মনিরুস সালেহীন
আমাদের বন্ধু বহলুল আসাদ। অনেক দিন পরে ওর সাথে দেখা। অফিসের কাজে এসেছি অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে। খুব ব্যস্ত সময় যাচ্ছে। তারপরও সময় করে এসেছি আজ ওর সাথে দেখা করতে। ও বারবার টেলিফোন করে বলেছে কোনোভাবেই যেন তার সাথে দেখা না করে দেশে না ফিরি।
এই আসাদের কথা মনে হলেই আমার মনে পড়ে একটা কথা। আসাদের উইটি একটা জবাব। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে পাশাপাশি রুমে ছিলাম। অনার্স পরীক্ষা শেষ না হতেই আসাদ প্রস্তুত হচ্ছিল বিসিএসের জন্য। একদিন ওর রুমে গিয়ে দেখি ও গভীর মনোযোগের সাথে ঝুঁকে আছে টেবিলের উপর মেলানো একটি বইয়ের ওপর। উঁকি দিয়ে দেখিÑ ক্লাস নাইন টেনের পাটীগণিত বইয়ের মেইড ইজি, মানে নোট বই। অংকে একদম গবেট না হলে কেউ অংকের নোটবই পড়ে নাÑ এমন একটা ধারণা নিয়েই স্কুল কলেজ ডিঙিয়েছি। তাই অর্থনীতিতে অনার্স পড়া আসাদের টেবিলে মাধ্যমিকের গণিতের নোটবই দেখে আমি যারপরনাই বিস্মিত হই। সেই বিস্ময় এতটুকু গোপন না করে আসাদকে জিজ্ঞেস করি, এ কী, তুমি নোট বই দেখে ক্লাস নাইনের অংক প্র্যাকটিস করছো! ভেবেছিলাম আমার কথায় আসাদ হয়তো একটু বিব্রত হবে। কিন্তু ও একটুও বিব্রত না হয়ে আমাকে জবাব দিয়েছিল, আসলে প্র্যাকটিস করছি না, নোটবইয়ে কোনো ভুল আছে কিনা সেটা দেখছি। আমি ওর এই তাৎক্ষণিক উইটি জবাব কোনদিন ভুলতে পারিনি।
আসাদের কথা মনে হতেই মনে হয়েছে এক অসাধারণ রেডি উইট ছিল আসাদ।
আসাদ প্রাবসী হয়েছে অনেক দিন। মাঝেমধ্যে কথা হয় মেসেঞ্জারে। ও দেশেআসলে কথা হয়েছে তার প্রবাস জীবন নিয়ে। আগে বলতো ওর প্রতিষ্ঠার গল্প, কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে দেখা হলেই তার দুঃখের ঝাঁপি, তার জীবন সংগ্রাম আর অনেক কিছু না পাওয়ার বেদনাÑ সবকিছু উগরে দেয় আমার মত দু’য়েকজন বন্ধুর কাছে। মনোযোগী শ্রোতা হয়ে ওর কথা শুনেছি, কখনো মনে হয়েছে আসলেই জীবন আসাদকে অনেকটাই বঞ্চিত করেছে।
সেই কবে পিআর নিয়ে সস্ত্রীক অস্ট্রেলিয়ায় এসেছিল আসাদ। পরপর দুই সন্তানের বাবা হয়েছে। প্রবাস জীবনের বছর পাঁচেকের মধ্যেই কীভাবে যেন স্ত্রী-সন্তানের সাথে আসাদের বন্ধন ঢিলে হতে শুরু করে। আসাদের কথা শুনলে মনে হয় ওর কোনো দোষ নেই, সব দোষ ওর স্ত্রীর, আমাদের সোনিয়া ভাবির।
বিয়ের পর একবারই দেখা হয়েছিল ভাবির সাথে। আমি আর সোহান গিয়েছিলাম ওদের বিয়ের দু’য়েক দিন পর। বেশ হাসিখুশিই মনে হয়েছিল ভাবিকে। হালকা কথাবার্তার এক পর্যায়ে আমাদের বন্ধুটিকে কেমন লাগছে জিজ্ঞেস করলে সোনিয়া ভাবি একটু ম্লান হেসে বলেছিলেন, “আপনাদের হ্যান্ডসাম বন্ধু। ওনাকে ভালো না লেগে পারে! কিন্তু আপনাদের বন্ধুটির তো মনে হয় মনের মতো বউ হয়নি!” আসাদের উপস্থিতিতেই কথা হয়েছিল। অপ্রিয় প্রসঙ্গ ভেবে আমরা আর কথা বাড়াইনি। প্রথমে আলাদা থাকা। তারপর আইন আদালত করে পাকাপাকি ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে স্ত্রীর সাথে। এ প্রসঙ্গে আসাদ একবার বলেছিল ভাবি নাকি তার ওপর প্রতিশোধ নিয়েছে। কী সেই প্রতিশোধ জানতে চাইলে আসাদ বলেছিল, বিয়ের প্রথম রাত্রিতেই দারুণ এক ভুল করেছিল সে। বিশ্ববিদ্যালয় পেরিয়ে একটা কলেজে চাকরির সুবিধার জন্য পরিবারের ইচ্ছাতেই বিয়ে করেছিল সোনিয়া ভাবিকে। বিয়েটা তার নিজের পছন্দে হয়নিÑ এমন একটা কথা নাকি সে অকপটে জানিয়েছিল বিয়ের প্রথম রাতেই। আসাদের এই কথাটা ভাবিকে কতটুকু আহত করেছিল তখনও বোঝেনি সে।
শুরুতে অস্ট্রেলিয়ায় এসে অন্য সব বাঙালি গৃহবধূর মতো ঘরকন্না করেছে সোনিয়া ভাবি। তারপর শুরুতে অড জব করলেও পরে ভদ্রলোকের গোছের চাকরি জুটিয়ে নিয়েছেন তিনি। দু’জন মিলে নিজেদের নামে বাড়ি করেছেন।
সোনিয়া ভাবি স্বাবলম্বী হয়ে উঠতেই নাকি ভাবি আস্তে আস্তে সরে যাওয়া শুরু করেছেন আসাদের কাছ থেকে। সাথে নিয়েছেন তাদের দুই সন্তান। এক সময় ভাবি তার বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছেনÑ স্বামী বা পিতা হিসেবে যথেষ্ট দায়িত্ব পালন করছে না আসাদ। এই কথাটা শুধু নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, অল্প অল্প করে পুলিশের কাছেও গিয়েছে। এসবই আসাদের বয়ান। ভাবির সাথে এসব বিষয়ে কখনো কোনো কথা হয়নি আমার। ইন ফ্যাক্ট, সেই প্রথমবারের দেখা হওয়ার পর তার সাথে দেখাও হয়নি।
আমি বুঝতে পারি আসাদ কখনোই ধোঁয়া তুলসী পাতা ছিল না। অনুমান করি ভাবির সাথে তার এই দাম্পত্য কলহের সময় সে হয়তো স্ত্রীর গায়ে হাতও তুলেছে। অস্ট্রেলিয়ার মতো জায়গায় মুখ বুজে সবকিছু সহ্য করার মত সাধারণ মহিলা ছিলেন না আসাদের স্ত্রী। থানা পুলিশ আর আইন আদালত করে তিনি আসাদকে সরিয়ে দিয়েছেন তার বাসা থেকে। আসাদের বাড়িও নাকি হাতছাড়া হয়েছে সন্তানের ভরণপোষণের নামে।
আসাদ বলেছে সে অনেকভাবে চেষ্টা করেছে স্ত্রী পুত্রের সান্নিধ্য পাওয়ার, তাদের সাথে একসাথে থাকার কিন্তু তার স্ত্রী রাজি হননি। বারবার দোহাই দিয়েছেন যে আসাদ তার বা তার সন্তানের জন্য নিরাপদ নয়। আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী সন্তানের পড়ালেখার খরচ আসাদকে দিতে হয়েছে। যদিও তাদের সাথে তার দেখা হওয়ার সুযোগ তেমন মিলেইনি।
ভালো চাকরিই জুটিয়েছিল আসাদ। তাই নিজের অর্থকড়ির তেমন অসুবিধা হয়নি। অর্থ এসেছে।পরিবারের সাথে বিচ্ছিন্ন থেকে অর্থ দিয়ে ক্ষণিক সঙ্গ, সঙ্গম কিনেছে কখনো কখনো। কিন্তু বঞ্চিত থেকেছে পরিবার-পুত্রের সান্নিধ্য থেকে। একসময় সে একাকী জীবনে বেছে নিয়েছে স্লট মেশিনে টাকা ওড়ানোর নেশা।
সিডনিতে আমার কাজের অবসরে আসাদের লাকামবার ফ্ল্যাটের ডোরবেল বাজাতেই বেরিয়ে এসে আসাদ তার স্বভাবসুলভ হাসি দিয়ে আমাকে হাত ধরে ভেতরে নিয়ে যায়। একজন সিঙ্গেল মানুষের ঘরবাড়ি যে রকম থাকার কথা তেমনি আছে, হয়তো আরেকটু বেশি অগোছালো।
আমি বসতে না বসতেই কেমন আছি, কী করছি, কত দিনের জন্য এসেছিÑ ঝাঁক বেঁধে এসব প্রশ্ন ছুঁড়ে নিজের অস্থিরতার জানান দেয় আসাদ।
আমার জন্য ব্ল্যাক কফি বানিয়ে এনে বলে, “আপাতত কফিটা এখানেই খাই। তারপর ডিনার বাইরে গিয়ে সারা যাবে।” বাইরের ঝকমকে যে দিনটা পেরিয়ে এখানে এসেছি, সেটি যেন আসাদের এখানে এসে ক্লান্ত, ম্লান হয়ে গেছে। অথচ, ইউনির হলে আমাদের আড্ডায় আসাদ মানেই ছিল ব্ল্যাক কফির চনমনে ভাব।
অল্প কথায় নিজের খবরাখবর জানাই আমি। জানতে চাই আসাদ কেমন আছে, কী করছে, কেমন চলছে সবকিছু। আসাদ বিভিন্ন কথা বলে যা জানায় একথায় তা হচ্ছে সে ভালো নেই। বলে, সে আরো বেশি একা হয়েছে। জানায় প্রতিপদেই সে ঠকেছে। মুখের স্বভাবসুলভ হাসিটা ধরে রেখেই বলে, যেন প্রতিনিয়ত ঠকাটা আনন্দেরই। আমি পরিবেশ হালকা করার জন্য বলি, “স্লট মেশিনের ঠকানোটা কি কমেছে?”
-আরে, কী যে বলো, ওটা প্রায় ছেড়েই দিয়েছি।
‘প্রায় ছেড়ে দিয়েছি’ শুনে আমি মনে মনে হাসি। কথা প্রসঙ্গে বলিÑ
-বিদেশ-বিভুইঁয়ে এই বয়সে একা একা থাকো। নিয়মিত শারীরিক এক্সারসাইজ, যোগ ব্যায়াম, ধর্মকর্ম তো কিছু করতে পারো। এতে অনেক ভালো থাকা যায়।
-রাখো ওসব। ওসবে আমার কিছু হবে না। ওপরওয়ালা কেউ থাকলে আর তার কাছে ন্যায় বিচার থাকলে কি আর বার বার এতো বিপদে পড়ি!
আমি আসাদকে সান্ত¡না দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করি মানুষের অনেক কষ্ট হয়, অনেক বিপদেও পড়ে। তারপরও যদি খুব নিরপেক্ষভাবে বিচার করে তাহলে দেখা যাবে জীবন তাকে অনেক কিছু দিয়েছে। এ জন্য কৃতজ্ঞ হওয়া দরকার। কৃতজ্ঞতা কষ্টের বোঝা লাঘব করে।
আসাদ জানায় এখন তার ঘাড়ে অনেক আর্থিক বোঝা। এক বন্ধুর পরামর্শের সে দুটো বাড়ি কিনেছিল। একটা মেলবোর্নে, আরেকটা সিডনিতে, দূরের একটা সাভার্বে। এগুলোর ঋণের কিস্তি চুকাতে এখন তাকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। বলি, “এখন তোমার বউবাচ্চা নেই, কোনো পিছুটান নেই। কার জন্য তুমি জীবনকে এত বেশি কমপ্লিকেটেড করে ফেলেছো? একটু সহজ করে বাঁচার চেষ্টা করো। দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।”
আসাদ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। আমার কথায় সায় দিয়ে বলে, “তুমি ঠিকই বলেছো। আসলেই অনেক বেশি কমপ্লিকেটেড করে ফেলেছি। এখন ভাবছি কীভাবে এটাকে একটু সহজ সরল করা যায়।”
আমি ওকে কিছু বুদ্ধি-পরামর্শ দিই। মনে হয় আমার সব কথায় সায় দেয়। ওর কথায় কখনো খুব কষ্ট ঝরে পড়ে। ওর জন্য আমার খারাপ লাগে। পরিবার পরিজন ছাড়া ওর একাকী থাকার কষ্ট আমাকে ছুঁয়ে যায়। আমি বলি, “আচ্ছা তোমার তো ভবিষ্যতের কোনো ধান্ধা এখানে আর নেই। দেশে গিয়ে কেন থাকো না? তোমার যতটুকু সঞ্চয় আছে দেশে গিয়ে যদি ঠিকমতো তা বিনিয়োগ করো তাহলে বাকি জীবন বেশ ভালোভাবে কাটাতে পারবে।”
আসাদ মনে হয় নিজেও একথা ভেবেছে।আমার কথায় সাথে সাথে সায় দিয়ে বলেÑ
-ঠিক বলেছো। আমিও এরকমটি ভাবছি। আমি এখানকার সিটিজেন। এখানে নিয়ম আছে যদি রিটায়ার করে বছরের ছয় মাস দেশেও থাকি তাহলেও এখানকার রিটায়ারমেন্ট বেনিফিট পেতে অসুবিধা হবে না। কিন্তু আবার ভাবি ওখানেই বা কে আমাকে সঙ্গ দেবে। সবাই তো ব্যস্ত। দেশে কি আর ভিন্ন কিছু হবে?
আমি আসাদকে আশ্বাস দিই।
-ওখানে তোমার পুরনো বন্ধুবান্ধব পাবে, মাটির গন্ধ পাবে। হয়তো এখানকার মতো পাবেনা হাতের কাছে ডাক্তার, দূষণমুক্ত বাতাস, এটা সেটা। কিন্তু মানসিক স্বস্তিটা হয়তো পেতে পারো। এখানে তোমার স্ত্রী বা পুত্রদের সাথে এতটুকু সম্পর্ক থাকলে আমি তোমাকে দেশে ফিরে যেতে বলতাম না।
-কী বলবো তোমাকে। কিছুদিন আগে বড় ছেলের বিয়ে হয়েছে। আমাকে খবরটা পর্যন্ত দেয়নি। আমি নিজে থেকেই গিয়েছিলাম ওদের কাছে। ও আমাকে সাথে সাথে বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে বলেছে। বিশ্বাস করবে না, সাথে সাথে পুলিশে কল করতে উদ্যত হয়েছে। কী আর করবো, নতুন করে পুলিশের হাঙ্গামায় না জড়িয়ে আমি তাড়া খাওয়া কুকুরের মত ফিরে এসেছি।
লক্ষ করি আসাদের চোখ চিক চিকচিক করছে। অতি সভ্য দেশে থাকে বলেই হয়তো আবেগ সংযত করতে শিখেছে।
আসাদের অসহায়ত্ব দেখে আমি বিভিন্নভাবে ওকে চাঙ্গা করার চেষ্টা করি। বলি, ইউনিতে তুমি শুধু হ্যান্ডসামই ছিলে না, কী স্মার্ট ছিলে। আসাদ, তোমার মনে পড়ে সেই অংক বই সংশোধনের কথা?
আসাদ ম্লান হাসে। বলে, আর বলো না। এখন তো নিজের জীবনের অংকই পুরো গড়বড় করে ফেলেছি। জানো প্রায়ই স্বপ্নে দেখি, পরীক্ষার হলে একটা সিঁড়ি ভাঙা সরল অংক করছি, যেটার ফল ১ বা শূন্য হওয়ার কথা, কিন্তু স্বপ্নে দেখি কী কিম্ভূতকিমাকার ফল আসছে।
আমি আসাদকে বোঝাই, “তোমার জীবন তোমার। তুমিই তো বলোÑ ভাবি অলরেডি অন্য একজনকে বিয়ে করেছে। মানে অই সম্পর্ক শেষ। আর দুই সন্তানের সাথে জন্মদাতার সম্পর্ক রাখতে তুমি চেষ্টার কোনো ত্রুটি করোনি। জানি, রক্তের টান অনেক গভীর। কিন্তু তা কখনো এক তরফা হয়না। তুমি বরং অতীত ঝেড়ে ফেল। আর পিছুটান রেখো না। কী হয়নি, কী পাওনি, পরিবারের বঞ্চনাÑ এসব ভেবে কোনো লাভ নেই। এতে তোমার ক্ষতিই হবে, এতটুকু ভালো হবে না। বরং নিজের কথা ভাবো। বাকিটা জীবন কীভাবে ভালো থাকবে, সুস্থ থাকবে সে চিন্তা করো।”
আমার যুক্তির পক্ষে নিজেই যোগ করে আরো কিছু।
আসাদের সাথে প্রায় ঠিকই হয়ে যায় যে আসাদনতুন করে সব শুরু করবে। দেশে ফিরবে। আমি ওকে যতটুকু পারি বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করবো। ও বার বার আমার কাছ থেকে কথা আদায় করে নেয় যে আমি ওকে সাহায্য করবো। বলে, “জীবনে এত ঠকেছি যে আর কাউকে বিশ্বাস করতে পারি না। বাট তোমাকে এখনো বিশ্বাস করি।”
আমি আবারও কথা দেই দেশে আমার পক্ষে ওর জন্য যতটুকু সহযোগিতা করার দরকার আমি করবো।
হঠাৎ করে আসাদের মোবাইল বেজে ওঠে। অনিচ্ছায় সে মোবাইলের দিকে হাত বাড়াতে বাড়াতে বলে, “এ সময় আবার কার ফোন?”
তারপর স্ক্রিনে তাকিয়ে বলে, “স্ট্রেঞ্জ, আমার ছোট ছেলে! দাঁড়াও এক মিনিট।”
একটু সরে গিয়ে আসাদ কথা বলে। আমি শুধু ওর জবাবই শুনি। ‘হ্যাঁ, গিয়েছিলাম তোমার মা’র কাছে।... আরে কী বলে, এটা ট্রেসপাস হবে কেন?... হ্যাঁ, তা আছে, আদালতের নিষেধ আছে তোমার মায়ের কাছে যাওয়ার... সরি।...আসলে তোমাদের সাথে কত দিন দেখা হয় না... ভাবলাম, যাই, কী আর হবে, একটু ঘুরে আসি... যদি দেখা হয়... আচ্ছা আর যাবো না... তুমিই আসবে? শিওর?... কবে?.. আমার প্রপার্টির বিষয়...? ...হ্যাঁ, হোমলোনের কিছু প্রব্লেম তো আছেই... আচ্ছা, আসো তুমি, আলাপ করা যাবে।...
আসাদের গদগদ ভাব আমার চোখ এড়ায় না। ফোন রেখে আমার দিকে তাকিয়ে আসাদ বলে, “আমার ছোট ছেলে সানজিদ। ওই-ই মাঝেমধ্যে খোঁজ নিতো, এখন নেয়। মাকে লুকিয়ে। এবার অনেক দিন পর কল দিলো। বোঝই তো ব্যস্ত থাকে। আর একই শহরে আছি। কোনো না কোনোভাবে হয়তো আমার খবর ঠিকই জেনে যায়। এজন্য...”
ছেলের ফোন পেয়ে আসাদের খুশি রীতিমতো দ্রষ্টব্য। কিছুক্ষণ আগের বিশাল বিষণœতার মেঘ সরিয়ে আসাদের মুখ যেন শরতের সূর্যের মতো আলো ছড়াচ্ছে। ওকে দেখে আমার মায়া হয়। আমি কিছু বলার আগেই ও বলে, “দীপু, ভাবছি, দেশে গিয়ে নতুন আর কী হবে! এখানে ছেলে দুটো আছে। আমি দেশে চলে গেলে আর আমার কিছু হলে এখানকার প্রপার্টি তো বেওয়ারিশ হয়ে সরকারের কাছে চলে যাবে। তারচে’ এখানে থাকলে ছেলেদের জন্য কিছু করা যাবে। তাই দেশে যাওয়া ঠিক হবে না, তুমি কী বলো?”
আমি আসাদের মুখের দিকে তাকাই। আমার কাছে ও যে উত্তর প্রত্যাশা করছে সেটা দিতে ইচ্ছে করছে না। ছেলের সাথে ওর কথা বলার সময় উপরি-শোনা ‘প্রপার্টি’ কথাটা আমার কানে লেগে আছে। আমার সন্দেহ হয় আবারো যে সরল অংকটায় হাত দিয়েছে আসাদ, সেটাও শেষ পর্যন্ত মিলবে না। কিন্তু ওর হঠাৎ জ্বলে ওঠা মুখ দেখে আর কিছু বলতে ইচ্ছা করে না। আর আসাদের অংক আমিই বা মিলাতে যাই কেন। ও-ই মিলাক। প্রয়োজনে অংকের মেডইজি শোধরানোর ছলে
মনিরুস সালেহীন
বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪
আমাদের বন্ধু বহলুল আসাদ। অনেক দিন পরে ওর সাথে দেখা। অফিসের কাজে এসেছি অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে। খুব ব্যস্ত সময় যাচ্ছে। তারপরও সময় করে এসেছি আজ ওর সাথে দেখা করতে। ও বারবার টেলিফোন করে বলেছে কোনোভাবেই যেন তার সাথে দেখা না করে দেশে না ফিরি।
এই আসাদের কথা মনে হলেই আমার মনে পড়ে একটা কথা। আসাদের উইটি একটা জবাব। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে পাশাপাশি রুমে ছিলাম। অনার্স পরীক্ষা শেষ না হতেই আসাদ প্রস্তুত হচ্ছিল বিসিএসের জন্য। একদিন ওর রুমে গিয়ে দেখি ও গভীর মনোযোগের সাথে ঝুঁকে আছে টেবিলের উপর মেলানো একটি বইয়ের ওপর। উঁকি দিয়ে দেখিÑ ক্লাস নাইন টেনের পাটীগণিত বইয়ের মেইড ইজি, মানে নোট বই। অংকে একদম গবেট না হলে কেউ অংকের নোটবই পড়ে নাÑ এমন একটা ধারণা নিয়েই স্কুল কলেজ ডিঙিয়েছি। তাই অর্থনীতিতে অনার্স পড়া আসাদের টেবিলে মাধ্যমিকের গণিতের নোটবই দেখে আমি যারপরনাই বিস্মিত হই। সেই বিস্ময় এতটুকু গোপন না করে আসাদকে জিজ্ঞেস করি, এ কী, তুমি নোট বই দেখে ক্লাস নাইনের অংক প্র্যাকটিস করছো! ভেবেছিলাম আমার কথায় আসাদ হয়তো একটু বিব্রত হবে। কিন্তু ও একটুও বিব্রত না হয়ে আমাকে জবাব দিয়েছিল, আসলে প্র্যাকটিস করছি না, নোটবইয়ে কোনো ভুল আছে কিনা সেটা দেখছি। আমি ওর এই তাৎক্ষণিক উইটি জবাব কোনদিন ভুলতে পারিনি।
আসাদের কথা মনে হতেই মনে হয়েছে এক অসাধারণ রেডি উইট ছিল আসাদ।
আসাদ প্রাবসী হয়েছে অনেক দিন। মাঝেমধ্যে কথা হয় মেসেঞ্জারে। ও দেশেআসলে কথা হয়েছে তার প্রবাস জীবন নিয়ে। আগে বলতো ওর প্রতিষ্ঠার গল্প, কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে দেখা হলেই তার দুঃখের ঝাঁপি, তার জীবন সংগ্রাম আর অনেক কিছু না পাওয়ার বেদনাÑ সবকিছু উগরে দেয় আমার মত দু’য়েকজন বন্ধুর কাছে। মনোযোগী শ্রোতা হয়ে ওর কথা শুনেছি, কখনো মনে হয়েছে আসলেই জীবন আসাদকে অনেকটাই বঞ্চিত করেছে।
সেই কবে পিআর নিয়ে সস্ত্রীক অস্ট্রেলিয়ায় এসেছিল আসাদ। পরপর দুই সন্তানের বাবা হয়েছে। প্রবাস জীবনের বছর পাঁচেকের মধ্যেই কীভাবে যেন স্ত্রী-সন্তানের সাথে আসাদের বন্ধন ঢিলে হতে শুরু করে। আসাদের কথা শুনলে মনে হয় ওর কোনো দোষ নেই, সব দোষ ওর স্ত্রীর, আমাদের সোনিয়া ভাবির।
বিয়ের পর একবারই দেখা হয়েছিল ভাবির সাথে। আমি আর সোহান গিয়েছিলাম ওদের বিয়ের দু’য়েক দিন পর। বেশ হাসিখুশিই মনে হয়েছিল ভাবিকে। হালকা কথাবার্তার এক পর্যায়ে আমাদের বন্ধুটিকে কেমন লাগছে জিজ্ঞেস করলে সোনিয়া ভাবি একটু ম্লান হেসে বলেছিলেন, “আপনাদের হ্যান্ডসাম বন্ধু। ওনাকে ভালো না লেগে পারে! কিন্তু আপনাদের বন্ধুটির তো মনে হয় মনের মতো বউ হয়নি!” আসাদের উপস্থিতিতেই কথা হয়েছিল। অপ্রিয় প্রসঙ্গ ভেবে আমরা আর কথা বাড়াইনি। প্রথমে আলাদা থাকা। তারপর আইন আদালত করে পাকাপাকি ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে স্ত্রীর সাথে। এ প্রসঙ্গে আসাদ একবার বলেছিল ভাবি নাকি তার ওপর প্রতিশোধ নিয়েছে। কী সেই প্রতিশোধ জানতে চাইলে আসাদ বলেছিল, বিয়ের প্রথম রাত্রিতেই দারুণ এক ভুল করেছিল সে। বিশ্ববিদ্যালয় পেরিয়ে একটা কলেজে চাকরির সুবিধার জন্য পরিবারের ইচ্ছাতেই বিয়ে করেছিল সোনিয়া ভাবিকে। বিয়েটা তার নিজের পছন্দে হয়নিÑ এমন একটা কথা নাকি সে অকপটে জানিয়েছিল বিয়ের প্রথম রাতেই। আসাদের এই কথাটা ভাবিকে কতটুকু আহত করেছিল তখনও বোঝেনি সে।
শুরুতে অস্ট্রেলিয়ায় এসে অন্য সব বাঙালি গৃহবধূর মতো ঘরকন্না করেছে সোনিয়া ভাবি। তারপর শুরুতে অড জব করলেও পরে ভদ্রলোকের গোছের চাকরি জুটিয়ে নিয়েছেন তিনি। দু’জন মিলে নিজেদের নামে বাড়ি করেছেন।
সোনিয়া ভাবি স্বাবলম্বী হয়ে উঠতেই নাকি ভাবি আস্তে আস্তে সরে যাওয়া শুরু করেছেন আসাদের কাছ থেকে। সাথে নিয়েছেন তাদের দুই সন্তান। এক সময় ভাবি তার বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছেনÑ স্বামী বা পিতা হিসেবে যথেষ্ট দায়িত্ব পালন করছে না আসাদ। এই কথাটা শুধু নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, অল্প অল্প করে পুলিশের কাছেও গিয়েছে। এসবই আসাদের বয়ান। ভাবির সাথে এসব বিষয়ে কখনো কোনো কথা হয়নি আমার। ইন ফ্যাক্ট, সেই প্রথমবারের দেখা হওয়ার পর তার সাথে দেখাও হয়নি।
আমি বুঝতে পারি আসাদ কখনোই ধোঁয়া তুলসী পাতা ছিল না। অনুমান করি ভাবির সাথে তার এই দাম্পত্য কলহের সময় সে হয়তো স্ত্রীর গায়ে হাতও তুলেছে। অস্ট্রেলিয়ার মতো জায়গায় মুখ বুজে সবকিছু সহ্য করার মত সাধারণ মহিলা ছিলেন না আসাদের স্ত্রী। থানা পুলিশ আর আইন আদালত করে তিনি আসাদকে সরিয়ে দিয়েছেন তার বাসা থেকে। আসাদের বাড়িও নাকি হাতছাড়া হয়েছে সন্তানের ভরণপোষণের নামে।
আসাদ বলেছে সে অনেকভাবে চেষ্টা করেছে স্ত্রী পুত্রের সান্নিধ্য পাওয়ার, তাদের সাথে একসাথে থাকার কিন্তু তার স্ত্রী রাজি হননি। বারবার দোহাই দিয়েছেন যে আসাদ তার বা তার সন্তানের জন্য নিরাপদ নয়। আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী সন্তানের পড়ালেখার খরচ আসাদকে দিতে হয়েছে। যদিও তাদের সাথে তার দেখা হওয়ার সুযোগ তেমন মিলেইনি।
ভালো চাকরিই জুটিয়েছিল আসাদ। তাই নিজের অর্থকড়ির তেমন অসুবিধা হয়নি। অর্থ এসেছে।পরিবারের সাথে বিচ্ছিন্ন থেকে অর্থ দিয়ে ক্ষণিক সঙ্গ, সঙ্গম কিনেছে কখনো কখনো। কিন্তু বঞ্চিত থেকেছে পরিবার-পুত্রের সান্নিধ্য থেকে। একসময় সে একাকী জীবনে বেছে নিয়েছে স্লট মেশিনে টাকা ওড়ানোর নেশা।
সিডনিতে আমার কাজের অবসরে আসাদের লাকামবার ফ্ল্যাটের ডোরবেল বাজাতেই বেরিয়ে এসে আসাদ তার স্বভাবসুলভ হাসি দিয়ে আমাকে হাত ধরে ভেতরে নিয়ে যায়। একজন সিঙ্গেল মানুষের ঘরবাড়ি যে রকম থাকার কথা তেমনি আছে, হয়তো আরেকটু বেশি অগোছালো।
আমি বসতে না বসতেই কেমন আছি, কী করছি, কত দিনের জন্য এসেছিÑ ঝাঁক বেঁধে এসব প্রশ্ন ছুঁড়ে নিজের অস্থিরতার জানান দেয় আসাদ।
আমার জন্য ব্ল্যাক কফি বানিয়ে এনে বলে, “আপাতত কফিটা এখানেই খাই। তারপর ডিনার বাইরে গিয়ে সারা যাবে।” বাইরের ঝকমকে যে দিনটা পেরিয়ে এখানে এসেছি, সেটি যেন আসাদের এখানে এসে ক্লান্ত, ম্লান হয়ে গেছে। অথচ, ইউনির হলে আমাদের আড্ডায় আসাদ মানেই ছিল ব্ল্যাক কফির চনমনে ভাব।
অল্প কথায় নিজের খবরাখবর জানাই আমি। জানতে চাই আসাদ কেমন আছে, কী করছে, কেমন চলছে সবকিছু। আসাদ বিভিন্ন কথা বলে যা জানায় একথায় তা হচ্ছে সে ভালো নেই। বলে, সে আরো বেশি একা হয়েছে। জানায় প্রতিপদেই সে ঠকেছে। মুখের স্বভাবসুলভ হাসিটা ধরে রেখেই বলে, যেন প্রতিনিয়ত ঠকাটা আনন্দেরই। আমি পরিবেশ হালকা করার জন্য বলি, “স্লট মেশিনের ঠকানোটা কি কমেছে?”
-আরে, কী যে বলো, ওটা প্রায় ছেড়েই দিয়েছি।
‘প্রায় ছেড়ে দিয়েছি’ শুনে আমি মনে মনে হাসি। কথা প্রসঙ্গে বলিÑ
-বিদেশ-বিভুইঁয়ে এই বয়সে একা একা থাকো। নিয়মিত শারীরিক এক্সারসাইজ, যোগ ব্যায়াম, ধর্মকর্ম তো কিছু করতে পারো। এতে অনেক ভালো থাকা যায়।
-রাখো ওসব। ওসবে আমার কিছু হবে না। ওপরওয়ালা কেউ থাকলে আর তার কাছে ন্যায় বিচার থাকলে কি আর বার বার এতো বিপদে পড়ি!
আমি আসাদকে সান্ত¡না দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করি মানুষের অনেক কষ্ট হয়, অনেক বিপদেও পড়ে। তারপরও যদি খুব নিরপেক্ষভাবে বিচার করে তাহলে দেখা যাবে জীবন তাকে অনেক কিছু দিয়েছে। এ জন্য কৃতজ্ঞ হওয়া দরকার। কৃতজ্ঞতা কষ্টের বোঝা লাঘব করে।
আসাদ জানায় এখন তার ঘাড়ে অনেক আর্থিক বোঝা। এক বন্ধুর পরামর্শের সে দুটো বাড়ি কিনেছিল। একটা মেলবোর্নে, আরেকটা সিডনিতে, দূরের একটা সাভার্বে। এগুলোর ঋণের কিস্তি চুকাতে এখন তাকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। বলি, “এখন তোমার বউবাচ্চা নেই, কোনো পিছুটান নেই। কার জন্য তুমি জীবনকে এত বেশি কমপ্লিকেটেড করে ফেলেছো? একটু সহজ করে বাঁচার চেষ্টা করো। দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।”
আসাদ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। আমার কথায় সায় দিয়ে বলে, “তুমি ঠিকই বলেছো। আসলেই অনেক বেশি কমপ্লিকেটেড করে ফেলেছি। এখন ভাবছি কীভাবে এটাকে একটু সহজ সরল করা যায়।”
আমি ওকে কিছু বুদ্ধি-পরামর্শ দিই। মনে হয় আমার সব কথায় সায় দেয়। ওর কথায় কখনো খুব কষ্ট ঝরে পড়ে। ওর জন্য আমার খারাপ লাগে। পরিবার পরিজন ছাড়া ওর একাকী থাকার কষ্ট আমাকে ছুঁয়ে যায়। আমি বলি, “আচ্ছা তোমার তো ভবিষ্যতের কোনো ধান্ধা এখানে আর নেই। দেশে গিয়ে কেন থাকো না? তোমার যতটুকু সঞ্চয় আছে দেশে গিয়ে যদি ঠিকমতো তা বিনিয়োগ করো তাহলে বাকি জীবন বেশ ভালোভাবে কাটাতে পারবে।”
আসাদ মনে হয় নিজেও একথা ভেবেছে।আমার কথায় সাথে সাথে সায় দিয়ে বলেÑ
-ঠিক বলেছো। আমিও এরকমটি ভাবছি। আমি এখানকার সিটিজেন। এখানে নিয়ম আছে যদি রিটায়ার করে বছরের ছয় মাস দেশেও থাকি তাহলেও এখানকার রিটায়ারমেন্ট বেনিফিট পেতে অসুবিধা হবে না। কিন্তু আবার ভাবি ওখানেই বা কে আমাকে সঙ্গ দেবে। সবাই তো ব্যস্ত। দেশে কি আর ভিন্ন কিছু হবে?
আমি আসাদকে আশ্বাস দিই।
-ওখানে তোমার পুরনো বন্ধুবান্ধব পাবে, মাটির গন্ধ পাবে। হয়তো এখানকার মতো পাবেনা হাতের কাছে ডাক্তার, দূষণমুক্ত বাতাস, এটা সেটা। কিন্তু মানসিক স্বস্তিটা হয়তো পেতে পারো। এখানে তোমার স্ত্রী বা পুত্রদের সাথে এতটুকু সম্পর্ক থাকলে আমি তোমাকে দেশে ফিরে যেতে বলতাম না।
-কী বলবো তোমাকে। কিছুদিন আগে বড় ছেলের বিয়ে হয়েছে। আমাকে খবরটা পর্যন্ত দেয়নি। আমি নিজে থেকেই গিয়েছিলাম ওদের কাছে। ও আমাকে সাথে সাথে বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে বলেছে। বিশ্বাস করবে না, সাথে সাথে পুলিশে কল করতে উদ্যত হয়েছে। কী আর করবো, নতুন করে পুলিশের হাঙ্গামায় না জড়িয়ে আমি তাড়া খাওয়া কুকুরের মত ফিরে এসেছি।
লক্ষ করি আসাদের চোখ চিক চিকচিক করছে। অতি সভ্য দেশে থাকে বলেই হয়তো আবেগ সংযত করতে শিখেছে।
আসাদের অসহায়ত্ব দেখে আমি বিভিন্নভাবে ওকে চাঙ্গা করার চেষ্টা করি। বলি, ইউনিতে তুমি শুধু হ্যান্ডসামই ছিলে না, কী স্মার্ট ছিলে। আসাদ, তোমার মনে পড়ে সেই অংক বই সংশোধনের কথা?
আসাদ ম্লান হাসে। বলে, আর বলো না। এখন তো নিজের জীবনের অংকই পুরো গড়বড় করে ফেলেছি। জানো প্রায়ই স্বপ্নে দেখি, পরীক্ষার হলে একটা সিঁড়ি ভাঙা সরল অংক করছি, যেটার ফল ১ বা শূন্য হওয়ার কথা, কিন্তু স্বপ্নে দেখি কী কিম্ভূতকিমাকার ফল আসছে।
আমি আসাদকে বোঝাই, “তোমার জীবন তোমার। তুমিই তো বলোÑ ভাবি অলরেডি অন্য একজনকে বিয়ে করেছে। মানে অই সম্পর্ক শেষ। আর দুই সন্তানের সাথে জন্মদাতার সম্পর্ক রাখতে তুমি চেষ্টার কোনো ত্রুটি করোনি। জানি, রক্তের টান অনেক গভীর। কিন্তু তা কখনো এক তরফা হয়না। তুমি বরং অতীত ঝেড়ে ফেল। আর পিছুটান রেখো না। কী হয়নি, কী পাওনি, পরিবারের বঞ্চনাÑ এসব ভেবে কোনো লাভ নেই। এতে তোমার ক্ষতিই হবে, এতটুকু ভালো হবে না। বরং নিজের কথা ভাবো। বাকিটা জীবন কীভাবে ভালো থাকবে, সুস্থ থাকবে সে চিন্তা করো।”
আমার যুক্তির পক্ষে নিজেই যোগ করে আরো কিছু।
আসাদের সাথে প্রায় ঠিকই হয়ে যায় যে আসাদনতুন করে সব শুরু করবে। দেশে ফিরবে। আমি ওকে যতটুকু পারি বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করবো। ও বার বার আমার কাছ থেকে কথা আদায় করে নেয় যে আমি ওকে সাহায্য করবো। বলে, “জীবনে এত ঠকেছি যে আর কাউকে বিশ্বাস করতে পারি না। বাট তোমাকে এখনো বিশ্বাস করি।”
আমি আবারও কথা দেই দেশে আমার পক্ষে ওর জন্য যতটুকু সহযোগিতা করার দরকার আমি করবো।
হঠাৎ করে আসাদের মোবাইল বেজে ওঠে। অনিচ্ছায় সে মোবাইলের দিকে হাত বাড়াতে বাড়াতে বলে, “এ সময় আবার কার ফোন?”
তারপর স্ক্রিনে তাকিয়ে বলে, “স্ট্রেঞ্জ, আমার ছোট ছেলে! দাঁড়াও এক মিনিট।”
একটু সরে গিয়ে আসাদ কথা বলে। আমি শুধু ওর জবাবই শুনি। ‘হ্যাঁ, গিয়েছিলাম তোমার মা’র কাছে।... আরে কী বলে, এটা ট্রেসপাস হবে কেন?... হ্যাঁ, তা আছে, আদালতের নিষেধ আছে তোমার মায়ের কাছে যাওয়ার... সরি।...আসলে তোমাদের সাথে কত দিন দেখা হয় না... ভাবলাম, যাই, কী আর হবে, একটু ঘুরে আসি... যদি দেখা হয়... আচ্ছা আর যাবো না... তুমিই আসবে? শিওর?... কবে?.. আমার প্রপার্টির বিষয়...? ...হ্যাঁ, হোমলোনের কিছু প্রব্লেম তো আছেই... আচ্ছা, আসো তুমি, আলাপ করা যাবে।...
আসাদের গদগদ ভাব আমার চোখ এড়ায় না। ফোন রেখে আমার দিকে তাকিয়ে আসাদ বলে, “আমার ছোট ছেলে সানজিদ। ওই-ই মাঝেমধ্যে খোঁজ নিতো, এখন নেয়। মাকে লুকিয়ে। এবার অনেক দিন পর কল দিলো। বোঝই তো ব্যস্ত থাকে। আর একই শহরে আছি। কোনো না কোনোভাবে হয়তো আমার খবর ঠিকই জেনে যায়। এজন্য...”
ছেলের ফোন পেয়ে আসাদের খুশি রীতিমতো দ্রষ্টব্য। কিছুক্ষণ আগের বিশাল বিষণœতার মেঘ সরিয়ে আসাদের মুখ যেন শরতের সূর্যের মতো আলো ছড়াচ্ছে। ওকে দেখে আমার মায়া হয়। আমি কিছু বলার আগেই ও বলে, “দীপু, ভাবছি, দেশে গিয়ে নতুন আর কী হবে! এখানে ছেলে দুটো আছে। আমি দেশে চলে গেলে আর আমার কিছু হলে এখানকার প্রপার্টি তো বেওয়ারিশ হয়ে সরকারের কাছে চলে যাবে। তারচে’ এখানে থাকলে ছেলেদের জন্য কিছু করা যাবে। তাই দেশে যাওয়া ঠিক হবে না, তুমি কী বলো?”
আমি আসাদের মুখের দিকে তাকাই। আমার কাছে ও যে উত্তর প্রত্যাশা করছে সেটা দিতে ইচ্ছে করছে না। ছেলের সাথে ওর কথা বলার সময় উপরি-শোনা ‘প্রপার্টি’ কথাটা আমার কানে লেগে আছে। আমার সন্দেহ হয় আবারো যে সরল অংকটায় হাত দিয়েছে আসাদ, সেটাও শেষ পর্যন্ত মিলবে না। কিন্তু ওর হঠাৎ জ্বলে ওঠা মুখ দেখে আর কিছু বলতে ইচ্ছা করে না। আর আসাদের অংক আমিই বা মিলাতে যাই কেন। ও-ই মিলাক। প্রয়োজনে অংকের মেডইজি শোধরানোর ছলে