alt

সাময়িকী

যে কবিতায় শামসুর রাহমানকে চিনেছি

বাসার তাসাউফ

: বৃহস্পতিবার, ২৪ অক্টোবর ২০২৪

শামসুর রাহমান ও ‘শামসুর রাহমান : নিঃসঙ্গ শেরপা’র লেখক হুমায়ুন আজাদ

কবি শামসুর রাহমানের ‘কখনো আমার মাকে’ কবিতাটি প্রথম যখন পড়ি তখন থাকি গ্রামে। অনন্তপুর আমার গ্রামের নাম। অজপড়াগাঁ। তখন আমার বয়স কত ছিল মনে নেই। তবে আমি যে তখন স্কুলে পড়তাম তা মনে আছে। আমাদের গ্রামে তখন ইলেট্রিসিটি ছিল না। দিনের শেষ হওয়া আলো আর রাতের সূচিত আঁধারে বৃক্ষের ছায়াঘেরা নির্জনে আমার থাকার ঘরটিকে মনে হতো ভৌতিক এক আবাসভূমি। সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত যত গভীর হতো প্রকৃতিজুড়ে নেমে আসত প্রগাঢ় রহস্যময়তা। অরণ্য আঁধারে প্রেতিনীর কান্না, শেওড়াগাছে ভূত অথবা অশরীরী আত্মার আনাগোনাÑ সবই ছিল রূপকথার মতো। হারিকেনের টিমটিমে আলোয় আমার বুক ধুক্ পুক্ করে কাঁপত। মনে হতো, জানালার বাইরে এখনই ভেসে উঠবে ভয়ানক কোনো দাঁতাল জন্তুর মুখ। এমনই গা ছমছম করা অবুঝ কৈশোরে আমি পড়েছিলাম শামসুর রাহমানের ‘বিধ্বস্ত নীলিমা’ কবিতার বইটি। সেই কিশোরবেলায় কোনো এক চৈত্রের বিকেলে আমার আব্বা বাজারের লাইব্রেরি থেকে কিছু গল্প-কবিতার বই নিয়ে এসেছিলেন। আমার বড় আপুরা এসব বই পড়তে পছন্দ করতেন। সব বই ছোটদের পড়ার উপযোগী ছিল না। আমি ভূত ভয় পাই বলে আব্বা দুয়েকটা ভৌতিক গল্পের বইও এনেছিলেন। ভূতের ভয় কাটাবার জন্য ভূতের বই পড়াÑ ব্যাপারটা ছিল খুবই মজার। কিন্তু আমি ভূতের বই পড়তে পছন্দ করতাম না। আপুরা যেসব বই পড়ত আমিও সেই বইগুলো পড়তে চাইতাম। কিন্তু আমাকে পড়তে দেয়া হতো না। বড় আপুকে দেখেছি ‘চিতাবহ্নিমান’ নামের একটি বই পড়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে। এসব বই পড়লে আমিও কেঁদে ফেলব বলেই কি আমাকে পড়তে দেয়া হয়নি? এমন প্রশ্নই জেগেছিল আমার কৈশোর অনুত্তীর্ণ মনে। নিষেধ থাকা সত্ত্বেও এক রাতে মেঝো আপুর পড়ার টেবিলে পড়ে থাকা কয়েকটি বই থেকে বেছে ‘বিধ্বস্ত নীলিমা’ নামের একটি বই আমি হাতে নিলাম। কয়েক পাতা উলটে ‘কখনো আমার মাকে’ শিরোনামের কবিতাটি চোখে পড়ল। পড়ে ফেললাম এক নিশ^াসে। পড়ার পরই আবার পড়তে ইচ্ছে হলো। আরেকবার পড়লাম। দ্বিতীয়বার পড়ার আমার কিশোর মনে অদ্ভুত এক ‘দোল’-এর অনুভূতি তৈরি হলো এবং তা মনের গহিনে এতটাই দোলা দিয়েছিল যে তা স্থায়ী ছিল বহুক্ষণ, এমনকি বহুদিনও। ব্যস, ওইটুকুই। কবিতাটির নিগূঢ় অর্থ বা এর তাৎপর্য বোঝার মতো জ্ঞান তখনো আমার হয়ে ওঠেনি। কিন্তু যখন পড়লাম, ‘কখনো আমার মাকে কোনো গান গাইতে শুনিনি’ তখনই কবি আমার আপন মানুষ হয়ে উঠলেন। আরে ঠিকই তো! আমিও তো আমার মাকে কোনোদিন গান গাইতে শুনিনি!

শুধু ঘরকন্না নিয়েই ব্যস্ত থাকবেন, রান্না-বান্না করবেন, সন্তান জন্ম দেবেন, লালন-পালন করবেন, সর্বোপরি নিজের অসুখ-বিসুখ উপেক্ষা করে গৃহকর্তা ও সন্তানদের সন্তুষ্টির জন্য নিজেকে উৎসর্গ করে দিবেনÑ মাকে নিয়ে এমন ধারণা আমাদের চিরকালের। কিন্তু কবিতাটি পড়ার পর একটু আবেগাপ্লুত হয়ে ভেবেছিলাম, কথাগুলো আমার মাকে নিয়ে লেখা।

শামসুর রাহমান মায়ের এমন একটি ঘরোয়া বিষয় নিয়ে কবিতা লিখলেন যে তাকে মনে রাখা বা চিরকাল বাঁচিয়ে রাখা আমাদের দায়িত্ব হয়ে গেল। কবিতাটি যারা পড়বেন পড়তে পড়তে প্রায় প্রতিটি শব্দে, বাক্যে নিজের মাকে খুঁজে পাবেন। আমিও আমার মাকে খুঁেজ পেয়েছি অথবা কবির মা-ই হয়ে উঠেছে আমার মা। আর এই অনুভূতির কারণেই শামসুর রাহমান আমার জীবনে চির স্মরণীয় একজন ব্যক্তি হয়ে উঠলেন। যুগে যুগে সেই সব কবি বা সাহিত্যিক অমর হয়েছেন যাদের ভাবনানিঃসৃত কথামালা বাণীবদ্ধ হয়ে সকলের ভাবনার সঙ্গে মিলে গিয়েছে। শামসুর রাহমান এই কবিতাটিতে অনুভূতির প্রক্ষেপণে বাঙালি ও বাংলা ভাষার পাঠক হৃদয়ে যে অনভূতির বিস্তার করেছেন এইটুকুই তাঁকে অমর করে রাখতে যথেষ্ট।

শৈশব-কৈশোরে এই একটি কবিতা দিয়ে চেনা কবি শামসুর রাহমান এর পর হয়ে গেলেন আমার প্রিয় কবিদের একজন আর তাঁর কবিতা হয়ে গেল আমার নিয়মিত পাঠচর্চার মূল উপাদান। সেই একটি কবিতা ভালো লাগা থেকে তাঁর আরও অনেক কবিতা পড়েছি এবং তাঁর সম্পর্কেও জেনেছি। তাঁর জীবনের একটা বড় অংশ কেটেছে কবিতার সঙ্গে লত্কা লত্কি করে আর এ কথাটি তিনি আমাদের জানিয়েও গেছেন কবিতায়Ñ ‘কাল সারারাত আমি কবিতার সঙ্গে অতিশয় / লত্কা লত্কি করে কাটিয়েছি...।’

শামসুর রাহমানের জন্ম বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায়। শৈশব, কৈশোর, যৌবন, কর্মজীবন সবই কেটেছে ঢাকায়। নগরজীবনের বাস্তবতা স্বাচ্ছন্দ্যে গ্রহণের শক্তি তাঁর তৈরি হয়েছিল জন্ম থেকেই। এসব বাস্তবতা সংবলিত তাঁর কবিতায় নগরজীবনের বাস্তবতা প্রতিফলিত হওয়া স্বাভাবিক। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়েছিল। এই বইয়ের বেশিরভাগ কবিতায় ঢাকার বস্তি-গ্রাম-নগরের মিশ্র জনপদের বর্ণনা আছে। নাগরিক জীবনের ক্লান্তি, ব্যর্থতা, শোভাহীনতা, নৈঃসঙ্গ্য নিপুণভাবে তুলে ধরেছেন। নিজস্ব বাকভঙ্গির মধ্যে দক্ষ শব্দ জাদুকরের মতো প্রচুর অভিনব শব্দ, চিত্রকল্প, উপমা এবং রূপক ব্যবহার করে তিনি হয়ে উঠলেন শ্রেষ্ঠ নাগরিক কবি। এই বইয়ের একটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা ‘রূপালি ¯œান’-এ তিনি লিখেছেনÑ ‘শুধু দু’টুকরো শুকনো রুটির নিরিবিলি ভোজ / অথবা প্রখর ধু-ধু পিপাসার আঁজলা-ভরানো পানীয়ের খোঁজ / শান্ত সোনালি আল্পনাময় অপরাহ্ণের কাছে এসে রোজ / চাইনি তো আমি। দৈনন্দিন পৃথিবীর পথে চাইনি শুধুই / শুকনো রুটির টক স্বাদ আর তৃষ্ণার জল। এখনও যে শুই / ভীরু-খরগোশ-ব্যবহৃত ঘাসে, বিকেলবেলায় কাঠবিড়ালীকে / দেখি ছায়া নিয়ে শরীরে ছড়ায়, -সন্ধ্যা-নদীর আঁকাবাঁকা জলে / মেঠো চাঁদ লিখে / রেখে যায় কোনো গভীর পাঁচালিÑ।’

শামসুর রাহমানের কবিতা তাঁর সমকালীন কবিদের চেয়ে স্বতন্ত্র ছিল। হয়তো এ কারণে তাঁর কবিতা পড়লে নতুন স্বর, নতুন চিত্রকল্প, উপমা, উৎপ্রেক্ষার সঙ্গে পরিচিত হওয়া যায়Ñ যাতে কেবল মুগ্ধতা আছে। এই মুগ্ধতার নেপথ্যে অন্যতম একটি উপকরণ হলো তাঁর কবিতায় বিষয়বৈচিত্র্য এবং আধুনিক প্রায় সব উপাদানের উপস্থিতি।

‘ডিমের খোলের অন্তস্থলে যেতে ভারি ইচ্ছে হয়।

সেখানে প্রস্থান করি যদি,

কেউ জানবে না,

কখনো আমার কোনো ক্রিয়ার খবর পৌঁছুবে না

কারুর কাছেই।’

(কোনো কোনো কবিতার শিরোনাম কাব্য: বর্ণমালা আমার দুঃখিনী বর্ণমাল)

অথবা

‘ছেলেবেলা থেকেই কিছু না কিছু সহসা হারিয়ে ফেলে আমি

ভারি দুঃখ পাই।

একটি রঙিন বল একদা কলকাতা থেকে এনে

আব্বা উপহার দিয়েছিলেন আমাকে,

একদিন সে-বল কোন শীতের বিকেলে

ছাদ থেকে প’ড়ে

গড়াতে গড়াতে

গড়াতে গড়াতে

কোথায় অদৃশ্য হল, পাইনি কখনো আর খোঁজ।’

(ছেলেবেলা থেকেই কাব্য: এ এক অহংকার)

শামসুর রাহমানের ‘বন্দী শিবির থেকে’ যখন পড়েছি তখন হাই স্কুলের গ-ি পেরিয়ে কলেজের চৌকাঠে পা রেখে ফেলেছি। নিজের পাঠক-মানসে ঋদ্ধতা এসেছে ততক্ষণে। একে একে পড়ে ফেলেছি তার ‘রৌদ্র করোটিতে’ (১৯৬৩) ‘নিরালোকে দিব্যরথ’ (১৯৬৮) ‘নিজ বাসভূমে (১৯৭০) এবং ‘বন্দী শিবির থেকে’ (১৯৭২) কাব্যগ্রন্থ। পাঠক হিসেবে ঋদ্ধ হওয়ার কারণেই হয়তো অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছি ‘বন্দী শিবির থেকে’ প্রকাশের পর তাঁর কবিতায় পরিপক্বতার এসেছে। এই কাব্যগ্রন্থ থেকেই তিনি কবিতায় নিজস্বতা অর্জন করতে শুরু করেছিলেন আর ‘নিজ বাসভূমে’ থেকে তাঁর কবিতায় বাঁক বদল শুরু হয়েছিল। আত্মকেন্দ্রিকতা থেকে বেরিয়ে তিনি সময়ের রূঢ় বাস্তবতার দিকে অগ্রসর হতে শুরু করেছিলেন। এই বাকভঙ্গিটা তাঁর আত্মকেন্দ্রিকতা থেকে সার্বজনীন ভাষা হয়ে উঠেছে। কবিতাগুলো যে পড়ে সে ভাবে তাঁর নিজের মনের কথা পড়ছে। এই যে লেখক ও পাঠককে মিলিয়ে দেওয়ার ক্ষমতাÑ এটা সব কবির থাকে না।

শামসুর রাহমানের কবিতা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে অবধারিতভাবে তাঁর লেখা কবিতায় মহান মুক্তিযুুদ্ধের বর্ণনা যে সুচারুরূপে বর্ণিত হয়েছে, তা উল্লেখ করতেই হবে। বলাবাহুল্য বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তাঁকে আপাদ-মস্তক বদলে দিয়েছিল, আত্মাচ্ছন্ন কবি থেকে সামাজিক অঙ্গীকারের কবিতে পরিণত করেছিল। মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে তিনি যেভাবে কবিতা লিখেছেন তা রাহমনীয় স্টাইল হয়ে দাঁড়িয়েছে। ‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা’ এবং ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতা দুটো আমাদের স্বাধীনতার প্রতীক হয়ে উঠেছে।

‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা’ কবিতায় স্বাধীনতাকাক্সক্ষী এমন কিছু মানুষের কথা বলেছেনÑ যারা একেবারে খেটে-খাওয়া, দরিদ্র সাধারণ মানুষ। উদাস দাওয়ায় বসে থাকা থুত্থুরে বুড়োÑ যার চোখের নিচে অপরাহ্ণের দুর্বল আলোর ঝিলিক। দগ্ধ ঘরের নড়বড়ে খুঁটি ধরে দাঁড়িয়ে থাকা মোল্লাবাড়ির এক বিধবা মহিলা। পথের ধারে শূন্য থালা হাতে দাঁড়িয়ে থাকা অনাথ কিশোরী। ঢাকার রিকশাওয়ালা রুস্তম শেখ, শাহবাজপুরের জোয়ান কৃষক সগির আলী, মেঘনা নদীর দক্ষ মাঝি মতলব মিঞাÑ সবাই প্রতীক্ষা করছে স্বাধীনতালাভের আশায়।

‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতায় স্বাধীনতা শব্দটিকে তিনি সাজিয়েছেন নানা বর্ণে-রূপে-সুরে এবং তিনি তা সংগ্রহ করেছেন বাংলার নৈসর্গিক জীবনাচার থেকে। স্বাধীনতাকে নজরুলের বাবরি চুল, রবীন্দ্রনাথের কবিতা, শহীদ মিনার, পতাকা মিছিল, ফসলের মাঠে কৃষকের হাসি, গ্রাম্য মেয়ের অবাধ সাঁতার ইত্যাদির সঙ্গে তুলনা করেছেন। যুদ্ধকালীন পুলিশ, রাজাকারের দৌরাত্ম্য, নারীর চিৎকার, হাত বাঁধা মানুষ, রাইফেলধারী পাঞ্জাবি সৈনিক ইত্যাদির বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছে ‘প্রত্যাহিক’ শিরোনামের কবিতায়Ñ ‘পশ্চিমা জোয়ান আসে তেড়ে / স্টেনগান হাতে আর প্রশ্ন দেয় ছুঁড়ে ঘাড় ধরে / ‘বাঙালী হো তুম?’ আমি রুদ্ধবাক, কী দেব জবাব? / জ্যোতির্ময় রৌদ্রালোকে বীরদর্পী সেনা / নিমেষেই হয়ে যায় লুটেরা, তস্কর।’

‘উদ্ধার’ ও ‘কাক’ কবিতাদ্বয় শামসুর রাহমানকে উদ্ধার করেছে আটকেপড়া বৃত্তাবদ্ধ জীবন থেকে। ‘কাক’ কবিতাটি আকারে কাকের মতো ছোট হলেও এর মধ্যে বিধৃত হয়েছে যুদ্ধকালীন বাংলাদেশের বাস্তব সমাজ আলেখ্যÑ ‘গ্রাম্য পথে পদচিহ্ন নেই। গোঠে গরু /নেই কোনো, রাখাল উধাও, রুক্ষ সরু / আল খাঁ-খাঁ, পথপার্শ্বে বৃক্ষেরা নির্বাক / নগ্ন রৌদ্র চতুর্দিকে, স্পন্দমান কাক, শুধু কাক।’ (কবিতা: কাক কাব্য : বন্দী শিবির থেকে)

মাতৃভূমিকে যারা গোরস্থানে পরিণত করেছে তাদের বিরুদ্ধে তিনি অভিশাপের বাণী উচ্চারণ করেছেন ‘ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা’ কাব্যগ্রন্থের ‘অভিশাপ দিচ্ছি’ কবিতায়। এই ধরনের অভিশাপের বাণী বাংলা কবিতায় সম্ভবত প্রথম ধ্বনিত হয়েছে। “না, আমি আসিনি / ওল্ড টেস্টামেন্টের প্রাচীন পাতা ফুঁড়ে, / দুর্বাশাও নই, / তবু আজ এখানে দাঁড়িয়ে এই রক্ত গোধূলিতে / অভিশাপ দিচ্ছি। / আমাদের বুকের ভেতর যারা ভয়ানক কৃষ্ণপক্ষ দিয়েছিলো সেঁটে, / মগজের কোষে কোষে যারা / পুঁতেছিলো আমাদেরই আপনজনের লাশ / দগ্ধ, রক্তাপ্লুত, / যারা গণহত্যা / করেছে শহরে গ্রামে টিলায় নদীতে ক্ষেত ও খামারে, / আমি অভিশাপ দিচ্ছি নেকড়ের চেয়েও অধিক / পশু সেই সব পশুদের।” (অভিশাপ দিচ্ছি কাব্য : ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা)

পাকিস্তান আমলে আইয়ুববিরোধী গণঅভ্যুত্থান এবং মুক্তিযুদ্ধের পূর্ব ও পরবর্তী বাস্তবতায় অস্ত্র হিসেবে বেছে নিয়েছেন কলমকে। ‘একটি মোনাজাতের খসড়া’ কবিতায় তিনি লিখেছেন : ‘হে পাক পারওয়ার দিগার, হে বিশ্বপালক, / আপনি আমাকে লহমায় / একজন তুখোড় রাজাকার ক’রে দিন। তা’হলেই আমি / দ্বীনের নামে দিনের পর দিন তেলা মাথায় / তেল ঢালতে পারবো অবিরল, / গরিবের গরিবী কায়েম রাখবো চিরদিন আর / মুক্তিযোদ্ধাদের গায়ের চামড়া দিয়ে / ডুগডুগি বানিয়ে নেচে বেড়াবো দিগি¦দিক আর সবার নাকের তলায় / একনিষ্ঠ ঘুণপোকার মতো অহর্নিশ / কুরে কুরে খাবো রাষ্ট্রের কাঠামো, অবকাঠামো।’

স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক আন্দোলনে দেশের সংস্কৃতি জগতের সঙ্গে কবিগণ যুক্ত হয়ে গঠিত করলেন জাতীয় কবিতা পরিষদ। উক্ত পরিষদের সভাপতি নির্বাচিত হলেন কবি শামসুর রাহমান। স্বৈরাচারবিরোধী ভূমিকার জন্য রাষ্ট্রপতি এরশাদের রোষানলে পড়ে ‘দৈনিক বাংলা’ পত্রিকার সম্পাদক পদ ছাড়তে হয়।

স্বৈরশাসক আইয়ুব খানকে বিদ্রুপ করে ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত ‘হাতির শুঁড়’ কবিতায় লিখেছিলেনÑ ‘ঘুমের খাটে শঙ্খমালা ঘুমন্ত / কৌটো-খোলা ভোমরা মরে জীবন্ত / ঐরাবতের খেয়ালখুশির ধান্ধায় / ভোরের ফকির মুকুট পরে সন্ধ্যায় / ...সেই চালে ভাই মিত্র কিবা শত্তুর / চলছে সবাই মস্ত সহায় হাতির শুঁড়।”

গণতন্ত্রের জন্য লড়াকু সৈনিক শহীদ নূর হোসেনকে উৎসর্গ করে রচিত ‘বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়’ কবিতায় লিখেছেনÑ

‘শহরে টহলদার ঝাঁক ঝাঁক বন্দুকের সীসা

নূর হোসেনের বুক নয় বাংলাদেশের হৃদয়

ফুটো করে দেয়; বাংলাদেশ

বনপোড়া হরিণীর মতো আর্তনাদ করে, তার

বুক থেকে অবিরল রক্ত ঝরতে থাকে, রক্ত ঝরতে থাকে।’

সত্তরের নভেম্বরের ভয়াল জলোচ্ছ্বাসের পর মওলানা ভাসানীর পল্টনের ঐতিহাসিক জনসভার পটভূমিতে রচিত ‘সফেদ পাঞ্জাবি’ কবিতায় লিখেছেনÑ

‘বল্লমের মতো ঝলসে ওঠে তার হাত বারবার

অতিদ্রুত স্ফীত হয়, স্ফীত হয়, মৌলানার সফেদ পাঞ্জাবি

যেন তিনি ধবধবে একটি পাঞ্জাবি দিয়ে সব

বিক্ষিপ্ত বে-আব্রু লাশ কী ব্যাকুল ঢেকে দিতে চান।

অজস্র কবিতা, গল্পে মানুষের কথা বলে যাওয়া এক কবি শামসুর রাহমান স্বদেশের ভাবনাতাড়িত হয়ে কাব্য রচনায় ছন্দোময় ও শিল্পিত শব্দের প্রক্ষেপণে ধারণ করেছেন বাঙালি ও বাংলা ভাষার অনন্য কবির পরিচয়। আপন কাব্যশৈলীর গুণে আবির্ভূত হয়েছিলেন জীবনানন্দ দাশের পরে বাংলা কাব্যভুবনের সবচেয়ে আলোচিত কবি হিসেবে। ‘বর্ণমালা আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’ কবিতায় বলেছেনÑ ‘নক্ষত্রপুঞ্জের মতো জ¦লজ¦লে পতাকা উড়িয়ে আছো আমার সত্তায় / মমতা নামের প্লুত প্রদেশের শ্যামলিমা তোমাকে নিবিড় / ঘিরে রয় সর্বদাই...!’

ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে জীবন বিসর্জন দেয়া আসাদকে নিয়ে লিখেছেন ‘আসাদের শার্ট’ কবিতাটি। পুলিশের গুলিতে নিহত আসাদের শার্ট উঁচুতে তুলে ধরে প্রতিবাদী এক কবির তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া প্রকাশিত হয়েছে এ কবিতায়Ñ ‘ডালিম গাছের মৃদু ছায়া আর রোদ্দুর-শোভিত / মায়ের উঠোন ছেড়ে এখন সে-শার্ট / শহরের প্রধান সড়কে / কারখানার চিমনি-চূড়োয় / গমগমে এভেন্যুর আনাচে কানাচে / উড়ছে, উড়ছে অবিরাম।’

এভাবেই নিভৃতচারী ও রোমান্টিক কবি শামসুর রাহমান হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশের সমকাল, অনাগত সময় এবং সর্বোপরি অনাদিকালে গুরুত্বপূর্ণ কাব্য ভাষ্যকার। কবিতা ছাড়াও উপন্যাস, ছড়া, প্রবন্ধ লেখার পাশাপাশি অনুবাদও করেছেন। গীতিকার হিসেবেও তাঁর পরিচিতি আছে। সংখ্যাধিক্যে না হলেও শব্দ চয়ন, উপমা ও শব্দের অন্ত্যমিল ব্যবহারে যা কিনা মানের বিবেচনায় পেয়েছে উৎকর্ষতা। তার উল্লেখযোগ্য গানের মধ্যে রয়েছেÑ ‘প্রতিদিন তোমায় দেখি সূর্য রাগে’ ‘স্মৃতি ঝলমল সুনীল মাঠের কাছে’ ‘ফসলের মাঠে মেঘনার তীরে’র মতো বিখ্যাত গান।

মৃত্যু নিয়ে শামসুর রাহমান প্রায়ই ভাবতেন। তার ভাবনার মধ্যে মৃত্যু ছিল বলেই হয়তো ‘ইচ্ছা’ নামক কবিতায় নিজের সুপ্ত বাসনা প্রকাশ করেছিলেন, ‘যদি বাঁচি চার দশকের বেশি / লিখবো / ...যদি বেঁচে যাই একদিন আরো / লিখবো।’

তিনি চার দশকেরও বেশি সময় ধরে যা লিখে গেছেন তা হয়তো দশকের পর দশক মানুষ পড়বে, গবেষণা হবে। কিন্তু কবি তা অবলোকন করতে পারবেন না। তিনি লিখেছেন, ‘যেদিন মরবো আমি, সেদিন কী বার হবে, বলা মুশকিল / শুক্রবার? বুধবার? শনিবার? নাকি রবিবার / যে বারই হোক / সেদিন বর্ষায় যেন না ভেজে শহর, যেন ঘিনঘিনে কাদা / না জমে গলির মোড়ে। সেদিন ভাসলে পথ-ঘাট / পূণ্যবান শবানুগামীরা বড়ো বিরক্ত হবেন।’

তিনি যেদিন চিরন্তন মহাযাত্রায় চলে গেলেন তখনও আলনায় ঝুলেছিল তার সাদা জামাটি, জমজ কবরের মতো জুতো জোড়া পড়েছিল ঘরের এক কোণে আর কবিতার শে^ত-শুভ্র খাতায়, বায়োগ্রাফিতে লেখা হয়েছিল ১৭ আগস্ট ২০০৬ খ্রিস্টাব্দ।

ছবি

সৈয়দ আবদুস সাদিক শোক-পঙ্ক্তি

ছবি

আমার রমণীর ফল

ছবি

প্রসঙ্গ : লেখকের বুদ্ধিবৃৃত্তিক দায় ও দর্শনের খোঁজে

সাময়িকী কবিতা

ছবি

অর্বাচীন নোঙর

ছবি

শামসুর রাহমানের রাজনীতির কবিতা, কবিতার রাজনীতি

ছবি

জীবনানন্দ দাশ: শুশ্রƒষার আশ্রয়ঘর

ছবি

আহমদ ছফা ও অলাতচক্র

সাময়িকী কবিতা

ছবি

দ্য হোয়াইট বুক

ছবি

হান কাঙের ৫টি কবিতা

ছবি

আমার রমণীর ফল

ছবি

ছোট ছোট ঘটনাই আমার অনুপ্রেরণা-হান কাং

ছবি

হান কাংয়ের প্রগাঢ় কাব্যিক গদ্য

ছবি

নার্গিস-উদ্যানে নজরুল তর্ক

ছবি

শহীদ কাদরীর কবি হয়ে ওঠা

ছবি

মাথার ওপর ছাতা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

অমিয়ভূষণ : ধ্রুপদীয়া আর স্ববিরোধের সমন্বয়

ছবি

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র স্বাতন্ত্র্য ও শ্রেষ্ঠত্ব

ছবি

মার্কেস ও আমার বিস্ময়

ছবি

অস্থির পৃথিবীর মায়াবী কবি

ছবি

সম্প্রীতির সাধক মরমী বাউল উকিল মুন্সী

ছবি

‘দিবারাত্রির কাব্য’ এবং ‘দ্য আউটসাইডার’ এক নিবিড় সাযুজ্য

ছবি

চুক্তি লিখন

ছবি

লিওপল্ড সেদর সেঙ্ঘর-এর কবিতা

ছবি

হিমু ও হুমায়ূন আহমেদ

শরতের পদাবলি

সাময়িকী কবিতা

মার্কিন চলচ্চিত্র জগতের প্রাণকেন্দ্র লস এঞ্জেলেস

ছবি

যুদ্ধের জানালায় দাঁড়িয়ে

ছবি

শব্দঘর : বিপ্লব, দ্রোহ ও গুচ্ছ কবিতা সংখ্যা

ছবি

সাহিত্যের দর্শনানুসন্ধান

ছবি

সালভাতর কোয়াসিমোদোর কবিতা

ছবি

টুটু

ছবি

অর্ধেক জীবন

tab

সাময়িকী

যে কবিতায় শামসুর রাহমানকে চিনেছি

বাসার তাসাউফ

শামসুর রাহমান ও ‘শামসুর রাহমান : নিঃসঙ্গ শেরপা’র লেখক হুমায়ুন আজাদ

বৃহস্পতিবার, ২৪ অক্টোবর ২০২৪

কবি শামসুর রাহমানের ‘কখনো আমার মাকে’ কবিতাটি প্রথম যখন পড়ি তখন থাকি গ্রামে। অনন্তপুর আমার গ্রামের নাম। অজপড়াগাঁ। তখন আমার বয়স কত ছিল মনে নেই। তবে আমি যে তখন স্কুলে পড়তাম তা মনে আছে। আমাদের গ্রামে তখন ইলেট্রিসিটি ছিল না। দিনের শেষ হওয়া আলো আর রাতের সূচিত আঁধারে বৃক্ষের ছায়াঘেরা নির্জনে আমার থাকার ঘরটিকে মনে হতো ভৌতিক এক আবাসভূমি। সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত যত গভীর হতো প্রকৃতিজুড়ে নেমে আসত প্রগাঢ় রহস্যময়তা। অরণ্য আঁধারে প্রেতিনীর কান্না, শেওড়াগাছে ভূত অথবা অশরীরী আত্মার আনাগোনাÑ সবই ছিল রূপকথার মতো। হারিকেনের টিমটিমে আলোয় আমার বুক ধুক্ পুক্ করে কাঁপত। মনে হতো, জানালার বাইরে এখনই ভেসে উঠবে ভয়ানক কোনো দাঁতাল জন্তুর মুখ। এমনই গা ছমছম করা অবুঝ কৈশোরে আমি পড়েছিলাম শামসুর রাহমানের ‘বিধ্বস্ত নীলিমা’ কবিতার বইটি। সেই কিশোরবেলায় কোনো এক চৈত্রের বিকেলে আমার আব্বা বাজারের লাইব্রেরি থেকে কিছু গল্প-কবিতার বই নিয়ে এসেছিলেন। আমার বড় আপুরা এসব বই পড়তে পছন্দ করতেন। সব বই ছোটদের পড়ার উপযোগী ছিল না। আমি ভূত ভয় পাই বলে আব্বা দুয়েকটা ভৌতিক গল্পের বইও এনেছিলেন। ভূতের ভয় কাটাবার জন্য ভূতের বই পড়াÑ ব্যাপারটা ছিল খুবই মজার। কিন্তু আমি ভূতের বই পড়তে পছন্দ করতাম না। আপুরা যেসব বই পড়ত আমিও সেই বইগুলো পড়তে চাইতাম। কিন্তু আমাকে পড়তে দেয়া হতো না। বড় আপুকে দেখেছি ‘চিতাবহ্নিমান’ নামের একটি বই পড়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে। এসব বই পড়লে আমিও কেঁদে ফেলব বলেই কি আমাকে পড়তে দেয়া হয়নি? এমন প্রশ্নই জেগেছিল আমার কৈশোর অনুত্তীর্ণ মনে। নিষেধ থাকা সত্ত্বেও এক রাতে মেঝো আপুর পড়ার টেবিলে পড়ে থাকা কয়েকটি বই থেকে বেছে ‘বিধ্বস্ত নীলিমা’ নামের একটি বই আমি হাতে নিলাম। কয়েক পাতা উলটে ‘কখনো আমার মাকে’ শিরোনামের কবিতাটি চোখে পড়ল। পড়ে ফেললাম এক নিশ^াসে। পড়ার পরই আবার পড়তে ইচ্ছে হলো। আরেকবার পড়লাম। দ্বিতীয়বার পড়ার আমার কিশোর মনে অদ্ভুত এক ‘দোল’-এর অনুভূতি তৈরি হলো এবং তা মনের গহিনে এতটাই দোলা দিয়েছিল যে তা স্থায়ী ছিল বহুক্ষণ, এমনকি বহুদিনও। ব্যস, ওইটুকুই। কবিতাটির নিগূঢ় অর্থ বা এর তাৎপর্য বোঝার মতো জ্ঞান তখনো আমার হয়ে ওঠেনি। কিন্তু যখন পড়লাম, ‘কখনো আমার মাকে কোনো গান গাইতে শুনিনি’ তখনই কবি আমার আপন মানুষ হয়ে উঠলেন। আরে ঠিকই তো! আমিও তো আমার মাকে কোনোদিন গান গাইতে শুনিনি!

শুধু ঘরকন্না নিয়েই ব্যস্ত থাকবেন, রান্না-বান্না করবেন, সন্তান জন্ম দেবেন, লালন-পালন করবেন, সর্বোপরি নিজের অসুখ-বিসুখ উপেক্ষা করে গৃহকর্তা ও সন্তানদের সন্তুষ্টির জন্য নিজেকে উৎসর্গ করে দিবেনÑ মাকে নিয়ে এমন ধারণা আমাদের চিরকালের। কিন্তু কবিতাটি পড়ার পর একটু আবেগাপ্লুত হয়ে ভেবেছিলাম, কথাগুলো আমার মাকে নিয়ে লেখা।

শামসুর রাহমান মায়ের এমন একটি ঘরোয়া বিষয় নিয়ে কবিতা লিখলেন যে তাকে মনে রাখা বা চিরকাল বাঁচিয়ে রাখা আমাদের দায়িত্ব হয়ে গেল। কবিতাটি যারা পড়বেন পড়তে পড়তে প্রায় প্রতিটি শব্দে, বাক্যে নিজের মাকে খুঁজে পাবেন। আমিও আমার মাকে খুঁেজ পেয়েছি অথবা কবির মা-ই হয়ে উঠেছে আমার মা। আর এই অনুভূতির কারণেই শামসুর রাহমান আমার জীবনে চির স্মরণীয় একজন ব্যক্তি হয়ে উঠলেন। যুগে যুগে সেই সব কবি বা সাহিত্যিক অমর হয়েছেন যাদের ভাবনানিঃসৃত কথামালা বাণীবদ্ধ হয়ে সকলের ভাবনার সঙ্গে মিলে গিয়েছে। শামসুর রাহমান এই কবিতাটিতে অনুভূতির প্রক্ষেপণে বাঙালি ও বাংলা ভাষার পাঠক হৃদয়ে যে অনভূতির বিস্তার করেছেন এইটুকুই তাঁকে অমর করে রাখতে যথেষ্ট।

শৈশব-কৈশোরে এই একটি কবিতা দিয়ে চেনা কবি শামসুর রাহমান এর পর হয়ে গেলেন আমার প্রিয় কবিদের একজন আর তাঁর কবিতা হয়ে গেল আমার নিয়মিত পাঠচর্চার মূল উপাদান। সেই একটি কবিতা ভালো লাগা থেকে তাঁর আরও অনেক কবিতা পড়েছি এবং তাঁর সম্পর্কেও জেনেছি। তাঁর জীবনের একটা বড় অংশ কেটেছে কবিতার সঙ্গে লত্কা লত্কি করে আর এ কথাটি তিনি আমাদের জানিয়েও গেছেন কবিতায়Ñ ‘কাল সারারাত আমি কবিতার সঙ্গে অতিশয় / লত্কা লত্কি করে কাটিয়েছি...।’

শামসুর রাহমানের জন্ম বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায়। শৈশব, কৈশোর, যৌবন, কর্মজীবন সবই কেটেছে ঢাকায়। নগরজীবনের বাস্তবতা স্বাচ্ছন্দ্যে গ্রহণের শক্তি তাঁর তৈরি হয়েছিল জন্ম থেকেই। এসব বাস্তবতা সংবলিত তাঁর কবিতায় নগরজীবনের বাস্তবতা প্রতিফলিত হওয়া স্বাভাবিক। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়েছিল। এই বইয়ের বেশিরভাগ কবিতায় ঢাকার বস্তি-গ্রাম-নগরের মিশ্র জনপদের বর্ণনা আছে। নাগরিক জীবনের ক্লান্তি, ব্যর্থতা, শোভাহীনতা, নৈঃসঙ্গ্য নিপুণভাবে তুলে ধরেছেন। নিজস্ব বাকভঙ্গির মধ্যে দক্ষ শব্দ জাদুকরের মতো প্রচুর অভিনব শব্দ, চিত্রকল্প, উপমা এবং রূপক ব্যবহার করে তিনি হয়ে উঠলেন শ্রেষ্ঠ নাগরিক কবি। এই বইয়ের একটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা ‘রূপালি ¯œান’-এ তিনি লিখেছেনÑ ‘শুধু দু’টুকরো শুকনো রুটির নিরিবিলি ভোজ / অথবা প্রখর ধু-ধু পিপাসার আঁজলা-ভরানো পানীয়ের খোঁজ / শান্ত সোনালি আল্পনাময় অপরাহ্ণের কাছে এসে রোজ / চাইনি তো আমি। দৈনন্দিন পৃথিবীর পথে চাইনি শুধুই / শুকনো রুটির টক স্বাদ আর তৃষ্ণার জল। এখনও যে শুই / ভীরু-খরগোশ-ব্যবহৃত ঘাসে, বিকেলবেলায় কাঠবিড়ালীকে / দেখি ছায়া নিয়ে শরীরে ছড়ায়, -সন্ধ্যা-নদীর আঁকাবাঁকা জলে / মেঠো চাঁদ লিখে / রেখে যায় কোনো গভীর পাঁচালিÑ।’

শামসুর রাহমানের কবিতা তাঁর সমকালীন কবিদের চেয়ে স্বতন্ত্র ছিল। হয়তো এ কারণে তাঁর কবিতা পড়লে নতুন স্বর, নতুন চিত্রকল্প, উপমা, উৎপ্রেক্ষার সঙ্গে পরিচিত হওয়া যায়Ñ যাতে কেবল মুগ্ধতা আছে। এই মুগ্ধতার নেপথ্যে অন্যতম একটি উপকরণ হলো তাঁর কবিতায় বিষয়বৈচিত্র্য এবং আধুনিক প্রায় সব উপাদানের উপস্থিতি।

‘ডিমের খোলের অন্তস্থলে যেতে ভারি ইচ্ছে হয়।

সেখানে প্রস্থান করি যদি,

কেউ জানবে না,

কখনো আমার কোনো ক্রিয়ার খবর পৌঁছুবে না

কারুর কাছেই।’

(কোনো কোনো কবিতার শিরোনাম কাব্য: বর্ণমালা আমার দুঃখিনী বর্ণমাল)

অথবা

‘ছেলেবেলা থেকেই কিছু না কিছু সহসা হারিয়ে ফেলে আমি

ভারি দুঃখ পাই।

একটি রঙিন বল একদা কলকাতা থেকে এনে

আব্বা উপহার দিয়েছিলেন আমাকে,

একদিন সে-বল কোন শীতের বিকেলে

ছাদ থেকে প’ড়ে

গড়াতে গড়াতে

গড়াতে গড়াতে

কোথায় অদৃশ্য হল, পাইনি কখনো আর খোঁজ।’

(ছেলেবেলা থেকেই কাব্য: এ এক অহংকার)

শামসুর রাহমানের ‘বন্দী শিবির থেকে’ যখন পড়েছি তখন হাই স্কুলের গ-ি পেরিয়ে কলেজের চৌকাঠে পা রেখে ফেলেছি। নিজের পাঠক-মানসে ঋদ্ধতা এসেছে ততক্ষণে। একে একে পড়ে ফেলেছি তার ‘রৌদ্র করোটিতে’ (১৯৬৩) ‘নিরালোকে দিব্যরথ’ (১৯৬৮) ‘নিজ বাসভূমে (১৯৭০) এবং ‘বন্দী শিবির থেকে’ (১৯৭২) কাব্যগ্রন্থ। পাঠক হিসেবে ঋদ্ধ হওয়ার কারণেই হয়তো অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছি ‘বন্দী শিবির থেকে’ প্রকাশের পর তাঁর কবিতায় পরিপক্বতার এসেছে। এই কাব্যগ্রন্থ থেকেই তিনি কবিতায় নিজস্বতা অর্জন করতে শুরু করেছিলেন আর ‘নিজ বাসভূমে’ থেকে তাঁর কবিতায় বাঁক বদল শুরু হয়েছিল। আত্মকেন্দ্রিকতা থেকে বেরিয়ে তিনি সময়ের রূঢ় বাস্তবতার দিকে অগ্রসর হতে শুরু করেছিলেন। এই বাকভঙ্গিটা তাঁর আত্মকেন্দ্রিকতা থেকে সার্বজনীন ভাষা হয়ে উঠেছে। কবিতাগুলো যে পড়ে সে ভাবে তাঁর নিজের মনের কথা পড়ছে। এই যে লেখক ও পাঠককে মিলিয়ে দেওয়ার ক্ষমতাÑ এটা সব কবির থাকে না।

শামসুর রাহমানের কবিতা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে অবধারিতভাবে তাঁর লেখা কবিতায় মহান মুক্তিযুুদ্ধের বর্ণনা যে সুচারুরূপে বর্ণিত হয়েছে, তা উল্লেখ করতেই হবে। বলাবাহুল্য বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তাঁকে আপাদ-মস্তক বদলে দিয়েছিল, আত্মাচ্ছন্ন কবি থেকে সামাজিক অঙ্গীকারের কবিতে পরিণত করেছিল। মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে তিনি যেভাবে কবিতা লিখেছেন তা রাহমনীয় স্টাইল হয়ে দাঁড়িয়েছে। ‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা’ এবং ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতা দুটো আমাদের স্বাধীনতার প্রতীক হয়ে উঠেছে।

‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা’ কবিতায় স্বাধীনতাকাক্সক্ষী এমন কিছু মানুষের কথা বলেছেনÑ যারা একেবারে খেটে-খাওয়া, দরিদ্র সাধারণ মানুষ। উদাস দাওয়ায় বসে থাকা থুত্থুরে বুড়োÑ যার চোখের নিচে অপরাহ্ণের দুর্বল আলোর ঝিলিক। দগ্ধ ঘরের নড়বড়ে খুঁটি ধরে দাঁড়িয়ে থাকা মোল্লাবাড়ির এক বিধবা মহিলা। পথের ধারে শূন্য থালা হাতে দাঁড়িয়ে থাকা অনাথ কিশোরী। ঢাকার রিকশাওয়ালা রুস্তম শেখ, শাহবাজপুরের জোয়ান কৃষক সগির আলী, মেঘনা নদীর দক্ষ মাঝি মতলব মিঞাÑ সবাই প্রতীক্ষা করছে স্বাধীনতালাভের আশায়।

‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতায় স্বাধীনতা শব্দটিকে তিনি সাজিয়েছেন নানা বর্ণে-রূপে-সুরে এবং তিনি তা সংগ্রহ করেছেন বাংলার নৈসর্গিক জীবনাচার থেকে। স্বাধীনতাকে নজরুলের বাবরি চুল, রবীন্দ্রনাথের কবিতা, শহীদ মিনার, পতাকা মিছিল, ফসলের মাঠে কৃষকের হাসি, গ্রাম্য মেয়ের অবাধ সাঁতার ইত্যাদির সঙ্গে তুলনা করেছেন। যুদ্ধকালীন পুলিশ, রাজাকারের দৌরাত্ম্য, নারীর চিৎকার, হাত বাঁধা মানুষ, রাইফেলধারী পাঞ্জাবি সৈনিক ইত্যাদির বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছে ‘প্রত্যাহিক’ শিরোনামের কবিতায়Ñ ‘পশ্চিমা জোয়ান আসে তেড়ে / স্টেনগান হাতে আর প্রশ্ন দেয় ছুঁড়ে ঘাড় ধরে / ‘বাঙালী হো তুম?’ আমি রুদ্ধবাক, কী দেব জবাব? / জ্যোতির্ময় রৌদ্রালোকে বীরদর্পী সেনা / নিমেষেই হয়ে যায় লুটেরা, তস্কর।’

‘উদ্ধার’ ও ‘কাক’ কবিতাদ্বয় শামসুর রাহমানকে উদ্ধার করেছে আটকেপড়া বৃত্তাবদ্ধ জীবন থেকে। ‘কাক’ কবিতাটি আকারে কাকের মতো ছোট হলেও এর মধ্যে বিধৃত হয়েছে যুদ্ধকালীন বাংলাদেশের বাস্তব সমাজ আলেখ্যÑ ‘গ্রাম্য পথে পদচিহ্ন নেই। গোঠে গরু /নেই কোনো, রাখাল উধাও, রুক্ষ সরু / আল খাঁ-খাঁ, পথপার্শ্বে বৃক্ষেরা নির্বাক / নগ্ন রৌদ্র চতুর্দিকে, স্পন্দমান কাক, শুধু কাক।’ (কবিতা: কাক কাব্য : বন্দী শিবির থেকে)

মাতৃভূমিকে যারা গোরস্থানে পরিণত করেছে তাদের বিরুদ্ধে তিনি অভিশাপের বাণী উচ্চারণ করেছেন ‘ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা’ কাব্যগ্রন্থের ‘অভিশাপ দিচ্ছি’ কবিতায়। এই ধরনের অভিশাপের বাণী বাংলা কবিতায় সম্ভবত প্রথম ধ্বনিত হয়েছে। “না, আমি আসিনি / ওল্ড টেস্টামেন্টের প্রাচীন পাতা ফুঁড়ে, / দুর্বাশাও নই, / তবু আজ এখানে দাঁড়িয়ে এই রক্ত গোধূলিতে / অভিশাপ দিচ্ছি। / আমাদের বুকের ভেতর যারা ভয়ানক কৃষ্ণপক্ষ দিয়েছিলো সেঁটে, / মগজের কোষে কোষে যারা / পুঁতেছিলো আমাদেরই আপনজনের লাশ / দগ্ধ, রক্তাপ্লুত, / যারা গণহত্যা / করেছে শহরে গ্রামে টিলায় নদীতে ক্ষেত ও খামারে, / আমি অভিশাপ দিচ্ছি নেকড়ের চেয়েও অধিক / পশু সেই সব পশুদের।” (অভিশাপ দিচ্ছি কাব্য : ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা)

পাকিস্তান আমলে আইয়ুববিরোধী গণঅভ্যুত্থান এবং মুক্তিযুদ্ধের পূর্ব ও পরবর্তী বাস্তবতায় অস্ত্র হিসেবে বেছে নিয়েছেন কলমকে। ‘একটি মোনাজাতের খসড়া’ কবিতায় তিনি লিখেছেন : ‘হে পাক পারওয়ার দিগার, হে বিশ্বপালক, / আপনি আমাকে লহমায় / একজন তুখোড় রাজাকার ক’রে দিন। তা’হলেই আমি / দ্বীনের নামে দিনের পর দিন তেলা মাথায় / তেল ঢালতে পারবো অবিরল, / গরিবের গরিবী কায়েম রাখবো চিরদিন আর / মুক্তিযোদ্ধাদের গায়ের চামড়া দিয়ে / ডুগডুগি বানিয়ে নেচে বেড়াবো দিগি¦দিক আর সবার নাকের তলায় / একনিষ্ঠ ঘুণপোকার মতো অহর্নিশ / কুরে কুরে খাবো রাষ্ট্রের কাঠামো, অবকাঠামো।’

স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক আন্দোলনে দেশের সংস্কৃতি জগতের সঙ্গে কবিগণ যুক্ত হয়ে গঠিত করলেন জাতীয় কবিতা পরিষদ। উক্ত পরিষদের সভাপতি নির্বাচিত হলেন কবি শামসুর রাহমান। স্বৈরাচারবিরোধী ভূমিকার জন্য রাষ্ট্রপতি এরশাদের রোষানলে পড়ে ‘দৈনিক বাংলা’ পত্রিকার সম্পাদক পদ ছাড়তে হয়।

স্বৈরশাসক আইয়ুব খানকে বিদ্রুপ করে ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত ‘হাতির শুঁড়’ কবিতায় লিখেছিলেনÑ ‘ঘুমের খাটে শঙ্খমালা ঘুমন্ত / কৌটো-খোলা ভোমরা মরে জীবন্ত / ঐরাবতের খেয়ালখুশির ধান্ধায় / ভোরের ফকির মুকুট পরে সন্ধ্যায় / ...সেই চালে ভাই মিত্র কিবা শত্তুর / চলছে সবাই মস্ত সহায় হাতির শুঁড়।”

গণতন্ত্রের জন্য লড়াকু সৈনিক শহীদ নূর হোসেনকে উৎসর্গ করে রচিত ‘বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়’ কবিতায় লিখেছেনÑ

‘শহরে টহলদার ঝাঁক ঝাঁক বন্দুকের সীসা

নূর হোসেনের বুক নয় বাংলাদেশের হৃদয়

ফুটো করে দেয়; বাংলাদেশ

বনপোড়া হরিণীর মতো আর্তনাদ করে, তার

বুক থেকে অবিরল রক্ত ঝরতে থাকে, রক্ত ঝরতে থাকে।’

সত্তরের নভেম্বরের ভয়াল জলোচ্ছ্বাসের পর মওলানা ভাসানীর পল্টনের ঐতিহাসিক জনসভার পটভূমিতে রচিত ‘সফেদ পাঞ্জাবি’ কবিতায় লিখেছেনÑ

‘বল্লমের মতো ঝলসে ওঠে তার হাত বারবার

অতিদ্রুত স্ফীত হয়, স্ফীত হয়, মৌলানার সফেদ পাঞ্জাবি

যেন তিনি ধবধবে একটি পাঞ্জাবি দিয়ে সব

বিক্ষিপ্ত বে-আব্রু লাশ কী ব্যাকুল ঢেকে দিতে চান।

অজস্র কবিতা, গল্পে মানুষের কথা বলে যাওয়া এক কবি শামসুর রাহমান স্বদেশের ভাবনাতাড়িত হয়ে কাব্য রচনায় ছন্দোময় ও শিল্পিত শব্দের প্রক্ষেপণে ধারণ করেছেন বাঙালি ও বাংলা ভাষার অনন্য কবির পরিচয়। আপন কাব্যশৈলীর গুণে আবির্ভূত হয়েছিলেন জীবনানন্দ দাশের পরে বাংলা কাব্যভুবনের সবচেয়ে আলোচিত কবি হিসেবে। ‘বর্ণমালা আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’ কবিতায় বলেছেনÑ ‘নক্ষত্রপুঞ্জের মতো জ¦লজ¦লে পতাকা উড়িয়ে আছো আমার সত্তায় / মমতা নামের প্লুত প্রদেশের শ্যামলিমা তোমাকে নিবিড় / ঘিরে রয় সর্বদাই...!’

ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে জীবন বিসর্জন দেয়া আসাদকে নিয়ে লিখেছেন ‘আসাদের শার্ট’ কবিতাটি। পুলিশের গুলিতে নিহত আসাদের শার্ট উঁচুতে তুলে ধরে প্রতিবাদী এক কবির তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া প্রকাশিত হয়েছে এ কবিতায়Ñ ‘ডালিম গাছের মৃদু ছায়া আর রোদ্দুর-শোভিত / মায়ের উঠোন ছেড়ে এখন সে-শার্ট / শহরের প্রধান সড়কে / কারখানার চিমনি-চূড়োয় / গমগমে এভেন্যুর আনাচে কানাচে / উড়ছে, উড়ছে অবিরাম।’

এভাবেই নিভৃতচারী ও রোমান্টিক কবি শামসুর রাহমান হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশের সমকাল, অনাগত সময় এবং সর্বোপরি অনাদিকালে গুরুত্বপূর্ণ কাব্য ভাষ্যকার। কবিতা ছাড়াও উপন্যাস, ছড়া, প্রবন্ধ লেখার পাশাপাশি অনুবাদও করেছেন। গীতিকার হিসেবেও তাঁর পরিচিতি আছে। সংখ্যাধিক্যে না হলেও শব্দ চয়ন, উপমা ও শব্দের অন্ত্যমিল ব্যবহারে যা কিনা মানের বিবেচনায় পেয়েছে উৎকর্ষতা। তার উল্লেখযোগ্য গানের মধ্যে রয়েছেÑ ‘প্রতিদিন তোমায় দেখি সূর্য রাগে’ ‘স্মৃতি ঝলমল সুনীল মাঠের কাছে’ ‘ফসলের মাঠে মেঘনার তীরে’র মতো বিখ্যাত গান।

মৃত্যু নিয়ে শামসুর রাহমান প্রায়ই ভাবতেন। তার ভাবনার মধ্যে মৃত্যু ছিল বলেই হয়তো ‘ইচ্ছা’ নামক কবিতায় নিজের সুপ্ত বাসনা প্রকাশ করেছিলেন, ‘যদি বাঁচি চার দশকের বেশি / লিখবো / ...যদি বেঁচে যাই একদিন আরো / লিখবো।’

তিনি চার দশকেরও বেশি সময় ধরে যা লিখে গেছেন তা হয়তো দশকের পর দশক মানুষ পড়বে, গবেষণা হবে। কিন্তু কবি তা অবলোকন করতে পারবেন না। তিনি লিখেছেন, ‘যেদিন মরবো আমি, সেদিন কী বার হবে, বলা মুশকিল / শুক্রবার? বুধবার? শনিবার? নাকি রবিবার / যে বারই হোক / সেদিন বর্ষায় যেন না ভেজে শহর, যেন ঘিনঘিনে কাদা / না জমে গলির মোড়ে। সেদিন ভাসলে পথ-ঘাট / পূণ্যবান শবানুগামীরা বড়ো বিরক্ত হবেন।’

তিনি যেদিন চিরন্তন মহাযাত্রায় চলে গেলেন তখনও আলনায় ঝুলেছিল তার সাদা জামাটি, জমজ কবরের মতো জুতো জোড়া পড়েছিল ঘরের এক কোণে আর কবিতার শে^ত-শুভ্র খাতায়, বায়োগ্রাফিতে লেখা হয়েছিল ১৭ আগস্ট ২০০৬ খ্রিস্টাব্দ।

back to top