অনুবাদ : কামাল রাহমান
ভালোবাসা
নিজেকে দেখতে শেখার অর্থ ভালোবাসা
যেভাবে দেখে কেউ দূরের কিছু
অনেকের ভেতর শুধু তুমি।
এবং ওভাবে সে হৃদয় রাখে অক্ষত,
এটা না জেনে, বিবিধ অসুস্থতা হতেÑ
একটা পাখি ও গাছ বলে: বন্ধু।
তখন সে চায় ব্যবহার করতে নিজেকে ও অন্য সবকিছু
যেন পরিপক্বতার ঔজ্জ্বল্যে পুলকিত সেসব।
কোনো বিষয়ই নয় এটা, সে জানে কিনা যে কি দিয়েছে সে
বোঝেই না সে অনেক সময়, যে দেয় সব চেয়ে ভালোটুকু।
ভুলে যাও
ভুলে যাও ঐ সব যাতনা
যা দিয়েছ অন্যদের
এমনকি ওগুলোও
যা দিয়েছে তোমাকে অন্যেরা।
শুধুই গড়িয়ে চলে জল
বুদ্বুদ তোলে ঝরনা, এবং ওখানেই শেষ
হেঁটে পেরিয়ে আস ঐ পৃথিবী যা তুমি ভুলে যাও।
দূরের নিষেধ শোনো কখনো।
কী অর্থ এটার, জিজ্ঞেস কর তুমি, কে গায়?
উষ্ণ হয়ে ওঠে সূর্য, ছোট্ট এক শিশুর মত
কোথাও জন্ম নেয় এক নাতি, ও এক পুতি
আরো একবার চালিত হও তুমি।
নদীর নামগুলো থেকে যায় তোমার সঙ্গে
কত বেশি নিঃশেষিত মনে হয় ঐ নদীগুলো!
তোমার ভূমি পড়ে থাকে অকর্ষিত,
নগরীর প্রাসাদচূড়াগুলো আর নেই সেভাবে।
দাঁড়িয়ে থাক তুমি নিস্তব্ধতার বাতাবরণে।
কিচিরমিচির
একই এবং ঠিক একই নয়, হেঁটে যাই ঔক বনের ভেতর দিয়ে
অবাক হই যে আমার স্বপ্নাচ্ছন্নতা, অথবা স্মৃতিপ্রবণতা
কোনোভাবেই বিলুপ্ত করে দেয় না আত্মহারা পুলক আমার।
ছোট্ট একটা দোয়েলা চিৎকার করে কানফাটা, বলি আমি: দোয়েলা?
দোয়েলা কী? কখনোই পাব না আমি একটা দোয়েল-হৃদয়,
চঞ্চুর উপর একটা লোমশ নাসারন্ধ্র, একটা উড্ডয়ন,
আর নেমে আসা নতুনরূপে প্রতিবার,
কখনো অনুভবে আসবে না আমার দোয়েলা!
অস্তিত্ব আদৌ না থাকে যদি দোয়েলার
আমার প্রকৃতিরও অস্তিত্ব নেই এ জগতে।
কে কল্পনা করবে এটা শত শত বছর পর,
হতে পারতাম কি জগতের শাশ্বত জিজ্ঞাসার উদ্ভাবক?
একটা বয়সে
চেয়েছি স্বীকার করতে পাপগুলো আমাদের, অথচ ওসব শোনার ছিল না কেউ।
সাদা মেঘেরা অস্বীকার করেছে গ্রহণ করতে সে-সব, এবং বাতাস
ছিল সদা ব্যস্ত, এক সমুদ্র হতে অন্য সমুদ্র পরিভ্রমণে।
বনের পশুগুলোকেও আগ্রহী করে তুলতে সক্ষম হই নি এমনকি।
একটা বেড়াল, যেমন অনৈতিক সে সব সময়, নেতিয়ে পড়েছে ঘুমে।
একজন মানুষ, যাকে মনে হয়েছে খুব ঘনিষ্ঠ,
অনেক দূরের বিষয় শুনতে কোনো আগ্রহ দেখায় নি সে।
ভদকা ও কফি নিয়ে বন্ধুদের আড্ডায়
বিরক্তির প্রথম চিহ্ন ফুটে ওঠার আগেই ওরা ভেবেছে, থেমে যাওয়া উচিত।
শুধু শোনার জন্য একটা ডিগ্রি আছে এমন কাউকে
ঘণ্টাচুক্তিতে নিয়োগ দেয়াও অশালীন।
মন্দির। সম্ভবত মন্দির। কিন্তু কিসের স্বীকারোক্তি ওখানে?
সুদর্শন ও মহৎ দেখাতে নিজেদের অভ্যস্ত আমরা ঐসব বেদীর নিচে।
অথচ আমাদের অবস্থানগুলোয় একটা কুনোব্যাঙের মতো কুৎসিত আমরা।
আধ-খোলা বীভৎস চোখের পাতা নিয়ে
কেউ যেন দেখতে পায় পরিষ্কার: “এই তো আমি।”
আমার নয়
সারা জীবন কেটেছে আমার ওদের এই পৃথিবীকে নিজের বলে ভান করতে
এবং এটা জানতে যে এমন ভান সত্যি লজ্জাকর।
কিইবা করতে পারি আমি? ধরা যাক অকস্মাৎ আর্তনাদ করে উঠি আমি
এবং শুরু করি নবুয়তি। কেউ তো শুনবে না আমাকে।
ওদের দেয়াল ও চোঙগুলো আমার জন্য নয়।
অন্যেরা চাইবে রাস্তায় ঘুরে বেড়াই আমি বিক্ষিপ্তভাবে
এবং কথা বলি ওদের সঙ্গে। উদ্যানের বেঞ্চে ঘুমাই
অথবা গলির বারান্দায়। যথেষ্ট কারাগার নেই
সব দরিদ্রদের অন্তরীণ রাখার জন্য। মিটিমিটি হাসি আমি, শান্ত থাকি।
আমাকে আর পায় না এখন ওরা।
ইয়ারদের সঙ্গে ভোঁজ- এটা ভালোই পারি আমি।
ঔ!
এটা সত্য, আমাদের গোত্রটা মৌমাছির মত,
প্রজ্ঞা থেকে সংগ্রহ করে মধু, বয়ে নিয়ে যায়, সঞ্চয় করে মধুচাকে
পাঠাগারের গোলকধাঁধার ভেতর ঘণ্টার পর ঘণ্টা
ঘুরে বেড়াতে সমর্থ আমি, এক তল হতে অন্য তলে
কিন্তু গতকাল, প্রভু ও নবীদের বাণীর খোঁজে
ঘোরের ভেতর ঘুরে বেড়িয়েছি উঁচু অঞ্চলগুলোয়
যেখানে কেউ যায় না প্রকৃতপক্ষে।
খুলে বসি একটা বই, যার কোনোকিছুরই অর্থোদ্ধার করা যায় না।
ঝাপসা হয়ে যাওয়া অক্ষরগুলোও প্রায় উধাও।
ঔ! আশ্চর্য হই- তাহলে এভাবে এসেছে এটা?
পরমপূজনীয়রা, কোথায় তোমরা এখন, তোমাদের শ্মশ্রু ও পরচুলা নিয়ে!
মোমের আলোয় রাত কাটে তোমাদের প্রেয়সী আলিঙ্গনের ভেতর
পৃথিবী রক্ষাকারী বার্তাগুলো কি নীরব হয়ে গেছে চিরদিনের জন্য?
একটা পরিত্রাণের দিন ছিল এটা তোমার ঘরে,
জেগে ওঠে আগুনের পাশে ঘুমিয়ে থাকা কুকুর,
হাই তোলে, এবং দেখে, যেন সে চেনে, তোমাকে।
মন্ত্র
মানুষের উদ্দেশ্য সুন্দর ও অজেয়।
কোনো বাধা নেই, কাঁটাতারের বেড়া নেই, গ্রন্থের পেষণ নেই,
নির্বাসনের শাস্তি বাধাগ্রস্ত করতে পারে না এটাকে।
ভাষার ভেতর দিয়ে শাশ্বত ধারণাসমূহ প্রতিষ্ঠিত করে এটা,
এবং নির্দেশ দেয় আমাদের বড় অক্ষরে লিখতে সত্য ও সুবিচারসমূহ,
মিথ্যা ও অবদমনগুলো ছোট হরফে।
এটা রাখে সেখানে যার থাকা উচিত উপরে, এবং আছে যেভাবে,
হতাশার শত্রু ও আশার বন্ধুরূপে।
গ্রীক থেকে ইহুদিদের অথবা প্রভু থেকে ভৃত্যকে পৃথক করতে জানে না এটা
আমাদের দেয় এক ব্যবস্থনীয় বিশ্ব।
অত্যাচারিত ও কুরুচিপূর্ণ বিসদৃশ শব্দপুঞ্জ হতে
এটা রক্ষা করে অনাড়ম্বর ও স্বচ্ছ বাক্যগুলো।
সূর্যের নিচে নতুন সব বিষয় সম্পর্কে বলে এটা।
উন্মোচন করে অতীতের আবরণ
তীব্র সুন্দর ও চিরতরুণ ফিলো-সোফিয়া
এবং কবিতা, শুভযোগে এর সখ্যতা।
গতকালের মত অনেকটা দেরিতে প্রকৃতি উদযাপন করে তার নবজন্ম,
একশৃঙ্গ এক ঘোটক ও প্রতিধ্বনি পর্বতে বয়ে নিয়ে যায় এ সংবাদ।
মহিমান্বিত ওদের বন্ধুত্ব, সমাপ্তি নেই ওদের সময়ের কোনো।
ওদের শত্রুরা নিজেদের নিক্ষেপ করে ধ্বংসের ভেতর।
তবুও বই
তবুও বইগুলো থেকে যাবে তাকের উপর, ভিন্ন অস্তিত্বে
এসেছিল একদা, এখনো ভেজা,
শরতের ¯িœগ্ধ গাছের নিচে ছড়ানো চকচকে কাঠবাদামের মত
এবং স্পর্শিত, যতেœ লালিত। দিগন্তে জ্বলে ওঠা আগুনের শিখা সত্ত্বেও,
শুরু করেছে বাঁচতে কেবল, ধুলিস্মাৎ হয় দুর্গগুলো,
দৌড়াতে থাকে মানুষেরা, গ্রহগুলো গতিপ্রাপ্ত।
‘এই আমরা’ বলে বইগুলো, এমনকি যখন ছেঁড়া হয় পৃষ্ঠাগুলো
অথবা লেলিহান শিখা খেয়ে ফেলে অক্ষরগুলো।
কত বেশি টেকসই ওরা আমাদের চেয়ে! আবেগাশ্রিত আমাদের নশ্বরতা,
স্মৃতির সঙ্গে থিতিয়ে পড়া, ছত্রভঙ্গ, ক্ষয়িষ্ণু।
কল্পনা করি ঐ বিশ্ব যেখানে আর নেই আমি:
কিছুই ঘটে না, কোনো ক্ষতি নেই, তখনও এক আশ্চর্য মুক্তমঞ্চ,
সুন্দর পোশাকে নারী, শিশিরসিক্ত লাইলাক, উপত্যকায় মধুর সংগীত
একই রকম সবকিছু। তখনও বইগুলো থেকে যাবে তাকের উপর,
আলোকোজ্জ্বল দীপ্তি, সুউচ্চ শিখর
ও মানুষের কাছ থেকে পাওয়া শুভজন্মপ্রাপ্ত।
[পোলিশ কবি চেশোয়া মিওশের জন্ম ১৯১১ সালে, তখনকার রুশ সাম্রাজ্যের অধীন লিথুয়ানিয়ায়। নিজেকে নির্দিষ্টভাবে পোলিশ অথবা লিথুয়ানিয়ান বলে স্বীকার করতে চাইতেন না তিনি। শৈশবের স্মৃতিজড়িত লিথুয়ানিয়ার দিনগুলো নিয়ে লেখা তাঁর অসাধারণ উপন্যাস দ্য ইসা ভেলি বাংলায়ও অনূদিত হয়েছে। বহু ভাষাভাষি ছিলেন তিনি; পোলিশ, লিথুয়ানিয়ান, রুশ, ইংরেজি ও ফরাসি ভাষায় অসাধারণ দক্ষতা ছিল তাঁর। একাধারে কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, গদ্য লেখক ও অনুবাদক হিসেবে সব্যসাচী লেখক হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর প্রায় সব কবিতাই পোলিশ ভাষায় লেখা, যদিও নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পূর্ব পযন্ত পোল্যান্ডে নিষিদ্ধ ছিল সে-সব। ১৯৬০-এ আমেরিকায় অভিবাসিত হন ও ১৯৭০-এ সেখানকার নাগরিকত্ব লাভ করেন। ১৯৮০ সালে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন, এবং পরের বছর পোল্যান্ডে ফিরে আসেন। ২০০৪ সালে ৯৩ বছর বয়সে পোল্যান্ডের ক্র্যাকো শহরে তাঁর জীবনাবসান ঘটে।]
অনুবাদ : কামাল রাহমান
বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪
ভালোবাসা
নিজেকে দেখতে শেখার অর্থ ভালোবাসা
যেভাবে দেখে কেউ দূরের কিছু
অনেকের ভেতর শুধু তুমি।
এবং ওভাবে সে হৃদয় রাখে অক্ষত,
এটা না জেনে, বিবিধ অসুস্থতা হতেÑ
একটা পাখি ও গাছ বলে: বন্ধু।
তখন সে চায় ব্যবহার করতে নিজেকে ও অন্য সবকিছু
যেন পরিপক্বতার ঔজ্জ্বল্যে পুলকিত সেসব।
কোনো বিষয়ই নয় এটা, সে জানে কিনা যে কি দিয়েছে সে
বোঝেই না সে অনেক সময়, যে দেয় সব চেয়ে ভালোটুকু।
ভুলে যাও
ভুলে যাও ঐ সব যাতনা
যা দিয়েছ অন্যদের
এমনকি ওগুলোও
যা দিয়েছে তোমাকে অন্যেরা।
শুধুই গড়িয়ে চলে জল
বুদ্বুদ তোলে ঝরনা, এবং ওখানেই শেষ
হেঁটে পেরিয়ে আস ঐ পৃথিবী যা তুমি ভুলে যাও।
দূরের নিষেধ শোনো কখনো।
কী অর্থ এটার, জিজ্ঞেস কর তুমি, কে গায়?
উষ্ণ হয়ে ওঠে সূর্য, ছোট্ট এক শিশুর মত
কোথাও জন্ম নেয় এক নাতি, ও এক পুতি
আরো একবার চালিত হও তুমি।
নদীর নামগুলো থেকে যায় তোমার সঙ্গে
কত বেশি নিঃশেষিত মনে হয় ঐ নদীগুলো!
তোমার ভূমি পড়ে থাকে অকর্ষিত,
নগরীর প্রাসাদচূড়াগুলো আর নেই সেভাবে।
দাঁড়িয়ে থাক তুমি নিস্তব্ধতার বাতাবরণে।
কিচিরমিচির
একই এবং ঠিক একই নয়, হেঁটে যাই ঔক বনের ভেতর দিয়ে
অবাক হই যে আমার স্বপ্নাচ্ছন্নতা, অথবা স্মৃতিপ্রবণতা
কোনোভাবেই বিলুপ্ত করে দেয় না আত্মহারা পুলক আমার।
ছোট্ট একটা দোয়েলা চিৎকার করে কানফাটা, বলি আমি: দোয়েলা?
দোয়েলা কী? কখনোই পাব না আমি একটা দোয়েল-হৃদয়,
চঞ্চুর উপর একটা লোমশ নাসারন্ধ্র, একটা উড্ডয়ন,
আর নেমে আসা নতুনরূপে প্রতিবার,
কখনো অনুভবে আসবে না আমার দোয়েলা!
অস্তিত্ব আদৌ না থাকে যদি দোয়েলার
আমার প্রকৃতিরও অস্তিত্ব নেই এ জগতে।
কে কল্পনা করবে এটা শত শত বছর পর,
হতে পারতাম কি জগতের শাশ্বত জিজ্ঞাসার উদ্ভাবক?
একটা বয়সে
চেয়েছি স্বীকার করতে পাপগুলো আমাদের, অথচ ওসব শোনার ছিল না কেউ।
সাদা মেঘেরা অস্বীকার করেছে গ্রহণ করতে সে-সব, এবং বাতাস
ছিল সদা ব্যস্ত, এক সমুদ্র হতে অন্য সমুদ্র পরিভ্রমণে।
বনের পশুগুলোকেও আগ্রহী করে তুলতে সক্ষম হই নি এমনকি।
একটা বেড়াল, যেমন অনৈতিক সে সব সময়, নেতিয়ে পড়েছে ঘুমে।
একজন মানুষ, যাকে মনে হয়েছে খুব ঘনিষ্ঠ,
অনেক দূরের বিষয় শুনতে কোনো আগ্রহ দেখায় নি সে।
ভদকা ও কফি নিয়ে বন্ধুদের আড্ডায়
বিরক্তির প্রথম চিহ্ন ফুটে ওঠার আগেই ওরা ভেবেছে, থেমে যাওয়া উচিত।
শুধু শোনার জন্য একটা ডিগ্রি আছে এমন কাউকে
ঘণ্টাচুক্তিতে নিয়োগ দেয়াও অশালীন।
মন্দির। সম্ভবত মন্দির। কিন্তু কিসের স্বীকারোক্তি ওখানে?
সুদর্শন ও মহৎ দেখাতে নিজেদের অভ্যস্ত আমরা ঐসব বেদীর নিচে।
অথচ আমাদের অবস্থানগুলোয় একটা কুনোব্যাঙের মতো কুৎসিত আমরা।
আধ-খোলা বীভৎস চোখের পাতা নিয়ে
কেউ যেন দেখতে পায় পরিষ্কার: “এই তো আমি।”
আমার নয়
সারা জীবন কেটেছে আমার ওদের এই পৃথিবীকে নিজের বলে ভান করতে
এবং এটা জানতে যে এমন ভান সত্যি লজ্জাকর।
কিইবা করতে পারি আমি? ধরা যাক অকস্মাৎ আর্তনাদ করে উঠি আমি
এবং শুরু করি নবুয়তি। কেউ তো শুনবে না আমাকে।
ওদের দেয়াল ও চোঙগুলো আমার জন্য নয়।
অন্যেরা চাইবে রাস্তায় ঘুরে বেড়াই আমি বিক্ষিপ্তভাবে
এবং কথা বলি ওদের সঙ্গে। উদ্যানের বেঞ্চে ঘুমাই
অথবা গলির বারান্দায়। যথেষ্ট কারাগার নেই
সব দরিদ্রদের অন্তরীণ রাখার জন্য। মিটিমিটি হাসি আমি, শান্ত থাকি।
আমাকে আর পায় না এখন ওরা।
ইয়ারদের সঙ্গে ভোঁজ- এটা ভালোই পারি আমি।
ঔ!
এটা সত্য, আমাদের গোত্রটা মৌমাছির মত,
প্রজ্ঞা থেকে সংগ্রহ করে মধু, বয়ে নিয়ে যায়, সঞ্চয় করে মধুচাকে
পাঠাগারের গোলকধাঁধার ভেতর ঘণ্টার পর ঘণ্টা
ঘুরে বেড়াতে সমর্থ আমি, এক তল হতে অন্য তলে
কিন্তু গতকাল, প্রভু ও নবীদের বাণীর খোঁজে
ঘোরের ভেতর ঘুরে বেড়িয়েছি উঁচু অঞ্চলগুলোয়
যেখানে কেউ যায় না প্রকৃতপক্ষে।
খুলে বসি একটা বই, যার কোনোকিছুরই অর্থোদ্ধার করা যায় না।
ঝাপসা হয়ে যাওয়া অক্ষরগুলোও প্রায় উধাও।
ঔ! আশ্চর্য হই- তাহলে এভাবে এসেছে এটা?
পরমপূজনীয়রা, কোথায় তোমরা এখন, তোমাদের শ্মশ্রু ও পরচুলা নিয়ে!
মোমের আলোয় রাত কাটে তোমাদের প্রেয়সী আলিঙ্গনের ভেতর
পৃথিবী রক্ষাকারী বার্তাগুলো কি নীরব হয়ে গেছে চিরদিনের জন্য?
একটা পরিত্রাণের দিন ছিল এটা তোমার ঘরে,
জেগে ওঠে আগুনের পাশে ঘুমিয়ে থাকা কুকুর,
হাই তোলে, এবং দেখে, যেন সে চেনে, তোমাকে।
মন্ত্র
মানুষের উদ্দেশ্য সুন্দর ও অজেয়।
কোনো বাধা নেই, কাঁটাতারের বেড়া নেই, গ্রন্থের পেষণ নেই,
নির্বাসনের শাস্তি বাধাগ্রস্ত করতে পারে না এটাকে।
ভাষার ভেতর দিয়ে শাশ্বত ধারণাসমূহ প্রতিষ্ঠিত করে এটা,
এবং নির্দেশ দেয় আমাদের বড় অক্ষরে লিখতে সত্য ও সুবিচারসমূহ,
মিথ্যা ও অবদমনগুলো ছোট হরফে।
এটা রাখে সেখানে যার থাকা উচিত উপরে, এবং আছে যেভাবে,
হতাশার শত্রু ও আশার বন্ধুরূপে।
গ্রীক থেকে ইহুদিদের অথবা প্রভু থেকে ভৃত্যকে পৃথক করতে জানে না এটা
আমাদের দেয় এক ব্যবস্থনীয় বিশ্ব।
অত্যাচারিত ও কুরুচিপূর্ণ বিসদৃশ শব্দপুঞ্জ হতে
এটা রক্ষা করে অনাড়ম্বর ও স্বচ্ছ বাক্যগুলো।
সূর্যের নিচে নতুন সব বিষয় সম্পর্কে বলে এটা।
উন্মোচন করে অতীতের আবরণ
তীব্র সুন্দর ও চিরতরুণ ফিলো-সোফিয়া
এবং কবিতা, শুভযোগে এর সখ্যতা।
গতকালের মত অনেকটা দেরিতে প্রকৃতি উদযাপন করে তার নবজন্ম,
একশৃঙ্গ এক ঘোটক ও প্রতিধ্বনি পর্বতে বয়ে নিয়ে যায় এ সংবাদ।
মহিমান্বিত ওদের বন্ধুত্ব, সমাপ্তি নেই ওদের সময়ের কোনো।
ওদের শত্রুরা নিজেদের নিক্ষেপ করে ধ্বংসের ভেতর।
তবুও বই
তবুও বইগুলো থেকে যাবে তাকের উপর, ভিন্ন অস্তিত্বে
এসেছিল একদা, এখনো ভেজা,
শরতের ¯িœগ্ধ গাছের নিচে ছড়ানো চকচকে কাঠবাদামের মত
এবং স্পর্শিত, যতেœ লালিত। দিগন্তে জ্বলে ওঠা আগুনের শিখা সত্ত্বেও,
শুরু করেছে বাঁচতে কেবল, ধুলিস্মাৎ হয় দুর্গগুলো,
দৌড়াতে থাকে মানুষেরা, গ্রহগুলো গতিপ্রাপ্ত।
‘এই আমরা’ বলে বইগুলো, এমনকি যখন ছেঁড়া হয় পৃষ্ঠাগুলো
অথবা লেলিহান শিখা খেয়ে ফেলে অক্ষরগুলো।
কত বেশি টেকসই ওরা আমাদের চেয়ে! আবেগাশ্রিত আমাদের নশ্বরতা,
স্মৃতির সঙ্গে থিতিয়ে পড়া, ছত্রভঙ্গ, ক্ষয়িষ্ণু।
কল্পনা করি ঐ বিশ্ব যেখানে আর নেই আমি:
কিছুই ঘটে না, কোনো ক্ষতি নেই, তখনও এক আশ্চর্য মুক্তমঞ্চ,
সুন্দর পোশাকে নারী, শিশিরসিক্ত লাইলাক, উপত্যকায় মধুর সংগীত
একই রকম সবকিছু। তখনও বইগুলো থেকে যাবে তাকের উপর,
আলোকোজ্জ্বল দীপ্তি, সুউচ্চ শিখর
ও মানুষের কাছ থেকে পাওয়া শুভজন্মপ্রাপ্ত।
[পোলিশ কবি চেশোয়া মিওশের জন্ম ১৯১১ সালে, তখনকার রুশ সাম্রাজ্যের অধীন লিথুয়ানিয়ায়। নিজেকে নির্দিষ্টভাবে পোলিশ অথবা লিথুয়ানিয়ান বলে স্বীকার করতে চাইতেন না তিনি। শৈশবের স্মৃতিজড়িত লিথুয়ানিয়ার দিনগুলো নিয়ে লেখা তাঁর অসাধারণ উপন্যাস দ্য ইসা ভেলি বাংলায়ও অনূদিত হয়েছে। বহু ভাষাভাষি ছিলেন তিনি; পোলিশ, লিথুয়ানিয়ান, রুশ, ইংরেজি ও ফরাসি ভাষায় অসাধারণ দক্ষতা ছিল তাঁর। একাধারে কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, গদ্য লেখক ও অনুবাদক হিসেবে সব্যসাচী লেখক হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর প্রায় সব কবিতাই পোলিশ ভাষায় লেখা, যদিও নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পূর্ব পযন্ত পোল্যান্ডে নিষিদ্ধ ছিল সে-সব। ১৯৬০-এ আমেরিকায় অভিবাসিত হন ও ১৯৭০-এ সেখানকার নাগরিকত্ব লাভ করেন। ১৯৮০ সালে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন, এবং পরের বছর পোল্যান্ডে ফিরে আসেন। ২০০৪ সালে ৯৩ বছর বয়সে পোল্যান্ডের ক্র্যাকো শহরে তাঁর জীবনাবসান ঘটে।]