alt

সাময়িকী

হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কবিতার আভিজাত্য

ওবায়েদ আকাশ

: বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪

হাবীবুল্লাহ সিরাজী

গত শতকের ষাটের দশকে এক নিরীক্ষাপ্রিয় সাহসী কবির আবির্ভাব ঘটে বাংলা কবিতায়। পাঠাভিজ্ঞতা ও ব্যক্তি পরিচয়ের সুবাদে যতটা জেনেছি ও দেখেছি, একটি কবিতাও তিনি গতানুগতিক ধারায় লিখতে চাননি, এবং সম্পাদকের আবদার মেটাতে যা খুশি তাই লিখে পাঠিয়ে দেননি মুদ্রণের জন্য। তাঁর ব্যক্তিজীবনের আভিজাত্য ও কাব্যিক জীবনের বোঝাপড়া মিলে তিনি ছিলেন একজন অনন্য মানুষ। বিনয়ী সুভাষী এই মানুষটি ছিলেন কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী। তিনি যে সময়টাতে কবিতা লিখতে শুরু করেন, এর পরবর্তী সময়ে অনেক ক্ষেত্রেই তাঁর নামটি অনুচ্চারিত থাকতে দেখা গেছে। এমনকি এখনো যে সে-অবস্থানের বিরাট কোনো পরিবর্তন ঘটেছে, তা বলা যাবে না। বিশেষ করে দশক বিবেচনায় তিনি ষাটের দশকের কবি, কিন্তু সাধারণ হিসেবে আমরা যখন প্রথম কাতারের কয়েকজন কবির নাম উচ্চারণ করি, সেখানে সিরাজী কখনো কখনো অনুপস্থিত থাকেন। কিন্তু সময়ান্তরে তিনি তাঁর কবিতার স্বাতন্ত্র্য দিয়ে আলোচনার মূলে ফিরে আসেন এবং এখান থেকে কিছু বোদ্ধা পাঠকেরও ভাবনার কেন্দ্রে ঠাঁই করে নেন। তাঁর অপ্রচল কাব্যভাষাকে তিনি এমনভাবে কবিতায় উপস্থাপন করেন যে, অন্য কোনো কবির সঙ্গে তাঁকে মেলানো যায়নি। কিন্তু তিনি যে তাঁর সব কবিতায় এমন নিরীক্ষা করে সফল হতে পেরেছিলেন তা নয় মোটেই। তাঁর অসংখ্য কবিতা গড়পড়তা কবিতার কাতারে রয়ে গেছে। কিন্তু তাঁর ভেতরে ভেতরে জেলখানার শেকল ছেঁড়ার যে আকুতি ছিল, তাও একসময় সফল হয়। তাঁর গত কয়েক বছরের কবিতায় এমন স্বাক্ষর রয়েছে যে, তিনি এমন একটি সময় অতিক্রমী ভাষার প্রভুত্ব করছেন, যা তাঁর পাঠকের মনে একটি ভিন্ন আগ্রহের সৃষ্টি করে। এবং জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সেই স্বনির্মিত ভাষায়ই উজান ঠেলে গেছেন।

সিরাজীর কবিতা পাঠান্তে এ কথা অস্বীকার করা যাবে না যে, তিনি ষাট দশকীয় উন্মাদনায় গা ভাসাননি। আবার পুরোটাও যে তিনি গড্ডলে ভেসেছিলেন, তারও কোনো সত্যতা নেই। বাংলাদেশের ষাটের দশকের কাব্য-জিজ্ঞাসা প্রাণ পেয়েছিল বোদলেয়ারীয় উন্মাদনা, বোহেমিয়ানিজম এবং আত্মবিধ্বংসী প্রবণতায়। তেমন কয়েকজন ষাটের কবির মধ্যে এখনো কেউ কেউ জীবিত আছেন। এবং পুরো ষাটের দশকের এই সাহিত্যিক উন্মাদনা ও স্বাধীনতা প্রাপ্তির প্রত্যাশায় অভাবনীয় রাজনৈতিক উষ্ণতা কিছু কিছু প্রবল ব্যক্তিত্বের জন্ম দিয়েছে। তাঁদের মধ্যে শিল্প-সাহিত্যের অঙ্গনে ষাটের দশকের কয়েকজন কবি-কথাসাহিত্যিক ও শিল্পীর কথা অকপটেই বলা যায়। সাহিত্যাঙ্গন থেকে সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও তাঁদেরকে সরব থাকতে দেখা গেছে। অনেকে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে, সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন আবার অনেকে পরোক্ষে দেশমাতৃকার মুক্তির আন্দোলনে সরব থেকেছেন।

সাতচল্লিশের ব্রিটিশ বিতাড়ন থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পূর্ব পর্যন্ত যে ভাষা আন্দোলন, গণআন্দোলন তথা জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রেক্ষাপট- তাই প্রথমত ছিল ষাটের দশকের কবিদের কবিতার প্রথম উপাদান। পরবর্তীতে, এমনকি তখনো কাউকে কাউকে দেখা যায় বৈশি^ক প্রেক্ষাপট ও বিশুদ্ধ কবিতাযাত্রায় পথ হাঁটতে। হাবীবুল্লাহ সিরাজী এই দ্বিতীয় কাতারের একজন নিষ্ঠ কবি ব্যক্তিত্ব। তিনি রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের চেয়ে অধিক গুরুত্ব দিলেন ব্যক্তির আত্মপরিচয় অনুসন্ধান, বাঙালিত্বের স্বরূপ উন্মোচন ও ভাষার কৌশলী মুন্সিয়ানায় প্রাণ সঞ্চারণে। তবে তাঁর স্বদেশ, স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ক কবিতার সংখ্যা নিতান্ত কম নয়। সিরাজীর যুদ্ধবিষয়ক ও রাজনৈতিক কবিতাগুলোও সরাসরি কথা বলে না। সেখানেও তিনি শিল্পের আড়াল রক্ষা করে নিজেকে উপস্থাপন করেন। তাঁর যুদ্ধ বিষয়ক একটি কবিতার কয়েক পঙ্ক্তি যেমন:

ভিতরেই যুদ্ধ। বায়ু থেকে জলে, অগ্নি ও নৈর্ঋতে

উদ্যত অস্ত্রের ঘায়ে অবিরাম ধসে যায় মাটি

বাঙ্কারে তরুণ সৈন্য খাদ্যাভাবে অসাড়, নির্বাক

তবু শেষ নেই। চতুর্দিকে

ফুঁসে ওঠে বোমারু বিমান

যুদ্ধ। স্বপ্নে: কামানের গোলা

কানে স্থির, অন্ধ চোখে ধোঁয়া...

ধমনিতে প্রবাহিত আর্যানার্য রক্তে মৃত্যুগামী ধারা

[যুদ্ধ, নির্বাচিত কবিতা, পৃ: ৩]

এ এমন এক যুদ্ধের বর্ণনাÑ তা যেমন ভিতরের, আবার গোলাবারুদের প্রকাশ্য যুদ্ধ। আবার এ যুদ্ধ আর্য-অনার্যেরও হতে পারে। শিল্পকে এভাবে সময়, স্থান ও সরল বাস্তবতায় আবদ্ধ না রেখে তাকে উন্মুক্ত ভাবনায় ঠাঁই দেবার ক্ষমতা একজন প্রাজ্ঞ কবির কাছে শিল্পের প্রত্যাশা। সিরাজী সেভাবেই তাঁর শিল্পের দায় মেটান।

তাঁর কবিতার কিছু কিছু চিত্রকল্প পাঠককে এমনভাবে নাড়া দেয় যে, মনে হয় তিনি সম্পূর্ণ নতুন কোনো কাব্যপ্রকরণ নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন। তিনি প্রথমত চিত্রকল্পের স্বভাব সন্তরণ থেকে লাফিয়ে ডাঙায় ওঠেন এবং পুনর্সন্তরণে স্থিত হতে ঘাম ঝরিয়ে দেন। পড়া যাক তাঁর ছোট্ট ‘ট্রেন’ কবিতার কয়েক লাইন:

আংটা দেয়া বেলা

গাছের লেজ, মাঠের পিঠ আর বাড়ির মাথা সাঁতরিয়ে

হুসহাস ছুটছেÑ

পাতের নিচে সুতোর মিস্ত্রি নাস্তানাবুদ

[নির্বাচিত কবিতা, পৃ: ৭২]

বলতে দ্বিধা নেই, সাম্প্রতিক সময়ের কবিরাও নতুন নতুন চিত্রকল্পের সন্ধানে মূলত এর বাইরে বেরুতে গিয়ে ঘাম ঝরিয়ে দিচ্ছেন। হয়তো প্রাগ্রসর কবি, বহু আগেই চিত্রকল্প নির্মাণের এই ধারা সম্পর্কে অনুধাবন করেছিলেন। তাই তাঁর যে নিরন্তর নিরীক্ষা ও অনুশীলন, তাঁকে যেমন সময়োপযোগী ভাবা যায়, তেমনি তাঁকে নির্ভর করে লাভবান হওয়া যায়।

কবি, যতক্ষণ না পর্যন্ত গণমানুষের বন্ধু, ততক্ষণ না বড় কবি। গণমানুষের বন্ধু মানে তাঁর কবিতার পাঠক প্রচুর হতে হবে, বা ব্যাপক গণমানুষ তাঁর কবিতা পড়বে, এমন নয়। গণমানুষের সুহৃদ মানে মানুষ তাঁর মনুষ্যত্বকে ভালোবাসে, মানুষ তাঁর মানবতাবোধকে সমীহ করে, এমন ব্যাপার। তাঁর কবিতা হয়তো এমন যা গণমানুষের বোধের দরজায় কখনো পৌঁছায় না। তিনি ব্যতিক্রম বা প্রচলিত ধারায় লেখেনও না। নিজেকে স্বতন্ত্র করে গড়েন বহু বহু সাধনায়। তাই তিনি সত্য উচ্চারণ করে গণমানুষের পাশে থেকেও হয়তো কবিতা লেখেন সম্পূর্ণ নিজের মতো করে এবং তাঁর কবিতা ব্যাকুল সৃষ্টির ক্ষুধায় অন্য এক নন্দনভুবনে বসবাস করে। তাই বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে কবিকেও চিনে-ওঠা দুসাধ্য হয়ে পড়ে। তাঁর কবিতার মতো তিনিও হয়তো এক ঘোরের মানুষ হয়ে সবার মাঝে বেঁচে থাকেন। এবং তাঁর প্রস্থানের পর ক্রমশই উজ্জ্বল হয়ে ওঠে তাঁর সৃষ্টির সম্ভার। ক্রমশই প্রকট হতে থাকে তাঁর অভাব।

বাংলাদেশের কুমার নদ আর পদ্মা পারের মোহনা, ফরিদপুর জেলার মধ্য শহরে জন্ম নেয়া কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী উপরে বর্ণিত বর্ণনা দ্বারা অলঙ্কৃত এক ব্যতিক্রমী কবি। গত শতাব্দির ষাটের দশকে তাঁকে বাংলা কবিতার ভুবনে প্রবেশকালেই দেখা যায় তাঁর কবিতাসজ্জার আসবাবগুলো অনেকটা ভিন্ন, অনেকটা অচেনা প্রকৃতির; তবে বাংলা ও বাঙালির নিঃসন্দেহে। তিনি নিজে যেমন গতানুগতিক ধারায় কবিতা লেখেননি, তেমনি কখনো তাঁর গণমানুষের জনপ্রিয় কবি হয়ে ওঠার আকাক্সক্ষাও চোখে পড়ে নি। যদিও তাঁকে গণমানুষের ভাষ্যকার ছাড়া কিছু বলা যায় না। তাঁর উপস্থাপনার ব্যতিক্রম এবং ভাষার মুন্সিয়ানায় হয়তো তা গণমানুষের বোধগম্য হতে সময় নিয়েছে। এখন একথা নির্দি¦ধায় বলা যায়, হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কবিতার পাঠক খুব বেশি নয়।

তাঁর সাম্প্রতিক লেখা একটি কবিতার উদাহরণ দিতে আগ্রহ বোধ করছি। ‘লালনের মন’ নামে এ কবিতাটিতে তিনি লালনকে বহু ব্যঞ্জনায় পাঠকের কাছে উপস্থাপন করেছেন। একজন সুরস¤্রাট, একজন মহৎ কবির মনকে তিনি মানব জীবনের বিবিধ অনুষঙ্গে যেভাবে প্রতীকায়িত করলেন, তা গড়পড়তা কোনো কবির কাজ নয়। তিনি লিখেছেনÑ “করুণা ও দয়া বোন/একান্ত আপন/নিত্য নয় মন/তারপরও প্রতিজন/সযতনে করে সমর্পণ/কর্মের সমন/একক লালন”

একই কবিতায় তিনি আবার বলেছেন: “করুণার মর্ম/আর দয়ার ধর্ম/সৃষ্টিগর্ভে মাতৃরূপে/ সৃষ্টিশর্তে পিতৃরূপে/ অপার আনন্দঘন/ চিত্ত-তীর্থ নিরূপণ/ লালনের মন”

তিনি এককজন অধ্যাত্ম সাধকের মনকে কোথা থেকে কোথায় নিয়ে সমর্পিত করেন, বিষয়টি ভাবনার। মরমীবাদ থেকে সৃষ্টিতত্ত্ব একজন আধুনিকপ্রান্তের কবিকে কতোটা বিচলিত করে, তা ‘লালনের মন’ থেকে আমরা অনুমান করতে পারি। কেননা, এই লালন কিন্তু স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকে পর্যন্ত ভাবিত করেছিলেন, রবীন্দ্র সঙ্গীতপ্রতিভাকে প্রভাবিত করেছিলেন লালন। এ কারণেই বলা যে, হাবীবুল্লাহ সিরাজী ব্যতিক্রম তবে বাঙালির মূল ধারা বা শাশ্বত ধারাকে কখনো অস্বীকার করেননি। আবার প্রচলিত কাব্য¯্রােতের ঢেউ ঘেঁষে স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ ও মানবপ্রেম সংক্রান্ত তাঁর কিছু জনপ্রিয় কবিতাও রয়েছেÑ যা তাঁকে নিয়ে বিবিধ আলোচনায় প্রায়শ লক্ষ্যযোগ্য।

সিরাজী নিজেকে একজন জেনারেল বলে দাবি করে স্বস্তি পেয়েছেন। কিন্তু পাঠকের স্বস্তির জায়গা হয়তো তিনি আমলে নেননি। কিংবা পাঠকের তৃপ্তিকে তিনি এড়িয়ে গেছেন। কিন্তু তিনি পাঠককে শিক্ষিত করতে চেয়েছেন। তাই তাঁকে বলা যায় কবিতার কমরেড। তিনি কবিতায় বিপ্লব ঘটানোর আশা পোষণ করতেন হয়তো। শতবর্ষ আগে বাংলা কবিতার শ্রেষ্ঠতম কবি জীবনানন্দ দাশ মনে করতেন, আধুনিক কবিতা বুঝতে হলে পাঠককেও সমানভাবে শিক্ষিত হতে হবে। ধারাবাহিক কবিতাপাঠ ব্যতীত তাকে স্পর্শ করা দুরূহ। তারও অর্ধশতাধিক বৎসর পরে এসে সিরাজীও ভাবেন তেমন কিছু যে, পাঠককে তৃপ্তি দেয়া কবির কাজ নয়। পাঠককে কবিতার নবতর বিন্যাসে, নবতর উপস্থাপনায় আবাসন গড়ে দেয়াই একজন অগ্রসর কবির কাজ। যে কারণে তিনি অনুবাদের জন্যও বেছে নেন দুজন ব্যতিক্রমী কবির কবিতা। একজন জালালউদ্দিন রুমি অন্যজন রসুল হামজাতভ। একজন মরমীবাদের কবি আর একজন সমাজতান্ত্রিক কবি।

রুমির কবিতা আজ সারা বিশ্বের সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য পাঠ। কয়েকশ বছর পরে রুমি তাঁর সময়ের চেয়েও জনপ্রিয় হয়ে বেঁচে আছেন। হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কবিতা সম্পর্কে তাই স্পষ্ট করে কথা বলা দুরূহ। সময় তাঁকে কীভাবে গ্রহণ করবে, তার ইঙ্গিত রয়েছে কবিতার প্রতিটি শব্দে, স্পেসে, বিষয়-প্রকরণে। এ-কথা কেউ জোর দিয়ে বলতে পারে না। পারলে শিক্ষিত সমাজ কখনো বিভ্রান্ত হতো না। একজন কবিকে গণহৃদয়ে ঠাঁই পাওয়ার জন্য মৃত্যুর পর শত শত বৎসর অপেক্ষা করতে হতো না। হাবীবুল্লাহ সিরাজীর পঁয়ত্রিশটি কবিতার বইসহ গ্রন্থসংখ্যা অর্ধ শতাধিক। একুশে পদকসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কারও পেয়েছেন তিনি। আবার প্রকৌশলী থেকে শেষ জীবনে এসে বাংলা একাডেমির মতো প্রতিষ্ঠানে মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু কোনো প্রলোভন তাঁকে কবিতা থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। সমসাময়িক অনেকের বেলায় এমনটি ঘটলেও তাঁর কবিতা রূপলাবণ্যে তাঁর নিজেকেই অতিক্রম করে যেতো। কতো মানুষ তো আশি নব্বই একশো বছর বেঁচে থেকে পৃথিবীর কাছে তার ঋণ শোধ করতে অপারগ থাকে। কিন্তু একজন সৃষ্টিচঞ্চল কবিকে কেন একাত্তরেই বা তারো কম সময়ে চলে যেতে হয়Ñ এ জিজ্ঞাসা সমগ্র সৃজনশীল সমাজের। হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কাছে আমাদের আরো পাওয়ার ছিলো তিনি দিতেও চেয়েছিলেন; কিন্তু কোথায় যেন ভ্রান্তি লুকিয়ে ছিলো।

কবিতামাত্র সদা উল্লম্ফনশীল। তার সঠিক গতিপ্রকৃতি কোনো পাঠক তো দূরের কথা, নিষ্ঠ সমালোচক পর্যন্ত বুঝতে পারেন না। যতটা পারেন তার পুরোটাই আপেক্ষিক। সময়ান্তরে তাই বদলে যাচ্ছে। হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কবিতা তাই শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ছিলো নানা ঘটন অঘটনে নাটকীয়। সমূহ ভাঙচুরে শৈল্পিক। শেষ দিন পর্যন্ত তিনি যে কবিতাটি রচনা করে গেছেন, তার মধ্যেও তাঁকে একজন প্রকৃত নিরীক্ষকের ভূমিকায় আবিষ্কার করবার সুযোগ আছে। যা লিখতেন, তাই বিশ্বাস করতেন তিনি। একদিন কবিতা বিষয়ক এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, সেই লেখা লিখে কী লাভ যা আজকের তরুণতর কবিকে পর্যন্ত নড়েচড়ে বসতে বাধ্য করছে না। যে লেখায় নতুন কোনো মেসেস নেই, তার লেখা আর না লেখা সমান কথা। এভাবে চিন্তা করতে করতে সিরাজীর একটি কাব্যজীবন শেষ হয়ে গেলেও পাঠক হৃদয়ে কিংবা তরুণতর কবিহৃদয়ে তার ঝঙ্কার থেকে গেছে। তিনি বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন যে, কবিতার নতুনত্ব হচ্ছে শিল্পের চূড়ান্ত উল্লম্ফন। এই উল্লম্ফন দিয়ে নতুনত্বে পৌঁছানো যায়। কবিতার শাশ্বত পথ খুঁজে পাওয়া যায়। সিরাজীর কথার খোঁচায় ক্ষত হয়ে যে তরুণ কবিতা লিখবেন, আর যাই হোক তিনি, গড়পড়তা লেখাকে এড়িয়ে যাবেন। কবিতার বিকল্প ব্যঞ্জনা সৃষ্টিতে তৎপর হবেন। সিরাজীর উচ্চারণের ভিন্নতার পক্ষে কয়েক পঙ্ক্তি উল্লেখ করা যায়:

ইতিহাস মানুষ নয়, কিন্তু মানুষের সঙ্গে-সাথে

দুই পায়ে হাঁটে। মিথ্যাসত্য লেখে।

সিংহাসনে বসে, অস্ত্রাগারে থাকে,

গণতন্ত্র-ধনতন্ত্র-সমাজতন্ত্র, বিজয় ও অহঙ্কার দিয়ে ভেজে

জাতি লেখে, ধর্ম লেখে, ভাষা লেখেÑ

লেখে কূট-কাল এবং লুপ্ত কঙ্কাল!

[ইতিহাস বদমাশ হলে মানুষ বড়ো কষ্ট পায়, নির্বাচিত কবিতা, বাএ, পৃ: ৬৭]

সিংহাসন থেকে ইতিহাসের সৃষ্টি হলেও তিনি ইতিহাসকেই সিংহাসনে বসিয়েছেন। এখানে ইতিহাসই প্রত্যক্ষ আর জীবন পরোক্ষে ক্রিয়াশীল। তিনি যে ইতিহাসের বর্ণনা দিয়েছেন তা নারকীয়তায় ভরপুর। তাই তাকে বদমাশ বলা হয়েছে। কিন্তু ইতিহাস লেখা হয় উল্টোপিঠেও। সে ইতিহাস হয়তো হরষিত। ইতিহাসে প্রাণ সঞ্চার করে ঘটনাকে আড়ালে লুকোনোর এই নিরীক্ষা নিঃসন্দেহে উপভোগ্য ও অভিনব।

আর একটি কবিতার কয়েক পঙ্ক্তি কীভাবে সমসাময়িক ও ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে স্বতন্ত্র তার উদাহরণ দেখি:

আমার গিন্নি ইলিশ বাজে, শ্রাবণ-ভাদ্রে বৃষ্টি ভাজে

সবজি-শস্য শেষ করে সে পানপত্র, পদ্য ভাজে

আজ সকালে জনকণ্ঠে মাংস ভেজে কাপড় কলের বাষ্প ভাজছে

নির্বাচনের মার্কা ভাজবে; ঈ তে ঈগল মেঘ-উঁচুতে একা ওড়ে...

গিন্নিরা সব পলটি ভাজে, বনস্পতি সয়াবিনে

... ... ...

আমার গিন্নি দশ পঞ্চাশের বাংলাদেশ ব্যাংক শুকনো ভাজে

[ভাজা @ গিন্নি ডট কম, নির্বাচিত কবিতা, পৃ: ৪৬]

কবিতার পাঠকমাত্র এতক্ষণে ভাবতে বসে গেছেন যে, এমন উচ্চারণে অতীতে আর কোনো কবির কবিতা তার মনে পড়ে কিনা। এবং শেষ পর্যন্ত না পেয়ে, কবিতাহাবীবুল্লাহ সিরাজীতে পুনরায় মগ্ন হন। এবং আমরাও নির্দ্বিধায় বলতে পারি এমন নতুন নতুন ও অভাবিত চিত্রকল্প ইতোপূর্বে চোখে পড়ে নি। এই যে ইলিশ ভাজার মতো একটি সাধারণ ক্রিয়া থেকে ক্রমশ গভীরে হেঁটে হেঁটে বৃষ্টি ভাজা, পদ্য ভাজা, বাষ্প ভাজা এমনকি কেন্দ্রিয় ব্যাংক অবধি শুকনো ভেজে ফেলা; তা শুধু কবিতার শ্রেষ্ঠত্বকেই প্রমাণ করে। এবং কবিতার এইসব চিত্রকল্প কতটা সমসাময়িক, গভীর-বিস্তারি ও ইঙ্গিতধর্মী, তা বোদ্ধা পাঠকের আর অজানা নয়। সবচেয়ে মারাত্মক সূক্ষ্মতা আমরা লক্ষ্য করি, যখন পড়তে হয়, “গিন্নিরা সব পলটি ভাজে, বনস্পতি সয়াবিনে”। এমন অনিবার্য সত্যকে কবিতা করে তোলা নিঃসন্দেহে কোনো কবির শক্তিমত্ততাকে প্রমাণ করে। গিন্নিদের এই নিমজ্জন কখনো এড়ানোর উপায় নেই।

আমরা যতই হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কবিতা পড়ি, যতই তার স্বকীয়তার সহজতা খুঁজতে যাই, ততই আমরা অনেকগুলো পথের মুখে বসে, প্রতিটি পথের সৌন্দর্যে ও তার দুপাশের অরণ্যানি খেলায় নিমগ্ন হই। বলতে ভুলে যাই, এখানে যখন সন্ধ্যা নামে, তার আগেই এপথ মিশে যায় অনন্ত আলোকমালায়। চিত্রকল্পের অভিনবত্বে ও ঔজ্জ্বল্যে শুরু হয় নবউচ্ছ্বাসের সন্তরণক্রীড়া। আবার ‘বিকেল ভালো তাই কাশফুল ভালো’ উচ্চারণের মোহে, নিগন্ধ কাশফুলের অরণ্যে হাঁটি অপর সৌন্দর্যে। সহজ করে বলতে গেলে হাবীবুল্লাহ সিরাজী বুঝে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, যা কিছু করবার প্রথম লগ্নেই সম্পন্ন করতে হয়। তাই শুরু থেকেই তার কবিতা অপর বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। তার নিরীক্ষাক্রম প্রজন্মান্তরে পথের দিশা।

ছবি

আর এক সুন্দর সকালবেলায়

ছবি

আবার নরকুম্ভির ও মডার্নিজম

ছবি

আত্মজীবনীর আত্মপ্রকাশ প্রসঙ্গে

ছবি

আসাদের অঙ্ক

ছবি

র্যাঁবোর কবিতায় প্রতীকী জীবনের ছায়া

ছবি

ভাষা সংস্কৃতি সাক্ষরতা

ছবি

চেশোয়া মিওশ-এর কবিতা

ছবি

সিলভিয়া প্লাথের মৃত্যু, নিঃসঙ্গতা ও আত্মবিনাশ

ছবি

সমসাময়িক মার্কিনি ‘সহস্রাব্দের কণ্ঠস্বর’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

অন্য নিরিখে দেখা

ছবি

হেলাল হাফিজের চলে যাওয়া

ছবি

হেলাল হাফিজের কবিতা

ছবি

কেন এত পাঠকপ্রিয় হেলাল হাফিজ

ছবি

নারী শিক্ষাবিদ : বেগম রোকেয়া

ছবি

বাসার তাসাউফ

ছবি

‘জগদ্দল’-এর শক্তি ও সমরেশ বসু

ছবি

রুগ্ণ আত্মার কথোয়াল

ছবি

রুবেন দারিও-র কবিতা

‘অঘ্রানের অনুভূতিমালা’

ছবি

কবিতা পড়া, কবিতা লেখা

ছবি

‘ধুলোয় সব মলিন’, পাঠকের কথা

ছবি

মহত্ত্বর কবি সিকদার আমিনুল হক

ছবি

রুগ্ণ আত্মার কথোয়াল

ছবি

কয়েকটি অনুগল্প

সাময়িকী কবিতা

ছবি

যেভাবে লেখা হলো ‘শিকিবু’

ছবি

জাঁ জোসেফ রাবেয়ারিভেলোর কবিতা

ছবি

সিকদার আমিনুল হকের গদ্য

ছবি

সিকদার আমিনুল হককে লেখা অগ্রজ ও খ্যাতিমান লেখক-সম্পাদকের চিঠি

ছবি

ফিওদর দস্তয়েভস্কি: রুগ্ণ আত্মার কথোয়াল

একজন গফুর মল্লিক

ছবি

অগ্রবীজের ‘অনুবাদ সাহিত্য’ সংখ্যা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

গোপন কথা

ছবি

র’নবীর টোকাই-কথন

tab

সাময়িকী

হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কবিতার আভিজাত্য

ওবায়েদ আকাশ

হাবীবুল্লাহ সিরাজী

বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪

গত শতকের ষাটের দশকে এক নিরীক্ষাপ্রিয় সাহসী কবির আবির্ভাব ঘটে বাংলা কবিতায়। পাঠাভিজ্ঞতা ও ব্যক্তি পরিচয়ের সুবাদে যতটা জেনেছি ও দেখেছি, একটি কবিতাও তিনি গতানুগতিক ধারায় লিখতে চাননি, এবং সম্পাদকের আবদার মেটাতে যা খুশি তাই লিখে পাঠিয়ে দেননি মুদ্রণের জন্য। তাঁর ব্যক্তিজীবনের আভিজাত্য ও কাব্যিক জীবনের বোঝাপড়া মিলে তিনি ছিলেন একজন অনন্য মানুষ। বিনয়ী সুভাষী এই মানুষটি ছিলেন কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী। তিনি যে সময়টাতে কবিতা লিখতে শুরু করেন, এর পরবর্তী সময়ে অনেক ক্ষেত্রেই তাঁর নামটি অনুচ্চারিত থাকতে দেখা গেছে। এমনকি এখনো যে সে-অবস্থানের বিরাট কোনো পরিবর্তন ঘটেছে, তা বলা যাবে না। বিশেষ করে দশক বিবেচনায় তিনি ষাটের দশকের কবি, কিন্তু সাধারণ হিসেবে আমরা যখন প্রথম কাতারের কয়েকজন কবির নাম উচ্চারণ করি, সেখানে সিরাজী কখনো কখনো অনুপস্থিত থাকেন। কিন্তু সময়ান্তরে তিনি তাঁর কবিতার স্বাতন্ত্র্য দিয়ে আলোচনার মূলে ফিরে আসেন এবং এখান থেকে কিছু বোদ্ধা পাঠকেরও ভাবনার কেন্দ্রে ঠাঁই করে নেন। তাঁর অপ্রচল কাব্যভাষাকে তিনি এমনভাবে কবিতায় উপস্থাপন করেন যে, অন্য কোনো কবির সঙ্গে তাঁকে মেলানো যায়নি। কিন্তু তিনি যে তাঁর সব কবিতায় এমন নিরীক্ষা করে সফল হতে পেরেছিলেন তা নয় মোটেই। তাঁর অসংখ্য কবিতা গড়পড়তা কবিতার কাতারে রয়ে গেছে। কিন্তু তাঁর ভেতরে ভেতরে জেলখানার শেকল ছেঁড়ার যে আকুতি ছিল, তাও একসময় সফল হয়। তাঁর গত কয়েক বছরের কবিতায় এমন স্বাক্ষর রয়েছে যে, তিনি এমন একটি সময় অতিক্রমী ভাষার প্রভুত্ব করছেন, যা তাঁর পাঠকের মনে একটি ভিন্ন আগ্রহের সৃষ্টি করে। এবং জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সেই স্বনির্মিত ভাষায়ই উজান ঠেলে গেছেন।

সিরাজীর কবিতা পাঠান্তে এ কথা অস্বীকার করা যাবে না যে, তিনি ষাট দশকীয় উন্মাদনায় গা ভাসাননি। আবার পুরোটাও যে তিনি গড্ডলে ভেসেছিলেন, তারও কোনো সত্যতা নেই। বাংলাদেশের ষাটের দশকের কাব্য-জিজ্ঞাসা প্রাণ পেয়েছিল বোদলেয়ারীয় উন্মাদনা, বোহেমিয়ানিজম এবং আত্মবিধ্বংসী প্রবণতায়। তেমন কয়েকজন ষাটের কবির মধ্যে এখনো কেউ কেউ জীবিত আছেন। এবং পুরো ষাটের দশকের এই সাহিত্যিক উন্মাদনা ও স্বাধীনতা প্রাপ্তির প্রত্যাশায় অভাবনীয় রাজনৈতিক উষ্ণতা কিছু কিছু প্রবল ব্যক্তিত্বের জন্ম দিয়েছে। তাঁদের মধ্যে শিল্প-সাহিত্যের অঙ্গনে ষাটের দশকের কয়েকজন কবি-কথাসাহিত্যিক ও শিল্পীর কথা অকপটেই বলা যায়। সাহিত্যাঙ্গন থেকে সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও তাঁদেরকে সরব থাকতে দেখা গেছে। অনেকে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে, সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন আবার অনেকে পরোক্ষে দেশমাতৃকার মুক্তির আন্দোলনে সরব থেকেছেন।

সাতচল্লিশের ব্রিটিশ বিতাড়ন থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পূর্ব পর্যন্ত যে ভাষা আন্দোলন, গণআন্দোলন তথা জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রেক্ষাপট- তাই প্রথমত ছিল ষাটের দশকের কবিদের কবিতার প্রথম উপাদান। পরবর্তীতে, এমনকি তখনো কাউকে কাউকে দেখা যায় বৈশি^ক প্রেক্ষাপট ও বিশুদ্ধ কবিতাযাত্রায় পথ হাঁটতে। হাবীবুল্লাহ সিরাজী এই দ্বিতীয় কাতারের একজন নিষ্ঠ কবি ব্যক্তিত্ব। তিনি রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের চেয়ে অধিক গুরুত্ব দিলেন ব্যক্তির আত্মপরিচয় অনুসন্ধান, বাঙালিত্বের স্বরূপ উন্মোচন ও ভাষার কৌশলী মুন্সিয়ানায় প্রাণ সঞ্চারণে। তবে তাঁর স্বদেশ, স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ক কবিতার সংখ্যা নিতান্ত কম নয়। সিরাজীর যুদ্ধবিষয়ক ও রাজনৈতিক কবিতাগুলোও সরাসরি কথা বলে না। সেখানেও তিনি শিল্পের আড়াল রক্ষা করে নিজেকে উপস্থাপন করেন। তাঁর যুদ্ধ বিষয়ক একটি কবিতার কয়েক পঙ্ক্তি যেমন:

ভিতরেই যুদ্ধ। বায়ু থেকে জলে, অগ্নি ও নৈর্ঋতে

উদ্যত অস্ত্রের ঘায়ে অবিরাম ধসে যায় মাটি

বাঙ্কারে তরুণ সৈন্য খাদ্যাভাবে অসাড়, নির্বাক

তবু শেষ নেই। চতুর্দিকে

ফুঁসে ওঠে বোমারু বিমান

যুদ্ধ। স্বপ্নে: কামানের গোলা

কানে স্থির, অন্ধ চোখে ধোঁয়া...

ধমনিতে প্রবাহিত আর্যানার্য রক্তে মৃত্যুগামী ধারা

[যুদ্ধ, নির্বাচিত কবিতা, পৃ: ৩]

এ এমন এক যুদ্ধের বর্ণনাÑ তা যেমন ভিতরের, আবার গোলাবারুদের প্রকাশ্য যুদ্ধ। আবার এ যুদ্ধ আর্য-অনার্যেরও হতে পারে। শিল্পকে এভাবে সময়, স্থান ও সরল বাস্তবতায় আবদ্ধ না রেখে তাকে উন্মুক্ত ভাবনায় ঠাঁই দেবার ক্ষমতা একজন প্রাজ্ঞ কবির কাছে শিল্পের প্রত্যাশা। সিরাজী সেভাবেই তাঁর শিল্পের দায় মেটান।

তাঁর কবিতার কিছু কিছু চিত্রকল্প পাঠককে এমনভাবে নাড়া দেয় যে, মনে হয় তিনি সম্পূর্ণ নতুন কোনো কাব্যপ্রকরণ নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন। তিনি প্রথমত চিত্রকল্পের স্বভাব সন্তরণ থেকে লাফিয়ে ডাঙায় ওঠেন এবং পুনর্সন্তরণে স্থিত হতে ঘাম ঝরিয়ে দেন। পড়া যাক তাঁর ছোট্ট ‘ট্রেন’ কবিতার কয়েক লাইন:

আংটা দেয়া বেলা

গাছের লেজ, মাঠের পিঠ আর বাড়ির মাথা সাঁতরিয়ে

হুসহাস ছুটছেÑ

পাতের নিচে সুতোর মিস্ত্রি নাস্তানাবুদ

[নির্বাচিত কবিতা, পৃ: ৭২]

বলতে দ্বিধা নেই, সাম্প্রতিক সময়ের কবিরাও নতুন নতুন চিত্রকল্পের সন্ধানে মূলত এর বাইরে বেরুতে গিয়ে ঘাম ঝরিয়ে দিচ্ছেন। হয়তো প্রাগ্রসর কবি, বহু আগেই চিত্রকল্প নির্মাণের এই ধারা সম্পর্কে অনুধাবন করেছিলেন। তাই তাঁর যে নিরন্তর নিরীক্ষা ও অনুশীলন, তাঁকে যেমন সময়োপযোগী ভাবা যায়, তেমনি তাঁকে নির্ভর করে লাভবান হওয়া যায়।

কবি, যতক্ষণ না পর্যন্ত গণমানুষের বন্ধু, ততক্ষণ না বড় কবি। গণমানুষের বন্ধু মানে তাঁর কবিতার পাঠক প্রচুর হতে হবে, বা ব্যাপক গণমানুষ তাঁর কবিতা পড়বে, এমন নয়। গণমানুষের সুহৃদ মানে মানুষ তাঁর মনুষ্যত্বকে ভালোবাসে, মানুষ তাঁর মানবতাবোধকে সমীহ করে, এমন ব্যাপার। তাঁর কবিতা হয়তো এমন যা গণমানুষের বোধের দরজায় কখনো পৌঁছায় না। তিনি ব্যতিক্রম বা প্রচলিত ধারায় লেখেনও না। নিজেকে স্বতন্ত্র করে গড়েন বহু বহু সাধনায়। তাই তিনি সত্য উচ্চারণ করে গণমানুষের পাশে থেকেও হয়তো কবিতা লেখেন সম্পূর্ণ নিজের মতো করে এবং তাঁর কবিতা ব্যাকুল সৃষ্টির ক্ষুধায় অন্য এক নন্দনভুবনে বসবাস করে। তাই বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে কবিকেও চিনে-ওঠা দুসাধ্য হয়ে পড়ে। তাঁর কবিতার মতো তিনিও হয়তো এক ঘোরের মানুষ হয়ে সবার মাঝে বেঁচে থাকেন। এবং তাঁর প্রস্থানের পর ক্রমশই উজ্জ্বল হয়ে ওঠে তাঁর সৃষ্টির সম্ভার। ক্রমশই প্রকট হতে থাকে তাঁর অভাব।

বাংলাদেশের কুমার নদ আর পদ্মা পারের মোহনা, ফরিদপুর জেলার মধ্য শহরে জন্ম নেয়া কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী উপরে বর্ণিত বর্ণনা দ্বারা অলঙ্কৃত এক ব্যতিক্রমী কবি। গত শতাব্দির ষাটের দশকে তাঁকে বাংলা কবিতার ভুবনে প্রবেশকালেই দেখা যায় তাঁর কবিতাসজ্জার আসবাবগুলো অনেকটা ভিন্ন, অনেকটা অচেনা প্রকৃতির; তবে বাংলা ও বাঙালির নিঃসন্দেহে। তিনি নিজে যেমন গতানুগতিক ধারায় কবিতা লেখেননি, তেমনি কখনো তাঁর গণমানুষের জনপ্রিয় কবি হয়ে ওঠার আকাক্সক্ষাও চোখে পড়ে নি। যদিও তাঁকে গণমানুষের ভাষ্যকার ছাড়া কিছু বলা যায় না। তাঁর উপস্থাপনার ব্যতিক্রম এবং ভাষার মুন্সিয়ানায় হয়তো তা গণমানুষের বোধগম্য হতে সময় নিয়েছে। এখন একথা নির্দি¦ধায় বলা যায়, হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কবিতার পাঠক খুব বেশি নয়।

তাঁর সাম্প্রতিক লেখা একটি কবিতার উদাহরণ দিতে আগ্রহ বোধ করছি। ‘লালনের মন’ নামে এ কবিতাটিতে তিনি লালনকে বহু ব্যঞ্জনায় পাঠকের কাছে উপস্থাপন করেছেন। একজন সুরস¤্রাট, একজন মহৎ কবির মনকে তিনি মানব জীবনের বিবিধ অনুষঙ্গে যেভাবে প্রতীকায়িত করলেন, তা গড়পড়তা কোনো কবির কাজ নয়। তিনি লিখেছেনÑ “করুণা ও দয়া বোন/একান্ত আপন/নিত্য নয় মন/তারপরও প্রতিজন/সযতনে করে সমর্পণ/কর্মের সমন/একক লালন”

একই কবিতায় তিনি আবার বলেছেন: “করুণার মর্ম/আর দয়ার ধর্ম/সৃষ্টিগর্ভে মাতৃরূপে/ সৃষ্টিশর্তে পিতৃরূপে/ অপার আনন্দঘন/ চিত্ত-তীর্থ নিরূপণ/ লালনের মন”

তিনি এককজন অধ্যাত্ম সাধকের মনকে কোথা থেকে কোথায় নিয়ে সমর্পিত করেন, বিষয়টি ভাবনার। মরমীবাদ থেকে সৃষ্টিতত্ত্ব একজন আধুনিকপ্রান্তের কবিকে কতোটা বিচলিত করে, তা ‘লালনের মন’ থেকে আমরা অনুমান করতে পারি। কেননা, এই লালন কিন্তু স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকে পর্যন্ত ভাবিত করেছিলেন, রবীন্দ্র সঙ্গীতপ্রতিভাকে প্রভাবিত করেছিলেন লালন। এ কারণেই বলা যে, হাবীবুল্লাহ সিরাজী ব্যতিক্রম তবে বাঙালির মূল ধারা বা শাশ্বত ধারাকে কখনো অস্বীকার করেননি। আবার প্রচলিত কাব্য¯্রােতের ঢেউ ঘেঁষে স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ ও মানবপ্রেম সংক্রান্ত তাঁর কিছু জনপ্রিয় কবিতাও রয়েছেÑ যা তাঁকে নিয়ে বিবিধ আলোচনায় প্রায়শ লক্ষ্যযোগ্য।

সিরাজী নিজেকে একজন জেনারেল বলে দাবি করে স্বস্তি পেয়েছেন। কিন্তু পাঠকের স্বস্তির জায়গা হয়তো তিনি আমলে নেননি। কিংবা পাঠকের তৃপ্তিকে তিনি এড়িয়ে গেছেন। কিন্তু তিনি পাঠককে শিক্ষিত করতে চেয়েছেন। তাই তাঁকে বলা যায় কবিতার কমরেড। তিনি কবিতায় বিপ্লব ঘটানোর আশা পোষণ করতেন হয়তো। শতবর্ষ আগে বাংলা কবিতার শ্রেষ্ঠতম কবি জীবনানন্দ দাশ মনে করতেন, আধুনিক কবিতা বুঝতে হলে পাঠককেও সমানভাবে শিক্ষিত হতে হবে। ধারাবাহিক কবিতাপাঠ ব্যতীত তাকে স্পর্শ করা দুরূহ। তারও অর্ধশতাধিক বৎসর পরে এসে সিরাজীও ভাবেন তেমন কিছু যে, পাঠককে তৃপ্তি দেয়া কবির কাজ নয়। পাঠককে কবিতার নবতর বিন্যাসে, নবতর উপস্থাপনায় আবাসন গড়ে দেয়াই একজন অগ্রসর কবির কাজ। যে কারণে তিনি অনুবাদের জন্যও বেছে নেন দুজন ব্যতিক্রমী কবির কবিতা। একজন জালালউদ্দিন রুমি অন্যজন রসুল হামজাতভ। একজন মরমীবাদের কবি আর একজন সমাজতান্ত্রিক কবি।

রুমির কবিতা আজ সারা বিশ্বের সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য পাঠ। কয়েকশ বছর পরে রুমি তাঁর সময়ের চেয়েও জনপ্রিয় হয়ে বেঁচে আছেন। হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কবিতা সম্পর্কে তাই স্পষ্ট করে কথা বলা দুরূহ। সময় তাঁকে কীভাবে গ্রহণ করবে, তার ইঙ্গিত রয়েছে কবিতার প্রতিটি শব্দে, স্পেসে, বিষয়-প্রকরণে। এ-কথা কেউ জোর দিয়ে বলতে পারে না। পারলে শিক্ষিত সমাজ কখনো বিভ্রান্ত হতো না। একজন কবিকে গণহৃদয়ে ঠাঁই পাওয়ার জন্য মৃত্যুর পর শত শত বৎসর অপেক্ষা করতে হতো না। হাবীবুল্লাহ সিরাজীর পঁয়ত্রিশটি কবিতার বইসহ গ্রন্থসংখ্যা অর্ধ শতাধিক। একুশে পদকসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কারও পেয়েছেন তিনি। আবার প্রকৌশলী থেকে শেষ জীবনে এসে বাংলা একাডেমির মতো প্রতিষ্ঠানে মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু কোনো প্রলোভন তাঁকে কবিতা থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। সমসাময়িক অনেকের বেলায় এমনটি ঘটলেও তাঁর কবিতা রূপলাবণ্যে তাঁর নিজেকেই অতিক্রম করে যেতো। কতো মানুষ তো আশি নব্বই একশো বছর বেঁচে থেকে পৃথিবীর কাছে তার ঋণ শোধ করতে অপারগ থাকে। কিন্তু একজন সৃষ্টিচঞ্চল কবিকে কেন একাত্তরেই বা তারো কম সময়ে চলে যেতে হয়Ñ এ জিজ্ঞাসা সমগ্র সৃজনশীল সমাজের। হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কাছে আমাদের আরো পাওয়ার ছিলো তিনি দিতেও চেয়েছিলেন; কিন্তু কোথায় যেন ভ্রান্তি লুকিয়ে ছিলো।

কবিতামাত্র সদা উল্লম্ফনশীল। তার সঠিক গতিপ্রকৃতি কোনো পাঠক তো দূরের কথা, নিষ্ঠ সমালোচক পর্যন্ত বুঝতে পারেন না। যতটা পারেন তার পুরোটাই আপেক্ষিক। সময়ান্তরে তাই বদলে যাচ্ছে। হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কবিতা তাই শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ছিলো নানা ঘটন অঘটনে নাটকীয়। সমূহ ভাঙচুরে শৈল্পিক। শেষ দিন পর্যন্ত তিনি যে কবিতাটি রচনা করে গেছেন, তার মধ্যেও তাঁকে একজন প্রকৃত নিরীক্ষকের ভূমিকায় আবিষ্কার করবার সুযোগ আছে। যা লিখতেন, তাই বিশ্বাস করতেন তিনি। একদিন কবিতা বিষয়ক এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, সেই লেখা লিখে কী লাভ যা আজকের তরুণতর কবিকে পর্যন্ত নড়েচড়ে বসতে বাধ্য করছে না। যে লেখায় নতুন কোনো মেসেস নেই, তার লেখা আর না লেখা সমান কথা। এভাবে চিন্তা করতে করতে সিরাজীর একটি কাব্যজীবন শেষ হয়ে গেলেও পাঠক হৃদয়ে কিংবা তরুণতর কবিহৃদয়ে তার ঝঙ্কার থেকে গেছে। তিনি বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন যে, কবিতার নতুনত্ব হচ্ছে শিল্পের চূড়ান্ত উল্লম্ফন। এই উল্লম্ফন দিয়ে নতুনত্বে পৌঁছানো যায়। কবিতার শাশ্বত পথ খুঁজে পাওয়া যায়। সিরাজীর কথার খোঁচায় ক্ষত হয়ে যে তরুণ কবিতা লিখবেন, আর যাই হোক তিনি, গড়পড়তা লেখাকে এড়িয়ে যাবেন। কবিতার বিকল্প ব্যঞ্জনা সৃষ্টিতে তৎপর হবেন। সিরাজীর উচ্চারণের ভিন্নতার পক্ষে কয়েক পঙ্ক্তি উল্লেখ করা যায়:

ইতিহাস মানুষ নয়, কিন্তু মানুষের সঙ্গে-সাথে

দুই পায়ে হাঁটে। মিথ্যাসত্য লেখে।

সিংহাসনে বসে, অস্ত্রাগারে থাকে,

গণতন্ত্র-ধনতন্ত্র-সমাজতন্ত্র, বিজয় ও অহঙ্কার দিয়ে ভেজে

জাতি লেখে, ধর্ম লেখে, ভাষা লেখেÑ

লেখে কূট-কাল এবং লুপ্ত কঙ্কাল!

[ইতিহাস বদমাশ হলে মানুষ বড়ো কষ্ট পায়, নির্বাচিত কবিতা, বাএ, পৃ: ৬৭]

সিংহাসন থেকে ইতিহাসের সৃষ্টি হলেও তিনি ইতিহাসকেই সিংহাসনে বসিয়েছেন। এখানে ইতিহাসই প্রত্যক্ষ আর জীবন পরোক্ষে ক্রিয়াশীল। তিনি যে ইতিহাসের বর্ণনা দিয়েছেন তা নারকীয়তায় ভরপুর। তাই তাকে বদমাশ বলা হয়েছে। কিন্তু ইতিহাস লেখা হয় উল্টোপিঠেও। সে ইতিহাস হয়তো হরষিত। ইতিহাসে প্রাণ সঞ্চার করে ঘটনাকে আড়ালে লুকোনোর এই নিরীক্ষা নিঃসন্দেহে উপভোগ্য ও অভিনব।

আর একটি কবিতার কয়েক পঙ্ক্তি কীভাবে সমসাময়িক ও ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে স্বতন্ত্র তার উদাহরণ দেখি:

আমার গিন্নি ইলিশ বাজে, শ্রাবণ-ভাদ্রে বৃষ্টি ভাজে

সবজি-শস্য শেষ করে সে পানপত্র, পদ্য ভাজে

আজ সকালে জনকণ্ঠে মাংস ভেজে কাপড় কলের বাষ্প ভাজছে

নির্বাচনের মার্কা ভাজবে; ঈ তে ঈগল মেঘ-উঁচুতে একা ওড়ে...

গিন্নিরা সব পলটি ভাজে, বনস্পতি সয়াবিনে

... ... ...

আমার গিন্নি দশ পঞ্চাশের বাংলাদেশ ব্যাংক শুকনো ভাজে

[ভাজা @ গিন্নি ডট কম, নির্বাচিত কবিতা, পৃ: ৪৬]

কবিতার পাঠকমাত্র এতক্ষণে ভাবতে বসে গেছেন যে, এমন উচ্চারণে অতীতে আর কোনো কবির কবিতা তার মনে পড়ে কিনা। এবং শেষ পর্যন্ত না পেয়ে, কবিতাহাবীবুল্লাহ সিরাজীতে পুনরায় মগ্ন হন। এবং আমরাও নির্দ্বিধায় বলতে পারি এমন নতুন নতুন ও অভাবিত চিত্রকল্প ইতোপূর্বে চোখে পড়ে নি। এই যে ইলিশ ভাজার মতো একটি সাধারণ ক্রিয়া থেকে ক্রমশ গভীরে হেঁটে হেঁটে বৃষ্টি ভাজা, পদ্য ভাজা, বাষ্প ভাজা এমনকি কেন্দ্রিয় ব্যাংক অবধি শুকনো ভেজে ফেলা; তা শুধু কবিতার শ্রেষ্ঠত্বকেই প্রমাণ করে। এবং কবিতার এইসব চিত্রকল্প কতটা সমসাময়িক, গভীর-বিস্তারি ও ইঙ্গিতধর্মী, তা বোদ্ধা পাঠকের আর অজানা নয়। সবচেয়ে মারাত্মক সূক্ষ্মতা আমরা লক্ষ্য করি, যখন পড়তে হয়, “গিন্নিরা সব পলটি ভাজে, বনস্পতি সয়াবিনে”। এমন অনিবার্য সত্যকে কবিতা করে তোলা নিঃসন্দেহে কোনো কবির শক্তিমত্ততাকে প্রমাণ করে। গিন্নিদের এই নিমজ্জন কখনো এড়ানোর উপায় নেই।

আমরা যতই হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কবিতা পড়ি, যতই তার স্বকীয়তার সহজতা খুঁজতে যাই, ততই আমরা অনেকগুলো পথের মুখে বসে, প্রতিটি পথের সৌন্দর্যে ও তার দুপাশের অরণ্যানি খেলায় নিমগ্ন হই। বলতে ভুলে যাই, এখানে যখন সন্ধ্যা নামে, তার আগেই এপথ মিশে যায় অনন্ত আলোকমালায়। চিত্রকল্পের অভিনবত্বে ও ঔজ্জ্বল্যে শুরু হয় নবউচ্ছ্বাসের সন্তরণক্রীড়া। আবার ‘বিকেল ভালো তাই কাশফুল ভালো’ উচ্চারণের মোহে, নিগন্ধ কাশফুলের অরণ্যে হাঁটি অপর সৌন্দর্যে। সহজ করে বলতে গেলে হাবীবুল্লাহ সিরাজী বুঝে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, যা কিছু করবার প্রথম লগ্নেই সম্পন্ন করতে হয়। তাই শুরু থেকেই তার কবিতা অপর বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। তার নিরীক্ষাক্রম প্রজন্মান্তরে পথের দিশা।

back to top