আদনান সৈয়দ
সন্দেহ নেই আর্তুর র্যাঁবোর? জীবন বিচিত্র এবং ছন্নছাড়া। এই বিচিত্র জীবনবোধের ছাপ তাঁর কাব্য জগতে পড়বে এই স্বাভাবিক। খুব বেশি সময় তিনি পৃথিবীতে বাঁচেননি। কিন্তু তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনভ্রমণে তিনি কাব্যপ্রেমীদের জন্যে রেখে গেছেন বিচিত্র জগতের তৃষ্ণার্ত কাব্যের সন্ধান। সে কারণেই র্যাঁবোকে কাব্য সমাজের এক অন্য মাত্রার কবি হিশেবে বিবেচনা করা হয়। বিচিত্র জীবন বীক্ষণে একজন প্রতীকবাদী কবি হিসেবে রাঁবোর ভূমিকা বিরল।
সন্দেহ নেই র্যাঁবোর কাব্যজীবন এবং দর্শন তাঁর সমসাময়িক অন্য কবিদের থেকে ছিল একটু ভিন্ন এবং চমকপ্রদ। বিশেষ করে তাঁর কবিতার মূল সুর হলো স্বাধীন, কাল্পনিক এবং স্বতঃস্ফূর্ত। কবিতা মানেই কল্পনার আশ্রয় নেওয়া কিন্তু র্যাঁবো সেই কল্পনাকে আশ্রয় নিয়েছেন তাঁর নির্মিত প্রতীকী ভাষাকে অবলম্বন করে। আর সে কারণেই র্যাঁবো তাঁর কবিতায় আমাদের পরিচয় করিয়ে দেন নতুন আবার অচেনা এক প্রতীকী জগতের সঙ্গে। যে জগত আমাদের চেনা কিন্তু আবার অচেনাও। যে জগতে আমরা নিত্য বসবাস করি অথচ যেন সেই জগতটাকে ঠিকমত দেখতে পাই না। এই জগতকে আমরা আবিষ্কার করি আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয়গুলো কাজে লাগিয়ে। এই ইন্দ্রিয়জাত অবস্থানকে ব্যাখা আর প্রকাশ করতে আমাদের দ্বারস্থ হয় প্রতীকী ভাষার। কারণ প্রতীকী ভাষা ছাড়া এই কাব্যের অন্তর্নিহীত ভাব প্রবেশ করা সম্ভব নয়।
ফরাসি কবিতা তো বটেই পৃথিবীর যে কোনো ভাষার কবিতাতেই র্যাঁবোর কাব্যভাবানার প্রচ্ছন্ন একটি ছাপ লক্ষ্য করা যায়। শুধু কবিতার নতুন গঠন শৈলি নয়, বরং কবিতায় নতুন ভাবনা সৃষ্টিতে র্যাঁবোর কোনো জুড়ি নেই। কবিতায় অধিবাস্তবাদী আন্দোলনে কবি আঁদ্রে ব্রিটন থেকে আঁদ্রে ফ্রেয়দসহ যেসব কবি এই মতবাদকে বেগবান করেছিলেন তারা সবাই কোনো না কোনোভাবে র্যাঁবোর ভাবধারায় আচ্ছন্ন হয়েছিলেন। সে কারণে র্যাঁবাকে বলা হয় ফরাসি কবিতার উনিশ দশকের অন্যতম প্রধান গুরুত্বপূর্ণ কবি। কবিতায় প্রতীকীভাব ফুটিয়ে শব্দকে নতুন এক মাত্রায় তুলে ধরতে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। কবিতার বিভিন্ন দিক নিয়ে কাজ করার পাশাপাশি তিনি অনুবাদ নিয়েও কাজ করেন। ইংরেজ কবি সেমুয়েল বেকেট এবং জন এ্যাসবেরি ব্যাঁবোর কবিতায় তিনি অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন।
জ্যাঁ নিকোলাস আর্তুর র্যাঁবোর জন্ম অক্টবোর ২০, ১৮৫৪ সালে ফ্রান্সের দক্ষিণ-পূর্বে শার্লভিল গ্রামে। বাবা ফ্রেডরিক র্যাঁবো ছিলেন সেনাবাহিনীর ক্যাপটেন। মার নাম ম্যেরি ক্যাথারিন ভিতালি। র্যাঁবোর বড় ভাই ফ্যাডরিক-এর জন্ম ১৯৫৩ সালে। তাঁর ছিল দুই বোন। ভিতালি (জন্ম ১৮৫৮) এবং ইসাবেলে (জন্ম ১৮৬০)। র্যাঁবোর ছেলেবেলাকালীন বাবার অনুপস্থিতি তাঁর জীবনকে নিঃসঙ্গ করে রেখেছিল। এই নিঃসঙ্গ জীবনের নানা রকম মানসিক যন্ত্রণা পরবর্তীতে তাঁর কবিতায় বিভিন্নভাবে ফুটে ওঠে। বিশেষ করে তাঁর (The Seven-Year-Old Poets, 1871) গ্রন্থের পাতায় সেই নিঃসঙ্গতার ছাপ সুস্পষ্ট। র্যাঁবোর মা ছিলেন গোড়া খ্রিস্টানধর্মালম্বী। তিনি গভীরভাবে ধর্মকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকায় বিশ্বাসী ছিলেন। এই বিষয়টিও র্যাঁবোর ছেলেবেলার ওপর প্রভাব ফেলেছিল। জানা যায় মা’র কড়া শাসনের কারণে র্যাঁবোকে সেই ছেলেবেলাতেই বাইবেল মুখস্থ করতে হয়েছিল অনেকটা বাধ্য হয়েই। ধর্মের প্রতি র্যাঁবোর বিদ্বেষ তৈরি হয় সেই তখন থেকেই। সে কারণেই হয়তো লিখেছিলেন, “ধর্ম খুব মারাত্মক এক বিষয়”।
কবি র্যাঁবোর কবিতা নিয়ে কথা বলতে হলে তাঁর ব্যক্তি জীবনের নানা ঘটনার উপরও কিঞ্চিৎ আলো আলো ফেলা জরুরি। কারণ র্যাঁবোর জীবনের অনেক ঘটনাই তাঁর কবিতায় বিভিন্ন সুরে বেজে উঠেছে এবং কাব্যমোদিদের অন্তরে জায়গা তৈরি করে নিয়েছে। ১৮৭০ সালে র্যাঁবো তাঁর বাড়ি থেকে তিনবার পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। বিশেষ করে ফ্রানকো-প্রুশিয়ান যুদ্ধের পরবর্তী অস্থির সময়গুলোতে র্যাঁবো মানসিকভাবে ছিলেন বিপর্যস্ত। তিনি তাঁর স্কুল-কলেজের গতানুগতিক শিক্ষার ইতি টেনেছিলেন তখনই। ১৮৭০ সালে তিনি প্যারিস চলে যান এবং বিনা টিকেটে রেল ভ্রমণের অপরাধে গ্রেফতার হন এবং তাকে জেলে পাঠানো হয়। মাস ছয়েক জেল খাটার পর র্যাঁবোকে তাঁর মা ছাড়িয়ে নিয়ে আসেন এবং আবার এক সঙ্গে থাকা শুরু করেন। ১৮৭১ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে র্যাঁবো আবার বাড়ি থেকে পালান এবং প্যারিসের একটি বিপ্লবী দলের সঙ্গে যোগ দেন। এই সময়টায় তার জীবনে নতুন আরেকটি মোড় নেয়। মনোজগতে তাঁর তখন চলতে থাকে কবিতা নিয়ে নানা রকম কাটাকাটি। বিশেষ করে কবিতার রূপরস নিয়ে তখন তিনি মেতে ওঠেন। কবিতার বিভিন্ন কাঠামো নিয়ে তিনি কাজ করতে শুরু করেন। জীবন বাস্তবতায় কবিতার অবস্থান নিয়ে তিনি ভাবতে শুরু করেন। কবিতা যে জীবনের অন্যান্য আনুষঙ্গিক বাস্তবতার রূপ তা তিনি তাঁর কাব্যসূত্রে নিয়ে আসেন। মে ১৩, ১৮৭১ সালে র্যাঁবো কবিতা নিয়ে এই নতুন ভাবনাগুলো তাঁর বন্ধু এবং শিক্ষক জর্জ ইজমবার্ডকে চিঠি লিখেন। মে ১৫, ১৮৭১ সালে তাঁর আরেক বন্ধু পল দিমেনিকেও তিনি একটি চিঠি লিখেন। র্যাঁবোর এই চিঠিটি পড়ে তাকে প্যারিসে আমন্ত্রণ জানানো হয়। র্যাঁরবো ঠিক তখনই ফরাসি জনপ্রিয় কবি পল ভেরলেঁর সঙ্গে পরিচিত হন। ১৮৭১ সালে তিনি কবি ভ্যারলেঁ এবং তার স্ত্রী মেথিলদের সঙ্গে বসবাস শুরু করতে থাকেন। ঠিক তখনেই ভ্যারলেঁ-এর সঙ্গে র্যাঁবোর একটি রোমান্টিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সেই সঙ্গে ভেরলেঁর ব্যক্তি জীবনে ঝামেলা শুরু হতে থাকে।
র্যাঁবোর প্রথম দিকের কবিতা Poésies লেখা হয়েছিল ১৮৬৯ এবং ১৮৭২ সালের মধ্যে। ১৮৯৫ সালে কবিতাগুলো গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেন তাঁর প্রাক্তন প্রেমিক পল ভেরলেঁ। কারিগরি জীবনবোধকে কাজে লাগিয়ে কবিতাগুলো ছিল মৌলিক ভাবধারায় লেখা। এই কবিতাগুলো পরবর্তীতে নতুন একটি ধারার দিকে প্রবাহিত হতে শুরু করে। কবিতার ভাষার নতুনত্ব, দৃষ্টিভঙ্গি এবং ভাবনার বৈচিত্র্য দিয়ে কবিতাগুলো ছিল আচ্ছন্ন। চলুন এবার কাব্যগ্রন্থটির ভেতরে প্রবেশ করি। তাঁর ‘শয়তান’ এবং ‘উপতক্যায় নিদ্রা’ দুটো কবিতাই যুদ্ধের বিভিষিকার চিত্র বিমূর্ত হয়ে ফুটে উঠেছে। ‘টারটাফের সাজা’ কবিতাটি মানুষের দ্বৈত সংঘাতের উপর লিখিত অসাধারণ একটি সনেট। ‘সবুজ সরাইখানায়’, ‘ধূর্ত একসময়’ এবং ‘আমার বোহেমিয়ান অস্তিত্ব’ এই তিনটি কবিতাতেই মানুষের বহেমিয়ান জীবনের ছবি ফুটে উঠেছে। একদিকে জীবন বাস্তবতা অন্যদিকে ‘হোমলেস মাইন্ড’-এর আর্তি। ‘সংগীতের প্রতি’ কবিতাটি একজন মানুষের চোখ দিয়ে দেখা যাপিত জীবনের আখ্যান। জীবনের সংগীতটি তিনি তাঁর কবিতার শব্দে ধারণ করেছিলেন। জীবনের বিভিন্ন তরঙ্গ প্রবাহগুলো র্যাঁবো তির্যক এবং প্রতীকীভাবে দেখতে পেয়েছিলেন। সেই জীবনের পরতে পরতে ধরা পড়েছিল মানুষের নানা রঙের মুখ ও মুখোশ। “একজন ভীত” কবিতায় জীবককে কার্টুনের সঙ্গে তুলনা করে রঙ্গ তামাশায় ভরিয়ে ?তুলেছিলেন র্যাঁবো। কবিতাটি পড়লে মানুষের বিচিত্র গঠন চোখের সামনে যেন দুলে ওঠে। এই রঙ্গরসিকতা কখনো হাস্যকর পর্যায়ে পৌঁছালেও শেষ পর্যন্ত তা যেন অবিকল মানুষের ছবি হয়েই ফুটে উঠেছে। তার “সন্ধ্যার প্রার্থনা” কবিতাটি এই দিক থেকে কিছুটা ব্যতিক্রম, সন্দেহ নেই। কেউ কেউ বলে থাকেন কবিতাটা প্রচলিত ধর্ম বিরোধী একটি কবিতা। এই কবিতায় তিনি আচ্ছামত ধর্মবিশ্বাসীদের ব্যাঙ্গ করতে ভুলে যাননি। কবিতায় তিনি নিজেই একজন বিধ্বংসী ফেরেস্তার রূপ ধারণ করে আবির্ভূত হয়েছেন। আকাশমুখি হয়ে তিনি তাঁর স্রষ্টার বিরুদ্ধে প্রতীকী ভাষায় প্রতিবাদ করেছেন।
চড়ল্কংরবং গ্রন্থে কবিতাকে নিয়ে এক দুঃসাহসিক অভিযাত্রী র্যাঁবো। এই সাহস তাঁর পূর্ববর্তী কবি বোদলেয়ার ছাড়া খুব কম কবিই দেখাতে পেয়েছিলেন। র্যাঁবো কবিতার শব্দ দিয়ে সেই সাহসিক অভিযানে যাত্রা শুরু করেছিলেন। কী ছিল সেই সাহসের মূল মন্ত্র! তাঁর কবিতা দিয়ে ধর্মীয় গোড়ামি থেকে মুক্ত হয়ে সাহসী এবং স্বতঃস্ফূর্ত জীবনের নির্যাসকে কবিতার ভাষায় ফুটিয়ে তুলেছিলেন। সেই সঙ্গে কবিতার নতুনত্বও আরেকটি প্রধান বিষয়। যাদুবাস্তবতা, প্রতীকী শব্দ, কল্পচিত্র এবং পাশাপাশি কবিতায় আধুনিকায়নে র্যঁবো তাঁর কবিতায় নতুন একটি ধারা তৈরি করেন। পরবর্তীতে আমরা দেখতে পাই চড়ল্কংরবং সংকলিত প্রতিটি কবিতাই র্যঁবোর পরবর্তী জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভাবনা হিসেবে কাজ করেছে। বিশেষ করে বিংশ এবং একবিংশ সময়ের কবিতা আন্দোলনেও তাঁর এই কবিতাগুলো অগ্রগণ্য।
র্যাঁবো তাঁর কবিতায় প্রতীকী ভাষা দিয়ে এমন কিছু শব্দচয়ন করেছেন যা তৎকালীন সময়ে অনেকের মতেই কাম্য ছিল না। ত্রিস্তা জাঁরা কবিতায় ডাডা মতবাদ দিয়ে ব্যাক্তিমানুষের চিন্তা এবং শক্তিকে পুঁজি করে কবিতায় যে নতুন ধারা তৈরি করেছিলেন র্যাঁবো যেন ঠিক সেই পথেও খানিকটা হেঁটেছিলেন। খানিক পথ এ কারণেই বলছি যে, তিনি ত্রিস্তা জাঁরার পথ থেকে খানিকটা সরে যেয়ে কবিতার রূপকে আরো বেশি প্রতীকী করে তুলতে পেরেছিলেন। সন্দেহ নেই তাঁর কবিতার এই নির্মাণশিল্প ছিল গতানুগতিক কবিতা নির্মাণের ধারার বাইরে। যে শব্দগুলো সমাজ বর্জন করে, যা সমাজে কর্তৃক অনুমোদিত নয় সেই বিষয়গুলোকেও তিনি কবিতায় তুলে আনেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে। তিনি কবিতার মাধ্যমে এই ধারণাটি দিয়েছেন যে, কবিতার শব্দগুলো মানুষের বিচিত্র ভাবনার খোরাক ছাড়া আর কিছুই নয়। অতএব জীবনকে আলিঙ্গন করতে হলে পরিপূর্ণভাবে জীবনের গোটা চিত্রই কবিতায় তুলে নিয়ে আসতে হবে। তাছাড়া যে ধর্মীয় ভাবনা এবং সামাজিক আচার মানুষকে নিজেদের প্রকৃতগত পথ থেকে দূরে সরে রাখতে বাধ্য করে তিনি সেই ধর্মীয় অনাচারের বিরুদ্ধেও কবিতায় প্রতিবাদী ছিলেন।
র্যঁবোর অনেক চিঠিপত্রে তাঁর চড়ল্কংরবং কাব্যসংকলন নিয়ে অনেক উচ্চাশা এবং ধারণার চালাচালি লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ করে কবিতার শব্দ এবং কবিতাকে আত্মায় ধারণ করতে হলে প্রতীকী ভাষার আশ্রয় নেওয়া নিয়ে তিনি অনেক তার সমসামিয়কদের সঙ্গে চিঠি চালাচালি করেন। মে ১৫, ১৮৭১ সালে বন্ধু ডেমিনিকে লেখা এক চিঠিতে র্যাঁবো তাঁর সেই আকাংখার কথা তুলে ধরেন। বিশেষ করে ফরাসি কবিতার বাঁক এবং নতুন কিছু ধারণা নিয়ে তিনি এই চিঠিতে তাঁর মতামত রাখেন। জ্যাঁ রাসিনের রোমান্টিক জগৎ থেকে শুরু করে শার্ল বোদলেয়ারের কবিতার প্রতীক মূর্তকে তিনি ব্যাখা করেন। এদিকে র্যাঁবোর কবিতায় আরো একজন ফরাসি কবি এবং দার্শনিক আচ্ছন্ন হয়েছিলেন এবং বিশেষভাবে আলোড়িত হয়েছিলেন তিনি হলেন কবি পল ভ্যালেরি। ভ্যালেরি ছিলেন র্যাঁবোর Vowel Sonnet কবিতার ভক্ত। পরবর্তীতে ভ্যালেরি ফরাসি কবিতার নতুন বাঁক নির্মাণে নিজের পাণ্ডিত্য রাখেন।
১৮৭২ সালের মার্চ মাসে র্যাঁবো শার্লভিলে ফিরে আসেন। এই সময়ে তিনি Last Verses গ্রন্থটি রচনা করেন। এই কাব্যগ্রন্থটি তৎকালীন সময়ে কবিতার উপর নীরিক্ষারূপে সাহিত্য সমাজে আদৃত হয়। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে কবিতাগুলোতে ভেরলেঁর কবিতার রূপে খানিকটা সজ্জিত হয়েছিল। ভেরলেঁর কবিতা মানেই সেখানে একটি মিষ্টি সজীবতা, নিঃসঙ্গতা এবং একই সঙ্গে বিচিত্র চরিত্রের সমাবেশ ঘটে। কিন্তু র্যাঁবো তাঁর কবিতাকে ভাঙতে যেয়ে বিভিন্ন ধরনের নীরিক্ষার আশ্রয় নেন। ‘লাস্ট ভার্সেস’ কবিতায় প্রচুর পরিমাণ নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করতে করেন। যারা ফলাফল কবিতায় সংগীত এবং বাস্তব কারিগরি ভাষা এক হয়ে নতুন এক মূর্ততা লাভ। তিনি কবিতায় প্রচুর পরিমাণে পৌরাণিক গাঁথা, সংগীত এবং ধর্মীয় ভাবনা এবং চিন্তার প্রবেশ ঘটান। তখন কবিতার শরীরে নতুন আরেক ভাষার জন্ম লাভ করে।
মানুষের আত্মায় লুক্কায়িত অশরীরী তৃষ্ণাকে জাগ্রত করতে র্যাঁবোর জুড়ি নেই। একজন ব্যক্তি কীভাবে নিজ আত্মাকে সমাজ থেকে বিযুক্ত করে এবং নিজের অস্তিত্বকে মুক্তি দিয়ে জীবনের নতুন আরেক স্বাদ নিতে পারেন ‘ঝড়’ কবিতাটি তার উজ্জ্বল ?উদাহরণ। ব্যক্তিবোধ যখন নিজ থেকে স্বাধীন হতে পারে তখন সেখানে জীবন ভিন্নভাবে রচিত হতে পারে। তার ‘আমি’ কবিতাটি থেকে ঠিক তেমন একটি দৃশ্যই খুঁজে পাই। একজন ব্যক্তি কীভাবে তার পারিপার্শিক অবস্থার শিকার হয়ে নিজের আত্মাকে বিসর্জন দিতে পারে, ‘আমি’ ঠিক সেই ধরনের কবিতা। র্যাঁবোর ‘আকাক্সক্ষা’ কবিতাটির কথাও এখানে উচ্চারিত হতে পারে। বিশেষ করে ব্যাক্তিমানসে আকাক্সক্ষা যখন লোভে পরিণত হয় এবং লোভ যখন মৃতের সাথে বন্ধুত্ব করে তখন সেখানে আকাংখার মৃত্যু ঘটে। তবে একজন ব্যক্তি যতক্ষণ পর্যন্ত নিজের ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করতে পারে ততক্ষণ পর্যন্ত জীবন বেঁচে থাকে। তাঁর ‘উচ্চ মিনারের গান” কবিতায় জীবনের তেমন স্বাদটি পাওয়া যায়। সেখানে কবি জীবন সংগীতকে গুরুত্ব দিয়েছেন বেশি। জীবন একটা সংগীতের মতো। যেখানে জীবনের সুউচ্চ মিনারে এই সংগীত নিত্যই বাজতে থাকে। এই সংগীত থেকে তৈরি হয় জীবনতৃষ্ণা। তৃষ্ণা ছাড়া জীবন অচল। জীবন তৃষ্ণার অনবদ্য আবেদন তখন জীবনের সুউচ্চ মিনারে বাজতে থাকে। র্যাঁবোর রোমান্স কবিতাটিতে যেন ঠিক সেই মূর্ছনা ধরা পড়ে।
“জুনের সুন্দর বিকেলে লেবু গাছগুলোর অসাধারণ ঘ্রাণ ভেসে আসে
চোখের পাতা বন্ধ করলে বাতাস কখনো কখনো হালকা মনে হয়,
শব্দে আচ্ছাদিত বাতাস-শহর খুব বেশি দূরে নয়Ñ
শিরায় ভাসছে সেই সুগন্ধ আর বিয়ারের সুঘ্রাণ...”
কবি এবং প্রেমিক পল ভেরলেঁ র্যাঁবোকে ১৮৭২ সালের মে মাসে প্যারিসে আবার ডেকে নিয়ে আসেন এবং জুলাই মাসে তিনি তাঁর স্ত্রী এবং পুত্রকে রেখে র্যাঁবোকে সঙ্গে নিয়ে লন্ডন বেড়াতে যান। ১৮৭৩ সালের এপ্রিল মাসে র্যাঁবো আবার তার গ্রাম শার্লভিলে ফিরে আসেন এবং তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ A season in hell (নরকে এক ঋতু) কাব্যগ্রন্থ লেখায় আত্মমগ্ন হন। ১৮৭৩ সালে তিনি আবার পল ভেরলেঁর সঙ্গে লন্ডন চলে যান। সেখান থেকে তারা দুজনেই ব্রাসেলস ভ্রমণ করেন। জানা যায় সেখানে ভেরলেঁর সঙ্গে র্যাঁবোর সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে। একদিন মাতাল অবস্থায় ব্রাসেলসের একটি হোটেল কক্ষে ভেরলেঁ ক্ষিপ্ত হয়ে র্যাঁবোকে গুলি করেন। র্যাঁবো গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন এবং ভারলেঁর সঙ্গে তার সম্পর্ক অবনতি ঘটে। ভেরলেঁকে শাস্তি হিসেবে বেলজিয়াম জেলখানায় দুবছর জেল খাটতে হয়। র্যাঁবো আবার তাঁর নিজের গ্রামে ফিরে আসেন। গ্রামে এসেই র্যাঁবো আবার তাঁর ‘নরকে এক ঋতু’ কাব্যগ্রন্থটি লিখতে ব্যাস্ত হয়ে ওঠেন। অনেক সাহিত্য সমালোচকদের মতে, র্যাঁবোর “নরকে এক ঋতু” তাঁর শ্রেষ্ঠ একটি কাজ। “একদা এক জীবন ছিল” কাব্যে র্যাঁবো লিখছেন, “একদিন সন্ধ্যায় সুন্দরকে কোলে বসিয়েছিলাম। সে বিব্রতÑ দেখি তাকে আমি করেছি আহত। ন্যায়ের বিরুদ্ধে আমি দাঁড়ালাম।” বেশ বোঝা যায় র্যাঁবোর আত্মায় তখন চলছে অন্যরকম এক কাটাকাটি।
র্যাঁবোর মনজগৎে নতুন আরেক সত্তা দোল খেতে শুরু করে। নজেকে পুনরাবিষ্কারে তিনি তখন চরম ব্যাস্ত। নিজের অন্তরত্মার চামড়া উপড়ে ফেলে সেখানে নতুন আরেক চামড়া বসিয়ে ভিন্ন মানুষ হওয়ার চেষ্টা করলেন তিনি। এই খোলস পরিবর্তন শুধু মানুষের বাহ্যিকভাবেই ঘটেনা, মনোজগতেও ঘটে বৈকি! কবি আর্তুর র্যাঁবো এই বিষয়টি নিয়ে ভাবতে শুরু করেন। অনেকেই মনে করেন র্যাঁবোর এই গ্রন্থে মূলত সাহিত্য থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়ার বার্তাটিই যেন প্রেরণ করেছিলেন। র্যাঁবে তখনো নতুন পথে হাঁটার চেষ্টায় ব্যাস্ত। অনেকে সাহিত্য সমালোচকদের দৃষ্টিতে এই কাব্যগ্রন্থটি তাঁর নিজের জীবনের সংগীত ছাড়া আর কিছুই নয়। ‘অসম্ভব’ কবিতায় তিনি লিখেছেন, “হে আমার আত্মা। সাবধানে থেকো। আকস্মিক মোক্ষকরর্মীদের মতো কোন হটকারী সিদ্ধন্তে পৌঁছে যেয়ো না।”
র্যাঁবো তাঁর মাকে ‘নরকে এক ঋতু’ গ্রন্থটি প্রকাশ করতে অনুরোধ করেন। ১৮৭৩ সালে গ্রন্থটি ব্রাসেলসে প্রকাশিত হয়। র্যাঁবোর এটিই একমাত্র গ্রন্থ যা তিনি নিজের পয়সা খরচ করে প্রকাশ করেন। কবিতাগুলো ছিল গদ্য কবিতার ধাঁচে লেখা। কবিতাগুলো নয় ভাগে বিভক্ত। কবিতায় নিজের স্বগতোক্তি যেমন “একদা, যদি আমার স্মৃতিগুলো সজীব থাকে”, “খারাপ রক্ত”, “নরকের রাত”, “বোকা কুমার”, “আলোর উৎসব”, “বিদায়” শব্দগুলো কাব্যগ্রন্থের চুম্বক অর্থ বহন করে। কেউ কেউ এই শব্দগুলোতে র্যাঁবোর জীবনের বিষণœতার সুরটিকে দেখতে পান। সাহিত্য সমালোচক বার্নার্ড ম্যাথিওর মতে, ‘নরকে এক ঋতু’ কাব্যগ্রন্থটি হেঁয়ালিমূলক একটি কাব্যগ্রন্থ। গ্রন্থটি লেখক এবং অন্যদের মধ্যে অসাধারণ মানসিক বিকারগ্রস্ত সংলাপ ছাড়া কিছুই নয়। র্যাঁবো একই সঙ্গে দুটো কণ্ঠকেই তাঁর কবিতায় আবিষ্কার করেছেন। দুটো আলাদা সত্তাকে তিনি এক করেছেন। সন্দেহ নেই র্যাঁবোর উপর বোদলেয়ায়েরর প্রচ্ছন্ন একটি প্রভাবকেও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ‘নরকে এক ঋতু’ গ্রন্থে তিনি লিখছেন, “যুক্তির মধ্য দিয়ে পুনর্জন্ম আমার। চমৎকার এই পৃথিবী। জীবনকে করে যাবো আশীর্বাদ। ভালোবাসবো যারা আমার ভাই। শিশুময় প্রতিশ্রুতিগুলো এখন আর আমার নাই। বুড়ো বয়সে মৃতু্যুকে এড়িয়ে থাকবার আশাও নেই। আমাকে ক্ষমতা দিয়েছেন ইশ্বর। আমি ঈশ্বরের বন্দনা করি।”
আবার অনেক কবিতা সমালোচক মনে করেন Les Illuminations র্যাঁবোর সবচেয়ে শক্তিশালি কাজ। এই কাব্যগ্রন্থের বস্তুগততভাবকে উপজীব্য করে লেখা তাঁর কবিতাগুলো নতুন এক ভাবনার সূচনা করে বৈকি! বিশেষ করে এই বিশ্বের শিশু ভাবনাটাকে তিনি কবি এবং কবিতার ভাবনায় নতুন একটি ব্যাঞ্জনা তৈরি করেছেন। কবিতার ভাষায় নতুন রূপ তৈরি লক্ষ্য করা যায় তার এই কাব্যগ্রন্থে। কাব্যগ্রন্থের কিছু কবিতা যেমন Morning of Drunkenness, Barbaric, Devotion কবিতাগুলো কবিতার ইতিহাসে নতুন একটি ধারা তৈরি করতে বাধ্য। বিভিন্নভাবেই কবিতাগুলো আলোচিত এবং সমালোচিত হয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন কবিতাগুলো নির্দিষ্ট কোনো ফরমেটকেই মেনে চলে নি। আবার কেউ মনে করেন র্যাঁবোর কবিতা যেন একেকটি রূপকথার গল্প। যে গল্পগুলো প্রাণে দাগ কাটে বটে কিন্তু বাস্তব মনে হয় না। এই কাব্যগ্রন্থটিতে একটি শিশুর চোখ দিয়ে বিশ্বকে দেখা যায়। যে বিশ্ব অনেকটাই অদেখা এবং রূপকথার মতোই। তাঁর কাব্যগ্রন্থটিতে সংকলিত ভোর কবিতাটির কয়েকটা লাইন।
“জড়িয়ে ধরি গ্রীষ্মের ভোর। প্রাসাদগুলো এখনও সাড়া শব্দ নেই। মৃত জল। ছায়ারা এখনও অরণ্যপথে ক্যাম্প করে আছে। হাঁটছি, উষ্ণ নিঃশ্বাস নিচ্ছি, ঝলমলে রতœ...” অথবা “লরেল বনের ধারে রাস্তায় আমি তাকে আচ্ছাদিত করি। আমি তার অপরিমেয় শরীরটাকে টের পাই। ভোর ও শিশু বনের ধারে পড়ে যায়। জেগে উঠে দেখি দুপুর।” (অনুবাদটি র্যাঁবোর উপর উইকিপিডিয়া থেকে নেওয়া হয়েছে)
র্যাঁবো তাঁর জীবনে মাত্র ৫ বছর কবিতা লিখেছেন। ১৮৭৫ সাল থেকে ১৮৭৬ সাল পর্যন্ত র্যাঁবো ইংল্যান্ড, জার্মানি, ইটালি এবং হল্যান্ড ভ্রমণ করেন। কর্মক্ষেত্রে বিভিন্ন জায়গায় তিনি নিজেকে জড়িয়ে ছড়িয়ে ছিলেন। ডাচ সেনাবাহিনীতে নিজের নাম লিখিয়েছিলেন। ১৮৭৬ সালে ভিয়েনায় স্থায়ী হয়েছিলেন তারপর সেখান থেকে মিশর, জাভা এবং সাইপ্রাস ভ্রমন করেন। তখন পেশাগতভাবে তিনি ফোরম্যানের কাজ করতেন। ১৮৮০ সালে তিনি ফ্রান্সে কফি ব্যাবসায়ীর পক্ষ হয়ে ইথিওপিয়া গিয়েছিলেন। র্যাঁবা সেখানে কফি ব্যাবসার প্রসারে নিজেকে নিবেদন করেছিলেন। কবিতা থেকে বিযুক্ত হয়ে র্যাঁবো দীর্ঘদিন কফির ব্যাবসায় নিজেকে ব্যস্ত রেখেছিলেন। সেই সময়ে কবি হিশেবে র্যাঁবো তত বিখ্যাত হয়ে ওঠেননি। ঠিক তখন সেই সময়ই পল ভেরলেঁই তাঁর কাব্যগ্রন্থে The Accursed Poets: Tristan Corbière; Arthur Rimbaud; Stéphane Mallarmé) প্রকশিত হয়। সেটি ছিল ১৮৮৪ সাল। ১৮৯১ সালে র্যাঁবোর হাঁটুতে টিউমার ধরা পড়ে। তিনি ফ্রান্সে চিকিৎসার জন্যে ফিরে আসেন। মারসেইলে হাসপাতালে তাঁর পা কাটা হয়। তিনি তাঁর গ্রামের বাড়ি রচিতে ফিরে যান কিন্তু তার স্বাস্থ্য অবনতি ঘটে। ১৮৯১ সালে ১০ নভেম্বর র্যাঁবোর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালীন তাঁর বোন ইসাবেলে পাশে ছিলেন। শার্লভিলে তাঁর কবর দেওয়া হয।
মাত্র ৩৭ বছরের জীবন ছিল তাঁর। ‘রোমান্স’ কবিতায় সেই সুরটিই যেন ধরা পড়ে। মনে হয় কবিতার শব্দগুলো বুঝি কবি নিজের জন্যেই লিখেছিলেন?
“যখন তুমি সতের তখন তুমি মোটেও হিশেবি ছিলে না।
এক সুন্দর সন্ধ্যায় তুমি পেয়েছিলে যথেষ্ট পরিমাণে বিয়ার আর লেমোনেড।
ঝলসানো আলোকোজ্জ্বল হৈচৈ ভরা কাফেতে
তুমি তখন সবুজ লেবুতলা দিয়ে বিহার করতে হেঁটে বেড়াও।”
জন্মমাসে জন্মদিনের শুভেচ্ছা র্যাঁবো।
আদনান সৈয়দ
বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪
সন্দেহ নেই আর্তুর র্যাঁবোর? জীবন বিচিত্র এবং ছন্নছাড়া। এই বিচিত্র জীবনবোধের ছাপ তাঁর কাব্য জগতে পড়বে এই স্বাভাবিক। খুব বেশি সময় তিনি পৃথিবীতে বাঁচেননি। কিন্তু তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনভ্রমণে তিনি কাব্যপ্রেমীদের জন্যে রেখে গেছেন বিচিত্র জগতের তৃষ্ণার্ত কাব্যের সন্ধান। সে কারণেই র্যাঁবোকে কাব্য সমাজের এক অন্য মাত্রার কবি হিশেবে বিবেচনা করা হয়। বিচিত্র জীবন বীক্ষণে একজন প্রতীকবাদী কবি হিসেবে রাঁবোর ভূমিকা বিরল।
সন্দেহ নেই র্যাঁবোর কাব্যজীবন এবং দর্শন তাঁর সমসাময়িক অন্য কবিদের থেকে ছিল একটু ভিন্ন এবং চমকপ্রদ। বিশেষ করে তাঁর কবিতার মূল সুর হলো স্বাধীন, কাল্পনিক এবং স্বতঃস্ফূর্ত। কবিতা মানেই কল্পনার আশ্রয় নেওয়া কিন্তু র্যাঁবো সেই কল্পনাকে আশ্রয় নিয়েছেন তাঁর নির্মিত প্রতীকী ভাষাকে অবলম্বন করে। আর সে কারণেই র্যাঁবো তাঁর কবিতায় আমাদের পরিচয় করিয়ে দেন নতুন আবার অচেনা এক প্রতীকী জগতের সঙ্গে। যে জগত আমাদের চেনা কিন্তু আবার অচেনাও। যে জগতে আমরা নিত্য বসবাস করি অথচ যেন সেই জগতটাকে ঠিকমত দেখতে পাই না। এই জগতকে আমরা আবিষ্কার করি আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয়গুলো কাজে লাগিয়ে। এই ইন্দ্রিয়জাত অবস্থানকে ব্যাখা আর প্রকাশ করতে আমাদের দ্বারস্থ হয় প্রতীকী ভাষার। কারণ প্রতীকী ভাষা ছাড়া এই কাব্যের অন্তর্নিহীত ভাব প্রবেশ করা সম্ভব নয়।
ফরাসি কবিতা তো বটেই পৃথিবীর যে কোনো ভাষার কবিতাতেই র্যাঁবোর কাব্যভাবানার প্রচ্ছন্ন একটি ছাপ লক্ষ্য করা যায়। শুধু কবিতার নতুন গঠন শৈলি নয়, বরং কবিতায় নতুন ভাবনা সৃষ্টিতে র্যাঁবোর কোনো জুড়ি নেই। কবিতায় অধিবাস্তবাদী আন্দোলনে কবি আঁদ্রে ব্রিটন থেকে আঁদ্রে ফ্রেয়দসহ যেসব কবি এই মতবাদকে বেগবান করেছিলেন তারা সবাই কোনো না কোনোভাবে র্যাঁবোর ভাবধারায় আচ্ছন্ন হয়েছিলেন। সে কারণে র্যাঁবাকে বলা হয় ফরাসি কবিতার উনিশ দশকের অন্যতম প্রধান গুরুত্বপূর্ণ কবি। কবিতায় প্রতীকীভাব ফুটিয়ে শব্দকে নতুন এক মাত্রায় তুলে ধরতে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। কবিতার বিভিন্ন দিক নিয়ে কাজ করার পাশাপাশি তিনি অনুবাদ নিয়েও কাজ করেন। ইংরেজ কবি সেমুয়েল বেকেট এবং জন এ্যাসবেরি ব্যাঁবোর কবিতায় তিনি অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন।
জ্যাঁ নিকোলাস আর্তুর র্যাঁবোর জন্ম অক্টবোর ২০, ১৮৫৪ সালে ফ্রান্সের দক্ষিণ-পূর্বে শার্লভিল গ্রামে। বাবা ফ্রেডরিক র্যাঁবো ছিলেন সেনাবাহিনীর ক্যাপটেন। মার নাম ম্যেরি ক্যাথারিন ভিতালি। র্যাঁবোর বড় ভাই ফ্যাডরিক-এর জন্ম ১৯৫৩ সালে। তাঁর ছিল দুই বোন। ভিতালি (জন্ম ১৮৫৮) এবং ইসাবেলে (জন্ম ১৮৬০)। র্যাঁবোর ছেলেবেলাকালীন বাবার অনুপস্থিতি তাঁর জীবনকে নিঃসঙ্গ করে রেখেছিল। এই নিঃসঙ্গ জীবনের নানা রকম মানসিক যন্ত্রণা পরবর্তীতে তাঁর কবিতায় বিভিন্নভাবে ফুটে ওঠে। বিশেষ করে তাঁর (The Seven-Year-Old Poets, 1871) গ্রন্থের পাতায় সেই নিঃসঙ্গতার ছাপ সুস্পষ্ট। র্যাঁবোর মা ছিলেন গোড়া খ্রিস্টানধর্মালম্বী। তিনি গভীরভাবে ধর্মকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকায় বিশ্বাসী ছিলেন। এই বিষয়টিও র্যাঁবোর ছেলেবেলার ওপর প্রভাব ফেলেছিল। জানা যায় মা’র কড়া শাসনের কারণে র্যাঁবোকে সেই ছেলেবেলাতেই বাইবেল মুখস্থ করতে হয়েছিল অনেকটা বাধ্য হয়েই। ধর্মের প্রতি র্যাঁবোর বিদ্বেষ তৈরি হয় সেই তখন থেকেই। সে কারণেই হয়তো লিখেছিলেন, “ধর্ম খুব মারাত্মক এক বিষয়”।
কবি র্যাঁবোর কবিতা নিয়ে কথা বলতে হলে তাঁর ব্যক্তি জীবনের নানা ঘটনার উপরও কিঞ্চিৎ আলো আলো ফেলা জরুরি। কারণ র্যাঁবোর জীবনের অনেক ঘটনাই তাঁর কবিতায় বিভিন্ন সুরে বেজে উঠেছে এবং কাব্যমোদিদের অন্তরে জায়গা তৈরি করে নিয়েছে। ১৮৭০ সালে র্যাঁবো তাঁর বাড়ি থেকে তিনবার পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। বিশেষ করে ফ্রানকো-প্রুশিয়ান যুদ্ধের পরবর্তী অস্থির সময়গুলোতে র্যাঁবো মানসিকভাবে ছিলেন বিপর্যস্ত। তিনি তাঁর স্কুল-কলেজের গতানুগতিক শিক্ষার ইতি টেনেছিলেন তখনই। ১৮৭০ সালে তিনি প্যারিস চলে যান এবং বিনা টিকেটে রেল ভ্রমণের অপরাধে গ্রেফতার হন এবং তাকে জেলে পাঠানো হয়। মাস ছয়েক জেল খাটার পর র্যাঁবোকে তাঁর মা ছাড়িয়ে নিয়ে আসেন এবং আবার এক সঙ্গে থাকা শুরু করেন। ১৮৭১ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে র্যাঁবো আবার বাড়ি থেকে পালান এবং প্যারিসের একটি বিপ্লবী দলের সঙ্গে যোগ দেন। এই সময়টায় তার জীবনে নতুন আরেকটি মোড় নেয়। মনোজগতে তাঁর তখন চলতে থাকে কবিতা নিয়ে নানা রকম কাটাকাটি। বিশেষ করে কবিতার রূপরস নিয়ে তখন তিনি মেতে ওঠেন। কবিতার বিভিন্ন কাঠামো নিয়ে তিনি কাজ করতে শুরু করেন। জীবন বাস্তবতায় কবিতার অবস্থান নিয়ে তিনি ভাবতে শুরু করেন। কবিতা যে জীবনের অন্যান্য আনুষঙ্গিক বাস্তবতার রূপ তা তিনি তাঁর কাব্যসূত্রে নিয়ে আসেন। মে ১৩, ১৮৭১ সালে র্যাঁবো কবিতা নিয়ে এই নতুন ভাবনাগুলো তাঁর বন্ধু এবং শিক্ষক জর্জ ইজমবার্ডকে চিঠি লিখেন। মে ১৫, ১৮৭১ সালে তাঁর আরেক বন্ধু পল দিমেনিকেও তিনি একটি চিঠি লিখেন। র্যাঁবোর এই চিঠিটি পড়ে তাকে প্যারিসে আমন্ত্রণ জানানো হয়। র্যাঁরবো ঠিক তখনই ফরাসি জনপ্রিয় কবি পল ভেরলেঁর সঙ্গে পরিচিত হন। ১৮৭১ সালে তিনি কবি ভ্যারলেঁ এবং তার স্ত্রী মেথিলদের সঙ্গে বসবাস শুরু করতে থাকেন। ঠিক তখনেই ভ্যারলেঁ-এর সঙ্গে র্যাঁবোর একটি রোমান্টিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সেই সঙ্গে ভেরলেঁর ব্যক্তি জীবনে ঝামেলা শুরু হতে থাকে।
র্যাঁবোর প্রথম দিকের কবিতা Poésies লেখা হয়েছিল ১৮৬৯ এবং ১৮৭২ সালের মধ্যে। ১৮৯৫ সালে কবিতাগুলো গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেন তাঁর প্রাক্তন প্রেমিক পল ভেরলেঁ। কারিগরি জীবনবোধকে কাজে লাগিয়ে কবিতাগুলো ছিল মৌলিক ভাবধারায় লেখা। এই কবিতাগুলো পরবর্তীতে নতুন একটি ধারার দিকে প্রবাহিত হতে শুরু করে। কবিতার ভাষার নতুনত্ব, দৃষ্টিভঙ্গি এবং ভাবনার বৈচিত্র্য দিয়ে কবিতাগুলো ছিল আচ্ছন্ন। চলুন এবার কাব্যগ্রন্থটির ভেতরে প্রবেশ করি। তাঁর ‘শয়তান’ এবং ‘উপতক্যায় নিদ্রা’ দুটো কবিতাই যুদ্ধের বিভিষিকার চিত্র বিমূর্ত হয়ে ফুটে উঠেছে। ‘টারটাফের সাজা’ কবিতাটি মানুষের দ্বৈত সংঘাতের উপর লিখিত অসাধারণ একটি সনেট। ‘সবুজ সরাইখানায়’, ‘ধূর্ত একসময়’ এবং ‘আমার বোহেমিয়ান অস্তিত্ব’ এই তিনটি কবিতাতেই মানুষের বহেমিয়ান জীবনের ছবি ফুটে উঠেছে। একদিকে জীবন বাস্তবতা অন্যদিকে ‘হোমলেস মাইন্ড’-এর আর্তি। ‘সংগীতের প্রতি’ কবিতাটি একজন মানুষের চোখ দিয়ে দেখা যাপিত জীবনের আখ্যান। জীবনের সংগীতটি তিনি তাঁর কবিতার শব্দে ধারণ করেছিলেন। জীবনের বিভিন্ন তরঙ্গ প্রবাহগুলো র্যাঁবো তির্যক এবং প্রতীকীভাবে দেখতে পেয়েছিলেন। সেই জীবনের পরতে পরতে ধরা পড়েছিল মানুষের নানা রঙের মুখ ও মুখোশ। “একজন ভীত” কবিতায় জীবককে কার্টুনের সঙ্গে তুলনা করে রঙ্গ তামাশায় ভরিয়ে ?তুলেছিলেন র্যাঁবো। কবিতাটি পড়লে মানুষের বিচিত্র গঠন চোখের সামনে যেন দুলে ওঠে। এই রঙ্গরসিকতা কখনো হাস্যকর পর্যায়ে পৌঁছালেও শেষ পর্যন্ত তা যেন অবিকল মানুষের ছবি হয়েই ফুটে উঠেছে। তার “সন্ধ্যার প্রার্থনা” কবিতাটি এই দিক থেকে কিছুটা ব্যতিক্রম, সন্দেহ নেই। কেউ কেউ বলে থাকেন কবিতাটা প্রচলিত ধর্ম বিরোধী একটি কবিতা। এই কবিতায় তিনি আচ্ছামত ধর্মবিশ্বাসীদের ব্যাঙ্গ করতে ভুলে যাননি। কবিতায় তিনি নিজেই একজন বিধ্বংসী ফেরেস্তার রূপ ধারণ করে আবির্ভূত হয়েছেন। আকাশমুখি হয়ে তিনি তাঁর স্রষ্টার বিরুদ্ধে প্রতীকী ভাষায় প্রতিবাদ করেছেন।
চড়ল্কংরবং গ্রন্থে কবিতাকে নিয়ে এক দুঃসাহসিক অভিযাত্রী র্যাঁবো। এই সাহস তাঁর পূর্ববর্তী কবি বোদলেয়ার ছাড়া খুব কম কবিই দেখাতে পেয়েছিলেন। র্যাঁবো কবিতার শব্দ দিয়ে সেই সাহসিক অভিযানে যাত্রা শুরু করেছিলেন। কী ছিল সেই সাহসের মূল মন্ত্র! তাঁর কবিতা দিয়ে ধর্মীয় গোড়ামি থেকে মুক্ত হয়ে সাহসী এবং স্বতঃস্ফূর্ত জীবনের নির্যাসকে কবিতার ভাষায় ফুটিয়ে তুলেছিলেন। সেই সঙ্গে কবিতার নতুনত্বও আরেকটি প্রধান বিষয়। যাদুবাস্তবতা, প্রতীকী শব্দ, কল্পচিত্র এবং পাশাপাশি কবিতায় আধুনিকায়নে র্যঁবো তাঁর কবিতায় নতুন একটি ধারা তৈরি করেন। পরবর্তীতে আমরা দেখতে পাই চড়ল্কংরবং সংকলিত প্রতিটি কবিতাই র্যঁবোর পরবর্তী জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভাবনা হিসেবে কাজ করেছে। বিশেষ করে বিংশ এবং একবিংশ সময়ের কবিতা আন্দোলনেও তাঁর এই কবিতাগুলো অগ্রগণ্য।
র্যাঁবো তাঁর কবিতায় প্রতীকী ভাষা দিয়ে এমন কিছু শব্দচয়ন করেছেন যা তৎকালীন সময়ে অনেকের মতেই কাম্য ছিল না। ত্রিস্তা জাঁরা কবিতায় ডাডা মতবাদ দিয়ে ব্যাক্তিমানুষের চিন্তা এবং শক্তিকে পুঁজি করে কবিতায় যে নতুন ধারা তৈরি করেছিলেন র্যাঁবো যেন ঠিক সেই পথেও খানিকটা হেঁটেছিলেন। খানিক পথ এ কারণেই বলছি যে, তিনি ত্রিস্তা জাঁরার পথ থেকে খানিকটা সরে যেয়ে কবিতার রূপকে আরো বেশি প্রতীকী করে তুলতে পেরেছিলেন। সন্দেহ নেই তাঁর কবিতার এই নির্মাণশিল্প ছিল গতানুগতিক কবিতা নির্মাণের ধারার বাইরে। যে শব্দগুলো সমাজ বর্জন করে, যা সমাজে কর্তৃক অনুমোদিত নয় সেই বিষয়গুলোকেও তিনি কবিতায় তুলে আনেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে। তিনি কবিতার মাধ্যমে এই ধারণাটি দিয়েছেন যে, কবিতার শব্দগুলো মানুষের বিচিত্র ভাবনার খোরাক ছাড়া আর কিছুই নয়। অতএব জীবনকে আলিঙ্গন করতে হলে পরিপূর্ণভাবে জীবনের গোটা চিত্রই কবিতায় তুলে নিয়ে আসতে হবে। তাছাড়া যে ধর্মীয় ভাবনা এবং সামাজিক আচার মানুষকে নিজেদের প্রকৃতগত পথ থেকে দূরে সরে রাখতে বাধ্য করে তিনি সেই ধর্মীয় অনাচারের বিরুদ্ধেও কবিতায় প্রতিবাদী ছিলেন।
র্যঁবোর অনেক চিঠিপত্রে তাঁর চড়ল্কংরবং কাব্যসংকলন নিয়ে অনেক উচ্চাশা এবং ধারণার চালাচালি লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ করে কবিতার শব্দ এবং কবিতাকে আত্মায় ধারণ করতে হলে প্রতীকী ভাষার আশ্রয় নেওয়া নিয়ে তিনি অনেক তার সমসামিয়কদের সঙ্গে চিঠি চালাচালি করেন। মে ১৫, ১৮৭১ সালে বন্ধু ডেমিনিকে লেখা এক চিঠিতে র্যাঁবো তাঁর সেই আকাংখার কথা তুলে ধরেন। বিশেষ করে ফরাসি কবিতার বাঁক এবং নতুন কিছু ধারণা নিয়ে তিনি এই চিঠিতে তাঁর মতামত রাখেন। জ্যাঁ রাসিনের রোমান্টিক জগৎ থেকে শুরু করে শার্ল বোদলেয়ারের কবিতার প্রতীক মূর্তকে তিনি ব্যাখা করেন। এদিকে র্যাঁবোর কবিতায় আরো একজন ফরাসি কবি এবং দার্শনিক আচ্ছন্ন হয়েছিলেন এবং বিশেষভাবে আলোড়িত হয়েছিলেন তিনি হলেন কবি পল ভ্যালেরি। ভ্যালেরি ছিলেন র্যাঁবোর Vowel Sonnet কবিতার ভক্ত। পরবর্তীতে ভ্যালেরি ফরাসি কবিতার নতুন বাঁক নির্মাণে নিজের পাণ্ডিত্য রাখেন।
১৮৭২ সালের মার্চ মাসে র্যাঁবো শার্লভিলে ফিরে আসেন। এই সময়ে তিনি Last Verses গ্রন্থটি রচনা করেন। এই কাব্যগ্রন্থটি তৎকালীন সময়ে কবিতার উপর নীরিক্ষারূপে সাহিত্য সমাজে আদৃত হয়। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে কবিতাগুলোতে ভেরলেঁর কবিতার রূপে খানিকটা সজ্জিত হয়েছিল। ভেরলেঁর কবিতা মানেই সেখানে একটি মিষ্টি সজীবতা, নিঃসঙ্গতা এবং একই সঙ্গে বিচিত্র চরিত্রের সমাবেশ ঘটে। কিন্তু র্যাঁবো তাঁর কবিতাকে ভাঙতে যেয়ে বিভিন্ন ধরনের নীরিক্ষার আশ্রয় নেন। ‘লাস্ট ভার্সেস’ কবিতায় প্রচুর পরিমাণ নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করতে করেন। যারা ফলাফল কবিতায় সংগীত এবং বাস্তব কারিগরি ভাষা এক হয়ে নতুন এক মূর্ততা লাভ। তিনি কবিতায় প্রচুর পরিমাণে পৌরাণিক গাঁথা, সংগীত এবং ধর্মীয় ভাবনা এবং চিন্তার প্রবেশ ঘটান। তখন কবিতার শরীরে নতুন আরেক ভাষার জন্ম লাভ করে।
মানুষের আত্মায় লুক্কায়িত অশরীরী তৃষ্ণাকে জাগ্রত করতে র্যাঁবোর জুড়ি নেই। একজন ব্যক্তি কীভাবে নিজ আত্মাকে সমাজ থেকে বিযুক্ত করে এবং নিজের অস্তিত্বকে মুক্তি দিয়ে জীবনের নতুন আরেক স্বাদ নিতে পারেন ‘ঝড়’ কবিতাটি তার উজ্জ্বল ?উদাহরণ। ব্যক্তিবোধ যখন নিজ থেকে স্বাধীন হতে পারে তখন সেখানে জীবন ভিন্নভাবে রচিত হতে পারে। তার ‘আমি’ কবিতাটি থেকে ঠিক তেমন একটি দৃশ্যই খুঁজে পাই। একজন ব্যক্তি কীভাবে তার পারিপার্শিক অবস্থার শিকার হয়ে নিজের আত্মাকে বিসর্জন দিতে পারে, ‘আমি’ ঠিক সেই ধরনের কবিতা। র্যাঁবোর ‘আকাক্সক্ষা’ কবিতাটির কথাও এখানে উচ্চারিত হতে পারে। বিশেষ করে ব্যাক্তিমানসে আকাক্সক্ষা যখন লোভে পরিণত হয় এবং লোভ যখন মৃতের সাথে বন্ধুত্ব করে তখন সেখানে আকাংখার মৃত্যু ঘটে। তবে একজন ব্যক্তি যতক্ষণ পর্যন্ত নিজের ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করতে পারে ততক্ষণ পর্যন্ত জীবন বেঁচে থাকে। তাঁর ‘উচ্চ মিনারের গান” কবিতায় জীবনের তেমন স্বাদটি পাওয়া যায়। সেখানে কবি জীবন সংগীতকে গুরুত্ব দিয়েছেন বেশি। জীবন একটা সংগীতের মতো। যেখানে জীবনের সুউচ্চ মিনারে এই সংগীত নিত্যই বাজতে থাকে। এই সংগীত থেকে তৈরি হয় জীবনতৃষ্ণা। তৃষ্ণা ছাড়া জীবন অচল। জীবন তৃষ্ণার অনবদ্য আবেদন তখন জীবনের সুউচ্চ মিনারে বাজতে থাকে। র্যাঁবোর রোমান্স কবিতাটিতে যেন ঠিক সেই মূর্ছনা ধরা পড়ে।
“জুনের সুন্দর বিকেলে লেবু গাছগুলোর অসাধারণ ঘ্রাণ ভেসে আসে
চোখের পাতা বন্ধ করলে বাতাস কখনো কখনো হালকা মনে হয়,
শব্দে আচ্ছাদিত বাতাস-শহর খুব বেশি দূরে নয়Ñ
শিরায় ভাসছে সেই সুগন্ধ আর বিয়ারের সুঘ্রাণ...”
কবি এবং প্রেমিক পল ভেরলেঁ র্যাঁবোকে ১৮৭২ সালের মে মাসে প্যারিসে আবার ডেকে নিয়ে আসেন এবং জুলাই মাসে তিনি তাঁর স্ত্রী এবং পুত্রকে রেখে র্যাঁবোকে সঙ্গে নিয়ে লন্ডন বেড়াতে যান। ১৮৭৩ সালের এপ্রিল মাসে র্যাঁবো আবার তার গ্রাম শার্লভিলে ফিরে আসেন এবং তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ A season in hell (নরকে এক ঋতু) কাব্যগ্রন্থ লেখায় আত্মমগ্ন হন। ১৮৭৩ সালে তিনি আবার পল ভেরলেঁর সঙ্গে লন্ডন চলে যান। সেখান থেকে তারা দুজনেই ব্রাসেলস ভ্রমণ করেন। জানা যায় সেখানে ভেরলেঁর সঙ্গে র্যাঁবোর সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে। একদিন মাতাল অবস্থায় ব্রাসেলসের একটি হোটেল কক্ষে ভেরলেঁ ক্ষিপ্ত হয়ে র্যাঁবোকে গুলি করেন। র্যাঁবো গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন এবং ভারলেঁর সঙ্গে তার সম্পর্ক অবনতি ঘটে। ভেরলেঁকে শাস্তি হিসেবে বেলজিয়াম জেলখানায় দুবছর জেল খাটতে হয়। র্যাঁবো আবার তাঁর নিজের গ্রামে ফিরে আসেন। গ্রামে এসেই র্যাঁবো আবার তাঁর ‘নরকে এক ঋতু’ কাব্যগ্রন্থটি লিখতে ব্যাস্ত হয়ে ওঠেন। অনেক সাহিত্য সমালোচকদের মতে, র্যাঁবোর “নরকে এক ঋতু” তাঁর শ্রেষ্ঠ একটি কাজ। “একদা এক জীবন ছিল” কাব্যে র্যাঁবো লিখছেন, “একদিন সন্ধ্যায় সুন্দরকে কোলে বসিয়েছিলাম। সে বিব্রতÑ দেখি তাকে আমি করেছি আহত। ন্যায়ের বিরুদ্ধে আমি দাঁড়ালাম।” বেশ বোঝা যায় র্যাঁবোর আত্মায় তখন চলছে অন্যরকম এক কাটাকাটি।
র্যাঁবোর মনজগৎে নতুন আরেক সত্তা দোল খেতে শুরু করে। নজেকে পুনরাবিষ্কারে তিনি তখন চরম ব্যাস্ত। নিজের অন্তরত্মার চামড়া উপড়ে ফেলে সেখানে নতুন আরেক চামড়া বসিয়ে ভিন্ন মানুষ হওয়ার চেষ্টা করলেন তিনি। এই খোলস পরিবর্তন শুধু মানুষের বাহ্যিকভাবেই ঘটেনা, মনোজগতেও ঘটে বৈকি! কবি আর্তুর র্যাঁবো এই বিষয়টি নিয়ে ভাবতে শুরু করেন। অনেকেই মনে করেন র্যাঁবোর এই গ্রন্থে মূলত সাহিত্য থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়ার বার্তাটিই যেন প্রেরণ করেছিলেন। র্যাঁবে তখনো নতুন পথে হাঁটার চেষ্টায় ব্যাস্ত। অনেকে সাহিত্য সমালোচকদের দৃষ্টিতে এই কাব্যগ্রন্থটি তাঁর নিজের জীবনের সংগীত ছাড়া আর কিছুই নয়। ‘অসম্ভব’ কবিতায় তিনি লিখেছেন, “হে আমার আত্মা। সাবধানে থেকো। আকস্মিক মোক্ষকরর্মীদের মতো কোন হটকারী সিদ্ধন্তে পৌঁছে যেয়ো না।”
র্যাঁবো তাঁর মাকে ‘নরকে এক ঋতু’ গ্রন্থটি প্রকাশ করতে অনুরোধ করেন। ১৮৭৩ সালে গ্রন্থটি ব্রাসেলসে প্রকাশিত হয়। র্যাঁবোর এটিই একমাত্র গ্রন্থ যা তিনি নিজের পয়সা খরচ করে প্রকাশ করেন। কবিতাগুলো ছিল গদ্য কবিতার ধাঁচে লেখা। কবিতাগুলো নয় ভাগে বিভক্ত। কবিতায় নিজের স্বগতোক্তি যেমন “একদা, যদি আমার স্মৃতিগুলো সজীব থাকে”, “খারাপ রক্ত”, “নরকের রাত”, “বোকা কুমার”, “আলোর উৎসব”, “বিদায়” শব্দগুলো কাব্যগ্রন্থের চুম্বক অর্থ বহন করে। কেউ কেউ এই শব্দগুলোতে র্যাঁবোর জীবনের বিষণœতার সুরটিকে দেখতে পান। সাহিত্য সমালোচক বার্নার্ড ম্যাথিওর মতে, ‘নরকে এক ঋতু’ কাব্যগ্রন্থটি হেঁয়ালিমূলক একটি কাব্যগ্রন্থ। গ্রন্থটি লেখক এবং অন্যদের মধ্যে অসাধারণ মানসিক বিকারগ্রস্ত সংলাপ ছাড়া কিছুই নয়। র্যাঁবো একই সঙ্গে দুটো কণ্ঠকেই তাঁর কবিতায় আবিষ্কার করেছেন। দুটো আলাদা সত্তাকে তিনি এক করেছেন। সন্দেহ নেই র্যাঁবোর উপর বোদলেয়ায়েরর প্রচ্ছন্ন একটি প্রভাবকেও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ‘নরকে এক ঋতু’ গ্রন্থে তিনি লিখছেন, “যুক্তির মধ্য দিয়ে পুনর্জন্ম আমার। চমৎকার এই পৃথিবী। জীবনকে করে যাবো আশীর্বাদ। ভালোবাসবো যারা আমার ভাই। শিশুময় প্রতিশ্রুতিগুলো এখন আর আমার নাই। বুড়ো বয়সে মৃতু্যুকে এড়িয়ে থাকবার আশাও নেই। আমাকে ক্ষমতা দিয়েছেন ইশ্বর। আমি ঈশ্বরের বন্দনা করি।”
আবার অনেক কবিতা সমালোচক মনে করেন Les Illuminations র্যাঁবোর সবচেয়ে শক্তিশালি কাজ। এই কাব্যগ্রন্থের বস্তুগততভাবকে উপজীব্য করে লেখা তাঁর কবিতাগুলো নতুন এক ভাবনার সূচনা করে বৈকি! বিশেষ করে এই বিশ্বের শিশু ভাবনাটাকে তিনি কবি এবং কবিতার ভাবনায় নতুন একটি ব্যাঞ্জনা তৈরি করেছেন। কবিতার ভাষায় নতুন রূপ তৈরি লক্ষ্য করা যায় তার এই কাব্যগ্রন্থে। কাব্যগ্রন্থের কিছু কবিতা যেমন Morning of Drunkenness, Barbaric, Devotion কবিতাগুলো কবিতার ইতিহাসে নতুন একটি ধারা তৈরি করতে বাধ্য। বিভিন্নভাবেই কবিতাগুলো আলোচিত এবং সমালোচিত হয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন কবিতাগুলো নির্দিষ্ট কোনো ফরমেটকেই মেনে চলে নি। আবার কেউ মনে করেন র্যাঁবোর কবিতা যেন একেকটি রূপকথার গল্প। যে গল্পগুলো প্রাণে দাগ কাটে বটে কিন্তু বাস্তব মনে হয় না। এই কাব্যগ্রন্থটিতে একটি শিশুর চোখ দিয়ে বিশ্বকে দেখা যায়। যে বিশ্ব অনেকটাই অদেখা এবং রূপকথার মতোই। তাঁর কাব্যগ্রন্থটিতে সংকলিত ভোর কবিতাটির কয়েকটা লাইন।
“জড়িয়ে ধরি গ্রীষ্মের ভোর। প্রাসাদগুলো এখনও সাড়া শব্দ নেই। মৃত জল। ছায়ারা এখনও অরণ্যপথে ক্যাম্প করে আছে। হাঁটছি, উষ্ণ নিঃশ্বাস নিচ্ছি, ঝলমলে রতœ...” অথবা “লরেল বনের ধারে রাস্তায় আমি তাকে আচ্ছাদিত করি। আমি তার অপরিমেয় শরীরটাকে টের পাই। ভোর ও শিশু বনের ধারে পড়ে যায়। জেগে উঠে দেখি দুপুর।” (অনুবাদটি র্যাঁবোর উপর উইকিপিডিয়া থেকে নেওয়া হয়েছে)
র্যাঁবো তাঁর জীবনে মাত্র ৫ বছর কবিতা লিখেছেন। ১৮৭৫ সাল থেকে ১৮৭৬ সাল পর্যন্ত র্যাঁবো ইংল্যান্ড, জার্মানি, ইটালি এবং হল্যান্ড ভ্রমণ করেন। কর্মক্ষেত্রে বিভিন্ন জায়গায় তিনি নিজেকে জড়িয়ে ছড়িয়ে ছিলেন। ডাচ সেনাবাহিনীতে নিজের নাম লিখিয়েছিলেন। ১৮৭৬ সালে ভিয়েনায় স্থায়ী হয়েছিলেন তারপর সেখান থেকে মিশর, জাভা এবং সাইপ্রাস ভ্রমন করেন। তখন পেশাগতভাবে তিনি ফোরম্যানের কাজ করতেন। ১৮৮০ সালে তিনি ফ্রান্সে কফি ব্যাবসায়ীর পক্ষ হয়ে ইথিওপিয়া গিয়েছিলেন। র্যাঁবা সেখানে কফি ব্যাবসার প্রসারে নিজেকে নিবেদন করেছিলেন। কবিতা থেকে বিযুক্ত হয়ে র্যাঁবো দীর্ঘদিন কফির ব্যাবসায় নিজেকে ব্যস্ত রেখেছিলেন। সেই সময়ে কবি হিশেবে র্যাঁবো তত বিখ্যাত হয়ে ওঠেননি। ঠিক তখন সেই সময়ই পল ভেরলেঁই তাঁর কাব্যগ্রন্থে The Accursed Poets: Tristan Corbière; Arthur Rimbaud; Stéphane Mallarmé) প্রকশিত হয়। সেটি ছিল ১৮৮৪ সাল। ১৮৯১ সালে র্যাঁবোর হাঁটুতে টিউমার ধরা পড়ে। তিনি ফ্রান্সে চিকিৎসার জন্যে ফিরে আসেন। মারসেইলে হাসপাতালে তাঁর পা কাটা হয়। তিনি তাঁর গ্রামের বাড়ি রচিতে ফিরে যান কিন্তু তার স্বাস্থ্য অবনতি ঘটে। ১৮৯১ সালে ১০ নভেম্বর র্যাঁবোর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালীন তাঁর বোন ইসাবেলে পাশে ছিলেন। শার্লভিলে তাঁর কবর দেওয়া হয।
মাত্র ৩৭ বছরের জীবন ছিল তাঁর। ‘রোমান্স’ কবিতায় সেই সুরটিই যেন ধরা পড়ে। মনে হয় কবিতার শব্দগুলো বুঝি কবি নিজের জন্যেই লিখেছিলেন?
“যখন তুমি সতের তখন তুমি মোটেও হিশেবি ছিলে না।
এক সুন্দর সন্ধ্যায় তুমি পেয়েছিলে যথেষ্ট পরিমাণে বিয়ার আর লেমোনেড।
ঝলসানো আলোকোজ্জ্বল হৈচৈ ভরা কাফেতে
তুমি তখন সবুজ লেবুতলা দিয়ে বিহার করতে হেঁটে বেড়াও।”
জন্মমাসে জন্মদিনের শুভেচ্ছা র্যাঁবো।