয় বর্মন
আলোর মিশকালো বাড়ি
সেদিন উই-ডঙে তুষারবৃষ্টি হচ্ছিল
আমার শরীর, আত্মার সঙ্গী
প্রতিটি অশ্রুকণা পতনের সঙ্গে কেঁপে উঠছিল।
পথে আসো।
তুমি কি দ্বিধান্বিত?
কী স্বপ্ন দেখছো, ওভাবে ভেসে ভেসে?
দ্বিতল বাড়িগুলো ফুলের মতো আলোকিত,
তার নিচে আমি যন্ত্রণা অনুভব করে
নির্মল আনন্দলোকের দিকে
বোকার মতো বাড়িয়ে দিলাম হাত।
পথে আসো।
কী স্বপ্ন দেখছো? হেঁটে চলো।
আমি হেঁটে চললাম, সড়কবাতিতে জমে ওঠা স্মৃতির দিকে।
ওপরের দিকে তাকালাম,
লাইটশেডের নিচে একটি মিশকালো বাড়ি,
আলোর মিশকালো বাড়ি।
আকাশ আঁধারে ঢাকা,
সেই আঁধারে এক ঝাঁক পাখি উড় গেলো
তাদের শরীরের ভার ঝেড়ে ফেলে দিয়ে।
ওভাবে ওড়ার জন্য আমাকে আর কতবার মরতে হবে?
কেউ ধরবে না আমার হাত।
কোন স্বপ্ন এত সুন্দর?
কোন স্মৃতি এত উজ্জ্বল?
মায়ের আঙুলের ডগার মতো, তুষারবৃষ্টি
আমার চোখের পাতা কাঁপিয়ে
বরফায়িত গালে আছড়ে পড়ছিল বারবার।
তাড়াতাড়ি, পথে আসো।
ঊষাসঙ্গীত
বসন্তবাতাসের ফাঁকে ক্রমবর্ধমান অন্ধকারে এক অর্ধমৃত আত্মার প্রতিচ্ছবি আবছা ফুটে ওঠে। আমার ঠোঁট কুঞ্চিত। নিশ্বাস নিশ্বাসই, আত্মা আত্মাই। আমার ঠোঁট কুঞ্চিত। কতটা প্রসারিত সে? কতটা ভেতরে প্রবাহিত। আমাকে অপেক্ষা করতে হবে। ফাঁক বুজে গেলে আমাকে আবার ঠোঁট খুলতে হবে। জিহ্বা গলে গেলে আমাকে আবার ঠোঁট খুলতে হবে। কখনো নয়, কখনোই নয়।
হৃদয় নামক বস্তু
আমি একটি মুছে যাওয়া রেখা পরীক্ষা করি।
আবছা রেখার অবশিষ্ট, যেখানে দুটো দাগ বেঁকে গেছে। ফাঁকা জায়গাটুকু আগেই শূন্য ছিল, মোছার আগে থেকেই।
এরকম জায়গায় আমি পথ করে নিতে চাই, কাঁধ ঝাঁকিয়ে, কোমর বাঁকিয়ে, হাঁটু নাড়িয়ে, দু’পায়ে শক্তভাবে দাঁড়িয়ে।
হৃদয় দুর্বল হলে তা আর অন্য কিছু দুর্বল হতে দেয় না
অস্পষ্ট একটি ছুরি আমার ঠোঁট ফালাফালা করে ফেলে।
আরো অন্ধকার খুঁজি, যখন জিহ্বা আমার গুটিসুটি মেরে থাকে।
মার্ক রথকো এবং আমি-ফেব্রুয়ারিতে মৃত্যু
অনায়াসেই বলা যায়, মার্ক রথকো এবং আমার মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই।
তার জন্ম হয়েছিল ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯০৩ সালে এবং মৃত্যু ২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৭০ সালে। আমার জন্ম ১৯৭০-এর ২৭ নভেম্বর এবং এখনো বেঁচে আছি। মাঝে মাঝে কেবল ভাবি, তার মৃত্যু থেকে আমার জন্মের দূরত্ব নয় মাস।
সেদিন সকালে স্টুডিওর লাগোয়া রান্নাঘরে তার দুই হাত বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো। আমার পিতামাতা দেহাংশগুলো একত্র করলেন। দেহের ভেতর নিশ্চয় তখনো ছিল প্রাণের স্পন্দন। শীতের শেষে নিউ ইয়র্কের গোরস্থানে তার দেহ হয়তো তখনো পচেনি।
এটা বিস্ময়কর নয়, এটা একাকিত্বের বিষয়। আমি হয়তো ছিলাম বিন্দু আকারে, যখন হৃদস্পন্দন শুরু হয়নি। মায়ের গোলাপি গর্ভে, তখন না জানি ভাষা, না বুঝি আলো কিংবা অশ্রু কী জিনিস।
জন্ম ও মৃত্যুর মাঝে, ব্যবধান-ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে সহ্য করা, শুধু সহ্য করা, অবশেষে সুস্থ হয়ে ওঠা।
অর্ধগলিত শীতল মাটিতে তার হাত হয়তো তখনো পচেনি।
হুইলচেয়ার নৃত্য
কান্না এখন অভ্যাস হয়ে গেছে, কিন্তু তা আমাকে গিলে ফেলেনি।
দুঃস্বপ্নও এখন অভ্যাসে পরিণত। এমনকি সমস্ত রক্তনালী জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে খাক করা বিনিদ্র রাতও আমাকে আর গিলে ফেলতে পারে না।
দেখো, আমি নাচছি। জ্বলন্ত হুইলচেয়ারে বসে আমি কাঁধ ঝাঁকাচ্ছি, তীব্রভাবে।
আমি যাদু জানি না, জানা নেই কোনো গোপন তরিকা। কেবল এটুকুই যে কোনো কিছু আমাকে পুরোপুরি ধ্বংস করতে পারবে না।
কোনো নরক, অভিশাপ বা সমাধি নয়, কিংবা নয় কদর্য হিম শিলাবৃষ্টি, ছুরিবৎ শিলা যা আমাকে ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলতে পারে।
দেখো, আমি গান গাইছি। আহা, হুইলচেয়ার তীব্রভাবে আগুন ছড়াচ্ছে, হুইলচেয়ার নৃত্য।
অনুবাদ: বিনয় বর্মন
বৃহস্পতিবার, ১৭ অক্টোবর ২০২৪
আলোর মিশকালো বাড়ি
সেদিন উই-ডঙে তুষারবৃষ্টি হচ্ছিল
আমার শরীর, আত্মার সঙ্গী
প্রতিটি অশ্রুকণা পতনের সঙ্গে কেঁপে উঠছিল।
পথে আসো।
তুমি কি দ্বিধান্বিত?
কী স্বপ্ন দেখছো, ওভাবে ভেসে ভেসে?
দ্বিতল বাড়িগুলো ফুলের মতো আলোকিত,
তার নিচে আমি যন্ত্রণা অনুভব করে
নির্মল আনন্দলোকের দিকে
বোকার মতো বাড়িয়ে দিলাম হাত।
পথে আসো।
কী স্বপ্ন দেখছো? হেঁটে চলো।
আমি হেঁটে চললাম, সড়কবাতিতে জমে ওঠা স্মৃতির দিকে।
ওপরের দিকে তাকালাম,
লাইটশেডের নিচে একটি মিশকালো বাড়ি,
আলোর মিশকালো বাড়ি।
আকাশ আঁধারে ঢাকা,
সেই আঁধারে এক ঝাঁক পাখি উড় গেলো
তাদের শরীরের ভার ঝেড়ে ফেলে দিয়ে।
ওভাবে ওড়ার জন্য আমাকে আর কতবার মরতে হবে?
কেউ ধরবে না আমার হাত।
কোন স্বপ্ন এত সুন্দর?
কোন স্মৃতি এত উজ্জ্বল?
মায়ের আঙুলের ডগার মতো, তুষারবৃষ্টি
আমার চোখের পাতা কাঁপিয়ে
বরফায়িত গালে আছড়ে পড়ছিল বারবার।
তাড়াতাড়ি, পথে আসো।
ঊষাসঙ্গীত
বসন্তবাতাসের ফাঁকে ক্রমবর্ধমান অন্ধকারে এক অর্ধমৃত আত্মার প্রতিচ্ছবি আবছা ফুটে ওঠে। আমার ঠোঁট কুঞ্চিত। নিশ্বাস নিশ্বাসই, আত্মা আত্মাই। আমার ঠোঁট কুঞ্চিত। কতটা প্রসারিত সে? কতটা ভেতরে প্রবাহিত। আমাকে অপেক্ষা করতে হবে। ফাঁক বুজে গেলে আমাকে আবার ঠোঁট খুলতে হবে। জিহ্বা গলে গেলে আমাকে আবার ঠোঁট খুলতে হবে। কখনো নয়, কখনোই নয়।
হৃদয় নামক বস্তু
আমি একটি মুছে যাওয়া রেখা পরীক্ষা করি।
আবছা রেখার অবশিষ্ট, যেখানে দুটো দাগ বেঁকে গেছে। ফাঁকা জায়গাটুকু আগেই শূন্য ছিল, মোছার আগে থেকেই।
এরকম জায়গায় আমি পথ করে নিতে চাই, কাঁধ ঝাঁকিয়ে, কোমর বাঁকিয়ে, হাঁটু নাড়িয়ে, দু’পায়ে শক্তভাবে দাঁড়িয়ে।
হৃদয় দুর্বল হলে তা আর অন্য কিছু দুর্বল হতে দেয় না
অস্পষ্ট একটি ছুরি আমার ঠোঁট ফালাফালা করে ফেলে।
আরো অন্ধকার খুঁজি, যখন জিহ্বা আমার গুটিসুটি মেরে থাকে।
মার্ক রথকো এবং আমি-ফেব্রুয়ারিতে মৃত্যু
অনায়াসেই বলা যায়, মার্ক রথকো এবং আমার মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই।
তার জন্ম হয়েছিল ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯০৩ সালে এবং মৃত্যু ২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৭০ সালে। আমার জন্ম ১৯৭০-এর ২৭ নভেম্বর এবং এখনো বেঁচে আছি। মাঝে মাঝে কেবল ভাবি, তার মৃত্যু থেকে আমার জন্মের দূরত্ব নয় মাস।
সেদিন সকালে স্টুডিওর লাগোয়া রান্নাঘরে তার দুই হাত বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো। আমার পিতামাতা দেহাংশগুলো একত্র করলেন। দেহের ভেতর নিশ্চয় তখনো ছিল প্রাণের স্পন্দন। শীতের শেষে নিউ ইয়র্কের গোরস্থানে তার দেহ হয়তো তখনো পচেনি।
এটা বিস্ময়কর নয়, এটা একাকিত্বের বিষয়। আমি হয়তো ছিলাম বিন্দু আকারে, যখন হৃদস্পন্দন শুরু হয়নি। মায়ের গোলাপি গর্ভে, তখন না জানি ভাষা, না বুঝি আলো কিংবা অশ্রু কী জিনিস।
জন্ম ও মৃত্যুর মাঝে, ব্যবধান-ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে সহ্য করা, শুধু সহ্য করা, অবশেষে সুস্থ হয়ে ওঠা।
অর্ধগলিত শীতল মাটিতে তার হাত হয়তো তখনো পচেনি।
হুইলচেয়ার নৃত্য
কান্না এখন অভ্যাস হয়ে গেছে, কিন্তু তা আমাকে গিলে ফেলেনি।
দুঃস্বপ্নও এখন অভ্যাসে পরিণত। এমনকি সমস্ত রক্তনালী জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে খাক করা বিনিদ্র রাতও আমাকে আর গিলে ফেলতে পারে না।
দেখো, আমি নাচছি। জ্বলন্ত হুইলচেয়ারে বসে আমি কাঁধ ঝাঁকাচ্ছি, তীব্রভাবে।
আমি যাদু জানি না, জানা নেই কোনো গোপন তরিকা। কেবল এটুকুই যে কোনো কিছু আমাকে পুরোপুরি ধ্বংস করতে পারবে না।
কোনো নরক, অভিশাপ বা সমাধি নয়, কিংবা নয় কদর্য হিম শিলাবৃষ্টি, ছুরিবৎ শিলা যা আমাকে ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলতে পারে।
দেখো, আমি গান গাইছি। আহা, হুইলচেয়ার তীব্রভাবে আগুন ছড়াচ্ছে, হুইলচেয়ার নৃত্য।