alt

সাময়িকী

অর্বাচীন নোঙর

মহিবুল আলম

: বৃহস্পতিবার, ২৪ অক্টোবর ২০২৪

শিল্পী : সঞ্জয় দে রিপন

ট্রেনে যুবতীটি বেশ কেঁদেছিলো। কিন্তু এখন তাকে বেশ স্বাভাবিক লাগছে। এখন সে থেমে থেমে হেসে উঠছে নিঃশব্দে।

ওরা হাঁটছে সামনের দিকে ঝুঁকে ঝুঁকে। পায়ের নিচে উঁচু আইল, মেঠো পথ। এক ধরনের মসৃণতা-অমসৃণতার দ্বন্দ্ব পথের সর্বত্র বিরাজ করছে। ওরা বেশ ক্লান্ত। দেহ টেনে টেনে চলছে। মাঝে মাঝে মৃদু হোঁচট খাচ্ছে। কখনও নিজে নিজেই ভারসাম্য ঠিক করছে। কখনও একজন অপর জনের বাহু চেপে ধরছে।

দেহ দুটোর একজন যুবক, আর অন্যজন যুবতী। উভয়ের অবস্থান ভিন্ন মাত্রিক আকারের। কিন্তু লক্ষ্য এক, টান এক। যুবকটি মাটি চষে, সময়কে কর্ষণ করে একটা নির্দিষ্ট ধাপে এসে উত্তীর্ণ হয়েছে। আর যুবতীটি দেখেনি ভাঙনের গান ও প্রকৃতির কর্ষণ। যুবতী জন্মের পরই দেখেছে এক লাগামহীন পৃথিবী। কিন্তু যুবকটি প্রতিনিয়ত পেয়েছে শুধু সংকীর্ণ পৃথিবী, বৈরি প্রকৃতি, আর প্রতিকূল সমাজ ব্যবস্থা।

যুবকটির নামÑ জাহিদ, আর যুবতীটির নামÑ তন্বী। এই যুবক-যুবতী পেছনে ফেলে এসেছে এক বিধ্বস্ত পৃথিবী। এবার গড়তে যাচ্ছে নবীন পৃথিবী, অবাচীন নোঙর। কিন্তু এই অর্বাচীন নোঙর কোন পললে ফেলবে ওরা জানে না। এই নবীন পৃথিবী কোন ¯্রােতে ভাসাবে ওরা তাও জানে না। ওরা অসীমের দিকে হাত বাড়িয়েছে। অনন্তের দিকে মুখ করে অনন্তকে টেনে এনেছে নিকটে, অতি নিকটে। অস্তিত্বের কাছাকাছি।

ওরা হাঁটতে হাঁটতে একটা খালের পাড়ে এসে থামলো। ডান হাতের ব্যাগটা বাঁহাতে নিয়ে যুবক, জাহিদ তাকালো খালের ভেতর। দৃষ্টি ফেললো এপার থেকে ওপারে যাওয়ার সাঁকোটার ওপর। সাঁকোটার আকার অপ্রশস্ত, আর খালের ভেতর জলের ধারা খুবই ক্ষীণ। এতটাই ক্ষীণ যে জলধারা খালটাকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখছে ঠিকই, কিন্তু অস্তিত্বের স্পন্দন জানান দিচ্ছে সলতে পোড়া শিখা হয়ে।

জাহিদ দেখলো, ইচ্ছে করলেই জলকে মাড়িয়ে খালটা পার হয়ে যেতে পারে। তাই সে সেদিকে নামতে গেলো।

তন্বী জিজ্ঞেস করলো, ‘নিচে নামছো যে?’

জাহিদ বললো, ‘নিচ দিয়ে খালটা পার হই। খালে তো পানি বেশি নেই। লাফিয়ে পার হওয়া যাবে’।

তন্বী শিশুর অধিকারী গলায় আবদার করলো, ‘জাহিদ, আমি সাঁকোর উপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে যাবো’।

জাহিদ তন্বীর চোখে তাকালো। তারপর হেসে উঠলো প্রশস্ত চিত্তে। বললো, ‘ঠিক আছে যাও, পারবে তো?’

তন্বী ঘাড় নেড়ে সায় দিলো। বললো, ‘হ্যাঁ পারবো। তুমিও আমার সাথে আসো না...’।

জাহিদ বললো, ‘আচ্ছা’।

জাহিদ বাম হাতে ব্যাগটা আরও চেপে ধরে ডান হাতটা উপরের বাঁশটায় ধরে ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে থাকলো সাঁকোর ওপারের দিকে। পেছনে পেছনে তন্বী বাম হাতে জাহিদের জামার আস্তিন আর ডান হাতে উপরের বাঁশটা ধরে এগিয়ে যেতে থাকলো।

সাঁকোটা তেমন শক্ত করে বাঁধা নয়, বেশ নড়বড়ে। হয়তোবা মানুষের চলাচলটা খালের ভেতর দিয়ে বলে সাঁকোটার তদারকি তেমন একটা নেয়া হয়নি। সাঁকোটা কাঁপছে। দু’বার শরীরের ভারসাম্য রাখতে না পেরে তন্বী জাহিদকে জাঁপটে ধরলো। মাঝে মাঝে সে কলকলিয়ে হেসে উঠতে থাকলো।

জাহিদের ভাল লাগছে তন্বীর এই জানান দেওয়া, ভালো লাগার পরিস্থিতিগুলো উপস্থাপন করা। কিন্তু সাঁকো পার হতে হতে জাহিদের মনে আচম্বিতে একটা প্রশ্ন উদয় হলো। কেন হলো? সে জানে না। সে ভাবলো, সাঁকোর এই নড়বড়ে অবস্থানটার মতো তার অনাগত জীবনটা হবে নাতো? আর তন্বী...?

সাঁকো পার হয়ে উভয়ে আবার হাঁটতে থাকলো। উঁচু আইলটা এবার বাঁক নিয়েছে উত্তর হয়ে কিঞ্চিৎ পশ্চিমে, তারপর আবার বরাবর উত্তরে। রাস্তার দু’ধারে ক্ষেতের পর ক্ষেত। মাঝে মাঝে তলদেশের প্রায় সীমান্ত ঘেঁষা শুকনো জলরাশি। এর চারিধারে ক্ষেতের দেহ থেকে সামান্য উপরে ওঠা আকাশমুখো মাটির বাঁধ। আইলের পশ্চিমে কয়েক বিঘা জমিনের দূরত্ব রেখে ওদের দেহের প্রায় সমান্তরাল হয়ে এগিয়ে চলছে ঘরের স্পষ্ট মুখো চাল, পুকুরের পার, ঘন গাছ-গাছালিতে ঢাকা আকাশ দৃষ্টির কুঁড়েঘর, পাকা মসজিদের চাহনি, খড়ের মাড়ার টাল, তালগাছ ও শুকনো চক। কিন্তু রাস্তার পুবদিকে অনেকটা দূর সীমান্ত পর্যন্ত জমিন, চষা-আচষা কিংবা রীতিসিদ্ধ। তারপর কালো কালো রাত চোখের আবরণ দেওয়া দৃষ্টির গাছগাছালিতে ঢেকে থাকা বাড়ির অস্তিত্ব, অন্য কিছুর নিশানা।

তন্বী সব কিছু দেখছে, মুগ্ধ দৃষ্টি নিয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। ওর সব কিছুতেই উচ্ছ্বাসের সৃষ্টি হচ্ছে, সব কিছুতে ওর মনে হচ্ছে অন্য রকম, অন্য তৃপ্তি।

জাহিদ জিজ্ঞেস করলো, ‘তন্বী, বসবে? চলো একটু জিরিয়ে নিই।’

তন্বী বললো, ‘হ্যাঁ, বসা যায়’।

আইলের বাম ধারে, পশ্চিমমুখো হয়ে জাহিদ বসলো।

তন্বী বসতে বসতে জিজ্ঞেস করলো, ‘আর কতদূর যেতে হবে, জাহিদ?’

জাহিদ রাস্তার মুখ, উত্তর দিকে তাকালো। বললো, আর বেশি নয়, সামনে মোড় নিয়ে একটু পশ্চিমে গেলেই সাহেবনগর গ্রামটার শেষ। তারপর কালিপুর গ্রামের শুরু। কালিপুর গ্রামে কয়েকটা বাড়ি পেরিয়েই মিতুলের স্বামীর বাড়ি।

তন্বী চিনতে না পেরে জিজ্ঞেস করলো, ‘মিতুল কে?’

জাহিদ বললো, ‘ওই যে বলেছিলাম, আমার ফুফাতো বোন’।

তন্বী বললো, ‘তুমি বলছিলে নাকি?’

জাহিদ জোর দিয়ে বললো, হ্যাঁ, বলছিলাম তো!’

তন্বী মাথা ঝাঁকালো। বললো, ‘ও আচ্ছা’। তারপর একটু থেমে আবার জিজ্ঞেস করলো, ‘আচ্ছা জাহিদ, তুমি আমাকে তোমাদের বাড়িতে নিয়ে যাওনি কেন?’

‘আমাদের বাড়িতে?’

‘হ্যাঁ, তোমার মার কাছে?’

জাহিদ কিছুটা সময় চুপ করে রইলো। তারপর হেসে উঠে বললো, ‘তোমার বাবা তো আমাদের বাড়ির ঠিকানা জানেন। রাতে কিংবা কাল সকালের মধ্যেই হয়তো আমাদের খোঁজে আমাদের বাড়িতে পুলিশ নিয়ে চলে আসতে পারেন’।

তন্বী আঁতকে উঠে বললো, ‘তাই তো’।

জাহিদ ঘাড় নাড়লো।

তারপর উভয়েই নীরব। রাত কথা বলছে চাঁদের দেহ গিলে। আকাশ কথা বলছে নক্ষত্রের নিশানা গিলে। বায়ু কথা বলছে প্রকৃতির নির্জীব সটান অনুভূতি গিলে। রাত গান গাচ্ছে। ঝিঁঝিঁ পোকা প্রকৃতির আর সব উপাদান সুর মিলাচ্ছে। মিষ্টি আমেজ ঢেলে ভরাট জ্যোৎস্না উগড়ে চাঁদ মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে।

তন্বী ভালো লাগার অনুভূতি নিয়ে প্রশস্ত চিত্তে জিজ্ঞেস করলো, ‘আচ্ছা জাহিদ, তোমার ফুফাতো বোনের বাড়িতে আমাদের এভাবে আসাটাকে কীভাবে উপস্থাপন করবে?’

জাহিদ ভাবলো, তাই তো! একটু সময় নিয়ে বললো, ‘তন্বী, আমরা একটা কাজ করতে পারি, আমরা বলবো আমরা বিয়ে করে বেড়াতে এসেছি’।

‘কিন্তু আমরা তো বিয়ে করিনি!’

‘করিনি ঠিক। তবে করবো তো। পরে না হয় এক সময় আসল ঘটনা বলবো’।

তন্বী হাসলো। বললো, ‘হুম’।

জাহিদও হাসলো।

তারপর উভয়েই আবার চুপ। রাতের কণ্ঠস্বর আগের মতোই গান গাইতে ব্যস্ত।

জাহিদ কী যেন ভেবে জিজ্ঞেস করলো, ‘তন্বী, তোমার এখন কেমন লাগছে?’

তন্বী বামে মাথা হেলিয়ে বললো, ‘হ্যাঁ, ভালো লাগছে’।

জাহিদ কিছুটা স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লো। বললো, ‘ভালো লাগলে তো ভালোই। তুমি তো আমাকে ভয়ই ধরিয়ে দিয়েছিলে। এমনিতেই ভয় যে, আমরা পালিয়ে আসছি। তারপর আবার ট্রেনে সারা রাস্তা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না। তুমি এত কাঁদতে পারো?’

তন্বী হাসলো। মুখে কিছু বললো না।

জাহিদ জিজ্ঞেস করলো, ‘আচ্ছা, তোমার কি তখন খুব খারাপ লেগেছিলো?’

তন্বী সরল উত্তর দিলো, ‘হ্যাঁ’।

‘কেন খারাপ লাগছিল?’

‘জাহিদ, নিজস্ব একটা পরিবেশ ছেড়ে সম্পূর্ণ অন্য, অজানা একটা পরিবেশে চলে আসছি। তুমি বলো, কান্না তো স্বাভাবিকভাবেই আসার কথা, তাই না?’

তন্বীর কথাটা জাহিদের অন্যরকম লাগলো। ভাবলো, তবে কি সে জোর করে তন্বীকে নিয়ে এসেছে? নাহ, তা হবে কেন? তন্বীই তো ওর বিয়ের তারিখ ঠিক হয়ে যাওয়াতে পালিয়ে আসতে বাধ্য করেছে। তবে?

জাহিদ গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলো, ‘তন্বী, ভুলটা তো তুমি নিজেই করেছো’।

তন্বী বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলো, ‘কিসের ভুল, জাহিদ?’

জাহিদ আগের গম্ভীর গলা ধরে রেখেই বললো, ‘এই যে পালিয়ে এসেছো, তারপর আবার কান্নাকাটি করছো?’

তন্বী জাহিদের কথাটা এবার বুঝতে পারলো। কিছুটা সময় চুপ থেকে বিমর্ষ গলায় জিজ্ঞেস করলো, ‘জাহিদ, তুমি এটাকে ভুল বলছো?

তন্বীর এই বিমর্ষ স্বর জাহিদকে মৃদু চমকে দিলো। সাথে সাথে চোখ তুলে সে সরাসরি তন্বীর দিকে তাকালো। দেখলো, তন্বী মায়াবী বিষণœ ফ্যালফেলে দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

তন্বীর এহেন দৃষ্টির সামনে জাহিদ নিজে বড্ড অসহায় বোধ করলো। পাশাপাশি এক ধরনের অপরাধবোধও তাকে জড়িয়ে ধরলো। এ অপরাধবোধ আরও বেশি মাত্রায় দংশন করতে লাগলো যখন সে বুঝতে পারলো মিতুল বা মিতুলের স্বামীর বাড়ির কথা মনে হওয়ার সাথে সাথে তার মনে তন্বীর প্রতি টান সর্বস্বতায় এক ধরনের ফিকে ভাবের উদয় হচ্ছে। আর অপর টানে মিতুলের প্রতি আকর্ষণ হচ্ছে মন ভিন্ন মাত্রায় ও ভিন্ন উপাদানে।

জাহিদ জানে না এই অপর টানের শেষ আছে কি না। তবে সে মুছে ফেলতে চায় এই অপর টান। প্রতিনিয়ত চেষ্টা চালাচ্ছে। হয়তো অনেকটা পেরেছে। হয়তো অনেকটা পারেনি।

জাহিদ ভাবলো, তবে কি তন্বীকে নিয়ে মিতুলের স্বামীর বাড়ির দিকে পালিয়ে আসাটা ভুল হচ্ছে? তবে? কিন্তু পরক্ষণেই ভাবলো, নাহ, তা হবে কেন, এছাড়া উপায় কী? আর তো এমন কোনো আত্মীয় নেই যে, তন্বীকে নিয়ে একটু নিরাপদে কিছুদিন অবস্থান করতে পারবে ও নির্বিঘেœ বিয়েটা সম্পন্ন করতে পারবে।

তন্বী দৃষ্টি নামিয়ে নিলো। এই দৃষ্টি নামানোর মাঝে জাহিদ লক্ষ্য করলো অবলম্বনহীন ক্রান্তিলগ্নের তীক্ষè প্রভাব।

জাহিদ অপরাধটাকে হালকা করার জন্য তন্বীর ডান হাতটা মুঠো করে বললো, ‘সরি, সরি তন্বী। আমাদের এই চলে আসা ভুল হবে কেন?’

তন্বী চোখ তুলে তাকালো। করুণ পরিবেশটা ওর চেহারা থেকে উবে গেলো মুহূর্তের মধ্যেই। সে মেঘের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা এক ফালি প্রশস্ত চাঁদের মতোই নিবিড় ঝলকে হাসলো। তারপর ঘাড়টা পাশে হেলিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘সত্যিই সরি বলছো তো?’

জাহিদের কিছুটা হাল্কা বোধ হলো। বললো, ‘হ্যাঁ, সত্যি’।

তন্বী আহ্লাদী গলায় বললো, ‘তিনবার সরি বলো’।

জাহিদ হাসলো। মুঠোয় ধরা তন্বীর ডান হাতটা আস্তে করে ঠোঁটে ছোঁয়ালো। তারপর আবেগ মিশ্রিত গলায় বললো, ‘সরি, সরি, সরি’।

তন্বী কলকল করে হেসে এদিক-ওদিক তাকালো।

জাহিদেরও ভালো লাগাটা জড়িয়ে ধরালা আস্তে আস্তে, সূক্ষ্ম আকার দেওয়া বুননে।

তন্বী সামনের জমিটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘জাহিদ, জমিতে ঐগুলো কিসের চারাগাছ?’

জাহিদ একটু ভালো করে পরখ করে বললো, ‘খুব সম্ভব তরমুজের চারা গাছ’।

তরমুজের চারা গাছগুলো সবে বেড়ে উঠেছে। দেহটা হেলিয়ে দিয়েছে জমিনের গায়ে, বিছানো খড়ের উপর। খড় বিছানো হয়েছে চারাকে কেন্দ্র করে ভূমির সর্বত্র। তন্বী উৎফুল্ল গলায় বললো, ‘জাহিদ, দেখেছো চাঁদের আলোতে চারাগাছগুলোকে কেমন চমৎকার লাগছে? আমি জমিতে নেমে চারাগুলো একটু ছুঁয়ে দেখি?’

জাহিদ হেসে ঘাড় নেড়ে সম্মতি দিলো।

তন্বী ঘাস মাড়িয়ে জমিতে নেমে গেলো।

জাহিদের মাঝে মুগ্ধ করা এক ভাবনা এসে জড়িয়ে ধরলো। তার মাঝে এখন আর টান-অপরটানের দ্বন্দ্ব নেই। তার মুক্ত ভাবনায় এসে জড়ো হলো তন্বীর কথা, তন্বীর ভালবাসার কথা। সত্যি তো, যে অফুরন্ত ভালোবাসতে পারে তার তো চারাগাছের আলতো পরশ ছুঁয়ে দেখার শখ জাগবেই।

তন্বী চারাগাছগুলোতে হাতের হাল্কা নৃত্য বইয়ে দিলো। থেমে থেমে হেসে উঠতে থাকলো প্রফুল্ল চিত্তে, নিজস্ব গড়া সরল বিধানে ও স্বকীয় সত্তায়।

জাহিদ ওর দেখাদেখি হাসতে থাকলো নিঃশব্দে, তবে প্রাণখোলা।

জাহিদ কী মনে করে উঠে দাঁড়ালো। আস্তে করে ঘাসের উপর দু’তিনটে ছাপ ফেলে নেমে এলো জমির ভেতর, তন্বীর পাশে। ব্যাগটা রেখে এলো উপরেই।

তন্বীর কাছ ঘেঁষে জাহিদ ওর পিঠে মৃদু চাপড়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘তন্বী, ভালো লাগছে গ্রামের এই প্রকৃতি, নিস্তব্ধ রাত?’

তন্বী ঘাড় বাঁকিয়ে তাকালো। তারপর অপূর্ব সুন্দর চোখ নিয়ে সে উদ্ভাসিত হয়ে হাসলো। হাসলে ওর গালে চমৎকার টোল পড়ে। সে আবেশী আমেজ মেখে বললো, ‘হ্যাঁ, ভালো লাগছে। জানো জাহিদ, আগে কোনোদিন আমি গ্রামে আসিনি। এই প্রথম গ্রামে এলাম’।

জাহিদ বললো, ‘তাই! তুমি তো আগে কোনোদিন বলোনি?’

তন্বী হাসলো।

জাহিদ জিজ্ঞেস করলো, ‘তন্বী, বসবে এই খড়ের উপর?’

তন্বী আবার ঘাড় ঘুরিয়ে বিছানো খড় ও চারাগাছগুলোকে দেখলো। বললো, ‘আমরা বসলে চারাগাছগুলো মথে যাবে না?

জাহিদ তন্বীর হাত টেনে বসতে বসতে বললো, ‘নাহ, আমরা তো চারা বুননের দুই সারির মাঝখানে বসবো’।

তন্বী সায় দিলো।

ওরা বিছানো খড়ের উপর বসলো।

জাহিদ পা দুটো পশ্চিম বরাবর ছেড়ে হাত দুটো পেছনে মাটি ঠেলে বসলো। ঘাড় পৃষ্ঠদেশমুখো বাঁকিয়ে দৃষ্টিকে উন্নত করলো উপর থেকে উপরে, এক আকাশ থেকে অন্য আকাশে।

তন্বী বসলো একই ভঙ্গিতে। তবে ওর বসায় কিঞ্চিৎ পার্থক্য বিদ্যমান। সে ডান পাটা বাঁকিয়ে, থুতনির দূরত্ব কমিয়ে এনে, ডান হাতটা বাঁকানো হাঁটুটায় ভাঁজ করে রেখেছে। আর বাঁহাতটা ঠেসে দিয়েছে পেছনের মাটিতে। তার দৃষ্টিও জাহিদের মতোই এক আকাশ পেরিয়ে অন্য আকাশে। তবে এখানেও উভয়ের দৃষ্টিভঙ্গীর পার্থক্য বিদ্যমান। তন্বী আকাশ ভাঙছে খুবই গুরুত্ব দিয়ে আর জাহিদ আকাশ ভাঙছে ভাব নিয়ে অতি সাধারণ দৃষ্টিতে।

তন্বী হঠাৎ শিশুর মতো কোমল চিত্তে হেসে বললো, ‘জাহিদ, দেখেছো, কী অপূর্ব চাঁদ! মনে হচ্ছে আমি এ জীবনে আর দেখিনি। আচ্ছা গ্রামের চাঁদ আর শহরের চাঁদের মাঝে কি কোনো পার্থক্য আছে?’

জাহিদ তন্বীর এই সরল প্রশ্নে হাসলো, মুখে কিছু বললো না। তবে মনে মনে বললো, ‘তন্বী, তুমি তো এখন প্রকৃতির কন্যা। তোমার তো তা মনে হবেই’।

জাহিদকে চুপচাপ হাসতে দেখে তন্বী আরও দৃঢ় ভঙ্গিতে চোখে ঝিলিক ফুটিয়ে বললো, ‘হ্যাঁ, সত্যি বলছি। আমার কাছে তো তা পার্থক্য মনে হচ্ছে। বাসার ছাদে তো অনেক রাতেই চাঁদ দেখেছি। কিন্তু এখানকার চাঁদের মতো এত নিবিড় আপন মনে হয়নি’।

জাহিদ চাঁদ হয়ে তীক্ষè গভীর দৃষ্টিতে তাকালো। আর মুগ্ধ হয়ে ভাবতে থাকলো, মানুষ কতটা উদার হলে প্রকৃতিকে এতটা সহজে কাছে টেনে নিতে পারে?

চাঁদমুখো হয়ে এভাবে তাকিয়ে থাকতে থাকতে উভয়ের ঘাড়ে কিছুটা চাপ বোধ হলো। তন্বী তখনই হঠাৎ প্রস্তাব করলো, ‘জাহিদ, চলো কিছুক্ষণ খড়ের উপর শুয়ে চাঁদ দেখি’।

জাহিদ তন্বীর এই শিশুসুলভ প্রস্তাবে প্রথমে দ্বন্দ্ব নিয়ে তাকালো। তারপরই স্বতঃস্ফূর্ত সম্মতি নিয়ে সরাসরি দৃষ্টি মেললো। এই দৃষ্টিতে চাঁদের আকর্ষণ। এই দৃষ্টিতে তন্বীর আকর্ষণ। এই দৃষ্টিতে আত্মআকর্ষণ। এই আকর্ষণ তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। অনেকটা তাৎপর্যহীন, কিন্তু বড্ড সতেজভাব বিরাজমান।

উভয়ে শুয়ে আছে আকাশের দিকে মুখ করে। দৃষ্টি মাটির উলম্ব, চাঁদের মুখোমুখি। ওদের পরস্পরের দেহের দূরত্ব হাতখানেক। ওদের মাঝখানে প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটা শিশু গাছ, পাতার চোখ মেলে, দৃঢ় কিন্তু নিঃশব্দ জানান দিয়ে। ওদের অবস্থানের চারিপাশে তখন বিরাজ করছে এক আকাশ জ্যোৎস্না, রুপালি আলোর ভরাট যৌবন-উজ্জ্বলতাহীন মায়াবী পরশ। প্রকৃতিতে ক্ষয়ে পড়ছে রাত উগলে নিশিকন্যা। জ্যোৎস্নায় জলছাপ ফেলতে ফেলতে উড়ছে মেঘ- কখনও ছেঁড়া ছেঁড়া ভাব নিয়ে, কখনও গভীর আলিঙ্গনে। দক্ষিণের মুখ গলে বেরিয়ে আসছে বায়ুÑ কখনও মিষ্টি শীতলতায়, কখনও নরম উষ্ণতায় কিংবা কখনও মিশ্রিত আমেজে।

জাহিদ মাথা তুলে তন্বীকে দেখলো। তন্বী শুয়ে আছে গাটা পুরোপুরি মাটিতে সঁপে। একটা হাত মাটির সংস্পর্শে আর অন্য হাতটাকে বাঁকিয়ে মাথার নিচে দেওয়া। ওর আশ্চর্য সুন্দর চোখ তাকিয়ে আছে চাঁদমুখো দৃষ্টি ফেলে অনন্ত আকাশকন্যার দিকে।

জাহিদ আবার শরীর টান টান করে শুলো। চোখ ফেললো চাঁদে। তারপর চাঁদের প্রভা ঘেঁষে ছুটন্ত জলকন্যার দিকে। এভাবে তাকিয়ে রইলো কিছুটা সময়। জলকন্যা চাঁদের মুখে নেকাব ফেললো। ফেলতে ফেলতেই সরালো। আবার ফেললো। আরার সরালো। আবার...।

এভাবে তাকিয়ে থাকতে থাকতে জাহিদের দৃষ্টি ক্রমশ ক্ষয়ে আসতে থাকলো। চোখের পর্দায় বাসা বাঁধলো অন্য একটা দৃশ্য। দৃশ্যটায় কোনো বিশেষত্ব নেই। শহরের উপকূলে পাশাপাশি বসবাসরত দু’টো বাড়িকে কেন্দ্র করেই দৃশ্যের পটভূমি। প্রথম বাড়িটা মোটামুটি বড় আয়তনের তিনতলা ইমারত, আধুনিক সজ্জায় সজ্জিত। মালিক হলেন পুলিশের রিটায়ার্ড এস, পি আরমান চৌধুরী, যার কন্যা তন্বী তামান্না এখন প্রকৃতির কাছে বিলীন হচ্ছে। সঁপে দিচ্ছে তার সব অস্তিত্ব এক আকাশ হৃদয়ের কাছে। আর অপর বাড়িটা একতলা হয়ে ছোট্ট একটা মাথা বের করে রেখেছে দৈন্যদশা নিয়ে। এই বাড়িটার মালিক হুসেন আলী মাস্টার। সাহিত্যসেবী তাই এক সাহিত্যিককে খুবই নিম্ন ভাড়ায় প্রশস্ত ছাদের ছোট্ট চিলেকোঠাটা দিয়ে রেখেছেন অনেকটা উদার চিত্তে ও সম্মানের সাথে। এই চিলেকোঠার ভগ্ন কথাসাহিত্যিক আর কেউ নয়, স্বয়ং জাহিদ, জাহিদুল আলম। যে পলেস্তারা ওঠা চিলেকোঠার সম্মুখে পেয়েছিলো ঠিক আঙিনা সদৃশ এক ছাদ ও প্রশস্ত নিশ্বাস ফেলার মতো স্থান। এই ছাদের প্রায় মুখোমুখি প্রমাণ আকার, তবে বেশ গুরুত্ববহ একটা জানালা। এই ছাদ আর জানালার সম্মিলনে গড়ে উঠতে থাকে একটা সাধারণ কাহিনি। তারপর কাহিনিটা ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে অসাধারণ। ছাদের মানুষটার এটা দ্বিতীয় হনন হলেও জানালার অপূর্ব সুন্দর চোখের এটা প্রথম হনন।

তন্বী ডাকলো, ‘জাহিদ’।

জাহিদ সাড়া দিল না।

তন্বী আবার ডাকলো, ‘এই জাহিদ’।

জাহিদ এবার সাড়া দিলো, ‘হু’।

তন্বী মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করলো, ‘কী ভাবছো?’

জাহিদ ঘাড় তুলে দৃষ্টিকে কাত করে তাকালো। মাথাটা ডান হাতের তালুতে স্থাপন করে হেসে বললো, ‘নাহ, তেমন কিছু না’।

তন্বীও মাথা তুলে কৌণিক দৃষ্টি স্থাপন করলো। নির্মল দৃষ্টিভঙ্গি আর বিমল চোখ দিয়ে কিছুটা সময় তাকিয়ে রইলো অযথাই। তারপর অনুরোধের গলায় বললো, ‘জাহিদ, একটা গান গাও না, প্লিজ!’

জাহিদ বললো, ‘আমি! গান?’

তন্বী মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, ‘হ্যাঁ’।

জাহিদ হাসলো। বললো, কী যে বলো? তার চেয়ে বরং তুমি একটা গাও, আমি শুনি। ঐ গানটা, যে গানটা তোমার কণ্ঠে শুনলেই আমার মনটা ভালো হয়ে যেতো এক নিমিষেই। কী এক ভালো লাগা এসে জড়িয়ে ধরতো আমাকে’।

তন্বী হাসলো। ঘাড় নেড়ে সায় দিলো। তারপর দেহটাকে টান টান চাঁদমুখো করে শুলো। প্রথমে কিছুটা সময় গুনগুন করে, পরে স্পষ্ট কণ্ঠে তন্বী গাইতে লাগলো। সে গাইতে থাকলো পাথর ভাঙার সুর। সে গাইতে থাকলো আকাশ-দিগন্ত ভাঙার সুর। এই সুর বড্ড আশাবাদের। এই সুর শুদ্ধ নির্মাণের। এই সুর নির্মাণের আনন্দে নতুন প্রাসাদ গড়ার।

জাহিদ আশ্চর্য হলো। তার অনুভূতিকে নাড়া দিলো গভীরভাবে, অন্য দ্যোতনায়। সে অনুভব করলো, তন্বীর এই গান আজ হৃদয়ে মাতন দিচ্ছে আরও নিবিড়তম সত্তায়। আর প্রকৃতিতে তা কাঁপন দিচ্ছে মিষ্টি শীতলতায়।

জাহিদ আরও দেখলো, চতুর্দিকে শুধু ঐক্য আর ঐক্য। সংহতির পরিচ্ছন্ন আন্দোলনে নেই কোনো দ্বন্দ্ব বা নেই কোনো সংশয়। সে বুঝতে পারলো না, চতুর্দিকে এত ঐক্য, এত সংহতি কেন? তবুও সে দৃষ্টির প্রসার ঘটালো, অনুভূতির প্রসার ঘটালো। সে দেখলো, গানের এই সুর রাতের কন্ঠে গেয়ে চলছে বিশুদ্ধ চেতনায়। চাঁদ ভাঙা জ্যোৎস্না তাতে সায় দিচ্ছে বিরান নির্জনতায়। বায়ু নাচছে। তার সাথে নেচে চলছে চারাগাছের নগ্ন দেহ। সে মুগ্ধ হচ্ছে, ভাবের বিস্তীর্ণ ভূমিতে বাসা বাঁধছে ছন্দোবদ্ধ শ্লোকের মন্ময় কাব্য। যে কাব্যে কোনো শোকগাথা নেই। যে কাব্যে শোকছন্দ নেই। যে কাব্যে শুধু বর্তমান মিষ্টি রোমান্টিকতা। শুধু দৃশ্যমানতা আর দৃশ্যমানতা।

কিন্তু হঠাৎ জাহিদ পা-িত্য দেখাতে গিয়ে এত সব আয়োজনের দৃশ্যমানতায় অন্তর্নিহিত দিক উন্মোচন করতে গেলো। ঠিক তখনই পরিচ্ছন্ন আন্দোলন অপরিচ্ছন্ন হয়ে উঠলো। অনৈক্যের বৈরিভাব সর্বত্র জানান দিলো ভিন্নমাত্রায় ও ভিন্ন আঙ্গিকে। ছন্দোবদ্ধ শোকের মন্ময় কাব্যে হয়ে উঠলো শোকছন্দের শোকগাথা। ছন্দের পতন হলো, যতির বিচ্ছেদ ঘটলো।

জাহিদ দেখলো, রাত থেমে গেছে সময়ের দ্বন্দ্বে। চাঁদ কালি হয়ে গেছে কু-লী মেঘের কালশিটে দাগ নিয়ে। জ্যোৎস্না হয়ে উঠেছে ধূসর। বায়ু নৃত্যের বদলে অসহ্য যন্ত্রণায় কাঁপছে। আর সাথে তিরতির করে কাঁপছে তরমুজের চারাগাছের নেতানো দেহগুলো। এখন আর আশাবাদের সুর নেই বা নির্মাণের গান নেই। গানটা হয়ে উঠেছে আশাভঙ্গের, প্রণয় ভঙ্গের, রীতিনীতি অভদ্রতার ও ভিন্ন তত্ত্বাবধানের।

এই আশাভঙ্গের অভদ্রতায় জাহিদ হয়ে উঠেছে উন্মাতাল। সে দেখছে গানের সেই মেয়েটি এখন আর তন্বী নয়। তন্বী হয়ে উঠেছে মিতুল। তন্বী-মিতুল...! সে মনে মনে প্রকৃতিকে প্রশ্ন করলো, ‘এখানে মিতুল কেন?’Ñ জবাব এলো না। সে রাতভাঙা জ্যোৎস্নাকে প্রশ্ন করলো, ‘তন্বীর বিশুদ্ধ গানকে কেন মিতুল করুণ বিধ্বস্ত সুরের আকার দিচ্ছে?’ এখানেও জবাব এলো না। আর তার শেষ প্রশ্ন, ‘মিতুলের সত্তা কেন দ্বিতীয় হননের মুখোমুখি হয়ে অপর টানের ডাক দিচ্ছে?Ñ সে জবাব পেলো না। আর একের পর এক প্রশ্নের জবাব না পেয়ে তার মাঝে এক অসহ্য যন্ত্রণা উত্থিত হলো। এই যন্ত্রণায় কৃশকায় হয়ে উঠলো তার মন। সে সহ্য করতে না পেরে তৃষ্ণার্ত মন নিয়ে শুষ্কতায় উঠে বসলো। ভরকেন্দ্র ঠিক করতে করতে দাঁড়িয়ে গেলো পুরো শরীর বায়ু ভেদ করে ও আকাশের দিকে মু-কে ঠেলে। তারপর এগিয়ে গেলো অতি ধীরে, শরীরকে টেনে টেনে আইলের উপর, ব্যাগটার কাছে। পিছু ফিরলো না বা বাক্য ব্যয় করলো না। তাকালো না একবারও।

এদিকে তন্বীর গান থেমে গেলো। বাতাসের স্পর্শ ছোঁয়া সুরের স্পষ্ট ধ্বনি থেমে গেলো ভূমিকাহীন আচমকা। জ্ঞান বৈভিন্নতায় তন্বী হয়ে উঠলো মুক ও কক্ষচ্যুত। স্থান বৈভিন্নতায় পল্লীবাসী হয়ে সে হয়ে উঠলো আশ্রয়হীন, ঘরছাড়া, বাটিহারা।

তন্বী জাহিদের আচম্বিত এই আচরণ বুঝতে পারল না।

কিন্তু বাতাসে গানের রেশ কাটতেই জাহিদ আবার নিজস্ব তত্ত্বাবধানে চলে এলো। ভিড় করলো প্রকৃতি ও প্রকৃতির প্রতিটি উপসর্গ পূর্ববৎ চিরায়ত নিয়মে।

জাহিদ আইল ছেড়ে আবার নেমে এলো, ফিরে এলো তন্বীর কাছে। সরাসরি দৃষ্টিতে তাকালো, যন্ত্রণা হঠাৎ করেই যেন প্রশমিত হয়ে গেলো তন্বীর অপূর্ব সুন্দর চোখে তাকিয়ে। হাত বাড়িয়ে দিলো তন্বীর প্রতি।

তন্বীর জ্ঞান বৈভিন্নতা দ্রুত লয়েই পূর্ববিন্দুতে চলে এলো। কক্ষচ্যুত তন্বী বাটির নিশানা খুঁজতে খুঁজতে ঘরের ঠিকানা পেয়ে গেলো। আশ্রয় পেলো জাহিদের বাড়ানো হাতে। পরম নিবিড়তায় দেহটা টেনে দিলো জাহিদের দিকে। উঠে দাঁড়ালো একান্ত সান্নিধ্যে একান্ত আপন হয়ে। তারপর জাহিদের স্বতঃস্ফূর্ত সাড়ায় গভীর আলিঙ্গনে নিজেকে সঁপে দিলো নিশ্চিন্ত নির্ভরতায়, অনাদি অবলম্বনে।

জাহিদ আস্তে করে বললো, ‘তন্বী, চলো আমরা এখান থেকে অন্য কোথাও চলে যাই’।

তন্বী জিজ্ঞেস করলো, ‘অন্য কোথাও?’

‘হ্যাঁ, অন্য কোথাও’।

‘কোথায় যাবে?’

জাহিদ গাঢ়-উদাসী গলায় বললো, ‘জানি না’।

তন্বী আর কোনো প্রশ্ন করলো না। চুপ হয়ে গেলো। ভাবলো, কোথায় সে নোঙর ফেলবে? কোনো গন্তব্যই তো তার জানা নেই। তাই সে জাহিদের প্রস্তাবে ঘাড় নেড়ে সায় দিয়ে বললো, ‘চলো, তোমার যেখানে ইচ্ছে’।

ওরা পুনরায় এগিয়ে যেতে থাকলো ধীর লয়ে, অতি মন্থর গতিতে ও বিগত গমনের উল্টো দিকে মুখ করে। আর তখন পুরোনো পদক্ষেপের উপর একের পর এক নতুন পদক্ষেপ পড়তে থাকলো বেহাত স্বচ্ছলতায় ঋণের বিলাস টেনে। রাতের দেহে তখন ভোরের ঘ্রাণ।

ছবি

সৈয়দ আবদুস সাদিক শোক-পঙ্ক্তি

ছবি

আমার রমণীর ফল

ছবি

প্রসঙ্গ : লেখকের বুদ্ধিবৃৃত্তিক দায় ও দর্শনের খোঁজে

সাময়িকী কবিতা

ছবি

যে কবিতায় শামসুর রাহমানকে চিনেছি

ছবি

শামসুর রাহমানের রাজনীতির কবিতা, কবিতার রাজনীতি

ছবি

জীবনানন্দ দাশ: শুশ্রƒষার আশ্রয়ঘর

ছবি

আহমদ ছফা ও অলাতচক্র

সাময়িকী কবিতা

ছবি

দ্য হোয়াইট বুক

ছবি

হান কাঙের ৫টি কবিতা

ছবি

আমার রমণীর ফল

ছবি

ছোট ছোট ঘটনাই আমার অনুপ্রেরণা-হান কাং

ছবি

হান কাংয়ের প্রগাঢ় কাব্যিক গদ্য

ছবি

নার্গিস-উদ্যানে নজরুল তর্ক

ছবি

শহীদ কাদরীর কবি হয়ে ওঠা

ছবি

মাথার ওপর ছাতা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

অমিয়ভূষণ : ধ্রুপদীয়া আর স্ববিরোধের সমন্বয়

ছবি

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র স্বাতন্ত্র্য ও শ্রেষ্ঠত্ব

ছবি

মার্কেস ও আমার বিস্ময়

ছবি

অস্থির পৃথিবীর মায়াবী কবি

ছবি

সম্প্রীতির সাধক মরমী বাউল উকিল মুন্সী

ছবি

‘দিবারাত্রির কাব্য’ এবং ‘দ্য আউটসাইডার’ এক নিবিড় সাযুজ্য

ছবি

চুক্তি লিখন

ছবি

লিওপল্ড সেদর সেঙ্ঘর-এর কবিতা

ছবি

হিমু ও হুমায়ূন আহমেদ

শরতের পদাবলি

সাময়িকী কবিতা

মার্কিন চলচ্চিত্র জগতের প্রাণকেন্দ্র লস এঞ্জেলেস

ছবি

যুদ্ধের জানালায় দাঁড়িয়ে

ছবি

শব্দঘর : বিপ্লব, দ্রোহ ও গুচ্ছ কবিতা সংখ্যা

ছবি

সাহিত্যের দর্শনানুসন্ধান

ছবি

সালভাতর কোয়াসিমোদোর কবিতা

ছবি

টুটু

ছবি

অর্ধেক জীবন

tab

সাময়িকী

অর্বাচীন নোঙর

মহিবুল আলম

শিল্পী : সঞ্জয় দে রিপন

বৃহস্পতিবার, ২৪ অক্টোবর ২০২৪

ট্রেনে যুবতীটি বেশ কেঁদেছিলো। কিন্তু এখন তাকে বেশ স্বাভাবিক লাগছে। এখন সে থেমে থেমে হেসে উঠছে নিঃশব্দে।

ওরা হাঁটছে সামনের দিকে ঝুঁকে ঝুঁকে। পায়ের নিচে উঁচু আইল, মেঠো পথ। এক ধরনের মসৃণতা-অমসৃণতার দ্বন্দ্ব পথের সর্বত্র বিরাজ করছে। ওরা বেশ ক্লান্ত। দেহ টেনে টেনে চলছে। মাঝে মাঝে মৃদু হোঁচট খাচ্ছে। কখনও নিজে নিজেই ভারসাম্য ঠিক করছে। কখনও একজন অপর জনের বাহু চেপে ধরছে।

দেহ দুটোর একজন যুবক, আর অন্যজন যুবতী। উভয়ের অবস্থান ভিন্ন মাত্রিক আকারের। কিন্তু লক্ষ্য এক, টান এক। যুবকটি মাটি চষে, সময়কে কর্ষণ করে একটা নির্দিষ্ট ধাপে এসে উত্তীর্ণ হয়েছে। আর যুবতীটি দেখেনি ভাঙনের গান ও প্রকৃতির কর্ষণ। যুবতী জন্মের পরই দেখেছে এক লাগামহীন পৃথিবী। কিন্তু যুবকটি প্রতিনিয়ত পেয়েছে শুধু সংকীর্ণ পৃথিবী, বৈরি প্রকৃতি, আর প্রতিকূল সমাজ ব্যবস্থা।

যুবকটির নামÑ জাহিদ, আর যুবতীটির নামÑ তন্বী। এই যুবক-যুবতী পেছনে ফেলে এসেছে এক বিধ্বস্ত পৃথিবী। এবার গড়তে যাচ্ছে নবীন পৃথিবী, অবাচীন নোঙর। কিন্তু এই অর্বাচীন নোঙর কোন পললে ফেলবে ওরা জানে না। এই নবীন পৃথিবী কোন ¯্রােতে ভাসাবে ওরা তাও জানে না। ওরা অসীমের দিকে হাত বাড়িয়েছে। অনন্তের দিকে মুখ করে অনন্তকে টেনে এনেছে নিকটে, অতি নিকটে। অস্তিত্বের কাছাকাছি।

ওরা হাঁটতে হাঁটতে একটা খালের পাড়ে এসে থামলো। ডান হাতের ব্যাগটা বাঁহাতে নিয়ে যুবক, জাহিদ তাকালো খালের ভেতর। দৃষ্টি ফেললো এপার থেকে ওপারে যাওয়ার সাঁকোটার ওপর। সাঁকোটার আকার অপ্রশস্ত, আর খালের ভেতর জলের ধারা খুবই ক্ষীণ। এতটাই ক্ষীণ যে জলধারা খালটাকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখছে ঠিকই, কিন্তু অস্তিত্বের স্পন্দন জানান দিচ্ছে সলতে পোড়া শিখা হয়ে।

জাহিদ দেখলো, ইচ্ছে করলেই জলকে মাড়িয়ে খালটা পার হয়ে যেতে পারে। তাই সে সেদিকে নামতে গেলো।

তন্বী জিজ্ঞেস করলো, ‘নিচে নামছো যে?’

জাহিদ বললো, ‘নিচ দিয়ে খালটা পার হই। খালে তো পানি বেশি নেই। লাফিয়ে পার হওয়া যাবে’।

তন্বী শিশুর অধিকারী গলায় আবদার করলো, ‘জাহিদ, আমি সাঁকোর উপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে যাবো’।

জাহিদ তন্বীর চোখে তাকালো। তারপর হেসে উঠলো প্রশস্ত চিত্তে। বললো, ‘ঠিক আছে যাও, পারবে তো?’

তন্বী ঘাড় নেড়ে সায় দিলো। বললো, ‘হ্যাঁ পারবো। তুমিও আমার সাথে আসো না...’।

জাহিদ বললো, ‘আচ্ছা’।

জাহিদ বাম হাতে ব্যাগটা আরও চেপে ধরে ডান হাতটা উপরের বাঁশটায় ধরে ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে থাকলো সাঁকোর ওপারের দিকে। পেছনে পেছনে তন্বী বাম হাতে জাহিদের জামার আস্তিন আর ডান হাতে উপরের বাঁশটা ধরে এগিয়ে যেতে থাকলো।

সাঁকোটা তেমন শক্ত করে বাঁধা নয়, বেশ নড়বড়ে। হয়তোবা মানুষের চলাচলটা খালের ভেতর দিয়ে বলে সাঁকোটার তদারকি তেমন একটা নেয়া হয়নি। সাঁকোটা কাঁপছে। দু’বার শরীরের ভারসাম্য রাখতে না পেরে তন্বী জাহিদকে জাঁপটে ধরলো। মাঝে মাঝে সে কলকলিয়ে হেসে উঠতে থাকলো।

জাহিদের ভাল লাগছে তন্বীর এই জানান দেওয়া, ভালো লাগার পরিস্থিতিগুলো উপস্থাপন করা। কিন্তু সাঁকো পার হতে হতে জাহিদের মনে আচম্বিতে একটা প্রশ্ন উদয় হলো। কেন হলো? সে জানে না। সে ভাবলো, সাঁকোর এই নড়বড়ে অবস্থানটার মতো তার অনাগত জীবনটা হবে নাতো? আর তন্বী...?

সাঁকো পার হয়ে উভয়ে আবার হাঁটতে থাকলো। উঁচু আইলটা এবার বাঁক নিয়েছে উত্তর হয়ে কিঞ্চিৎ পশ্চিমে, তারপর আবার বরাবর উত্তরে। রাস্তার দু’ধারে ক্ষেতের পর ক্ষেত। মাঝে মাঝে তলদেশের প্রায় সীমান্ত ঘেঁষা শুকনো জলরাশি। এর চারিধারে ক্ষেতের দেহ থেকে সামান্য উপরে ওঠা আকাশমুখো মাটির বাঁধ। আইলের পশ্চিমে কয়েক বিঘা জমিনের দূরত্ব রেখে ওদের দেহের প্রায় সমান্তরাল হয়ে এগিয়ে চলছে ঘরের স্পষ্ট মুখো চাল, পুকুরের পার, ঘন গাছ-গাছালিতে ঢাকা আকাশ দৃষ্টির কুঁড়েঘর, পাকা মসজিদের চাহনি, খড়ের মাড়ার টাল, তালগাছ ও শুকনো চক। কিন্তু রাস্তার পুবদিকে অনেকটা দূর সীমান্ত পর্যন্ত জমিন, চষা-আচষা কিংবা রীতিসিদ্ধ। তারপর কালো কালো রাত চোখের আবরণ দেওয়া দৃষ্টির গাছগাছালিতে ঢেকে থাকা বাড়ির অস্তিত্ব, অন্য কিছুর নিশানা।

তন্বী সব কিছু দেখছে, মুগ্ধ দৃষ্টি নিয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। ওর সব কিছুতেই উচ্ছ্বাসের সৃষ্টি হচ্ছে, সব কিছুতে ওর মনে হচ্ছে অন্য রকম, অন্য তৃপ্তি।

জাহিদ জিজ্ঞেস করলো, ‘তন্বী, বসবে? চলো একটু জিরিয়ে নিই।’

তন্বী বললো, ‘হ্যাঁ, বসা যায়’।

আইলের বাম ধারে, পশ্চিমমুখো হয়ে জাহিদ বসলো।

তন্বী বসতে বসতে জিজ্ঞেস করলো, ‘আর কতদূর যেতে হবে, জাহিদ?’

জাহিদ রাস্তার মুখ, উত্তর দিকে তাকালো। বললো, আর বেশি নয়, সামনে মোড় নিয়ে একটু পশ্চিমে গেলেই সাহেবনগর গ্রামটার শেষ। তারপর কালিপুর গ্রামের শুরু। কালিপুর গ্রামে কয়েকটা বাড়ি পেরিয়েই মিতুলের স্বামীর বাড়ি।

তন্বী চিনতে না পেরে জিজ্ঞেস করলো, ‘মিতুল কে?’

জাহিদ বললো, ‘ওই যে বলেছিলাম, আমার ফুফাতো বোন’।

তন্বী বললো, ‘তুমি বলছিলে নাকি?’

জাহিদ জোর দিয়ে বললো, হ্যাঁ, বলছিলাম তো!’

তন্বী মাথা ঝাঁকালো। বললো, ‘ও আচ্ছা’। তারপর একটু থেমে আবার জিজ্ঞেস করলো, ‘আচ্ছা জাহিদ, তুমি আমাকে তোমাদের বাড়িতে নিয়ে যাওনি কেন?’

‘আমাদের বাড়িতে?’

‘হ্যাঁ, তোমার মার কাছে?’

জাহিদ কিছুটা সময় চুপ করে রইলো। তারপর হেসে উঠে বললো, ‘তোমার বাবা তো আমাদের বাড়ির ঠিকানা জানেন। রাতে কিংবা কাল সকালের মধ্যেই হয়তো আমাদের খোঁজে আমাদের বাড়িতে পুলিশ নিয়ে চলে আসতে পারেন’।

তন্বী আঁতকে উঠে বললো, ‘তাই তো’।

জাহিদ ঘাড় নাড়লো।

তারপর উভয়েই নীরব। রাত কথা বলছে চাঁদের দেহ গিলে। আকাশ কথা বলছে নক্ষত্রের নিশানা গিলে। বায়ু কথা বলছে প্রকৃতির নির্জীব সটান অনুভূতি গিলে। রাত গান গাচ্ছে। ঝিঁঝিঁ পোকা প্রকৃতির আর সব উপাদান সুর মিলাচ্ছে। মিষ্টি আমেজ ঢেলে ভরাট জ্যোৎস্না উগড়ে চাঁদ মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে।

তন্বী ভালো লাগার অনুভূতি নিয়ে প্রশস্ত চিত্তে জিজ্ঞেস করলো, ‘আচ্ছা জাহিদ, তোমার ফুফাতো বোনের বাড়িতে আমাদের এভাবে আসাটাকে কীভাবে উপস্থাপন করবে?’

জাহিদ ভাবলো, তাই তো! একটু সময় নিয়ে বললো, ‘তন্বী, আমরা একটা কাজ করতে পারি, আমরা বলবো আমরা বিয়ে করে বেড়াতে এসেছি’।

‘কিন্তু আমরা তো বিয়ে করিনি!’

‘করিনি ঠিক। তবে করবো তো। পরে না হয় এক সময় আসল ঘটনা বলবো’।

তন্বী হাসলো। বললো, ‘হুম’।

জাহিদও হাসলো।

তারপর উভয়েই আবার চুপ। রাতের কণ্ঠস্বর আগের মতোই গান গাইতে ব্যস্ত।

জাহিদ কী যেন ভেবে জিজ্ঞেস করলো, ‘তন্বী, তোমার এখন কেমন লাগছে?’

তন্বী বামে মাথা হেলিয়ে বললো, ‘হ্যাঁ, ভালো লাগছে’।

জাহিদ কিছুটা স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লো। বললো, ‘ভালো লাগলে তো ভালোই। তুমি তো আমাকে ভয়ই ধরিয়ে দিয়েছিলে। এমনিতেই ভয় যে, আমরা পালিয়ে আসছি। তারপর আবার ট্রেনে সারা রাস্তা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না। তুমি এত কাঁদতে পারো?’

তন্বী হাসলো। মুখে কিছু বললো না।

জাহিদ জিজ্ঞেস করলো, ‘আচ্ছা, তোমার কি তখন খুব খারাপ লেগেছিলো?’

তন্বী সরল উত্তর দিলো, ‘হ্যাঁ’।

‘কেন খারাপ লাগছিল?’

‘জাহিদ, নিজস্ব একটা পরিবেশ ছেড়ে সম্পূর্ণ অন্য, অজানা একটা পরিবেশে চলে আসছি। তুমি বলো, কান্না তো স্বাভাবিকভাবেই আসার কথা, তাই না?’

তন্বীর কথাটা জাহিদের অন্যরকম লাগলো। ভাবলো, তবে কি সে জোর করে তন্বীকে নিয়ে এসেছে? নাহ, তা হবে কেন? তন্বীই তো ওর বিয়ের তারিখ ঠিক হয়ে যাওয়াতে পালিয়ে আসতে বাধ্য করেছে। তবে?

জাহিদ গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলো, ‘তন্বী, ভুলটা তো তুমি নিজেই করেছো’।

তন্বী বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলো, ‘কিসের ভুল, জাহিদ?’

জাহিদ আগের গম্ভীর গলা ধরে রেখেই বললো, ‘এই যে পালিয়ে এসেছো, তারপর আবার কান্নাকাটি করছো?’

তন্বী জাহিদের কথাটা এবার বুঝতে পারলো। কিছুটা সময় চুপ থেকে বিমর্ষ গলায় জিজ্ঞেস করলো, ‘জাহিদ, তুমি এটাকে ভুল বলছো?

তন্বীর এই বিমর্ষ স্বর জাহিদকে মৃদু চমকে দিলো। সাথে সাথে চোখ তুলে সে সরাসরি তন্বীর দিকে তাকালো। দেখলো, তন্বী মায়াবী বিষণœ ফ্যালফেলে দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

তন্বীর এহেন দৃষ্টির সামনে জাহিদ নিজে বড্ড অসহায় বোধ করলো। পাশাপাশি এক ধরনের অপরাধবোধও তাকে জড়িয়ে ধরলো। এ অপরাধবোধ আরও বেশি মাত্রায় দংশন করতে লাগলো যখন সে বুঝতে পারলো মিতুল বা মিতুলের স্বামীর বাড়ির কথা মনে হওয়ার সাথে সাথে তার মনে তন্বীর প্রতি টান সর্বস্বতায় এক ধরনের ফিকে ভাবের উদয় হচ্ছে। আর অপর টানে মিতুলের প্রতি আকর্ষণ হচ্ছে মন ভিন্ন মাত্রায় ও ভিন্ন উপাদানে।

জাহিদ জানে না এই অপর টানের শেষ আছে কি না। তবে সে মুছে ফেলতে চায় এই অপর টান। প্রতিনিয়ত চেষ্টা চালাচ্ছে। হয়তো অনেকটা পেরেছে। হয়তো অনেকটা পারেনি।

জাহিদ ভাবলো, তবে কি তন্বীকে নিয়ে মিতুলের স্বামীর বাড়ির দিকে পালিয়ে আসাটা ভুল হচ্ছে? তবে? কিন্তু পরক্ষণেই ভাবলো, নাহ, তা হবে কেন, এছাড়া উপায় কী? আর তো এমন কোনো আত্মীয় নেই যে, তন্বীকে নিয়ে একটু নিরাপদে কিছুদিন অবস্থান করতে পারবে ও নির্বিঘেœ বিয়েটা সম্পন্ন করতে পারবে।

তন্বী দৃষ্টি নামিয়ে নিলো। এই দৃষ্টি নামানোর মাঝে জাহিদ লক্ষ্য করলো অবলম্বনহীন ক্রান্তিলগ্নের তীক্ষè প্রভাব।

জাহিদ অপরাধটাকে হালকা করার জন্য তন্বীর ডান হাতটা মুঠো করে বললো, ‘সরি, সরি তন্বী। আমাদের এই চলে আসা ভুল হবে কেন?’

তন্বী চোখ তুলে তাকালো। করুণ পরিবেশটা ওর চেহারা থেকে উবে গেলো মুহূর্তের মধ্যেই। সে মেঘের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা এক ফালি প্রশস্ত চাঁদের মতোই নিবিড় ঝলকে হাসলো। তারপর ঘাড়টা পাশে হেলিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘সত্যিই সরি বলছো তো?’

জাহিদের কিছুটা হাল্কা বোধ হলো। বললো, ‘হ্যাঁ, সত্যি’।

তন্বী আহ্লাদী গলায় বললো, ‘তিনবার সরি বলো’।

জাহিদ হাসলো। মুঠোয় ধরা তন্বীর ডান হাতটা আস্তে করে ঠোঁটে ছোঁয়ালো। তারপর আবেগ মিশ্রিত গলায় বললো, ‘সরি, সরি, সরি’।

তন্বী কলকল করে হেসে এদিক-ওদিক তাকালো।

জাহিদেরও ভালো লাগাটা জড়িয়ে ধরালা আস্তে আস্তে, সূক্ষ্ম আকার দেওয়া বুননে।

তন্বী সামনের জমিটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘জাহিদ, জমিতে ঐগুলো কিসের চারাগাছ?’

জাহিদ একটু ভালো করে পরখ করে বললো, ‘খুব সম্ভব তরমুজের চারা গাছ’।

তরমুজের চারা গাছগুলো সবে বেড়ে উঠেছে। দেহটা হেলিয়ে দিয়েছে জমিনের গায়ে, বিছানো খড়ের উপর। খড় বিছানো হয়েছে চারাকে কেন্দ্র করে ভূমির সর্বত্র। তন্বী উৎফুল্ল গলায় বললো, ‘জাহিদ, দেখেছো চাঁদের আলোতে চারাগাছগুলোকে কেমন চমৎকার লাগছে? আমি জমিতে নেমে চারাগুলো একটু ছুঁয়ে দেখি?’

জাহিদ হেসে ঘাড় নেড়ে সম্মতি দিলো।

তন্বী ঘাস মাড়িয়ে জমিতে নেমে গেলো।

জাহিদের মাঝে মুগ্ধ করা এক ভাবনা এসে জড়িয়ে ধরলো। তার মাঝে এখন আর টান-অপরটানের দ্বন্দ্ব নেই। তার মুক্ত ভাবনায় এসে জড়ো হলো তন্বীর কথা, তন্বীর ভালবাসার কথা। সত্যি তো, যে অফুরন্ত ভালোবাসতে পারে তার তো চারাগাছের আলতো পরশ ছুঁয়ে দেখার শখ জাগবেই।

তন্বী চারাগাছগুলোতে হাতের হাল্কা নৃত্য বইয়ে দিলো। থেমে থেমে হেসে উঠতে থাকলো প্রফুল্ল চিত্তে, নিজস্ব গড়া সরল বিধানে ও স্বকীয় সত্তায়।

জাহিদ ওর দেখাদেখি হাসতে থাকলো নিঃশব্দে, তবে প্রাণখোলা।

জাহিদ কী মনে করে উঠে দাঁড়ালো। আস্তে করে ঘাসের উপর দু’তিনটে ছাপ ফেলে নেমে এলো জমির ভেতর, তন্বীর পাশে। ব্যাগটা রেখে এলো উপরেই।

তন্বীর কাছ ঘেঁষে জাহিদ ওর পিঠে মৃদু চাপড়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘তন্বী, ভালো লাগছে গ্রামের এই প্রকৃতি, নিস্তব্ধ রাত?’

তন্বী ঘাড় বাঁকিয়ে তাকালো। তারপর অপূর্ব সুন্দর চোখ নিয়ে সে উদ্ভাসিত হয়ে হাসলো। হাসলে ওর গালে চমৎকার টোল পড়ে। সে আবেশী আমেজ মেখে বললো, ‘হ্যাঁ, ভালো লাগছে। জানো জাহিদ, আগে কোনোদিন আমি গ্রামে আসিনি। এই প্রথম গ্রামে এলাম’।

জাহিদ বললো, ‘তাই! তুমি তো আগে কোনোদিন বলোনি?’

তন্বী হাসলো।

জাহিদ জিজ্ঞেস করলো, ‘তন্বী, বসবে এই খড়ের উপর?’

তন্বী আবার ঘাড় ঘুরিয়ে বিছানো খড় ও চারাগাছগুলোকে দেখলো। বললো, ‘আমরা বসলে চারাগাছগুলো মথে যাবে না?

জাহিদ তন্বীর হাত টেনে বসতে বসতে বললো, ‘নাহ, আমরা তো চারা বুননের দুই সারির মাঝখানে বসবো’।

তন্বী সায় দিলো।

ওরা বিছানো খড়ের উপর বসলো।

জাহিদ পা দুটো পশ্চিম বরাবর ছেড়ে হাত দুটো পেছনে মাটি ঠেলে বসলো। ঘাড় পৃষ্ঠদেশমুখো বাঁকিয়ে দৃষ্টিকে উন্নত করলো উপর থেকে উপরে, এক আকাশ থেকে অন্য আকাশে।

তন্বী বসলো একই ভঙ্গিতে। তবে ওর বসায় কিঞ্চিৎ পার্থক্য বিদ্যমান। সে ডান পাটা বাঁকিয়ে, থুতনির দূরত্ব কমিয়ে এনে, ডান হাতটা বাঁকানো হাঁটুটায় ভাঁজ করে রেখেছে। আর বাঁহাতটা ঠেসে দিয়েছে পেছনের মাটিতে। তার দৃষ্টিও জাহিদের মতোই এক আকাশ পেরিয়ে অন্য আকাশে। তবে এখানেও উভয়ের দৃষ্টিভঙ্গীর পার্থক্য বিদ্যমান। তন্বী আকাশ ভাঙছে খুবই গুরুত্ব দিয়ে আর জাহিদ আকাশ ভাঙছে ভাব নিয়ে অতি সাধারণ দৃষ্টিতে।

তন্বী হঠাৎ শিশুর মতো কোমল চিত্তে হেসে বললো, ‘জাহিদ, দেখেছো, কী অপূর্ব চাঁদ! মনে হচ্ছে আমি এ জীবনে আর দেখিনি। আচ্ছা গ্রামের চাঁদ আর শহরের চাঁদের মাঝে কি কোনো পার্থক্য আছে?’

জাহিদ তন্বীর এই সরল প্রশ্নে হাসলো, মুখে কিছু বললো না। তবে মনে মনে বললো, ‘তন্বী, তুমি তো এখন প্রকৃতির কন্যা। তোমার তো তা মনে হবেই’।

জাহিদকে চুপচাপ হাসতে দেখে তন্বী আরও দৃঢ় ভঙ্গিতে চোখে ঝিলিক ফুটিয়ে বললো, ‘হ্যাঁ, সত্যি বলছি। আমার কাছে তো তা পার্থক্য মনে হচ্ছে। বাসার ছাদে তো অনেক রাতেই চাঁদ দেখেছি। কিন্তু এখানকার চাঁদের মতো এত নিবিড় আপন মনে হয়নি’।

জাহিদ চাঁদ হয়ে তীক্ষè গভীর দৃষ্টিতে তাকালো। আর মুগ্ধ হয়ে ভাবতে থাকলো, মানুষ কতটা উদার হলে প্রকৃতিকে এতটা সহজে কাছে টেনে নিতে পারে?

চাঁদমুখো হয়ে এভাবে তাকিয়ে থাকতে থাকতে উভয়ের ঘাড়ে কিছুটা চাপ বোধ হলো। তন্বী তখনই হঠাৎ প্রস্তাব করলো, ‘জাহিদ, চলো কিছুক্ষণ খড়ের উপর শুয়ে চাঁদ দেখি’।

জাহিদ তন্বীর এই শিশুসুলভ প্রস্তাবে প্রথমে দ্বন্দ্ব নিয়ে তাকালো। তারপরই স্বতঃস্ফূর্ত সম্মতি নিয়ে সরাসরি দৃষ্টি মেললো। এই দৃষ্টিতে চাঁদের আকর্ষণ। এই দৃষ্টিতে তন্বীর আকর্ষণ। এই দৃষ্টিতে আত্মআকর্ষণ। এই আকর্ষণ তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। অনেকটা তাৎপর্যহীন, কিন্তু বড্ড সতেজভাব বিরাজমান।

উভয়ে শুয়ে আছে আকাশের দিকে মুখ করে। দৃষ্টি মাটির উলম্ব, চাঁদের মুখোমুখি। ওদের পরস্পরের দেহের দূরত্ব হাতখানেক। ওদের মাঝখানে প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটা শিশু গাছ, পাতার চোখ মেলে, দৃঢ় কিন্তু নিঃশব্দ জানান দিয়ে। ওদের অবস্থানের চারিপাশে তখন বিরাজ করছে এক আকাশ জ্যোৎস্না, রুপালি আলোর ভরাট যৌবন-উজ্জ্বলতাহীন মায়াবী পরশ। প্রকৃতিতে ক্ষয়ে পড়ছে রাত উগলে নিশিকন্যা। জ্যোৎস্নায় জলছাপ ফেলতে ফেলতে উড়ছে মেঘ- কখনও ছেঁড়া ছেঁড়া ভাব নিয়ে, কখনও গভীর আলিঙ্গনে। দক্ষিণের মুখ গলে বেরিয়ে আসছে বায়ুÑ কখনও মিষ্টি শীতলতায়, কখনও নরম উষ্ণতায় কিংবা কখনও মিশ্রিত আমেজে।

জাহিদ মাথা তুলে তন্বীকে দেখলো। তন্বী শুয়ে আছে গাটা পুরোপুরি মাটিতে সঁপে। একটা হাত মাটির সংস্পর্শে আর অন্য হাতটাকে বাঁকিয়ে মাথার নিচে দেওয়া। ওর আশ্চর্য সুন্দর চোখ তাকিয়ে আছে চাঁদমুখো দৃষ্টি ফেলে অনন্ত আকাশকন্যার দিকে।

জাহিদ আবার শরীর টান টান করে শুলো। চোখ ফেললো চাঁদে। তারপর চাঁদের প্রভা ঘেঁষে ছুটন্ত জলকন্যার দিকে। এভাবে তাকিয়ে রইলো কিছুটা সময়। জলকন্যা চাঁদের মুখে নেকাব ফেললো। ফেলতে ফেলতেই সরালো। আবার ফেললো। আরার সরালো। আবার...।

এভাবে তাকিয়ে থাকতে থাকতে জাহিদের দৃষ্টি ক্রমশ ক্ষয়ে আসতে থাকলো। চোখের পর্দায় বাসা বাঁধলো অন্য একটা দৃশ্য। দৃশ্যটায় কোনো বিশেষত্ব নেই। শহরের উপকূলে পাশাপাশি বসবাসরত দু’টো বাড়িকে কেন্দ্র করেই দৃশ্যের পটভূমি। প্রথম বাড়িটা মোটামুটি বড় আয়তনের তিনতলা ইমারত, আধুনিক সজ্জায় সজ্জিত। মালিক হলেন পুলিশের রিটায়ার্ড এস, পি আরমান চৌধুরী, যার কন্যা তন্বী তামান্না এখন প্রকৃতির কাছে বিলীন হচ্ছে। সঁপে দিচ্ছে তার সব অস্তিত্ব এক আকাশ হৃদয়ের কাছে। আর অপর বাড়িটা একতলা হয়ে ছোট্ট একটা মাথা বের করে রেখেছে দৈন্যদশা নিয়ে। এই বাড়িটার মালিক হুসেন আলী মাস্টার। সাহিত্যসেবী তাই এক সাহিত্যিককে খুবই নিম্ন ভাড়ায় প্রশস্ত ছাদের ছোট্ট চিলেকোঠাটা দিয়ে রেখেছেন অনেকটা উদার চিত্তে ও সম্মানের সাথে। এই চিলেকোঠার ভগ্ন কথাসাহিত্যিক আর কেউ নয়, স্বয়ং জাহিদ, জাহিদুল আলম। যে পলেস্তারা ওঠা চিলেকোঠার সম্মুখে পেয়েছিলো ঠিক আঙিনা সদৃশ এক ছাদ ও প্রশস্ত নিশ্বাস ফেলার মতো স্থান। এই ছাদের প্রায় মুখোমুখি প্রমাণ আকার, তবে বেশ গুরুত্ববহ একটা জানালা। এই ছাদ আর জানালার সম্মিলনে গড়ে উঠতে থাকে একটা সাধারণ কাহিনি। তারপর কাহিনিটা ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে অসাধারণ। ছাদের মানুষটার এটা দ্বিতীয় হনন হলেও জানালার অপূর্ব সুন্দর চোখের এটা প্রথম হনন।

তন্বী ডাকলো, ‘জাহিদ’।

জাহিদ সাড়া দিল না।

তন্বী আবার ডাকলো, ‘এই জাহিদ’।

জাহিদ এবার সাড়া দিলো, ‘হু’।

তন্বী মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করলো, ‘কী ভাবছো?’

জাহিদ ঘাড় তুলে দৃষ্টিকে কাত করে তাকালো। মাথাটা ডান হাতের তালুতে স্থাপন করে হেসে বললো, ‘নাহ, তেমন কিছু না’।

তন্বীও মাথা তুলে কৌণিক দৃষ্টি স্থাপন করলো। নির্মল দৃষ্টিভঙ্গি আর বিমল চোখ দিয়ে কিছুটা সময় তাকিয়ে রইলো অযথাই। তারপর অনুরোধের গলায় বললো, ‘জাহিদ, একটা গান গাও না, প্লিজ!’

জাহিদ বললো, ‘আমি! গান?’

তন্বী মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, ‘হ্যাঁ’।

জাহিদ হাসলো। বললো, কী যে বলো? তার চেয়ে বরং তুমি একটা গাও, আমি শুনি। ঐ গানটা, যে গানটা তোমার কণ্ঠে শুনলেই আমার মনটা ভালো হয়ে যেতো এক নিমিষেই। কী এক ভালো লাগা এসে জড়িয়ে ধরতো আমাকে’।

তন্বী হাসলো। ঘাড় নেড়ে সায় দিলো। তারপর দেহটাকে টান টান চাঁদমুখো করে শুলো। প্রথমে কিছুটা সময় গুনগুন করে, পরে স্পষ্ট কণ্ঠে তন্বী গাইতে লাগলো। সে গাইতে থাকলো পাথর ভাঙার সুর। সে গাইতে থাকলো আকাশ-দিগন্ত ভাঙার সুর। এই সুর বড্ড আশাবাদের। এই সুর শুদ্ধ নির্মাণের। এই সুর নির্মাণের আনন্দে নতুন প্রাসাদ গড়ার।

জাহিদ আশ্চর্য হলো। তার অনুভূতিকে নাড়া দিলো গভীরভাবে, অন্য দ্যোতনায়। সে অনুভব করলো, তন্বীর এই গান আজ হৃদয়ে মাতন দিচ্ছে আরও নিবিড়তম সত্তায়। আর প্রকৃতিতে তা কাঁপন দিচ্ছে মিষ্টি শীতলতায়।

জাহিদ আরও দেখলো, চতুর্দিকে শুধু ঐক্য আর ঐক্য। সংহতির পরিচ্ছন্ন আন্দোলনে নেই কোনো দ্বন্দ্ব বা নেই কোনো সংশয়। সে বুঝতে পারলো না, চতুর্দিকে এত ঐক্য, এত সংহতি কেন? তবুও সে দৃষ্টির প্রসার ঘটালো, অনুভূতির প্রসার ঘটালো। সে দেখলো, গানের এই সুর রাতের কন্ঠে গেয়ে চলছে বিশুদ্ধ চেতনায়। চাঁদ ভাঙা জ্যোৎস্না তাতে সায় দিচ্ছে বিরান নির্জনতায়। বায়ু নাচছে। তার সাথে নেচে চলছে চারাগাছের নগ্ন দেহ। সে মুগ্ধ হচ্ছে, ভাবের বিস্তীর্ণ ভূমিতে বাসা বাঁধছে ছন্দোবদ্ধ শ্লোকের মন্ময় কাব্য। যে কাব্যে কোনো শোকগাথা নেই। যে কাব্যে শোকছন্দ নেই। যে কাব্যে শুধু বর্তমান মিষ্টি রোমান্টিকতা। শুধু দৃশ্যমানতা আর দৃশ্যমানতা।

কিন্তু হঠাৎ জাহিদ পা-িত্য দেখাতে গিয়ে এত সব আয়োজনের দৃশ্যমানতায় অন্তর্নিহিত দিক উন্মোচন করতে গেলো। ঠিক তখনই পরিচ্ছন্ন আন্দোলন অপরিচ্ছন্ন হয়ে উঠলো। অনৈক্যের বৈরিভাব সর্বত্র জানান দিলো ভিন্নমাত্রায় ও ভিন্ন আঙ্গিকে। ছন্দোবদ্ধ শোকের মন্ময় কাব্যে হয়ে উঠলো শোকছন্দের শোকগাথা। ছন্দের পতন হলো, যতির বিচ্ছেদ ঘটলো।

জাহিদ দেখলো, রাত থেমে গেছে সময়ের দ্বন্দ্বে। চাঁদ কালি হয়ে গেছে কু-লী মেঘের কালশিটে দাগ নিয়ে। জ্যোৎস্না হয়ে উঠেছে ধূসর। বায়ু নৃত্যের বদলে অসহ্য যন্ত্রণায় কাঁপছে। আর সাথে তিরতির করে কাঁপছে তরমুজের চারাগাছের নেতানো দেহগুলো। এখন আর আশাবাদের সুর নেই বা নির্মাণের গান নেই। গানটা হয়ে উঠেছে আশাভঙ্গের, প্রণয় ভঙ্গের, রীতিনীতি অভদ্রতার ও ভিন্ন তত্ত্বাবধানের।

এই আশাভঙ্গের অভদ্রতায় জাহিদ হয়ে উঠেছে উন্মাতাল। সে দেখছে গানের সেই মেয়েটি এখন আর তন্বী নয়। তন্বী হয়ে উঠেছে মিতুল। তন্বী-মিতুল...! সে মনে মনে প্রকৃতিকে প্রশ্ন করলো, ‘এখানে মিতুল কেন?’Ñ জবাব এলো না। সে রাতভাঙা জ্যোৎস্নাকে প্রশ্ন করলো, ‘তন্বীর বিশুদ্ধ গানকে কেন মিতুল করুণ বিধ্বস্ত সুরের আকার দিচ্ছে?’ এখানেও জবাব এলো না। আর তার শেষ প্রশ্ন, ‘মিতুলের সত্তা কেন দ্বিতীয় হননের মুখোমুখি হয়ে অপর টানের ডাক দিচ্ছে?Ñ সে জবাব পেলো না। আর একের পর এক প্রশ্নের জবাব না পেয়ে তার মাঝে এক অসহ্য যন্ত্রণা উত্থিত হলো। এই যন্ত্রণায় কৃশকায় হয়ে উঠলো তার মন। সে সহ্য করতে না পেরে তৃষ্ণার্ত মন নিয়ে শুষ্কতায় উঠে বসলো। ভরকেন্দ্র ঠিক করতে করতে দাঁড়িয়ে গেলো পুরো শরীর বায়ু ভেদ করে ও আকাশের দিকে মু-কে ঠেলে। তারপর এগিয়ে গেলো অতি ধীরে, শরীরকে টেনে টেনে আইলের উপর, ব্যাগটার কাছে। পিছু ফিরলো না বা বাক্য ব্যয় করলো না। তাকালো না একবারও।

এদিকে তন্বীর গান থেমে গেলো। বাতাসের স্পর্শ ছোঁয়া সুরের স্পষ্ট ধ্বনি থেমে গেলো ভূমিকাহীন আচমকা। জ্ঞান বৈভিন্নতায় তন্বী হয়ে উঠলো মুক ও কক্ষচ্যুত। স্থান বৈভিন্নতায় পল্লীবাসী হয়ে সে হয়ে উঠলো আশ্রয়হীন, ঘরছাড়া, বাটিহারা।

তন্বী জাহিদের আচম্বিত এই আচরণ বুঝতে পারল না।

কিন্তু বাতাসে গানের রেশ কাটতেই জাহিদ আবার নিজস্ব তত্ত্বাবধানে চলে এলো। ভিড় করলো প্রকৃতি ও প্রকৃতির প্রতিটি উপসর্গ পূর্ববৎ চিরায়ত নিয়মে।

জাহিদ আইল ছেড়ে আবার নেমে এলো, ফিরে এলো তন্বীর কাছে। সরাসরি দৃষ্টিতে তাকালো, যন্ত্রণা হঠাৎ করেই যেন প্রশমিত হয়ে গেলো তন্বীর অপূর্ব সুন্দর চোখে তাকিয়ে। হাত বাড়িয়ে দিলো তন্বীর প্রতি।

তন্বীর জ্ঞান বৈভিন্নতা দ্রুত লয়েই পূর্ববিন্দুতে চলে এলো। কক্ষচ্যুত তন্বী বাটির নিশানা খুঁজতে খুঁজতে ঘরের ঠিকানা পেয়ে গেলো। আশ্রয় পেলো জাহিদের বাড়ানো হাতে। পরম নিবিড়তায় দেহটা টেনে দিলো জাহিদের দিকে। উঠে দাঁড়ালো একান্ত সান্নিধ্যে একান্ত আপন হয়ে। তারপর জাহিদের স্বতঃস্ফূর্ত সাড়ায় গভীর আলিঙ্গনে নিজেকে সঁপে দিলো নিশ্চিন্ত নির্ভরতায়, অনাদি অবলম্বনে।

জাহিদ আস্তে করে বললো, ‘তন্বী, চলো আমরা এখান থেকে অন্য কোথাও চলে যাই’।

তন্বী জিজ্ঞেস করলো, ‘অন্য কোথাও?’

‘হ্যাঁ, অন্য কোথাও’।

‘কোথায় যাবে?’

জাহিদ গাঢ়-উদাসী গলায় বললো, ‘জানি না’।

তন্বী আর কোনো প্রশ্ন করলো না। চুপ হয়ে গেলো। ভাবলো, কোথায় সে নোঙর ফেলবে? কোনো গন্তব্যই তো তার জানা নেই। তাই সে জাহিদের প্রস্তাবে ঘাড় নেড়ে সায় দিয়ে বললো, ‘চলো, তোমার যেখানে ইচ্ছে’।

ওরা পুনরায় এগিয়ে যেতে থাকলো ধীর লয়ে, অতি মন্থর গতিতে ও বিগত গমনের উল্টো দিকে মুখ করে। আর তখন পুরোনো পদক্ষেপের উপর একের পর এক নতুন পদক্ষেপ পড়তে থাকলো বেহাত স্বচ্ছলতায় ঋণের বিলাস টেনে। রাতের দেহে তখন ভোরের ঘ্রাণ।

back to top