alt

সাময়িকী

হান কাংয়ের উপন্যাসের অংশ

দ্য হোয়াইট বুক

অনুবাদ : ফজল হাসান

: বৃহস্পতিবার, ১৭ অক্টোবর ২০২৪

১.

বসন্তকালে যখন আমি সাদা জিনিসগুলো সম্পর্কে লেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, তখন আমি প্রথম যে কাজটি করেছিলাম, তা ছিল একটি তালিকা তৈরি করা।

নবজাতকের কম্বল

নবজাতকের পোশাক

লবণ

তুষারপাত

বরফ

চাঁদ

চাউল

ঢেউ

ইউলান

সাদা পাখি

‘শুভ্র হাসি’

ফাঁকা কাগজ

সাদা কুকুর

সাদা চুল

কাফনের কাপড়

এক একটা করে নাম লেখার সময় আমার মধ্যে উত্তেজনার ঢেউ বয়ে যাচ্ছিল। আমি অনুভব করেছি যে, হ্যাঁ, আমার এই বইটি লেখা দরকার এবং লেখার প্রক্রিয়াটি রূপান্তর করা যাবে, যা নিজে নিজেই ফোঁড়ায় প্রয়োগ করা সাদা মলমের মতো কিছুতে পরিবর্তিত হবে, যেমন কোনো ক্ষতের উপর রাখা গজ। আমার কিছু একটা প্রয়োজন ছিল।

কিন্তু তারপর, কয়েকদিন পরে, সেই তালিকার উপর পুনরায় চোখ বুলিয়েছি। আমি শব্দগুলোর হৃদয়ের গভীরে উঁকি দিয়ে ভাবছিলাম, এ কাজের মধ্যে কী অর্থ থাকতে পারে।

আমি যদি এই কথাগুলো নিজের ভেতর স্থানান্তরিত করি, তাহলে ধাতব সুতা থেকে ধনুকের টানা অদ্ভুত, করুণ আর্তনাদের মতো বাক্যগুলো কেঁপে উঠবে। আমি কী শুভ্র কম্বল দিয়ে ঢেকে নিজেকে এসব বাক্যের মধ্যে আড়াল করে রাখতে পারি?

প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কঠিন ছিল। তাই আমি তালিকাটি যেমন ছিল, তেমন রেখেছি এবং বাড়তি আরও কিছু নাম বাদ দিয়েছি। আমি আগস্টে বিদেশে এসেছি এবং এই দেশে আমি আগে কখনও আসিনি। দেশটির রাজধানীতে স্বল্প সময়ের জন্য অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নিয়েছি এবং এই অদ্ভুত পরিবেশে আমার দিনগুলো চালিয়ে নেওয়া শিখেছি। প্রায় দুই মাস পরে কোনও এক রাতে, যখন ঋতুর ঠা-া হাওয়া সবেমাত্র গায়ে বিঁধতে শুরু করেছিল, তখন ভীষণ মাইগ্রেন শুরু হয়, যা আমার কাছে ছিল ভীষণভাবে পরিচিত। আমি গরম পানির সঙ্গে কয়েকটা বড়ি গলাধঃকরণ করেছি এবং বুঝতে পেরেছি (বেশ শান্তভাবে) যে, বিষয়টা লুকানো সম্ভব না।

মাঝেমধ্যে মনে হয় চলমান সময় অত্যন্ত স্পষ্ট। শারীরিক ব্যথা সবসময় সচেতনতাকে আরও ধারালো করে। আমার বয়স যখন বারো-তেরো বছর, তখন থেকে মাইগ্রেন শুরু হয়েছে এবং কোনও সতর্কতা ছাড়াই আমাকে আক্রমণ করে। মাইগ্রেন যখন আমাকে কাবু করে, তখন তার সঙ্গে পেটের মধ্যে যন্ত্রণাদায়ক খিঁচুনি হয়, যা দৈনন্দিন চলমান জীবনকে রীতিমতো থামিয়ে দেয়। এমনকি ক্ষুদ্রতম কাজটিও থেমে যায়, যখন আমি শুধু ব্যথা সহ্য করার দিকে মনোযোগী হই, সময়ের বিচ্ছিন্ন মুহূর্তগুলো আমি দাড়ি কামানোর ধারালো ক্ষুরের মতো অনুভব করি, যা আমার আঙ্গুলের ডগা স্পর্শ করে। একটা গভীর নিশ্বাস বেরিয়ে আসে এবং জীবনের এই নতুন মুহূর্ত রক্তের ফোঁটার মতো স্পষ্ট আকার ধারণ করে। এমনকি একবার আমি স্বচ্ছন্দ গতি থামিয়ে পেছনে সরে আসি, একদিন নির্বিঘেœ অন্য আরেক দিনের সঙ্গে মিশে যাই এবং সেই অনুভূতি সবসময় একই জায়গায় থেকে যায়, অপেক্ষা করে, শ্বাস আটকে থাকে।

প্রতিটি মুহূর্ত এক অদৃশ্য খাদের কিনারা থেকে এক লাফে এগিয়ে যায়, যেখানে সময়ের তীব্রতা অবিরাম নবায়ন করা হয়। আমরা পুরো জীবনের শক্ত মাটি থেকে আমাদের পা তুলে নিই এবং সেই বিপজ্জনক পদক্ষেপ শূন্য জায়গায় নিয়ে যাই। আমরা বিশেষ কোনও সাহস দাবি করতে পারি বলে নয়, বরং এ কারণে যে আমাদের অন্য কোনও পথ খোলা নেই। এখন, এই মুহূর্তে, আমি আমার মধ্যে সেই মাথা ঝিমঝিম করা রোমাঞ্চকর অনুভূতি টের পাই। আমি যেই বেপরোয়াভাবে সময়ের দিকে পা বাড়াই, যে সময়ে আমি এখনও বাস করিনি, এই বইয়ের মধ্যে যা আমি এখনও লিখিনি।

দরজা

এমন একটা ঘটনা, যা অনেকদিন আগে ঘটেছিল।

ভাড়া নেওয়ার চুক্তিপত্রে সই করার আগে আমি আবার অ্যাপার্টমেন্ট দেখতে গিয়েছিলাম।

অ্যাপার্টমেন্টের ধাতব দরজাটি একসময় সাদা ছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রঙের উজ্জ্বলতা মলিন হয়ে গেছে। আমি যখন দেখেছি, তখন সেখানে হযবরল অবস্থা ছিল, রঙ গলে পড়ার পরে দরজায় মরিচা দেখা যাচ্ছিল। আর যদি বিষয়টা এটুকুই হতো, তাহলে আমি এটাকে একটা জীর্ণ পুরনো দরজা ছাড়া অন্য কিছু ভেবে মনে রাখতাম না। তবে দরজার গায়ে ৩০১ নম্বর যেভাবে লেখা ছিল, তা একইভাবে রয়েছে।

কেউ একজনÑ হয়তো অস্থায়ী বাসিন্দাদের দীর্ঘ লাইনে অন্য কেউÑ দরজার গায়ে নম্বরটি তুলে ফেলার জন্য কিছু ধারালো সরঞ্জাম, সম্ভবত গর্ত করার ড্রিল মেশিন ব্যবহার করেছিল। প্রতিটি সংখ্যা আমি দেখতে পেয়েছি: ৩, নিজেই তিন হাত প্রশস্ত; ০ (শূন্য), ছোট আকৃতির, তবে তা দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। অবশেষে, ১, দীর্ঘ, গভীর গর্তের টানা দাগ, তৈরি করার সময় আঁটসাঁট ছিল। সেই সোজা ও বাঁকা অংশের পাশে মরিচা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে, দীর্ঘ শুকনো রক্তের দাগের মতো, হিং¯্রতার পরবর্তী অবস্থা, শক্ত, লালচে-কালো। আমার কাছে কিছুই নেই, লক্ষ্মীটি। আমি যেখানে থাকি, সেই জায়গা নয়, যে দরজা দিয়ে আমি প্রতিদিন আসা-যাওয়া করি, তাও নয়, এমনকি, ধুত্তরি, আমার জীবনও নয়। দরজার গায়ে সেঁটে থাকা সেই সংখ্যাগুলো শক্ত করে দাঁতে দাঁত চেপে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল।

সেই অ্যাপার্টমেন্টটি আমি শীতকালে চেয়েছিলাম, সেই অ্যাপার্টমেন্টটি যেখানে আমি আমার দিন যাপন করতে বেছে নিয়েছিলাম।

বাক্সপেঁটরা খুলে জিনিসপত্র বের করার পরই আমি সাদা রঙের একটা টিনের কৌটা আর একটা ভালো আকৃতির রঙ করার তুলি কিনেছি। রান্নাঘর বা শোবার ঘরÑ কোনটাই নতুন করে রঙ করা হয়নি এবং সেসব ঘরের দেওয়াল জুড়ে বড় ও ছোট দাগের চিহ্ন রয়েছে। এসব গাঢ় দাগ বিশেষ করে বৈদ্যুতিক সুইচের চারপাশে স্পষ্ট ছিল। আমার পরনে ছিল ফ্যাকাশে ধূসর ট্র্যাকস্যুট প্যান্ট এবং পুরনো সাদা সোয়েটার, যাতে ছিটকে পড়া রঙের ফোঁটা খুব খারাপভাবে দেখা না যায়। রঙের কাজ শুরু করার আগেও নিঁখুত, এমনকি কাজ শেষ করার বিষয়ে আমি উদ্বিগ্ন ছিলাম না। আমি নিজেকে যুক্তি দেখিয়ে বলেছি, দাগের উপর আঁকাই যথেষ্টÑ নিশ্চয়ই নোংরা দাগের চেয়ে সাদা দাগ ভালো? আমি তুলি দিয়ে সিলিংয়ের বড় বড় দাগের উপর রঙের আঁচড় টানি, যেখানে বৃষ্টির ফোঁটা অবশ্যই একবার হলেও প্রবেশ করেছিল। রঙ করার সময় আমি সাদা রঙের আড়ালে ধূসর সিলিং অদৃশ্য হয়ে যেতে দেখেছি। একই উজ্জ্বল সাদা রঙ করার আগে আমি মোছার কাপড় দিয়ে নোংরা সিঙ্ক পরিষ্কার করেছি। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সিঙ্কের রঙ বাদামী ছিল।

অবশেষে আমি করিডোরে ঢুকে সদর দরজা রঙ করেছি। দাগের উপর প্রতিবার তুলির আঁচড়ের সঙ্গে সঙ্গে দরজার ধূসর চিহ্নগুলো মুছে যেতে থাকে। সেই গভীর ক্ষতের সংখ্যাগুলো অদৃশ্য হয়ে যায়, সেই মরচে ধরা রক্তের দাগগুলো মুছে যায়। আমি বিরতি নিতে এবং পুনরায় শক্তি সঞ্চয় করার জন্য অ্যাপার্টমেন্টের ভেতরে যাই। এক ঘণ্টা পরে যখন আমি ফিরে আসি, তখন দেখেছি যে রঙ করা কাজ শেষ হয়ে গেছে। তবে দেখতে অপরিচ্ছন্ন লাগছিল। সম্ভবত এ কারণ যে, আমি রোলারের পরিবর্তে তুলি ব্যবহার করেছি। তুলির দাগ কম দেখা যাওয়ার জন্য উপরের দিকে আরেকবার অতিরিক্ত প্রলেপ দিয়েছি এবং তা শুকানোর জন্য আমি অপেক্ষা করতে আবার ভেতরে যাই। চপ্পল পরে ভেতর থেকে বেরিয়ে আসার আগে আরও এক ঘণ্টা কেটে যায়। তুষারপাত শুরু হয়েছে। বাইরে, সরু গলি অন্ধকারে ঢেকে গেছে; রাস্তার আলো তখনও জ্বলেনি। আমার এক হাতে রঙের কৌটা, আরেক হাতে তুলি, আমি নড়াচড়া না করে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকি। তুষারকণার ধীর গতি পতনের এক নীরব সাক্ষী, যেন শত শত পালক ঝরে পড়ছে।

নবজাতকের কম্বল

বরফের মতো সাদা নবজাতকের কম্বল দিয়ে সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুর চারপাশ পেঁচানো হয়েছে। জন্মের পরপরই অচেনা পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য নার্স নবজাতকের পুরো শরীর শক্ত করে পেঁচিয়ে রেখেছে।

জন্মের পর যে শিশু কেবল শ্বাস নিতে শুরু করে, প্রথমবারের মতো ফুসফুস ভরাট করার শ্বাস। যে নবজাতক জানে না সে কে, কোথায় আছে, সেই মুহূর্তে কী শুরু হয়েছে। প্রাণিদের মধ্যে শিশুরা সবচেয়ে অসহায়, এমনকি সদ্যজাত পাখির ছানার চেয়েও অরক্ষিত।

মহিলা, রক্তক্ষরণের কারণে ফ্যাকাশে দেখাচ্ছিল, কান্নারত শিশুর দিকে তাকিয়ে আছেন। বিচলিত হয়ে, তিনি কম্বল দিয়ে পেঁচানো সত্তাকে নিজের বাহুর মধ্যে তুলে নেন। তাঁর কাছে নবজাতকের কান্না থামানোর উপায় জানা নেই। কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত তিনি এমন আশ্চর্য যন্ত্রণার মধ্যে ছিলেন। অপ্রত্যাশিতভাবে শিশুটি নিজেকে শান্ত করে। হয়তো কোনও ধরনের গন্ধের কারণে হবে। অথবা মা ও শিশু এখনও পরস্পরের সঙ্গে বন্ধনে আবদ্ধ রয়েছে। পিটপিটে এক জোড়া কালো ছোট্ট চোখ মায়ের মুখের দিকে ঘুরিয়ে আছেÑ মায়ের কণ্ঠস্বরের দিকে তার মনোযোগ। চলমান সময়ে কী নির্ধারিত আছে, তা জানা নেই, তবে এই দু’টি মানুষ এখনও একই সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। নিস্তব্ধতার মধ্যে রক্তের গন্ধ ভাসছে। দু’টি দেহের মাঝখানে যা থাকে, তা হলো জড়ানো কম্বলের শুভ্রতা।

অন্ধকারে নির্দিষ্ট কিছু বস্তু

অন্ধকারে কিছু বস্তু সাদা দেখায়। ক্ষীণ আলোতেও যখন আবছা অন্ধকার থাকে, এমনকি যেসব জিনিস অন্য সময় ফ্যাকাশে আলোয় সাদা দেখাত না।

আমি রাতে বসার ঘরের কোণে সোফা বিছিয়ে বিছানা তৈরি করি এবং সেই আবছা আলোয় শুয়ে পড়ি। ঘুমানোর চেষ্টা না করে আমি অপেক্ষা করি এবং অনুভব করি আমার ইন্দ্রিয়গুলো সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছে। জানালার বাইরের গাছগুলো সাদা রঙ করা দেওয়ালে ধূসর নকশার ছায়া ফেলেছে। আমি সেই ব্যক্তির কথা ভাবি, যিনি এই শহরের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ, তাদের মুখের আদল নিয়ে ভেবেছিল। আমি অপেক্ষা করছি সেই রূপরেখা একত্রিত হওয়ার জন্য এবং তার সেই অভিব্যক্তি পড়তে সক্ষম হওয়ার জন্য।

মোমবাতি

আমি তাকে কল্পনা করেছি, মহিলা এই শহরের রাস্তায় হাঁটেন। চৌরাস্তায় তিনি লাল ইটের দেওয়ালের একাংশ দেখতে পান। আরও একটি বিধ্বস্ত দালান পুনরাম নির্মাণের সময় দেওয়ালটি ভেঙে ফেলা হয়েছে এবং তার মূল অবস্থানের এক মিটার সামনে পুনর্নির্মাণ করা হয়। তার পাশাপাশি নিচু সমাধিস্তম্ভের গায়ে লেখা রয়েছে, জার্মান সেনাবাহিনী বেসামরিক লোকদের লাইনে দাঁড় করিয়ে তাদের গুলি করার জন্য ব্যবহার করেছিল। কেউ স্মৃতিস্তম্ভের সামনে ফুলদানি রেখেছে, আর সেখানে কয়েকটা সাদা মোমবাতি আগুনের লেলিহান শিখায় জ্বলছে।

কুয়াশার কু-লী এখনও শহরকে ঢেকে রেখেছে, তবে ভোরের চেয়ে কম ঘন, ট্রেসিং পেপারের মতো স্বচ্ছ। প্রবল বাতাস উঠে যদি কুয়াশা কেটে যায়, তাহলে সত্তর বছর আগের ধ্বংসাবশেষগুলো চমক সৃষ্টি করতে পারে এবং বর্তমানে পুনরাম নির্মাণের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসতে পারে। মহিলার খুব কাছাকাছি জড়ো হওয়া ভূতেরা হয়তো দেওয়ালে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে তাদের জবাই করা হয়েছিল, এবং তাদের চোখ জ্বলজ্বল করছে।

কিন্তু কোনও বাতাস নেই এবং ইতিমধ্যে যা কিছু দৃশ্যমান, সেসব জিনিস ছাড়া অন্য কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। জ্বলন্ত সাদা মোমবাতির মোম গলে ক্রমশ নিচের দিকে গড়িয়ে পড়ছিল। আগুনে মোমবাতির সাদা পলিতা নিজেকে পোড়াচ্ছিল, গলিত মোম ধীরে ধীরে নিচের জায়গা ঢেকে দিচ্ছিল, অবশেষে অস্তিত্ব ছেড়ে বাইরে চলে গিয়েছে।

এখন আমি তোমাকে সাদা জিনিস দিচ্ছি,

যা শুভ্র, যদিও তা কলঙ্কিত হতে পারে;

শুধু সাদা জিনিসই দিচ্ছি।

আমি আর প্রশ্ন করব না

এ জীবন তোমায় দিব কি না।

সূত্র:

‘দ্য হোয়াইট বুক’, মূল: হা কাং, কোরিয়ান ভাষা থেকে ইংরেজি অনুবাদ: ডেবোরাহ্ স্মিথ, প্রকাশক: পোর্টোবেলো বুকস, এডিনবার্গ, স্কটল্যান্ড, কিন্ডল সংস্করণ।

অনূদিত অংশগুলো গ্রন্থের প্রথম অংশের যথাক্রমে ও (রোমান), Door, Swaddling bands, Certain objects in the darkness Ges Candle.

ছবি

আর এক সুন্দর সকালবেলায়

ছবি

আবার নরকুম্ভির ও মডার্নিজম

ছবি

আত্মজীবনীর আত্মপ্রকাশ প্রসঙ্গে

ছবি

আসাদের অঙ্ক

ছবি

র্যাঁবোর কবিতায় প্রতীকী জীবনের ছায়া

ছবি

ভাষা সংস্কৃতি সাক্ষরতা

ছবি

হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কবিতার আভিজাত্য

ছবি

চেশোয়া মিওশ-এর কবিতা

ছবি

সিলভিয়া প্লাথের মৃত্যু, নিঃসঙ্গতা ও আত্মবিনাশ

ছবি

সমসাময়িক মার্কিনি ‘সহস্রাব্দের কণ্ঠস্বর’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

অন্য নিরিখে দেখা

ছবি

হেলাল হাফিজের চলে যাওয়া

ছবি

হেলাল হাফিজের কবিতা

ছবি

কেন এত পাঠকপ্রিয় হেলাল হাফিজ

ছবি

নারী শিক্ষাবিদ : বেগম রোকেয়া

ছবি

বাসার তাসাউফ

ছবি

‘জগদ্দল’-এর শক্তি ও সমরেশ বসু

ছবি

রুগ্ণ আত্মার কথোয়াল

ছবি

রুবেন দারিও-র কবিতা

‘অঘ্রানের অনুভূতিমালা’

ছবি

কবিতা পড়া, কবিতা লেখা

ছবি

‘ধুলোয় সব মলিন’, পাঠকের কথা

ছবি

মহত্ত্বর কবি সিকদার আমিনুল হক

ছবি

রুগ্ণ আত্মার কথোয়াল

ছবি

কয়েকটি অনুগল্প

সাময়িকী কবিতা

ছবি

যেভাবে লেখা হলো ‘শিকিবু’

ছবি

জাঁ জোসেফ রাবেয়ারিভেলোর কবিতা

ছবি

সিকদার আমিনুল হকের গদ্য

ছবি

সিকদার আমিনুল হককে লেখা অগ্রজ ও খ্যাতিমান লেখক-সম্পাদকের চিঠি

ছবি

ফিওদর দস্তয়েভস্কি: রুগ্ণ আত্মার কথোয়াল

একজন গফুর মল্লিক

ছবি

অগ্রবীজের ‘অনুবাদ সাহিত্য’ সংখ্যা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

গোপন কথা

tab

সাময়িকী

হান কাংয়ের উপন্যাসের অংশ

দ্য হোয়াইট বুক

অনুবাদ : ফজল হাসান

বৃহস্পতিবার, ১৭ অক্টোবর ২০২৪

১.

বসন্তকালে যখন আমি সাদা জিনিসগুলো সম্পর্কে লেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, তখন আমি প্রথম যে কাজটি করেছিলাম, তা ছিল একটি তালিকা তৈরি করা।

নবজাতকের কম্বল

নবজাতকের পোশাক

লবণ

তুষারপাত

বরফ

চাঁদ

চাউল

ঢেউ

ইউলান

সাদা পাখি

‘শুভ্র হাসি’

ফাঁকা কাগজ

সাদা কুকুর

সাদা চুল

কাফনের কাপড়

এক একটা করে নাম লেখার সময় আমার মধ্যে উত্তেজনার ঢেউ বয়ে যাচ্ছিল। আমি অনুভব করেছি যে, হ্যাঁ, আমার এই বইটি লেখা দরকার এবং লেখার প্রক্রিয়াটি রূপান্তর করা যাবে, যা নিজে নিজেই ফোঁড়ায় প্রয়োগ করা সাদা মলমের মতো কিছুতে পরিবর্তিত হবে, যেমন কোনো ক্ষতের উপর রাখা গজ। আমার কিছু একটা প্রয়োজন ছিল।

কিন্তু তারপর, কয়েকদিন পরে, সেই তালিকার উপর পুনরায় চোখ বুলিয়েছি। আমি শব্দগুলোর হৃদয়ের গভীরে উঁকি দিয়ে ভাবছিলাম, এ কাজের মধ্যে কী অর্থ থাকতে পারে।

আমি যদি এই কথাগুলো নিজের ভেতর স্থানান্তরিত করি, তাহলে ধাতব সুতা থেকে ধনুকের টানা অদ্ভুত, করুণ আর্তনাদের মতো বাক্যগুলো কেঁপে উঠবে। আমি কী শুভ্র কম্বল দিয়ে ঢেকে নিজেকে এসব বাক্যের মধ্যে আড়াল করে রাখতে পারি?

প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কঠিন ছিল। তাই আমি তালিকাটি যেমন ছিল, তেমন রেখেছি এবং বাড়তি আরও কিছু নাম বাদ দিয়েছি। আমি আগস্টে বিদেশে এসেছি এবং এই দেশে আমি আগে কখনও আসিনি। দেশটির রাজধানীতে স্বল্প সময়ের জন্য অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নিয়েছি এবং এই অদ্ভুত পরিবেশে আমার দিনগুলো চালিয়ে নেওয়া শিখেছি। প্রায় দুই মাস পরে কোনও এক রাতে, যখন ঋতুর ঠা-া হাওয়া সবেমাত্র গায়ে বিঁধতে শুরু করেছিল, তখন ভীষণ মাইগ্রেন শুরু হয়, যা আমার কাছে ছিল ভীষণভাবে পরিচিত। আমি গরম পানির সঙ্গে কয়েকটা বড়ি গলাধঃকরণ করেছি এবং বুঝতে পেরেছি (বেশ শান্তভাবে) যে, বিষয়টা লুকানো সম্ভব না।

মাঝেমধ্যে মনে হয় চলমান সময় অত্যন্ত স্পষ্ট। শারীরিক ব্যথা সবসময় সচেতনতাকে আরও ধারালো করে। আমার বয়স যখন বারো-তেরো বছর, তখন থেকে মাইগ্রেন শুরু হয়েছে এবং কোনও সতর্কতা ছাড়াই আমাকে আক্রমণ করে। মাইগ্রেন যখন আমাকে কাবু করে, তখন তার সঙ্গে পেটের মধ্যে যন্ত্রণাদায়ক খিঁচুনি হয়, যা দৈনন্দিন চলমান জীবনকে রীতিমতো থামিয়ে দেয়। এমনকি ক্ষুদ্রতম কাজটিও থেমে যায়, যখন আমি শুধু ব্যথা সহ্য করার দিকে মনোযোগী হই, সময়ের বিচ্ছিন্ন মুহূর্তগুলো আমি দাড়ি কামানোর ধারালো ক্ষুরের মতো অনুভব করি, যা আমার আঙ্গুলের ডগা স্পর্শ করে। একটা গভীর নিশ্বাস বেরিয়ে আসে এবং জীবনের এই নতুন মুহূর্ত রক্তের ফোঁটার মতো স্পষ্ট আকার ধারণ করে। এমনকি একবার আমি স্বচ্ছন্দ গতি থামিয়ে পেছনে সরে আসি, একদিন নির্বিঘেœ অন্য আরেক দিনের সঙ্গে মিশে যাই এবং সেই অনুভূতি সবসময় একই জায়গায় থেকে যায়, অপেক্ষা করে, শ্বাস আটকে থাকে।

প্রতিটি মুহূর্ত এক অদৃশ্য খাদের কিনারা থেকে এক লাফে এগিয়ে যায়, যেখানে সময়ের তীব্রতা অবিরাম নবায়ন করা হয়। আমরা পুরো জীবনের শক্ত মাটি থেকে আমাদের পা তুলে নিই এবং সেই বিপজ্জনক পদক্ষেপ শূন্য জায়গায় নিয়ে যাই। আমরা বিশেষ কোনও সাহস দাবি করতে পারি বলে নয়, বরং এ কারণে যে আমাদের অন্য কোনও পথ খোলা নেই। এখন, এই মুহূর্তে, আমি আমার মধ্যে সেই মাথা ঝিমঝিম করা রোমাঞ্চকর অনুভূতি টের পাই। আমি যেই বেপরোয়াভাবে সময়ের দিকে পা বাড়াই, যে সময়ে আমি এখনও বাস করিনি, এই বইয়ের মধ্যে যা আমি এখনও লিখিনি।

দরজা

এমন একটা ঘটনা, যা অনেকদিন আগে ঘটেছিল।

ভাড়া নেওয়ার চুক্তিপত্রে সই করার আগে আমি আবার অ্যাপার্টমেন্ট দেখতে গিয়েছিলাম।

অ্যাপার্টমেন্টের ধাতব দরজাটি একসময় সাদা ছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রঙের উজ্জ্বলতা মলিন হয়ে গেছে। আমি যখন দেখেছি, তখন সেখানে হযবরল অবস্থা ছিল, রঙ গলে পড়ার পরে দরজায় মরিচা দেখা যাচ্ছিল। আর যদি বিষয়টা এটুকুই হতো, তাহলে আমি এটাকে একটা জীর্ণ পুরনো দরজা ছাড়া অন্য কিছু ভেবে মনে রাখতাম না। তবে দরজার গায়ে ৩০১ নম্বর যেভাবে লেখা ছিল, তা একইভাবে রয়েছে।

কেউ একজনÑ হয়তো অস্থায়ী বাসিন্দাদের দীর্ঘ লাইনে অন্য কেউÑ দরজার গায়ে নম্বরটি তুলে ফেলার জন্য কিছু ধারালো সরঞ্জাম, সম্ভবত গর্ত করার ড্রিল মেশিন ব্যবহার করেছিল। প্রতিটি সংখ্যা আমি দেখতে পেয়েছি: ৩, নিজেই তিন হাত প্রশস্ত; ০ (শূন্য), ছোট আকৃতির, তবে তা দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। অবশেষে, ১, দীর্ঘ, গভীর গর্তের টানা দাগ, তৈরি করার সময় আঁটসাঁট ছিল। সেই সোজা ও বাঁকা অংশের পাশে মরিচা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে, দীর্ঘ শুকনো রক্তের দাগের মতো, হিং¯্রতার পরবর্তী অবস্থা, শক্ত, লালচে-কালো। আমার কাছে কিছুই নেই, লক্ষ্মীটি। আমি যেখানে থাকি, সেই জায়গা নয়, যে দরজা দিয়ে আমি প্রতিদিন আসা-যাওয়া করি, তাও নয়, এমনকি, ধুত্তরি, আমার জীবনও নয়। দরজার গায়ে সেঁটে থাকা সেই সংখ্যাগুলো শক্ত করে দাঁতে দাঁত চেপে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল।

সেই অ্যাপার্টমেন্টটি আমি শীতকালে চেয়েছিলাম, সেই অ্যাপার্টমেন্টটি যেখানে আমি আমার দিন যাপন করতে বেছে নিয়েছিলাম।

বাক্সপেঁটরা খুলে জিনিসপত্র বের করার পরই আমি সাদা রঙের একটা টিনের কৌটা আর একটা ভালো আকৃতির রঙ করার তুলি কিনেছি। রান্নাঘর বা শোবার ঘরÑ কোনটাই নতুন করে রঙ করা হয়নি এবং সেসব ঘরের দেওয়াল জুড়ে বড় ও ছোট দাগের চিহ্ন রয়েছে। এসব গাঢ় দাগ বিশেষ করে বৈদ্যুতিক সুইচের চারপাশে স্পষ্ট ছিল। আমার পরনে ছিল ফ্যাকাশে ধূসর ট্র্যাকস্যুট প্যান্ট এবং পুরনো সাদা সোয়েটার, যাতে ছিটকে পড়া রঙের ফোঁটা খুব খারাপভাবে দেখা না যায়। রঙের কাজ শুরু করার আগেও নিঁখুত, এমনকি কাজ শেষ করার বিষয়ে আমি উদ্বিগ্ন ছিলাম না। আমি নিজেকে যুক্তি দেখিয়ে বলেছি, দাগের উপর আঁকাই যথেষ্টÑ নিশ্চয়ই নোংরা দাগের চেয়ে সাদা দাগ ভালো? আমি তুলি দিয়ে সিলিংয়ের বড় বড় দাগের উপর রঙের আঁচড় টানি, যেখানে বৃষ্টির ফোঁটা অবশ্যই একবার হলেও প্রবেশ করেছিল। রঙ করার সময় আমি সাদা রঙের আড়ালে ধূসর সিলিং অদৃশ্য হয়ে যেতে দেখেছি। একই উজ্জ্বল সাদা রঙ করার আগে আমি মোছার কাপড় দিয়ে নোংরা সিঙ্ক পরিষ্কার করেছি। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সিঙ্কের রঙ বাদামী ছিল।

অবশেষে আমি করিডোরে ঢুকে সদর দরজা রঙ করেছি। দাগের উপর প্রতিবার তুলির আঁচড়ের সঙ্গে সঙ্গে দরজার ধূসর চিহ্নগুলো মুছে যেতে থাকে। সেই গভীর ক্ষতের সংখ্যাগুলো অদৃশ্য হয়ে যায়, সেই মরচে ধরা রক্তের দাগগুলো মুছে যায়। আমি বিরতি নিতে এবং পুনরায় শক্তি সঞ্চয় করার জন্য অ্যাপার্টমেন্টের ভেতরে যাই। এক ঘণ্টা পরে যখন আমি ফিরে আসি, তখন দেখেছি যে রঙ করা কাজ শেষ হয়ে গেছে। তবে দেখতে অপরিচ্ছন্ন লাগছিল। সম্ভবত এ কারণ যে, আমি রোলারের পরিবর্তে তুলি ব্যবহার করেছি। তুলির দাগ কম দেখা যাওয়ার জন্য উপরের দিকে আরেকবার অতিরিক্ত প্রলেপ দিয়েছি এবং তা শুকানোর জন্য আমি অপেক্ষা করতে আবার ভেতরে যাই। চপ্পল পরে ভেতর থেকে বেরিয়ে আসার আগে আরও এক ঘণ্টা কেটে যায়। তুষারপাত শুরু হয়েছে। বাইরে, সরু গলি অন্ধকারে ঢেকে গেছে; রাস্তার আলো তখনও জ্বলেনি। আমার এক হাতে রঙের কৌটা, আরেক হাতে তুলি, আমি নড়াচড়া না করে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকি। তুষারকণার ধীর গতি পতনের এক নীরব সাক্ষী, যেন শত শত পালক ঝরে পড়ছে।

নবজাতকের কম্বল

বরফের মতো সাদা নবজাতকের কম্বল দিয়ে সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুর চারপাশ পেঁচানো হয়েছে। জন্মের পরপরই অচেনা পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য নার্স নবজাতকের পুরো শরীর শক্ত করে পেঁচিয়ে রেখেছে।

জন্মের পর যে শিশু কেবল শ্বাস নিতে শুরু করে, প্রথমবারের মতো ফুসফুস ভরাট করার শ্বাস। যে নবজাতক জানে না সে কে, কোথায় আছে, সেই মুহূর্তে কী শুরু হয়েছে। প্রাণিদের মধ্যে শিশুরা সবচেয়ে অসহায়, এমনকি সদ্যজাত পাখির ছানার চেয়েও অরক্ষিত।

মহিলা, রক্তক্ষরণের কারণে ফ্যাকাশে দেখাচ্ছিল, কান্নারত শিশুর দিকে তাকিয়ে আছেন। বিচলিত হয়ে, তিনি কম্বল দিয়ে পেঁচানো সত্তাকে নিজের বাহুর মধ্যে তুলে নেন। তাঁর কাছে নবজাতকের কান্না থামানোর উপায় জানা নেই। কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত তিনি এমন আশ্চর্য যন্ত্রণার মধ্যে ছিলেন। অপ্রত্যাশিতভাবে শিশুটি নিজেকে শান্ত করে। হয়তো কোনও ধরনের গন্ধের কারণে হবে। অথবা মা ও শিশু এখনও পরস্পরের সঙ্গে বন্ধনে আবদ্ধ রয়েছে। পিটপিটে এক জোড়া কালো ছোট্ট চোখ মায়ের মুখের দিকে ঘুরিয়ে আছেÑ মায়ের কণ্ঠস্বরের দিকে তার মনোযোগ। চলমান সময়ে কী নির্ধারিত আছে, তা জানা নেই, তবে এই দু’টি মানুষ এখনও একই সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। নিস্তব্ধতার মধ্যে রক্তের গন্ধ ভাসছে। দু’টি দেহের মাঝখানে যা থাকে, তা হলো জড়ানো কম্বলের শুভ্রতা।

অন্ধকারে নির্দিষ্ট কিছু বস্তু

অন্ধকারে কিছু বস্তু সাদা দেখায়। ক্ষীণ আলোতেও যখন আবছা অন্ধকার থাকে, এমনকি যেসব জিনিস অন্য সময় ফ্যাকাশে আলোয় সাদা দেখাত না।

আমি রাতে বসার ঘরের কোণে সোফা বিছিয়ে বিছানা তৈরি করি এবং সেই আবছা আলোয় শুয়ে পড়ি। ঘুমানোর চেষ্টা না করে আমি অপেক্ষা করি এবং অনুভব করি আমার ইন্দ্রিয়গুলো সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছে। জানালার বাইরের গাছগুলো সাদা রঙ করা দেওয়ালে ধূসর নকশার ছায়া ফেলেছে। আমি সেই ব্যক্তির কথা ভাবি, যিনি এই শহরের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ, তাদের মুখের আদল নিয়ে ভেবেছিল। আমি অপেক্ষা করছি সেই রূপরেখা একত্রিত হওয়ার জন্য এবং তার সেই অভিব্যক্তি পড়তে সক্ষম হওয়ার জন্য।

মোমবাতি

আমি তাকে কল্পনা করেছি, মহিলা এই শহরের রাস্তায় হাঁটেন। চৌরাস্তায় তিনি লাল ইটের দেওয়ালের একাংশ দেখতে পান। আরও একটি বিধ্বস্ত দালান পুনরাম নির্মাণের সময় দেওয়ালটি ভেঙে ফেলা হয়েছে এবং তার মূল অবস্থানের এক মিটার সামনে পুনর্নির্মাণ করা হয়। তার পাশাপাশি নিচু সমাধিস্তম্ভের গায়ে লেখা রয়েছে, জার্মান সেনাবাহিনী বেসামরিক লোকদের লাইনে দাঁড় করিয়ে তাদের গুলি করার জন্য ব্যবহার করেছিল। কেউ স্মৃতিস্তম্ভের সামনে ফুলদানি রেখেছে, আর সেখানে কয়েকটা সাদা মোমবাতি আগুনের লেলিহান শিখায় জ্বলছে।

কুয়াশার কু-লী এখনও শহরকে ঢেকে রেখেছে, তবে ভোরের চেয়ে কম ঘন, ট্রেসিং পেপারের মতো স্বচ্ছ। প্রবল বাতাস উঠে যদি কুয়াশা কেটে যায়, তাহলে সত্তর বছর আগের ধ্বংসাবশেষগুলো চমক সৃষ্টি করতে পারে এবং বর্তমানে পুনরাম নির্মাণের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসতে পারে। মহিলার খুব কাছাকাছি জড়ো হওয়া ভূতেরা হয়তো দেওয়ালে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে তাদের জবাই করা হয়েছিল, এবং তাদের চোখ জ্বলজ্বল করছে।

কিন্তু কোনও বাতাস নেই এবং ইতিমধ্যে যা কিছু দৃশ্যমান, সেসব জিনিস ছাড়া অন্য কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। জ্বলন্ত সাদা মোমবাতির মোম গলে ক্রমশ নিচের দিকে গড়িয়ে পড়ছিল। আগুনে মোমবাতির সাদা পলিতা নিজেকে পোড়াচ্ছিল, গলিত মোম ধীরে ধীরে নিচের জায়গা ঢেকে দিচ্ছিল, অবশেষে অস্তিত্ব ছেড়ে বাইরে চলে গিয়েছে।

এখন আমি তোমাকে সাদা জিনিস দিচ্ছি,

যা শুভ্র, যদিও তা কলঙ্কিত হতে পারে;

শুধু সাদা জিনিসই দিচ্ছি।

আমি আর প্রশ্ন করব না

এ জীবন তোমায় দিব কি না।

সূত্র:

‘দ্য হোয়াইট বুক’, মূল: হা কাং, কোরিয়ান ভাষা থেকে ইংরেজি অনুবাদ: ডেবোরাহ্ স্মিথ, প্রকাশক: পোর্টোবেলো বুকস, এডিনবার্গ, স্কটল্যান্ড, কিন্ডল সংস্করণ।

অনূদিত অংশগুলো গ্রন্থের প্রথম অংশের যথাক্রমে ও (রোমান), Door, Swaddling bands, Certain objects in the darkness Ges Candle.

back to top